ভুট্টা

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৬:২৫, ১ মার্চ ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

ভুট্টা (Maize)  Cyperales বর্গের Graminae গোত্রের একদানা খাদ্যশস্য, Zea mays। যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় ভুট্টা ‘কর্ন’ (corn) নামে সুপরিচিত এবং এটি সেখানকার অন্যতম প্রধান দানা ফসল (cereal crop)। ‘মেইজ’ (maize) শব্দের উৎপত্তি ভারতীয় আরাওয়াক (Arawak) শব্দ ma-hiz থেকে। স্প্যানিশ ভাষায় একে maiz বলা হয় এবং এ শব্দ আমেরিকার স্প্যানিশ ভাষা-ভাষীদের মধ্যে এখনো চালু আছে। পশ্চিম গোলার্ধে ইউরোপিয়ানদের পৌঁছাবার পূর্বেই আমেরিকায় ভুট্টার চাষাবাদ শুরু হয় বলে জানা যায়। তবে কবে কখন কোথায় চাষযোগ্য ভুট্টার জাত প্রথম উদ্ভূত হয়েছিল সে সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায়নি। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন Zea mexicana প্রজাতির অনুকূল পরিব্যক্তির (mutation) মাধ্যমে আধুনিক কালের আবাদযোগ্য ভুট্টার উদ্ভব হয়েছে। মেক্সিকো অথবা মধ্য আমেরিকা ভুট্টা উদ্ভবের কেন্দ্রস্থল বলে মনে করা হয় এবং সেখান থেকে পরবর্তীতে পৃথিবীর নানা দেশে এটি ছড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীর বহুদেশে এখন ভুট্টার চাষ হয়। এশিয়ার প্রধান ভুট্টা চাষের দেশগুলোর মধ্যে ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, চীন, ভারত এবং পাকিস্তান উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশে খরিফ (Kharif) এবং রবি (Rabi) মৌসুমে কমবেশি প্রায় সব জেলাতেই সীমিত পরিমাণ জমিতে ভুট্টার চাষ হয়। ভুট্টা থেকে তৈরি খাদ্যের সঙ্গে এ দেশের মানুষ তেমন পরিচিত না হবার কারণে এ ফসল চাষের তেমন উৎসাহ এখানকার কৃষকদের নেই। ইউরোপ এবং আমেরিকায় ভুট্টা অন্যতম প্রধান খাদ্যশস্য। মেক্সিকো, চিলি, মধ্য আমেরিকা এবং পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকায় অনেক ধরনের প্রধান খাদ্য বস্ত্ত তৈরি হয় ভুট্টা থেকে।

ভুট্টার মোচা

ভুট্টা একবীজপত্রী, শক্ত এক কান্ডবিশিষ্ট বীরুৎ। গাছ সোজা বা খাড়া হয়ে জন্মায় এবং ঠেসমূল মাটির সাথে একে আটকে রাখে। ঠেসমূল বেশ মোটা, পরবর্তীতে মাটিতে প্রবেশ করে এগুলো স্বাভাবিক মূলের ন্যায় কাজ করে। ভুট্টা গাছের উচ্চতা হয় অনেকটা আখ গাছের মতোই। জাত (variety) অথবা প্রজাতি ভেদে ১ থেকে ৩ মি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। কদাচিৎ কুশি হয়। কান্ড নিরেট, ৩-৪ সেমি ব্যাসযুক্ত। পর্বের (node) সংখ্যা সাধারণত ১১-১৫টি। মাঝের বা উপরের দিকের পর্বের কুঁড়ির মধ্যে মোচা (cob) জন্মে। মোচার সংখ্যা জাত ভেদে কমবেশি হয়। ভুট্টার পাতা গাছের দুপাশে দুসারিতে সাজানো, সাধারণত সংখ্যায় হয় ১৬ থেকে ২৩। পাতা লম্বা ও চওড়া, ধার কিছুটা ঢেউ খেলানো। পাতার উপরিভাগে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাঁটার মতো রোম থাকায় অমসৃণ দেখায়; অঙ্কীয়ভাগ মসৃণ।

পুং ও স্ত্রী পুষ্পমঞ্জরী একই গাছে পৃথক পৃথকভাবে অবস্থিত। পুরুষ পুষ্পমঞ্জরীকে টাসেল (tassel) বলে। স্ত্রী পুষ্পমঞ্জরীকে বলা হয় মোচা, এটি পরিবর্তিত কয়েকটি পাতায় আবৃত থাকে।

বিভিন্ন প্রকার মাটিতে ভুট্টার চাষ করা যেতে পারে। তবে বেলে দো-অাঁশ থেকে ভারী এঁটেল-দো-অাঁশ মাটিতে ভুট্টা ভাল জন্মে। মাটির pH মাত্রা ৫.৫ থেকে ৮.৫-এর মধ্যে হলে ভাল হয়, pH মাত্রা ৬-৭ সবচেয়ে ভাল। পরিবেশের তাপমাত্রা ১২° সে থেকে ২৯° সে ভুট্টা চাষের অনুকূল। এছাড়া অপেক্ষাকৃত প্রতিকূল আবহাওয়াতেও ভুট্টা উৎপাদন করা সম্ভব।এমনকি অত্যধিক তাপমাত্রা,বৃষ্টিপাতের স্বল্পতা বা বণ্যা প্রভৃতির কারণে এ ফসলের ক্ষয়ক্ষতির পরিমান তুলনামূলকভাবে কম।বাংলাদেশে উন্নত জাতের যেসব ভুট্টার আবাদ করা হয় তার মধ্যে সাভার, জেসি (JC), ডিএমআর (DMR), বর্ণালী, শুভ্রা, মোহর, খইভুট্টা এবং সোয়ান-২ উল্লেখযোগ্য। কয়েকটি সঙ্করজাতের ভুট্টাও কতক এলাকায় চাষ করা হয়।

