মুদ্রাব্যবস্থা

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১০:২১, ৪ মার্চ ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

মুদ্রাব্যবস্থা  সাধারণত আদান-প্রদানের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহূত নির্দিষ্ট ওজনের একটি বিশুদ্ধ ধাতুখন্ড। মুদ্রার এই নির্দিষ্ট ওজন ও এর ধাতব বিশুদ্ধতা সাধারণত নিয়ন্ত্রিত হয় কোন নির্দিষ্ট ভূখন্ডের সার্বভৌম রাজনৈতিক সরকার দ্বারা। মুদ্রার ব্যবহার একটি জটিল আর্থ-সামাজিক অবস্থার ইঙ্গিত করে। এ আর্থ-সামাজিক অবস্থা যথেষ্ট পরিমাণে ব্যবসায়িক শ্রীবৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ফসল। ইতিহাসের পথপরিক্রমায় বিভিন্ন পর্যায়ে মুদ্রার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সূচিত হয়েছে।

প্রাচীনযুগ  প্রাচীন লিপি ও পুথি-পুস্তকের সাক্ষ্যে প্রমাণিত হয় যে, প্রাচীনকালে বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের বদৌলতে বাংলার অর্থনীতি বেশ দৃঢ় অবস্থানে ছিল। পেরিপ্লাসের বিবরণ থেকে জানা যায়, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, এমনকি মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের সঙ্গে বাংলার বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।

তৎকালে বাণিজ্যিক কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য আদান-প্রদানের মাধ্যম হিসেবে মুদ্রাব্যবস্থার অস্তিত্বের সুস্পষ্ট নিদর্শন পাওয়া গেছে। তবে পর্যাপ্ত উপাত্তের অভাবে এতদ্সম্পর্কিত জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত।  মহাস্থান ব্রাহ্মী লিপি থেকে প্রমাণিত হয়, খ্রিস্টের জন্মেরও আগে ‘গন্ডক’ ও ‘কাকনিক’ নামক মুদ্রা এতদঞ্চলে প্রচলিত ছিল। পেরিপ্লাসের বর্ণনায় ‘কলতিস’ এবং ‘কল্লইস’ নামক স্বর্ণমুদ্রা প্রচলনের আভাস পাওয়া যায়। ছাপাঙ্কিত ধাতুখন্ড এবং ছাঁচে ঢালা তাম্রমুদ্রা থেকে ইঙ্গিত মেলে যে, খ্রিস্টের জন্মেরও কয়েকশ বছর আগে প্রাচীন বাংলায় এক ধরনের মুদ্রাব্যবস্থা চালু ছিল।

গুপ্ত শাসনাধীনে উত্তরবঙ্গে সমৃদ্ধ ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে উঠেছিল। খ্রিস্টীয় পাঁচ ও ছয় শতকে স্বর্ণ ও রৌপ্য উভয় প্রকার মুদ্রারই ব্যাপক প্রচলন ছিল। স্বর্ণমুদ্রা ‘দিনার’ এবং রৌপ্যমুদ্রা ‘রূপক’ নামে অভিহিত হতো। আট রূপক ছিল অর্ধ দিনারের সমান। কিন্তু সাত শতক থেকে বিস্ময়করভাবে এই স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার প্রচলন প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় কিছু রৌপ্য মুদ্রার প্রচলন অবশ্য ছিল। সমগ্র প্রাচীন যুগ ধরে মুদ্রার নিম্নতম একক হিসেবে কড়ির প্রচলন অব্যাহত ছিল। গ্রামাঞ্চলে কড়ির প্রচলন অব্যাহত ছিল উনিশ শতকের শেষ ভাগেও। এমনকি কোন কোন অঞ্চলে এর পরও কড়ির প্রচলন লক্ষ্য করা গেছে। তখন মালদ্বীপ থেকে চালের বিনিময়ে কড়ি আনা হতো।

