প্রত্নতত্ত্ব

প্রত্নতত্ত্ব  হলো Archaeology শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ। সংস্কৃত প্র+ত্ন (স্তূপ)= প্রত্ন=পুরাতন এবং তৎ +ত্ব (তত্ত্ব)- জ্ঞান বা বিজ্ঞান থেকে আধুনিক কালে প্রত্নতত্ত্ব শব্দটির জন্ম। অপরদিকে গ্রিক শব্দ Archaia এবং Logos শব্দদ্বয় থেকে Archaeology শব্দের উৎপত্তি। এর অর্থ প্রাচীন দ্রব্যাদি ও জ্ঞান বা বিজ্ঞান। সার্বিক অর্থে প্রত্নতত্ত্ব হল ‘প্রাচীন দ্রব্য সম্পর্কিত জ্ঞান’। যদিও বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব প্রাচীন জনগোষ্ঠীর জীবনধারার যাবতীয় তথ্য নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে চিহ্নিতকরণ, প্রাপ্ত বস্ত্তর বিশ্লেষণ, সংরক্ষণ ও উপস্থাপনে নিয়োজিত বিজ্ঞানভিত্তিক শাখাটির প্রতিনিধিত্ব করে। প্রত্নতত্ত্বের মূল উপজীব্য হলো ইতিহাস ও ঐতিহ্য। প্রত্নতত্ত্বের চর্চার বিকাশ লাভ করে মূলত আঠারো শতকেই। বাংলায় প্রত্নতত্ত্ব চর্চার সূচনা হয় উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে। বর্তমান বাংলাদেশ ও পশ্চিম বঙ্গের বিভিন্ন প্রত্নস্থলের চিহ্নিতকরণ ও তা খননের মাধ্যমে বাংলায় প্রত্নচর্চার যাত্রা শুরু।

প্রত্নতত্ত্ব, বাংলাদেশ  বাংলাদেশের কোন কোন অঞ্চলে বিক্ষিপ্তভাবে পাথুরে হাতিয়ার পাওয়া গেলেও এই বদ্বীপ ভূমিতে প্রাগৈতিহাসিক পর্বের অস্তিত্ব ছিল এমনটি ধারণা করা হতো না। এদেশে ফসিল কাঠের হাতিয়ার তৈরির যে ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল, অতি সম্প্রতি তা বিস্তৃত অঞ্চলে শনাক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশের ভূখন্ডে প্রাপ্ত প্রত্নবস্ত্তসমূহ মূলত ‘আদি ঐতিহাসিক’ ও ‘আদি মধ্যযুগের’।

বাংলাদেশের হিন্দু-বৌদ্ধ প্রত্নঅঞ্চলসমূহের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নওগাঁর পাহাড়পুর, বগুড়ার মহাস্থান এবং কুমিল্লার ময়নামতী। প্রতিটি অঞ্চলই যার যার দিক থেকে বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। পাহাড়পুরে রয়েছে বৃহত্তম বৌদ্ধ বিহার ও মন্দির। মহাস্থান বাংলাদেশের ধর্মীয় প্রত্নঅঞ্চলসমূহের মধ্যে শুধু একমাত্র নগর অঞ্চলই নয় বরং এটি হচ্ছে এদেশের প্রাচীনতম নগর (৩য়-২য় খ্রি.পূ)। মহাস্থান ছিল বৈশালী, পাটালিপুত্র, কৌশম্বির মতো গাঙ্গেয় উপত্যকার আদি ঐতিহাসিক নগরসমূহের সমসাময়িক। ময়নামতীর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এ অঞ্চল জুড়ে ধর্মীয় স্থাপনাসমূহের সমাহার গড়ে উঠেছিল। পাহাড়ের ওপর কয়েক মাইলব্যাপী বিস্তৃত পরবর্তী বৌদ্ধযুগের (আনু. ৬ষ্ঠ-১৩শ খ্রিস্টাব্দ) বিহার ও মন্দির ছিল এখানে। এ সমস্ত বৌদ্ধ নিদর্শনের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম হচ্ছে চারপত্র মুড়া মন্দির। সম্ভবত মন্দিরটি বৈষ্ণব ধারার সঙ্গে যুক্ত ছিল।

১৮৭৯-৮০ সালে স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম যে সকল অঞ্চল নিয়ে বর্তমান বাংলাদেশ গঠিত সেই অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক পরিভ্রমণ করেছিলেন, মহাস্থান এবং পাহাড়পুর তাঁর ভ্রমণ অঞ্চলের অন্তর্গত ছিল। কানিংহাম তাঁর বিবরণীতে মহাস্থানের নিকট অবস্থিত ভাসু বিহার এবং পাহাড়পুরের নিকট অবস্থিত যোগী ঘোপার কথা উল্লেখ করেছেন। এছাড়াও তিনি পাহাড়পুরের নিকট অবস্থিত ঘাটনগর এবং ধীবর দিঘির কথাও লিখেছেন। ই.ভি ওয়েস্টম্যাকট (১৮৭৫), এইচ. বেভারিজ (১৮৭৮), সি.জে ও’ডনেল-এর মতো আরও কয়েকজন ব্রিটিশ প্রশাসক ইতোমধ্যে পাহাড়পুর এবং মহাস্থানগড়ের ধ্বংসাবশেষ সম্পর্কে লিখেছিলেন। স্থানীয় জমিদারের অসহযোগিতার কারণে কানিংহাম পাহাড়পুর প্রত্নঅঞ্চলের প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন করার মতো বিস্তারিত অনুসন্ধান কার্যক্রম চালাতে পারেন নি। কানিংহামের বেশ কিছুকাল পরে সেখানে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে এক রোমাঞ্চকর প্রত্নঅঞ্চল উন্মোচিত হয় যা ছিল উপমহাদেশের বৃহত্তম বৌদ্ধ বিহার (অতি সম্প্রতি বিক্রমশিলাকে পাহাড়পুরের চেয়ে কিছুটা বড় বলে দাবি করা হচ্ছে)।

যাহোক, ১৮৭৯-৮০ সালে কানিংহামের ভ্রমণের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সাফল্য ছিল হিউয়েন সাং-এর ভ্রমণ বৃত্তান্তের পদাঙ্ক অনুসরণ করে শহর পুন্ড্রনগরসহ মহাস্থানগড়কে শনাক্ত করা। পরবর্তীকালে (১৯৩১) প্রাচীন ব্রাহ্মী রীতির লিপি (মহাস্থান ব্রাহ্মী লিপি) খোদিত একটি পাথরের ফলক এ অঞ্চলে পাওয়া যায়। লিপিভাষ্য ও লিখন পদ্ধতি থেকে বোঝা যায় অঞ্চলটি ছিল মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত এবং সম্ভবত প্রাদেশিক রাজধানী।

উৎখনন প্রসঙ্গ উল্লেখের পূর্বে কতিপয় প্রশংসনীয় ব্যক্তিগত উদ্যোগের কথা আলোচনা করা যেতে পারে যা বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্বকে অনেকটা এগিয়ে নিয়েছিল। বিশেষ করে পাহাড়পুর ও মহাস্থানগড়ে প্রাথমিক ভাবে কিছু উৎখনন কাজ পরিচালিত হয় বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে। এর মধ্যে অগ্রগণ্য ছিল রাজশাহীর বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি। এর নেতৃত্বে ছিলেন দিঘাপতিয়ার কুমার শরৎকুমার রায়। রাজশাহী শহরের কয়েকজন অত্যুৎসাহী ভদ্রলোক ছিলেন তাঁর সহযোগী। এঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন আইন ব্যবসায়ী  অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, স্থানীয় কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক রমাপ্রসাদ চন্দ প্রমুখ। এঁরা পান্ডিত্যের বিচারে উত্তরকালে যাঁর যাঁর ক্ষেত্রে সুপরিচিত হয়েছিলেন। এ সমিতি ১৯১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। শরৎকুমার রায়ের আর্থিক সহযোগিতায় সমিতি রাজশাহীর চারপাশে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান, ছোটখাট উৎখনন, রিপোর্ট প্রকাশ করা প্রভৃতি কার্যক্রম গ্রহণ করতে থাকে। এছাড়াও সমিতি প্রাচীন নিদর্শন বিশেষ করে ভাস্কর্যসমূহ সংগ্রহ করতে থাকে। এর ফলে ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি জাদুঘর’। বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি এখন আর টিকে না থাকলেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশ হিসেবে বর্তমানে জাদুঘরটি বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর নামে সুপ্রতিষ্ঠিত।

বাংলাদেশে প্রত্নতত্ত্ব চর্চার ক্ষেত্রে আরেকটি যুগান্তকারী বেসরকারি উদ্যোগ ছিল কলকাতায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ এর প্রতিষ্ঠা। এর প্রতিষ্ঠাকাল ১৮৯৩-৯৪ সালে - বরেন্দ্র গবেষণা সমিতি প্রতিষ্ঠার কিছুকাল আগে। পরিষৎটিতে ধীরে ধীরে ভাস্কর্যের মূল্যবান সংগ্রহ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯০৫ সাল থেকে রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, সিলেট ও কুমিল্লার মত দূরবর্তী অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে এর শাখা। প্রতিটি শাখাতেই নিজস্ব ভাস্কর্য সংগ্রহ চলতে থাকে। ১৯১৪ সালে ঢাকা জাদুঘরের কিউরেটর পদে নিযুক্ত হন তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী অক্লান্ত এবং পরিশ্রমী নলিনীকান্ত ভট্টশালী। তাঁর অবদানের কথা এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। ভট্টশালীর বহুমুখী প্রতিভা ও নিবেদিত শ্রমে বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব চর্চা উচ্চতর স্তরে পৌঁছেছিল। তিনি ছিলেন একাধারে প্রাচীন এবং মধ্যযুগের লিপি ও মুদ্রাতত্ত্ববিদ এবং শিল্প-ইতিহাসবেত্তা। ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চল-যেমন, সাভার, বিক্রমপুর, উয়ারী-বটেশ্বর এ অক্লান্তভাবে তিনি প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান চালান। এছাড়াও তিনি কুমিল্লার ময়নামতী ভ্রমণ করেন। তাঁর দুটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ Iconography of Hindu Buddhist Sculptures in Dacca Museum এবং The Coins and Chronology of the Early Independent Sultans of Bengal আজও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হচ্ছে।

