প্রাকৃতিক গ্যাস

প্রাকৃতিক গ্যাস (Natural Gas)  ভূত্বকে প্রাপ্ত দাহ্য গ্যাসের মিশ্রণ (প্রায়ই খনিজ তেলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে)। কয়লা ও তেল ছাড়া বিশ্বের তিনটি জীবাশ্ম জ্বালানির অন্যতম। অন্যভাবে বলতে গেলে, স্বাভাবিক চাপ ও তাপে গ্যাস বা বাষ্পাকারে অবস্থিত হাইড্রোকার্বনই প্রাকৃতিক গ্যাস। এর প্রধান গুরুত্বপূর্ণ উপাদান মিথেন হলেও ইথেন, প্রোপেন ও অন্যান্য উপাদানও এতে বিদ্যমান থাকতে পারে। প্রচলিত অপদ্রব্যসমূহের মধ্যে নাইট্রোজেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও হাইড্রোজেন সালফাইড অন্তর্ভুক্ত। প্রাকৃতিক গ্যাস স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবেও থাকতে পারে আবার তেল সহযোগেও বিদ্যমান থাকতে পারে।

সচ্ছিদ্র ও প্রবেশ্য হাইড্রোকার্বনবাহী বালুময় গঠন ও অনন্য ফাঁদ তৈরির উপযোগী শিলাসোপান সম্বলিত একটি বদ্বীপ অঞ্চল হওয়ায় বাংলাদেশকে সবসময় একটি প্রাকৃতিক গ্যাস সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে মনে করা হয়েছে। দেশের পূর্বাঞ্চলে বৃহত্তর সিলেট থেকে শুরু করে বৃহত্তর কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে এই গ্যাস বলয় সম্প্রসারিত। বঙ্গোপসাগরের উপকূলভাগেও প্রাকৃতিক গ্যাস আবিষ্কৃত হয়েছে।

আমাদের অর্থনীতিতে প্রাকৃতিক গ্যাস অতিগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। পরিবেশ বান্ধব এই জ্বালানি একদিকে যেমন নির্মল শিখায় জ্বলে তেমনি এর দহন ক্রিয়াও কটুগন্ধহীন। গৃহস্থালির রান্নাবান্নার কাজে, কলকারখানায় (ধাতুমলবিদ্যা, মৃৎশিল্প, কাচ, রুটি বিস্কুটের কারখানা, পাওয়ার স্টেশন, সিমেন্ট, স্টিম বয়লার ইত্যাদি) ও কৃষিতে (শুষ্ক ও তপ্তকরণ এবং স্টিম বয়লারের জ্বালানি হিসেবে) এর ব্যবহার ব্যাপক। প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে তরলীকৃতত পেট্রোলিয়াম গ্যাস, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস এবং সঙ্কুচিত প্রাকৃতিক গ্যাস পাওয়া যায় এবং গার্হস্থ্য, শিল্প ও কৃষিকাজে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। রাসায়নিক শিল্পে কৃত্রিম সার, প্লাস্টিক, রজন, রবার, কার্বনব্ল্যাক, নির্মলক (detergents), অ্যামোনিয়া ও নাইট্রিক এসিডের মত বিভিন্ন রাসায়নিক প্রস্ত্ততিতে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহূত হয়। [মো. এহসানুল্লাহ]

অনুসন্ধান ইতিহাস  ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে আসাম রেলওয়ে এন্ড ট্রেডিং কোম্পানি এই উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে প্রথম রেলপথ নির্মাণ করে। কোম্পানিটি এই ভূখন্ডে ১৮৮৩ সনে প্রথম হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধান এবং এ লক্ষ্যে ড্রিলিং শুরু করে। পরবর্তীতে স্থানীয় বাজারে সরবরাহের লক্ষ্যে পেট্রোলিয়াম আমদানি ও বিক্রয়ের জন্য প্রতিষ্ঠিত আসাম অয়েল কোম্পানি পূর্বোক্ত কোম্পানির উত্তরসূরী হিসেবে পেট্রোলিয়াম অনুসন্ধান কর্মকান্ড ১৯১১ সনে শুরু করে। বার্মা অয়েল কোম্পানির অনুসন্ধান কর্মসূচীতে সুরমা বেসিন ও চট্টগ্রাম অঞ্চলও অন্তর্ভুক্ত ছিল।

