ভূমিকম্প

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৪:৪৫, ২ মার্চ ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

ভূমিকম্প (Earthquake)  ভূ-পৃষ্ঠে সংঘটিত আকস্মিক ও অস্থায়ী কম্পন। ভূ-অভ্যন্তরস্থ শিলারাশিতে সঞ্চিত শক্তির আকস্মিক অবমুক্তির কারণে সৃষ্ট এই স্পন্দনের মাত্রা মৃদু কম্পন থেকে প্রচন্ড ঘূর্ণনের মধ্যে হতে পারে। ভূমিকম্প হচ্ছে তরঙ্গ গতির এক ধরনের শক্তি, যা সীমিত পরিসরে উদ্ভূত হয়ে ঘটনার উৎস থেকে সকল দিকে ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণত কয়েক সেকেন্ড থেকে এক মিনিট পর্যন্ত ভূমিকম্প স্থায়ী হয়। স্থলভাগের যে বিন্দুতে ভূমিকম্পের তরঙ্গ সূচিত হয় তাকে কেন্দ্র বলে এবং এই কেন্দ্র থেকে স্পন্দন সকল দিকে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম এটি কেন্দ্রের ঠিক উপরের বিন্দু বরাবর ভূ-পৃষ্ঠে অনুভূত হয় যাকে উপকেন্দ্র (epicentre) বলে। এই উপকেন্দ্রেই ভূমিকম্পের প্রথম ঝাঁকি অনুভূত হয়। কেন্দ্রের গভীরতার ভিত্তিতে ভূমিকম্পকে অগভীর কেন্দ্র (০-৭০ কিমি), মাঝারি কেন্দ্র (৭০-৩০০ কিমি) ও গভীর কেন্দ্র (৩০০ কিমি) ইত্যাদি সংজ্ঞায় অভিহিত করা হয়। ভূমিকম্পের আকার পরিমাপের সবচেয়ে প্রচলিত মাপক হচ্ছে রিকটারের মান (M)। রিকটার স্কেলে তীব্রতা নির্ধারণে সিসমোগ্রামে সর্বোচ্চ পৃষ্ঠ তরঙ্গ বিস্তার (Surface Wave Amplitude) এবং প্রাথমিক (P) ও মাধ্যমিক (S) তরঙ্গ পৌঁছানোর সময়ের পার্থক্যকে ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন কারণে ভূমিকম্প ঘটে। সেগুলিকে দুটি প্রধান শ্রেণীতে ভাগ করা যায়, যেমন: ভূ-গাঠনিক ও অ-ভূ-গাঠনিক। অধ্যাপক এইচ.এফ রীড ভূগাঠনিক ভূমিকম্পের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইলাসটিক রিবাউন্ড থিওরি উপস্থাপন করেছেন।

বিশ্বে ভূমিকম্পের বণ্টন বৈষম্যমূলক। অবশ্য প্রায় সকল ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্প দুটি সুপরিচিত অঞ্চল বা বলয়ে উদ্ভূত হতে দেখা যায়। যেমন, দি সারকাম-প্যাসিফিক বেল্ট বা প্রশান্ত মহাসাগরীয় বলয় এবং ভূমধ্যসাগরীয় হিমালয় ভূকম্পনীয় বলয়।

বাংলাদেশ ভূমিকম্পের জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল হলেও এই কম্পনের প্রকৃতি ও মাত্রা সম্পর্কে ধ্যানধারণা খুবই অপ্রতুল। বাংলাদেশে ভূমিকম্প অনুধাবনের প্রয়োজনীয় সুবিধা পাওয়া যায় না। আবহাওয়া দপ্তর ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রামে একটি ভূকম্পন মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করে। আজও সেটিই দেশের একমাত্র মানমন্দির।

ভূমিকম্পের ইতিহাস ভূ-গাঠনিক কার্য-কারণের ভিত্তিতে বাংলাদেশে ভূ-কম্পন মূল্যায়নে ভূমিকম্প সম্পর্কিত ঐতিহাসিক তথ্যের প্রেক্ষাপট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের ভিতরে ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহের বিগত ২৫০ বছরের ভূকম্পনের ইতিহাস পাওয়া যায়। ভূমিকম্পের রেকর্ড থেকে দেখা যাচ্ছে ১৯০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত শতাধিক মাঝারি থেকে বড় ধরনের ভূমিকম্প বাংলাদেশে সংঘটিত হয়েছে, যার মধ্যে ৬৫টিরও বেশি আঘাত হেনেছে ১৯৬০ সালের পরে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বিগত ৩০ বছরে ভূমিকম্পের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। ভূমিকম্প ঘটনার এই বৃদ্ধি নতুন ভূ-গাঠনিক ক্রিয়া বা সংলগ্ন ভূকম্পনীয় অঞ্চল থেকে ফাটলের ইঙ্গিত প্রদান করে। ইউরোপীয়রা এ দেশে আসার পূর্বে ভূমিকম্পের কোন নির্দিষ্ট লিপিবদ্ধ তালিকা ছিল না। ১৫৪৮ সাল থেকে এই অঞ্চলের কয়েকটি ভয়াবহ ভূমিকম্পের কালানুক্রমিক বিবরণ নিচে দেওয়া হলো:

