বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন, ১৮৮৫

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৬:৪৮, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন, ১৮৮৫ ভূমি নিয়ন্ত্রণে প্রজা ও জমিদারদের পারস্পরিক দায় ও অধিকার সংক্রান্ত আইন। আইনটি প্রণীত হয়েছিল একটি বিশেষ প্রেক্ষাপটে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর থেকে জমিদার-প্রজা সম্পর্কে অবনতি ঘটতে থাকে। পরিশেষে উভয় শ্রেণির মধ্যে দ্বন্দ্ব এমন চরমে ওঠে যে, উপনিবেশিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা হুমকির সম্মুখীন হয়। জামিদারদের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রজা-অসন্তোষ প্রশমনের উদ্দেশ্যে সরকার প্রয়োজনীয় বিধিবিধান প্রণয়নের আবশ্যকতা অনুভব করে। স্মর্তব্য যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত জমিদারকে ভূমির একমাত্র মালিক বলে ঘোষণা করলেও রায়তের অধিকার সম্পর্কে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের রেগুলেশন ছিল নিরব। তবে রেগুলেশনে ভূমিতে প্রজার প্রথাগত অধিকার রয়েছে মর্মে অস্পষ্ট আভাষ ছিল মাত্র। উনিশ শতকের প্রথমদিকে কৃষকের চেয়ে ভূমির সরবরাহ বেশি থাকায় প্রজার ওপর জমিদারদের উৎপীড়ন তেমন লক্ষ্য করা যায় যায় না। কিন্তু উনিশ শতকের শেষপর্বে এসে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ভূমির ওপর চাপ বৃদ্ধি পায় এবং জমিদার-রায়ত সম্পর্কের ওপর এর স্বাভাবিক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। ভূম্যধিকারী শ্রেণীর মধ্যে ভূমির চাহিদা বৃদ্ধির সুযোগে খাজনার হার বৃদ্ধি করার প্রবণতা দেখা দেয়। কিন্তু রায়তশ্রেণী জামিদারদের এরূপ প্রবণতাকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে এ যুক্তিতে যে, ভূমিতে তাদের প্রথাভিত্তিক অধিকার রয়েছে এবং তা ক্ষুণ্ণ করার অধিকার জমিদারের নেই। তারা দাবি করে যে, প্রত্যেক মহালের পরগনা নিরিখ বা খাজনার হার প্রথাগতভাবে নির্ধারিত রয়েছে। তাদের মতে, পরগনা নিরিখ মোতাবেক সে নির্ধারিত হার সম্পূর্ণ আইনানুগ ও বৈধ। তারা দাবি করে যে, যুগ যুগ ধরে প্রচলিত ঐ পরগনা নিরিখ উপেক্ষা করে খাজনা বৃদ্ধি করার অধিকার জমিদার বা সরকারের নেই। কিন্তু জমিদারশ্রেণী এ যুক্তি বরাবর অগ্রাহ্য করে পাল্টা যুক্তি দেয় যে, জমির একচ্ছত্র মালিক হিসেবে জমিদার ইচ্ছেমতো খাজনা বৃদ্ধির অধিকার রাখে। তাদের মতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত রেগুলেশন অনুসারে রায়ত হলো জমিদারের ইচ্ছাধীন প্রজা (tenant-at-will), অর্থাৎ ভূমির মালিক হিসেবে জমিদার ইচ্ছেমতো খাজনার হার বাড়াতে কমাতে পারে, এমনকি রায়তকে তার ভূমি থেকে উচ্ছেদও করতে পারে।

