ভূমি ব্যবহার

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৪:২৫, ২ মার্চ ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

ভূমি ব্যবহার (Landuse)  ভূমির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত মানবীয় কর্মকান্ড। ভূমির সম্পদ ব্যবহার এবং এর ফলে সৃষ্ট প্রতিক্রিয়া অধ্যয়ন প্রধানত ভূমি ব্যবহারের আলোচ্য বিষয়। ভূমি আচ্ছাদন (land cover) হচ্ছে ভূমির একটি প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, অপরদিকে একটি বিশেষ আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে মানুষ কর্তৃক ভূমির ব্যবহার ধরন (pattern) হচ্ছে ভূমি ব্যবহার। মানুষ তার প্রয়োজন মেটানোর জন্য প্রাকৃতিক ভূমি আচ্ছাদনকে নিজের ব্যবহারের আওতায় নিয়ে আসে এবং এই প্রক্রিয়ায় প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক ভূমি আচ্ছাদনের পরিবর্তন সাধিত হয়ে চলছে।

ভূপ্রাকৃতিকভাবে বাংলাদেশকে প্রধান তিনটি এককে বিভক্ত করা যায়: উত্তর, উত্তরপূর্ব এবং দক্ষিণপূর্বের পাহাড়ী অঞ্চল যা দেশের প্রায় ১২ শতাংশ এলাকাজুড়ে বিস্তৃত; দেশের ৮ শতাংশ এলাকাব্যাপী বিস্তৃত প্লাইসটোসিন সোপান অঞ্চল এবং অবশিষ্ট ৮০ ভাগ এলাকা প্লাবনভূমি দ্বারা গঠিত। ভূমি ব্যবহার, বিশেষ করে বাড়ীঘর নির্মাণ, চাষাবাদ প্রভৃতি কর্মকান্ডের জন্য ভূমি নির্বাচনের ক্ষেত্রে বন্যা বা প্লাবনসীমার সাপেক্ষে ভূমির অবস্থান বিবেচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি গ্রামীণ এলাকায় বন্যার গভীরতা, স্থায়িত্ব এবং সংঘটনের সময়কালের ওপর নির্ভর করে জনগণের পেশাও বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। ভূপ্রাকৃতিক বিভিন্নতা তথা বিভিন্ন ধরনের ভূমির বণ্টনের বিভিন্নতার দরুন দেশের বিভিন্ন স্থানে ভূমি ব্যবহার ধরনে আঞ্চলিক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।

ভূপ্রকৃতি (physiography), জলবায়ু এবং প্লাবনসীমার প্রেক্ষিতে ভূমির অবস্থান-এই তিনটি নির্ণায়ক দ্বারা বাংলাদেশে ভূমি ব্যবহার ধরণ নির্ণিত হয়ে থাকে। এই প্রেক্ষাপটে দেশের রাষ্ট্রীয় সীমার আওতাভুক্ত সকল ভূমি ও নদনদী এবং জলাভূমি ভূমির অন্তর্ভুক্ত। অত্যধিক জনসংখ্যাবহুল এবং প্রাথমিক পর্যায়ের অর্থনৈতিক প্রাধান্যবিশিষ্ট এই দেশে ভূমির গুরুত্ব অপরিসীম।

ভূমি ও পানি বাংলাদেশের দুটি প্রধান প্রাকৃতিক সম্পদ। বাংলাদেশের মোট আয়তন ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিমি যার মধ্যে ৯,৭৩৪ বর্গ কিমি জুড়ে রয়েছে আভ্যন্তরীণ জলাশয় (নদনদী, বিল, ঝিল, হাওর প্রভৃতি), বাড়ীঘর দ্বারা পূর্ণ ১১,২২৭ বর্গ কিমি, নগর কাঠামোর আওতাভুক্ত রয়েছে ৯৫০ বর্গ কিমি এবং ২,১৫৪ বর্গ কিমি জুড়ে রয়েছে বনভূমি। এই পরিমাপের মধ্যে বদ্বীপভুক্ত বিভিন্ন উপকূলবর্তী দ্বীপসমূহের মধ্যবর্তী অগভীর উপকূলও অন্তর্ভুক্ত।

