ফুলহার বিল্ডিং কমপ্লেক্স

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১০:৪৪, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

ফুলহার বিল্ডিং কমপ্লেক্স  করতোয়া নদীর ডান তীরে গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ফুলহার গ্রামে অবস্থিত। দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট দুর্গ থেকে এটি খুব বেশি দূরে নয়। এ কমপ্লেক্সের ইমারতগুলি সুবিন্যস্ত- পশ্চিম প্রান্তে একটি তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ, পূর্বে বিভিন্ন আকৃতির চারটি ছোট ইমারতের একটি সারি এবং উত্তরে রয়েছে বেশ বড় আকারের আরেকটি ইমারত। দক্ষিণ দিকটি বর্তমানে উন্মুক্ত।

ফুলহার মসজিদ, গাইবান্ধা

বাংলার মুগল স্থাপত্যের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী পুরো কমপ্লেক্সটিই ইট দিয়ে তৈরি এবং মসৃণ পলেস্তারা আচ্ছাদনে আবৃত। পশ্চিম প্রান্তের যে মসজিদটিকে কেন্দ্র করে কমপ্লেক্সটি গড়ে উঠেছে সেটি পরিকল্পনায় আয়তাকার। বাইরে থেকে এর পরিমাপ ১৮.২৯ মি × ৬.৮৬ মি। চারকোণে রয়েছে চারটি অষ্টভুজী পার্শতবুরুজ। বুরুজগুলি ছাদের অনুভূমিক বপ্র (parapet) ছাড়িয়ে উপরে উঠে গেছে এবং এগুলির শীর্ষে রয়েছে কলস-নকশার শীর্ষচূড়া (finial) শোভিত ক্ষুদ্রাকৃতির শিরাল গম্বুজে আচ্ছাদিত ছত্রী। পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত দুটি আড়-খিলানের (transverse arch) সাহায্যে মসজিদের অভ্যন্তরভাগকে তিনটি সমান বর্গাকার ‘বে’তে বিভক্ত করা হয়েছে। এ তিনটি ‘বে’র উপরে রয়েছে তিনটি গম্বুজ। সমান আকৃতির এ গম্বুজগুলি সরাসরি অষ্টকোণ পিপার (drum) উপর স্থাপিত এবং এগুলির শীর্ষে রয়েছে পদ্ম-কলস নকশায় শোভিত শীর্ষচূড়া। মসজিদ অভ্যন্তরের চওড়া আড়-খিলানদ্বয় এবং মিহরাব ও প্রবেশপথসমূহের উপরের বদ্ধ খিলান গম্বুজগুলির ভার বহন করেছে। খিলানসমূহের উপরের কোণগুলি পূরণ করা হয়েছে ত্রিকোণাকার পেন্ডেন্টিভ দিয়ে। মসজিদটিতে রয়েছে পাঁচটি প্রবেশপথ-পূর্বদিকের সম্মুখভাগে তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালে একটি করে। পূর্ব দেওয়ালের তিনটি প্রবেশপথ বরাবর কিবলা দেওয়ালের অভ্যন্তরভাগে রয়েছে তিনটি অর্ধ অষ্টকোণাকৃতির মিহরাব। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী পূর্বদেওয়ালের কেন্দ্রীয় প্রবেশপথ এবং কেন্দ্রীয় মিহরাব উভয়টিই পার্শতবর্তীগুলির তুলনায় বড় এবং এগুলির বাইরের দিকে রয়েছে দু’ প্রান্তে আলঙ্কারিক মিনার শোভিত আয়তাকার প্রক্ষেপণ। এ মিনারগুলি ছাদের অনুভূমিক বপ্র ছাড়িয়ে উঠে গেছে এবং এর শীর্ষে রয়েছে ক্ষুদ্রাকৃতির গম্বুজ।

কোন শিলালিপি না থাকায় মসজিদটির নির্মাণকাল সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি। তবে মাত্র ২০ কিমি দূরে অবস্থিত দরিয়াপুর মসজিদ (১৭১৭-১৮ খ্রি.) এর সঙ্গে এ মসজিদের স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্যের মিল দেখে অনুমান করা যায় যে, এ মসজিদের নির্মাণকাল আঠারো শতকের প্রথমভাগেই হতে পারে।