পাহাড়পুর রাজশাহীর বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর যৌথ উদ্যোগে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. ভান্ডারকারের নির্দেশনায় ১৯২২-২৩ সালে পাহাড়পুরে প্রথম উৎখনন কার্য পরিচালিত হয়। ১৯২৫-২৬ থেকে এ উৎখনন কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া। ১৯৩০-৩২ সালে সাময়িক বিরতি ছাড়া উৎখনন কার্য এগিয়ে চলে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত। এ উৎখনন কার্যক্রমে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কে.এন দীক্ষিত, তবে কিছু সময় দায়িত্ব পালন করেছিলেন আর.ডি ব্যানার্জি এবং জি.সি চন্দ্র। পাহাড়পুর রিপোর্টটি ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত হয়। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার ৫৫নং স্মারকের এ রিপোর্টটি অদ্যাবধি বাংলার প্রত্নস্থল সম্পর্কে প্রকাশিত রিপোর্টগুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ।

পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার, নওগাঁ

পাহাড়পুরের উৎখনন বিস্ময়কর ফলাফল উপস্থাপন করে। স্থাপত্যকলার দিক থেকে এ বৌদ্ধ মন্দির স্থাপত্যটির নির্মাণ শৈলীতে নতুনত্ব ছিল। সর্বোতভদ্র রীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল ক্রুশাকৃতির ভূমি নকশা এবং চত্বরযুক্ত উপরিকাঠামো। একটি নতুন ধরনের বিহার স্থাপত্য হিসেবে ভিক্ষুদের জন্য নির্মিত কক্ষসমূহ থেকে চারটি লম্বা পথ একটি প্রশস্ত চতুর্ভুজাকার অংশে এসে মিশেছে। এ চতুর্ভুজাকৃতি অংশের কেন্দ্র জুড়ে রয়েছে প্রধান মন্দিরটি। এ ধরনের আরও কতিপয় ক্রুশাকৃতি মন্দির স্থাপত্যের উদাহরণ পাওয়া যায় বাংলাদেশের ভারত ভায়না, সাভার এবং বিশেষ করে ময়নামতীতে। বস্ত্তত ভারত ভায়না এবং ময়নামতীর অন্তত একটি মন্দির পাহাড়পুরের চেয়ে প্রাচীন। মজার বিষয় হচ্ছে, পাহাড়পুর ও ময়নামতীর ক্রুশাকৃতি মন্দিরগুলির সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধ মন্দিরগুলির ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষ করে মায়ানমারের প্যাগান সিরিজের কতিপয় মন্দিরে এ ধারা লক্ষণীয়। এ বার্মিজ মন্দিরগুলি পাহাড়পুর ও ময়নামতীর মন্দিরসমূহের পরবর্তীকালে নির্মিত হয়েছিল। তবে বরবদুর (আট শতকের শেষ দিকে নির্মিত) মন্দিরটি এদের সমসাময়িক হতে পারে। পাহাড়পুরের পরিকল্পিত মন্দির এলাকার নির্মাতা ছিলেন পাল রাজা ধর্মপাল (আনু. ৭৮১-৮২১ খ্রি.)। বিহারে প্রাপ্ত সিলমোহরে উৎকীর্ণ লিপি থেকে জানা যায় যে, এর নামকরণ করা হয় ধর্মপালদেব মহাবিহার, যা সোমপুরে অবস্থিত।

মধ্যযুগের বাংলার প্রাথমিক পর্বের স্থাপত্য ও বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে আলোকপাত করা ছাড়াও পাহাড়পুরের উৎখনন বাংলাদেশের ভাস্কর্য শিল্পের ইতিহাসের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত গুরুত্ববহ। পাহাড়পুর ছাড়া আর কোন প্রত্নঅঞ্চল নেই যেখানে এত বেশি পরিমাণে পাথরের ভাস্কর্য ও পোড়ামাটির ফলক পাওয়া গিয়েছে। পাহাড়পুরে যে ভাস্কর্যসমূহ পাওয়া গিয়েছে তার মধ্যে ৬৩ টিরও বেশি মূর্তি মন্দিরের ভিত্তি-দেয়ালের গায়ে সাঁটা রয়েছে। এসব ভাস্কর্য বিস্তারিতভাবে চর্চার মধ্যদিয়ে ধর্মীয়, শৈল্পিক, কৌশলগত দিক এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির নানা বিষয় জানার সুযোগ রয়েছে। অন্যদিকে অসংখ্য পোড়ামাটির ফলক থেকে সে যুগের বাংলাদেশের মানুষের প্রতিদিনের জীবনচিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। ভাসু বিহার এবং ময়নামতীর মতো সংখ্যায় খুব বেশি না হলেও পাহাড়পুরে কিছু ব্রোঞ্জ নির্মিত ক্ষুদ্রাকৃতির মূর্তি পাওয়া গিয়েছে। তবে এ ক্ষতি পুষিয়ে দিয়েছে ১৯৮২ সালে আবিষ্কৃত আনুমানিক ৯ শতকে নির্মিত একটি বিশালাকার (৪´৩´´) মস্তকবিহীন বৌদ্ধমূর্তি (সম্পূর্ণ মূর্তিটি অবশ্যই ৮ ফুটেরও বেশি উচ্চতাবিশিষ্ট ছিল) যা প্রাচীন কালে আগুনে কিছুটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ৯-১০ শতকে বাংলাদেশে ব্রোঞ্জের ঢালাই শিল্প যে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছিল তা এই উজ্জ্বল উদাহরণ থেকে জানা যায়।

মহাস্থানগড়, খননকৃত স্থান

মহাস্থানগড় মহাস্থানগড়ের দেয়ালের ধ্বংসাবশেষসমূহ প্রমাণ করে যে, এককালে এখানে দুর্গ সুরক্ষিত নগর ছিল। এর উপশহর ছিল মাইলের পর মাইল বিস্তৃত, যার অনেক আকর্ষণীয় ধ্বংসাবশেষ অদ্যাবধি পাওয়া যাচ্ছে। এ নগরের অবস্থিতি এ কারণেও তাৎপর্যপূর্ণ যে ধ্বংসাবশেষসমূহ থেকে ১৫০০ বছরেরও বেশি সময়ের অর্থাৎ আনুমানিক ৩-২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে প্রায় খ্রিস্টীয় ১৫ শতক পর্যন্ত সময়ের ইতিহাসের ধারাবাহিকতা খুঁজে পাওয়া যায়।

প্রাচীন আবিষ্কার থেকে পাওয়া গিয়েছে ভষ্মাধার সমাধিস্ত করার নমুনা আর সাম্প্রতিক আবিষ্কারে পাওয়া গিয়েছে ক্যালকোলিথিক স্তর (বাংলাদেশ-ফরাসি যৌথ উৎখনন)। তাতে ধারণা করা সম্ভব হয়েছে যে, মৌর্য যুগে নগর প্রতিষ্ঠার কয়েক শতক পূর্ব থেকেই এখানে জনবসতি গড়ে উঠেছিল। ২০শতকের শুরুতে বিশেষ করে ১৯০৭ সালে মহাস্থানে বেশ কয়েকটি উৎখনন কার্য পরিচালনা করা হয়।অতঃপর ১৯২৮-২৯ সালে উৎখনন পরিচালনা করেন আর্কিওলোজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার কে.এন দীক্ষিত। এর পর পরই তাঁকে অনুসরণ করেন বগুড়ার আইনজীবী প্রভাষচন্দ্র সেন। তিনি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ঢিবি শনাক্ত করেছিলেন। প্রত্নস্থল এবং এর পরিপার্শ্ব সংযুক্ত একটি চমৎকার মানচিত্রসহ তাঁর রিপোর্টটি ১৯১৯ সালে বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি প্রকাশ করে।