বাংলাদেশের মোট ভূভাগের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভূমি (২৯%) উঁচুভূমি (highland) শ্রেণীভুক্ত যা বার্ষিক স্বাভাবিক প্লাবনসীমার ঊর্ধ্বে অবস্থিত। এই উঁচুভূমি থেকে সামান্য নিচু বা মধ্যম উচ্চতার উঁচুভূমি শ্রেণীভুক্ত (Higher Medium Highland or MH-1) ভূভাগ মোট ভূভাগের এক-দশমাংশেরও বেশি এলাকা জুড়ে    বিস্তৃত (১১.৫%)। মধ্যম মাত্রার উঁচুভূমি ৩০ সেমি গভীরতায় প্লাবিত হয়ে থাকে। মধ্যম মাত্রার উঁচুভূমি থেকে নিচুভূমি যা নিম্নতর মধ্যম উঁচুভূমি শ্রেণীভুক্ত (Lower Medium Highland or MH-2) ভূমি স্বাভাবিক প্লাবন দ্বারা ৩০ থেকে ৯০ সেমি গভীরতায় প্লাবিত হয়ে থাকে এবং এই প্লাবন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্থানীয় বৃষ্টিপাতের সুষ্ঠু নিষ্কাশনের অভাবে সৃষ্টি হয়ে থাকে। মোট ভূভাগের ২৩.২% ভূমি নিম্নতর মধ্যম উঁচুভূমি বা MH-2 শ্রেণীভুক্ত। দেশের মোট ভূভাগের ১২% ভূমি মধ্যম নিচুভূমি শ্রেণীভুক্ত এবং এই মধ্যম নিচুভূমির উপর দিয়ে প্রবাহিত নদনদীর দ্বারা প্রধানত এই ভূমি ৯০ সেমি থেকে ১২০ সেমি গভীরতায় প্লাবিত হয়ে থাকে। স্বাভাবিক প্লাবনে ১৮০ সেমি এবং ৩০০ সেমি-এর মধ্যবর্তী গভীরতায় প্লাবিত ভূমিকে নিচুভূমি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। দেশের মোট ভূমির ৭.৬% ভূমি নিচুভূমি। ৩০০ সেমি-এর অধিক গভীরতায় প্লাবিত অত্যধিক নিচুভূমি দেশের মোট আয়তনের ১.৪% জুড়ে রয়েছে। অবশিষ্ট ১৫.৩% ভূমি জলাশয় এবং নগর ও গ্রামীণ বসতির আওতাভুক্ত। নগরের পরিধি প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে এই পরিমাণও বেড়ে চলেছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএস (Bangladesh Bureau of Statistics-BBS) কর্তৃক সংগৃহীত ও প্রকাশিত ভূমি ব্যবহার পরিসংখ্যান (Land Utilisation Statistics) থেকেও জাতীয় ভূমি ব্যবহার সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। বিবিএস কৃষি দৃষ্টিকোণ থেকে এই ভূমি ব্যবহার পরিসংখ্যান প্রস্ত্তত করে থাকে বলে এতে অন্যান্য ভূমি ব্যবহার সম্পর্কে অবগত হওয়ার সুযোগ সীমিত। এই ভূমি ব্যবহারে অন্তর্ভুক্ত ভূমির শ্রেণীসমূহ হচ্ছে: নীট চাষকৃত ভূমি (net cropped area), বর্তমান পতিতভূমি (current fallow), বর্তমানে খিলাভূমি (current waste), বনভূমি এবং চাষাবাদের আওতা বহির্ভুত জমি। এ প্রকার ভূমি ব্যবহার শ্রেণীবিন্যাসে চাষাবাদের আওতা বহির্ভূত জমি এবং অ-বনভূমিকে একই শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। জাতীয় ভূমি ব্যবহার মানচিত্র তৈরিতে এই শ্রেণীবিন্যাস সহায়ক নয়।

