বায়ুদূষণ

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১০:২০, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

বায়ুদূষণ (Air Pollution)  প্রাকৃতিকভাবে অথবা মানুষের কর্মকান্ডের ফলে সৃষ্ট ক্ষতিকর ও বিষাক্ত পদার্থের দ্বারা বায়ুমন্ডলের দূষণ। বায়ুদূষণপূর্ণ কোন একটি এলাকায় বায়ুতে অবমুক্ত ক্ষতিকর পদার্থসমূহের পরিমাণ অন্যান্য স্থানের তুলনায় অধিকতর হওয়ায় সহজেই দূষণের ক্ষতিকর প্রভাবসমূহ শনাক্ত করা যায়। বায়ুদূষণের প্রধান উৎসসমূহ হচ্ছে গাড়ি থেকে নির্গত ধোঁয়া, বিদ্যুৎ ও তাপ উৎপাদনকারী যন্ত্র থেকে উৎপন্ন ধোঁয়া, শিল্পকারখানা এবং কঠিন বর্জ্য পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট ধোঁয়া। বায়ুদূষণের আরও একটি কারণ অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের ঊর্ধ্বে বায়ুমন্ডলের ওজোন স্তরে ক্রমবর্ধমান ফাটল সৃষ্টি হওয়া। মানবজাতি, উদ্ভিদরাজি, পশুপাখি এবং জলজ প্রতিবেশ ব্যবস্থার ওপর অ্যাসিড বৃষ্টি সংঘটনের মাধ্যমেও বায়ুদূষণ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে আসছে।

সাম্প্রতিককালে বিশ্বের অন্যান্য স্থানের মতো এশিয়াতেও পরিবেশগত ইস্যুগুলির মধ্যে বায়ুদূষণ অধিকতর প্রাধান্য লাভ করেছে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য বাণিজ্যিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রগুলিতে সমস্যাটি প্রকট আকার ধারণ করেছে। চট্টগ্রাম, খুলনা, বগুড়া এবং রাজশাহী অঞ্চলের নগর এলাকাগুলিতে বায়ুদূষণের স্বাস্থ্যগত প্রতিক্রিয়া ঢাকার তুলনায় কম। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শহর এলাকায় অনেক সময় এমন সব শিলা ও মৃত্তিকার উপর বাড়িঘর নির্মাণ করা হয় যাদের ভিত্তি থেকে তেজষ্ক্রিয় গ্যাস বিকীর্ণ হয়। দীর্ঘসময় এই গ্যাস নিঃশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করলে ফুসফুসের ক্যান্সার হতে পারে। বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় বায়ুদূষণ এখনও তেমন কোন সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয় নি। কেননা এ সকল এলাকায় যন্ত্রচালিত গাড়ির সংখ্যা যেমন কম, তেমনি শিল্প কারখানার সংখ্যাও অল্প। তবে ইটের ভাটা এবং রান্নার চুল্লি থেকে শহরতলী ও গ্রামীণ এলাকায় যথেষ্ট পরিমাণে বায়ুদূষণ ঘটছে। গ্রামাঞ্চলে কাঠ, কয়লা এবং বিভিন্ন ধরনের জৈববস্ত্ত জ্বালানি হিসেবে ব্যবহূত হয়ে থাকে। ফলে গ্রামাঞ্চলে প্রধান বায়ুদূষক হলো সম্ভবত কোন নির্দিষ্ট কণিকা উপাদানে গঠিত বস্ত্ত এবং উদ্বায়ী জৈব যৌগ (Volatile Organic Compound-VOC)।