হিউয়েন সাং-এর বর্ণনায় ৭ শতকের মাঝ পর্বে একটি সমৃদ্ধিশালী ও ঐশ্বর্যশালী শহর হিসেবে পুন্ড্রনগরের পরিচয় পাওয়া যায়। এর পাঁচ শত বছর পরে ১২ শতকে পরবর্তী পাল যুগের শহর হিসেবে একই ধরনের সমৃদ্ধির কথা রামচরিতম্ গ্রন্থে বিধৃত থাকায় বহু শতক ব্যাপী পুন্ড্রনগরের অব্যাহত সমৃদ্ধি সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া যায়। বরাবর মহাস্থানের উৎখনন একটি সীমিত এলাকার ভেতরই সাধিত হয়েছে। গুপ্ত ও পাল যুগের মন্দিরের সম্ভাব্য ধ্বংসাবশেষ এবং বর্ণিত হয় নি এমন স্থাপনার ধ্বংসাবশেষের চিহ্ন শহরের কতটা এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তা নকশার ভেতর যুক্ত না থাকায় উল্লিখিত যুগ-পর্ব সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেওয়া যায় না। সব শেষে বাংলাদেশ-ফরাসি যৌথ উৎখনন কার্যক্রমের সাত মৌসুম খনন সমাপ্ত করে এ ধারণায় উপনীত হওয়া গিয়েছে যে, প্রত্নঅঞ্চলটির সাংস্কৃতিক বিকাশ অনুভূমিকভাবে নয় উল্লম্বভাবে হয়েছে। শহরের ভেতর অবস্থিত কয়েকটি ধর্মীয় ইমারত ব্যাপকভাবে পূর্বেই খনন করা হয়েছিল। এগুলি হচ্ছে ১৯২৮-২৯ সালে উৎখননকৃত গোবিন্দ ভিটা এবং ১৯৩৪-৩৬ সালে উৎখননকৃত লক্ষিন্দরের মেধগোকুল মেধ

বাংলাদেশের অন্যান্য প্রত্নঅঞ্চলের মত মহাস্থানগড়েও পর্যাপ্ত পোড়ামাটির ফলক পাওয়া গিয়েছে। তবে প্রধান শহর অঞ্চলের নিকট সাম্প্রতিক উৎখননে প্রাপ্ত ব্যতিক্রমধর্মী পোড়ামাটির ফলকসমূহের কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। বর্তমানে বিলুপ্ত মন্দিরের দেয়াল অলঙ্করণে এ ফলকসমূহ ব্যবহূত হয়েছিল। ফলকসমূহের বিশেষত্ব হচ্ছে এর মধ্যে রামায়ণের কাহিনী উৎকীর্ণ করা হয়েছে। প্রতিটি ফলকে রয়েছে আলাদা আলাদা চিত্র এবং উৎকীর্ণ রয়েছে সাত শতকের শেষ দিকের সংস্কৃত লিপি। বাংলাদেশে এটি এক অনন্য নিদর্শন। অতি সম্প্রতি মহাস্থানে নতুন সাংস্কৃতিক নিদর্শন হিসেবে অলংকৃত মসৃণ মৃৎপাত্র আবিষ্কৃত হয়েছে।

ভাসুবিহার

ভাসু বিহার মহাস্থানগড় থেকে প্রায় ৩-৪ মাইল উত্তর-পশ্চিমে একটি বিস্তৃত প্রত্নএলাকা জুড়ে ভাসু বিহার অবস্থিত। হিউয়েন সাং উল্লিখিত পো-শি-পো বিহার হিসেবে কানিংহাম এ বিহারের ঢিবিসমূহ শনাক্ত করেন। পো-শি-পো বিহার হোক বা না হোক স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের মাধ্যমে এ অঞ্চলে দুটি বড় আকারের বৌদ্ধ মঠ এবং একটি মাঝারি আকারের বৌদ্ধ সমাধি উন্মোচিত হয়েছে। ১৯৭৯-৮৩ সালে বিহার ঢিবিতে উৎখনন পরিচালনার মাধ্যমে ৩৭টি কক্ষ বিশিষ্ট একটি ছোট আকারের মঠ আবিষ্কৃত হয়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রত্নবস্ত্ত উদ্ধারে ভাসু বিহারের উৎখনন যথেষ্ট ফলপ্রসূ হয়েছিল। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ক্ষুদ্রাকৃতির ব্রোঞ্জ মূর্তি এবং পোড়ামাটির ফলক। উভয় নিদর্শনই শৈল্পিক দিক থেকে ছিল উচ্চ মানের। এসব নিদর্শনের মধ্যে কমপক্ষে ৬০টি ছিল ব্রোঞ্জের ক্ষুদ্র মূর্তি এবং ২৭টিরও বেশি ছিল পোড়ামাটির ফলক।

তবে এখানে বড় আকৃতির কোন ব্রোঞ্জ মূর্তি পাওয়া যায় নি। অবশ্য একটি বড় আকারের লিপি উৎকীর্ণ বেদি পাওয়ায় ধারণা করা হয় যে, এখানে এক সময় মূর্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল। ভাসু বিহারের পোড়ামাটির ফলকসমূহ অন্যান্য অঞ্চলে প্রাপ্ত ফলকগুলির চেয়ে আকারে ছিল বড় এবং সৌন্দর্যে ছিল চিত্তাকর্ষক। ভাসু বিহারে পর্যাপ্ত পরিমাণ লিপি উৎকীর্ণ পোড়ামাটির সিল পাওয়া গিয়েছে। এ ধরনের সিল সংগৃহীত হয়েছে ২৫০টিরও বেশি।

হলুদ বিহার পাহাড়পুর থেকে ৯ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত হলুদ বিহার নামের প্রত্নস্থলটি বৌদ্ধ অবস্থানের নানা ধ্বংসাবশেষের জন্য সুপরিচিত। একটি মাঝারি আকারের ক্রুশাকৃতি বৌদ্ধ সমাধি এখানে পাওয়া গিয়েছে। মাটির উপরিভাগে দেখতে পাওয়া যায় এন.বি.পি-র অনেক ভাঙ্গা টুকরা।

সীতাকোট বিহার

সীতাকোট দিনাজপুর জেলার নওয়াবগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত সীতাকোট প্রত্নস্থলটিতে ১৯৭২-৭৩ সালেউৎখনন কার্য পরিচালিত হলে বর্গাকৃত নকশার (২১৫ বর্গফুট) একটি বৌদ্ধ মঠ উন্মোচিত হয়। মঠটির আঙ্গিনায় কোন কেন্দ্রীয় মন্দির ছিল না। দক্ষিণের বাঁকে অবস্থিত কেন্দ্রীয় কক্ষটি প্রধান বেদির ভূমিকা পালন করত বলে মনে করা হয়। এ মঠে সর্বমোট ৪১টি কক্ষ ছিল। প্রত্যেকটি কক্ষ ৩.৬৬ মিটার লম্বা এবং ৩.৩৫ মিটার চওড়া। ব্রোঞ্জের দুটি ক্ষুদ্রাকৃত বৌদ্ধ মূর্তি এবং প্রায় ১৩০টি অলঙ্কৃত ইট ছাড়া এ প্রত্নস্থল থেকে উল্লেখযোগ্য আর কিছু পাওয়া যায় নি। মঠটির নির্মাণকাল ৭-৮শতক।

জগদ্দল এখনও জগদ্দলের (নওগাঁ) উৎখনন কার্য অব্যাহত রয়েছে। এখানে মাটি থেকে উন্মোচিত হয়েছে সীতাকোটের অনুরূপ একটি ছোট আকারের চতুর্ভুজাকৃতির মঠ।

শালবন বিহার ,ময়নামতী

ময়নামতী ময়নামতীর উঁচু ভূমিতে প্রাচীন নিদর্শনাদি উন্মোচিত হওয়ার পর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চল হিসেবে এর মূল্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮০৩ সালের প্রথম দিকে রণবঙ্কমল্ল হরিকালদেবের একটি  তাম্রলিপি আবিষ্কৃত হয়। ১৮৭৫ সালে প্রাপ্ত কোটবাড়ি ঢিবির ধ্বংসাবশেষকে ছোট আকারের ‘ইট নির্মিত দুর্গ’ মনে করা হয়েছিল। এখানে পাওয়া গিয়েছিল ময়নামতীর প্রথাগত পোড়ামাটির ফলক। এটি ছিল আসলে একটি মঠ। আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে কানিংহাম এই প্রত্নস্থল কখনও পরিদর্শন করেন নি। ১৮শতকের শেষে ফ্রান্সিস বুকানন এই অঞ্চল পরিভ্রমণ করেছিলেন। ১৯১৭ সালে এন.কে. ভট্টাশালী ময়নামতী ভ্রমণ করেন এবং তাঁর Iconography of Buddhist and Brahmanical Sculpture in the Dacca Museum (১৯২৯) গ্রন্থে এ ভ্রমণ রিপোর্ট অন্তর্ভুক্ত করেন। উনিশ শ’ চল্লিশের দশকের প্রথম দিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আর্কিওলোজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার সুপারিনটেন্ডেন্ট টি.এন রমাচন্দ্রন এ অঞ্চল পরিদর্শন করেন এবং সামরিক ঠিকাদারদের তস্করবৃত্তির হাত থেকে প্রত্ন নিদর্শসসমূহ রক্ষার জন্য কিছু পদক্ষেপ নেন। তাঁর সুপারিশ ক্রমে ২০টি প্রত্নস্থল সংরক্ষণ করা হয়। রমাচন্দ্রনের বিস্তারিত রিপোর্টটি ১৯৪৬ সালে BC Law Volume pt. II-এ প্রকাশিত হয়েছিল। ভারত বিভক্তির পর পাকিস্তান প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে রমাচন্দ্রনের প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করে এবং বিস্তারিত জরিপের মাধ্যমে ৫৫টি প্রত্নস্থল তালিকাভুক্ত করে। লালমাই পাহাড় জুড়ে এখনও এ সকল প্রত্নস্থল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ১৯৫৫ থেকে শুরু করে এখনও বিভিন্ন প্রত্নস্থলে উৎখনন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এ সমস্ত উৎখননের মাধ্যমে দৃশ্যমান হওয়ার সুযোগ হয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশের নানা গুরুত্বপূর্ণ ও অজানা তথ্য। জানার সুযোগ হয়েছে এ অঞ্চলের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও শিল্প ইতিহাসের বিভিন্ন তথ্য এবং উপমহাদেশের একেবারে পূর্বাঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মীয় স্থাপত্য হারিয়ে যাওয়ার আগে এর ক্রমবিকাশের ধারা। আমেরিকান পন্ডিত ব্যারি এম. মরিসন ২০শতকের ষাটের দশকের শুরুতে এ অঞ্চলের ধ্বংসাবশেষ অনুসন্ধান করেন এবং এর ফলাফল ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত  Lalmai-A Cultural Center of Early Bengal- গ্রন্থে প্রকাশ করেন।

