বিকল্প বিরোধ-নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৫:৩৬, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

বিকল্প বিরোধ-নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫-তে মামলার বিচারের শুনানীপূর্ব পর্যায়ে আদালতের উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর আপোষ বা সমঝোতার মাধ্যমে পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তি করার, এবং বিচার শেষ হবার পর ও রায় প্রদানের আগে বিকল্প বিরোধ-নিষ্পত্তি প্রক্রিয়ায় গৃহশান্তি ও পারিবারিক পরিবেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। নির্বাচিত পারিবারিক আদালতগুলোতে আলাপ-আলোচনা, মধ্যস্থতা ও সালিশির মাধ্যমে পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য সরকার যুক্তরাষ্ট্রের একটি সংস্থার সহযোগিতায় ২০০০ সালে একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প গ্রহণ করার পূর্ব পর্যন্ত এ বিধানগুলো সংবিধি পুস্তকে বর্ণিত থাকলেও বাস্তবে অকার্যকর ছিল। পারিবারিক আদালতে বিচারের অপেক্ষায় থাকা মামলাগুলোর নিষ্পত্তির জন্য এমন আদালতের কিছু কিছু বিচারক ও আইনজীবিকে বিকল্প বিরোধ-নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া প্রয়োগ করার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। নির্বাচিত পারিবারিক আদালতগুলোর কাছ থেকে আশাব্যঞ্জক ফল লাভ করার পর বিকল্প বিরোধ- নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া এ জাতীয় আরও কতিপয় আদালত অবধি সম্প্রসারিত করা হয়েছে।

পারিবারিক আদালতের মামলাগুলোতে বিকল্প বিরোধ-নিষ্পত্তির পদ্ধতি প্রয়োগের ফলাফলে অনুপ্রাণিত হয়ে মধ্যস্থতা ও সালিশির মাধ্যমে দেওয়ানি মামলা নিষ্পত্তির জন্য দেওয়ানি কার্যবিধি (সংশোধনী) আইন, ২০০৩ বলে দেওয়ানি কার্যবিধিতে ৮৯ক ও ৮৯খ ধারা দুটির বিধান সংযোজিত হয়েছে। তবে অর্থঋণ আদালতগুলোতে বিচারের অপেক্ষায় থাকা অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানগুলোর পাওনা ঋণ আদায়ের মামলাগুলো এর আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। দেওয়ানি কার্যবিধির নতুন সংযোজিত ৮৯ক ধারার বিধানে দেওয়ানি আদালতকে মামলায় লিখিত বক্তব্য পেশ হবার পর প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষগুলো সশরীরে বা উকিলের মাধ্যমে আদালতে উপস্থিত হয়ে মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির জন্য মামলার শুনানী মূলতবী করে মামলার বিরোধ মধ্যস্থতা করার কিম্বা সেগুলো পক্ষগুলোর নিয়োজিত উকিলের কাছে কিম্বা উকিল নিয়োগ করা না থাকলে পক্ষ বা পক্ষগুলোর কাছে অথবা স্থানীয় আইনজীবী সমিতির সঙ্গে পরমর্শক্রমে জেলা জজ প্রণীত প্যানেলের মধ্য থেকে একজন মধ্যস্থতাকারীর কাছে পাঠানোর ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। মামলার পক্ষগুলোর উকিলদের কাছে বিরোধ পাঠানো হলে তারা মক্কেলদের সম্মতিক্রমে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একজন নিরপেক্ষ উকিল যেমন একজন অবসরপ্রাপ্ত জজ অথবা জেলা জজ প্রণীত নামের প্যানেল থেকে একজন মধ্যস্থতাকারী কিম্বা উপযুক্ত অপর যেকোন ব্যক্তিকে নিয়োগ করবেন। পক্ষগুলো এ ধরনের নিষ্পত্তির ব্যাপারে রাজী আছেন কিনা তা মধ্যস্থতার জন্য মামলাটি পাঠানোর তারিখ থেকে ১০ দিনের মধ্যে তাদের আদালতকে জানাতে হবে, এবং আদালতকে জানানোর তারিখ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে মধ্যস্থতার কাজ সম্পূর্ণ করতে হবে যদি না আদালত এই মোকদ্দমাটির মেয়াদ আরও ৩০ দিন বাড়িয়ে দেন। মধ্যস্থতাকারী মধ্যস্থতা ও কার্যক্রমের ফলাফল সম্পর্কে আদালতের কাছে রিপোর্ট পেশ করবেন এবং ফলাফল যদি মামলার বিরোধ বা বিরোধগুলোর আপোষ নিষ্পত্তি হয়ে থাকে তাহলে আপোষ রফার শর্তাবলি একটি চুক্তির আকারে লিপিবদ্ধ করতে হবে। সেই চুক্তিতে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো স্বাক্ষর করবে এবং মধ্যস্থতাকারী ও উকিলরা তা সত্যায়িত করবেন। অতঃপর আদালত সেই চুক্তির ভিত্তিতে আদেশ বা ডিক্রি জারী করবেন। মধ্যস্থতা ব্যর্থ হলে এবং আদালত নিজে মধ্যস্থতা না করলে যে পর্যায়ে মধ্যস্থতা শুরু হয়েছিল সেই পর্যায় থেকে শুনানীর মধ্য দিয়ে মামলার বিচার প্রক্রিয়া অগ্রসর হবে যেন মধ্যস্থতার কোনো সিদ্ধান্তই কখনও নেয়া হয় নি। আদালত নিজেই যদি মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তাহলে তার মধ্যস্থতা ব্যর্থ হলে মধ্যস্থতা করার এখতিয়ার সম্পন্ন অপর একটি আদালত মামলার  শুনানী গ্রহণ করবে।