জমিদার-প্রজা সম্পর্ক অবনতিতে বিশেষ অবদান রাখে মধ্যস্বত্ব সমস্যা। সূর্যাস্ত আইন এর চাপে পড়ে খাজনা সংগ্রহের সুবিধার্থে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত রেগুলেশন লঙ্ঘন করে জমিদারেরা উনিশ শতকের প্রথম থেকেই ভূমিতে মধ্যস্বতভোগী শ্রেণী সৃষ্টি করতে থাকে। এ প্রবণতার ফলে জমিদার ও প্রজার মধ্যখানে উদ্ভূত হয় উৎপাদনে ভূমিকাহীন মধ্যস্বত্বভোগী নামে একটি পরজীবীশ্রেণী। জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগীদের আয় অটুট রাখা বা বৃদ্ধি করার জন্য খাজনা বাড়ানোর প্রয়োজন দেখা দেয়। ভুক্তভোগী রায়তগণ আইনের আশ্রয় নিলে আদালত মধ্যস্বত্বভোগীদের অধিকার সম্পর্কে কোন চূড়ান্ত রুলিং না দিয়ে কখনও এ সমস্যাকে বৈধ, কখনও বা অবৈধ বলে রায় প্রদান করে। ফলে রায়ত ও জমিদারশেণী, তথা রায়ত ও ঊর্ধ্বতন সকল ভূ-স্বার্থশ্রেণীর মধ্যে বিরোধ ক্রমাগত বাড়তেই থাকে। এ বিরোধকে তীব্রতর করে আরেকটি নবোত্থিত ভূমি-ভিত্তিক শ্রেণী। ব্রিটিশ শাসনাধীনে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ ও কৃষিপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি প্রভৃতি কারণে গ্রামীণ সমাজে একটি ধনী কৃষক শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। কিন্তু ভূমিতে এদের অধিকার ছিল অন্যান্য প্রজার মতোই ন্যূন যা তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারে নি। তাদের স্বচ্ছলতা ও সামাজিক প্রতিপত্তি এমন বৃদ্ধি পায় যে, তারা অধিকার আদায়ের জন্য সাধারণ প্রজাদের নেতৃত্ব দিতে থাকে। তাদেরকে ভুমিতে নানা সুযোগ সুবিধার স্বীকৃতি দিয়ে প্রণীত হয়েছিল রেন্ট অ্যাক্ট, ১৮৫৯ (খাজনা আইন)। কিন্তু এতে কৃষক অসন্তোষ  প্রশমিত হয় নি।

উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে কৃষক প্রতিরোধ আন্দোলন ক্রমশ দানা বেঁধে উঠলে সরকার উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। ১৮৭০-এর দশকে সারা বাংলায়, বিশেষ করে পাট উৎপাদনকারী জেলাসমূহে  কৃষক প্রতিরোধ আন্দোলন এমন চরমে ওঠে যে, দাবি আদায়ের লক্ষ্যে জেলায় জেলায় জমিদারবিরোধী প্রজাজোট গঠন করে রায়তশ্রেণি আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটায়। পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সরকার ১৮৮০ সনে একটি ‘রেন্ট কমিশন’ গঠন করে। এ কমিশনের সুপারিশের আলোকে বঙ্গীয় আইন পরিষদ ১৮৮৫ সালে অষ্টম আইন প্রণয়ন করে যা, সাধারণভাবে  বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন, ১৮৮৫ নামে পরিচিত। প্রজাদের দাবিদাওয়া অনেকাংশে মেনে নিয়ে আইনটি বিভিন্ন শ্রেণির প্রজা ও মধ্যস্বত্বভোগীর অধিকার ও দায়দায়িত্ব সংজ্ঞায়িত করে। প্রথাগত অধিকারও এ আইনে স্বীকৃত হয় যা কৃষক প্রতিরোধ আন্দোলনের এক বড় অর্জন। তবে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনে নিম্নশ্রেণির রায়তের অধিকার সংজ্ঞায়িত হয় নি। কোর্ফা, বর্গা, চাকরান, নানকার, কর্ষাদার প্রভৃতি নিম্নশ্রেণীর কৃষক জমিদারের ইচ্ছাধীন প্রজারূপে চিহ্নিত হয় এবং বাকি সব প্রজা স্থায়ী ভূ-স্বার্থ শ্রেণী হিসেবে স্বীকৃত হয়। বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন পর্যায়ক্রমে ভূমি জরিপের জন্য একটি ম্যানুয়েলও তৈরি করে। এ জরিপের উদ্দেশ্য, জমিদার থেকে নিম্নতম প্রজা পর্যন্ত সকল শ্রেণীর অধিকার, দায়দায়িত্ব চিহ্নিত করে একটি Record of Right বা চকভিত্তিক স্বত্ব-খতিয়ান দলিল তৈরি করা।

বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব (সংশোধনী) আইন, ১৯২৮ নিমস্বত্ব রায়তদের (Under Raiyots) দাবির প্রেক্ষাপটে বঙ্গীয় আইন পরিষদ কর্তৃক প্রণীত হয় একটি সংশোধনী আইন। ১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন স্থায়ী রায়তদের অধিকারসমূহ স্পষ্টভাবে সজ্ঞায়িত হলেও নিমস্বত্ব রায়তদের অধিকার (তাদের দখলে থাকা ভূমির ওপর) সংজ্ঞায়িত হয় নি। আইনে অস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল মাত্র। বিভিন্ন শ্রেণীর নিমস্বত্ব রায়তগণ (বর্গাদার, কর্ষাদার, কোর্ফা এবং ধানকরারি রায়তগণ) নিয়মিত বন্দোবস্তে আবাদ করত না, তারা অস্থায়িভাবে প্রতিযোগিতামূলক ভিত্তিতে পতিত ভূমি আবাদ করত। ভূমির প্রাচুর্যের কারণে তারা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে স্থায়ী ভোগদখলকারী রায়তদের চেয়েও স্বল্প খাজনায় আবাদ করতে পারত। এ জাতীয় প্রতিযোগিতামূলক রায়তগণ সাধারণত নিমস্বত্ব রায়ত নামে পরিচিত হয় এবং কৃষক ও ভূমির অনুপাত কৃষকের পক্ষে থাকা পর্যন্ত তুলনামূলকভাবে ভূমিতে কৃষক শ্রেণীর অবস্থান খুব খারাপ ছিল না। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ঊনিশ শতকের শেষ দিক থেকে শুরু করে, বিশেষ করে বিশ শতকের প্রথম দিকে ভূমির ওপর চাপ উল্লেখযোগ্যহারে বেড়ে যায়। ভূমির স্বল্পতা এবং তার ওপর নিমস্বত্ব রায়তদের ওপর রাজস্ব বৃদ্ধির কারণে তাদের অর্থনীতি ক্রমান্বয়ে খারাপের দিকে যাচ্ছিল।

১৯২০ সাল থেকে নির্বাচনী রাজনীতি প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এবং বাংলায় কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রসারের ফলে এ দেশের অধস্তন রায়তদের আইনগত অবস্থান সম্পর্কে জনমত ক্রমেই সমালোচনামুখর হয়ে ওঠে। উল্লেখ্য যে, বাংলার রায়তশ্রেণীর অধিকাংশই ছিল ভূমিতে অধিকারবিহীন। যেসকল রায়ত এক নাগাড়ে কয়েক বছর কোন ভূমিতে দখলদার ছিল, উক্ত বিলে তাদেরকে সে ভূমিতে অধিকার প্রদানের প্রস্তাব করা হয়। অধিকন্তু এই বিলে বর্গাদারকেও ভূমিতে অধিকার দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়।

আইনসভায় ভূম্যধিকারী গোষ্ঠী প্রস্তাবটির চরম বিরোধিতা করে, কিন্তু তা মুসলমান সদস্যগণসহ কৃষকদরদি দলগুলির দ্বারা সমর্থিত হয়। কয়েকটি সংশোধনীসহ প্রস্তাবটি আইন পরিষদে পাস হয়। বস্ত্তত এ সংশোধনীগুলির ফলে আইনের মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়। এ আইনের অধীনে একজন নিমস্বত্ব রায়ত কোন নির্দিষ্ট জমি ক্রমাগত বারো বছর ভোগ দখল করে থাকলে প্রতিযোগিতামূলক হারে নিয়মিত রাজস্ব প্রদানের ভিত্তিতে সেই জমির ওপর সে অধিকার লাভ করে। এই রায়তদের রাজস্ব বৃদ্ধি করার এবং রাজস্ব না দেওয়ার জন্য তাদের উৎখাত করার অধিকার জমিদারদের হাতে সংরক্ষিত থাকে। এর ফলে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব (সংশোধনী) আইন, ১৯২৮ নিমস্বত্ব রায়তদের বাস্তব সুবিধা প্রদান করতে পারেনি, তবে কাগজে-কলমে এটি একটি রাজনৈতিক দলিল হিসেবেই থেকে যায়। এ.কে ফজলুল হক এর মন্ত্রিসভা ১৯৩৮ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব (সংশোধনী) আইন পাস করে আইনটির দুর্বলতা দূর করার চেষ্টা করে। [সিরাজুল ইসলাম]