মুসলিম ব্যক্তি আইন

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৪:৩০, ৫ মার্চ ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

মুসলিম ব্যক্তি আইন আরবী মু’আমালাত শব্দের বাংলা সমার্থক শব্দ সামাজিক বিষয়াদি সংক্রান্ত বিধান। মু‘আমালাত অর্থ মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহারিক জীবনবিধান। একজন মানুষ পারিবারিক, ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে যেসব বিধান মেনে চলে সেসবের সমষ্টিকে বলা হয় মু’আমালাত বা সামাজিক আইন। সাধারণ আইন ব্যবস্থার যে শাখাটি ‘ব্যক্তিগত আইন’ বলে বিবেচিত, ইসলামি শরী’আয় সেটিকে বলা হয় ‘সামাজিক আইন’। সুতরাং ‘মুসলিম আইন’ অর্থ মুসলমানদের জন্য ব্যক্তিগত, নাগরিক ও সামজিক আইন।

মুসলিম শরী’আয় আইন বলতে একান্তভাবে ওহী-মারফত প্রেরিত আল্লাহর আদেশ বোঝানো হয়। এটি এমন একটি ঐশী নির্ধারিত ব্যবস্থা যা মুসলিম রাষ্ট্রের দিকনির্দেশনা এবং যা দ্বারা মুসলিম সমাজ নিয়ন্ত্রিত হয়। বাংলাদেশের আদালতসমূহ সকল ক্ষেত্রে মুসলিম আইন প্রয়োগ করে না, শুধু নির্দিষ্ট কতিপয় ক্ষেত্রে করে থাকে। আদালতসমূহ কর্তৃক মুসলিম আইন প্রয়োগের ক্ষমতার উৎস  প্রধানত সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইন, তবে এর কিছু অংশ এসেছে বিধিবদ্ধ আইনসমূহ থেকে। মুসলিম আইনসমূহ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

বাংলাদেশে মুসলিম আইনের বিধানসমূহ প্রয়োগ করা হয় উত্তরাধিকার, জমি ক্রয়াধিকার, দখল, বিবাহ, তালাক, ভরণপোষণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে। মুসলিম আইনশাস্ত্র সম্পর্কে ধারণা পেতে হলে মুসলমান সমাজের বিচারগত ও প্রশাসনিক পদ্ধতির দিকনির্দেশনাসম্বলিত শয়ী‘আ বা সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক প্রদত্ত আইনের লক্ষ্য ও কার্যকারিতার বিশ্লেষণ প্রয়োজন।

নিম্নবর্ণিত আইনসমূহ ইসলামে সামাজিক আইন হিসাবে বিবেচিত: (১) বিবাহ সংক্রান্ত আইন, (২) ভরণপোষণ ও অভিভাবকত্ব সম্পর্কিত আইন, (৩) সম্পত্তির উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আইন, (৪) ওয়াক্ফ ও দাতব্য সংক্রান্ত আইন, এবং (৫) অগ্রক্রয়াধিকার আইন।

বিবাহ সংক্রান্ত আইন যেসকল আইন দ্বারা বৈবাহিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রিত হয় সেগুলোকে বলা হয় বিবাহ আইন; এর বিচার্য বিষয় বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ।

বিবাহ (নিকাহ্)  ইসলামে বিবাহের সঙ্গে আইনগত, সামজিক ও ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয় জড়িত। এটি একটি চুক্তি, যার উদ্দেশ্য নারী-পুরুষের দাম্পত্য সম্পর্ককে আইনগত অনুমতিদান, হেফাজত এবং সন্তানাদির বৈধকরণ (বাইলি-৪, আল-হিদায়া)। বিচারপতি মাহমুদের মতানুসারে, ‘মুসলিম বিবাহ কোনও ধর্মীয় ব্যাপার নয়, বরং সম্পূর্ণরূপে একটি সামাজিক চুক্তি’ (আবদুল কবির বনাম সালেমা (১৮৮৬) ৮, এলাহাবাদ, ১৪৯)। মুসলিম বিবাহের অপরিহার্য শর্তাবলি হচ্ছে বিবাহের প্রস্তাব ও সম্মতি; বৈবাহিক চুক্তি সম্পাদনের সামর্থ্য; দুই জন স্বাক্ষী; অভিন্ন বৈঠকে প্রস্তাব ও সম্মতি উচ্চারণ; কোনও প্রতিবন্ধকহীনতা।