ময়নামতী অঞ্চলে এ পর্যস্ত নয়টি প্রত্নস্থল উৎখনন করা হয়েছে এবং আরও কয়েকটিতে খনন চলছে। এগুলি হচ্ছে  শালবন বিহার, কুটিলা মুড়া, চারপত্র মুড়া, রানীর বাংলো, আনন্দ বিহার, ইটাখোলামুড়া, রূপবান মুড়া, ভোজ বিহার এবং ময়নামতি ঢিবি। রমাচন্দ্রন শালবন রাজার প্রাসাদ ঢিবিকে (বর্তমানে শালবন বিহার নামে পরিচিত) তেমন বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেন নি। কিন্তু পাকিস্তান প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের পরিচালক এফ.এ খান প্রথমবারের মতো এ প্রত্নস্থল উৎখনন করেন এবং প্রাপ্ত ফলাফলের মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে, তাঁর সিদ্ধান্ত যথার্থ ছিল। সামগ্রিক ভাবে ময়নামতীতে পর্যাপ্ত সাংস্কৃতিক বস্ত্ত সামগ্রী থাকলেও প্রাপ্ত সিলমোহরের ভিত্তিতে ভবদেব মহাবিহার নামে পরিচিত শালবন বিহারে ছিল শিলালিপি, মুদ্রা ও পোড়ামাটির ফলকের বিপুল সঞ্চয়। ময়নামতী উৎখনন থেকে প্রাপ্ত ১৩টি (১৮০৩ সালে প্রাপ্ত হরিকালদেবের তাম্রশাসনটি যোগ করলে ১৪টি) তাম্রশাসনের মধ্যে কমপক্ষে ৮টি পাওয়া গিয়েছে শালবন বিহারে, ৪টি চারপত্র মুড়ায় এবং সম্ভবত একটি পাওয়া গিয়েছে আনন্দ বিহারে। ময়নামতী থেকে প্রায় ৪০০ মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে। এরমধ্যে প্রায় ৩৫০টিই সংগৃহীত হয়েছে শালবন বিহার থেকে। এগুলির ভেতর গুপ্ত, দেব ও খড়গদের কিছু স্বর্ণ মুদ্রাও রয়েছে। শালবন বিহারে প্রাপ্ত ব্রোঞ্জের ক্ষুদ্রাকৃতি প্রতিমূর্তির সংখ্যাও কম নয়। পর্যালোচনা করলে বলা যায়, বাংলাদেশের যে কোন প্রত্নস্থলের তুলনায় পাহাড়পুরে যেমন পাওয়া গিয়েছে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পাথরের ভাস্কর্য এবং পোড়ামাটির ফলক, তেমনিভাবে বিপুল সংখ্যক লিপি, মুদ্রা এবং ব্রোঞ্জের ক্ষুদ্রাকৃতির মূর্তি পাওয়া গিয়েছে ময়নামতীতে, যার সমতুল্য প্রাচীন প্রত্নস্থল শুধু বাংলাদেশেই নয় সম্ভবত উপমাদেশেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে শুধু প্রাপ্ত নিদর্শনের সংখ্যা বিচারে নয়, তাৎপর্যের দিক থেকেও এগুলি সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ময়নামতীতে প্রাপ্ত লিপিসমূহে কমপক্ষে পাঁচটি রাজবংশের পরিচয় রয়েছে (গুপ্ত, খড়গ, দেব, চন্দ্র, পরবর্তী দেব)। এদের মধ্যে এমন নতুন রাজবংশের নাম জানা যায় যাদের কথা পূর্বে শোনা যায় নি, যেমন দেব বংশ। মোটের ওপর ময়নামতীর আবিষ্কারসমূহ-এর লিপি, মুদ্রা, ভাস্কর্য এবং স্থাপত্য আনুমানিক ৬ থেকে ১৩ শতকের দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গের ইতিহাসের ধারণাই পাল্টে দেয়। এ শুধু রাজনৈতিক ইতিহাসের ক্ষেত্রেই নয়ল-শিল্পকলা, ধর্ম এবং অর্থনৈতিক ইতিহাসের ক্ষেত্রেও সমান প্রযোজ্য।

শালবন বিহার উৎখননের গুরুত্ব আলোচনায় ফিরে আসা যাক। ৩০০টিরও বেশি স্বর্ণ, রৌপ্য (পর্যাপ্ত পরিমাণ) এবং তাম্র মুদ্রা প্রাপ্তি প্রমাণ করে যে, এখানে একটি মুদ্রা ব্যবস্থা কার্যকর ছিল। পাল ও সেন যুগের মুদ্রা অনুপস্থিত থাকায় বাংলায় মুদ্রা ব্যবস্থা গড়ে ওঠে নি বলে আমাদের যে বদ্ধ ধারণা তৈরি হয়েছিল এ আবিষ্কার তাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। বাংলার দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে এ বিকাশমান মুদ্রা ব্যবস্থা একই সঙ্গে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক জীবনের বিকাশমান ধারাকেও নির্দেশ করে। শালবন বিহারে পট্টিকেরা ও হরিকেল রৌপ্য মুদ্রাসমূহের একই সময়ে আবিষ্কার এ দুই মুদ্রা ব্যবস্থা সম্পর্কে আমাদের ধারণা স্বচ্ছ করতে সাহায্য করে।

এ উৎখননসমূহের মাধ্যমে বেশ কয়েক ধরনের বৌদ্ধ ধর্মীয় স্থাপত্য উন্মোচিত হয়। এর মধ্যে ক্রুশাকৃতির মন্দির সম্পর্কে আগেই আলোচনা করা হয়েছে। ময়নামতীর মন্দিরসমূহের মধ্যে আনন্দ বিহার হচ্ছে বৃহত্তম। যদি তৃতীয় দেব রাজার নামে এ বিহারটির নামকরণ হয়ে থাকে, যিনি ৮শতকের মাঝ পর্বে কিছু সময় সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তবে ধারণা করা যেতে পারে যে, এ ক্রুশাকৃতি মন্দিরটি পাহাড়পুরের চেয়েও প্রাচীন।

বৈচিত্র্যপূর্ণ আরও তিন ধরনের উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য রীতির নিদর্শন কুটিলা মুড়ার ধতংসাবশেষের প্রতিনিধিত্ব করছে। এগুলি হচ্ছে এক সারিতে তিনটি প্রথাগত স্তূপ, প্রত্যেকটির সামনে ছিল একটি করে চৈত্য। কুটিলা মুড়া প্রত্নক্ষেত্রকে রত্ন-ত্রয় (বৌদ্ধ, তিন রত্ন) ধরনের স্তূপ বলা হয়ে থাকে। পাহাড়ের ওপর এটি সম্ভবত প্রাচীনতম স্থাপনা। ৭শতকের মাঝ পর্ব থেকে ৮শতকের মাঝ পর্বে খড়গ রাজাদের সময় এ স্তূপগুলি নির্মিত হয়। তবে কুটিলা মুড়া  স্তূপসমূহের নির্মাণকাল ৭শতকের শেষ ভাগে বলে বিশ্বাস করার পেছনে কিছু যুক্তি রয়েছে। কুটিলা মুড়ার তাৎপর্য এই যে, এখানকার স্তূপের মূল উপরিকাঠামোটি অদ্যাবধি টিকে আছে। একই কারণে রূপবান মুড়ার স্থাপত্যও উল্লেখযোগ্য। এখানে এখনও টিকে আছে করবেল পদ্ধতির ছাদ বিশিষ্ট একটি প্রতিমা কক্ষের মূল উপরিকাঠামোর কিছু অংশ, যা বাংলাদেশের প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের মধ্যে একমাত্র টিকে থাকা স্থাপত্যের উদাহরণ।

অন্য দুই ধরনের উল্লেখযোগ্য স্থাপত্যিক নিদর্শন পাওয়া যায় চারপত্র মুড়া ও ইটাখোলা মুড়ায়। চারপত্র মুড়ায় পাওয়া গিয়েছে চন্দ্র রাজা লড়হচন্দ্রের একটি শিলালিপি। লড়হচন্দ্রের নামে উৎসর্গীকৃত চারপত্র মুড়াটি হিন্দু বৈষ্ণব মন্দির হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