এমন মধ্যস্থতার কার্যক্রম গোপন থাকবে এবং মধ্যস্থতা চলাকালে করা হয়েছে বা অনুষ্ঠিত হয়েছে এমন যেকোন যোগাযোগ বা সংলাপ প্রকাশ না করার বিশেষ অধিকার হিসেবে গণ্য হবে এবং একই মামলার পরবর্তী কোনো শুনানীতে বা অপর কোনো কার্যক্রমে সেগুলো উল্লেখ করা যাবে না ও সাক্ষ্য প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। এধরনের আপোষ নিষ্পত্তি অনুযায়ী আদালতের দেয়া কোনো আদেশ বা ডিক্রির বিরুদ্ধে কোনরকম আপীল করা বা পর্যালোচনার আবেদন করা যাবে না। মধ্যস্থতার মাধ্যমে কোনো মামলার নিষ্পত্তি বা আপোষ করা হলে আদালত সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে কোর্ট ফির টাকা ফেরত দেয়ার আদেশ দেবেন।

অনুরূপভাবে দেওয়ানি কার্যবিধির ৮৯খ ধারার বিধানে বিরোধ বা বিরোধগুলো সালিশের কাছে পাঠানোর জন্য সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর আবেদনের ভিত্তিতে দেওয়ানি আদালতকে মামলা প্রত্যাহারের অনুমতি দেয়ার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এমন একটি দরখাস্ত সালিশি আইন, ২০০১-এর ৯ ধারার অধীনে একটি সালিশ চুক্তি বলে গণ্য হবে। কোনো  ধরনের সালিশ না হলে কিম্বা সালিশ ব্যর্থ হলে ইতোপূর্বে প্রত্যাহূত মামলাটি নতুন করে রুজু করার অধিকার সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর থাকবে। আপীল মামলার ক্ষেত্রেও অনুরূপ মধ্যস্থতার ব্যবস্থা করে দেওয়ানি কার্যবিধি (সংশোধনী) আইন, ২০০৬ এর মাধ্যমে ৮৯ গ ধারা  উক্ত কার্যবিধিতে সংযোজিত করা হয়েছে।