বাংলাদেশে প্রধানত দুটি উৎস থেকে বায়ুদূষণ ঘটছে- শিল্প কারখানাসমূহ নির্গত ধোঁয়া এবং যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া। ইটের ভাটা, সার কারখানা, চিনি কল, কাগজ কল, পাটকল, বস্ত্র কারখানা, স্পিনিং মিল, ট্যানারী শিল্প, গার্মেন্ট ফ্যাক্টরী, রুটি ও বিস্কুট কারখানা, রাসায়নিক ও ঔষধ শিল্প, সিমেন্ট কারখানা, মেটাল ওয়ার্কশপ, করাত কল প্রভৃতি শিল্প কারখানা প্রধানত বায়ুদূষণ ঘটাচ্ছে। এছাড়াও কর্ষিত জমি থেকে উৎপন্ন ধুলা এবং উপকূলীয় দ্বীপসমূহ ও উপকূলীয় ভূমি এলাকায় সন্নিকটস্থ সমুদ্র তরঙ্গসৃষ্ট লবণ কণা দ্বারা বায়ুদূষণ হয়ে থাকে। বায়ুদূষণের এসকল উৎস থেকে প্রচুর পরিমাণে ধোঁয়া, বাষ্প, গ্যাস ও ধুলিকণা উৎপন্ন হয়, যা কুয়াশা ও ধোঁয়াচ্ছন্ন পরিবেশ সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের কয়েক প্রকার শিল্প কারখানা যেমন ঢাকা শহরের হাজারীবাগে অবস্থিত ট্যানারী কারখানাগুলি প্রতিনিয়ত হাইড্রোজেন সালফাইড, অ্যামোনিয়া, ক্লোরিনসহ আরও কয়েক প্রকার গন্ধহীন রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করছে যেগুলি একদিকে যেমন বিষাক্ত তেমনি অন্যদিকে স্থানীয় জনগণের বিরক্তি ও পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এসকল দূষক মাথাধরা এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যগত সমস্যা সৃষ্টি করছে। অধিক হারে নগরায়নের কারণে নগরে যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে অধিকতর হারে বায়ুদূষণ ঘটছে।

পরিবেশ অধিদপ্তর এবং পরিবেশ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থা দুই স্ট্রোক ইঞ্জিনবিশিষ্ট অটোরিক্সা (বেবিট্যাক্সি), টেম্পো, মিনি-ট্রাক ও মোটর সাইকেলকে প্রধান বায়ুদূষণকারী যান হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বর্তমানে (২০০১ সাল) ঢাকা শহরে চলাচলকারী ২,৯৬,০০০-এরও অধিক মোটর যানের মধ্যে প্রায় ৬৫ হাজারই দুই স্ট্রোক ইঞ্জিনবিশিষ্ট বেবিট্যাক্সি। সেইসঙ্গে মাত্রাতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল বোঝাই করা, দুর্বল ইঞ্জিনবিশিষ্ট পুরাতন বাস ও ট্রাকসমূহ কালো ধোঁয়া ও বিষাক্ত গ্যাস নির্গত করে নগরীর রাস্তায় চলাচল করছে। প্রকৃতপক্ষে ঢাকার রাস্তায় প্রতিদিন চলাচলকারী ৯০ ভাগেরও অধিক যানবাহন ত্রুটিযুক্ত যেগুলি প্রতিদিন সহনীয় মাত্রার অধিক ধোঁয়া নির্গত করে চলেছে। ডিজেল চালিত যানবাহনগুলি কালো ধোঁয়া নির্গত করে যাতে দহন সম্পূর্ণ না হওয়া সূক্ষ্ম কার্বন কণা বিদ্যমান থাকে।

অধিক দূষণ সৃষ্টির কারণে ঢাকা মহানগরীতে বর্তমানে দুই স্ট্রোক ইঞ্জিনকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। মহানগরীসমূহে যানবাহনসৃষ্ট বায়ুদূষণের প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাংক বেবিট্যাক্সিসহ ছোট ছোট যানবাহনের পরিবর্তে নগরীসমূহে বড় বড় বাসের পরিমাণ বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ঢাকা মহানগরীতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যানবাহনের আগমন এই উদ্যোগেরই ফসল।

বাংলাদেশে বর্তমানে বায়ুর দূষক পদার্থ শনাক্তকরণের লক্ষ্যে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা এবং বগুড়ায় বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ঢাকার তেজগাঁও, ফার্মগেট, মানিক মিয়া এভিনিউ, গুলশান, লালমাটিয়া এবং আগারগাঁও-এ যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া পরীক্ষা করার কেন্দ্র রয়েছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৯৫ সাল থেকে নিয়মিত বায়ুর গুণাগুণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আসছে।