নিচের সারণিতে ২০০০ সালে বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহারের একটি মোটামুটি সঠিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ জরিপ অধিদপ্তর কর্তৃক হিসাবকৃত ভূমি এলাকা, ভূমি রেকর্ড অধিদপ্তর কৃত ভূমি রেকর্ড এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (Food and Agricultural Organaisation-FAO) কর্তৃক পরিচালিত ভূমি সম্পদ মূল্যায়ন, কৃষি শুমারী ১৯৯৬ ও কৃষি নমুনা জরিপ ১৯৯৭ থেকে প্রাপ্ত তথ্য, পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা (Water Resources Planning Organisation-WARPO), মৎস্য অধিদপ্তর, বন অধিদপ্তর, কৃষি মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র কৃষি পরিসংখ্যান বিভাগ প্রভৃতি উৎস থেকে এই ভূমি ব্যবহার সারণির মৌলিক উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে।

সারণি ভূমি ব্যবহার ২০০০ (বর্গ কিমি-এ)।

নম্বর শ্রেণীবিন্যাস শুষ্ক মৌসুম (মার্চ) বর্ষা মৌসুম (সেপ্টেম্বর)
১. নদনদী ৬,৪০০ ৭,৭০০
প্রধান প্রধান নদী ২,৮৬০ ৩৯৪০
সুন্দরবনের নদনদীসমূহ ১৬৬০ ১৬৬০
অন্যান্য নদনদী ১৮৮০ ২১০০
২. আবদ্ধ জলাশয়সমূহ ৪,২৪৫ ৯৫০০
হাওর ৪৫০ ৩৭০০
বিল ১৭৭ ১৫০০
বাঁওড় ৫৫ ৬০
পুকুর, দিঘী, ডোবা ৩০০০ ৩৫০০
কাপ্তাই হ্রদ ৫৬৩ ৭৪০
৩. বনভূমি ১৯,৬১০ ১৯৬১০
সুন্দরবন (ভূমি এলাকা) ৪১১০ ৪১১০
উপকূলীয় বনভূমি ১৪০০ ১৪০০
পার্বত্য বনভূমি ৬০০০ ৬০০০
পার্বত্য গুল্ম ও তৃণভূমি ৬৯০০ ৬৯০০
সমতলীয় বনভূমি ও গুল্মভূমি ১২০০ ১২০০
৪. চাষাবাদকৃত ভূমি ৭৭,৬০০ ৭৩৫০০
শস্যভূমি ৫১০০০ ১৭১৪০
বৃজাতীয় শস্যভূমি ৪৯০০ ৪৯০০
সাময়িক পতিতভূমি ১৭০০০ ১৬৭৬০
বর্তমানে পতিতভূমি ৪১০০ ৪১০০
শুধুমাত্র বীজতলা ৬০০ ৬০০
৫. লবণাক্ত-স্বাদুজলীয় মৎস্যচাষ ১৯০০ ১৯০০
৬. লবণত্রে ৫০
৭. গ্রামীণ অবকাঠামো ৭০০০ ৭০০০
বাড়ীঘর ৫৫০০ ৫৫০০
প্রতিষ্ঠান ১৫০০ ১৫০০
৮. চাষাবাদ বহির্ভূত গ্রামীণ ভূমি ৮৪০০ ৮৪০০
চাষাবাদযোগ্য পতিতভূমি ৫৮০০ ৫৮০০
বাঁশ ঝাড় ১২৫০ ১২৫০
বনজঙ্গল ১৩৫০ ১৩৫০
৯. নগরভূমি ৭০০০ ৭০০০
১০. অবকাঠামো ২১০০ ২১০০
১১. মোহনা এলাকা ৮৬০০ ৮৬০০
মোট ১৪৭৫৭০ ১৪৭৫৭০