১৯০৮ থেকে ১৯১৪ সময়কালে ইন্দো-বার্মা পেট্রোলিয়াম কোম্পানি সীতাকুন্ড ঊর্ধ্বভাঁজে কয়েকটি অনুসন্ধান কূপ খনন করে। বাংলাদেশ ভূখন্ডে ১৯১৪ সন থেকে আজ অবধি মোট ৬২টি কূপ খনন করা হয়েছে। দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানি গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য এ অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কূপ খনন করেছে। দেশে উপর্যুপরি অনুসন্ধান কর্মকান্ডের ফসল হিসেবে ১টি তেল ও ২৩টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। শুরুর দিকে (১৯১০-১৯৩৩) তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কূপ মূলত ভাঁজ অঞ্চলের তেলের ঝরণ বা নিঃসরণ এলাকায় স্থাপিত হতো। এসময়ে ৭৬৩ মিটার থেকে ১০৫০ মিটার গভীরতার অনুসন্ধান কূপ খনন করা হতো। উন্নততর প্রযুক্তি সহজলভ্য হবার সাথে সাথে গভীরতর কূপ খনন নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে এবং এতে অনুসন্ধান সাফল্যের হারও বেড়েছে। ১৯৫৫ সনে বার্মা অয়েল কোম্পানি এদেশে প্রথম গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে। ষাট ও সত্তর দশকে অনেকগুলো গ্যাসক্ষেত্রের সফল আবিষ্কার নিশ্চিত হয় কূপ খননের মাধ্যমেই। পেট্রোলিয়াম অনুসন্ধান কূপ খননের কাজে প্রতি তিনটি ড্রিলিং এর একটিতে সফল হওয়া খুবই উৎসাহ ব্যাঞ্জক বলে বিবেচিত হয়। তবে ১৯১০-১৯৩৩ সনের মধ্যবর্তী সময়কালে এদেশে মোট ৬টি ড্রিলিং হলেও বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কোন গ্যাসক্ষেত্রের আবিষ্কার সম্ভব হয় নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পাকিস্তানের শুরুর দিকে পেট্রোলিয়াম অনুসন্ধানের নতুন উদ্যোগ গৃহীত হয় এবং ১৯৫১-১৯৭০ সময়কালে মোট ২২টি কূপ খনন করা হয়, যার ফলে ৮টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছিল। তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের তৃতীয় পর্যায়ে (১৯৭২-১৯৯২) মোট ২৪টি কূপ খনন করে ৯টি নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করা হয় ১৯৯৩-২০০০ সময়কালে মোট ১০টি কূপ খননের মাধ্যমে আরও ৫টি নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়।

দেশে ১৯৫৯ সনে ছাতক গ্যাসক্ষেত্র থেকে সর্বপ্রথম শিল্পখাতে গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়। ১৯৬৮ সনে প্রখ্যাত লেখক শওকত ওসমানের ঢাকাস্থ ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার বাসায় সর্বপ্রথম পাইপ যোগে রান্নার গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়। শিল্পখাতে গ্যাসের প্রধান ব্যবহার হয় বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে। শিল্পখাতে অন্যান্য প্রধান প্রধান গ্যাস ব্যবহারকারী হলো: সার কারখানা, সিমেন্ট ফ্যাক্টরী, পাম্প ও পেপার মিল। এই শিল্প কারখানাগুলো মূলত দেশের পূর্ব ও মধ্য অঞ্চলে অবস্থিত। বর্তমানে বাংলাদেশের ১৭টি গ্যাসক্ষেত্রের প্রায় ৭৯টি কূপ হতে গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে। গ্যাসের দৈনিক গড় উৎপাদন প্রায় ২০০০ মিলিয়ন ঘনফুট, যার মধ্যে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিসমূহ উৎপাদন করছে প্রায় ৯৬০ মিলিয়ন ঘনফূট গ্যাস। বর্তমানে প্রাকৃতিক গ্যাসের দৈনিক চাহিদা গড়ে প্রায় ২৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট এবং এ চাহিদা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবেশবান্ধব জ্বালানী হিসেবে গৃহস্থালি, পরিবহনব্যবস্থা, শিল্পকারখানা, সারকারখানা এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে এর ব্যাপক ব্যবহারই এ চাহিদা বৃদ্ধির কারণ। যেহেতু বাংলাদেশের জ্বালানীখাত মূলত প্রাকৃতিক গ্যাসের উপরই নির্ভরশীল কাজেই গ্যাসক্ষেত্রসমূহ থেকে গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধি, নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার এবং বিকল্প জ্বালানীর ব্যবহার নিশ্চিত করা না গেলে বাংলাদেশকে কঠিন জ্বালানী সংকটে পড়তে হবে। ১৯৬০ সনে গ্যাসের ব্যবহার ছিল দৈনিক গড়ে ১০ মিলিয়ন ঘনফুট।  [বদরুল ইমাম ও মুশফিকুর রহমান]

গ্যাস প্রবণ (Gas prone)  বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে একটি প্রমাণিত গ্যাস প্রবণ দেশ। গ্যাস মূলত পাওয়া গিয়েছে ভূবন ও বোকাবিল স্তরসমষ্টির শিলায়। মায়োসিন কর্দম শিলা, বিশেষ করে মধ্য ও প্রবীণ ভূবন, যার ঞঙঈ ০.৯% পর্যন্ত, গ্যাস প্রবণ, এবং এটি অবশ্যই প্রান্তিক উৎস শিলার শ্রেণীভুক্ত। মায়োসিন ভূবন ও বোকাবিল স্তরসমষ্টি মাত্র ৩০ লক্ষ থেকে ৪০ লক্ষ বছর আগে গ্যাস উৎপাদী পরিপক্কতা অর্জন করে, বিশেষ করে গভীরতর অববাহিকীয় অঞ্চল ও প্রবীণ ভূবন স্তরসমষ্টিতে। এইসব অবক্ষেপ থেকে উৎপাদিত গ্যাস প্রায় সম্পূর্ণত উত্তলভঙ্গ (anticline) দ্বারা আবদ্ধ যা ঐ সময়ের মধ্যে সুরমা বেসিনে গড়ে উঠেছিল। কিছু ভূতত্ত্ববিদ মনে করেন, ভূবন স্তরসমষ্টির কর্দমশিলা উৎস শিলা হওয়ার মতো যথেষ্ট জৈব পদার্থে পূর্ণ নয়। তারা আরও বিশ্বাস করেন ভূবন স্তরসমষ্টির চাইতে প্রবীণ ওলিগোসিন বরাইল শিলাদলের কর্দমশিলা জৈব পদার্থে পূর্ণ এবং গ্যাস উৎপাদন করে। পরবর্তীতে এই গ্যাস শিলার ঊর্ধ্বমুখী ঢালের দিকে কয়েক কিলোমিটার অভিপ্রয়াণের (migration) পর পরিশেষে ভূবন এবং বোকাবিল স্তরসমষ্টির বেলেপাথর আধারে সঞ্চিত হয়েছে।  [সিফাতুল কাদের চৌধুরী]

