মীরজুমলা

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২২:৪৫, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

মীরজুমলা (১৬৬০-১৬৬৩ খ্রি)  বাংলার সুবাহদার। জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন ইরানি এবং প্রথমে তাঁর নাম ছিল মুহম্মদ সাঈদ। মুগল সম্রাটের কাছ থেকে তিনি মুয়াজ্জম খান, খান-ই-খানান, সিপাহ সালার এবং ইয়ার-ই-ওয়াফাদারের মতো বিভিন্ন উপাধি লাভ করেছিলেন। তবে মীরজুমলা নামেই তিনি ইতিহাসে সমধিক পরিচিত। ইস্পাহানের আর্দিস্তানে ১৫৯১ খ্রিস্টাব্দের দিকে তাঁর জন্ম হয়। তিনি ছিলেন এক দরিদ্র তেল-ব্যবসায়ীর পুত্র। বাল্যকালে মীরজুমলা কিছুটা পড়তে, লিখতে এবং অঙ্ক কষতে শিখেছিলেন, যার ফলে তিনি হীরক খনির জন্য বিখ্যাত গোলকুন্ডার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক হীরক ব্যবসায়ীর অধীনে কেরানির চাকরি লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি অন্য একজন ব্যবসায়ীর অধীনে চাকরি নিয়ে ভারতে এসেছিলেন। তিনি অবশ্য নিজেই হীরার ব্যবসা শুরু করেন, কয়েকটি হীরক খনি ইজারা নেন এবং ঝুঁকিপূর্ণ সামুদ্রিক বাণিজ্যে লিপ্ত হন। ক্রমে ক্রমে বহু জাহাজের মালিক হয়ে তিনি এক খ্যাতিমান ব্যবসায়ী রূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।

মীরজুমলা গোলকুন্ডার সুলতানের অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন এবং রাজ্যের উজির বা প্রধানমন্ত্রীর পদে উন্নীত হন। তিনি কর্নাটক রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযানে নেতৃত্ব দিয়ে তা দখল করে প্রচুর ধনসম্পদ লাভ করেন। বিষয়টি তাঁর প্রতি গোলকুন্ডার সুলতানের সন্দেহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দাক্ষিণাত্যের মুগল সুবাহদার শাহজাদা আওরঙ্গজেব তাঁর উন্নতির সহায়ক হন এবং সম্রাট শাহজাহান তাঁর নিরাপত্তা বিধান করেন। সম্রাট তাঁকে মুয়াজ্জম খান উপাধি প্রদান করে সম্মানিত করেন এবং তাঁর পদমর্যাদা ৬০০০ জাট ও ৬০০০ সাওয়ারে উন্নীত এবং তাঁকে দীউয়ান-ই-কুল বা প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন।

সম্রাট আওরঙ্গজেবের অধীনে মীরজুমলা শাহ সুজার মোকাবিলা করার দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। খাজোয়ার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে শাহ সুজা তান্ডায় পালিয়ে যান এবং ৯ মে ১৬৬০ খিস্টাব্দে ঢাকায় পৌঁছেন। মীর জুমলা খাজোয়া থেকে তান্ডা হয়ে ঢাকা পর্যন্ত শাহ সুজার পশ্চাদ্ধাবন করেন। কিন্তু সুজা ঢাকা থেকে পূর্ব সীমান্ত অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত আরাকানের রাজার কাছে আশ্রয়লাভ করেন। মীরজুমলা ঢাকায় পৌঁছার অল্পদিন পরই বাংলার সুবাহদার হিসেবে তাঁর নিয়োগের রাজকীয় ফরমান লাভ করেন ১৬৬০ খিস্টাব্দে।