তুর্কো-আফগান আমল পন্ডিতগণ এ ব্যাপারে একমত যে, সোনা ও রূপার অপর্যাপ্ততার কারণে পাল ও সেন আমলে ধাতব মুদ্রার যে অভাব দেখা দেয়, তা প্রায় হোসেনশাহী আমলের আগ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। পাল ও সেন আমলে সোনা-রূপার অপ্রতুলতার জন্য বহির্বাণিজ্যের অধোগতিকে দায়ী করা যায়। দেশে সোনা-রূপার কোন খনি ছিল না। সুতরাং কোন এক নির্দিষ্ট সময়ে বাংলা যে পরিমাণ সোনা-রূপার অধিকারী ছিল, তা সম্ভব হয়েছিল উদ্বৃত্ত বৈদেশিক বাণিজ্যের অর্জন থেকে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা যখন দুর্বল হয়ে পড়ত এবং ধাতব মুদ্রা ব্যবস্থায় বৈকল্য দেখা দিত, তখন আদান-প্রদানে কড়ি প্রাধান্য পেত। দ্রব্য বিনিময়ও তখন জোরদার হতো।

তুর্কো-আফগান আমলে এসে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে পুনরায় মুদ্রার প্রয়োগ হতে দেখা যায়। গ্রামাঞ্চলে তখনও কড়ির ব্যবহারই ছিল প্রধান, আর আদান-প্রদানের পরিমাণও সেখানে ছিল নেহায়েতই কম। হোসেনশাহী আমলে (১৪৯৪-১৫৩৮) আকার এবং ওজনে বিভিন্ন প্রকার রৌপ্যমুদ্রা ক্রমান্বয়ে অধিক হারে চালু হতে থাকে। এই সময় মুদ্রা ‘তঙ্কা’ নামে অভিহিত হয়। তঙ্কা পুরানো আমলের ‘রূপক’-এর স্থান দখল করে (সুলতানি আমলে রূপী ও তঙ্কা দ্বারা একই মুদ্রাকে বুঝানো হতো এবং এই অবস্থা ব্রিটিশ শাসনের একেবারে শেষ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে)। কিন্তু এটি সত্য যে, দৈনন্দিন সাধারণ কেনা-বেচায় কড়িই আদান-প্রদানের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহূত হতো এবং মুদ্রা ব্যবহূত হতো শুধু বড় ধরনের আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে। কড়ির ঊর্ধ্বপাতন হিসাব করা হতো নিম্নোক্ত উপায়ে: ৪ কড়িতে ১ গন্ডা, ৫ গন্ডায় ১ বুড়ি, ৪ বুড়িতে ১ পণ, ১৬ পণে ১ কাহন এবং ১০ কাহনে ১ তঙ্কা/রূপী। বিস্ময়কর যে, কড়ি যখন মুদ্রাব্যবস্থার অঙ্গ হিসেবে আর বিবেচিত হতো না, তখনও রূপীর বিভিন্ন অংশের একক হিসেবে উপরিউক্ত হিসাব প্রচলিত ছিল। প্রথাগতভাবে তখনও হিসাবের একটি কাল্পনিক একক রূপে কড়িকে ধরা হতো। হোসেনশাহী আমলে রৌপ্য ও স্বর্ণমুদ্রার পুনঃপ্রবর্তন হয়। তবে সাধারণ আদান-প্রদানে রৌপ্য মুদ্রারই প্রচলন ছিল, স্বর্ণমুদ্রা ছিল শুধু রাজকীয় জৌলুসের প্রতীক। প্রাক-মুগল যুগে রূপীর শুধু দুটি খন্ডাংশ ছিল- আধুলি ও সিকি। এর প্রচলন ছিল শুধু সীমিত আকারে, সারা দেশব্যাপী এগুলির প্রাপ্যতা ছিল না। এক আনার প্রয়োগ ছিল শুধু হিসাবের ক্ষেত্রে, এর বাস্তব কোন অস্তিত্ব ছিল না।