তিনটি বিস্ময়কর সাম্প্রতিক আবিষ্কার প্রসঙ্গ যুক্ত না করলে ময়নামতীর আলোচনা সম্পূর্ণতা লাভ করবে না। এর মধ্যে দুটি হচ্ছে উন্নত দক্ষতায় তৈরি ধাতব মূর্তি এবং একটি পাথরের ভাস্কর্য। পাথরের ভাস্কর্যটি একটি দন্ডায়মান বুদ্ধমূর্তি। রূপবান মুড়ায় উৎখননে এটি আবিষ্কৃত হয়। এর বিশেষ গুরুত্ব এ জন্য যে, আবিষ্কৃত মূর্তিটি বাংলাদেশে প্রাপ্ত ধ্রুপদী যুগের গুপ্ত ভাস্কর্যের একমাত্র উদাহরণ। অন্য দুই বিস্ময়কর আবিষ্কারের একটি হচ্ছে ১৯৯৪ সালে ভোজ বিহারের ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রাপ্ত ব্রোঞ্জ নির্মিত বিশালাকায় বজ্রসত্ত্ব মূর্তি এবং অপরটি রূপবান কন্যা মুড়া থেকে প্রাপ্ত একটি বিশালাকার ঘণ্টা। অনুমানিক ১০-১১শতকে নির্মিত ১.৫ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট এ উপবিষ্ট বজ্রসত্ত্বটি ব্রোঞ্জের ঢালাই কাজের এক আশ্চর্য নিদর্শন। একই ধরনের একটি বুদ্ধ মূর্তির কর্তিত মাথা সংরক্ষণ করা হয়েছে যা আরেক ব্রোঞ্জ মূর্তির অংশ বিশেষ। ব্রোঞ্জ নির্মিত এ পূর্ণ আকারের বোধিসত্ত্ব অবলোকিতেশ্বরের মাথাটি বৈরাগী মুড়া ঢিবি থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এটি একটি মসৃণ স্বর্ণ পাত্রের ওপর বসানো ছিল। ব্রোঞ্জ নির্মিত ঘণ্টাটির ওজন অর্ধ টন। এরও নির্মাণকাল ১০-১১শতক।

উয়ারী-বটেশ্বর অতিসম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যলয়ে প্রতিষ্ঠিত প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্বের অঙ্গনে নতুন ক্ষেত্র উন্মোচনে গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্বের প্রাক-ইতিহাস এবং আদি ইতিহাস্ল অন্বেষণে বিভাগটি পথপ্রদর্শকের ভূমিকা রেখেছে। উয়ারী-বটেশ্বরে তাদের সাম্প্রতিক কাজ থেকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, দক্ষিণপূর্ব বাংলার (বঙ্গ-সমতট) প্রত্নঅঞ্চলটি উত্তরবঙ্গের মহাস্থানগড়ের (পুন্ড্রবর্ধন) মতো আদি ঐতিহাসিক পর্বে অর্থাৎ ৪-৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মৌর্য বা মৌর্য-পূর্ব যুগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। উয়ারী ও বটেশ্বর বৃহত্তর ঢাকার নরসিংদীতে অবস্থিত দুটি প্রতিবেশী গ্রাম। মাটির উপরিভাগে নানা ছোট ছোট প্রত্নবস্ত্ত প্রাপ্তির কারণে এলাকাটি সুপরিচিত ছিল। এ সমস্ত ক্ষুদ্র প্রত্নবস্ত্তর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পাথরের (ফসিল কাঠ) হাতিয়ার, হাজার হাজার ছাপাঙ্কিত মুদ্রা এবং সহস্রাধিক কম দামী পাথরের গুটিকা। এর অনেকগুলি অসম্পূর্ণ অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে, যা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এগুলি স্থানীয়ভাবে নির্মিত হয়েছিল।

উয়ারী- বটেশ্বর, নরসিংদী

এটি এমন একটি প্রত্নস্থল যেখানে কোন ঢিবি পাওয়া যায় নি। স্থানীয় সম্ভ্রান্ত পাঠান পরিবারের জনাব হানিফ পাঠান ও তাঁর পুত্র হাবিবুল্লাহ পাঠান এ ধরনের প্রাচীন নিদর্শনসমূহের পারিবারিক সংগ্রহ গড়ে তোলেন। তাঁরা ১৯৩৩ সাল থেকে এ প্রত্নস্থলের গুরুত্ব উন্মোচন করে বিভিন্ন জার্নালে প্রবন্ধ লিখতে ও গ্রন্থ প্রকাশ করতে থাকেন। বস্ত্তত, এন.কে ভট্টশালী প্রত্নস্থলটি পরিদর্শন করে ১৯৩৫-৩৬ সালে একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছিলেন। উয়ারী-বটেশ্বরের বেশ কয়েক মাইল এলাকা ঘিরে ছাপাঙ্কিত মুদ্রা্ পাওয়া যাওয়ায় সম্পূর্ণ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর চারপাশে রয়েছে আদি মধ্যযুগের বেশ কিছু প্রত্নস্থল। উদাহরণ হিসেবে বেলাবো (ভোজবর্মন তাম্রশাসন) ও আশরফপুরের (দেবখড়গের ২টি তাম্রশাসন) কথা বলা যেতে পারে। এসব নিদর্শন উল্লিখিত গুরুত্বের ধারাবাহিকতা প্রকাশ করে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যলয় এ প্রত্নস্থলে অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করে ১৯৮৯ সালে। এরপর ২০০০ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যলয়, বঙ্গীয় শিল্পকলা র্চ্চার আন্তর্জাতিক কেন্দ্র (আই.সি.এস.বি.এ) এবং সরকারি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের যৌথ উদ্যোগে এখানে পরীক্ষামূলক উৎখনন পরিচালিত হয়। সম্প্রতি আই.সি.এস.বি.এ কর্তৃক একটি প্রাথমিক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। যাহোক, এ প্রত্নস্থলের প্রকৃতি অনুধাবন করতে হলে এ সম্পর্কিত আরও কাজ করা প্রয়োজন। অবশ্য এখন নিশ্চিত যে, এ প্রত্নস্থলের প্রতিষ্ঠাকাল সময়ের ধারাবাহিকতায় খ্রিস্টপূর্ব ৪-৩ শতকে উপমহাদেশের আদি ঐতিহাসিক যুগের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে বিস্তারিত ভাবে এর প্রকৃতি অন্বেষণ এবং এর সাংস্কৃতিক বিস্তার ও চরিত্র, কেন এখানে গড়ে উঠেছিল তার কারণ উদ্ঘাটনলপ্রভৃতি বিষয়ের ওপর চর্চা করার প্রয়োজন রয়েছে। সমুদ্র বাণিজ্যের সঙ্গে যে এ অঞ্চলের যোগাযোগ ছিল তা এখন নিশ্চিত।

প্রাকইতিহাস ১৯৮৯ সাল থেকে প্রাকইতিহাস চর্চা করা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আরেকটি অবদান। এ গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রাক-ইতিহাসের ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে, যেখানে পূর্বে ভাবা হতো যে, এ বদ্বীপ ভূমিতে এ ধরনের অঞ্চল থাকার সম্ভাবনা নেই। নোয়াখালীর ছাগলনাইয়াতে সামান্য কিছু পাথুরে হাতিয়ার ফসিল, কাঠে তৈরি একটি চাছুঁনি (scraper) এবং শালবন বিহার উৎখননের পর এর ৭-৮শতকের স্তরে নবোপলীয় যুগের কিছু ফসিল কাঠের হাতিয়ার সম্পর্কে জানা ছিল। ফসিল কাঠে তৈরি আরও দুটি হাতিয়ারের নমুনা পাওয়া গিয়েছিল সীতাকুন্ডে (চট্টগ্রাম)। একটি পাওয়া যায় ১৮৮৬ ও অন্যটি ১৯১৭ সালের কিছু আগে। বেশ কিছু নবোপলীয় হাতিয়ার সংগৃহীত হয়েছে ওয়ারী-বটেশ্বর থেকে। ডাইসন নামক এক আমেরিকান ১৯৫৮ সালে একটি পাথুরে হাতিয়ার সংগ্রহ করে চট্টগ্রাম জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরে জমা দিয়েছিলেন, কিন্তু এখন তার কোন হদিস পাওয়া যায় না। কিন্তু অধ্যাপক দিলিপ কে চক্রবর্তীর নেতৃত্বে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ময়নামতী অঞ্চলে ফসিল কাঠের তৈরি হাতিয়ারের কারখানা আবিষ্কার করে। এতে এখন সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে যে, এখানে পাথুরে হাতিয়ার ব্যবহারকারী সংস্কৃতির মানুষেরা কাঁচামাল হিসেবে ফসিল কাঠ ব্যবহার করত। এর পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পুনরায় পাথুরে হাতিয়ার ব্যবহারকারী সংস্কৃতির অস্তিত্ব আবিষ্কার করে সিলেটের চাকলাপুঞ্জিতে। তবে এ গবেষণাসমূহ এখনও অত্যন্ত প্রাথমিক স্তরে রয়েছে। এ সংস্কৃতির বিকাশ সম্পর্কে আরও স্পষ্ট ও বোধগম্য ধারণা পাওয়ার জন্য বিস্তারিত গবেষণা প্রয়োজন। একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, কোন পাথরের হাতিয়ারের সঙ্গেই মানুষের দেহাবশেষের নমুনা পাওয়া যায় নি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ সিলেটের জৈন্তিয়ার মেগালিথিক সংস্কৃতির ওপরও গবেষণা শুরু করেছে।  [আবু ইমাম]

প্রত্নতত্ত্ব, পশ্চিম বাংলা বরেন্দ্রের দক্ষিণে এবং রাঢ় অঞ্চলের পূর্বে গঙ্গ-ব্রহ্মপুত্র ও তাদের শাখা-প্রশাখা দ্বারা গঠিত অঞ্চল অথবা দুই নদীর ব-দ্বীপ অঞ্চলই হলো দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলা। ভূ-তাত্ত্বিক বিচারে এটি সম্পূর্ণরূপে সাম্প্রতিক কালের।  শ্রী চৈতন্যের আবির্ভাব এবং ভক্তি আন্দোলনের উদ্ভবের আগ পর্যন্ত এ অঞ্চলকে সাংস্কৃতিক দিক থেকে পশ্চাৎপদ মনে করা হতো। তবে বিগত শতাব্দীর প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারসমূহ এ অঞ্চলকে আলোচনায় নিয়ে এসেছে।