বিবাহের উদ্দেশ্য চারটি: নারী ও পুরুষের যৌনকামনার আইনগত বৈধতাদান এবং যৌনব্যাভিচার থেকে তাদের বিরত রাখা (সুরা নিসা: ২৪); পবিত্র পন্থায় নারী ও পুরুষের স্বাভাবিক ভালবাসা ও আন্তরিকতার চাহিদা পূরণ (সুরা আল রূম: ২১); হেফাজত (সুরা আল শূরা: ১১); এবং (ঘ) পরিবার গঠন (সুরা তাহরীম: ৬)।

যেসব ক্ষেত্রে বিবাহ নিষিদ্ধ এক স্ত্রীলোক কতৃক একই সময়ে একাধিক পতি গ্রহণ; রক্তসম্পর্ক, জ্ঞাতিসম্পর্ক, পালক-সম্পর্ক, পঞ্চম স্ত্রী গ্রহণ, যথাযথ সাক্ষ্যের অনুপস্থিতি, ধর্মীয় পার্থক্য, অবৈধ মিলন, ইদ্দাৎ পালনরতা নারী। পবিত্র কুরআনের বিধান অনুসারে যেসব ব্যক্তির সঙ্গে বিবাহ নিষিদ্ধ তারা হলেন (ক) মা (ও তার সন্তান-সন্ততি), (খ) কন্যা (এবং তার সন্তান-সন্ততি), (গ) বোন, (ঘ) খালা, ফুফু, (ঙ) ভাগিনেয়ী, ভাতিজী, (চ) দুধ মাতা, (ছ) পালক বোন, (জ) শ্বাশুড়ি, (ঝ) একই সময়ে দুই বোন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, একজন মুসলমান পুরুষ একজন ‘কিতাবিয়া নারী’কে (আহ্লে কিতাব) বিবাহ করতে পারে, কিন্তু কোনও মুসলমান নারী কোনও অমুসলিম পুরুষকে বিবাহ করতে পারে না। (15 DLR, SC 9; 103, IC 430; BLD, 1958, Lah 227)

মহর স্ত্রীর প্রতি সম্মানের নিদর্শনস্বরূপ স্বামীকর্তৃক প্রদত্ত সন্মানী। ইসলামী শরী‘আয় বিবাহ একটি আইনগত বন্ধন আর মহর বিবাহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। ইসলামে মহরকে স্বামীর জন্য স্ত্রী মিলন বৈধকরণের সম্মানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আল কুরআনে বলা হয়েছে: তোমরা তোমাদের স্ত্রীগণের নিকট থেকে যে স্বাদ গ্রহণ কর তার জন্য ফরজ হিসাবে তাদের মহর প্রদান কর (সুরা নিসা: ২৪)।

মহরের পরিমাণ  স্বামীর আর্থিক সামর্থ্য ও স্ত্রীর সামাজিক মর্যাদার ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে মহরের যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ [আবদুল রহমান বনাম ইনায়েত বিবি, (৩১), AO 63, 130, IC 113]। মহানবী (সঃ) বলেছেন, ‘মহরের সর্বোত্তম পরিমাণ তাই যা সহজে পরিশোধ করা যায়’ (আবু দাউদ)। হানাফি মতানুসারে মহরের ন্যূনতম পরিমাণ দশ দিরহাম (আল-হিদায়া, বাইলি- ৯২)।

বহুবিবাহ একজন মুসলমান পুরুষ একই সঙ্গে চারজন স্ত্রী রাখতে পারে, কিন্তু তার বেশি নয়। পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১-এর ৬(১) ধারা অনুসারে কোনও ব্যক্তি তার স্ত্রীর উপস্থিতিতে আরবিট্রেশান কাউন্সিলের লিখিত পূর্বানুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিবাহের চুক্তি সম্পাদন করতে পারে না। তবে মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ কোনও পুরুষের স্ত্রী থাকা অবস্থায় অন্য বিবাহকে অবৈধ বা অসিদ্ধ ঘোষণা করেনি। এতে মুসলমান পুরুষদের বহুবিবাহের রীতির ওপর কিছু কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে মাত্র। একজন মুসলমান নারীর ক্ষেত্রে একই সময়ে একাধিক পতিগ্রহণ আইনগতভাবে অবৈধ। শুধু তাই নয়, স্বামী থাকা অবস্থায় যদি কোনও নারী আরও একটি বিবাহ করেন তাহলে দন্ডবিধির ৪৯৪ ধারার অধীনে তিনি দন্ডিত হবেন (143, IC 589)।

