বসু, গিরিশচন্দ্র

বসু, গিরিশচন্দ্র (১৮৫৩-১৯৩৯)  শিক্ষাবিদ ও কৃষিগবেষক। ১৮৫৩ সালের ২৯ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার বেরুগ্রামে তাঁর জন্ম। ১৮৭৬ সালে হুগলি কলেজ থেকে বিএ পাস করে তিনি কটকের র‌্যাভেন্শ কলেজে উদ্ভিদবিদ্যার প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। এ পেশায় নিয়োজিত থাকা অবস্থায়ই ১৮৭৮ সালে তিনি এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৮৮১ সালে সরকারি বৃত্তি নিয়ে কৃষি বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভের জন্য তিনি লন্ডন যান। সেখানে কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ইংল্যান্ডের রয়েল এগ্রিকালচারাল সোসাইটির আজীবন সদস্য (১৮৮২) এবং কেমিক্যাল সোসাইটি অব ইংল্যান্ডের ফেলো (১৮৮৩) নির্বাচিত হন। লন্ডনে অধ্যয়নশেষে তিনি স্কটল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইতালি হয়ে ১৮৮৪ সালে দেশে ফিরে আসেন। এ সময় তিনি নতুন নতুন শিক্ষাপদ্ধতি সম্পর্কেও জ্ঞান লাভ করেন।

১৮৭৭ সালে বৈবাহিক সূত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়। পরবর্তীকালে  ভূদেব মুখোপাধ্যায়, ভূপাল বসু, ব্যোমকেশ চক্রবর্তী, লর্ড এস.পি সিং,  প্রফুল্লচন্দ্র রায়জগদীশচন্দ্র বসু প্রমুখ মনীষীর সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ইংল্যান্ডের জীবনযাপন এবং টেনিসনের রচনাও তাঁকে অনেকখানি প্রভাবিত করে।

ভারতের শিক্ষাক্ষেত্রে, বিশেষত কৃষিশিক্ষা ক্ষেত্রে, গিরিশচন্দ্রের অবদান অবিস্মরণীয়। বিলাত থেকে দেশে ফিরে সরকারি উচ্চপদ ও মর্যাদা উপেক্ষা করে তিনি কৃষি-ব্যবস্থার উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁরই উদ্যোগে ১৮৮৬ সালে বঙ্গবাসী স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পরের বছর এটি কলেজে রূপান্তরিত হয়। মূলত কৃষিশিক্ষার প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যেই এ কলেজ স্থাপিত হয়। তাঁর প্রচেষ্টায় ১৯৩৫ সালে এ কলেজে জীববিদ্যা বিভাগ খোলা হয়। গিরিশচন্দ্র দীর্ঘকাল (১৮৮৭-১৯৩৩) এ কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৩৫ সালে রেক্টর মনোনীত হন।

কৃষিবিদ গিরিশচন্দ্র বিশ্বাস করতেন, ভারতের অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা কেবল কৃষির উন্নতির মাধ্যমেই সম্ভব। কৃষির সঙ্গে অবশ্য তিনি শিল্পের উন্নয়নের কথাও বলতেন। গিরিশচন্দ্র বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় কৃষি গেজেট (১৮৮৫) নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল ভারতের কৃষিব্যবস্থার উন্নয়ন ও জনগণের মধ্যে কৃষিশিক্ষা প্রচার করা। তিনি উদ্ভিদবিদ্যা ও কৃষিবিদ্যা বিষয়ক অনেক মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য: এ ম্যানুয়াল অব ইন্ডিয়ান বোটানি, ভূ-তত্ত্ব (১৮৮১), উদ্ভিদ জনন, কৃষি-সোপান (১৮৮৮), কৃষি পরিচয় (১৮৯০), কৃষিদর্শন (১ম ভাগ, ১৮৯৭), গাছের কথা (১৯১০) এবং উদ্ভিদজ্ঞান (১৯২৩-১৯২৫, দুই পর্ব)। ইংল্যান্ড ভ্রমণের অভিজ্ঞতা প্রকাশ পেয়েছে তাঁর রচিত বিলাতের পত্র (১৮৭৬) ও ইউরোপ ভ্রমণ (১৮৮৪) গ্রন্থে।

১৯০৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন প্রণয়নে গিরিশচন্দ্র বিশেষ ভূমিকা রাখেন। দীর্ঘসময় তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেট সভার সদস্য ছিলেন। এছাড়া তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে বিজ্ঞান শাখার (১৯১৯) সভাপতি এবং বোটানিক্যাল সোসাইটি অব বেঙ্গল-এর (১৯৩৫) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।

সামাজিক দিক থেকে গিরিশচন্দ্র ছিলেন একজন উদারচেতা ও প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ। তিনি অস্পৃশ্যতা বা বর্ণপ্রথায় বিশ্বাস করতেন না। মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের একজন ঘোর সমর্থক ছিলেন তিনি। নারীশিক্ষার প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা ছিল। তিনি বহুবিবাহের কঠোর বিরোধিতা করেন। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ না করলেও তাঁর জাতীয়তাবাদী চেতনা ও দেশাত্মবোধ ছিল প্রবল। তিনি ব্রিটিশ নীতির সমালোচনা করেন এবং মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য কাজ করেন। ১৯৩৯ সালের ১ জানুয়ারি তাঁর মৃত্যু হয়।  [সমবারু চন্দ্র মহন্ত]