বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৬:২২, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ

বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক  কৃষিঋণ কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে দেশের সর্ববৃহৎ জাতীয় বিশেষায়িত ব্যংকিং প্রতিষ্ঠান। ১৯৭৩ সালে কৃষি উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক আদেশবলে (রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ২৭, ১৯৭৩) একটি বিশেষায়িত সরকারি ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স কর্পোরেশন এবং ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক-এর সমন্বয়ে ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের উত্তরসূরি। প্রাথমিকভাবে ব্যাংকের অনুমোদিত মূলধন ৫০০ মিলিয়ন টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ছিল ৩৭০ মিলিয়ন টাকা। সম্পূর্ণ শেয়ারই সরকার ক্রয় করে। পরবর্তীকালে ব্যাংকিং কার্যক্রম ও ব্যবসায় বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে এর অনুমোদিত এবং পরিশোধিত মূলধন যথাক্রমে ২ বিলিয়ন ও ১ বিলিয়ন টাকায় উন্নীত করা হয়। ২০০৮ সালে কৃষি ব্যাংকের অনুমোদিত এবং পরিশোধিত উভয় মুলধনই ৩.৫ বিলিয়ন টাকায় উন্নীত করা হয়।

গ্রাম-বাংলার অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যকে সামনে রেখে কৃষির সার্বিক উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য এই ব্যাংকের সৃষ্টি। দেশে কৃষিঋণ পরিচালনা কর্মকান্ডের সিংহভাগই এককভাবে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের অবদান। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক কৃষি খাতের জন্য একটি বিশেষায়িত উন্নয়ন ব্যাংক হলেও এটি অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংকের মতো সব ধরনের ব্যাংকিং কর্মকান্ড পরিচালনা করে থাকে। কৃষিঋণ বিতরণের পাশাপাশি বৈদেশিক বিনিময় ব্যবসা, বাণিজ্যিক ও কৃষিভিত্তিক শিল্প/প্রকল্প, প্রকল্পের চলতি মূলধন, এসএমই, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা, মাইক্রো ক্রেডিট, কনজ্যুমার ক্রেডিট এবং দারিদ্র্য বিমোচন কর্মকান্ড ইত্যাদি খাতে এই ব্যাংক ঋণ সহায়তা প্রদান করে থাকে। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে দুইদফা বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলিতে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের গৃহীত পুনর্বাসন কর্মসূচি সরকারসহ সকল মহলে প্রশংসিত হয়। বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যবসার জন্য এই ব্যাংকের রয়েছে ১৫টি অনুমোদিত বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় শাখা এবং ২২৫টি বিদেশি প্রতিসঙ্গী ব্যাংক। এই শাখাগুলির মাধ্যমে ব্যাংকের সকল শাখার বৈদেশিক রেমিট্যান্সের টাকা ৩ দিনের মধ্যে গ্রাহকের নিকট পৌঁছে দেওয়া হয়। এ ব্যাংকের মোট ৮২টি শাখা ওয়ানস্টপ সার্ভিসের আওতায় আনা হয়েছে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকার বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের (বিকেবি) কার্যক্রম দেখাশোনা করার জন্য প্রশাসক নিয়োগ করে। ১৯৭৩ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক আদেশ-এর শর্তানুযায়ী একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্যাংকের সার্বিক দায়িত্ব গ্রহণ করে। ১৯৭৫ সালের মার্চে সরকার ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদ গঠন করে এবং ১৯৮১ সালের এপ্রিলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদাধিকারবলে পরিচালক পর্ষদের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়। ১৯৮১ সালের এপ্রিলে চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের জন্য দুটি ভিন্ন ভিন্ন অফিস প্রতিষ্ঠা করা হয়। সরকার কর্তৃক বিকেবি-র কর্মকর্তা নন এমন একজন পরিচালককে পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ করা হয়। পক্ষান্তরে ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী করা হয়। বর্তমানে পরিচালক পর্ষদে চেয়ারম্যানসহ মোট ১১ জন পরিচালক রয়েছে। ব্যাংকের ঢাকাস্থ প্রধান কার্যালয়ে ৭টি বিভাগ রয়েছে, যথা প্রশাসন, ঋণ, অর্থ, কার্যক্রম, পরিকল্পনা ও ঋণ আদায়, নিরীক্ষা ও পরিদর্শন এবং আন্তর্জাতিক বিভাগ। ৭টি বিভাগের প্রতিটির প্রধানের দায়িত্বে রয়েছে একজন করে মহাব্যবস্থাপক।

