ভারত ছাড় আন্দোলন, ১৯৪২

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২২:৩৫, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

ভারত ছাড় আন্দোলন, ১৯৪২ ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে শ্বেতাঙ্গ-বিরোধী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ প্রথম স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপক আন্দোলন (Quit India Movement, 1942)। ক্রিপস মিশন এর অস্পষ্ট প্রস্তাবাবলি- যেমন, যুদ্ধ পরবর্তীকালে ভারতের জন্য ডোমিনিয়ন মর্যাদা প্রদান, প্রাদেশিক আইনসভা ও দেশীয় রাজ্যগুলির দ্বারা সংবিধান প্রণয়ন কমিটি নির্বাচন, প্রদেশগুলির এতে যোগদান করা না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ধারা, যুদ্ধে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের আশু অংশগ্রহণ কিন্তু ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা রাখা প্রভৃতি কাউকেই সন্তুষ্ট করতে পারে নি। বরং এ প্রেক্ষিতে বলকান উপদ্বীপের মতো ভারতের ভাগ্য বিপর্যয়ের আশংকা দেখা দেয়। মালয়, বার্মা ও সিঙ্গাপুর থেকে ব্রিটিশদের কলঙ্কজনক পলায়নের ফলে তাদের অধীনস্থ ভারতীয়দের নিজেদেরকেই আত্মরক্ষার চেষ্টা করতে হয়। এসব ভারতীয়ের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের অবর্ণনীয় দুর্দশাপূর্ণ অবস্থা, ভারতের বিভিন্ন স্থানে কর্মরত শ্বেতাঙ্গ সৈন্যদের দ্বারা ভারতীয়দের ওপর জাতিগত বিদ্বেষমূলক আচরণ, সকল প্রকারের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে যুদ্ধের কাজে লাগানোর কারণে সম্ভাব্য জাপানি আক্রমণের বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের বাংলায় অনুসৃত ‘পোড়ামাটি নীতি’, যুদ্ধকালীন জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি, কালোবাজারী এবং মুনাফাখোরদের দৌরাত্মে সবকিছুই শ্বেতাঙ্গ-বিরোধী উত্তেজনা সৃষ্টি করতে বিশেষ অবদান রাখে। সর্বোপরি, যুদ্ধের শুরু থেকেই ১৯৩২ সালের আদলে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রের ব্যাপক কঠোর নীতি গ্রহণ করার প্রয়াস ছিল।

৯ আগস্ট ভোরে কংগ্রেস নেতাদের গ্রেপ্তার দেশব্যাপী এক নজিরবিহীন গণরোষের সৃষ্টি করে, যা বাংলার শহরগুলিতে, বিশেষ করে বড় শহরগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে।

ভারত ছাড় আন্দোলনের প্রধান তিনটি পর্ব দেখা যায়। প্রথম পর্বে এ আন্দোলন প্রধানত শহর অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল। এ পর্যায়ে প্রধান শহরগুলিতে হরতাল, ধর্মঘট, পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সাথে সংঘর্ষ ছিল লক্ষণীয় বিষয়। এ পর্বের আন্দোলন ছিল খুবই ব্যাপক এবং সহিংস। কিন্তু দ্রুততার সাথেই এ আন্দোলনকে দমন করা হয়।

আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় আগস্টের মধ্যভাগ থেকে। এ পর্যায়ে জঙ্গী ছাত্ররা বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে ছড়িয়ে পড়ে। তারা যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয় এবং একই সঙ্গে উত্তর ও পশ্চিম বিহার, উত্তর প্রদেশের পূর্বাঞ্চল, বাংলার মেদিনীপুর জেলা এবং মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক ও  উড়িষ্যার বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষক বিদ্রোহের নেতৃত্ব গ্রহণ করে। এ সময় বেশ কয়েকটি অঞ্চলে স্বল্প স্থায়ী আঞ্চলিক ‘জাতীয় সরকার’ও গঠিত হয়।

সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে আন্দোলনের তৃতীয় পর্ব শুরু হয়। এ পর্বের বৈশিষ্ট্য হলো শিক্ষিত যুবক সম্প্রদায় ও কৃষক দলের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা এবং গেরিলা যুদ্ধ। এ সময়ে মেদিনীপুরের তমলুক, মহারাষ্ট্রের সাতারা, উড়িষ্যার তালচের অঞ্চলে এই জাতীয় সরকার কাজ করছিল। তিনটি পর্বের আন্দোলনকে অত্যন্ত নৃশংসভাবে দমন করা হয়। আন্দোলন দমন করতে সরকার আকাশ থেকে মেশিনগানও ব্যবহার করেছিল।

ভারত ছাড় আন্দোলনের প্রকৃতি সম্পর্কে বেশ মতবিরোধ আছে। এ সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, এটা কি কোন স্বতঃস্ফূর্ত বিপ্লব, নাকি একটি সুসংগঠিত বিদ্রোহ। ১৯৪২ সালের ৮ আগস্ট নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির (বোম্বাইর) অধিবেশনে বিখ্যাত ভারত ছাড় আন্দোলনের প্রস্তাব পাস হয় এবং পরপরই যতদূর সম্ভব ব্যাপকভাবে অহিংস পথে গান্ধীর নেতৃত্বে আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়। প্রস্তাবের সঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণ একটি অতিরিক্ত ধারা সংযোজিত হয় এবং তা হলো- কংগ্রেস নেতৃত্বকে যদি গ্রেপ্তারের মাধ্যমে সরিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে প্রত্যেক ভারতবাসী যিনি স্বাধীনতা চান এবং তার জন্য সংগ্রাম করেন তিনি নিজেই তার পথপ্রদর্শক হবেন। ১৪ জুলাইর ওয়াদা ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাবেও সামাজিক র‌্যাডিক্যালিজমের বিশেষ বৈশিষ্ট্যাবলি উল্লিখিত হয়। ২৭ এপ্রিল থেকে ১ মে পর্যন্ত সময়ে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির অধিবেশনে গান্ধীর কড়া নীতিকে একযোগে সমর্থন করেন ডানপন্থী প্যাটেল, রাজেন্দ্র প্রসাদ ও কৃপালনী এবং সমাজতন্ত্রী অচ্যুত পাটওয়াবর্ধন ও নরেন্দ্রদেব। জওহরলাল প্রথমদিকে দ্বিধাগ্রস্ত থাকলেও পরিশেষে গান্ধীর নীতিকেই সমর্থন করেন এবং একমাত্র কমিউনিস্টরাই ভারত ছাড় প্রস্তাবের বিরোধিতা করে।

ভারত ছাড় আন্দোলন চলাকালীন এবং পরে ব্রিটিশরা টোটেনহ্যামের প্রতিবেদনের মতো দলিল পত্রে সমগ্র বিস্ফোরণকে অক্ষ শক্তিকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ‘পঞ্চম বাহিনী’র সুচিন্তিত ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করে। তবে এ ব্যাখ্যা ছিল নিতান্তই হাস্যকার, কারণ কংগ্রেস বরাবরই ছিল ফ্যাসিবাদ-বিরোধী এবং ৯ আগস্ট ভোরে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ গ্রেপ্তার হয়ে যাওয়ার পরও ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে চলে। এই ব্যাখ্যার কারণে আলাপ-আলোচনার পথই শুধু রুদ্ধ হয় নি, বরং মনে হয় গোটা ব্যাপারটাই ছিল বিশেষ কার্য পদ্ধতি অনুসরণ করে শেষ সীমায় পৌঁছানোর একটা প্রয়াস; আর সেই সঙ্গে দরকষাকষিরও একটা কৌশল মাত্র। কিন্তু এর পরেই যে বিস্ফোরণ হয় তার একমাত্র কারণ এই যে, ব্রিটিশরা সর্বাত্মকভাবে দমননীতি প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্রিটিশরা এ অভিযোগ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি যে, ৯ আগস্টের পূর্বে কংগ্রেস সত্যিই এক হিংসাত্মক বিদ্রোহের পরিকল্পনা করে।

