মীরকাসিম

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২২:৪৫, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

মীরকাসিম  বাংলার নওয়াব (১৭৬০-১৭৬৩ খ্রি)। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দের ২০ অক্টোবর মীরজাফরকে অপসারণ করে তাঁর জামাতা মীরকাসিমকে মুর্শিদাবাদের মসনদে অধিষ্ঠিত করে। সুদক্ষ ও উচ্চাভিলাষী মীরকাসিম প্রথম সুযোগেই স্বীয় স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর হন। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শোষণের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন ভারতের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। তবে বাংলার নওয়াবী লাভের জন্য এরই মধ্যে তিনি তাঁর দেশের ভাগ্যকে বন্ধক দিয়েছেন। ইংরেজ সেনাবাহিনীর ব্যয় নির্বাহের জন্য তিনি বর্ধমান, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রাম এ তিনটি জেলার রাজস্ব আয় তুলে দিয়েছিলেন ইংরেজদের হাতে। মীরজাফরের বকেয়া দেনা পরিশোধের দায়িত্ব তাঁর উপরই বর্তেছিল। এছাড়াও কলকাতা কাউন্সিলকে নগদ দুই লক্ষ পাউন্ড দিতে হয়েছিল। মীরকাসিম ভেবেছিলেন, যেহেতু তিনি ইংরেজ কোম্পানি ও কর্মকর্তাদের প্রচুর অর্থের বিনিময়ে তাঁকে সিংহাসনে বসানোর ঋণ শোধ করেন, কোম্পানির উচিত তাঁকে স্বাধীনভাবে বাংলা শাসন করতে দেওয়া। তিনি অনুধাবন করেন যে, স্বাধীনভাবে বাংলা শাসন করার জন্য অপরিহার্য ছিল একটি পরিপূর্ণ রাজকোষ এবং একটি দক্ষ সেনাবাহিনী। এভাবে বাংলায় দুটি প্রতিপক্ষ শক্তির উদ্ভব হয়, যারা নিজ নিজ শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার উদ্দেশ্যে জরুরি তহবিল সংগ্রহে মনোনিবেশ করে। তবে এক পক্ষের সামরিক ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নির্ভরশীল ছিল অপর পক্ষের ধ্বংসের ওপর। ফলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। তবে নওয়াবের সুচতুরতায় এবং কলকাতা কাউন্সিলে দলাদলির কারণে তিন বছর পর্যন্ত যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়।