মৌল তথ্য ও পরিসংখ্যান (মিলিয়ন টাকায়)
বিবরণ ২০০৪ ২০০৫ ২০০৬ ২০০৭ ২০০৮ ২০০৯
অনুমোদিত মূলধন ২০০০ ২৪০০ ৩০০০ ৩০০০ ৩৫০০ ১৫০০০
পরিশোধিত মূলধন ২০০০ ২৪০০ ৩০০০ ৩০০০ ৩৫০০ ৯০০০
রিজার্ভ ফান্ড ১২৪২ ১৩০৫ ১৩৩৮ ১৩৬৯ ১৫৪০ ২০৬০
মোট আমানত ৪৯৭০০ ৫৫৯৬০ ৬৩৪১৩ ৬৬৩০৭ ৭৯৫১৭ ৯৩৪৪৭
ক) তলবি আমানত ৪৭৫৫ ৫৪০৮ ৬৫০৮ ৭৩৬৬ ৭৬৭৩ ১০৩৫১
খ) মেয়াদি আমানত ৪৪৯৪৫ ৫০৫৫২ ৫৬৯০৫ ৫৮৯৪১ ৭১৮৪৪ ৮৩০৯৬
ঋণ ও অগ্রিম ৫৯৩০৪ ৬১৪০৭ ৭০০৫৬ ৭৩২৮৬ ৮৩৪৪৮ ৯১৭৯৮
বিনিয়োগ ১৬৮৮ ১৭১৯ ১৬০৮ ১৬০৮ ১৪৯২ ১৫১২
মোট পরিসম্পদ ৮৭৪১৬ ৯৫২৮৪ ১০২৩৯৬ ১০২৩৯৬ ১১৭৮২৩ ১৪০৮১৬
মোট আয় ৪১৯৮ ৩৯২৩ ৪৭৩১ ৪৭৩১ ৬৫০১ ৯৮৬৬
মোট ব্যয় ৫৬০৬ ৫৭৬৭ ৬৫০৪ ৬৫০৪ ৮৪৬৭ ৯৭৪১
বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবসা পরিচালনা ১১৯৯২ ২০২৬৮ ২৭৬২০ ৩১২১২ ৩৫৮৫২ ৪৫৯৫৯
ক) রপ্তানি ৪৮৪০ ৫৬৩১ ৭৫৬৮ ৯০৮৬ ১০৮৪৪ ১৩৪৬৭
খ) আমদানি ৫৫৮০ ১২১৮৩ ১৬৭৭২ ১৬৮৩১ ১৮১৩০ ২২৯৭৯
গ) রেমিট্যান্স ১৫৭২ ২৪৫৪ ৩২৮০ ৫২৯৫ ৬৮৭৮ ৯৫১৩
মোট জনশক্তি (সংখ্যায়) ১০৭৭৯ ১০৬১৭ ১০৪৫৪ ১০২৩৬ ১০৫৩০ ১০৩১৩
ক) কর্মকর্তা ৪৬৪২ ৪৬৩৪ ৪৫০১ ৪৩৬৫ ৪৭৫৬ ৪৭১৭
খ) কর্মচারি ৬১৩৭ ৫৯৮৩ ৫৯৫৩ ৫৮৭১ ৫৭৭৪ ৫৫৯৬
বিদেশি প্রতিসংগী ব্যাংক (সংখ্যায়) ১৭৯ ১৮১ ১৮৮ ১৯০ ২১৫ ২২৫
শাখা (সংখ্যায়) ৯২৯ ৯৩৮ ৯৪২ ৯৪৮ ৯৫০ ৯৫২
ক) বাংলাদেশে ৯২৯ ৯৩৮ ৯৪২ ৯৪৮ ৯৫০ ৯৫২
কৃষিখাতে
ক) ঋণ বিতরণ ১২৬০৫ ১২৬৬৮ ১৭৬০০ ১৬৭৯৯ ১৬৭০৯ ১৭৩৬৬
খ) আদায় ১৩০৭৩ ৮৯১৩ ১৪৫৪৮ ১৭৮৭৩ ১৫৩৭১ ১৫৩৪৯
শিল্প খাতে
ক) ঋণ বিতরণ ৩৮৮৩ ৩৯৮৮ ৫৫১১ ৭২৪৪ ৭১০৫ ৭৯৬৪
খ) আদায় ৩৫৭৬ ৩১৫৬ ৪৬৭৯ ৬৭৭১ ৬৮১৪ ৮৫৪২
খাতভিত্তিক ঋণের স্থিতি
ক) কৃষি ও মৎস্য ৩৬৯৩৩ ৪৫৩৯৩ ৫০৭৯৯ ৫০৭৪২ ৫৬১০৯ ৫৭১৭৫
খ) শিল্প ৬৫৫৮ ৬৯৭৫ ৯০৭৯ ১০২৪৫ ১০০৪৮ ৯৭৮৩
গ) ব্যবসাবাণিজ্য ২৬৪৭ ১৬০৮ ২৫৪৯ ২৭৫৩ ৫৭১৫ ৯৮৪৯
ঘ) দারিদ্র্য বিমোচন ৩২০০ ২১৩০ ২২০৭ ২৪১০ ১৩২০ ৩৪১৫

উৎস  অর্থবিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সরকার, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যাবলী, ২০০৪-০৫ থেকে ২০০৯-১০