মীরজুমলার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ উপাধি ও পুরস্কার প্রদান ছাড়াও মনসব বৃদ্ধি করে সম্রাট তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন। দায়িত্ব গ্রহণ করেই তিনি প্রশাসনকে পুনর্গঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। উত্তরাধিকার যুদ্ধ চলাকালে শাহ সুজার অনুপস্থিতির কারণে প্রশাসন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল এবং সেখানে অবাধ্যতা এবং একগুঁয়েমি দেখা দিয়েছিল। তিনি সুজা কর্তৃক রাজমহলে রাজধানী স্থানান্তর বাতিল করে ঢাকাকে তার পূর্বতন গৌরবে পুনঃঅধিষ্ঠিত করেন। এরপর তিনি বিচার বিভাগের প্রতি নজর দেন। তিনি অসৎ কাজী ও মীর আদলদের বরখাস্ত করে তাদের স্থলে সৎ ব্যক্তিদের নিয়োগ দান করেন।

ঢাকা ও শহরতলী এলাকায় মীরজুমলার নির্মাণ কর্মকান্ডের মধ্যে রয়েছে দ্রুত সৈন্য চলাচল, যন্ত্রপাতি ও গোলাবারুদ প্রেরণের জন্য এবং জনকল্যাণমূলক দুটি রাস্তা ও দুটি সেতু। কৌশলগত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজনে তিনি কয়েকটি দুর্গও নির্মাণ করেন। একটি দুর্গ ছিল টঙ্গী জামালপুরে, যা ঢাকাকে উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্তকারী (বর্তমানে ময়মনসিংহ রোড নামে পরিচিত) সড়কটির নিরাপত্তা বিধান করত। অন্য সড়কটি পূর্বদিকে চলে গিয়ে রাজধানীকে ফতুল্লার (পুরাতন ধাপা) সঙ্গে যুক্ত করেছে, যেখানে দুটি দুর্গ রয়েছে। আরও বিস্তৃত হওয়া এই সড়কটি দিয়ে খিজিরপুর পর্যন্ত যাওয়া যেত এবং সেখানেও দুটি দুর্গ অবস্থিত ছিল। ফতুল্লার অদূরে পাগলা সেতুটি এই রাস্তায় অবস্থিত। মীর জুমলা কর্তৃক নির্মিত সড়ক ও দুর্গগুলির কিছু অংশ এখনও বিদ্যমান।

বাংলায় মীরজুমলার শাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে তাঁর উত্তর-পূর্ব সীমান্ত নীতি, যার দ্বারা তিনি সীমান্তবর্তী কামরূপ এবং আসাম রাজ্যগুলি জয় করেছিলেন। কুচবিহার ছিল সামন্ত রাজ্য, কিন্তু উত্তরাধিকার যুদ্ধের সুযোগে রাজা প্রাণনারায়ণ আনুগত্য অস্বীকার করেন। আসামের রাজা জয়ধ্বজ সিংহ কামরূপ দখল করে নেন। এটা আগে বাংলা সুবাহর অঙ্গীভূত ছিল। এক বিশাল সৈন্যবাহিনী ও নৌবাহিনী নিয়ে মীরজুমলা শত্রুর বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। সৈন্যবাহিনী ও নৌবাহিনীর মূল অংশ কামরূপের দিকে প্রেরণ করে তিনি নিজে কুচবিহারের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। তিনি নিকটবর্তী হলে প্রাণনারায়ণ দেশ ত্যাগ করে পাহাড়ের দিকে পালিয়ে যান। কুচবিহার দখল করতে দেড় মাসের মতো সময় লেগেছিল এবং সেখানকার প্রশাসনিক বন্দোবস্ত করে মীরজুমলা কামরূপের দিকে প্রেরিত অগ্রবর্তী দলের সঙ্গে যোগদান করেন। আসামের রাজা কামরূপ ত্যাগ করে যথেষ্ট দূরদর্শিতার পরিচয় দান করেন। তবে মীরজুমলা আসাম জয়েরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তখনকার দিনে আসাম ছিল একটি বড় ভূখন্ড এবং এর ভৌগোলিক প্রকৃতি ছিল বাংলা থেকে অনেকটা ভিন্নতর। কিন্তু কিছুই মীরজুমলাকে নিরুৎসাহিত করতে পারেনি। গৌহাটি থেকে যাত্রা শুরু করার পর ছয় সপ্তাহেরও কম সময়ে মীরজুমলা আসামের রাজধানী গড়গাঁও পর্যন্ত এলাকা জয় করেন। রাজা যেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেই ভূখন্ডটি ছিল ঘোড়া ও সৈন্যদের পক্ষে দুর্গম উঁচু পাহাড়। বর্ষাকালে মুগল সৈন্যবাহিনী কিছু উঁচু ভূমিতে আটকে পড়ে, রাস্তাঘাট ডুবে যায় এবং ছোট ছোট নদী, এমনকি নালাগুলিও (নর্দমা) স্ফীত হয়ে বড় নদীর আকার ধারণ করে। অসমিয়াগণ চারদিক থেকে তাদের অভ্যাসগত রাত্রিকালীন আক্রমণ চালিয়ে মুগলদের নাজেহাল করে; রাস্তাগুলি প্লাবিত হওয়ার ফলে কোন কিছু পাঠানো অসম্ভব হয়ে পড়ে যার ফলে ঘাঁটি থেকে তাদের জন্য খাদ্য দ্রব্যাদি আসাও বন্ধ হয়ে যায়। শিবিরগুলিতে মানুষ ও পশুর জন্য প্রচন্ড খাদ্যাভাব দেখা দেয়। সৈন্যগণ যুদ্ধের জন্য সজ্জিত ঘোড়াগুলি হত্যা করতে শুরু করে এবং বহু কষ্টে মুগলগণ সম্পূর্ণ ধ্বংসের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম হয়। খাদ্যাভাব ছাড়াও দূষিত ও অস্বাস্থ্যকর বায়ু এবং জলের কারণে মুগল শিবিরগুলিতে মহামারি দেখা দেয়। এর ফলে মীরজুমলার সৈন্যবাহিনীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মৃত্যুমুখে পতিত হয়। মীরজুমলা নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েন।