গ্যাসক্ষেত্র  ২০১০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ২৩টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রগুলির মধ্যে ২টি উপকূলের অদূরে বঙ্গোপসাগরে এবং অবশিষ্ট গ্যাসক্ষেত্রগুলি দেশের পূর্ব ভূভাগে অবস্থিত। প্রাথমিক মূল্যায়নে (Total gas initially in place-GIIP) এই ২৩টি গ্যাসক্ষেত্রের মোট মজুত প্রায় ২৬ ট্রিলিয়ন ঘনফুট বলে অনুমিত হয়েছে যার মধ্যে উত্তোলনযোগ্য মজুত প্রায় ২১ ট্রিলিয়ন ঘনফুট বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। ২০১০ সালের শেষ নাগাদ প্রায় ৮ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে এবং অবশিষ্ট মজুতের পরিমাণ প্রায় ১২.১ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। ভূ-পৃষ্ঠের প্রায় ১,০০০ থেকে ৩,৫০০ মিটার গভীরতায় মায়োসিন (৫০ লক্ষ থেকে ২ কোটি ৪০ লক্ষ বছর পূর্বে) - প্লায়োসিন (২০ লক্ষ থেকে ৫০ লক্ষ বছর পূর্বে) সময়কালের বেলেপাথর আধারে এই প্রাকৃতিক গ্যাস পাওয়া গিয়েছে।

বাংলাদেশে প্রাপ্ত প্রাকৃতিক গ্যাস অধিক বিশুদ্ধ যার মধ্যে প্রায় ৯৫% থেকে ৯৯%-ই মিথেন এবং সালফার প্রায় অনুপস্থিত। প্রাকৃতিক গ্যাসের গড় গঠন হচ্ছে মিথেন ৯৭.৩৩ ভাগ, ইথেন ১.৭২ ভাগ, প্রপেন ০.৩৫ ভাগ এবং অবশিষ্ট ০.১৯ ভাগে রয়েছে উচ্চতর হাইড্রোকার্বনসমূহ। অধিকাংশ গ্যাসক্ষেত্রের গ্যাসই শুষ্ক, তবে অল্প কয়েকটি গ্যাসক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কনডেনসেটের উপস্থিতিসহ আর্দ্র গ্যাস পাওয়া গিয়েছে। আর্দ্র গ্যাসক্ষেত্রগুলি হচ্ছে বিয়ানীবাজার (কনডেনসেট ১৬ ব্যারেল/মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস), জালালাবাদ ((কনডেনসেট ১৫ ব্যারেল/মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস) এবং কৈলাশটিলা (কনডেনসেট ১১ ব্যারেল/মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস)। দেশে কনডেনসেটের মোট অনুমিত মজুত প্রায় ৬ কোটি ৫০ লক্ষ ব্যারেল।

দেশের ভূতাত্ত্বিক গঠন থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, ইতিমধ্যে আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রগুলি ছাড়াও ভবিষ্যতে আরও গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের সম্ভাবনা অতি উজ্জ্বুল। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রাকৃতিক গ্যাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।

দেশে আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রগুলি হচ্ছে সিলেট, ছাতক, তিতাস, রশিদপুর, কৈলাশটিলা, হবিগঞ্জ, বাখরাবাদ, সেমুতাং, কুতুবদিয়া, বেগমগঞ্জ, কামতা, ফেনী, বিয়ানীবাজার, ফেঞ্চুগঞ্জ, জালালাবাদ, নরসিংদী, মেঘনা, শাহবাজপুর, সালদানদী, সাংগু, বিবিয়ানা ও মৌলভীবাজার। অধিকাংশ গ্যাসক্ষেত্র বাংলাদেশের পূর্বাংশের ইন্দোবার্মা ভাঁজুসমূহের সন্নিকটস্থ স্থলভাগে অবস্থিত।

সাধারণত ঊর্ধ্বভঙ্গীয় ধারকে (anticlinal traps) প্রাকৃতিক গ্যাস সঞ্চিত হয়। আধারের প্রবেশ্যতা, সচ্ছিদ্রতা প্রভৃতি গুণাগুণের ভিত্তিতে গ্যাসাধার উত্তম থেকে অতি উত্তম হয়ে থাকে। অনেক গ্যাসক্ষেত্রেই একাধিক বেলেপাথর গ্যাসাধার রয়েছে, এমনকি কোন কোনটিতে ১২টির মতো গ্যাস-বেলেপাথর অঞ্চল বিদ্যমান থাকতে দেখা যায়। বাংলাদেশের গ্যাসক্ষেত্রসমূহ থেকে প্রাপ্ত গ্যাসের বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল থেকে প্রতীয়মান হয় যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভূভাগের জৈব পদার্থ থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপন্ন হয় এবং অয়েল উইন্ডোতে (oil window) সঞ্চিত হয়। গ্যাসের উৎস শিলাসমূহ সাধারণত বরাইল শিলাদলের ওলিগোসিন (বর্তমান কাল থেকে ২ কোটি ৪০ লক্ষ থেকে ৩ কোটি ৬০ লক্ষ বছর পূর্বে) কর্দমশিলা হয়ে থাকে। এই গ্যাস ওলিগোসিন কর্দম উৎসশিলা থেকে চ্যুতি নালার মধ্য দিয়ে ঊর্ধ্বমুখী মধ্যম থেকে দীর্ঘ দূরত্ব অতিক্রম করে মায়োসিন বেলেপাথর আধারে সঞ্চিত হয় বলে ভূতত্ত্ববিদদের ধারণা।