প্রাক-মুগল যুগে তিন ধরনের মুদ্রা প্রচলিত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। এগুলির ওজন ছিল যথাক্রমে ১৬০, ৮০ এবং ৪০ গ্রেন। সুতরাং এগুলির মধ্যে উচ্চতম মানের মুদ্রার সাথে অপর দুটির আনুপাতিক মান ছিল ২:১ ও ৪:১; অন্য কথায় টাকা, আধুলি ও সিকি। তবে অপর দুপ্রকার মুদ্রা অপেক্ষা রূপার টাকার প্রচলন ছিল পরিমাণে বেশি। সকল মুদ্রাই ১৭২.৮ গ্রেণ ওজনে নির্মিত হওয়ার কথা থাকলেও কদাচিৎ এই মান রক্ষিত হতো। পূর্ণ টাকার ওজন ১৪৮ থেকে ১৭০ গ্রেনের মধ্যে ওঠানামা করত।

মুগল আমল সতেরো ও আঠারো শতকে সমুদ্রপথে যাতায়াতের উন্নতির ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন ঘটে এবং বৈপ্লবিক পবিবর্তন সাধিত হয়। বাংলা সমুদ্র সমীপবর্তী দেশ হওয়ায় ধনতান্ত্রিক বিশ্ববাণিজ্যের সাথে সম্পৃক্ত হয়। এর ফলে এদেশের অর্থনীতি মুদ্রানির্ভর হয়ে পড়ে। তবে অনেক পন্ডিত সাধারণত যে পরিমাণ অর্থের আদান-প্রদানের কথা বলেন, ঠিক ততটা বিপুল পরিমাণ অর্থের বাণিজ্য তখনও বাংলায় গড়ে ওঠেনি। সুপ্রাচীনকাল থেকেই বাংলায় মুদ্রাব্যবস্থার প্রচলন থাকলেও তা সীমাবদ্ধ ছিল শহুরে উৎপাদন ও বিতরণ কেন্দ্রসমূহের মধ্যেই। গ্রামাঞ্চলে আদান-প্রদানের মাধ্যম ছিল হয় কড়ি, নয়তো পণ্য কিংবা শ্রম। পণ্যের বিনিময়ে পণ্য, সেবার বিনিময়ে সেবা এবং শ্রমের বিনিময়ে শ্রম চলছিল বেশ ভালভাবেই। পরিপূর্ণভাবে না হলেও মুগল আমলে পণ্য বিনিময়ের পরিবর্তে অর্থের বিনিময়ে আদান-প্রদান বহুল পরিমাণে চালু হয়। মুগল যুগের শুরু থেকেই বিদেশী, বিশেষ করে সমুদ্রপথে আগমনকারী ইউরোপীয় বণিকগণ বাংলার বহির্বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করতে শুরু করে। যেহেতু তাদের উৎপাদিত পণ্যের এদেশে কোন বাজার ছিল না, সেহেতু তারা পণ্য ক্রয়ের জন্য নিয়ে আসে স্বর্ণ বা রৌপ্য পিন্ড। প্রচুর পরিমাণ রৌপ্য বা অন্য মূল্যবান ধাতুর আমদানির ফলে মুগল সরকার মুদ্রাভিত্তিক অর্থনীতি চাঙ্গা করার সুযোগ পায়। ঢাকা, মুর্শিদাবাদ এবং পাটনায় টাকশাল প্রতিষ্ঠিত হয়। স্রফগণ ধাতুপিন্ড নিয়ে আসত অনুমোদিত ওজন ও মান অনুযায়ী মুদ্রা নির্মাণের জন্য। মুগল মুদ্রা ‘রূপী’ নামে অভিহিত হতো (রূপা বা রূপাইয়া অনুসারে)। সরকারিভাবে পুরানো ‘টঙ্কা’ নাম পরিত্যক্ত হলেও জনসাধারণ রূপীকে ‘টাকি’ বলতে থাকে। বর্তমান বাংলাদেশের মুদ্রার নামও টাকা।

ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শাসক কর্তৃক প্রচারিত সকল মুদ্রাকে বলা হতো ‘সিক্কা’। এই সিক্কা মুদ্রা হতো প্রায় ১৭৫ গ্রেন রৌপ্য বিশিষ্ট। এই মুদ্রার একটা বিশেষ রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য ছিল। যখনই কোন নতুন সম্রাট সিংহাসনে বসতেন তখনই পূর্ববর্তী শাসকের আমলের মুদ্রা হয়ে যেত ‘সনৎ’ (অবমূল্যায়নকৃত) এবং এ সকল মুদ্রাকে ‘বাট্টা’র (discount) আওতায় আনা হতো। রাষ্ট্রীয় কোষাগারে সনৎ মুদ্রাকে কিন্তু বাট্টা প্রদানের পরও গ্রহণ করা হতো না। মুদ্রা বাজারে ‘স্রফ’ বা সররফ নামক একদল পেশাজীবী মুদ্রা বিনিময়কারী থাকতেন, যারা বাট্টা কষে সনৎ মুদ্রা কিনে নিতেন এবং রাজকীয় টাকশালে নিয়ে সেগুলিকে পুনরায় সিক্কা মুদ্রায় রূপান্তরিত করাতেন।

সরকার যতদিন পর্যন্ত টাকশালগুলি সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করত ততদিন পর্যন্ত এই ছিল ব্যবস্থা। কিন্তু আওরঙ্গজেব এর মৃত্যুর পর কেন্দ্রীয় সরকার দুর্বল হয়ে পড়লে সাম্রাজ্যের প্রশাসনে অনেক পরিবর্তন আসে। এসকল পরিবর্তনের মধ্যে একটি ছিল বিশেষ কয়েকটি ব্যাংক পরিবারকে টাকশালের দায়িত্ব বরাদ্দ করা। ১৭১৮ সাল থেকে শুধুমাত্র জগৎ শেঠ পরিবার টাকশালের একক বরাদ্দ লাভ করে।

বাজারে শুধু সিক্কা ও সনৎ মুদ্রাই প্রচলিত ছিল না। একই সাথে আদান-প্রদানের মাধ্যম হিসেবে আরও বহু ধরনের মুদ্রা প্রচলিত ছিল। বাংলার অব্যাহত উদ্বৃত্ত বাণিজ্যের কারণে ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশ থেকে বণিকগণ তাদের নিজস্ব মুদ্রা নিয়ে বাংলার পণ্য কেনার জন্য আসত। এসকল মুদ্রার সহজাত (ধাতব) মূল্যের কারণে এগুলিও বাট্টা প্রদানের মাধ্যমে বাংলার বাজারে গ্রহণযোগ্যতা পেত। এ সকল মুদ্রার বেশিরভাগ ছিল আর্কট, বারাণসী, কোচবিহার, লক্ষ্ণৌ, মাদ্রাজ, সুরাট ইত্যাদি ভারতের বিভিন্ন টাকশাল থেকে জারিকৃত। আর্কট মুদ্রা প্রথমে জারি হতো কর্নাটের নওয়াব কর্তৃক। পরে বেশ কয়েক ধরনের আর্কট মুদ্রা বাজারে আসে, কেননা ইংরেজ, ফরাসি এবং ওলন্দাজগণ তাদের স্ব স্ব আর্কট মুদ্রা জারি করার অধিকার লাভ করে। এভাবে বাংলার মুদ্রা বাজারে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মুদ্রার সাথে সাথে এদেশে ব্যবসারত ইংরেজ, ফরাসি এবং ওলন্দাজ বণিকদের জারিকৃত আর্কট মুদ্রাও প্রবেশলাভ করে। ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একটা কাল্পনিক মুদ্রা ছিল যেটাকে তারা বলত ‘বর্তমান টাকা’ (Current Rupee)। বাজারে বহু ধরনের মুদ্রা প্রচলিত থাকায় ইংরেজগণ একটা কাল্পনিক মুদ্রার হিসেবে এদেশে প্রচলিত মুদ্রাসমূহের মূল্য যাচাই করত। কাল্পনিক বর্তমান টাকা ছিল একটা দশমাসা টাকা অপেক্ষা শতকরা দশ ভাগ কম মান বিশিষ্ট। কিন্তু বর্তমান টাকা ছিল কলকাতার চৌহদ্দির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ১৭৫৬ সাল থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত নিজস্ব টাকশাল থেকে সিক্কা টাকা মুদ্রায়নের অধিকার লাভ করে। এভাবে কলকাতা সিক্কা নামে একটা নতুন মুদ্রা বাজারে এসে ইতোমধ্যেই যথেষ্ট জটিলকৃত মুদ্রাব্যবস্থাকে জটিলতর করে তোলে।