কালানুক্রম

১৫৪৮ প্রচন্ড এই ভূমিকম্পটি প্রথম লিপিবদ্ধ ভূমিকম্পের ঘটনা। এতে সিলেট ও চট্টগ্রাম ভীষণভাবে প্রকম্পিত হয়, বহু স্থানে ধরণী দুই ভাগ হয়ে যায় এবং গন্ধকীয় বাসযুক্ত পানি ও কাদা শূন্যে উৎক্ষিপ্ত হয়।
১৬৪২ তীব্রতর এই ভূমিকম্পে সিলেট জেলায় মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হয়। দালানকোঠায় ফাটল দেখা দেয়, যদিও প্রাণহানি ঘটে নি।
১৬৬৩ আসামের এই প্রলয়ংকরী ভূমিকম্প থেমে থেমে আধ ঘণ্টা স্থায়ী হয় এবং সিলেট জেলাও এর কম্পন থেকে রেহাই পায় নি।
১৭৬২ ২ এপ্রিল সংঘটিত এই ভয়াবহ ভূমিকম্পের ফলে ফাউল দ্বীপ উপকূল ২.৭৪ মিটার ও চেদুয়া দ্বীপের উত্তর-পশ্চিম উপকূল ৬.৭১ মিটার সমুদ্রপৃষ্ঠের উপরে উঠে যায়। এর ফলে চট্টগ্রামের কাছে ১৫৫.৪০ বর্গ কিমি এলাকা স্থায়ীভাবে দেবে যায়। এই ভূমিকম্প ঢাকা ও চট্টগ্রাম পর্যন্ত মেঘনার পূর্বতীর বরাবর প্রচন্ডভাবে অনুভূত হয়। ঢাকায় মোট ৫০০ লোকের প্রাণহানি ঘটে। এখানকার নদী ও খাল-বিলের পানি উপচে স্বাভাবিক মাত্রার উপরে উঠে আসে এবং পরে এই পানি যখন নেমে যায় তখন মরা মাছের আস্তরণে নদীর তীর ভরে যায়। একটি বড় নদীর পানি সম্পূর্ণভাবে উপচে নদীটি শুকিয়ে যায়। এক খন্ড ভূমি ডুবে গিয়ে দুশ লোক ও অনেক গবাদিপশু মারা যায়। সীতাকুন্ড পাহাড়ে দুটি আগ্নেয়গিরির সৃষ্টি হয়।
১৭৭৫ ১০ এপ্রিল ঢাকার আশপাশে এই তীব্র ভূমিকম্প অনুভূত হয়। কোন প্রাণহানি ঘটে নি।
১৮১২ সিলেটে প্রচন্ড এই ভূমিকম্প সংঘটিত হয় ১১ মে।
১৮৬৫ দ্বিতীয় দফা আঘাত হানে ১৮৬৫ সালের শীতকালে। এর প্রচন্ড আঘাত ব্যাপকভাবে অনুভূত হলেও মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি তেমন হয় নি।
১৮৬৯ সিলেটে এটি সবচেয়ে বেশি মাত্রায় সংঘটিত হয়। এর ফলে জেলার পূর্বাঞ্চলে গির্জার চূড়া ভেঙে পড়ে, আদালত ভবন ও সার্কিট বাংলোর দেয়ালে চিড় ধরে, বহু নদীর তীর দেবে যায়, তবে প্রাণহানির কোন খবর পাওয়া যায় নি।
১৮৭৬ ১৩ ডিসেম্বর সংঘটিত হয় এই ভূমিকম্প।
১৮৭৬ ১৪ জুলাই সংঘটিত এই ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল মানিকগঞ্জ। তীব্রতা ছিল ৭.০।
১৮৯৭ ১২ জুন বিকেল ৫.১৫ মিনিটে সংঘটিত এই ভূমিকম্প ৩,৭৫ ৫৫০ বর্গ কিমি এলাকায় পাকা দালান কোঠার ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। শুধু সিলেট জেলাতেই এই প্রাকৃতিক তান্ডবে মৃতের সংখ্যা ৫৪৫-এ দাঁড়ায়। এদের অধিকাংশই বাড়িঘর চাপা পড়ে মারা যায়। পূর্বে দক্ষিণ লুসাই পাহাড় থেকে পশ্চিমে শাহবাদ-বাংলার সর্বত্র এই ভূকম্পন অনুভূত হয়। ময়মনসিংহ সদরে আদালত ভবনসহ বহু সরকারি ভবন বিধ্বস্ত হয় এবং জমিদারদের ব্যবহূত দ্বিতল ভবনের খুব কমই অক্ষত থাকে। যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয় এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ রেল যোগাযোগ ও অন্যান্য যানবাহন প্রায় এক পক্ষকাল বন্ধ থাকে। জেলার নৌ যোগাযোগ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়। ব্যাপকভাবে প্রাণহানি না ঘটলেও সহায়-সম্পত্তির ক্ষতির হিসাব তখনকার হিসাবে পঞ্চাশ লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়। রাজশাহী, বিশেষ করে এর পূর্বাঞ্চল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যদিও প্রাণহানি তুলনামূলকভাবে কম ছিল। ১৫ জন  নিহত ও কিছু লোক আহত হয়। মালামাল ও সম্পত্তির ক্ষতি বিশেষ করে ঢাকা শহরে খুব বেশি ছিল। ত্রিপুরায় পাকা দালান, পুরানো মন্দির ইত্যাদি ভেঙে পড়ে। এখানে মোট ক্ষতির পরিমাণ তখনকার হিসাবে আনুমানিক ৯,০০০ টাকা।