একক বৃহত্তম ভূমি ব্যবহার হচ্ছে কৃষি ভূমি ব্যবহার, তবে সকল প্রকার ভূমি ব্যবহার নির্ণয়কারী মৌলিক প্রাকৃতিক বৈশিষ্টসমূহ হচ্ছে জলপ্রবাহসমূহ এবং আবদ্ধ জলাশয়সমূহ। বাংলাদেশের মোট ভূভাগের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে রয়েছে জলাভূমি। বর্ষা ঋতুতে দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এলাকাকে রামসার কনভেনশনে প্রদত্ত জলাভূমির সংজ্ঞানুযায়ী জলাভূমির শ্রেণীভুক্ত করা যায়। বর্ষা ঋতুতে নদনদীসমূহ প্রায় ৭,৭০০ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত হয়। বিভিন্ন আকৃতির নদনদী এই পরিমাপের অন্তর্ভুক্ত, তবে খুবই ক্ষুদ্র আকৃতির ঋতুভিত্তিক খালগুলি এতে অন্তর্ভুক্ত নয়। বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার হিসাব নির্ণয়ের একটি অন্যতম সমস্যা হচ্ছে যে বর্ষাকালে এর জলাভূমির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পায়, আবার শুষ্কমৌসুমে এই পরিমাণ প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে।

অন্য আরেকটি জটিল বিষয় হচ্ছে মোহনার নিকটবর্তী চরসমূহে জোয়ারভাটার প্রভাব। বর্ষা মৌসুমে (মে মাস থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত) বঙ্গোপসাগরের সীমা শুষ্ক মৌসুমের (নভেম্ববর মাস থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত) তুলনায় প্রায় দুই মিটার উচ্চে অবস্থান করে। এভাবে শুষ্ক মৌসুমে জেগে থাকা এবং চাষাবাদকৃত অনেক চর ও দিয়ারা বর্ষা ঋতুতে পানির নিচে চলে যায়। উপকূলীয় এলাকার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কৃষিজমি বর্তমানে চিংড়ি চাষের আওতায় চলে এসেছে।

ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, তিস্তা, গঙ্গা, পদ্মা, মেঘনা, গড়াই প্রভৃতি দেশের প্রধান প্রধান নদনদী বাহিত পলল দ্বারা চর গঠিত হয়ে থাকে। নদীর পাড় বরাবর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ভূমিকে দিয়ারা নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। নদীর প্রবাহপথে গঠিত হওয়ায় এবং মৃত্তিকা গঠন সংহত না হওয়ায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসকল ভূসংস্থান স্থায়ী হয় না। তা সত্ত্বেও এসকল চর ও দিয়ারা গঠন বড় বড় নদনদীর ক্ষেত্রে একটি নিয়মিত প্রক্রিয়াস্বরূপ। লোয়ার মেঘনা নদীর মোহনা এলাকায় চর ও দিয়ারাসমূহ ভূমিরূপের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রতিনিয়ত সেখানে বিদ্যমান দ্বীপসমূহের আয়তন বৃদ্ধি পাচ্ছে অথবা নতুন নতুন দ্বীপ গঠিত হচ্ছে যেগুলো হয়তো আবার কয়েক বছরের মধ্যেই ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে যাচ্ছে। শুষ্ক ঋতুতে দেশের চর ও দিয়ারাসমূহের মোট পরিমাপকৃত আয়তন দাঁড়ায় ২,১৬৩ বর্গ কিমি যা বর্ষা ঋতুতে ১,৪৬৩ বর্গ কিলোমিটারে কমে আসে। এটা অনস্বীকার্য যে এই হিসাবটি শুধুমাত্র একটি ঋতুর জন্য সঠিক এবং পরবর্তী বছরগুলোতে তা হয়তোবা বিশ শতাংশে পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে।