আবাসিক এলাকা, শিল্প এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা এবং সংবেদনশীল এলাকাসমূহের জন্য বায়ুর গুণাগুণ মাত্রা বিভিন্ন ধরনের। ঢাকা শহরের সর্বাধিক বায়ুদূষণ কবলিত এলাকাসমূহ হচ্ছে হাটখোলা, মানিক মিয়া এভিনিউ, তেজগাঁও, ফার্মগেট, মতিঝিল, লালমাটিয়া এবং মহাখালী। ১৯৯০ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, বায়ুমন্ডলে বিদ্যমান দূষক কণাসমূহের ঘনত্ব প্রতি ঘনমিটারে ৩,০০০ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে (ফার্মগেট পুলিশ বক্স, ডিসেম্বর ১৯৯৯), যেখানে গ্রহণযোগ্য মাত্রা হচ্ছে প্রতি ঘনমিটারে ৪০০ মাইক্রোগ্রাম। ফার্মগেট এলাকায় সালফার ডাই অক্সাইডের ঘনত্ব পাওয়া গিয়েছে প্রতি ঘনমিটারে ৩৮৫ মাইক্রোগ্রাম, যেখানে বায়ুমন্ডলে এর সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য সীমা প্রতি ঘনমিটারে ১০০ মাইক্রোগ্রাম। একইভাবে তেজগাঁও শিল্প এলাকায় ১৯৯৭ সালের জানুয়ারি মাসে বায়ুমন্ডলে বিদ্যমান দূষক কণাসমূহের ঘনত্ব পরিলক্ষিত হয়েছে প্রতি ঘনমিটারে ১,৮৪৯ মাইক্রোগ্রাম, যা ঐ এলাকার গ্রহণযোগ্য মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ৫০০ মাইক্রোগ্রামের তুলনায় অনেক বেশি। সচরাচর ডিসেম্বর মাস থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত বিদ্যমান শুষ্ক মাসগুলিতে ঢাকার বায়ুদূষণ সর্বাধিক পরিলক্ষিত হয়ে থাকে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন এবং বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (সায়েন্স ল্যাবরেটরি) পরিবেশ অধিদপ্তরের সহযোগিতায় ঢাকার বাতাসে সীসার ঘনত্ব পরিমাপ করেছে। ঢাকা শিশু হাসপাতাল বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ঢাকা মহানগরীর শিশুদের রক্তে সীসার মাত্রা পরীক্ষা করেছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বি.আর.টি.এ) যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া পরিমাপ করার লক্ষ্যে মিরপুরে একটি কেন্দ্র স্থাপন করেছে।

বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন এক রিপোর্টে উল্লেখ করেছে যে, নগরবাসীরা রাস্তাঘাটে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে যে সীসা গ্রহণ করছে তা পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক নিরাপদ ঘোষিত মাত্রার চেয়ে প্রায় ১০ গুণেরও বেশি। ঢাকা শহরের প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে সীসার পরিমাণ ৪৬৩ ন্যানোগ্রাম যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। ১৯৯৬ সালের নভেম্বর মাস থেকে ১৯৯৭ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ঢাকা শহরের ফার্মগেট এবং তেজগাঁও এলাকার তিনটি বিভিন্ন স্থানে প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে পরিমাপকৃত সীসার মাত্রা ছিল যথাক্রমে ১২৩ থেকে ২৫২ ন্যানোগ্রাম এবং ৬১ থেকে ৭৬ ন্যানোগ্রাম।