নদীয়া জেলার যখেরডাঙ্গা এবং দক্ষিণ চবিবশ পরগণার দেউলপোতা ও হরিনারায়ণপুরের মতো বিভিন্ন স্থানে প্রাপ্ত বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র প্রস্তর হাতিয়ারসমূহের আবিষ্কার থেকে অনুমান করা যায় যে, এগুলি পশ্চিমাঞ্চল থেকে ভেসে এসে জমা হয়েছিল অর্থাৎ এগুলি মধ্যপ্রস্তর যুগের সৃষ্ট নয়। কারণ যেখানে এগুলি পাওয়া গেছে সেখানকার ভূমির গঠন অতি সাম্প্রতিককালের। খননকার্যের মাধ্যমে নাটশাল থেকে পাওয়া গেছে হাঁড়ের তৈরি হাতিয়ার, মেদিনীপুর জেলার তমলুকে পাওয়া গেছে চীনামাটি, পোড়া মৃৎপাত্র এবং মসৃণ যন্ত্রপাতি। এগুলি থেকে নব্যপ্রস্তর স্তরের প্রমাণ মেলে। এসব অঞ্চলে প্রকৃত আবাসনও ছিল। মেদিনীপুর জেলার আগুইবাড়ি থেকে তামার মুদ্রা ভান্ডারের সন্ধান পাওয়া গেছে।

ঐতিহাসিক যুগের শুরুতে এ অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে অনেক শহরের উদ্ভব লক্ষ্য করা যায়। তমলুক এবং নাটশাল তখনও তাদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছিল। এ ছাড়া মেদিনীপুর জেলার বাহিরী এবং তিলদা, উত্তর চবিবশ পরগনা জেলার চন্দ্রকেতুগড়, মোচপোল এবং গোপলাপুর এবং দক্ষিণ চবিবশ পরগনার দেউলপোতা, হরিনারায়ণপুর, পুকুরতলা, আটঘরা, বড়াল ও ভাঙ্গনখালির ন্যায় বহু নতুন কেন্দ্র গড়ে উঠে।

এসকল প্রত্নস্থলে তমলুক ব্যতীত আর কোথাও মৌর্যযুগের স্পষ্ট নিদর্শন পাওয়া যায় না। এ অঞ্চলে শুঙ্গ, কুষাণ যুগের সমৃদ্ধ নিদর্শন পাওয়া গেছে। হুগলি নদীর পূর্বপাশের প্রত্নস্থলগুলিও এ দুযুগ অপেক্ষা খুব একটা প্রাচীন বলে মনে হয় না। এ অঞ্চলের দুটি গুরুত্বপূর্ণ নগরকেন্দ্র হলো তমলুক এবং চন্দ্রকেতুগড়। প্রাচীন বন্দর তাম্রলিপ্তিই তমলুক হিসেবে পরিচিত। আর বড় চম্পাদেউলিয়া, সিঙ্গার আটি, শানপুকুর, হাদিপুর, জিকরা, প্রভৃতি আধুনিক গ্রাম ছিল চন্দ্রকেতুগড়ের অন্তর্ভুক্ত। এ প্রত্নস্থলগুলি থেকে এ যুগের কোন ইটের তৈরি কাঠামোর অস্তিত্ব পাওয়া যায় নি। তবে কয়েকটি প্রত্নস্থলে মাটির পাতকুয়া পাওয়া গেছে। সমগ্র অঞ্চলে প্রাপ্ত এ যুগের নৃতাত্ত্বিক হাতিয়ার থেকেও একইরূপ সাংস্কৃতিক নিদর্শন এবং শৈল্পিক বিন্যাসের পরিচয় মেলে।

তমলুক এবং চন্দ্রকেতুগড় থেকে প্রাপ্ত চমৎকার পোড়ামাটির জিনিসপত্রগুলি সূক্ষ্ম শিল্পকর্মের জন্য অত্যন্ত সুপরিচিত। এগুলির মধ্যে অধিকাংশই শুঙ্গ-কুষাণ রীতির অসংখ্য ছাঁচে তৈরি ফলক এবং অধিকাংশ ফলকে নারীর অবয়ব চিহ্নিত। এসকল নারী মূর্তির মাথায় চওড়া মস্তকাবরণী এবং অলঙ্কার দ্বারা বিশেষভাবে সজ্জিত। নারী মূর্তির আশেপাশে রয়েছে আরও কিছু মূর্তি। কিছু কিছু ফলকে রয়েছে মা ও শিশু মূর্তি। পুরুষ মূর্তিগুলি সু-অলঙ্কৃত এবং পাগড়ি সদৃশ মস্তকাবরণ পরিহিত। পুরুষ এবং নারী উভয় শ্রেণির কিছু মূর্তি ডানা সম্বলিত। কিছু কিছু ফলকে নারী পুরুষের যুগল অবয়ব পরিস্ফুটিত। কোন কোন ফলক বর্ণনাত্মক। এগুলিতে দৈনন্দিন জীবনের অথবা কিছু সাধারণ কাহিনীর চিত্র পাওয়া যায়। এগুলির মধ্যে রয়েছে মিছিলের দৃশ্য এবং গায়িকা, নর্তকী, শস্যকর্তনরত কৃষক ও ঘর-গৃহস্থালীর দৃশ্য। কোন কোন ফলকে জঙ্গলের পটভূমিতে একক অথবা দলবদ্ধ প্রাণীর চিত্র দেখা যায়।

পোড়ামাটির ক্ষুদ্র মূর্তিগুলির কোন কোনটি হাতে তৈরি, আবার কোন কোনটি দ্বৈত ছাঁচে তৈরি। একটি ছাঁচ দিয়ে মূর্তির সামনের দিক এবং অপরটি দিয়ে পেছনের দিক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কোন কোন মূর্তির অভ্যন্তরস্থ ফাঁপা অংশ কাদার তৈরি কণা দ্বারা পূর্ণ। মূর্তি তৈরির এ প্রক্রিয়া প্রাণী এবং মানুষ উভয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহূত হতো। ছাঁচে তৈরি মূর্তির মুখের অবয়ব, পরিচ্ছদ এবং মস্তকাবরণ মৌর্যরীতির নিদর্শন। এগুলির অধিকাংশই তমলুক থেকে প্রাপ্ত। এ অঞ্চল থেকে মাত্র কয়েকটি উপজাতীয় নৃতাত্ত্বিক পরিচয়বাহী কুষাণ রীতির মূর্তি পাওয়া গেছে যেগুলির মাথা দেহের খাজের সাথে আলাদাভাবে সংলগ্ন। ফলকগুলির মধ্যে কিছু খেলনা গাড়িও রয়েছে। এ খেলনা গাড়িতে অক্ষদন্ড স্থাপনের জন্য নিচের অংশে আড়াআড়িভাবে গর্ত করা এবং প্রান্তভাগে চাকা সংযুক্ত। খেলনা গাড়ি অবয়বের দিক থেকে প্রাণী, গাড়িতে উপবিষ্ট প্রাণী এবং দানবাকৃতির।

এ অঞ্চলে প্রাপ্ত বেশির ভাগ প্রত্নবস্ত্ত ছিল মৃৎপাত্রের টুকরা বিশেষ। এখানে প্রাপ্ত আদি ঐতিহাসিক পর্বের চীনামাটির নিদর্শনগুলিও সমজাতীয়। ঐতিহ্যগত এ চীনামাটির নিদর্শনগুলি দক্ষিণ ভারতের ঐতিহাসিক মৃৎপাত্রের বৈশিষ্ট্য অনুসরণ করেছে। তবে এগুলিতে আঞ্চলিক রূপ স্থান পাওয়ায় কিছু পরিবর্তন এসেছে। তমলুক এবং চন্দ্রকেতুগড়ে উত্তর ভারতীয় কালো মসৃণ পাত্রের ন্যায় কিছু উন্নত মানের পাত্র পাওয়া গেছে। মৌর্যযুগের পাত্র যেমন অবশ্যই কালো রঙের হয়, এগুলি সর্বক্ষেত্রে তা কিন্তু নয়। এখানে রুলেট নকশার কিছু কালো এবং ধূসর রংয়ের পাত্রও রয়েছে। চীনামাটির এ পাত্রগুলি মূলত রোমান বিশ্বের বাণিজ্যের সাথে সম্পৃক্ত। ভেতরের দিকে নকশা করা কিছু গামলার মতো কৌণিক পাত্র এখানে পাওয়া গেছে যেমনটি ভারতের পূর্ব উপকূলের সর্বত্র পাওয়া যায়। এখানে চাকা দ্বারা চিত্রায়িত আরও কিছু গোলাকার কিংবা পাতার আদলে নকশা করা পাত্র পাওয়া গেছে যা উত্তর ভারতের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। ফুল, প্রাণী এবং পুরুষাকৃতির দেবতা অঙ্কিত কিছু ছাঁচে তৈরি মৃৎপাত্র এ অঞ্চলে পাওয়া যায়। এছাড়া এখানে লম্বাকৃতির সোরাহীর মত পুষ্পাধার পাওয়া গেছে যা শুধু এ অঞ্চলেরই বৈশিষ্ট্য। কাঁথি উপকূলেও দুই হাতল বিশিষ্ট সোরাহী পাওয়া গিয়েছিল। মৃৎপাত্রগুলিতে নানা রঙের নকশা এবং খোদাই-এর কাজ ব্যবহূত হয়েছিল।