নতুন করে সংবিধিবদ্ধ অর্থঋণ আদালত আইন ২০০৩ সালের ৫ম অধ্যায়ে ফয়সালামূলক বৈঠক ও মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিকল্প বিরোধ-নিষ্পত্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। উক্ত আইনের ২১ ধারায় বলা আছে যে, অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানের দায়েরকৃত সুদসহ ঋণ আদায়ের মামলায় বিবাদী পক্ষ লিখিত বক্তব্য পেশ করার পর অর্থঋণ আদালতের পরিচালনাকারী জজ ঐ মামলার পরবর্তী সকল কার্যক্রম স্থগিত রেখে ফয়সালামূলক বৈঠক ডাকবেন এবং তাতে মামলার পক্ষগুলো এবং তাদের আইনজীবী ও প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন। ফয়সালা বা নিষ্পত্তিমূলক বৈঠক গোপনীয়তার মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে। এমন বৈঠকে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো কোনো সমঝোতায় পৌঁছালে সমঝোতার শর্তাবলি উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো একটি চুক্তি স্বাক্ষর করবেন এবং উপস্থিত আইনজীবী ও প্রতিনিধিরা তা সত্যায়িত করবেন এবং এই চুক্তির ভিত্তিতে আদালত একটি আদেশ বা ডিক্রি জারী করবেন। এমন বৈঠকে কোনো সমঝোতায় পৌঁছানো না গেলে ঐ আদালতের পরিচালনাকারী বিচারক যদি ইত্যবসরে বদলী হয়ে না থাকেন তাহলে মামলাটি এ বিষয়ে এখতিয়ার সম্পন্ন আরেকটি আদালতে স্থানান্তরিত হবে এবং মামলার কার্যক্রম সেই পর্যায় থেকে শুরু হবে যে পর্যায়ে সমঝোতা বৈঠকটি শুরু হয়েছিল, যেন সমঝোতা বৈঠক অনুষ্ঠানের কোনো কার্যক্রম ছিল না। উক্ত আইনের ২২ ধারায় বলা আছে যে, মামলায় বাদীপক্ষ লিখিত বক্তব্য পেশ করার পর সমঝোতা বৈঠক অনুষ্ঠানের কোনো আদেশ যদি দেয়া না হয়ে থাকে তাহলে আদালত স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে কিম্বা পক্ষগুলোর অনুরোধে মামলার পরবর্তী সকল কার্যক্রম স্থগিত রেখে নিরপেক্ষ আইনজীবী, অবসরপ্রাপ্ত জজ বা ব্যাংক ও অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানের কোনো অবসরপ্রাপ্ত অফিসার অথবা সমঝোতার জন্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিযুক্ত অপর কোনো উপযুক্ত ব্যক্তির কাছে পাঠাবেন। মধ্যস্থতার কার্যক্রম গোপনে অনুষ্ঠিত হবে। মধ্যস্থতার পর মধ্যস্থতাকারী মধ্যস্থতার বিবরণ সম্বলিত একটি রিপোর্ট আদালতে পেশ করবেন। এ ধরনের কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে কোনো সমঝোতা হয়ে থাকলে বিরোধ নিষ্পত্তির শর্তাবলি অন্তর্ভূক্ত করে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে এবং মধ্যস্থতাকারী ও আইনজীবীদের তা সত্যায়িত করতে হবে। ঐ চুক্তির ভিত্তিতে আদালত একটি আদেশ বা ডিক্রী জারী করবেন। এমন মধ্যস্থতা কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে যদি কোনো ফয়সালা না হয় তাহলে যে পর্যায়ে মধ্যস্থতা শুরু হয়েছিল সে পর্যায় থেকে মামলার শুনানী শুরু হবে যেন এধরনের মধ্যস্থতার কোনো কার্যক্রম কখনই হয় নি। এমন মধ্যস্থতার কার্যক্রম গোপন থাকবে এবং মধ্যস্ততা চলাকালীন যেকোন যোগাযোগ বা সংলাপ ইত্যাদি বিশেষাধিকার হিসেবে গণ্য হবে এবং ঐ মামলার পরবর্তী কার্যক্রমে কিম্বা অন্য আর কোনো কার্যক্রমে সেগুলোর উল্লেখ করা হবে না কিম্বা সাক্ষ্যপ্রমাণেও তা গ্রহণযোগ্য হবে না। মামলার দুই পক্ষের মধ্যকার এধরনের চুক্তির ভিত্তিতে আদালতের দেয়া আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে কোনো আপীল বা পর্যালোচনার আবেদন করা যাবে না। মামলাটি এমন সমঝোতার মাধ্যমে নিষ্পত্তি হলে আদালত সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে কোর্ট ফির অর্থ ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেবেন।

এমন সমঝোতা বৈঠক বা কার্যক্রম ঐ বৈঠক বা কার্যক্রমের আদেশের তারিখ থেকে ৬০ দিন সময়ের মধ্যে এবং কতিপয় চুক্তিতে আরও ৩০ দিন সময়ের মধ্যে সম্পন্ন এমন বৈঠক বা কার্যক্রমে আলোচ্য অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানের প্রাধিকার প্রাপ্ত একজন অফিসার প্রতিনিধি হিসেবে থাকবেন এবং মামলায় দাবিকৃত অর্থের পরিমাণ পাঁচ কোটি টাকার বেশি হলে আদালতকে এই বৈঠক বা কার্যক্রম শুরু করা সংক্রান্ত আদেশ ঐ অর্থ প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীকে জানাতে হবে।

আদালত সংস্কার (সহায়ক বিধানাবলি) বাস্তবায়ন আইন, ২০০৪-এ সরকার কর্তৃক প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শক্রমে প্রজ্ঞাপন জারী মারফত সুপ্রিম কোর্ট বা প্রকল্প জেলা আদালতগুলোতে প্রচলিত আইনের প্রয়োগ সাময়িকভাবে শিথিল বা বন্ধ রাখার এবং ওসব আদালতে জুডিশিয়াল ক্যাপাসিটি বিল্ডিং প্রজেক্ট ফর কোর্ট এডমিনিস্ট্রেশন বাস্তবায়ন, মামলার ব্যবস্থাপনা, তথ্য প্রযুক্তির প্রয়োগ ইত্যাদির জন্য প্রচলিত আদেশ, বিধিবিধান ইত্যাদির প্রয়োগ সাময়িকভাবে শিথিল বা বন্ধ রাখার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ঢাকা,  গাজীপুর, খুলনা, কুমিল্লা ও রংপুর জেলা আদালত এ প্রকল্পের অর্ন্তগত। [কাজী এবাদুল হক]