বাস্তবিকপক্ষে, এ আন্দোলন ছিল প্রাথমিক এবং ব্যাপকভাবে স্বতঃস্ফূর্ত। বহুবিধ কারণ এবং এ আশায় আন্দোলন ব্যাপক ভাবে বিস্তার লাভ করে যে, শীঘ্রই ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটছে। ব্রিটিশ আমলাদের স্বেচ্ছাচারিতা এবং প্ররোচনা পরিস্থিতিকে আরও খারাপের দিকে ঠেলে দেয়। মালয় ও বার্মায় আর্থিক ক্ষতি সাধিত হওয়ায় ভারতীয় ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের বিভিন্ন অংশ কিছু সময়ের জন্য হলেও গোপনে আন্দোলনকে সহায়তা করতে উৎসাহিত হয় (যদিও তা সহিংস হয়)।

ভারত ছাড় আন্দোলনের প্রকৃত চিত্র হলো এই যে, প্রতিষ্ঠিত নেতাদের সরিয়ে দেওয়ার ফলে বাম ও অধিকতর জঙ্গী তরুণ কর্মীদেরকে চলতে হয় তাদের নিজেদের উদ্যোগে এবং এতে নিচ থেকে চাপ দেওয়ার বিরাট সুবিধা সৃষ্টি হয়। কংগ্রেস যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর পরিকল্পিতভাবে আক্রমণ চালাচ্ছে এবং অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতায় লিপ্ত  আমেরীর এ মিথ্যা প্রচারণা বুমেরাং হয়ে প্রচন্ডভাবে তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহূত হয়। কারণ, অনেকেই বিশ্বাস করতেন যে, এ কার্যকলাপ কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির পরিকল্পনা অনুযায়ী সংঘটিত হচ্ছিল। ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের মতো কৃতিত্বপূর্ণ প্রাথমিক সংগ্রামের জন্য প্রস্ত্ততির বিষয়টি তাৎক্ষণিক সাংগঠনিক তৎপরতার আলোকে মূল্যায়ন করা যাবে না, বরং জনগণের ওপর এ আন্দোলন কতটুকু প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল তার ওপর ভিত্তি করে বিষয়টি বিচার করতে হবে।

ভারত ছাড় আন্দোলনে শ্রমিকদের অংশগ্রহণ ছিল স্বল্পমেয়াদী এবং সীমিত। কিন্তু সমাজের উচ্চ শ্রেণির লোকেরা এ আন্দোলনকে গোপনে সমর্থন করছিলেন। এমনকি ভারতীয় উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাগণও ১৯৪২-এর এ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন। এ ধরনের সমর্থনের ফলে আন্দোলনের কর্মীরা বেশ কার্যকর গুপ্ত সংস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। এর মধ্যে একটি গোপন বেতার কেন্দ্রও ছিল। এটি বোম্বেতে ঊষা মেহতার পরিচালনায় তিন মাস পরিচালিত হয়েছিল। আইন অমান্য আন্দোলনে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ছাত্ররা তেমন একটা যোগ দেয় নি, কিন্তু ১৯৪২ সালের আন্দোলনে অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতার সংগঠক হিসেবে অথবা উদ্দীপনাদানকারী হিসেবে তারাই ছিল প্রথম সারিতে। কোন কোন অঞ্চলে, বিশেষ করে বিহারে এ আন্দোলন দুর্দমনীয় হয়ে ওঠার কারণ হলো ব্যাপকভাবে কৃষকদের অভ্যুত্থান। বস্ত্তত, ১৯৪২ সালের ভারত ছাড় আন্দোলন কংগ্রেস কর্তৃক পরিচালিত ব্রিটিশ-বিরোধী সকল আন্দোলনকে অতিক্রম করে গিয়েছিল, যার কারণে সম্ভবত আন্তঃশ্রেণির চাপা-উত্তেজনা এবং সামাজিক উত্তপ্ততা প্রশমিত হয়। এ আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, এ আন্দোলনে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ওপর তেমন আক্রমণ হয় নি, এমনকি ১৯৩০-৩৪ সালের মতো রাজস্ব বন্ধ আন্দোলনও ততটা সর্বব্যাপী হয় নি।