১৯১৮ শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্প নামে পরিচিত। ১৮ জুলাই অনুষ্ঠিত এই ভূমিকম্পের মূল কেন্দ্র ছিল সিলেট জেলার শ্রীমঙ্গলে। তীব্রতা ছিল ৭.৬। এখানে প্রচন্ড ক্ষতি হয়, তবে ঢাকায় মৃদু কম্পন অনুভূত হয়।
১৯৩০ ৩ জুলাই অনুষ্ঠিত এই দুর্যোগের মূল কেন্দ্র ছিল আসামের ধুবড়ি। তীব্রতা ছিল ৭.১। রংপুরের পূর্বাঞ্চলে ব্যাপক ক্ষতি হয়।
১৯৩৪ এটি ঘটেছিল ১৫ জানুয়ারি। মূলকেন্দ্র ছিল ভারতের বিহার, তীব্রতা ছিল ৮.৩। বিহার-নেপাল ভূমিকম্প নামে পরিচিত। বাংলাদেশের তুলনায় বিহার, নেপাল ও উত্তর প্রদেশে ব্যাপক ক্ষতি হয়। একই বছর ৩ জুলাই আরেকটি ভূমিকম্প আসামে সংঘটিত হয়েছিল যার মাত্রা ছিল ৭.১। এই ভূমিকম্পটি বৃহত্তর রংপুর জেলায় ব্যাপক ক্ষতি করেছিল।
১৯৫০ ১৫ আগস্ট এই ভয়াবহ ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছিল ভারতের আসামে, তীব্রতা ছিল ৮.৪। আসাম ভূমিকম্প নামে পরিচিত। ভূমিকম্পটি বাংলাদেশে অনুভূত হলেও কোন ক্ষয়ক্ষতি হয় নি।
১৯৯৭ চট্টগ্রামে সংঘটিত হয় ২২ নভেম্বর। এর মাত্রা ছিল ৬.০। এতে চট্টগ্রাম শহরের সামান্য ক্ষতি হয়।
১৯৯৯ মহেশখালি দ্বীপে সংঘটিত হয় জুলাই মাসে। মূল কেন্দ্রবিন্দুও ছিল মহেশখালি দ্বীপ। মাত্রা ছিল ৫.২। মহেশখালি দ্বীপ ও সংলগ্ন সমুদ্রে অনুভূত হয়। বাড়ীঘরে স্থানে স্থানে ফাটল ধরে।
২০০২ এই বৎসরে চট্টগ্রামে মোট ৪০ বার ভূমিকম্প অনুভূত হয়।রাঙ্গামাটি জেলার বরকল উপজেলার কলাবুনিয়া ইউনিয়নে সংঘটিত হয় ২৭ জুলাই। এর মাত্রা ছিল ৫.১। এতে তিনজন লোক নিহত হয়।সুমাত্রা ভূমিকম্প নামে পরিচিত। উত্তর সুমাত্রার পশ্চিম উপকূলে ২৬শে ডিসেম্বর এই ভূমিকম্প আঘাত হানে। এর মাত্রা ছিল ৯.৩। ভয়াবহ এই ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট সুনামিতে ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী ১৪টি দেশে প্রায় দুই লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারায়। এর মধ্যে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলেও দুইজনের প্রাণহানি ঘটে।
২০০৬ নড়াইল ভূমিকম্প ২০০৬ সালের ৫ই আগস্ট আঘাত হানে। এর মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৪.২ এবং উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে প্রায় ১১০কিমি দক্ষিণপশ্চিমে।
২০০৮ মানিকগঞ্জ ভূমিকম্প ২০০৮ সালের ২০শে মার্চ ঢাকা ও তার আশেপাশের এলাকায় মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ধারণা করা হয় মধুপুর চ্যুতি হতে এই ভূমিকম্পটির উৎপত্তি। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৩.৮।
২০০৮ চাঁদপুর ভূমিকম্প ২০০৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর এই ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর উৎসস্থল ছিল চাঁদপুরের কচুয়াতে। এর মাত্রা ছিল ৪.৫।
২০০৯ ভূটান ভূমিকম্প নামে পরিচিত। ২০০৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর এই ভূমিকম্প হয়। এর উৎসস্থল ছিল ভুটানের পূর্বাঞ্চলে।
২০০৯ বঙ্গোপসাগর ভূমিকম্প নামে পরিচিত। ১১ই আগস্ট বাংলাদেশ সময় ০১:৫৫:৩৫.৬১। এর উৎপত্তিস্থল ছিল বঙ্গোপসাগরে উত্তর আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ ও বার্মার সমুদ্র উপকূলে। মাত্রা ছিল ৭.৫। বাংলাদেশে যদিও তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, তবু ঢাকায় এর তীব্রতায় মাটি কেঁপে উঠেছিল।