উত্তর-দক্ষিণ অক্ষে একই সমান্তরালে নির্মিত এ কমপ্লেক্সের চারটি এক কক্ষ বিশিষ্ট ইমারত মসজিদটির পূর্ব দিকে ১১.৮৫ মিটার দূরে অবস্থিত। এগুলির মধ্যে সর্ব উত্তরে অবস্থিত ইমারতটি আয়তনে সবচেয়ে ছোট এবং বর্গাকার (প্রতিবাহুর দৈর্ঘ ২.৫৯ মিটার)। পশ্চিমদিকে অবস্থিত একটি মাত্র খিলানযুক্ত প্রবেশ পথের মধ্য দিয়ে এর ভেতরে ঢোকা যায়। অভ্যন্তরের মধ্যবর্তী অংশে রয়েছে দুই স্তরবিশিষ্ট একটি মঞ্চ (platform)। ইমারতটির উপরে রয়েছে পিরামিড আকৃতির ছাদ, আর এর শীর্ষে পদ্ম ও কলস নকশা শোভিত শীর্ষচূড়া। চারদেওয়ালের ভিতরের ও বাইরের উভয় দিকেই প্লাস্টারের আচ্ছাদন রয়েছে, তবে অনেক স্থানে সেগুলি এখন খসে পড়েছে।

এই সারির দ্বিতীয় ইমারতটি প্রথমোক্তটি থেকে প্রায় ১ মিটার দক্ষিণে অবস্থিত। পরিকল্পনায় এটি আয়তাকার, উত্তর-দক্ষিণে ৪.৮৮ মিটার দীর্ঘ এবং পূর্ব পশ্চিমে ২.৫৯ মিটার প্রশস্ত। এটিরও পশ্চিম দিকে রয়েছে একটি মাত্র প্রবেশপথ, তবে সেই প্রবেশ পথের খিলানটি বহুখাঁজ বিশিষ্ট। এ প্রবেশপথের দুপার্শ্বে রয়েছে খিলানযুক্ত একটি করে গভীর কুলুঙ্গি। কুলুঙ্গির খিলানগুলি উত্থিত হয়েছে এর দুপ্রান্তের সরু আলঙ্কারিক সংলগ্ন স্তম্ভ (pilasters) থেকে। পূর্বদিকের সম্মুখ ভাগে প্রবেশপথের উপরের অংশে রয়েছে ছোট ছোট কুলুঙ্গির একটি সারি। কুলুঙ্গিগুলির অভ্যন্তরে রয়েছে প্লাস্টার দিয়ে উৎকীর্ণ ছোট ছোট পুষ্পিত বৃক্ষের নকশা। ইমারতটির ভেতরে পূর্ব দেওয়ালের মাঝামাঝি অংশে রয়েছে দুই ধাপ বিশিষ্ট একটি মঞ্চ। আর এটির ছাদে রয়েছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী কুঁড়ে ঘরের অনুরূপ দোচালা আকৃতির ছাদ। ছাদের শীর্ষে রয়েছে কলস নকশা শোভিত তিনটি শীর্ষচূড়া-দুপ্রান্তে দুটি এবং কেন্দ্রস্থলে আরেকটি।

তৃতীয় ইমারতটিও আয়তাকার (৪.৩৪ মি × ২.৯০ মি) এবং ভেতরে-বাইরে প্লাস্টার আচ্ছাদিত, যদিও বর্তমানে অনেক স্থানেই এ প্লাস্টার খসে পড়েছে। এটির ওপরে আচ্ছাদন হিসেবে রয়েছে একটি চৌচালা আকৃতির ভল্ট। ইমারতটির চারদিকে ঘিরে একটি সমান্তরাল কার্নিস রয়েছে এবং পূর্বোক্ত মসজিদটির চারকোণের পার্শ্ববুরুজগুলির মতো এর চারপাশে রয়েছে ছাদ ছাড়িয়ে উঠে যাওয়া ক্ষুদ্রাকৃতির শিরাল গম্বুজ আচ্ছাদিত ছত্রী। যথারীতি এখানেও পশ্চিমদিকে একটি মাত্র খিলানযুক্ত প্রবেশপথ রয়েছে এবং এর অভ্যন্তরে পূর্ব দেওয়ালের সমান্তরালে রয়েছে দুই ধাপ বিশিষ্ট একটি নিচু মঞ্চ।

এই সারির চতুর্থ বা শেষ ইমারতটি পরিকল্পনা ও স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্যে হুবহু পূর্বোক্ত তৃতীয় ইমারতটির অনুরূপ, কেবল এর আকার-আয়তন একটু ভিন্ন। বাইরে থেকে এর পরিমাপ ৫.৭৯ মি × ২.৭৪ মি। ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর বর্তমানে এ ইমারতের উত্তর ও পশ্চিম দেওয়ালই কেবল ভূমি থেকে ১ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত টিকে রয়েছে।