আবদ্ধ জলাশয়সমূহ বাংলাদেশের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। প্রাকৃতিক আবদ্ধ জলাশয়সমূহের মধ্যে রয়েছে হাওর, বাঁওড়, বিল প্রভৃতি। দেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলে হাওর অববাহিকায় অবস্থিত হাওরগুলো বৃহদাকৃতির অগভীর অবভূমি। বর্ষা ঋতুতে হাওরগুলো বিরাটাকৃতির হ্রদে পরিণত হয়, তবে অধিকাংশই যখন শুষ্ক ঋতুতে নিষ্কাশিত হয়ে যায় তখন স্থানে স্থানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু জলাশয় বিদ্যমান থাকে। অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদসমূহকে স্থানীয়ভাবে বাঁওড় বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে যাদেরকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মৃতপ্রায় বদ্বীপাঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়। পরিবর্তনশীল আয়তনবিশিষ্ট এসকল জলাশয়ের স্থিতি বছরের বিশেষ সময়ের ওপর নির্ভরশীল। জুলাই এবং আগস্ট মাসে আভ্যন্তরীণ সাগরসম সমগ্র হাওর অববাহিকার আয়তন দাঁড়ায় ৪,৫০০ বর্গ কিলোমিটার যা ডিসেম্বর মাসে এক-তৃতীয়াংশে হ্রাস পায়। সুতরাং বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার সংক্রান্ত যে কোন হিসাব অবশ্যই ঋতুভিত্তিক পরিবর্তনকে বিবেচনায় রেখে করতে হবে। শুষ্ক ঋতুতে হাওর অববাহিকা প্রধানত কৃষিভূমি হিসেবে বিবেচ্য, কিন্তু বর্ষা ঋতুতে তা আবার প্রধানত মৎস্যভূমির আওতাভুক্ত হয়ে পড়ে। দেশের বিল এলাকাগুলোর জন্যও একই বিষয় প্রযোজ্য। শুষ্ক ঋতুতে দেশের মোট বিল এলাকার আয়তন প্রায় ১৭৭ বর্গ কিমি এবং বর্ষাকালে তা বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ১,৫০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত হয়। বাঁওড় এলাকার মোট পরিমাণ প্রায় ৫৫ থেকে ৫৮ বর্গ কিমি এবং ঋতুভেদে এই পরিমাণের উল্লেখযোগ্য কোন পরিবর্তন ঘটে না।

দেশের সর্বত্রই বিবিধ উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য ছোটবড় পুকুর রয়েছে। নিচুভূমি এলাকাসমূহে বাড়ীঘরের ভিটি নির্মাণের জন্য পুকুর খনন করে মাটি তোলা হয়ে থাকে। এর ফলে এসকল পুকুর বাড়ীঘরেরই একটি অংশ বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। এমনকি বন্যামুক্ত এলাকাসমূহেও পানির সংস্থান এবং মৎস্যক্ষেত্র হিসেবে পুকুরের যথেষ্ট উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ১৯৯৬ সালের কৃষিশুমারী অনুযায়ী দেশে পুকুর, দিঘী ও ডোবাসমূহের সম্মিলিত আয়তন ৩,৪৮৯ বর্গ কিমি।

দেশের একক বৃহত্তম জলাশয় কাপ্তাই হ্রদের আয়তন বর্ষা ঋতুর শেষদিকে কানায় কানায় পূর্ণ হওয়ার পর ৭৪২ বর্গ কিমি-এ পৌঁছে, আবার শুষ্ক ঋতুর শেষে এর আয়তন দাঁড়ায় ৫৮৩ বর্গ কিমি-এ। ঋতুভেদে এই হ্রদের আয়তন পরিবর্তন লক্ষণীয়। শুষ্ক ঋতুতে কাপ্তাই হ্রদ থেকে ১০০ বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি পাহাড়ী জমি এবং উপত্যকা জেগে ওঠে এবং প্রায় ২০ বর্গ কিমি উন্মুক্ত সমতল জমিতে ধান এবং সবজি চাষাবাদ করা হয়ে থাকে।