ভূমিকম্পের প্রবণতা বাংলাদেশ উচ্চ ভূকম্পনশীল অঞ্চলসমূহ দ্বারা পরিবেষ্টিত, যার মধ্যে রয়েছে উত্তরের হিমালয়ান আর্ক ও শিলং মালভূমি, পূর্বে বার্মিজ আর্ক ও আরাকান ইয়োমা ঊর্ধ্বভঙ্গধারা এবং উত্তর-পূর্বে জটিল নাগা ডিসাং হাফলং ঘাত অঞ্চল। এটি অসংখ্য অন্তর্ভূ-পৃষ্ঠ সক্রিয় চ্যুতি ও হিনজ জোন নামে পরিচিত একটি ভগ্ন অঞ্চলসহ বৃহৎ ডাউকি চ্যুতি ব্যবস্থার স্থল। ভূ-গাঠনিক দিক থেকে দুর্বল এসব অঞ্চল অববাহিকীয় এলাকার মধ্যে শিলা চলাচলের প্রয়োজনীয় স্থান সংকুলান করে বলে ধারণা করা হয়।

বাংলাদেশের সাধারণীকৃত ভূ-গাঠনিক মানচিত্রে মূল কেন্দ্রসমূহের বণ্টন ডাউকি চ্যুতি ব্যবস্থা বরাবর এক রেখায় এবং বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে বিক্ষিপ্তভাবে দেখতে পাওয়া যায়। মানচিত্রের অনুসন্ধানে দেখা যায়, মূল কেন্দ্রগুলি পৃষ্ঠ বা অন্তর্ভূ-পৃষ্ঠ চ্যুতিতে গঠিত দুর্বল অঞ্চলে অবস্থিত। কম্পনগুলির তীব্রতা থেকে দেখা যায় অধিকাংশ কম্পনই মাঝারি মানের (M = 4-6) এবং কম গভীরতায় অবস্থিত, যা ভিত্তিশিলায় অধিশায়িত অবক্ষেপে সাম্প্রতিক বিচলনের ইঙ্গিতবাহী। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অংশে (সুরমা বেসিন) গুরুত্বপূর্ণ কম্পনগুলি ডাউকি চ্যুতি ব্যবস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মধুপুর সোপান স্তূপের ভিতরে ও আশেপাশে সংঘটিত কম্পনসমূহ পলল থেকে স্তূপকে পৃথককারী চ্যুতির অগভীর স্থানান্তরের ইঙ্গিতবাহী।

