বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতি

বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতি  ১৮৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন। প্রথমে এর নাম ছিল চট্টগ্রাম বৌদ্ধ সমিতি, পরে নতুন নামকরণ হয় ‘বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতি’। শুরু থেকেই সমিতির প্রধান কার্যালয় চট্টগ্রামে অবস্থিত, তবে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরেও এর শাখা কার্যালয় রয়েছে।

সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে গুণমেজু মহাথেরো এবং নাজির কৃষ্ণচন্দ্র চৌধুরী। গুণমেজুর মৃত্যুর পর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন প্রথম সঙ্ঘরাজ পূর্ণাচার ধর্মাধারী চন্দ্রমোহন মহাথেরো। ১৯০৪ সালে সমিতির উদ্যোগে চট্টগ্রামে বৌদ্ধ মন্দির সড়কের পাশে নির্মিত হয় বর্তমান চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহার। এ সময় সমিতির সভাপতি পদে বৃত হন চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ অগ্গমহাপন্ডিত  ধর্মবংশ মহাস্থবির (১৮৭২-১৯৩৯)। তাঁর নেতৃত্বে এতদঞ্চলের বৌদ্ধদের মধ্যে এক নবজাগরণের সৃষ্টি হয়।

শতবর্ষ প্রাচীন এই বৌদ্ধ সমিতির কর্মক্ষেত্র যেমন ব্যাপক তেমনি গৌরবদীপ্ত। ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ ভারতের বড়লাট চট্টগ্রাম সফরে এলে সমিতির পক্ষ থেকে তাঁর নিকট একটি স্মারকলিপি পেশ করা হয়। তাতে উত্থাপিত দাবির প্রেক্ষাপটে ১৯১০ সাল থেকে চট্টগ্রাম কলেজে পালি বিভাগ খোলা হয়।

এই সমিতির অনুপ্রেরণায় চট্টগ্রাম অঞ্চলের বৌদ্ধদের মধ্যে শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যে জাগরণ ঘটে তার ফলে  বেণীমাধব বড়ুয়া, নলিনাক্ষ দত্ত, রায় বাহাদুর ধীরেন্দ্রলাল বড়ুয়া (প্রাক্তন এম.পি) প্রমুখের ন্যায় অনেক বৌদ্ধ জ্ঞানি-গুণীর আবির্ভাব ঘটে। বর্তমানে এই সমিতির পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত হচ্ছে  চট্টগ্রাম পালি কলেজ, ধর্মবংশ ইনস্টিটিউশন এবং বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কর্মকান্ড। এছাড়া শীলাচার ভবন এবং ডি.বি ইনস্টিটিউশন ভবনও এই সমিতির উদ্যোগেই নির্মিত হয়।

শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতি দেশের ভাবমূর্তি বিকাশে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করছে। ১৯৩৬ সালে আসামের ডিব্রুগড়ে একটি বৌদ্ধবিহার প্রতিষ্ঠায় সমিতির সভাপতি ধর্মবংশ মহাথেরোর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। তিনি রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের জন্মশত বার্ষিকীতে আমন্ত্রিত হয়ে সেখানে গিয়েছিলেন। ১৯৫৬ সালে বার্মায় যে ষষ্ঠ বৌদ্ধ  সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়, তাতে বার্মা সরকার কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়ে সমিতির সভাপতি দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান মহাথেরো পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে যোগদান করেন। চট্টগ্রাম বৌদ্ধবিহারে সুরক্ষিত বুদ্ধের কেশধাতু দেশের এক অমূল্য সম্পদ। এর কিয়দংশ ১৯৫৮ সালে শ্রীলঙ্কা, ১৯৬৪ সালে জাপান এবং ১৯৭৯ সালে থাইল্যান্ড সরকারকে সে দেশের জনগণের পূজার জন্য বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে অর্পণ করা হয়। এর ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে ওইসব দেশের এক বন্ধুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

বিশ্ব বৌদ্ধ সৌভ্রাতৃত্ব সংঘ (WFB) বিশ্বের বৌদ্ধ নেতৃবৃন্দের মিলনতীর্থস্বরূপ। এ সংস্থার বিভিন্ন কর্মকান্ডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত থেকে বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিশেষ অবদান রাখছে। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বিনিময়ের নিদর্শনস্বরূপ শ্রীলঙ্কা সরকার সমিতিকে একটি বোধিবৃক্ষের চারা উপহার দেয়। ১৯৮০ সালে রাষ্ট্রপতি  জিয়াউর রহমান এক বর্ণাঢ্য উৎসবের মাধ্যমে চারাটি চট্টগ্রাম বৌদ্ধবিহার চত্বরে রোপণ করেন। উল্লেখ্য যে, বোধিবৃক্ষের এই চারাটি বুদ্ধগয়ার মহাবোধি বৃক্ষের বংশোদ্ভূত।

বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতি আমেরিকা, কোরিয়া, হংকং, মালয়েশিয়া, নেপাল, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রতিনিধিত্ব করে দেশের ভাবমূর্তি বিকাশে অবদান রেখেছে।  [রেবতপ্রিয় বড়ুয়া]