যে সকল গ্যাসক্ষেত্র থেকে বর্তমানে উৎপাদন হচ্ছে সেগুলি হলো তিতাস, সিলেট, কৈলাশটিলা, হবিগঞ্জ, সালদানদী জালালাবাদ এবং সাঙ্গু। উল্লেখিত গ্যাসক্ষেত্রগুলির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা নিচে দেওয়া হলো।

সিলেট গ্যাসক্ষেত্র  সিলেট শহরের ২০ কিমি উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। পাকিস্তান পেট্রোলিয়াম লিমিটেড (পিপিএল) ১৯৫৫ সালে গ্যাসক্ষেত্রটি আবিষ্কার করে। উক্ত কোম্পানি সর্বমোট ৭টি কূপ খনন করে। তারমধ্যে সিলেট-১ কূপটি ব্লো-আউট হয়ে যায়। বর্তমানে সিলেট-৩ ও সিলেট-৬ নং কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলিত হচ্ছে। সিলেট-৭ নং কূপটিই একমাত্র কূপ যেখান থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত দৈনিক ১০০ থেকে ৩০০ ব্যারেল অশোধিত খনিজ তেল উত্তোলিত হতো।

ছাতক গ্যাসক্ষেত্র  সুনামগঞ্জ জেলায় অবস্থিত এই গ্যাসক্ষেত্রটি পাকিস্তান পেট্রোলিয়াম লিমিটেড কর্তৃক ১৯৫৯ সালে আবিষ্কৃত হয়। এই গ্যাসক্ষেত্রে ২,১৩৩ মিটার গভীরতা পর্যন্ত কূপ খনন করা হয়। অত্যধিক পানি প্রবাহের কারণে ১৯৮৫ সাল থেকে ছাতক গ্যাসক্ষেত্রের গ্যাস উৎপাদন বন্ধ করা হয়।

গ্যাসক্ষেত্র

তিতাস গ্যাসক্ষেত্র দেশের বৃহত্তম গ্যাসক্ষেত্রগুলির মধ্যে একটি এবং বর্তমান সময় পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্যাস উৎপাদনকারী ক্ষেত্র। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় অবস্থিত এই গ্যাসক্ষেত্রটি ১৯৬২ সালে পাকিস্তান শেল অয়েল কোম্পানি আবিষ্কার করে। ২০০০ সাল পর্যন্ত এখানে ১৪টি কূপ খনন করা হয়েছে। ৬৪ বর্গ কিলোমিটার ব্যাপী বিস্তৃত এই ক্ষেত্রটির ভূ-গঠন গম্বুজাকৃতির। গ্যাস উৎপাদিত বালুকণাগুলির স্তর অধিকাংশই ২,৬১৬ মিটার থেকে ৩,১২৪ মিটার গভীরতার মধ্যে। তিতাস গ্যাসক্ষেত্রের মোট অনুমিত মজুত প্রায় ৪.১৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট যার মধ্যে উত্তোলনযোগ্য মজুত ২.১ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। ২০০০ সালের শেষ পর্যন্ত এই গ্যাসক্ষেত্র থেকে মোট ১.৭২ টিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে যা মোট উত্তোলনযোগ্য মজুতের প্রায় ৭৫ ভাগ।

রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্র মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থিত এই গ্যাসক্ষেত্রটি ১৯৬০ সালে আবিষ্কৃত হয়। এই ভূ-গঠনে মোট ৪টি কূপ খনন করা হয়েছে। এখানে গ্যাসের মোট মজুত ২.২৪ টিসিএফ যার মধ্যে উত্তোলনযোগ্য মজুত ১.৩০ টিসিএফ।

কৈলাশটিলা গ্যাসক্ষেত্র সিলেট জেলায় অবস্থিত; বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ গ্যাসক্ষেত্র। পাকিস্তান শেল অয়েল কোম্পানি ১৯৬২ সালে এই গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে। এর মোট অনুমিত মজুত ৩.৬৫ টিসিএফ যার মধ্যে উত্তোলনযোগ্য মজুত ২.৫২ টিসিএফ গ্যাস। কৈলাশটিলা গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাসের সঙ্গে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কনডেনসেটও উৎপাদিত হয়ে থাকে। ১৯৮৩ সাল থেকে এই গ্যাসক্ষেত্রের গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে।

হবিগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্র ১৯৬৩ সালে আবিষ্কৃত দেশের অন্যতম বৃহৎ গ্যাসক্ষেত্র। এটি ১১ কিমি দীর্ঘ এবং ৪.৫ কিমি প্রশস্ত। প্রায় ৩০ শতাংশ সচ্ছিদ্রতাবিশিষ্ট হবিগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্র একটি উন্নতমানের গ্যাসাধার হিসেবে খ্যাত। বর্তমানে এটি দেশের অন্যতম একটি গ্যাস উৎপাদনক্ষেত্র। আজ পর্যন্ত এই গ্যাসক্ষেত্রে ১০টি কূপ খনন করা হয়েছে।

