বিশ্ব ইজতেমা

বিশ্ব ইজতেমা  ‘তাবলীগ জামাত বাংলাদেশ’ কর্তৃক আয়োজিত অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় সমাবেশ। এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম সমাবেশ। ১৯৬৭ থেকে প্রতি বছর টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে এ ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। আরবি শব্দ ইজতিমা-র বাংলা অর্থ সম্মিলন, সভা বা সমাবেশ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এখানে সমবেত হয় বলেই এটি বিশ্ব ইজতেমা হিসেবে পরিচিত। বিশ্ব ইজতেমা তাবলীগ জামাতের নিরলস প্রচেষ্টার ফসল। মুসলমানদেরকে তরবিয়ত ও উৎসাহ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় নেওয়া এবং কোরআন-হাদীস তথা ইসলামি মূল্যবোধের আলোকে জীবন-যাপনে উদ্বুদ্ধ ও অভ্যস্ত করা বিশ্ব ইজতেমার প্রধান উদ্দেশ্য।

১৯২৬ সালে হযরত মাওলানা ইলিয়াস (রহঃ) ভারতের উত্তর প্রদেশের মেওয়াত এলাকায় তাবলীগী আন্দোলনের গোড়াপত্তন করেন এবং একই সঙ্গে এলাকাভিত্তিক সম্মিলন বা ইজতেমার আয়োজন করেন। কালক্রমে তাবলীগ সমগ্র উপমহাদেশে বিস্তার লাভ করে এবং উপমহাদেশের বাইরেও এর প্রভাব পড়ে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সূত্র ধরে উপমহাদেশের ভারত, পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান এ তিনটি অঞ্চলে মুসলমানদের অবস্থান সাপেক্ষে তাবলীগের তিনটি কেন্দ্র স্থাপিত হয়। পূর্ব পাকিস্তান অঞ্চলের তাবলীগ জামাতের বার্ষিক ইজতেমাই এখন টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা। বাংলাদেশ ছাড়াও পাকিস্তানের রাইভেন্ডে এবং ভারতের ভূপালে এ ধরনের বড় ইজতেমা হয়, তবে তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি লোক সমাগম হয়।

তাবলীগ জামাত বাংলাদেশ উনিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে ঢাকার কাকরাইল মসজিদে স্বল্পসংখ্যক লোক নিয়ে যাত্রা শুরু করে। পরবর্তীকালে ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রামের হাজী ক্যাম্পে তাবলীগ জামাতের একটি বড় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এরপর নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ইজতেমা হয় ১৯৫৮ সালে। ইজতেমার প্রতি মানুষের আগ্রহ দিন দিন বাড়তে থাকে এবং ১৯৬০, ১৯৬২ ও ১৯৬৫ সালে তা ঢাকায় রমনা পার্কের মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। জনসমাগম অনেক বেশি বেড়ে যাওয়ার কারণে ১৯৬৬ সালে টঙ্গীর পূর্বে অবস্থিত পাগার গ্রামে খোলা মাঠে ইজতেমার আয়োজন করা হয়। সে স্থানটিও অপর্যাপ্ত হওয়ায় পরবর্তী বছর টঙ্গী মহাসড়কের পশ্চিমে তুরাগ নদীর পূর্ব তীর সংলগ্ন বিস্তীর্ণ খোলা মাঠে ইজতেমার আয়োজন করা হয়। ১৯৬৭ সাল থেকে এখানেই নিয়মিত ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। সমাবেশে বিদেশ থেকেও বিপুল সংখ্যক মুসলমান যোগ দেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার বিশ্ব ইজতেমার জন্য তুরাগ নদীর তীরবর্তী এলাকায় ১৬০ একর জমির বরাদ্দ দেয়। টঙ্গী ছাড়াও বিশ্ব ইজতেমা বর্তমানে ভারত ও পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত হয়।

২০১০ সাল থেকে বিশ্ব ইজতেমা দু’পর্বে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। ২০০০-২০০১ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ইজতেমায় ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, মিশর, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, জার্মানি, চীন, জাপান, কেনিয়া, তুরস্কসহ প্রায় ৭০টি দেশ থেকে সর্বমোট প্রায় ২০ লক্ষ তাবলীগ অনুসারী বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণ করেন। তিনদিন ব্যাপী ইজতেমার তৃতীয় দিনে আখেরী মুনাজাতে অংশগ্রহণের জন্য রাজধানী ঢাকাসহ পার্শ্ববর্তী জেলাসমূহ থেকে লাখ লাখ মানুষ ইজতেমার মাঠে পৌঁছান।

প্রতিবছর বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে টঙ্গীর প্রায় ৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। ইজতেমা বিশ্বের নানা প্রান্তের মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক ঐক্য, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্যের এক অপূর্ব মিলনক্ষেত্র, যা ইসলামী সমাজ, শৃঙ্খলা, ভ্রাতৃত্ব ও মহানুভবতার এক অতুলনীয় দৃষ্টান্ত।

ইজতেমার কার্যক্রম পরিচালনার সুবিধার্থে ইজতেমার মাঠটিকে ২১টি খিত্তা বা অংশে বিভক্ত করা হয়। একেকটি খিত্তা মূলত বাংলাদেশের পুরাতন জেলাগুলির জন্যে নির্দ্দিষ্ট। কয়েকটি থাকে বিদেশিদের ভৌগোলিক বাসস্থান ভিত্তিতে বিন্যাসকৃত। পুরাতন বৃহত্তর জেলা অনুযায়ী বিভক্ত প্রতিটি খিত্তায় একজন সিনিয়র জিম্মাদার থাকেন এবং তাঁর অধীনে থাকেন জেলা ও থানার জিম্মাদার। সমন্বয়ের জন্য রয়েছে একটি কেন্দ্রীয় ইজতেমা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। তবে ইজতেমার বিশাল আয়োজনে কোন শ্রমিক নিয়োগ করা হয় না, সব কাজই নানা স্বেচ্ছাসেবক দল দ্বারা পরিচালিত হয়।  [মোহাম্মদ ইউছুফ]

আরও দেখুন তাবলীগ