পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৮:২৪, ৮ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০  এই আইনে পূর্ববাংলায় জমিতে খাজনা সংগ্রাহক ও অন্যান্য স্বার্থধারীদের তালুক অধিগ্রহণের বিধান, তালুকে প্রজাদের সঙ্গে সম্পর্ক এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত আরও অন্যান্য বিষয়ের আইনগত সম্পর্ক সংজ্ঞায়িত করার বিধান রয়েছে। আইনটি পাশের আগে এদেশের কৃষিসংক্রান্ত আইন বলতে প্রধানত ছিল ১৭৯৩ সালের বঙ্গীয় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবিধান ও বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন, ১৮৮৫। বঙ্গীয় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবিধান সরকারকে নির্ধারিত অঙ্কের রাজস্ব নিয়মিত পরিশোধের শর্তে জমিদারদেরকে জমির মালিক করে দেয় আর তার সঙ্গে তারা তাদের অধীন বন্দোবস্তধারীদের কাছ থেকে খাজনা আদায়েরও অধিকারী হয়। শেষোক্ত পক্ষ আবার জমিতে তাদের অধস্তন স্বার্থধারী সৃষ্টি করার অধিকারী হয়। ১৭৯৩ সালের বঙ্গীয় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবিধান একশ্রেণির জমিমালিক অভিজাত গোষ্ঠীর জন্ম দেয়। এদের সম্পর্কে ব্রিটিশদের প্রত্যাশা ছিল যে, এরপর তারা ব্রিটিশ শাসক কর্তৃপক্ষের অনুগত থাকবে। এছাড়া বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন ঊর্ধ্বতন ভূমি মালিকদের সঙ্গে প্রজা বা রায়তের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অধিকার ও দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করে।

সময়ের বিবর্তনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উপযোগিতা ফুরিয়ে গেলে ভূমি সংস্কারের দাবি ওঠে। এর পরিণামে ১৯৩৮ সালে স্যার ফ্রান্সিস ফ্লাউডের সভাপতিত্বে এক উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ভূমিসংস্কার কমিশন গঠিত হয়। আরোপিত অন্যান্য দায়িত্বের সঙ্গে স্যার ফ্রান্সিস ফ্লাউডের অন্যতম কাজ ছিল প্রকৃত জমি-চাষিকে সরাসরি সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত করার জন্য জমিতে সকল ঊর্ধ্বতন স্বার্থধারীর স্বার্থ অধিগ্রহণ বাস্তব অর্থে সরকারের জন্য বাঞ্ছনীয় হবে কি-না সে সম্পর্কে সরকারের কাছে প্রতিবেদন পেশ করা। সরকার ভূমি রাজস্ব কমিশনের সুপারিশ বিবেচনায় আনে এবং বাস্তবায়নের জন্য ১৯৪৭ সালের ১০ এপ্রিল ব্যবস্থাপক পরিষদে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন উত্থাপন করে। তবে ভারত বিভাগের কারণে এ বিষয়ে আর কোন অগ্রগতি হয় নি। দেশ বিভাগের পর পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব বিল প্রণয়ন করে ১৯৪৮ সালের ৩১ মার্চ তা প্রকাশ করা হয়। তারপর এই বিলটিকে আইন পরিষদের বিশেষ কমিটিতে পাঠানো হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিলটি পাস হওয়ার পর ১৬ মে ১৯৫১ সালে বিলে প্রয়োজনীয় অনুমোদনমূলক সম্মতি পাওয়া যায়।

এই আইনের আওতায় সরকার দেশের একমাত্র জমিদারে পরিণত হয় এবং সরকার পর্যায়ক্রমে জমিতে সকল খাজনা-আদায়ি স্বার্থ অধিগ্রহণ করে। এই আইনের ৩ নং ধারা বলবৎ হওয়ায় জমির সকল মালিক সরকারের প্রত্যক্ষ প্রজায় পরিণত হয়। তাদেরকে মালিক বলে অভিহিত করা হয়। তবে ভূ-অভ্যন্তরস্থ খনি এবং হাটবাজার, বনভূমি, মৎস্য এলাকা ও ফেরিঘাটের মালিকানা সরকারে বর্তায়। এই আইনবলে সরকার হাটবাজার, ফেরি ও মাছ উৎপাদনমূলক জলভাগের মালিক ও ব্যবস্থাপক হয়।