বাখরাবাদ গ্যাসক্ষেত্র কুমিল্লা জেলায় অবস্থিত। ১৯৬৯ সালে শেল অয়েল কোম্পানি এই গ্যাসক্ষেত্রটি আবিষ্কার করে। ১৯৮৪ সালে এখান থেকে গ্যাস উৎপাদন শুরু হয় এবং ১৯৯৩ সালে এর উৎপাদন সর্বোচ্চে পৌঁছে (দৈনিক ১৯০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস)। তখন থেকে এই গ্যাসক্ষেত্রের চাপ ও উৎপাদনে দ্রুত পতন ঘটে। ২০০০ সালের শেষদিকে এখান থেকে প্রতিদিন মাত্র ৩৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে যে, বাখরাবাদ গ্যাসক্ষেত্রটি দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাবে।

সেমুতাং গ্যাসক্ষেত্র খাগড়াছড়ি জেলায় অবস্থিত পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার একমাত্র গ্যাসক্ষেত্র। ১৯৬৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের জাতীয় তেল কোম্পানি ও.জি.ডি.সি এই গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে। খননকৃত ৪টি কূপের মধ্যে ৩নং ও ৪নং কূপে কোন গ্যাস পাওয়া যায় নি। এই গ্যাসক্ষেত্র থেকে কোন গ্যাস উত্তোলিত হয় নি।

কুতুবদিয়া গ্যাসক্ষেত্র চট্টগ্রাম বন্দরের প্রায় ৯২ কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিয়ন অয়েল কোম্পানি ১৯৭৬ সালে এই গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে। যদিও গ্যাসক্ষেত্রটি ছোট আকৃতির, তবুও এর উন্নয়নে এখন পর্যন্ত কোন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় নি।

বেগমগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্র নোয়াখালী জেলায় অবস্থিত। পেট্রোবাংলা ১৯৭৭ সালে এই গ্যাসক্ষেত্রটি আবিষ্কার করে। বেগমগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্রটি একটি ছোট আকৃতির গ্যাসক্ষেত্র এবং এর উন্নয়নে এখন পর্যন্ত কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় নি। এখানে খননকৃত দুটি গ্যাসক্ষেত্রের মধ্যে একটি শুষ্ক পাওয়া যায়।

কামতা গ্যাসক্ষেত্র ১৯৮১ সালে পেট্রোবাংলা গাজীপুর জেলায় এই গ্যাসক্ষেত্রটি আবিষ্কার করে। ছয় বছর গ্যাস উত্তোলনের পর অত্যধিক পানি প্রবাহের কারণে ১৯৯১ সালে গ্যাসক্ষেত্রটি বন্ধ করা হয়।

ফেনী গ্যাসক্ষেত্র ফেনী জেলায় অবস্থিত একটি ছোট আকৃতির গ্যাসক্ষেত্র। ১৯৮১ সালে পেট্রোবাংলা কর্তৃক এই গ্যাসক্ষেত্রটি আবিষ্কৃত হয়। কূপটির গভীরতা ৩০০০ মিটার। বর্তমানে ক্ষেত্রটি উত্তোলনযোগ্য নয়।

বিয়ানীবাজার গ্যাসক্ষেত্র সিলেট জেলায় অবস্থিত এই গ্যাসক্ষেত্রটি ১৯৮১ সালে পেট্রোবাংলা কর্তৃক আবিষ্কৃত। বর্তমানে এর দুটি কূপ থেকে গ্যাস উৎপাদন করা হচ্ছে।

ফেঞ্চুগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্র ১৯৮৮ সালে পেট্রোবাংলা সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জে আবিষ্কার করে। মধ্যম আকৃতির এই গ্যাসক্ষেত্রটিতে রয়েছে বাংলাদেশের গভীরতম কূপ যার গভীরতা ৪,৯৭৭ মি। এই গ্যাসক্ষেত্রে কিছু পরিমাণে অ-বাণিজ্যিক তেল পাওয়া গিয়েছে। এখান থেকে এখনও গ্যাস উত্তোলন শুরু হয় নি।

জালালাবাদ গ্যাসক্ষেত্র  সিলেট জেলায় অবস্থিত। ১৯৮৯ সালে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি সিমিটার এই গ্যাসক্ষেত্রটি আবিষ্কার করে। পরবর্তীতে অক্সিডেন্টাল তথা ইউনোক্যাল এই গ্যাসক্ষেত্রের দায়িত্ব গ্রহণ করে। বর্তমানে গ্যাসক্ষেত্রটি থেকে গ্যাস উত্তোলিত হচ্ছে।

নরসিংদী গ্যাসক্ষেত্র নরসিংদী জেলায় অবস্থিত। ১৯৯০ সালে পেট্রোবাংলার আবিষ্কৃত এই গ্যাসক্ষেত্রটি ১৯৯৬ সাল থেকে গ্যাস উৎপাদনের আওতায় এসেছে।

মেঘনা গ্যাসক্ষেত্র বাখরাবাদ গ্যাসক্ষেত্রের উত্তরে মেঘনা প্লাবনভূমিতে অবস্থিত। মধ্যম আকৃতির এই গ্যাসক্ষেত্রটি ১৯৯০ সালে পেট্রোবাংলা কর্তৃক আবিষ্কৃত হয়। ১৯৯৭ সালে এখানে গ্যাস উৎপাদন শুরু হয়।

শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র ভোলা জেলার শাহবাজপুরে অবস্থিত। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স) এটি আবিষ্কার করে। শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উৎপাদন শুরু হয় নি।

সালদানদী গ্যাসক্ষেত্র ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় অবস্থিত। ১৯৯৬ সালে বাপেক্স গ্যাসক্ষেত্রটি খনন করে যার গভীরতা ২৫১২ মিটার। বর্তমানে এই গ্যাসক্ষেত্রটি থেকে গ্যাস উৎপাদন করা হচ্ছে।

সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র একমাত্র উপকূলীয় গ্যাসক্ষেত্র যেখান থেকে গ্যাস উৎপাদন করা হচ্ছে। ১৯৯৬ সালে কেয়ার্ন এনার্জি এই গ্যাসক্ষেত্রটি আবিষ্কার করে। বর্তমানে শেল অয়েল কোম্পানি সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র পরিচালনা করছে।

বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র হবিগঞ্জ জেলায় অবস্থিত দেশের অন্যতম বৃহৎ গ্যাসক্ষেত্র। ১৯৯৮ সালে ইউনোক্যাল এই গ্যাসক্ষেত্রটি আবিষ্কার করে। এই গ্যাসক্ষেত্রের মোট অনুমিত গ্যাসের মজুত প্রায় ৫ টি.সি.এফ যার মধ্যে উত্তোলনযোগ্য মজুত ২.৪ টি.সি.এফ। অদূর ভবিষ্যতে ইউনোক্যাল এই গ্যাসক্ষেত্রের উন্নয়ন সাধন করার লক্ষ্যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।

মৌলভীবাজার গ্যাসক্ষেত্র মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত এই গ্যাসক্ষেত্রটি মাগুরছড়া গ্যাস উৎক্ষেপণ (ব্লো-আউট) জনিত দুর্ঘটনার জন্য পরিচিতি লাভ করেছে। ১৯৯৮ সালে অক্সিডেন্টাল অয়েল কোম্পানি এখানে প্রথম কূপ খনন করার সময় এই দুর্ঘটনা ঘটে। এর ফলে বায়ুমন্ডলে প্রচুর পরিমাণে গ্যাস বের হয়ে যায়। পরবর্তীতে অক্সিডেন্টালের দায় গ্রহণকারী কোম্পানি ইউনোক্যাল এখানে ২নং কূপ খননকালে গ্যাসের অনুসন্ধান লাভ করে। মৌলভীবাজার গ্যাসক্ষেত্রের উন্নয়ন কাজ এখনও অবশিষ্ট রয়েছে।  [বদরুল ইমাম এবং মো. লুৎফর রহমান চৌধুরী]

গ্যাস পাইপলাইন  গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উৎপাদনের পর তা পাইপলাইনের মাধমে সরবরাহ করা হয়। সরবরাহ ও চাহিদা অনুসারে পাইপলাইন স্থাপন করা হয়ে থাকে। এ উদ্দেশ্যে সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানি (Transmission and Distribution Company) গঠন করা হয়েছে। শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এবং গৃহস্থালি ভোক্তার কাছে গ্যাস সরবরাহের জন্য বাংলাদেশে রয়েছে বিস্তৃত ও দীর্ঘ গ্যাস পাইপলাইন নেটওয়ার্ক। শিল্পক্ষেত্রে গ্যাস ব্যবহারকারীদের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ উৎপাদিত গ্যাসের সিংহভাগ ব্যবহার করে থাকে। সেই সঙ্গে প্রধানত দেশের পূর্ব ও কেন্দ্রীয় অঞ্চলে অবস্থিত সার ও সিমেন্ট কারখানাসমূহ, পাল্প ও পেপার মিল এবং অন্যান্য শিল্পকারখানাসমূহও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করে থাকে।

বর্তমানে দেশে তিনটি সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানি তিনটি নিজস্ব আওতাভুক্ত এলাকায় প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে- (ক) তিতাস গ্যাস সুবিধাভোগী এলাকা (Titas Franchise Area-TFA), (খ) জালালাবাদ গ্যাস সুবিধাভোগী এলাকা (Jalalabad Franchise Area-JFA) এবং (গ) বাখরাবাদ গ্যাস সুবিধাভোগী এলাকা (Bakhrabad Franchise Area-BFA)। তিতাস গ্যাস সুবিধাভোগী এলাকার মধ্যে রয়েছে: আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, জিয়া সার কারখানা, যমুনা সার কারখানা, ঘোড়াশাল ইউরিয়া সার কারখানা, ঘোড়াশাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, জামালপুর ও শেরপুর জেলাসমূহ। জালালাবাদ গ্যাস সুবিধাভোগী এলাকার মধ্যে রয়েছে: কুমারগাঁও বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সিলেট কাগজ ও মন্ড কারখানা, ছাতক সিমেন্ট কারখানা, আইনপুর সিমেন্ট কারখানা, বেসরকারি অন্যান্য সিমেন্ট কারখানাসমূহ; সিলেট, ছাতক, সুনামগঞ্জ জেলা ও তৎসলগ্ন এলাকায় অবস্থিত শিল্প, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও গৃহস্থালি ভোক্তাসমূহ; এবং ফেঞ্চুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, শাহজালাল সার কারখানা, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার এলাকাসমূহ (শাহজীবাজার বিদ্যুৎ কেন্দ্র, চা বাগানসমূহ ও অন্যান্য শিল্পকারখানাসমূহ)। বাখরাবাদ গ্যাস সুবিধাভোগী এলাকার মধ্যে রয়েছে: কর্ণফুলী সার কারখানা (কাফকো), চিটাগাং ইউরিয়া সার কারখানা, রাউজান বিদ্যুৎ কেন্দ্র, শিকলবাহা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, কর্ণফুলী পেপার মিল; চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, লাকসাম ও ফেনী এলাকায় অবস্থিত শিল্প, বাণিজ্যিক ও গৃহস্থালি ভোক্তাসমূহ।