বর্ষাকাল শেষ হলে মীরজুমলা ও আসামের রাজা দুজনই এক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করতে সম্মত হন। এর শর্তাবলি মুগলদের অনুকূল হলেও মীরজুমলার প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই অধিকৃত আসাম ভূখন্ড হাতছাড়া হয়ে যায়। ফিরে আসার পথে খিজিরপুরের কাছে মীর জুমলার মৃত্যু হয় (৩০ মার্চ, ১৬৬৩ খ্রি)।

দেশের অর্থনীতিতে ব্যবসা ও ব্যবসায়ীদের অবদান সম্পর্কে মীরজুমলা অবগত ছিলেন। বাংলার সুবাহদার হিসেবে তিনি ব্যবসায়ীদের স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য রেখেছিলেন। তাঁর আমলে পর্তুগিজদের বাণিজ্যের অবনতি ঘটেছিল। কিন্তু, তাদের স্থান নেওয়ার জন্য ওলন্দাজ ও ইংরেজ কোম্পানিগুলির আবির্ভাব ঘটেছিল। তারা তাঁর ক্ষমতায় ভীত ছিল এবং তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থনা করত। রাজকীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ইতোমধ্যে তাদেরকে প্রদত্ত বাণিজ্যিক সুবিধাদি ভোগ করার জন্য তিনি ইউরোপীয় কোম্পানিগুলিসহ বিদেশী বণিকদের সাহায্য করেছিলেন।

নিজের চেষ্টায় সামান্য অবস্থা থেকে অতি উচ্চপদে উন্নীত মানুষ মীরজুমলা ছিলেন সতেরো শতকে ভারতের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের অন্যতম। তিনি ছিলেন উদ্যোগী এবং নম্র ও সৌহার্দ্যপূর্ণ। একজন সাধারণ কেরানি হিসেবে জীবন শুরু করে তিনি মুগল সাম্রাজ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সেনাপতি ও সুবাহদার হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ রাষ্ট্র পরিচালক এবং দূরদর্শী ব্যক্তি। একজন ন্যায়পরায়ণ ও দয়ালু মুগল সুবাহদার হিসেবে তিনি স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন।  [আবদুল করিম]

গ্রস্থপঞ্জি  JN Sarkar (ed.), History of Aurangzib, II, New Delhi, 1972-74; Jagadish Narayan Sarkar, The life of Mir Jumla the General of Aurangzib, Calcutta, 1979; A Karim, History of Bengal, Mughal Period, II, Rajshahi, 1995.