মাল জামিনী

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২২:৪৩, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

মাল জামিনী  ফার্সি শব্দ। ‘মাল’ ও ‘জামিন’ হতে উদ্ভূত। ‘মাল’ শব্দের অর্থ যে কোন ধরনের সম্পত্তি যা বাংলার রাজস্ব ব্যবস্থায় বিশেষত ভূমি  রাজস্বকে বোঝায়  এবং ‘জামিন’ বলতে রাজস্ব বা ঋণ পরিশোধের নিশ্চয়তা প্রদানকারী বা জামিনদারকে বোঝায়। অতএব মাল-জামিনী বলতে রাজস্ব পরিশোধের নিশ্চয়তা প্রদান এর ব্যবস্থা বা  জামিনদারি ব্যবস্থাকে বোঝায়। আঠারো শতকে মুর্শিদকুলী খানের রাজস্ব ব্যবস্থা সংক্রান্ত কার্যক্রমে এ শব্দটির প্রয়োগ হয়। রাজস্ব প্রশাসনে শৃঙখলা বিধানের জন্য সুবাহ বাংলার দীউয়ান-সুবাহদার মুর্শিদকুলী খান (১৭০০-১৭২৭) রাজস্ব আদায়ের বার্ষিক ইজারা গ্রহণকালে নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব যথাসময়ে রাজকোষে জমাদান নিশ্চিত করার জন্য নতুন ইজারাদারদের পক্ষ থেকে নিরাপত্তামূলক মুচলেকা প্রদানের জন্য চাপ প্রয়োগ করেন বলে উল্লেখ আছে।

আকবরের বিভাজক রাজস্ব তালিকা (১৫৮২) সংশোধনকল্পে মুর্শিদকুলী খানের পূর্ণাঙ্গ রাজস্ব তালিকার (১৭২২) কতিপয় বৈশিষ্ট্য বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। কারণ, এই রাজস্ব ব্যবস্থার বিশদ বিবরণ সম্পর্কে প্রামান্য তথ্যের অভাব ছিল। পন্ডিতদের মতে, মাল জামিনী প্রথা মুর্শিদকুলী খানের রাজস্ব ব্যবস্থার সমার্থক। অন্যদের মতে এটি তাঁর সামগ্রিক রাজস্ব সংস্কারের অংশবিশেষ।

মুর্শিদকুলী খানের দীউয়ানের দায়িত্ব গ্রহণকালে রাষ্ট্রের আয়ের প্রধান উৎস ভূমিরাজস্ব অত্যন্ত হ্রাস পায় এবং সরকারকে মূলত পণ্যশুল্কের উপর নির্ভর করতে হয়। দেশের চাষযোগ্য ভূমির এক উল্লেখযোগ্য অংশ রাজকর্মচারীদের বেতনের পরিবর্তে জায়গির হিসেবে বরাদ্দ করাই ছিল এর মূল কারণ। এছাড়া জমিদারগণ বংশানুক্রমিকভাবে বাংলার ভূমি মালিকানার ক্ষেত্রে একচেটিয়া অধিকার ভোগ করলেও তাঁরা তাঁদের প্রদেয় রাজস্ব বছরের পর বছর বকেয়া ফেলে রাখতেন। এই অপব্যবস্থা সরকারকে একটি নিয়মিত  বার্ষিক আয়ের সুফল হতে বঞ্চিত করে। রাজস্ব আয়ের যথাসম্ভব বৃদ্ধি তার মূল লক্ষ্য হওয়ায় মুর্শিদকুলী খান প্রথমে বাংলার উর্বর ভূমিতে জায়গির প্রদানের পরিবর্তে উড়িষ্যার কম উর্বর ভূমিতে জায়গির দানের ব্যবস্থা করেন। দ্বিতীয়ত, ভূমি জরিপ ও পরিমাপের পর তিনি রাজস্ব ধার্য করেন। অতঃপর আর্থিক বছরের সূচনা দিবসে পুণ্যাহ অনুষ্ঠানে বন্দোবস্ত অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদানের মুচলেকা দানে সম্মত ইজারাদার বা রাজস্ব ঠিকাদারদের ভূমি পত্তনি দিতেন। ইতিপূর্বে যদিও রাজস্ব ইজারাদারদের রাজকীয় কোষাগারে চুক্তি নবায়নের  প্রথা চালু ছিল, কিন্তু তা ছিল একটি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র; কারণ ইজারাদার বা রাজস্ব পত্তনিদারগণ বংশানুক্রমিকভাবে বিভিন্ন শ্রেণির জমিদারে পরিণত হয়েছিলেন এবং বার্ষিক বন্দোবস্তের সময় তাদের কোন নিরাপত্তামূলক মুচলেকা সম্পাদন করতে হতো না। আমিল, আমিন, কানুনগো, শিকদার, পাটোয়ারী প্রভৃতি সরকারি কর্মকর্তাগণ ভূমি জরিপ, রাজস্ব নির্ধারণ এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে রাজস্ব আদায় তত্ত্বাবধান করতেন। সরকারগুলির (জেলা) দায়িত্বে নিয়োজিত ফৌজদারগণ (সামরিক প্রশাসক) রাজস্ব সঠিকভাবে কেন্দ্রে  প্রেরণের কার্যক্রম দেখাশোনা করতেন।

সম্রাটের কর্তৃত্ব হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজস্ব পত্তনিদার, বিশেষ করে বড় বড় জমিদারদের উপর সরকারের  নিয়ন্ত্রণ  হ্রাস পায়। এরূপ পরিস্থিতিতে মুর্শিদকুলী খান ভূমি মালিকানা ব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন আনতে সচেষ্ট হন। তিনি ভূমি জরিপ ও পরিমাপ ব্যবস্থা কঠোরভাবে প্রয়োগ করেন। এরপর বন্দোবস্তপ্রাপ্ত রাজস্ব পত্তনিদারগণ নিশ্চয়তামূলক মুচলেকা প্রদান করে সরকারের সঙ্গে নতুন চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারতেন। কোন কোন পন্ডিত মনে করেন যে, মুর্শিদকুলীর সময়ে রাজস্ব প্রশাসনে ব্যাপকভাবে নিয়োজিত আমিলগণ মুচলেকা দাতা জমিদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। কিন্তু এটাই অধিকতর সঙ্গত মনে হয় যে, আমিলদের উপর তাঁর নির্ভরতা সত্ত্বেও নিজেদের এখতিয়ারভুক্ত এলাকার ক্ষুদ্র জমিদারিগুলির রাজস্ব প্রেরণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত নবনিযুক্ত চাকলাদারগণই সম্ভবত মুচলেকা দাতা জমিদারের ভূমিকা পালন করতেন।  [শিরীন আখতার]