সুদক্ষ কূটনীতির মাধ্যমে মীরকাসিম মুগল বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ আলম এর স্বীকৃতি-সনদ লাভ করেন এবং তাঁকে বিহার ছেড়ে যেতে প্রলুব্ধ করেন। তিনি জানতেন যে নৌশক্তির প্রাধান্যের কারণে বিগত পঞ্চাশ বছরে ইংরেজরা গঙ্গানদীর নিম্নাঞ্চলে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছে। তিনি এমন একটি কৌশল অবলম্বন করেন যাতে ইংরেজরা নিম্ন গঙ্গার বদ্বীপ অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকে এবং তাদের গানবোটসমূহ উত্তর গঙ্গা অঞ্চলে ঢুকতে না পারে। এরপর তিনি একটি সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী গঠনের উদ্দেশ্যে এবং কলকাতা হতে ইংরেজ কোম্পানির অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ এড়ানোর লক্ষ্যে নদীবহুল মুর্শিদাবাদ থেকে পার্বত্য মুঙ্গের জেলায় তাঁর রাজধানী স্থানান্তরে মনোনিবেশ করেন। এসব কাজের জন্য তাঁর প্রচুর অর্থের প্রয়োজন ছিল। খাজনামুক্ত বিপুল পরিমাণ লাখেরাজ জমিকে খাজনার আওতায় এনে, ভূমির নতুন জরিপ এবং ভূমিকর বৃদ্ধি করে তিনি রাষ্ট্রের রাজস্ব আয় বাড়াতে সমর্থ হন। যে সকল জমিদার বর্ধিত ভূমি রাজস্ব প্রদান করতে অনিচ্ছুক ছিল তিনি তাদের উচ্ছেদ করেন। এভাবে রাষ্ট্রের রাজস্ব আয় উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। ফলে পলাশীর যুদ্ধ এর পর এই প্রথম নওয়াব তাঁর সেনাবাহিনী ও আমলাদের নিয়মিত বেতন প্রদান করতে সমর্থ হন। এরপর তিনি ইংরেজ কর্মকর্তাদের দুর্নীতির ফলে রাজস্ব ক্ষেত্রে নওয়াবের যে ক্ষতি হচ্ছিল তার প্রতিকার বিধানে তৎপর হন। এই কাজটি ইংরেজরা পছন্দ করেনি। ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দের মুগল বাদশাহের ফরমানের অপব্যবহার করে ইংরেজ কোম্পানির কর্মকর্তাদের বিনাশুল্কে দেশের অভ্যন্তরে পণ্যদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয় এবং বিদেশে রপ্তানিতে নওয়াবের বাধা প্রদানকে তারা বেশি অপছন্দ করে। অথচ ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে মুগল বাদশাহের ফরমান অনুসারে ইংরেজ কোম্পানির বৈদেশিক বাণিজ্যের আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে কর মওকুফ করা হলেও লবণ ও তামাকের মতো পণ্যের ক্ষেত্রে কোম্পানির কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের ওপর অভ্যন্তরীণ শুল্ক প্রদানের বিধান ছিল। কিন্তু ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে মীরজাফরের সঙ্গে ক্লাইভের স্বাক্ষরিত চুক্তিতে কোম্পানির কর্মকর্তাদের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে শুল্ক মওকুফের বিষয়টি উল্লেখিত না হলেও রবার্ট ক্লাইভ মীরজাফরের কাছ থেকে কোম্পানির কর্মকর্তাদের জন্য বিনাশুল্কে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের অনুমতি আদায় করেন। ফলে কোম্পানির কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসার প্রভূত উন্নতি সাধিত হলেও দেশীয় ব্যবসায়ীদের ব্যবসা-বাণিজ্যে কর আরোপিত হওয়ায় ইংরেজ কোম্পানি ও কর্মকর্তাদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তারা মার খেয়ে যায়। তবে কোম্পানির কর্মকর্তারা তাদের অনুগত ভারতীয় ব্যবসায়ীদের অবৈধভাবে বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতিপত্র বা দস্তক সরবরাহ করায় সেসব অসাধু ভারতীয় ব্যবসায়ীরাও শুল্ক ফাঁকি দিচ্ছিল। ফলে ভারতীয় সৎ ব্যবসায়ীদের ব্যবসা ধ্বংসের প্রায় দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়। নওয়াব তাঁর প্রত্যাশিত কর থেকেও বঞ্চিত হন, অথচ তখন তাঁর শুল্কক্ষেত্রে অধিক আয়ের প্রয়োজন ছিল।

কলকাতা কাউন্সিল ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মাত্র শতকরা নয় ভাগ শুল্ক প্রদানেও অসম্মতি জ্ঞাপন করে, যদিও তখন দেশীয় ব্যবসায়ীদের শতকরা চল্লিশ ভাগ কর প্রদান করতে হতো। কলকাতা কাউন্সিল ওই নয় ভাগ শুল্ক প্রদানে কোন সমস্যার সৃষ্টি হলে নওয়াবের ফৌজদারদের হস্তক্ষেপেরও বিরোধিতা করে। পরে নওয়াব কর্তৃক ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের লবণের ব্যবসার ক্ষেত্রে শুল্ক শতকরা নয় ভাগ থেকে হ্রাস করে মাত্র শতকরা আড়াই ভাগে নির্ধারণ করা হলেও কোম্পানি নওয়াবের কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপের অধিকার মানতে অস্বীকার করে। রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা বিধানে নওয়াবের দৃঢ়তার ফলে ইংরেজ কোম্পানির সাথে তাঁর সম্পর্কের অবনতি ঘটে। নওয়াব স্থানীয় ব্যবসায়ীদের বাণিজ্য শুল্ক রহিত করে ইংরেজদের উপর প্রতিশোধ নেন; তিনি ইংরেজ ব্যবসায়ীদের পায়ের তলার মাটি সরিয়ে দেন এবং তাঁর প্রজাদের ব্যবসার ক্ষেত্রে ইংরেজদের সমান সুযোগ দেন। কিন্তু ইংরেজ বণিকরা দেশীয় ব্যবসায়ীদের সাথে সমতার ভিত্তিতে ব্যবসা-বাণিজ্য চালাতে অনীহা প্রকাশ করে এবং দেশীয় ব্যবসায়ীদের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের উপর পুনরায় কর আরোপের জন্য নওয়াবকে চাপ দিতে থাকে। এভাবে বাংলায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় কোম্পানির একগুঁয়ে আচরণ নিয়ন্ত্রণ এবং তাদের আইনের আওতায় এনে নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় নওয়াবের অনমনীয় মনোভাবের ফলে ইংরেজদের সঙ্গে তাঁর সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে।

