ফরহাদ, মোহাম্মদ

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৪:৫৭, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)
মোহাম্মদ ফরহাদ

ফরহাদ, মোহাম্মদ (১৯৩৮-১৯৮৭) রাজনীতিক। পঞ্চগড় জেলার বোদায় ১৯৩৮ সালের ৫ জুলাই তাঁর জন্ম। পিতা আহমেদ সাদাকাতুল বারী ছিলেন শিক্ষাবিদ এবং মা তৈয়বন্নেসা। দিনাজপুরে সুরেন্দ্রনাথ কলেজে অধ্যয়নকালে মোহাম্মদ ফরহাদ সাহিত্যপাঠ ও নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে বামপন্থী আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি কলেজ ছাত্র-সংসদের সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতি ছিলেন। সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৬১ সালে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন।

তেভাগার সংগ্রাম ও বাম আন্দোলনের ঐতিহ্যমন্ডিত দিনাজপুরে গোপন পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন মোহাম্মদ ফরহাদ। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান সরকার ৯২-ক ধারা জারি করে নেতাকর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করলে মোহাম্মদ ফরহাদও গ্রেফতার হয়ে আট মাসকাল কারাভোগ করেন। কারামুক্তির পর ১৯৫৫ সালে তিনি আত্মগোপনকৃত পার্টির আনুষ্ঠানিক সদস্যপদ লাভ করেন।

১৯৬২ সালে আইয়ূব বিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের অন্যতম রূপকার ছিলেন মোহাম্মদ ফরহাদ এবং এখান থেকে সূচিত হয় জাতীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁর প্রতিষ্ঠা। এই আন্দোলনের ফলে মোহাম্মদ ফরহাদের ওপর গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। ফলে গ্রেফতার এড়িয়ে গোপনে তাঁকে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ ডিগ্রি লাভের পর মোহাম্মদ ফরহাদ কিছুকাল দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় কাজ করেন। কিন্তু রাজনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য সাংবাদিকতা পেশায় তিনি স্থিত হতে পারেন নি। তিনি গোপন কমিউনিস্ট পার্টির ঢাকা জেলা সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন এবং ১৯৬৬ সালে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সংগঠক নির্বাচিত হন। তাঁর সাংগঠনিক নেতৃত্বে ছাত্র-সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন দ্রুত বিকশিত হতে থাকে। বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে চীন সোভিয়েত বিরোধের ফলে যে বিভেদ দেখা দেয় তার প্রভাবে এ দেশের বাম আন্দোলনও পরস্পর বিরোধী শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং ১৯৬৫ সালে ছাত্র গণসংগঠনেও বিভক্তি দেখা দেয়। মোহাম্মদ ফরহাদ মস্কোপন্থী হিসেবে পরিচিত গোষ্ঠীর তরুণ নেতা হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে কমিউনিস্টদের সম্পৃক্ত হওয়ার পটভূমি তৈরিতেও তিনি বিশেষ ভূমিকা রাখেন।

১৯৬৮ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত গোপন কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেসে মোহাম্মদ ফরহাদ কেন্দ্রীয় সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন। পার্টির নেতৃত্বে ছাত্র আন্দোলন, নারী আন্দোলন ও ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রম প্রসারে তাঁর ছিল মুখ্য ভূমিকা। প্রবীণ প্রজন্মের ত্যাগী নেতা এবং নতুন প্রজন্মের নবীন কর্মীদের মধ্যকার সেতুবন্ধন ছিলেন মোহাম্মদ ফরহাদ।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত কমিউনিস্ট পার্টি-ন্যাপ-ছাত্র ইউনিয়নের সম্মিলিত গেরিলা বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন ফরহাদ। স্বাধীন বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টি প্রকাশ্যে কাজ করার সুযোগ লাভ করে এবং ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে মোহাম্মদ ফরহাদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী সময়ে ফরহাদ একাধিকবার কারাবরণ করেন। ১৯৭৭ সালে সরকার কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তাঁকে বিনা বিচারে আটক করে। ১৯৭৮ সালের জুলাই মাসে সুপ্রিম কোর্টে রিট আবেদন করে তিনি মুক্তিলাভ করেন। ১৯৮০ সালের মার্চে নিম্ন বেতনভুক সরকারি কর্মচারীদের আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তৎকালীন সামরিক সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে মামলা শুরু করে। ১৯৮১ সালের আগস্টে সুপ্রিম কোর্টের এক আদেশবলে তিনি মুক্তি পান। ১৯৭৮ সালে জেনারেল এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে ১৫ দল ও ৭ দলের যুগপৎ কর্মসূচি প্রণয়ন ও আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মোহাম্মদ ফরহাদের ছিল বিশেষ ভূমিকা। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে ১৫ দলীয় প্রার্থী হিসেবে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তাঁর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারায় অবদান রচনার পথে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু ১৯৮৭ সালের ৭ অক্টোবর মস্কোতে চিকিৎসাধীন থাকাকালে মোহাম্মদ ফরহাদের অকাল মৃত্যু এই প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে।

মোহাম্মদ ফরহাদ স্বনামের চাইতে বেনামিতেই বেশিরভাগ রাজনৈতিক নিবন্ধ লিখেছেন। তাঁর একমাত্র প্রকাশিত গ্রন্থ উনসত্তুরের গণ-অভ্যুত্থান।  [মফিদুল হক]