তালাক  আরবি শব্দ তালাক-এর যথার্থ পরিভাষা ত্যাজ্য ঘোষণা করা। এর উৎপত্তি এমন একটি প্রত্যয় থেকে যার অর্থ বিবাহের বন্ধন থেকে স্ত্রীকে মুক্তি দেয়া। মুসলিম আইন অনুসারে নিম্নলিখিত পন্থায় বৈবাহিক চুক্তির অবসান ঘটানো যায়:

১. আদালতের হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে স্বামীর দ্বারা তার নিজ ইচ্ছায়; ২.আদালতের হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে স্বামী ও স্ত্রীর পারস্পরিক সম্মতিক্রমে; ৩. স্বামী বা স্ত্রী কর্তৃক দায়েরকৃত মামলায় আদালতের আদেশের মাধ্যমে।

যখন স্বামী বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটায় তখন তাকে বলা হয় তালাক। যখন পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ সম্পন্ন হয় তখন তাকে বলে ‘খুলা’ বা উভয় পক্ষের চুক্তির শর্তাবলি অনুসারে তাকে বলা হয় ‘মুবারাত’।

মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ অনুসারে স্ত্রীও বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে যদি বৈবাহিক চুক্তির সময় তাকে সে অধিকার দেয়া থাকে। এই অধ্যাদেশের ৭(১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনও পুরুষ তার স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে চায় তাহলে ‘তালাক’ উচ্চারণ করার পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে লিখিত নোটিশের মাধ্যমে জানাতে হবে যে সে স্ত্রীকে তালাক দিয়েছে এবং ওই নোটিশের একটি কপি তার স্ত্রীকেও দিতে হবে। ৭(২) ধারায় বলা হয়েছে, (১) উপধারা মোতাবেক, চেয়ারম্যানকে তালাকের নোটিশ দেওয়ার পর ৯০ দিন অতিবাহিত হওয়ার আগে তালাক কার্যকর হবে না।

প্রকৃতপক্ষে, এ আইনে তালাক-ই-হাসান ও তালাক-ই-আহ্সান-এর সম্মিলন ঘটানো হয়েছে। এ আইনে বাংলাদেশে এক নতুন ধরনের তালাক কার্যকর হয়েছে যা তালাক-ই-হাসান ও তালাক-ই-আহ্সানের অনুরূপ।

আদালতের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন, ১৯৩৯ অনুসারে একজন মুসলিম নারী কতক অবস্থায় বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন জানাতে পারে। সেগুলো হলো: ১. চার বা ততোধিক বছরের জন্য স্বামীর কোনও হদিশ পাওয়া না গেলে; ২. দুই বছর ধরে স্ত্রীর ভরণপোষণে স্বামীর ব্যর্থতা; ৩. স্বামীর সাত বছরের কারাদন্ড; ৪. স্ত্রী বিবাহের ঘটনাকে অস্বীকার করলে; ৫. স্বামীর যৌন অক্ষমতা; ৬. স্বামীর নিষ্ঠুরতা; ৭. স্বামীর স্বধর্ম ত্যাগ; ৮. স্বামীর মানসিক অসুস্থতা। পবিত্র কুরআনে বিভিন্ন সূরায় বিবাহ বিচ্ছেদের বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে।

ভরণপোষণ ও অভিভাবকত্ব সংক্রান্ত আইন ভরণপোষণ খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান ‘ভরণপোষণ’-এর অন্তর্ভুক্ত। সামাজিক মর্যাদা অনুসারে একজন নাবালকের মানসিক ও দৈহিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার ব্যয়ও ভরণপোষণের অন্তর্ভুক্ত। শিক্ষার খরচও এর মধ্যে রয়েছে [আহমেদুল্লাহ্ বনাম মফিজদ্দিন আহমেদ (৭৩) AIR Gau. 56]।