কংগ্রেস যখন জনগণকে অহিংস পন্থা অবলম্বনের কথা দৃঢ়ভাবে বলছিল, তখন জনগণ কেন সহিংস পন্থা অবলম্বন করল তার সমাধান নিম্নরূপে হতে পারে। এ আন্দোলনে অনেকেই ছিলেন যাঁরা সহিংস পন্থা অবলম্বনে অস্বীকৃতি জানান এবং কংগ্রেসের প্রচলিত রাজনৈতিক ধারায় নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ রাখেন। কিন্তু গান্ধীর গোঁড়া সমর্থকদের অনেকেই ১৯৪২ সালে সহিংস নীতি অবলম্বন করেন। অনেকে মনে করেন যে, টেলিগ্রাফের তার কাটা কিংবা ব্রীজ উড়িয়ে দেওয়া সঠিক ছিল তখন পর্যন্ত, যখন পর্যন্ত এতে মানুষের প্রাণহানি ঘটে নি। কিন্তু অন্যেরা স্বীকার করেন যে, অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে তাদের পক্ষে সহিংস পন্থা অবলম্বন যথাযথ নয়, যদিও তারা কঠোর পরিস্থিতিতে আত্মরক্ষার শেষ উপায় হিসেবে এ পন্থাকে সঠিক মনে করেন। গান্ধী জনগণের এ সহিংস পন্থাকে নিন্দা জ্ঞাপনে অস্বীকৃতি জানান। কারণ তিনি একে দেখেন বড়ধরনের সহিংসতার প্রতিক্রিয়া হিসেবে। বলা হয়ে থাকে যে, সহিংসতার ব্যাপারে গান্ধীর মূল আপত্তি ছিল এ জন্য যে, এ পন্থায় আন্দোলনে জনগণের অংশগ্রহণ বাধাপ্রাপ্ত হয়। ১৯৪২ সালে গান্ধী এ অভিমত ব্যক্ত করেন যে, কিছু বিক্ষিপ্ত সহিংস ঘটনার জন্য জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। গান্ধী এটা অনুধাবন করেন যে, তিনি দেশবাসীকে যে ধরনের অহিংসার ধারণা প্রদান করেছেন এবং অনুসরণ করতে বলেছেন, তাতে তাঁর লক্ষ্য অর্জিত হবে না। এ জন্য তিনি রাজনৈতিক জীবনের শেষদিকে এসে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী জনগণকে নিজস্ব ধারায় পরিচালিত হওয়ার জন্য কিছুটা উপায় রেখে দেন। দীর্ঘকাল ধৈর্য্যের সাথে চলার পর তিনি এমন এক স্থানে পৌঁছেন যে, তিনি উপলব্ধি করেন, ঝুঁকিপূর্ণ হলেও তিনি জনগণকে দাসত্বের বিরুদ্ধে লড়তে বলবেন। গান্ধী যদিও এ সময়ে অতিমাত্রায় জঙ্গী মনোভাবাপন্ন ছিলেন, তথাপি কোনক্রমেই তিনি অহিংস পথকে পরিত্যাগ করতে প্রস্ত্তত ছিলেন না। এ সময়ে তিনি চাচ্ছিলেন আন্দোলন অহিংস পন্থায় পরিচালিত হোক, তবে জনগণের অনিয়ন্ত্রিত আন্দোলন যদি গৃহযুদ্ধ পর্যন্ত গড়ায় তবু তিনি আন্দোলন চালিয়ে যেতে প্রস্ত্তত ছিলেন। তাই গান্ধী বলেন, তারা যেন ভারতকে সঁপে দেয় ভগবানের হাতে অথবা আধুনিক অরাজকতার পথে। এভাবে দেখা যায় যে, ভারত ছাড় আন্দোলন গান্ধী পরিচালিত ১৯২০-২২ ও ১৯৩০-৩৪ সালের পূর্ববর্তী আন্দোলনের মতো নিয়ন্ত্রিত ও স্বেচ্ছামূলক আন্দোলন ছিল না। এটা প্রথানুগ সত্যাগ্রহের রূপ পরিগ্রহ করে নি। এটা ছিল শেষ করার যুদ্ধ, একটি প্রকাশ্য বিদ্রোহ, সংক্ষিপ্ত এবং দ্রুত ব্যবস্থা যা দেশকে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের মধ্যে ফেলে দেবে এবং যে কোন মূল্যেই বিদেশী আধিপত্যের অবসান ঘটবে।