বায়ুদূষণের কারণে সর্বাধিক ক্ষতির শিকার হয় শিশুরা। বায়ুতে অতিরিক্ত সীসার উপস্থিতি শিশুদের মানসিক বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে। প্রতিবছর ঢাকা মহানগরীর বায়ুতে প্রায় ৫০ টন সীসা নির্গত হচ্ছে। শুষ্ক ঋতুতে অর্থাৎ নভেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসে বায়ুতে সীসার পরিমাণ সর্বোচ্চে পৌঁছে। ঢাকা শিশু হাসপাতালের শিশু বিকাশ কেন্দ্রে (Child Development Centre) সম্প্রতি শিশুদের দেহে সীসা দূষণের ঘটনা শনাক্ত করা হয়েছে। পরীক্ষাকৃত শিশুদের রক্তে প্রায় ৮০ মাইক্রোগ্রাম/ডি.এল থেকে ১৮০ মাইক্রোগ্রাম/ডি.এল সীসা পাওয়া গিয়েছে যা গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে ৭ থেকে ১৬ গুণ বেশি। ইউ.এস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন-এর নির্দেশনা অনুযায়ী রক্তে ১০ মাইক্রোগ্রাম/ডি.এল পরিমাণ পর্যন্ত সীসার উপস্থিতি নিরাপদ। মধ্যম আয়ের নগর এলাকা অথবা গ্রামীণ এলাকার তুলনায় নগরীয় বস্তি এলাকায় বসবাসকারী অধিবাসীদের রক্তে গড় সীসার মাত্রায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান সীসা দূষণ মানবদেহের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করা ছাড়াও বৃক্কের সচলতাকে নষ্ট করে দেয় এবং উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি করে। শিশুদের রক্তে অতিরিক্ত সীসার উপস্থিতি তাদের মস্তিষ্ক এবং বৃক্ককে নষ্ট করে ফেলতে পারে। পূর্ণ বয়ষ্ক মানুষের তুলনায় শিশুরা সীসা দূষণে তিনগুণ বেশি আক্রান্ত হয়।

ঢাকা মহানগরীর রিক্সাওয়ালা, বেবিট্যাক্সি চালক, ট্রাফিক পুলিশ, টেম্পো চালকের সহকারী, পেট্রোল পাম্পে কর্মরত শ্রমিকদের রক্তে সীসার উপস্থিতি লক্ষ্য করা গিয়েছে এবং এ সকল পেশার লোকদের রক্তে গড় সীসার পরিমাণ যথাক্রমে ২৪৮ মাইক্রোগ্রাম/ডি.এল (১৫৪ থেকে ৩৪৪ মাইক্রোগ্রাম/ডি.এল পর্যন্ত), ২৮৭ মাইক্রোগ্রাম/ডি.এল (১৬১ থেকে ৩৭২ মাইক্রোগ্রাম/ডি.এল পর্যন্ত), ২৭২ মাইক্রোগ্রাম/ডি.এল (১৫২ থেকে ৩৩২ মাইক্রোগ্রাম/ডি.এল পর্যন্ত), ২৫৫ মাইক্রোগ্রাম/ডি.এল এবং ২৪৯ মাইক্রোগ্রাম/ডি.এল পাওয়া গিয়েছে। এ সকল পেশার লোকদের রক্তে প্রাপ্ত সীসার গড় মাত্রা গ্রহণযোগ্য সীমার চেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে এবং এদের মধ্যে ট্রাফিক পুলিশ সবচেয়ে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ দল। সাধারণত রক্তে সীসার মাত্রা বৃদ্ধি বায়ুদূষিত অঞ্চলে অবস্থান বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পৃক্ত।

সীসার এ সকল ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়ার কথা বিবেচনা করে সরকার সীসামুক্ত পেট্রোল আমদানি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে এবং ১৯৯৯ সাল থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়েছে। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কেন্দ্র এবং ইস্টার্ন রিফাইনারী লিমিটেড-এর সাম্প্রতিক জরিপ অনুযায়ী (১৯৯৯ সাল থেকে ২০০০ সালের মধ্যে পরিচালিত) বর্তমানে দেশের পেট্রোল পাম্পসমূহ থেকে বিতরণকৃত গ্যাসোলিন সম্পূর্ণ সীসামুক্ত।

লক্ষ্য করা গিয়েছে যে, ঢাকা শহরের ভিওসি (VOC) গ্রহণযোগ্য সীমার বাইরে রয়েছে, যাদের কয়েকটি ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী। ঢাকার দুই-স্ট্রোকবিশিষ্ট অটোরিক্সাসমূহ থেকে নির্গত ধোঁয়ায় গ্রহণযোগ্য সীমার চেয়ে ৪ থেকে ৭ গুণ বেশি ভিওসি পাওয়া গিয়েছে।