ব্রিটিশ আমল একই সাথে এতসব মুদ্রা প্রচলিত থাকায় আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়া ছিল অবশ্যম্ভাবী। একটামাত্র মানসম্মত মুদ্রা - সিক্কা টাকা প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে কোম্পানি সরকার ঢাকা ও পাটনা টাকশাল দুটি ১৭৭৩ সালে এবং মুর্শিদাবাদ টাকশাল ১৭৭৭ সালে বন্ধ করে দেয়। ব্যবসা-বাণিজ্যে আদান-প্রদান এবং কর প্রদানের ক্ষেত্রে শুধু কলকাতা টাকশাল থেকে জারিকৃত সিক্কা টাকাকে একমাত্র মুদ্রায় পরিণত করা হয়। হেস্টিংস এর মুদ্রা সংস্কার চরমভাবে ব্যর্থ হয়। মুদ্রা বাজারে সকল প্রকার সনৎ ব্যাপকহারে চালু থাকে। পাটনা, মুর্শিদাবাদ ও ঢাকার টাকশালগুলি পুনরায় চালু করে লর্ড কর্নওয়ালিস মুদ্রাব্যবস্থা সংস্কারের প্রয়াস পান। তিনি মুদ্রাব্যবস্থার সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করার জন্য ১৭৯২ সালে একটি টাকশাল কমিটি (Mint Committee) গঠন করেন। এই কমিটি পর্যায়ক্রমে সনৎ মুদ্রা বাতিল করার সুপারিশ করে। দেশে রূপার অভাব দেখা দেওয়ায় মুদ্রাবাজারে যে সংকট দেখা দিয়েছিল তা নিরসনের জন্য কমিটির রিপোর্টে স্বর্ণমুদ্রা প্রচলনেরও সুপারিশ করা হয়।

কোম্পানি শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর স্বর্ণ-রৌপ্য পিন্ডের আমদানি কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। তদুপরি চীনের সাথে কোম্পানির ব্যবসায় মূলধন যোগানের ক্ষেত্রে বাংলার রূপা ব্যবহার করা হতো। রূপার অভাব মেটানোর জন্য ১৭৬৬ ও ১৭৬৯ সালে স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করা হয়, কিন্তু সোনা রূপার স্থান দখল করতে পারেনি। বাঙালি স্রফ ও ভোক্তাগণ সোনা অপেক্ষা রূপাকেই বেশি পছন্দ করত। ফলে রূপার দাম যায় বেড়ে আর সোনার দাম কমে যায়। এতে মুদ্রা বাজার আরও জটিল হয়ে পড়ে। হেস্টিংস ১৭৭৭ সালে স্বর্ণমুদ্রা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখেন, কিন্তু রূপার সংকট মোকাবিলা করার জন্য তাঁকে ১৭৮০ সালে আবার স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করতে হয়। কিন্তু কলকাতার বাইরে সোনার মোহরের কোন গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। এর ফলে সোনার মোহরের বাট্টা বেড়ে যায় এবং সোনার দাম আরও কমে যায়। কর্নওয়ালিস ১৭৮৮ সালে স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন বন্ধ করলেও ১৭৯২ সালে পুনরায় চালু করতে বাধ্য হন। তিনি কলকাতা টাকশালের ১ সোনার মোহরের সাথে ১৬ সিক্কা টাকার বিনিময় হার ধার্য করেন। তিনি বাজারের যে কোন পণ্যের মতোই সোনার মোহরকেও একই রূপ বিবেচনা করার সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে বাজারের অন্যান্য পণ্যের দামের মতো এর দামও উঠা-নামা করতে পারত। কর্নওয়ালিসের সংস্কার কার্যকর হয় এবং এক দশকের মধ্যে বাংলার মুদ্রা সংক্রান্ত জটিলতার নিরসন ঘটে।