ভুট্টার দানার আকার, আকৃতি এবং রঙে বিস্তর পার্থক্য দেখা যায়, যদিও হলুদ এবং সাদা রঙ সচরাচর বেশি চোখে পড়ে। স্বাদের দিক থেকেও বিভিন্ন জাতের ভুট্টার মধ্যে প্রচুর বৈষম্য বর্তমান। বাংলাদেশে ১৯৯৭-৯৮ সালে মোট ৬,২৯৫ একর জমিতে ভুট্টার আবাদ হয়েছিল এবং মোট উৎপাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় ২,৬৫০ মে টন। কমবেশি অনেক জেলাতে ভুট্টার আবাদ হলেও বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, দিনাজপুর এবং রাজশাহী এলাকায় এর চাষ বেশি হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-এর প্রতিবেদনে দেখা যায় এদেশে ভুট্টার বাৎসরিক উৎপাদনের পরিমাণ ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে।

সারণি  ২০০৭-০৮ থেকে ২০০৯-১০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ভুট্টা চাষে ব্যবহূত মোট জমির পরিমাণ এবং উৎপাদন।

বছর জমির পরিমাণ (একর) উৎপাদন (মে টন)
২০০৭/২০০৮ ৫,৫২,৯৫৫ ১৩,৪৬,৪৭১
২০০৮/২০০৯ ৩,১৭,২৫৩ ৭,২৯,৬২৯
২০০৯/২০১০ ৩,৭৫,৬২৮ ৮,৮৭,৩৯১

উৎস  BBS Yearly Statistical Bulletin, July, 2010।

অনিষ্টকারী পোকা-মাকড় ও রোগ-বালাই  মাঠ পর্যায়ে বেশ কতক কীটপতঙ্গ ভুট্টা ফসলকে আক্রমণ করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাটওয়ার্ম (Agrotis ipsilon), শুটফ্লাই (Atherigona sp), মাজরা পোকা (Sesamia inferens Ges Chilo partellus), জাবপোকা (Rhopalosiphum maidis) এবং পডবোরার বা মোচাপোকা (Helicoverpa armigera)। গুদামজাত অবস্থায় সতর্কতা অবলম্বন না করলে ভুট্টার উইভিল (Sitophilus zeamais) এবং চাউলের উইভিল (S. oryzae) ভুট্টাদানার প্রচুর ক্ষতি করতে পারে।

ভুট্টার উল্লেখযোগ্য রোগের মধ্যে রয়েছে ঝুল রোগ (smut, Ustilago maydis), পাতা ধসা (leaf blight, Drechlera turcicum), পাতা দাগ (Leaf spot, Helminthosporium rostratum) এবং পাতাফড়িং সংক্রামিত ভাইরাজনিত ভুট্টার ডর্ফ মোজাইক (dwarf mosaic) রোগগুলি। বাংলাদেশে এসব রোগের প্রাদুর্ভাব কমবেশি লক্ষ্য করা যায় এবং অনেক সময়ে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়।

ভুট্টার ব্যবহার  ভুট্টা থেকে নানা ধরনের খাদ্য সামগ্রী তৈরি করা যায়। চাল এবং গমের মতোই খাদ্য হিসেবে এ ফসল ব্যবহারের উপযোগী। ভুট্টা এবং ভুট্টার ময়দা থেকে অথবা গম বা অন্য কোনো শস্যের ময়দার সঙ্গে মিশিয়ে তা দিয়ে পরোটা, পুরি, সুপ, মিশ্রিত খাদ্য, খিচুরি, ভুট্টা পোলাও ইত্যাদি উপাদেয় খাদ্য তৈরি করা সম্ভব। ভুট্টার অপরিণত মোচা অথবা দানা সিদ্ধ বা ভেজে খাওয়া যায়। ভুট্টার খৈ (pop corn) বিশ্ব জুড়েই এক অতি উপাদেয় খাদ্য।

অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানে স্টার্চ, অ্যাজবেস্টস বোর্ড, গবাদিপশুর খাদ্য, প্রসাধন সামগ্রী, বিস্কুট, হরলিকস, কর্নফ্লেক্স, ভোজ্য তেল ইত্যাদি উৎপাদনের জন্য ভুট্টা কাচামাল হিসেবে ব্যবহূত হয়। ভুট্টা থেকে এসিটিক এসিড এবং অ্যালকোহলসহ আরো কয়েক ধরনের শিল্পজাত দ্রব্য উৎপাদন করা হয়। [এস.এম হুমায়ুন কবির এবং আবুল খায়ের]

আরও দেখুন দানাশস্য