ধূলিকণা থেকে সৃষ্ট বায়ুদূষণ হাঁপানিসহ শ্বাসযন্ত্রের অন্যান্য রোগ সৃষ্টি করে থাকে। সম্প্রতি ঢাকা শহরের শেওড়াপাড়া থেকে সংগৃহীত বায়ুর চারটি নমুনা বিশ্লেষণে ২০০ প্রকার জৈব যৌগ শনাক্ত করা গিয়েছে। ঢাকার হাটখোলা, মানিক মিয়া এভিনিউ, তেজগাঁও, ফার্মগেট, মতিঝিল, লালমাটিয়া এবং আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালগুলিকে সর্বাধিক ভিওসি দূষিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিগত ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে ১৯৯৭ সালের জুন মাস পর্যন্ত পরিচালিত এক জরিপে দেখা গিয়েছে যে, ফার্মগেট এলাকার বায়ুতে বিরাজমান দূষক পদার্থসমূহের ঘনত্ব প্রতি ঘনমিটারে ২,৪৬৫ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে, যেখানে গ্রহণযোগ্য সীমা হচ্ছে প্রতি ঘনমিটারে ৪০০ মাইক্রোগ্রাম। অন্যদিকে, তেজগাঁও শিল্প এলাকায় বায়ুতে বিদ্যমান দূষক পদার্থের সর্বোচ্চ ঘনত্ব গ্রহণযোগ্য প্রতি ঘনমিটারে ৫০০ মাইক্রোগ্রামের বিপরীতে ছিল ৬৩০ মাইক্রোগ্রাম।

খনি বায়ু দূষণ  ধুলাবালি এবং খনিতে সৃষ্ট গ্যাস কয়লাখনিতে সমস্যার সৃষ্টি করে থাকে। সৌভাগ্যক্রমে দিনাজপুর জেলার বড়পুকুরিয়া কয়লাখনিতে গ্যাসের পরিমাণ খুবই অনুল্লেখযোগ্য হওয়ায় খনি থেকে কয়লা উত্তোলন প্রক্রিয়ায় মিথেন গ্যাস নির্গমন ও মিথেন গ্যাস সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দুর্যোগ ঘটার সম্ভাবনাও রয়েছে খুবই কম। বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে যান্ত্রিক উপায়ে কয়লা আহরণ করা হবে বিধায় প্রচুর পরিমাণে কয়লার গুঁড়াও উৎপন্ন হবে, তবে যথার্থ পদক্ষেপ গ্রহণ করলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হতে পারে। একইভাবে দিনাজপুর জেলার মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনি থেকেও প্রচুর পরিমাণে ধুলাবালি উৎপন্ন হবে। সেইসঙ্গে ঘন ঘন যান চলাচল এবং পণ্য বোঝাই ও পণ্য খালাসকরণ প্রক্রিয়ায়ও প্রচুর ধুলাবালি উৎপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ভূ-পৃষ্ঠে এবং খনি গহবরে কয়লা, জ্বালানি এবং লুব্রিক্যান্টের দহনের ফলে সৃষ্ট গ্যাস দ্বারা আশপাশের এলাকার বায়ু দূষিত হতে পারে। খনি থেকে কয়লা ও কঠিন শিলা কর্তন, গলানো, চূর্ণ করা এবং পরিবহণের সময় সৃষ্ট ধুলাবালি খনিতে কর্মরত শ্রমিক এবং আশপাশের এলাকার অধিবাসীদের জন্য হুমকিস্বরূপ।