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে কোম্পানির বাংলা রাজ্য একটি সর্ব ভারতীয় সাম্রাজ্যের রূপ নেয়। ১৮৩৩ সালে ব্রিটিশ বাংলার নাম পরিবর্তিত হয়ে ব্রিটিশ ভারত হয় এবং বাংলা ব্রিটিশ ভারতের একটি প্রদেশে পরিণত হয়। কলকাতা হয় ব্রিটিশ ভারত সাম্রাজ্যের রাজধানী। সাম্রাজ্যের কথা বিবেচনায় এনে ১৮৩৫ সালে কর্নওয়ালিসের মুদ্রা ব্যবস্থার অবসান ঘটানো হয় এবং ১৮০ গ্রেন ওজনের কোম্পানির রূপার টাকা চালু করা হয়। এর নাম দেওয়া হয় কোম্পানির টাকা (১৮৬১ সালে এর নাম দেওয়া হয় শুধু টাকা) এবং শুধু এই মুদ্রাকেই সারা ব্রিটিশ ভারতের একমাত্র মুদ্রা হিসেবে বৈধতা দেওয়া হয়। কিন্তু এই একক ধাতুর মুদ্রা সম্পূর্ণ সন্তোষজনক প্রমাণিত হয়নি। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধের কারণে রূপার নিয়মিত সরবরাহ সম্ভব হয়নি। মানুষের মধ্যে রূপা দিয়ে গহনা তৈরি ও অন্যান্য ভোগবিলাসের স্পৃহা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায় এবং বিপুল পরিমাণ ধাতু আটকা পড়ে যায়। এর ফলে উনিশ শতকের পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে বাজারে রূপার টাকার অভাব দেখা দেয়। এই অসুবিধা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য বিভিন্ন ব্যাংক পরিবারের ছাপাঙ্কিত বেসরকারি স্বর্ণপিন্ড মুদ্রা হিসেবে বাজারে চালু হয়। এ জাতীয় স্বর্ণমুদ্রা গ্রহণযোগ্যতা পায়, বিশেষ করে এর সহজাত ধাতব মূল্যের কারণে। তাছাড়া সোনার মোহরের প্রতি মানুষের স্বাভাবিক আগ্রহ ছিল। জনগণের চাপের মুখে ভারত সরকার এই বেসরকারি সোনার টাকাকে সাময়িক স্বীকৃতি দেয়। রাষ্ট্রীয় কোষাগারে সভরেন ও আধা সভরেন যথাক্রমে ১০ ও ৫ টাকা হারে গৃহীত হয়।

কিন্তু দ্বিবিধ ধাতব মুদ্রা প্রবর্তনে সরকারের কোন আগ্রহ ছিল না। এর পরিবর্তে এক ধরনের প্রতীক মুদ্রা প্রবর্তনের চেষ্টা চালানো হয়। ১৮৬১ সালের মুদ্রা আইন অনুসারে সরকার আদান-প্রদানের একক কর্তৃত্ব গ্রহণ করে। সকল ব্যাংক ও স্রফ পরিবারের প্রমিজরি নোট প্রদানের ক্ষমতা অস্বীকার করা হয়। মহারানী ভিক্টোরিয়ার নামে পরিপূর্ণ দায়িত্ব সহকারে ১৮৬১ সালে কাগজের নোট প্রচলন করা হয়। ১০, ২০, ৫০, ১০০, ৫০০, ১০০০ টাকার নোট বাজারে আসে। বিনিময় সুবিধার্থে ১৮৯১ সালে ৫ টাকার নোট প্রচলিত হয়। ব্রিটিশ সরকারের তরফ থেকে স্বর্ণমুদ্রা ও স্বর্ণপিন্ডকে সিকিরিউটি হিসেবে নিয়ে কন্ট্রোলার অব কারেন্সির প্রতিশ্রুতিতে কাগজের মুদ্রা প্রচলিত হয়। সরকারের তরফ থেকে কাগজের মুদ্রার সিকিরিউটি ছিল সর্বোচ্চ ৪ কোটি টাকা এবং কাগজি মুদ্রার অবশিষ্টাংশের প্রতিভূ ছিল রূপার টাকা ও স্বর্ণ-রৌপ্য পিন্ড।