১৯৯৫-৯৬ সালের সরকারি হিসাবে দেশের প্রায় ১৩ শতাংশ এলাকাকে বনভূমির আওতাভুক্ত করা হলেও শুধুমাত্র এর অর্ধেকের কিছু বেশি এলাকায় উদ্ভিদ আচ্ছাদন রয়েছে। একক বৃহত্তম বনভূমি সুন্দরবনের মোট আয়তন ৫,৭৭০ বর্গ কিমি যার মধ্যে ৪,১১০ বর্গ কিমি এলাকা ভূভাগ এবং ১,৬৬০ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে রয়েছে জলভাগ। সুন্দরবন বিশ্বের বৃহত্তম গরান বনভূমি। দেশের উত্তর, উত্তরপূর্ব এবং দক্ষিণপূর্ব অঞ্চলে বিদ্যমান পাহাড়ী এলাকায় ১২,৯০০ বর্গ কিমি এলাকাজুড়ে রয়েছে বৃক্ষ, গুল্ম, বাঁশ এবং শনের আচ্ছাদন। তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের বনভূমি অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। পার্বত্য জেলাগুলোর অশ্রেণীকৃত রাষ্ট্রীয় বনভূমি (Unclassed State Forest) প্রধানত গুল্ম ও তৃণ দ্বারা আবৃত এবং মাঝে মাঝে জুম চাষের আওতাভুক্ত ভূমি দ্বারা বিভক্ত। প্রধানত মধুপুর গড় এবং বরেন্দ্রভূমির উত্তরাংশের সামান্য এলাকায় বিস্তৃত সমভূমি এলাকার বনভূমির মোট পরিমাণ প্রায় ১,২০০ বর্গ কিমি। এই বনভূমিতে প্রধানত শালজাতীয় বৃক্ষ পাওয়া যায়, তবে অনেক স্থানে বন অধিদপ্তর অস্ট্রেলীয় প্রজাতির বৃক্ষ দ্বারা নতুনভাবে বনায়ন করেছে। শাল বনের উল্লেখযোগ্য অংশ বর্তমানে গুল্মভূমি এবং কৃষিভূমিতে পরিণত হয়েছে।

দেশের কৃষি ব্যবস্থায় ঋতুভেদ একটি গুরত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে বিবেচিত। নভেম্বর মাস থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত অপেক্ষাকৃত শুষ্ক মাসগুলোর চাষাবাদের ধরন জুন থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত বিরাজমান বর্ষা ঋতুর চাষাবাদের ধরন থেকে খুবই পৃথক। শুষ্ক ঋতুর প্রধান শস্যগুলো হচ্ছে বোরো ধান, গম, ডাল জাতীয় শস্য, তেলবীজ এবং বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি। শুষ্ক ঋতুর শেষে আউশ এবং জলি আমন ধান লাগানো হয়ে থাকে। মার্চ মাসে বছরের যে কোন সময় অপেক্ষা অধিকাংশ এলাকা চাষের আওতাভুক্ত থাকে। বর্ষা ঋতুর প্রারম্ভে শুষ্ক ঋতুর ফসলগুলো কেটে ফেলা হয় এবং মাঠে মাঠে তখন প্রধানত বোরো ও আউশ ধান এবং পাট অবশিষ্ট থাকে। আগস্ট মাসের মধ্যে এগুলোও কেটে ফেলা হয় এবং শাইল আমন ধান রোপন করা হয়। সেপ্টেম্বর মাসে জমিতে প্লাবনমাত্রা সর্বোচ্চে পৌঁছে এবং এসময় শস্যের আওতাভুক্ত জমির পরিমাণ সর্বনিম্ন হয়ে থাকে। যেখানে মার্চ মাসের শুরুর দিকে কয়েক ডজন শস্য প্রায় ৫১,০০০ বর্গ কিমি চাষযোগ্য জমি দখল করে থাকে সেখানে সেপ্টেম্বর মাসের উল্লেখ করার মতো ফসল হচ্ছে শাইল ও জলি আমন ধান এবং কয়েক প্রকার গ্রীষ্মকালীন শাকসবজি। কৃষি ভূমি ব্যবহারের অন্তর্ভূক্ত ঋতুগত পতিত শ্রেণীর জমিসমূহ বর্ষাকালে প্লাবিত জমির অন্তর্গত এবং এগুলো এ সময় উৎকৃষ্ট আভ্যন্তরীণ মৎস্যক্ষেত্রে পরিণত হয়। বর্ষাকালে পানিতে তলিয়ে যাওয়া যে কোন ভূমিই গুরুত্বপূর্ণ মৎস্যক্ষেত্রে পরিণত হয়।