যেসব ব্যক্তি ভরণপোষণ লাভের অধিকারী নিম্নবর্ণিত পাঁচ শ্রেণীর লোক ভরণপোষণ লাভের দাবি করতে পারেন : ১. সদ্যপ্রসূত শিশু ও অবিবাহিত  কন্যা; ২. বয়স্ক শিশু; ৩. পিতামাতা; ৪. পিতামহ ও পিতামহী; ৫. স্ত্রী। মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১-এর ক ধারায় বলা হয়েছে যে, স্ত্রীর ভরণপোষণ করা স্বামীর আইনি বাধ্যবাধকতা। পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫-এর ৫ম ধারায় উল্লেখিত ভরণপোষণের বিধান বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ স্থগিত রেখেছে।

অভিভাবকত্ব ‘অভিভাবক’ বলতে এমন ব্যক্তিকে বোঝানো হয় যিনি অন্যকে ভরণপোষণ ও দেখাশোনা করেন। তিনি হতে পারেন স্বাভাবিক অভিভাবক, যেমন পিতা, মাতা, বা হতে পারেন আদালত কর্তৃক নিযুক্ত আইনগত অভিভাবক, কার্যত অভিভাবক যিনি ভরণপোষণ ও দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করেন। ‘অভিভাবকত্ব’ অর্থ একজন অভিভাবকের সেসব কাজ যার দ্বারা তিনি তার দায়িত্ব পালন করেন।

নাবালকত্বের মেয়াদ নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকল ব্যক্তি ১৬ বছর বয়স পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত নাবালক বলে গণ্য হবেন, তবে বয়স সন্ধির বা প্রজনন ক্ষমতার লক্ষণাদি ওই বয়সের আগেই দেখা দিলে এর ব্যতিক্রম হবে। ইসলামী আইন অনুসারে, একজন বালক বা বালিকা যখনই প্রজননক্ষমতা অর্জন করে তখই তার নাবালকত্বের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১-তে সাবালকত্বের বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ১৬ বছর [S. 12(1) (a)]।

সাবালকত্ব আইন, ১৮৭৫ (ধারা ৩) অনুসারে নাবালকত্বের মেয়াদ পূর্ণ হয় ১৮ বছর বয়সে। তবে যদি কোনো নাবালকের অভিভাবক নিয়োগ ও ওই নাবালকের সম্পত্তির তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব কোর্ট অফ ওয়ার্ডের ওপর ন্যস্ত থাকে তাহলে নাবালকত্বের বয়সসীমা ২১ বছর পর্যন্ত বর্ধিত হবে।

স্বাভাবিক অভিভাবকত্ব ইসলামী আইনে পিতা জীবিত থাকলে তিনিই তার নাবালক সন্তান ও তার সম্পত্তির স্বাভাবিক ও আইনগত অভিভাবক (AIR 1949 Cal 272; DLR W.P. 1:20 DLR, SC. 117)।

আদালত কর্তৃক নিযুক্ত অভিভাবক  গার্ডিয়ান্স অ্যান্ড ওয়ার্ডস অ্যাক্ট, ১৮৯০-এর অধীনে আদালত কর্তৃক কোনো নাবালকের অভিভাবক নিযুক্ত বা ঘোষিত হতে পারে।

কার্যত অভিভাবক  আইনগত অভিভাবক বা আদালত কর্তৃক নিযুক্ত অভিভাবক নন এমন কোনও ব্যক্তি যদি স্বেচ্ছায় কোনো নাবালক ও তার সম্পত্তি দেখাশোনার দায়িত্ব নেন তাহলে তাঁকে বলা হয় কার্যত অভিভাবক। একজন কার্যত অভিভাবক একজন নাবালক ও তার সম্পত্তির একজন হেফাজতকারী মাত্র।  [ইমামবাদী বনাম মুৎসুদ্দি (১৯১৮)]