সোনার মান ভিত্তিক প্রতীক মুদ্রা প্রচলন এবং সকল টাকশাল বন্ধ করার বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। অভিযোগ করা হয়, এই ব্যবস্থা শুধু ব্রিটিশ স্বার্থকেই সংরক্ষিত করবে। জনগণের সমলোচনা এবং বিশৃঙ্খল মুদ্রাব্যবস্থাপনার কারণ উদ্ঘাটনের জন্য একটি কমিটি গঠিত হয়। ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী লর্ড হার্শেলকে করা হয় উক্ত কমিটির প্রধান। হার্শেল কমিটির রিপোর্ট অনুসারে সরকার মুদ্রাব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কার করে।

১৮৯৩ সালের মুদ্রা আইন ভারতকে দ্বিবিধ (স্বর্ণ ও রৌপ্য) ধাতুভিত্তিক মুদ্রাব্যবস্থার দেশ হিসেবে ঘোষণা করে। এই আইনে মুদ্রা প্রচলন ও নিয়ন্ত্রণের একক ক্ষমতা শুধু সরকারের উপরই বর্তায়। ১৮৯৩ সালের সংস্কারের মাধ্যমে টাকা একটি প্রতীক মুদ্রায় পরিণত হয় এবং চাওয়া মাত্র এর বিপরীতে সোনা বা রূপার আন্তর্জাতিক মূল্য পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। ১৮৯৮ সাল থেকে শুধু সোনা মুদ্রামান হিসেবে ধার্য হয়, তবে এতে বিনিময় সমস্যার কোন সুরাহা হয়নি।

মুদ্রামান পর্যালোচনার জন্য ১৯১৩ এবং ১৯২৫ সালে আরও দুটি ‘রয়্যাল কমিশন’ গঠিত হয়। ১৯২৫ সালের কমিশন রিপোর্ট মোতাবেক সরকার ভারতকে মিশ্র (স্বর্ণপিন্ড ও স্টার্লিং) মুদ্রামানের দেশ হিসেবে ঘোষণা করে। ১ টাকা = দেড় শিলিং, এই হারে বিনিময় ধার্য হয়। এই হার পূর্বতন হার (১ টাকা = ১১/৩ শিলিং)-কে অতিক্রম করলে ১৯২৭ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত তিক্ত বিতর্কের অবতারণা হয়। টাকার সাথে পাউন্ডের বিনিময় হার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, সোনার তুলনায় টাকার দাম কমে যায় অর্থাৎ টাকার ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়। সোনার দাম বেড়ে যাওয়ায় বিনিময় হারে প্রচন্ড তোলপাড় শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মুদ্রামানের ক্ষেত্রে কোন প্রকার বাস্তব পরিবর্তন আনয়নকে অসম্ভব করে তোলে। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে এবং যুদ্ধোত্তর কালে বাজারে মুদ্রার প্রবাহ দারুণভাবে বেড়ে যায়। এর অনুষঙ্গ হিসেবে দেখা দেয় মুদ্রাস্ফীতি অর্থাৎ এই সময়ে দেশভাগের রাজনীতি মুদ্রাপ্রবাহ ও বিনিময়হারের রাজনীতিকে অবদমিত করে রাখে।  [সিরাজুল ইসলাম]

আরও দেখুন মুদ্রা