দেশের সর্বত্র বিদ্যমান পুকুরগুলোতে স্বাদুপানির মৎস্য চাষ করা হয়ে থাকে। অপরদিকে, দেশের দক্ষিণপূর্ব এবং দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ত-স্বাদুজলের (brackish water) মৎস্য চাষ করা হয়ে থাকে। এ সকল এলাকায় লবণাক্ত-স্বাদুজলের জোয়ারভাটার প্রভাব সহজলভ্য হওয়ায় এমনটি করা সম্ভব হয়েছে। দেশে আভ্যন্তরীণ মৎস্যচাষের আওতাভুক্ত মোট জমির পরিমাণ প্রায় ১,৯০০ বর্গ কিমি। কক্সবাজার উপকূল বরাবর রয়েছে কযেক হাজার লবণক্ষেত্র যেখানে শুকনা মৌসুমে লবণ চাষ করা হয়ে থাকে। বর্ষাকালে এ সকল লবণক্ষেত্র মৎস্য চাষের আওতায় চলে আসে।

গ্রামীণ বসতিগুলোতে বসতভিটা, গাছগাছালি, বাঁশঝাড়, কোলাজমি, সরকারি কিছু দালানকোঠা এবং বিদ্যালয়ের খেলার মাঠ প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত থাকে। প্রতিটি গ্রামের রয়েছে কৃষিজমি এবং তার বসতি। গ্রামের ভূমি ব্যবহারকে এভাবে তিনটি অংশে বিভক্ত করা যায়: চাষাবাদের ভূমি, গ্রামীণ অবকাঠামো এবং অ-চাষাবাদকৃত গ্রামীণ ভূমি। গ্রামীণ অবকাঠামোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বসতভিটা এবং গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানের আওতাভুক্ত এলাকা। আদমশুমারীতে প্রদত্ত বসতভিটার সংজ্ঞা হচ্ছে বাড়ীঘর ও অন্যান্য কাঠামো, উঠান এবং যাতায়াতের জন্য বরাদ্দকৃত পরিসরভুক্ত এলাকা। গ্রামীণ বসতভিটাসমূহ দেশের মোট ৫,৫০০ বর্গ কিমি এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও অন্যান্য প্রয়োজনে ব্যবহূত ভূমির মোট পরিমাণ প্রায় ১,৫০০ বর্গ কিমি।

অ-চাষাবাদকৃত তথা চাষাবাদের বহির্ভূত গ্রামীণ ভূমির মধ্যে রয়েছে আবাদযোগ্য পতিতভূমি (culturable waste) (৫,৮০০ বর্গ কিমি), বাঁশঝাড় (১,২৫০ বর্গ কিমি) এবং জঙ্গল ও বৃক্ষভূমি (১,৩৫০ বর্গ কিমি)। আবাদযোগ্য পতিতভূমি শ্রেণীর ভূমি ঋতুগতভাবে প্লাবিত হয়ে থাকে এবং গুরুত্বপূর্ণ আভ্যন্তরীণ মৎস্য ক্ষেত্র হিসেবে ভূমিকা পালন করে থাকে।