কমপ্লেক্সের উত্তরপার্শ্ব জুড়ে অবস্থিত ইমারতটি স্থানীয় লোকজনের কাছে দেওয়ান ঘর নামে পরিচিত। আয়তাকার অভ্যন্তরীণ একটি কক্ষ এবং দক্ষিণাংশে একটি বারান্দা নিয়ে এ ইমারতটি গঠিত। ৬.৭১ মি × ৩.০৫ মি আয়তনের অভ্যন্তরীণ কক্ষটিতে প্রবেশের জন্য পশ্চিমদিকে রয়েছে একটি প্রবেশপথ, আর দক্ষিণ দিকে আরও তিনটি খিলানপথ। বারান্দাটিতে প্রবেশের জন্যও অভ্যন্তরীণ কক্ষের তিনটি প্রবেশপথ বরাবর রয়েছে তিনটি খিলানপথ। দুই পার্শ্বের দেওয়াল আর তার মাঝে স্থাপিত মোট চারটি একক স্তম্ভের ওপর থেকে এ ছয়টি প্রবেশ পথের খিলানগুলি নির্মিত হয়েছে। বারান্দা এবং মূল কক্ষ উভয়টিতেই আচ্ছাদন হিসেবে রয়েছে নলাকৃতির খিলান ছাদ (tunnel vault)।

এই দেওয়ান ঘর এর সামনে রয়েছে ইট দিয়ে নির্মিত ধাপ বিশিষ্ট একটি সমাধি। এ সমাধিতে কে শায়িত আছেন তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। স্থানীয় জনশ্রুতি অনুসারে এখানে শায়িত আছেন জনৈক ‘পীর বাবা’, যিনি এই পুরো স্থাপনাটির নির্মাতা। দেওয়ান ঘর এবং পূর্ব দিকের চারটি ইমারত সবগুলিরই নির্মাণ রীতি ও কৌশল পূর্বোক্ত তিনগম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটির অনুরূপ।

কি উদ্দেশ্যে ইমারতটি নির্মিত হয়েছিল সুনির্দিষ্টভাবে তা জানা যায় না। তবে স্থানীয় জনশ্রুতি এবং ইসলামি স্থাপত্যের ইতিহাসের আলোকে এ ব্যাপারে একটি ধারণা করা যেতে পারে। এ এলাকায় প্রচলিত জনশ্রুতি অনুযায়ী কমপ্লেক্সটি সুফিবাদীদের একটি আস্তানা এবং এর চারটি ক্ষুদ্র ইমারত চার সুফি তরিকা কাদেরিয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দিয়া ও মুজাদ্দেদিয়ার প্রতীক। কমপ্লেক্সটি সুফি সাধকদের আস্তানা বা খানকাহ হওয়া মোটেই বিচিত্র কিছু নয়, তবে এখানে একই সঙ্গে চার সুফি তরিকার সম্মিলন প্রায় অসম্ভব। কারণ সুফিবাদী এ চারটি তরিকার মৌলিক রীতি-নীতিই এতটা আলাদা যে, তাদের একই স্থানে একসঙ্গে অবস্থান সম্ভব নয়।

প্রকৃতপক্ষে, তিনগম্বুজ বিশিষ্ট এ মসজিদ যে মুসল্লিদের একসঙ্গে নামায পড়ার উদ্দেশে নির্মিত তাতে সন্দেহ নেই। উত্তরের ‘দেওয়ান ঘর’টি সম্ভবত ব্যবহূত হতো ইসলামি শরীয়ার বিভিন্ন দিক নিয়ে উচ্চমার্গীয় আলোচনার জন্য। পূর্ব দিকের চারটি ক্ষুদ্র ইমারতের মধ্যে সর্ব উত্তরেরটির ভেতরে মাঝামাঝি স্থানে একটি নিচু মঞ্চ আছে। এর থেকে অনুমান করা যায় যে, এটি সুফি সাধকের বিশেষ ইবাদতের (ধ্যান) জন্য ব্যবহূত হতো। বাকি তিনটিতে পূর্ব দেওয়াল ঘেঁষে রয়েছে অনুরূপ মঞ্চ। এগুলি সম্ভবত সুফি সাধকের শিষ্যদের জ্ঞানদান এবং সে সঙ্গে তাদের জিকির-এর স্থান হিসেবে ব্যবহূত হতো। ফুলহার বিল্ডিং কমপ্লেক্সটিকে কোন সুফি সাধকের আস্তানা বা খানকাহ হিসেবেই চিহ্নিত করা যায় অনায়াসে। এ সাধকের পরিচয় এখনও অজানা তবে সম্ভবত তিনিই দেওয়ান ঘর এর সামনের সমাধিতে শায়িত আছেন। লক্ষণীয় যে, এ কমপ্লেক্সের অভ্যন্তরে কোন আবাসিক ভবন নেই- অর্থাৎ এ খানকাহটিতে কেউ স্থায়ীভাবে বাস করত না। এ ধরনের অনাবাসিক খানকাহর কিছু উদাহরণ পাওয়া যায় মিশর ও অন্যান্য দেশে। সে ক্ষেত্রে অবশ্য এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক যে, এ খানকাহর সুফি সাধকের আবাসস্থল ছিল নিকটেই, যা এখন হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে।  [এম.এ বারি]