পিতৃত্ব ও মাতৃত্ব  পিতৃত্ব ও মাতৃত্বের মধ্যে আইনগত সম্পর্ক থেকে উত্তরাধিকার, অভিভাবকত্ব ও ভরণপোষণ সংক্রান্ত কতকগুলো নির্দিষ্ট অধিকার ও দায়দায়িত্বের উৎপত্তি হয়েছে (20 DLR WP 176; 29 DLR SC. 296)। কোন দম্পতির বিবাহের ছয় মাস পরে জন্মগ্রহণকারী শিশু সর্বতোভাবে স্বামীর সন্তানরূপে বিবেচিত হবে এবং অনুরূপভাবে স্বামীর মৃত্যুর পর দুই বছরের মধ্যে অথবা বিবাহ বিচ্ছেদের দুই বছরের মধ্যে জন্মগ্রহণকারী যে কোনও শিশু ওই স্বামীর সন্তানরূপে গণ্য হবে।

উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আইন  মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে সমষ্টিগত সম্পত্তি ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি বা পূর্বপুরুষের সম্পত্তি ও অর্জিত সম্পত্তির মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। যখন পুত্র ও কন্যা একই সময়ে কোনও সম্পত্তি উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করে তখন পুত্র যে পরিমাণ পায়, কন্যা পায় তার অর্ধেক। এক পুত্র বা একজন উত্তরাধিকারীর পক্ষে কোনও সম্পত্তি উইল করে দেয়া হলে অন্যান্য পুত্র বা অন্যান্য উত্তরাধিকারীদের সম্মতি ছাড়া সেই উইল কার্যকর হতে পারে না।

একজন মুসলিম ব্যক্তির মৃত্যুর পর তাঁর ভূসম্পত্তি থেকে পর্যায়ক্রমে নিম্নবর্ণিত ব্যয়গুলো মেটাতে হবে: ১. তাঁর মৃতুশয্যার ও দাফন-কাফনের খরচপত্র, ২. সম্পত্তির দলিলপত্র যথা পরিচালনা সম্পর্কিত পত্র বা উত্তরাধিকার সনদপত্র গ্রহণের খরচপত্র, ৩. মৃত ব্যক্তির নিয়োজিত কোনও মজুর, কারিগর বা গৃহ পরিচারক/পরিচারিকার বকেয়া মাইনে ওই ব্যক্তির মৃত্যুর তিন মাসের মধ্যে পরিশোধ করা, ৪. মরহুমের অন্যান্য ঋণ (যদি থাকে) সেগুলোর অগ্রাধিকার অনুসারে পরিশোধ করা, এবং ৫. এসব কিছু পরিশোধের পর যদি আরও কোনও দেনা রয়ে যায় তবে তা পরিশোধ করা।

ভূসম্পত্তির অবশিষ্টাংশ মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বন্টিত হবে মৃত ব্যক্তি মৃত্যুর সময় যে সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন সে সম্প্রদায়ের বিধান অনুসারে [হায়াল-উন-নিসা বনাম মুহাম্মদ (১৮৯০) ১২. AU. 290, 171. A. 73], তাঁর উত্তরাধিকারী হিসাবে তাঁর ভূসম্পত্তি দাবিকারী ব্যক্তিরা যে সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত সে সম্প্রদায়ের বিধান অনুসারে নয়।

যারা উত্তরাধিকার লাভের যোগ্য নয়  দাস, কাফের, ধর্মান্তরিত ব্যক্তি, নরহত্যাকারী এবং অবৈধ সন্তান উত্তরাধিকারসুত্রে কোনও সম্পত্তি পাওয়ার যোগ্য নয়। ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে তাদের আনুগত্যের পার্থক্যের ফলে উত্তরাধিকার ব্যতিক্রম হবে না।