চন্দ্রকেতুগড়, হরিনারায়ণপুর, দেউলপোতা এবং তমলুক থেকে প্রচুর পরিমাণে পাথরের গুটিকা (পুঁতি) পাওয়া গেছে। একসময় এগুলি মালা গেঁথে অলংকার রূপে ব্যবহূত হতো। এগুলি আকিক, কার্নেলিয়ান, স্ফটিক, গার্নেট, জ্যাসপার প্রভৃতি কম দামের পাথর থেকে নির্মিত হয়েছিল। গুটিকা তৈরিতে বিভিন্ন রংয়ের কাঁচ, পোড়ামাটি, তামা, হাঁড় ইত্যাদিও ব্যবহূত হতো। আকিক এবং কার্নেলিয়ান পাথর থেকে তৈরি গুটিকাগুলিতে চুনাপাথর ব্যবহূত হতো এবং স্বচ্ছ কাঁচের তৈরি গুটিকাগুলি সোনার পাত দিয়ে আবৃত করা হতো। এগুলি আলেকজান্দ্রিয়া থেকে আসত বলে ধারণা করা হয়।

এযুগের আদি ঐতিহাসিক মুদ্রার মধ্যে রয়েছে পঞ্চ প্রতীক সম্বলিত ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রা, নৌকা প্রতীক সম্বলিত ছাপাঙ্কিত মুদ্রা এবং অখোদিত ছাঁচে তৈরি মুদ্রা। তীরের অগ্রভাগ এবং তীক্ষ্ণ শলাকা সদৃশ হাঁড়ের তৈরি কিছু জিনিসও এখানে পাওয়া গেছে। হাতির দাঁতের তৈরি কিছু পাশা এবং ছোট মূর্তি ও এ অঞ্চলে পাওয়া গেছে।

গুপ্তযুগেও তমলুক এবং চন্দ্রকেতুগড়ের অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল। এসময় তিলদা এবং পান্না নামক কেন্দ্রগুলিরও উদ্ভব হয়েছিল। অন্যান্য অনেক স্থান থেকেও গুপ্ত মুদ্রা পাওয়া গেছে। তিলদা এবং পান্না থেকে গুপ্ত রীতির কয়েকটি সুদৃশ্য পোড়ামাটির ফলক পাওয়া গেছে।

তমলুক ও চন্দ্রকেতুগড় ছাড়াও অন্যান্য বিভিন্ন স্থানে গুপ্ত ও পাল পরবর্তী যুগের নিদর্শনসমূহ বিদ্যমান। অন্যান্য প্রত্ন স্থলগুলির মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ চবিবশ পরগনা জেলার হরিনারায়ণপুর, দেউলপোতা, আটঘরা, বড়াল, হরোয়া, কঙ্কনদিঘি, বাসিস্হাটা, নালগোরা, হাওড়া জেলার হরিনারায়ণপুর এবং নদীয়া জেলার বামনপুর। এসকল স্থানের প্রায় সবগুলিতেই কাঠামোগত নিদর্শন পাওয়া গেছে। মা এবং শিশুর মূর্তিও পাওয়া গেছে। এছাড়া উপবিষ্ট বুদ্ধ মূর্তি সম্বলিত কিছু ফলকও পাওয়া গেছে।

পাল-সেন যুগে (নয়-বারো শতক) এ অঞ্চলের বিভিন্ন স্থান থেকে কালো শিলা দ্বারা তৈরি সূর্য, চামুন্ডা, বিষ্ণু প্রভৃতি ভাস্কর্য পাওয়া গেছে। সরিষাদহ নামক প্রত্নস্থল থেকে একটি একশিলা স্তম্ভ উদ্ধার করা হয়েছিল। দক্ষিণ চবিবশ পরগনার রায়দিঘি থেকে দিগম্বর সম্প্রদায়ের তিনজন জৈনতীর্থঙ্কর  আদিনাথ, পার্শ্বনাথ ও নেমিনাথ  এর মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে বৌদ্ধমূর্তি পাওয়া যায়। বাইশহাট এরূপ একটি স্থান। নদীয়া জেলার অনুলিয়া এবং দক্ষিণ চবিবশ পরগনা জেলার বকুলতলায় লক্ষণসেনের কয়েকটি  তাম্রলিপি পাওয়া গেছে। এ এলাকার কয়েকটি মন্দিরও এযুগে নির্মিত বলে মনে করা হয়। এগুলির মধ্যে চন্দ্রকেতুগড়ের খনা মিহিরের ঢিবি এবং দক্ষিণ চবিবশ পরগনার কঙ্কনদিঘির অতি সন্নিকটে জটার দেউল উলেখযোগ্য। জটার দেউল-এ ছিল একটি ত্রিরথ শিখর এবং একটি গর্ভগৃহ, অবশ্য এতে কোন মন্ডপ ছিল না। এগুলির আশে পাশে ভগ্নাবস্থায় আরও কয়েকটি মন্দির রয়েছে।

এখানে মধ্যযুগের শেষভাগের বেশ কিছু ইটের মন্দির স্থাপত্য দেখা যায়। এগুলির অধিকাংশই ১৭ থেকে ১৯ শতকের মধ্যে নির্মিত। এগুলি বিভিন্ন স্থাপত্য রীতিতে নির্মিত পূর্ববর্তী যুগের দেউল রীতি যেমন অব্যাহত ছিল তেমনি বাংলা, চালা, রত্ন এবং সমতল ছাদের রীতিও অনুসরণ করা হয়। প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রেই একক রীতি অনুসরণ না করে বিভিন্ন রীতির সংমিশ্রণ ঘটানো হয়েছে। মন্দিরগুলি প্রায় ক্ষেত্রেই পোড়ামাটির ফলক দ্বারা সুসজ্জিত। এগুলির অধিকাংশই বিষ্ণু মন্দির। তবে শিবমন্দির এবং কালীমন্দিরও যথেষ্ট দেখা যায়।

এভাবেই দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলি সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে আবাসনের ক্রমবর্ধমান বিস্তৃতি নির্দেশ করে। নব্য প্রস্তর যুগে অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসরে যাত্রা শুরু করে এই মনুষ্য বসতি ইতিহাসের প্রাথমিক যুগে বিস্তৃতি লাভ করে এবং মধ্যযুগের শেষ দিকে এসে অধিকতর বিস্তৃত এবং প্রাচুর্যপূর্ণ হয়ে উঠে।  [শর্মী চক্রবর্তী]

প্রত্নতাত্ত্বিক আইন কানুন ভারত উপমহাদেশে প্রাচীন কীর্তি বিষয়ক ভাবনা শুরু হয় উনিশ শতকের গোড়ার দিকে, যার প্রমাণ ১৮১০ সালের আইন যা ‘Bengal Regulation XIX’ নামে পরিচিত। পরবর্তী সময়ে প্রণীত হয়  ‘Madras Regulation VII’। উভয় আইন প্রায়োগিক দিক থেকে কেবল সরকারি ইমারতের সংরক্ষণে সীমাবদ্ধ ছিল। বেসরকারি ইমারতের রক্ষণাবেক্ষণে এই আইন দুটির কোন ভূমিকা ছিল না। পরবর্তী সময়ে ব্যক্তি মালিকানাধীন গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ও স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ইমারতের সংরক্ষণে ১৮৬৩ সালে ‘Act XX’ প্রণীত হয়। এ সকল আইনের ধারাবাহিকতায় কেবল ইমারতই নয় অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষণেও আইন প্রণয়নের কথা ভাবা হয় এবং এই ধারাবাহিকতায় ১৮৭৮ সালে ‘গুপ্তধন আইন’ (Treasure Trove Act) প্রণীত হয়। সে সময়ে প্রত্ননিদর্শন বোঝাতে অ্যান্টিকুইটি শব্দটির পরিবর্তে ট্রেজার শব্দটি ব্যবহূত হতো। তাই ট্রেজার চুরি বন্ধ ও মালিকানা নির্ধারণের জন্যই ব্রিটিশ সরকার Treasure Trove Act প্রণয়ন করে। ট্রেজার আবিষ্কার, সংগ্রহ, সংরক্ষণ, তথ্য গোপন বা লুকিয়ে ফেলার শাস্তি এবং সরকারের পক্ষে সংগ্রহের ক্ষমতা ইত্যাদি নানা বিষয় আলোচিত হয়েছিল আইনে। Treasure Trove Act অনুযায়ী যখন কোনো গুপ্তধন বা ‘প্রত্নবস্ত্ত’ পাওয়া যাবে তখন থেকে বস্ত্তটির বয়স অন্তত একশ বছর এবং মূল্য দশ রুপির বেশি হতে হবে। পরবর্তীকালে ট্রেজার ট্রোভ অ্যাক্ট’র ধারাবাহিকতায় ১৯০৪ সালে ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ স্থাপত্য নির্দশন সংরক্ষণ বিষয়ক নীতিমালা সংক্রান্ত ‘প্রাচীন ইমারত সংরক্ষণ আইন’ (Ancient Monument Preservation Act) প্রণীত হয়। আইনটিতে প্রাচীন স্থাপত্যকর্মের মালিকানা, অধিকার, অধিগ্রহণ, চুক্তি ও চুক্তিভঙ্গের শাস্তি ইত্যাদি নানা বিষয় আলোচিত হয়।