বর্তমানে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড-জিটিসিএল কৈলাশটিলা থেকে আশুগঞ্জ পর্যন্ত ১৭৮ কিমি দীর্ঘ ও ৬০.৯৬ সেমি ব্যাসার্ধ বিশিষ্ট গ্যাস পাইপলাইন এবং উত্তর-দক্ষিণ গ্যাস ট্রান্সমিশন পাইপলাইন পরিচালনা করছে। ১৯৯৭ সালে স্থাপিত এবং ৫৮ কিমি দীর্ঘ আশুগঞ্জ থেকে বাখরাবাদ পর্যন্ত ৭৬.২০ সেমি ব্যাসার্ধ বিশিষ্ট পাইপলাইনটিও জিটিসিএল পরিচালনা করছে। জিটিসিএল বর্তমানে বিয়ানীবাজার গ্যাসক্ষেত্র পর্যন্ত এবং যমুনা নদীর পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস পাইপলাইন নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে। জাতীয় গ্যাস গ্রিডের (National Gas Grid) আওতাভুক্ত সকল গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন ক্রমান্বয়ে জিটিসিএলের কাছে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে।

উপরোক্ত সকল গ্যাস সুবিধাভোগী এলাকায় গ্যাসের দৈনিক চাহিদা বৃদ্ধি পেয়ে ২৫.৬৫ মিলিয়ন ঘনফুটে দাঁড়াতে পারে। বর্তমানে নির্মানাধীন বিয়ানীবাজার-কৈলাশটিলা গ্যাস পাইপলাইনে দৈনিক ১.১২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের প্রয়োজন হবে। এর ফলে গ্যাসের নিট চাহিদা বৃদ্ধি পেয়ে দৈনিক ২৬.৭৭ মিলিয়ন ঘনফুটে দাঁড়াবে। অদূর ভবিষ্যতে গ্যাস প্রবাহ দৈনিক অতিরিক্ত ৭.২৮ থেকে ৭.৫৬ মিলিয়ন ঘনফুটে উন্নীত হবে এবং সেই সঙ্গে গ্যাস পাইপলাইনের পরিমাণও বৃদ্ধি করার প্রয়োজন দেখা দেবে।  [মো. লুৎফর রহমান চৌধুরী]

গ্যাসের বাজারজাতকরণ  ছাতক গ্যাসক্ষেত্র থেকে ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরীতে পাইপলাইনের সাহায্যে গ্যাস সরবরাহের মাধ্যমে ১৯৬০ সালে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ শুরু হয়। ১৯৬১ সালে ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানায় সরবরাহের জন্য সিলেটে দ্বিতীয় গ্যাসক্ষেত্রে উৎপাদন শুরু হয়। ১৯৬১ সালে দেশে মোট উৎপাদিত গ্যাসের পরিমাণ ছিল ৩.৫ বিলিয়ন ঘনফুট। এর পর থেকে দেশে গ্যাস উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে। ১৯৯৮ সালের শেষ দিকে আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রের সংখ্যা ২২টিতে দাঁড়ায় যার মধ্যে ১২টিতে উৎপাদন শুরু হয়। ঐ সালে দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের মোট উৎপাদন ছিল ২৯৮ বিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমানে দেশে দৈনিক গ্যাস উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ১০০০ মিলিয়ন ঘনফুট।

২০০১ সালে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনের দায়িত্বে রয়েছে পেট্রোবাংলার তিনটি সহায়ক কোম্পানি (বাংলাদেশ গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড এবং বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন কোম্পানি লিমিটেড) এবং দুটি আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি (শেল ও ইউনোকল)। শক্তি স্থাপনা, সার কারখানা ও বিভিন্ন শিল্প, বাণিজ্যিক ও গার্হস্থ্য সংযোগ প্রদানের দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে বেশ কিছু গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানি (তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড, বাংলাদেশ গ্যাস সিস্টেমস লিমিটেড এবং জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমস লিমিটেড)।

বর্তমানে উৎপাদিত প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রায় ৮০% ব্যবহূত হয় শক্তি উৎপাদন ও সার উৎপাদনের কাজে। দেশের মোট ব্যবহূত গ্যাসের খাতওয়ারি হার হচ্ছে: বিদ্যুৎ উপাদন ৪৫%, সার (৩৫%) এবং শিল্প, বাণিজ্য ও গার্হস্থ্য ২০%। বছরে ১৩.৪% হারে প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে।

উপরোল্লিখিত খাত ছাড়া অন্যান্য খাতে প্রাকৃতিক গ্যাসের বিকল্প ব্যবহারের বিষয়টি সরকারি, বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংগঠনসমূহের সঙ্গে আলোচিত হয়েছে। পেট্রোরাসায়নিক শিল্প, এলএনজি বা আরও সাম্প্রতিককালে কৃত্রিম তরল জ্বালানি অর্থাৎ গ্যাস তরলীকরণ প্রযুক্তি বিশ্বের অনেক স্থানে চালু থাকলেও এই সব বিকল্প বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষিতে বিবেচনা করা হচ্ছে না। তৎপরিবর্তে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস রপ্তানির সম্ভাব্যতা গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হচ্ছে।