পন্ডিতগণ ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া হিসেবে ভারত ছাড় আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ততা ও প্রস্ত্ততিমূলক প্রশ্নটিকে বিশ্লেষণ করেন। নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তার জনগণকে আতঙ্কিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে ফেলে। ধর্মঘট, বিক্ষোভ, মিছিল চলতে থাকে এবং এগুলিতে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ সরকারকে শঙ্কিত করে তোলে। জনগণের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা দেখা দেয় এবং এর থেকেই শুরু হয় সংঘাত। জনগণের জন্য কোন প্রকার দিক নির্দেশনা ছিল না। নেতৃবৃন্দ হয় পর্দার অন্তরালে অথবা আত্মগোপনে চলে যান। আবেগ তখন চরমে ছিল। বিভিন্ন ব্যক্তি ও দল তাদের নিজস্ব অবস্থান থেকে তাদের ধারণা অনুযায়ী পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করতে থাকে এবং তারা যা ভাল মনে করেন সেভাবেই কার্যক্রম পরিচালনা করেন। অব্যাহত পুলিশি নির্যাতন এবং রাষ্ট্রীয় অধ্যাদেশ জনগণের চিন্তা-চেতনাকে আরও উদ্দীপ্ত করে তোলে। এ সময় কংগ্রেস কর্তৃক আইন অমান্য আন্দোলন এর কোন প্রকার ডাক ছিল না। অতএব যা ব্যক্তিগত ক্ষোভ ও বিরোধিতা থেকে শুরু হয়েছিল তা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে আন্দোলনে রূপান্তরিত হয় এবং আন্দোলন পরিণত হয় বিদ্রোহে।

গুরুত্ব ও বিস্তৃতির দিক থেকে ভারত ছাড় আন্দোলনকে লর্ড লিনলিথগোর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ১৮৫৭ সালের ভারতীয় মহাবিদ্রোহের সাথে তুলনা করা যায়। এ আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, কারণ নিরস্ত্র ও নেতৃত্ববিহীন জনগণ শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদী সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে না। তবুও, এ মহান আন্দোলনের গুরুত্ব এখানে যে, এটা জাতীয় আন্দোলনে স্বাধীনতার দাবিকে মৌলিক দাবিতে পরিণত করে। ভারত ছাড় আন্দোলনের পরে পেছন দিকে ফেরার আর কোন পথ ছিল না। ব্রিটিশ সরকারের সাথে ভবিষ্যতে কোন ধরনের আলোচনা শুধু ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নেই হতে পারে। স্বাধীনতা আর দরকষাকষির ব্যাপার ছিল না এবং তা সুস্পষ্ট হয়েছিল যুদ্ধের পরে।  [রঞ্জিত রায়]