ভূকম্পনীয় মূল কেন্দ্রের বণ্টন এবং বিভিন্ন ভূ-গাঠনিক ব্লকের ভিত্তিতে বাংলাদেশকে তিনটি সাধারণীকৃত ভূকম্পন অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়েছে, যথা  অঞ্চল-১, অঞ্চল-২ ও অঞ্চল-৩। বাংলাদেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলকে নিয়ে গঠিত অঞ্চল-১ হচ্ছে সবচেয়ে সক্রিয় অঞ্চল, যার মৌলিক ভূকম্পনীয় সহগ হচ্ছে ০.০৮। এই অঞ্চল পূর্ব সিলেটের ডাউকি চ্যুতি ব্যবস্থা, গভীর প্রোথিত সিলেট চ্যুতি এবং জাফলং ঘাত, নাগা ঘাত ও ডিসাং ঘাতের সঙ্গে উচ্চ সক্রিয় দক্ষিণ-পূর্ব আসামের অঞ্চলসমূহকে অন্তর্ভুক্ত করে। অঞ্চল-২-এর মধ্যে রয়েছে বরেন্দ্র ও মধুপুরের সম্প্রতি উত্থিত প্লাইসটোসিন ব্লকের অঞ্চলসমূহ এবং বলিত বলয়ের পশ্চিমা সম্প্রসারণ। অঞ্চল-৩ ভূকম্পায়িতভাবে আনুমানিক মৌলিক ভূকম্পনীয় সহগ ০.০৪-এর সঙ্গে প্রায় অভিন্ন। অঞ্চলটি দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করে ও ভূকম্পনীয়ভাবে শান্ত।

উপমহাদেশের প্রথম ভূকম্পনীয় অঞ্চলীকরণ মানচিত্র (Seismic Zoning Map)  জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া কর্তৃক ১৯৩৫ সালে প্রণীত হয়। বাংলাদেশ আবহাওয়া দপ্তর ১৯৭২ সালে একটি ভূকম্পনীয় অঞ্চলীকরণ মানচিত্র প্রণয়ন করে। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ সরকার ভূকম্পন সমস্যা পরীক্ষা ও যথাযথ সুপারিশ প্রদানের জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে। বিশেষজ্ঞ কমিটি একই সালে বাংলাদেশের জন্য একটি অঞ্চলীকরণ মানচিত্র প্রস্তাব করে।

প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা  ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলে ভূমিকম্পের সংঘটন ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। বরঞ্চ যা করা যেতে পারে তা হলো ভূমিকম্পের পূর্বাভাষের মাধ্যমে জানমালের ক্ষতি কিভাবে সীমিত করা যায় সে সম্পর্কে পরামর্শ প্রদান। যদিও সুনির্দিষ্ট পূর্বাভাষ সবসময় দেওয়া সম্ভব নয়, তথাপি গ্রহণযোগ্য একটা আগাম সতর্কীকরণ জানমালের ক্ষতি কমিয়ে আনতে নিশ্চিতভাবেই সক্ষম হবে। চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর আমবাগানের জরাজীর্ণ কেন্দ্র থেকে ভূমিকম্পের সঠিক উপাত্ত পাওয়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একটি বিস্তারিত ভূতাত্ত্বিক মানচিত্রায়ণের ওপর সবিশেষ গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। এই মানচিত্রে যাবতীয় ভূত্বকীয় চ্যুতির নকশা ও রৈখিক বৈশিষ্ট্যসমূহ অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। বাংলাদেশের অ্যারোম্যাগনেটিক জরিপে ইতোমধ্যেই এই সব চ্যুতির ও রৈখিক বৈশিষ্ট্যের নকশা ও বণ্টন সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেছে। বিক্ষিপ্ত গবেষণায় টারশিয়ারী অংশে চ্যুতির অস্তিত্ব চিহ্নিত করা গেলেও কোয়াটারনারী অংশ খুবই অনিশ্চিত। অনেক তথ্য-প্রমাণ থেকেই দেখা যায় উত্থান, ভূঅবনমন, ভূমি বিকৃতি ও ব্যাপক তরলীকরণ সম্পর্কিত বিভিন্ন ভূমিকম্পনীয় ঘটনা দ্বারা কোয়াটারনারী অংশ প্রভাবিত।

ভূমিকম্প দুর্যোগ প্রতিরোধ মোকাবেলায় তিনটি পদক্ষেপ অনুসরণ করা যায়, যথা: (১) প্রাক-দুর্যোগ মানব বসতি সংক্রান্ত ভৌত পরিকল্পনা, (২) দুর্যোগের ক্ষতিকর প্রভাব লাঘবে ব্যবস্থাদি গ্রহণ এবং (৩) জমিজরিপ ব্যবস্থাপনা। [সিফাতুল কাদের চৌধুরী এবং আফতাব আলম খান]