প্রত্নবস্ত্তর রপ্তানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত বিষয়ে ব্রিটিশ ভারতের সর্বশেষ সংযোজন ১৯৪৭ সালের ‘প্রত্নবস্ত্ত রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ আইন’ Antiquities Export Control Act (Act No. XXXI of 1947)। কোন নিদর্শন প্রত্নবস্ত্ত কি প্রত্নবস্ত্ত নয় এ সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব অর্পিত হয় Archaeological Survey of India এর মহাপরিচালকের হাতে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা অর্জনের পরেও ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত সেখানে পূর্ববর্তী আইনসমূহ বলবৎ ছিল। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার নতুন ‘প্রত্ননিদর্শন আইন’ (Antiquities Act) পাস করে। আইনটিতে ৩২নং ধারা বলে ১৯০৪ সালের ‘প্রাচীন ইমারত সংরক্ষণ আইন’ ও ১৯৪৭ সালের ‘প্রত্নবস্ত্ত রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ আইন’ এর কার্যকারিতা বাতিল করা হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৬ সালে পাকিস্তানে প্রণীত ‘পুরাবস্ত্ত আইন ১৯৬৮’ সংশোধন করে এবং ‘প্রত্ননিদর্শন (সংশোধন) অধ্যাদেশ’ [Atiquities (amendment) Ordinance] জারি করে। বাংলাদেশ সরকার ১৯৬৮ সালের আইনের ৩২নং ধারাটি রহিত করলে ১৯০৪ ও ১৯৪৭ সালের আইন পুনর্জীবিত হয়।

১৯৭৬ সালে ‘প্রত্ননিদর্শন (সংশোধন) অধ্যাদেশ’ এ ১৯৬৮ সালের ‘প্রত্ননিদর্শন আইন’ এর উল্লেখযোগ্য সংশোধনীসমূহ-

ক. ‘পাকিস্তান’ (১৯৬৮) এর স্থলে ‘বাংলাদেশ’।

খ. ‘কেন্দ্রীয় সরকার’ (১৯৬৮) এর স্থলে ‘সরকার’।

গ. ‘রুপি’ (১৯৬৮) এর স্থলে ‘টাকা’।

ঘ. ‘১৮৫৭ সালের পূর্বে’ এর স্থলে ‘একশ বছরের পূর্বে’।

ঙ. ‘পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের প্রত্যেক প্রদেশ থেকে একজন করে’ এর পরিবর্তে ‘বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের দুজন সদস্য’।

প্রত্ননিদর্শন আইন-১৯৬৮ এর ৩নং ধারা অনুযায়ী এই আইন কার্যকর করার জন্য একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠনের উল্লেখ ছিল। যেটির গঠন কাঠামো নিম্নরূপ-

ক. পরিচালক (বর্তমানে মহাপরিচালক), প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।

খ. দু’জন সংসদ সদস্য।

গ. তিনজন বিশেষজ্ঞ প্রত্নতত্ত্ববিদ।

আইনের ধারা-৪ এ বলা হয়েছে প্রত্ননিদর্শন সম্পর্কিত কোন প্রশ্ন কিংবা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রশ্ন উত্থাপিত হলে সরকার উপদেষ্টা কমিটির মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।

ধারা-৭ অনুযায়ী যদি কোনো স্থানে প্রত্ননিদর্শন থাকে তাহলে সেই জমি সরকার ‘জমি অধিগ্রহণ আইন-১৮৯৪’ বলে অধিগ্রহণ করতে পারবে।

ধারা-১০ অনুযায়ী সরকার যে কোনো প্রত্নকীর্তিকে সংরক্ষিত হিসেবে ঘোষণা করতে পারে। সংরক্ষিত ঘোষিত নোটিশের একটি কপি প্রত্নকীর্তির মালিককে প্রদান করা হবে এবং প্রত্নবস্ত্তটি যদি স্থাবর সম্পত্তি হয় তাহলে তা চোখে পড়ে এমন স্থানে নোটিশ হিসেবে টানিয়ে দিবে। প্রাচীন কীর্তিস্তম্ভকে সংরক্ষিত স্থাপত্য হিসেবে ‘প্রাচীন ইমারত সংরক্ষণ আইন- ১৯০৪’ অনুযায়ী সংরক্ষণ করতে হবে।

ধারা-১৬ এ সংরক্ষিত স্থাবর প্রত্ননিদর্শন অধিগ্রহণ সম্বন্ধে বলা হয়েছে-যদি প্রশাসন মনে করে কোনো প্রত্নবস্ত্ত হুমকির সম্মুখীন বা ধবংসের সম্মুখীন, তবে প্রশাসন উপদেষ্টা কমিটির সঙ্গে আলোচনাপূর্বক প্রত্নকীর্তিটির অধিকার সংরক্ষণ করতে পারবে। এটি ভূমি অধিগ্রহণ আইন-১৮৯৪ এর আওতায় সম্পন্ন হতে পারে। তবে, পুরাকীর্তি বা পুরাকীর্তির অংশ ধর্মীয় প্রয়োজনে সাময়িকভাবে ব্যবহূত হলে, সে ক্ষেত্রে এ ধারা প্রযোজ্য হবে না। উল্লেখযোগ্য যে, ধর্মীয় প্রয়োজনে ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনেক সময় স্থাপত্যকর্মটির পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা হয়ে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরানো নিদর্শন ভেঙ্গে নতুন স্থাপনা তৈরি করা হয়। যেমনটি করা হয়েছে পুরানো ঢাকার ঐতিহাসিক চুড়িহাট্টা মসজিদের ক্ষেত্রে।

ধারা-১৯ অনুযায়ী যে সকল প্রত্নকীর্তি সংরক্ষিত হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, সেসকল প্রত্নকীর্তির ধ্বংস সাধন, ক্ষতি বা পরিবর্তন সাধন কিংবা এগুলোর উপর কোনো কিছু লেখা বা খোদাই করা যাবে না। যদি করে তাহলে এক বছর পর্যন্ত জেল বা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু যে সকল প্রত্নকীর্তিকে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়নি সেক্ষেত্রে কোনো দিক নির্দেশনা নেই। তাছাড়া এই আইন লঙ্ঘনে কোনো শাস্তির বিধানের কথাও জানা যায় না।

ধারা-২০ অনুযায়ী যদি কোনো ব্যক্তি কোনো প্রত্নবস্ত্ত জাল বা অনুকপি তৈরি করে অর্থাৎ নকল করে অথবা প্রত্নবস্ত্তর অন্যায় ব্যবহার করে তাহলে তার বা তাদের ছয় মাস পর্যন্ত জেল অথবা জরিমানা অথবা উভয়ই দন্ডই হতে পারে।

ধারা-২১ অনুযায়ী পরিচালকের অনুমতি পত্র (লাইসেন্স) ব্যতিত কোন ব্যক্তি প্রত্নবস্ত্ত কেনা-বেচা করতে পারবে না। এই ধারায় পুরাকীর্তি ব্যবসায়ীকে একটি রেজিস্ট্রার সংরক্ষণ করতে বলা হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে রেজিস্ট্রারে কিভাবে তথ্য সংরক্ষণ করতে হবে বা ছবি সংরক্ষণের বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ নেই।

ধারা-২২ এর উপধারা-১ এ প্রত্ননিদর্শন রপ্তানির নিয়মাবলী উল্লেখ করা হয়েছে। পরিচালকের অনুমতি পত্র (লাইসেন্স) ব্যতিত কোন প্রকার প্রত্ননিদর্শন বিদেশে রপ্তানি নিষিদ্ধ। এ সকল ক্ষেত্রে প্রদর্শন, পরীক্ষণ অথবা ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে সংরক্ষণের জন্য রপ্তানি, কিংবা কোনো পক্ষের সাথে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান এবং উৎখনন চুক্তির কোনো ধারা বলে রপ্তানি কিংবা বিদেশি রাষ্ট্রের সাথে অনন্য নয় এমন প্রত্ননিদর্শন বিনিময়ের জন্য রপ্তানি হতে পারে।

উপধারা-২ অনুসারে উপধারা- ১ এর অধীনে যেসব প্রত্নবস্ত্ত রপ্তানি করা নিষিদ্ধ সেগুলো সমুদ্র আবগারী আইন- ১৮৭৮ এর ধারা- ১৯ অনুযায়ীও নিষিদ্ধ বলে বিবেচিত হবে এবং এই আইনের কোন শর্ত লঙ্ঘন করা হলে সকল নিদর্শন বাজেয়াপ্ত করা হবে।

ধারা-২৫ অনুযায়ী প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পরিচালকের লাইসেন্স ছাড়া যে কোনো প্রকারের প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কেউ এ ধারা লঙ্ঘন করলে এক বছর পর্যন্ত কারাদন্ড অথবা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে পারেন।

ধারা- ২৮ অনুযায়ী যদি কোনো কর্মকর্তা বা সরকার কতৃক ক্ষমতা প্রাপ্ত ব্যক্তি কারো বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ না করেন তবে প্রত্নতাত্ত্বিক আইন বলে কাউকে কোনো প্রকার শান্তি দেয়া যাবে না। এক্ষেত্রে দেশের প্রত্নসম্পদ রক্ষার্থে সাধারণ কোনো নাগরিকের আইনের আশ্রয় নেয়ার  সুযোগ রাখা হয়নি।

ধারা-৩২ এ ১৯০৪ সালের প্রাচীন ইমারত সংরক্ষণ আইন এবং ১৯৪৭ প্রত্নবস্ত্ত রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ আইন বাতিল করা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৬ সালের প্রত্ননিদর্শন (সংশোধন) অধ্যাদেশ বলে এই ধারাটি রহিত করার কারণে উল্লিখিত আইন দু’টি পুনরায় কার্যকর হয়।  [মোকাম্মেল এইচ ভূঁইয়া]