প্রিন্সেপ, জেমস

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২২:১৫, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

প্রিন্সেপ, জেমস (১৭৯৯-১৮৪০)  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে চাকরি নিয়ে ১৮১৯ সালে কলকাতায় আসেন এবং বারানসী টাকশালে মুদ্রা-ধাতু পরীক্ষক পদে যোগ দেন। তিনি ১৮৩০ সালে কলকাতা টাকশালে মুদ্রা-ধাতু উপ-পরীক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এইচ.এইচ উইলসন তখন টাকশালের প্রধান পরীক্ষক ছিলেন। প্রিন্সেপ ১৮৩২ সালে উইলসনের স্থলাভিষিক্ত হন এবং ১৮৩৩ সাল পর্যন্ত এ পদে বহাল ছিলেন। ঐ বছরই তিনি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে যান। ১৮৪০ সালের ২৩ এপ্রিল ৪১ বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।

টাকশালে চাকরিকালে তিনি ওজন ও পরিমাপে কিছু সংস্কার সাধন করেন এবং সুষম মুদ্রার প্রচলন করেন। তিনি এক গ্রেনের (প্রায় অর্ধ রতি) তিন হাজার ভাগের এক ভাগ পর্যন্ত পরিমাপ নির্ণয়ের উপযোগী নিক্তি উদ্ভাবন করেন। প্রিন্সেপ প্রকৃতই ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি একজন দক্ষ স্থপতিও ছিলেন। বারানসীতে অবস্থানকালে তিনি তাঁর নিজ নকশা অনুযায়ী টাকশাল ভবন নির্মাণ করেন এবং একটি গির্জাও নির্মাণ করেন। তিনি পৌরসভা উন্নয়ন কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং একটি সুড়ঙ্গপথ নির্মাণ করে নগরীর পয়ঃব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন করেন। তিনি কর্মনাশা নদীর উপর একটি সেতু নির্মাণ করেন এবং  আওরঙ্গজেব এর আমলে নির্মিত মসজিদটি পুনঃনির্মাণ করেন।

কানিংহামেরও পূর্বসূরি প্রিন্সেপ ছিলেন এমন একজন বিখ্যাত পুরাতত্ত্ববিদ যিনি ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বকে নবজীবন দান করেন। পরবর্তী বছরগুলিতে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বের সকল শাখায় বিশেষত মুদ্রাতত্ত্ব ও লিপিবিদ্যার ক্ষেত্রে তাঁর প্রবর্তিত গবেষণা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। কয়েক বছরের রোমাঞ্চকর উদ্দীপনা ও বিপুল শ্রমে প্রিন্সেপ তাঁর ভারতীয় ও ইউরোপীয় সহকর্মীদের নিয়ে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বের ক্ষেত্রে যে আবিষ্কার সম্পন্ন করেন তা ছিল পূর্ববর্তী পঞ্চাশ বছরের সম্পাদিত আবিষ্কারের চেয়েও বেশি।

এশিয়াটিক সোসাইটির তৎকালীন সম্পাদক ও টাকশালে তাঁর উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ড. এইচ.এইচ উইলসনকে মুদ্রার শ্রেণীবন্যিাস ও মুদ্রা খোদাই কাজে সহায়তাকালে প্রাচীন মুদ্রা সম্পর্কে প্রিন্সেপের মধ্যে যে আগ্রহ সৃষ্টি হয় তা তিনি ধরে রাখেন। উইলসন ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার পর প্রিন্সেপ এশিয়াটিক সোসাইটির সম্পাদক হন এবং ১৮৩২ সালে The Journal of the Asiatic Society of Bengal- এ প্রকাশ শুরু করেন। উত্তর ভারতের প্রদেশসমূহে কর্মরত রাজকর্মচারীদের মধ্যে যাদের প্রত্নসম্পদ সংগ্রহের সুযোগ রয়েছে প্রিন্সেপ সঙ্গে সঙ্গে তাদের প্রতি আবেদন জানান যেন তারা আরও মুদ্রা ও লিপি সংগ্রহ করে পাঠান। প্রিন্সেপের ছিল নিজের উৎসাহ উদ্দীপনাকে অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার বিরল এক ক্ষমতা। প্রিন্সেপের আবেদনে ব্যাপক সাড়া মেলে। অচিরেই তাঁর কাছে প্রচুর মুদ্রা ও উৎকীর্ণ লিপি এসে জমা হয়, আর তাতে পাল্টে যায় ভারতীয় পুরাতত্ত্ব গবেষণার ধারা।