উত্তরাধিকার বণ্টন  উত্তরাধিকার আইন, ১৯২৫ এর ৩৯ ও ৪০ ধারার বিধান অনুসারে, অসিয়তপত্র না রেখে ইনতিকাল করেছেন এমন  একজন মৃত মুসলিম ব্যক্তির সমগ্র ভূসম্পত্তি তাঁর মৃত্যুর পরবর্তী মুহূর্ত থেকে তাঁর উত্তরাধিকারীদের কাছে হস্তান্তরিত হবে। অথবা কেউ যদি অসিয়তপত্র রেখে মারা যান, কিন্তু মৃত্যুর মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর ভূ-সম্পত্তি যদি হস্তান্তরিত না হয়ে থাকে তাহলেও তাঁর সকল ভূ-সম্পত্তি তাঁর উত্তরাধিকারীদের নিকট হস্তান্তরের যোগ্য হবে। শুধুমাত্র মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া ঋণের কারণে তাঁর উত্তরাধিকারীদের নিকট তাঁর ভূ-সম্পত্তি হস্তান্তর স্থগিত করা যাবে না।  [জুফরি বেগম বনাম আমির মুহাম্মদ (১৮৮৫)] উত্তরাধিকারীগণ নির্দিষ্ট অংশীদারিত্ব অনুসারে মৃত ব্যক্তির ভূ-সম্পত্তির ভোগ-দখল যৌথভাবে অর্জন করবেন।  [আবদুল কাদের বনাম চিদাম্বরম (১৯০৯) Mad 276-278]।

উত্তরাধিকার হস্তান্তর ও সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা সংক্রান্ত নির্দেশনা প্রদত্ত হয়েছে সুরা নিসা’র ১১, ১২ ও ১৭৬ নং আয়াতে। অন্যান্য উত্তরাধিকারীগণের সংখ্যা ও তাদের প্রাপ্য অংশের পরিমাণ যাই হোক না কেন, সর্বক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির পিতামাতা, সন্তানগণ, স্বামী বা স্ত্রী তাঁর সম্পত্তির অংশ পাবেন।

অসিয়ত  কোনও অসিয়ত সাধারণত কার্যকর হয় অসিয়তকারী ব্যক্তির মৃত্যুর পরবর্তী মুহূর্ত থেকে এবং অসিয়ত একটি সামগ্রিক দলিল হিসাবে গণ্য হয়।

অসিয়ত করার অধিকার যাদের রয়েছে  নাবালক এবং অসিয়ত দ্বারা সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন এমন ব্যক্তি ছাড়া মানসিকভাবে সুস্থ প্রত্যেক মুসলমান অসিয়ত করার যোগ্য। অসিয়তে মিথ্যা শপথের সম্ভাবনা প্রতিহত করার জন্য হযরত মুহাম্মদ (সঃ) অসিয়তের ব্যাপারে চিন্তিত ছিলেন। তাই সুরা মাইদা’র ১০৫-১০৬ নং আয়াতে আল্লাহ বিধান দিয়েছেন যে, মরণাপন্ন ব্যক্তির অসিয়ত একাধিক আস্থাভাজন সাক্ষী দ্বারা প্রত্যয়ন করতে হবে।

সুতরাং একটি অসিয়ত বৈধ হতে হলে ন্যূনপক্ষে দুজন সাক্ষী অবশ্যই প্রয়োজন। একজন মুসলিম ব্যক্তি তার কাফন-দাফনের খরচ মেটানো ও ঋণ পরিশোধের পর অবশিষ্ট সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশের বেশি অসিয়ত দ্বারা হস্তান্তর করতে পারেন না।

হিবা বা দান  হিবা বা দান হচ্ছে কোনও বিচার-বিবেচনা ছাড়াই কাউকে প্রদত্ত সম্পত্তি। একটি হিবার বৈধতার জন্য যেমন দাতার পক্ষ থেকে স্বত্ব প্রদান অপরিহার্য, তেমনি গ্রহীতার পক্ষ থেকে তা গ্রহণ করাও অপরিহার্য। হিবার অর্থ হচ্ছে এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে কোনও কিছুর বিনিময় ছাড়া অপর ব্যক্তির কাছে সরাসরি সম্পত্তি হস্তান্তর, এবং পরবর্তী ব্যক্তি নিজে বা তার পক্ষ থেকে সে সম্পত্তি গ্রহণ করা। কোনো হিবার বৈধতার জন্য অপরিহার্য বিষয় হচ্ছে: ১. দাতা কর্তৃক একটি দান ঘোষণাপত্র, ২. গ্রহীতা বা তার পক্ষ থেকে কারও দ্বারা সেই দান গ্রহণপত্র, এবং ৩.  ১৫০ ধারায় বর্ণিতক্রমে দাতা কর্তৃক গ্রহীতার নিকট দানের বস্ত্ত হস্তান্তর। এসব শর্ত পূরণ হলে একটি হিবা পূর্ণাঙ্গতা পায়। (Baillie, 515)

