ভূতাত্ত্বিক বিবর্তন

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১০:০৩, ১ মার্চ ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

ভূতাত্ত্বিক বিবর্তন (Geological Evolution)  পৃথিবীর অস্তিত্বের মোট ৪৬০ কোটি বছর সময় কালকে শিলা বিবরণীর ভিত্তিতে মহাযুগ (era), যুগ (period) ও উপযুগে (epoch) ভাগ করে প্রদত্ত ভূতাত্ত্বিক বিকাশ সংক্রান্ত বিবর্তন মতবাদ। প্রধান চারটি মহাযুগ হলো প্রাক-ক্যামব্রিয়ান (Pre-Cambrian), প্যালিয়জোয়িক (Paleozoic), মেসোজোয়িক (Mesozoic) ও সেনোজোয়িক (Cenozoic)। প্রতিটি মহাযুগ আবার যুগ ও উপযুগে উপবিভাজিত।

প্রাক-ক্যামব্রিয়ান হচ্ছে সবচেয়ে দীর্ঘ মহাযুগ। ৪৬০ কোটি থেকে প্রায় ৫৭ কোটি বছর পূর্ব পর্যন্ত প্রলম্বিত এই মহাযুগ পৃথিবীর মোট বয়সের প্রায় ৮৫% সময়কে ধারণ করে আছে। এই মহাযুগের শিলাসমূহের অধিকাংশই কেলাসিত আগ্নেয় ও রূপান্তরজ শিলা এবং পাললিক শিলাপূর্ণ অববাহিকা সমূহের ভীতের মূল উপাদান। কেবলমাত্র অত্যধিক প্রাচীন প্রাণী, অধিকাংশই এককোষী জীব এই কালে সমুদ্রে অস্তিত্বশীল ছিল। প্রধানত গ্রানাইট, গ্রানোডায়োরাইট ও নাইস (gneiss) জাতীয় প্রাক-ক্যামব্রিয়ান মহাযুগের শিলা উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় বাংলাদেশের দিনাজপুর ও রংপুর জেলার মাটির প্রায় ১৫০ থেকে ৩০০ মিটার গভীরে দেখতে পাওয়া যায়।

উৎস সিফাতুল কাদের চেীধুরী

বিগত প্রায় ৫৭ কোটি বছর থেকে সাড়ে ২৪ কোটি বছর আগের সময়কালকে প্যালিয়জোয়িক মহাযুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কালানুক্রমিকভাবে এটি ৬টি যুগে বিভক্ত, যথা: ক্যামব্রিয়ান, অর্ডোভিসিয়ান, সিলুরিয়ান, ডিভোনিয়ান, কার্বোনিফেরাস ও পার্মিয়ান যুগ। এই মহাযুগ অমেরুদন্ডী প্রাণীর মহাযুগ হিসেবেও পরিচিত, কারণ এই সময়ে পৃথিবীতে প্রাণের এই রূপই প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। বাংলাদেশে ক্যামব্রিয়ান থেকে ডিভোনিয়ান যুগের কোন শিলার সন্ধান পাওয়া যায় না। তবে কার্বোনিফেরাস যুগে বঙ্গীয় অববাহিকার ভূত্বকের বিরাট এলাকা জুড়ে বিচলনের ফলে ভূতাত্ত্বিক গঠনসমূহের সৃষ্টি হয়েছিল। প্রবীণ কার্বোনিফেরাস সময়ে গন্ডোয়ানাল্যান্ডে হিমবাহ যুগ ছিল। কিন্তু নবীন কার্বোনিফেরাস যুগে ক্রমাগত পার্শ্বীয় প্রসারণ এবং মহাদেশীয় ভূত্বকের একটি অংশের নিম্নগামী বাঁক নেওয়ার ফলে প্যালিয়জোয়িক মহাযুগের অভ্যন্তরীণ অগভীর নিম্নভূমির সৃষ্টি হয় এবং ভয়ানকভাবে বিচলনের ফলে গন্ডোয়ানাল্যান্ডের নিম্নগামী বাঁক প্রাক-ক্যাম্ব্রীয় ভিত্তিশিলায় চ্যুতিখাদের সৃষ্টি করে। বঙ্গীয় অববাহিকায় এই চ্যুতিখাদসমূহ পশ্চিমাঞ্চলীয় অন্তরীপ সোপান অঞ্চলে পাওয়া যায়। এই চ্যুতিখাদসমূহে গন্ডোয়ানা শিলা ও গন্ডোয়ানা কয়লাস্তর রক্ষিত আছে। বঙ্গীয় অববাহিকায় কার্বোনিফেরাস অবক্ষেপ এখনও পাওয়া যায়নি। তবে মনে হয় গন্ডোয়ানা শিলাদলের নিম্নের গন্ডশিলাসমূহ নবীন কার্বোনিফেরাস যুগে অবক্ষেপিত হয়েছিল। পার্মিয়ান যুগে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে দীর্ঘ নদী অববাহিকাসহ জলাময় ও ঘন বৃক্ষ আচ্ছাদিত ভূমির অস্তিত্ব ছিল। এ কারণে বেলেপাথর, কয়লাস্তর ও কর্দম শিলাস্তর গঠিত হয়, যা ঐ অঞ্চলের ভূগর্ভে পরিদৃশ্যমান। এইসব কয়লাস্তর উত্তর-পশ্চিম বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক কয়লা মজুত ভান্ডার গড়ে তুলেছে।