ইংরেজ কোম্পানির ঋণ শোধ করার পরও মীরকাসিমকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। সেনাবাহিনীর বিপুল বকেয়া বেতন পরিশোধ করা, দরবারের খরচ কমানো এবং জমিদারদের ক্ষমতা খর্ব করার মতো যোগ্যতা প্রদর্শন করা সত্ত্বেও তাঁকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। প্রথম থেকেই কলকাতা কাউন্সিলের অধিকাংশ সদস্য তাঁর প্রতি সন্দেহ ও শত্রুতার মনোভাব পোষণ করতে থাকে।

পাটনায় সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। সেখানে ইংরেজ ‘রেসিডেন্ট’ এলিসের আচরণে অতিষ্ঠ নওয়াবের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। ১৭৬৩ সালের গ্রীষ্মকালে নওয়াব বাহিনীর সাথে ইংরেজদের যুদ্ধ বাঁধে। কাটোয়া, মুর্শিদাবাদ, গিরিয়া, সুটি, উদয়নালা এবং মুঙ্গেরে নওয়াব বাহিনীর সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ হয়। প্রতিটি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে নওয়াব পাটনায় পালিয়ে যান। সেখান থেকে তিনি অযোধ্যায় যান। অযোধ্যার নওয়াব সুজাউদ্দৌলা এবং তখনকার রাজ্যহারা মুগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম ইংরেজদের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রামের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেন। তিন নেতা ত্রিপক্ষীয় শক্তিসংঘ গঠন করে ইংরেজদের হাত থেকে বাংলাকে পুনরুদ্ধারে সংকল্পবদ্ধ হন। ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে শরৎকালে পুনরায় যুদ্ধ শুরু হয়। ২২ অক্টোবর বক্সার নামক স্থানে চূড়ান্ত যুদ্ধ সংঘঠিত হয় এবং ইংরেজ বাহিনী জয়লাভ করে। পরাজিত মুগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম ইংরেজদের সঙ্গে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেন। সুজাউদ্দৌলা রোহিলাখন্ডে ফিরে যান এবং অযোধ্যা ইংরেজদের পদানত হয়। মীরকাসিম নিরুদ্দেশ হন এবং ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির নিকটে কোন এক স্থানে তাঁর মৃত্যু হয়।

ইংরেজদের বিরুদ্ধে মীরকাসিমের এই সংক্ষিপ্ত অথচ চূড়ান্ত যুদ্ধ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এই যুদ্ধ ছিল নওয়াব ও ইংরেজ বাহিনীর মধ্যে মুখোমুখি যুদ্ধ। উভয় পক্ষই এর পরিণাম সম্পর্কে অবগত ছিলেন। মীরকাসিম ভাল করেই জানতেন যে, ইংরেজদের সঙ্গে তাঁর এই যুদ্ধ ছিল তাঁর নীতিরই পরিণতি। সে কারণেই তিনি প্রথম সুযোগেই সাধ্যানুসারে তাঁর সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করেন। সমসাময়িক ভারতীয় শাসকদের তুলনায় তিনি কোন অংশেই অযোগ্য ছিলেন না। তাঁর পুনঃপুন পরাজয়ে তাঁর সেনাবাহিনী এবং বাংলার প্রশাসনযন্ত্রের অন্তর্নিহিত দুর্বলতাই প্রমাণ করে। তবুও ইংরেজদের বিরুদ্ধে তিনি যে কনফেডারেসি বা শক্তিসংঘ গঠন করেন তা তাঁর কূটনৈতিক পরিপক্কতার প্রমাণ এবং সেটা তাঁর যুগের তুলনায় অনেক অগ্রগামী ছিল। এ কূটনৈতিক পারদর্শিতার পরাজয় এ কথাই প্রমাণ করে যে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর অন্তর্নিহিত দুর্বলতাই ছিল এ পরাজয়ের প্রধান কারণ। মীরকাসিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভের ফলে ইংরেজরা পলাশী যুদ্ধের বিজয়ের তুলনায় অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিজয় অর্জন করে, যা তাদের প্রকৃত শাসকের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে।  [মোহাম্মদ শাহ]