সরকারি সিদ্ধান্ত  সম্প্রতি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় বায়ুদূষণ রোধে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে: (১) দুই স্ট্রোক ইঞ্জিনে ব্যবহারের জন্য লুব্রিকেটিং অয়েলের ন্যূনতম মান হতে হবে APITC অথবা JASOEB এবং (২) অপরিশোধিত খনিজ তেলের বিপণন যত দ্রুত সম্ভব বন্ধ করা হবে।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন ১৯৮৫-৮৬ সাল থেকে যানবাহনে গ্যাসোলিনের পরিবর্তে সংকুচিত প্রাকৃতিক গ্যাস (সিএনজি)- এর ব্যবহার প্রবর্তনের লক্ষ্যে একটি প্রকল্প চালু করেছে। এই প্রকল্পের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল গ্যাসোলিন ব্যবহারের ফলে যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া সৃষ্ট বায়ুদূষণ সিএনজি ব্যবহারের মাধ্যমে হ্রাস করা। এই প্রকল্প শুরু করার জন্য বিশ্বব্যাঙ্ক ২২৫ মিলিয়ন টাকা অনুদান হিসেবে প্রদান করেছে। সর্বশেষ প্রাপ্ত উপাত্ত থেকে জানা যায়, ১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৯৭ সালের মধ্যে নিম্নলিখিত হারে যানবাহন সিএনজিতে রূপান্তর করা হয়েছে, যথা: ১৯৮৫-৮৬ সালে ২টি; ১৯৮৮-৮৯ সালে ১৯টি; ১৯৮৯-৯০ সালে ৯টি; ১৯৯০-৯১ সালে ৬টি; ১৯৯১-৯২ সালে ১০টি; ১৯৯২-৯৩ সালে ১৬টি; ১৯৯৩-৯৪ সালে ৩টি; ১৯৯৫-৯৬ সালে ১৩টি এবং ১৯৯৬-৯৭ সালে ৮৬টি। যানবাহন সিএনজিতে রূপান্তর করার প্রক্রিয়ায় বেসরকারি খাতের ট্যাক্সি ক্যাবগুলির অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। ২০০২ সালের প্রারম্ভে সরকার যানবাহনে সিএনজি ব্যবহারের লক্ষ্যে প্রচারণা শুরু করার পাশাপাশি দুই স্ট্রোকবিশিষ্ট অটোরিক্সাসৃষ্ট বায়ুদূষণ হ্রাস করার উদ্দেশ্যে এ সকল যানবাহনের ইঞ্জিন সিএনজিতে রূপান্তর করার জন্য মালিকদেরকে বাধ্য করছে।

দূষণ নিয়ন্ত্রণ নীতি  পরিবেশ সম্পর্কিত বাংলাদেশের প্রথম প্রবিধান ছিল ১৯৬৫ সালের কলকারখানা সংক্রান্ত অধ্যাদেশ (Factory Act of 1965)। এর পরে ১৯৭০ সালে প্রণীত হয় প্রথম বিধিবদ্ধ পরিবেশ সংরক্ষণ অধ্যাদেশ ‘পানি দূষণ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ ১৯৭০’। তবে এ সকল অধ্যাদেশে বায়ুদূষণ সমস্যা অন্তর্ভুক্ত নয়। পরবর্তীতে এ সকল অধ্যাদেশে সংশোধনী আনা হয় এবং পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ, ১৯৭৭ (Environmental Pollution Control Ordinance-EPC) প্রণীত হয়। এই অধ্যাদেশে তরল, গ্যাসীয়, কঠিন, তেজষ্ক্রিয় অথবা অন্যান্য পদার্থ দ্বারা সৃষ্ট বায়ু, ভূ-পৃষ্ঠস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানি এবং মৃত্তিকা দূষণ রোধ সম্পর্কে সরকারি নীতিমালা বর্ণিত হয়েছে। যদিও আইনগতভাবে ই.পি.সি-১৯৭৭ পাস করা হয়, কিন্তু কখনও এই আইনের যথাযথ প্রয়োগ বাস্তবে দেখা যায় নি। দ্রুত শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার ফলে বাংলাদেশের পরিবেশ চিত্রে নাটকীয় পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। দেশের বন ও পরিবেশ রক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯৮৯ সালে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ অধিদপ্তর গঠন করা হয় এবং ১৯৯২ সালে পরিবেশ নীতি প্রণয়ন করা হয়। দেশব্যাপী পরিবেশ সংরক্ষণ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষাপটে এবং দেশের পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের লক্ষ্যে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে পরিবেশ সংরক্ষণ অধ্যাদেশ, ১৯৯৫ এবং পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা, ১৯৯৭ পাস হয়।  [সিফাতুল কাদের চৌধুরী]

গ্রন্থপঞ্জি  United Nations Environment Programme, State of the Environment, Bangladesh, United Nations Environment Programme, 2001.