কলকাতা টাকশালের মুদ্রা-ধাতু পরীক্ষক হিসেবে সঙ্গত কারণেই মুদ্রার প্রতি প্রিন্সেপের মূল আগ্রহ ছিল। তিনি ব্যাক্ট্রীয় ও কুষাণ আমলের মুদ্রার পাঠোদ্ধার ও বিশ্লেষণ করেন। এ ছাড়া তিনি ছাপাঙ্কিত মুদ্রাসহ সকল ভারতীয় স্থানীয় মুদ্রা, স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্রের মুদ্রা, গুপ্ত আমল ও অন্যান্য সময়ের মুদ্রার পাঠোদ্ধার করেন। প্রিন্সেপই ‘পাঞ্চ-মার্কড’ বা ছাপঙ্কিত কথাটি প্রথম চালু করেন। তিনি কুষাণ মুদ্রার আদলে গুপ্ত আমলের মুদ্রা প্রচলনের মতবাদ চালু করেন। এ আলোচনা তাকে ভারতে মুদ্রা তৈরির কৌশলের বিভিন্ন পর্যায় সম্পর্কিত প্রশ্নের মুখোমুখি নিয়ে আসে। তিনি মুদ্রা প্রচলনের পর্যায় হিসেবে ছাপঙ্কিত নকশা খচিত ও ছাঁচে ঢালাইকৃত তিনটি পর্যায় শনাক্ত করেন।

কিন্তু ব্রাহ্মী লিপির পাঠোদ্ধার এবং প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের বহু রহস্য উদ্ঘাটন ছিল প্রিন্সেপের এক দশকের শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব। যদিও উল্লেখ্য যে, প্রিন্সেপের চূড়ান্ত কৃতিত্বের পূর্বেই অধিকাংশ ব্রাহ্মী লিপির পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়েছিল। খরোষ্ঠী লিপির পাঠোদ্ধারে প্রিন্সেপ অন্যান্যদের দ্বারা প্রদর্শিত সূত্র অনুসরণ করেন। কিছু ভ্রমাত্মক পাঠের পর ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার পূর্বে প্রিন্সেপ খরোষ্ঠী লিপির পাঠোদ্ধারে উনিশটি একক ও একটি যোগিক বর্ণমালার মূল্যায়ণ করতে সমর্থ হন। এখানে উল্লেখ্য যে, Corpus Inscriptionum Indicarum-এর ধারণাটি প্রিন্সেপের সময়ের এবং তাঁরই চিন্তা থেকে আহরিত।

প্রিন্সেপ কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে দিনে দিনে নিজেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেন। গুরুতর অসুস্থ থাকার কারণে তাঁকে তাঁর কাজের মাঝপথেই বিদায় নিতে হয় এবং তাঁর অধিকাংশ কাজই অসমাপ্ত থেকে যায়। ‘জার্নাল অব দি এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল’ -এর নতুন সম্পাদকের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য: ভারতের সর্বত্র প্রত্ন-নিদর্শনের সংগ্রাহকরা তাদের সংগৃহীত যে কোন বস্ত্ত তাঁর কাছে নিয়ে আসতেন সেগুলির পাঠোদ্ধার বা ব্যাখ্যার জন্য, কিন্তু তা করতে যে শ্রমের প্রয়োজন সে জন্য ভারতীয় জলবায়ু অনুকূল ছিল না। ফলে সম্পাদকের বলিষ্ঠ দেহ এ অবিরাম পরিশ্রমের কারণে একসময় নেতিয়ে পড়ে। তা সত্বেও বিদায়ের আগে তিনি পরবর্তী অন্যূন পঞ্চাশ বছরের জন্য ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব গবেষণার প্রধান ধারা নির্ধারণ করে গেছেন।  [আবু ইমাম]