পাইলাইনে গ্যাস রপ্তানির বিকল্পটি বাংলাদেশে গ্যাস অনুসন্ধানে নিয়োজিত বিদেশি তেল কোম্পানিগুলোই খুব জোর দিয়ে বলছে। গ্যাস রপ্তানির উদ্যোক্তাদের মত হচ্ছে স্থানীয়ভাবে সরবরাহের পরিমাণ অপ্রতুল বিধায় প্রতিবেশী ভারতে যে বিশাল গ্যাসের বাজার অপেক্ষা করে রয়েছে বাংলাদেশের উচিত এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করা। বলা হচ্ছে ভারতে প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানি করে নিজের অর্থনীতিকে চাঙা করার প্রয়োজনীয় বিদেশি মুদ্রা বাংলাদেশ এর মাধ্যমে আয় করতে পারে। উদ্যোক্তারা আরও বলছে, অদূর ভবিষ্যতে সৌরশক্তির মত বিকল্প জ্বালানির উৎস আবিষ্কৃত হলে গ্যাস অপেক্ষাকৃত অপ্রয়োজনীয় জ্বালানিতে রূপান্তরিত হবে এবং আজকের এই গুরুত্ব হারিয়ে ফেলবে।

কিন্তু দেশের বিশেষজ্ঞ ও রাজনীতিবিদদের একটা বড় অংশ ভিন্নমত পোষণ করেন। তাঁরা এ মুহূর্তে পাইপলাইনে গ্যাস রপ্তানি প্রকল্পের ঘোর বিরোধী। তাদের বক্তব্য বিদেশে পাইপলাইনে গ্যাস রপ্তানির কথা বিবেচনার আগে দুটি বিষয় গভীর ভাবে ভেবে দেখা দরকার। প্রথমত ভবিষ্যৎ চাহিদা পূরণে সক্ষম যথেষ্ট গ্যাসের মজুত বাংলাদেশে আছে কিনা এবং দ্বিতীয়ত জ্বালানি হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাসের ভবিষ্যৎ কি।

গ্যাস রপ্তানির বিরোধীদের মতে, দেশের বর্তমান গ্যাসের মজুত, যা মোটামুটি সন্তোষজনক যা হয়ত তাৎক্ষণিক ভবিষ্যতের চাহিদা পূরণের পক্ষে যথেষ্ট, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে দেশের ভবিষ্যৎ চাহিদা মেটানোর পক্ষে তা পর্যাপ্ত নয়। নিজস্ব একমাত্র বাণিজ্যিক জ্বালানি প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর বাংলাদেশ খুবই নির্ভরশীল। এদেশে তেলের উল্লেখযোগ্য তেমন মজুত নেই এবং ভবিষ্যতে আরও জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের সম্ভাবনাও প্রায় শূন্য। পরমাণু শক্তি অর্জনের সম্ভাবনাও সুদূর পরাহত। এই প্রেক্ষিতে এদেশে বাণিজ্যিক জ্বালানির একমাত্র উৎস হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা দীর্ঘদিন বলবৎ থাকবে। তাই বাংলাদেশ যদি এ মুহূর্তে প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানি শুরু করে, তা হলে শক্তির বিকল্প কোন উৎস আবিষ্কৃত হওয়ার আগেই হয়ত তার বর্তমান গ্যাসের মজুত শেষ হয়ে যাবে। যা ভবিষ্যৎ জ্বালানি দৃশ্যপটের জন্য হবে ভয়াবহ। তাদের মতে বর্তমানে পাইপলাইন সহযোগে গ্যাস রপ্তানির মাধ্যমে স্বল্পমেয়াদী অর্থনৈতিক মুনাফা অর্জন হয়ত সম্ভব হবে, কিন্তু মজুত গ্যাস নিঃশেষ করার ঝুঁকির তুলনায় সে লাভ খুবই অকিঞ্চিৎকর হবে।

জ্বালানি হিসেবে গ্যাসের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের অভিমত এই যে, ২০৪০ সাল পর্যন্ত তেল ও গ্যাস জ্বালানির প্রধান উৎস হিসেবে কার্যকর থাকবে, যার পর গ্যাসই জ্বালানি হিসেবে বিশ্বজুড়ে প্রায় একছত্র আধিপত্য কায়েম করবে। প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার ২০৫০ সালে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে। তখন এর ব্যবহার তেল ও গ্যাসের সম্বিলিত ব্যবহারকেও ছাড়িয়ে যাবে। সৌরশক্তি বা অন্য কোন বিকল্প জ্বালানির বিশ্বজনীন প্রচলন বিলম্বিত হবে এবং ২০৫০ সালের আগে শুরু হবে না। বাংলাদেশে গ্যাস রপ্তানির বিরোধীরা তাই যুক্তি দেখাচ্ছেন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃহৎ মজুত আবিষ্কৃত না হওয়া পর্যন্ত গ্যাস রপ্তানি বিবেচনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অপেক্ষা করা উচিত।  [বদরুল ইমাম]

আরও দেখুন হাইড্রোকার্বন; হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধান; হাইড্রোকার্বন উৎপাদন; হাইড্রোকার্বন আধার