বিকেবি ব্যক্তিবিশেষ ও যে কোনো সংস্থাকে শস্য উৎপাদন, সবজি আবাদ, বনায়ন, মৎস্যচাষ কর্মকান্ডে নিয়োজিতদের ঋণসুবিধা প্রদান করে থাকে। এটি গ্রামীণ কুটির শিল্পকেও আর্থিক এবং কারিগরি সহায়তা দিয়ে থাকে। বিকেবিকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কাজ করার নির্দেশ রয়েছে তবে তা হতে হবে পল্লী ও শহর এলাকার কৃষি, কৃষিভিত্তিক এবং এই সম্পর্কিত অন্যান্য শিল্পের উন্নতির জন্য। বিকেবি ক্ষুদ্র কৃষক এবং অন্যান্য সুবিধাবঞ্চিত দলকে ঋণ চাহিদায় যতদূর সম্ভব অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে।

ব্যাংকটি শস্য উৎপাদনে আর্থিক সহায়তা প্রদানে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে এবং উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ, গুদামজাতকরণ, কৃষি ও কৃষিভিত্তিক উৎপাদিত পণ্য বিপণনে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদান করে থাকে। যে উদ্দেশ্যে ঋণ প্রদান করা হবে তার কার্যকাল এবং আয় সৃষ্টির ক্ষমতার ওপর ঋণের মেয়াদ নির্ধারিত হয়ে থাকে। ব্যাংকটি সাধারণত মৌসুমি কৃষি উৎপাদন কর্মকান্ডের জন্য স্বল্পমেয়াদি ঋণ প্রদান করে। অগভীর পাম্প, হস্তচালিত পাম্প, কৃষি সরঞ্জাম, গরুর গাড়ি, ছাগলের খামার, হাঁসমুরগি, হালের জন্য গরু-মহিষ, কৃষিপণ্যের পরিবহণ সুবিধা এবং কৃষি উন্নয়ন সম্পর্কিত কর্মকান্ডের জন্য মধ্যমেয়াদি ঋণ মঞ্জুর করে থাকে। দীর্ঘমেয়াদি ঋণ মূলধন ব্যয়ের জন্য প্রদান করা হয়, যেমন কলের লাঙল ক্রয়, অগভীর নলকূপ, বরফকল নির্মাণ, কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপন, চা বাগান সম্প্রসারণ, সবজি বাগান, বনায়ন, মৎস্যচাষে বিনিয়োগ। স্বল্পমেয়াদি ঋণের মেয়াদ ১৮ মাস, মধ্যমেয়াদি ঋণের মেয়াদ ৫ বছর পর্যন্ত এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণের মেয়াদ ৫ বছরের অধিক।

বিকেবি অসংখ্য প্রকল্প এবং বিশেষ কর্মসূচিতে আর্থিক সহায়তা দেয়, যেমন বিশেষ কৃষিঋণ, বিএডিসির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ কৃষি-খামারি, আলু চাষ এবং সংরক্ষণ, চা বাগান, হস্তচালিত পাম্প, অগভীর ও গভীর নলকূপ স্থাপন, পরীক্ষামূলক অর্থসংস্থান প্রকল্প, দুগ্ধ খামার প্রকল্প, হাঁস-মুরগি পালন, মৎস্যচাষ, গবাদিপশু পালন, তামাক, তুলা ও কলা উৎপাদন এবং বিপণনে ঋণ সহায়তা, বেতাগি কমিউনিটি ফরেস্ট প্রজেক্ট, স্বনির্ভর বাংলাদেশ, শিক্ষিত বেকার যুবকদের আত্মকর্মসংস্থান ইত্যাদি খাতে ব্যাংকটি বার্ষিক প্রায় ১৪ বিলিয়ন টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করে।

কৃষি খাতের উন্নয়নের মাধ্যমে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, আমদানি বিকল্প শস্য উৎপাদন, ক্রমবর্ধমান কৃষি ঋণের চাহিদা পূরণ, কৃষিতে নতুন নতুন দিক চিহ্নিতকরণের মাধ্যমে ব্যাপক কৃষিঋণ বিতরণপূর্বক কৃষি খাতকে অধিকতর সুদৃঢ়করণ এবং ব্যাংকের তহবিলের ভিত্তি আরো মজবুতকরণ ইত্যাদির প্রতি লক্ষ্য রেখে প্রতিটি অর্থবছরের কৃষিঋণ বিতরণ, ঋণ আদায় ও আমানত সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।

দেশের মানুষের মধ্যে সঞ্চয় স্পৃহা জাগ্রত করে তাদেরকে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল করার লক্ষ্যে সাধারণ আমানত হিসাবের পাশাপাশি কৃষি ব্যাংক ইতিপূর্বে বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র সঞ্চয় স্কিম চালু করেছে। ২০০৮ অর্থবছরে ‘বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক সঞ্চয় স্কিম’ নামে ৭ বছর মেয়াদি একটি নতুন সঞ্চয় স্কিম চালু করে হয়। ফসল মৌসুমে যথাসময়ে দ্রুততা ও স্বচ্ছতার সাথে কৃষকদের হাতে ঋণের টাকা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে ব্যাংকের শাখাগুলি কৃষিঋণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এছাড়া আর্থ-সামাজিক ও দারিদ্র্য বিমোচন কর্মকান্ডের আওতায় ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও বর্গাচাষীদেরও সহজ শর্তে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক আর্থিক সহায়তা প্রদান করছে।  [মোহাম্মদ আবদুল মজিদ]