মেসোজোয়িক মহাযুগ আজ থেকে সাড়ে ২৪ কোটি বছর থেকে প্রায় ৬ কোটি ৬০ লক্ষ বছর আগে পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। তিনটি যুগে এই মহাযুগ বিভক্ত। এগুলো হচ্ছে ট্রায়াসিক (Triassic), জুরাসিক (Jurassic) ও ক্রিটেসিয়াস (Cretaceous)। ডায়নোসর যুগ নামে পরিচিত এই মহাযুগেই ডায়নোসররা পৃথিবী জুড়ে রাজত্ব করতো। ট্রায়াসিক শিলা এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে পাওয়া যায়নি। জুরাসিক-প্রবীণ ক্রিটেসিয়াস যুগে অদূরবর্তী এলাকায় আগ্নেয়গিরির ব্যাপক অগ্ন্যুৎপাতের কারণে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে বিশেষ করে জামালগঞ্জ, শিবগঞ্জ এবং বগুড়া গ্রস্ত উপত্যকা এলাকায় আগ্নেয় শিলাস্তর গঠিত হয়। এই শিলারাশিকে রাজমহল শিলাসোপান (ট্র্যাপ) বলে। ভূগর্ভে প্রাপ্ত কৃষ্ণবর্ণের ব্যাসল্টে এই শিলাসোপান গঠিত।

বিগত ছয় কোটি ৬০ লক্ষ বছর থেকে বর্তমান সময় সেনোজোয়িক মহাযুগ হিসেবে অভিহিত। এটি টারশিয়ারী (Tertiary) ও কোয়াটারনারী (Quaternary) এই দুই যুগে বিভক্ত। টারশিয়ারী যুগ (আজ থেকে ৬ কোটি ৬০ লক্ষ বছর থেকে ২০ লক্ষ বছর আগে) ৫টি উপযুগে বিভক্ত, যেমন প্যালিওসিন, ইয়োসিন, ওলিগোসিন, মায়োসিন ও প্লায়োসিন। অপরদিকে কোয়াটারনারী যুগ (২০ লক্ষ বছর থেকে বর্তমান সময়) দুইটি উপযুগে বিভক্ত, যেমন প্লাইসটোসিন ও হলোসিন (সাম্প্রতিক)। প্লাইসটোসিন উপযুগ হলো প্রবীণ উপযুগ, যার ব্যাপ্তি প্রায় ২০ লক্ষ বছর। হলোসিন উপযুগ হলো নবীন উপযুগ, যার ব্যাপ্তি আজ থেকে প্রায় ১০,০০০ বছর। সেনোজোয়িক মহাযুগ স্তন্যপায়ী প্রাণীদের যুগ হিসেবে পরিচিত। এই মহাযুগে আবির্ভূত স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে Elephus, Equs and Leptobos গুরুত্বপূর্ণ।