নগর শ্রেণীভুক্ত এলাকার মোট পরিমাণ ৭,০০০ বর্গ কিমি এবং ৫,০০০-এর অধিক জনসংখ্যা অথবা অন্য কোন নগরীয় বৈশিষ্ট্যের কারণে নগর ঘোষিত এলাকার অন্তর্ভুক্ত সকল প্রকার নগরীয় কাঠামোভুক্ত ভূমি এই ভূমি ব্যবহারের আওতাভুক্ত। উল্লিখিত ভূমির প্রায় অর্ধেক নগর এলাকা ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকাভুক্ত। অবশিষ্ট ভূমি চট্টগ্রাম, খুলনা এবং রাজশাহী মেট্রোপলিটন এলাকাভুক্ত। অনেক গ্রামীণ শহর এলাকাকে তাদের পৌরসভার মধ্যে বড় এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হলেও তাদের গ্রাম ও কৃষি এলাকাসমূহকে নগর এলাকার হিসাব থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। গ্রামীণ অবকাঠামোর মধ্যে রয়েছে ধর্মীয় উপাসনালয়, কবরস্থান এবং অন্যান্য সম্প্রদায়গত প্রয়োজনীয় এলাকাসমূহ। এই উভয় শ্রেণীর ভূমি ব্যবহারই ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং এর পরিণতিতে বিশেষ করে আবাদি ভূমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে।

বিভিন্ন ঋতুতে মোহনা এলাকায় জলপৃষ্ঠের বিস্তার ওঠানামা করে থাকে। শুষ্ক ঋতুতে বঙ্গোপসাগরের সীমা নিম্নতর থাকে এবং বর্ষা মৌসুমের তুলনায় সমুদ্র শান্ত থাকে। তদুপরি শুষ্ক ঋতুতে নদনদীতে প্রবাহ কম থাকার কারণে নদীপৃষ্ঠও নিচে নেমে যায়। এ সময় চর ও দিয়ারাসমূহের বিস্তৃতি সর্বাধিক থাকে। বর্ষাকালে আবার অধিকাংশ চরই নিমজ্জিত হয়ে পড়ে এবং এগুলো তখন মোহনা এলাকার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। এই প্রকার ভূমি ব্যবহার শ্রেণীর সমুদ্র অভিমুখী সীমা মোটামুটি ৩০ ফ্যাদম রেখা পর্যন্ত নির্ধারণ করে নেওয়া হয়েছে। দেশের ৩১,০০০ বর্গ কিমি রাষ্ট্রীয় জলসীমার অংশ মোহনা এলাকার আয়তন প্রায় ৮,৬০০ বর্গ কিমি। এই জলসীমার সম্মুখে বঙ্গোপসাগরের ৬৯,০০০ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে রয়েছে সংরক্ষিত অর্থনৈতিক বলয় (Exclusive Economic Zone-EEZ)। বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার ধরনের পরিবর্তন থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, দেশের ভূমি সম্পদ উল্লেখযোগ্যভাবে বন উজাড়করণ, কৃষি নিবিড়করণ এবং প্রাকৃতিক উদ্ভিজ্জের পরিমাণ হ্রাসের ফলে সৃষ্ট পরিবেশগত বিপর্যয়ের প্রতিক্রিয়ার শিকার হচ্ছে। [হারুন-অর-রশীদ এবং মু. শামসুল আলম]

গ্রন্থপঞ্জি  UNDP, Landuse in Bangladesh, Selected Topics: Agriculture Sector Review, UNDP, Dhaka, 1989; Haroun Er Rashid, Geography of Bangladesh, University Press Ltd, Dhaka, 1991; Government of Bangladesh, National Water Plan Report, Volume 1, Ministry of Irrigation Drainage and Flood Control, Government of Bangladesh, 1991; UNFP/FAO, GEM Report, series 23, Report of the UNEP/FAO Expert Meeting on Harmonizing Land Cover and Landuse Classifications, Geneva, 23-25 November, 1993; Bangladesh Bureau of Statistics (BBS), Statistical Year Book of Bangladesh 1996, BBS, Ministry of Planning, Government of Bangladesh, 1997; Bangladesh Bureau of Statistics (BBS), Agriculture Sample Survey 1997, BBS, Ministry of Planning, Government of Bangladesh, 1999; Bangladesh Bureau of Statistics (BBS), Census of Agriculture 1996, BBS, Ministry of Planning, Government of Bangladesh, 1999; Water Resources Planning Organisation (WARPO) Land and Water Resources, Draft Development Strategy, National Water Management Plan, Volume 4, WARPO, Ministry of Water Resources, Government of Bangladesh, 2000.