ওয়াক্ফ ও জনহতকির কর্মকান্ড সম্পর্কিত আইন

ওয়াক্ফ  ওয়াক্ফ শব্দের আক্ষরিক অর্থ আটকাবস্থা। ইমাম আবু হানীফার (রাঃ) মতানুসারে ওয়াক্ফের আইনগত অর্থ হচ্ছে;

ওয়াকিফ বা ভোগকারীর মালিকানায় কোনও নির্দিষ্ট বিষয়বস্ত্তর হস্তান্তর যার মুনাফা বা ভোগাধিকার নিবেদিত হয় ‘দরিদ্রদের সেবা বা অন্যান্য হিতকর কাজে। ওয়াকফ সম্পদ মুসলিম আইনে ধর্মীয়, পবিত্র ও সেবামূলক হিসেবে বিবেচিত। (ওয়াকফ অধ্যাদেশ, ১৯৬২-এর ১৭৪ নং ধারা)।

হানাফী আইনে বৈধ ওয়াকফের অপরিহার্য উপাদান  হানাফী আইন অনুসারে একটি বৈধ ওয়াকফের অপরিহার্য শর্ত পাঁচটি: ১. সম্পত্তি অবশ্যই স্থায়ীভাবে দান করতে হবে, ২. ওয়াকিফকে অবশ্যই দানের যোগ্য হতে হবে, ৩. ওয়াকিফকে অবশ্যই ওই সম্পত্তির মালিক হতে হবে, ৪. ওয়াক্ফের উদ্দেশ্য অবশ্যই হবে ধর্মীয় এবং  ৫. ওয়াকফ অবশ্যই নিঃশর্ত হবে।

অগ্র-ক্রয়াধিকার (শুফ্‘আ) সংক্রান্ত আইন অগ্র-ক্রয়াধিকার একটি অধিকার। অন্য কোনও ব্যক্তি বা কোনও আগন্তুকের নিকট বিক্রয়কৃত কোনও স্থাবর সম্পত্তি ক্রয়ের মাধ্যমে দখল লাভের অধিকার হচ্ছে অগ্র-ক্রয়াধিকার বা শুফ্‘আ। এটি তৃতীয় একজন ব্যক্তির অধিকার যাকে বলা হয় অগ্র-ক্রয়াধিকারী। কোনও স্থাবর সম্পত্তি বিক্রয়ের চুক্তি সম্পাদনের সময় অগ্র-ক্রয়াধিকারী ওই সম্পত্তি ক্রয়ের দাবি নিয়ে উপস্থিত হতে পারেন এবং ক্রেতার স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন। সেক্ষেত্রে পূর্বের ক্রেতা ও বিক্রেতা যে মূলে ও যেসব শর্তে ক্রয়-বিক্রয়ে সম্মত হয়েছেন, সেই মূল্যে ও সেসব শর্তে ওই সম্পত্তি ক্রয় করতে পারেন। অগ্র-ক্রয়াধিকারের বিধানের লক্ষ্য হচ্ছে অবাঞ্ছিত আগন্তুকদের এজমালি সম্পত্তির মালিক বা নিকট প্রতিবেশী হিসাবে গ্রহণের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য ঝুট-ঝামেলা থেকে কোনও পরিবার বা গোষ্ঠীকে রক্ষা করা।

মুসলিম আইন অনুসারে নিম্নবর্ণিত ব্যক্তিগণ অগ্র-ক্রয়াধিকার দাবি করতে পারেন;  ১. শফী‘ই শরীক যিনি বিক্রয়কৃত সম্পত্তির শরীক বা অংশীদার; ২. শফী‘ই খালীত যিনি আলোচ্য সম্পত্তির আওতাধীন বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার অংশীদার (যেমন পানি, রাস্তাঘাট বা অন্যান্য বারোয়ারি ব্যবস্থাদি ব্যবহারের অধিকার); এবং ৩. শফী‘ই-জার যিনি আলোচ্য সম্পত্তির পার্শ্ববতী স্থাবর সম্পত্তির মালিক।

অগ্র-ক্রয়াধিকারের নীতি সাধারণভাবে সকল মুসলিম আইনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।  [মোহাম্মদ আবদুল হান্নান]