সেনোজোয়িক মহাযুগ বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, দেশের অধিকাংশ পাললিক স্তর ও ভূতাত্ত্বিক গঠনাদি এই সময়ে গঠিত হয়। বাংলাদেশের সেনোজোয়িক ভূ-গাঠনিক বিবর্তন প্রধানত সংঘটিত হয়েছিল নবীন ইয়োসিন, মধ্য মায়োসিন, নবীন প্লায়োসিন এবং প্রবীণ প্লাইসটোসিন সময়ে। প্রবীণ টারশিয়ারী আমলে (প্যালিওসিন ও ইয়োসিন উপযুগ) বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকা উন্মুক্ত সামুদ্রিক পরিবেশের অধীন ছিল, যার ফলে জীবাশ্মসমৃদ্ধ চুনাপাথর ও কিছু বেলেপাথরসহ কর্দমশিলা গঠিত হয়। নবীন টারশিয়ারী যুগে (ওলিগোসিন, মায়োসিন ও প্লায়োসিন যুগ) উত্তরে হিমালয় পবর্তমালা উত্থিত হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় উন্মুক্ত সাগর দক্ষিণে নেমে যায় এবং নদী ব্যবস্থাদি একটি বৃহৎ বদ্বীপীয় ভূ-খন্ডের সৃষ্টি করে, যা বর্তমান কালের গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপের মূল কাঠামোর জন্ম দেয়। বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের ভূ-পৃষ্ঠে ও ভূগর্ভে বর্তমানে যে পর্যায়ক্রমে আবর্তিত বেলেপাথর ও কর্দম শিলার স্তর দেখা যায়, সেগুলো টারশিয়ারী যুগে এই বদ্বীপীয় পরিবেশেই গঠিত হয়েছিল। কোয়াটারনারী যুগ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী প্রচন্ড ঠান্ডা হয়ে পড়ে এবং হিমায়ন প্রক্রিয়ার অধীনে পৃথিবী উত্তরোত্তর ঢাকা পড়ে যায়। একারণে প্লাইসটোসিন উপযুগ তুষার যুগ নামে পরিচিত। তুষার যুগে সমুদ্রপৃষ্ঠ নেমে যায় এবং তুষার গলা যুগে সমুদ্রপৃষ্ঠ স্ফীত হয়। কোয়াটারনারী যুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো হোমিনিডস বা হোমোসেপিয়ান এবং বিশেষ করে আধুনিক মানুষের এই পৃথিবীতে আবির্ভাব। বাংলাদেশে প্লাইসটোসিন উপযুগের হৈম-অবক্ষেপ (glacial deposit) পাওয়া যায়নি। অবশ্য বাংলাদেশ সংলগ্ন হিমালয় পর্বতমালা সে সময়ে বরফাবৃত ছিল এবং পরবর্তীতে বরফ গলা যুগে গলে যাওয়া পানি বঙ্গীয় সমভূমির উপর দিয়ে গভীরভাবে ছেদিত নদী উপত্যকার মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে পতিত হতো। ফলে সেই সময়ের মধ্যে বঙ্গীয় সমভূমি হিমান্ত সমতলভূমির ন্যায় আচরণ করতো। বাংলাদেশের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ এলাকা প্লাইসটোসিন নদীজ ও হলোসিন পলিজ অবক্ষেপ দ্বারা পূর্ণ। বাংলাদেশের উপর দিয়ে বর্তমান গঙ্গা নদীর গতিপথ ভূতাত্ত্বিকভাবে একটি সাম্প্রতিক ঘটনা এবং দেশটির অধিকাংশ অঞ্চল কোয়াটারনারী যুগে তার বর্তমান আকৃতি লাভ করে এবং নদী প্রভাবিত এর ভূ-প্রাকৃতিক ব্যবস্থা সে সময়েই গড়ে ওঠে।  [বদরুল ইমাম এবং সিফাতুল কাদের চেীধুরী]