এই আইনে ১৫২টি ধারা রয়েছে। এগুলি পাঁচটি অংশ ও উনিশটি অধ্যায়ে বিভক্ত। অধ্যায় ১-এ রয়েছে বিশেষ বিশেষ খাজনা গ্রাহকদের স্বার্থ অধিগ্রহণের বিশেষ বিধান। এসব বিধানবলে সরকার সকল খাজনা-গ্রাহক স্বার্থ অধিগ্রহণের অধিকারী হয়। অধ্যায় ২-এ ক্ষতিপূরণ নিরূপণ, জমাবন্দি ও খতিয়ান অধিগ্রহণের বিকল্প পদ্ধতি সম্পর্কিত বিষয় রয়েছে। এ বিষয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অংশে এসব বলবৎ হয়। অধ্যায় ৩-এ চাকরি বা সেবা প্রদানের বিনিময়ে জমিতে ভোগদখল থাকার বিধিবিধান রয়েছে। অধ্যায় ৪-এ জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের বিধানসমূহের বলবৎ হওয়া ও জমি হস্তান্তর বা উত্তরাধিকারের কারণজনিত পরিবর্তন সংযুক্ত করে খতিয়ান তৈরির বিষয় সন্নিবেশিত রয়েছে। অধ্যায় ৫-এ ক্ষতিপূরণ, জমাবন্দি অধিগ্রহণ এবং জমাজমির দলিলপত্র সম্পাদনের বিকল্প পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে। অধ্যায় ৭-এ ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ, জমাবন্দি সংশোধন এবং ক্ষতিপূরণ প্রশ্নে বিবাদ-বিরোধ সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া সন্নিবেশিত রয়েছে। অধ্যায় ৮-এ ক্ষতিপূরণ প্রদানের পদ্ধতি বর্ণিত রয়েছে। অধ্যায় ৯-এ আছে বকেয়া রাজস্ব, খাজনা ও উপকর সম্পর্কিত বিধান। অধ্যায় ১০-এ ঋণগ্রস্ত খাজনাগ্রাহক সম্পর্কিত বিধানসমূহ রয়েছে। অধ্যায় ১১-তে রয়েছে সরকারি জমির বন্দোবস্ত ও বিবিধ বিষয় সম্পর্কিত আইন। অধ্যায় ১২-তে রয়েছে আইনের পঞ্চম অধ্যায় বাস্তবায়নের ফলে বিভিন্ন এলাকায় উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কিত বিষয়। অধ্যায় ১৩-তে রায়তের জোত-এর আপতন, শিকস্তি জমি, ক্রয় অগ্রাধিকার, আদিবাসীদের জমি হস্তান্তরের বিধিনিষেধ ইত্যাদির বর্ণনা রয়েছে। অধ্যায় ১৪-তে রয়েছে খাজনা নিরূপণ, বৃদ্ধি ও হ্রাস সংক্রান্ত বিধানসমূহ। অধ্যায় ১৫-তে রয়েছে জোত একত্রীকরণ, বিভাজন ও সংহতকরণ সম্পর্কিত বিধিবিধান। অধ্যায় ১৬-তে সন্নিবিষ্ট রয়েছে খাজনা ও খাজনা আদায় সম্পর্কিত বিভিন্ন বিধান। খতিয়ান রেকর্ড সংরক্ষণ ও সংশোধন পদ্ধতি সম্পর্কিত বিষয় রয়েছে অধ্যায় ১৭-তে। অধ্যায় ১৮-তে এখতিয়ার, আপিল, সংশোধন ও পুনর্বিবেচনা সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং উপাসনাস্থল, গোরস্তান, শ্মশান ইত্যাদি ও অন্যান্য জমির খাজনা অব্যাহতির বিশেষ বিধানাবলি উল্লেখ করা হয়েছে। অধ্যায় ১৯-এ রয়েছে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা সম্পর্কিত বিষয়।

জমিদারি অধিগ্রহণ আইন প্রবর্তনের ফলে সরকার ও রায়ত প্রজার মধ্যে জমিতে মধ্যবর্তী স্বার্থের অস্তিত্ব অবলুপ্ত হয়। সরকারই হয়ে ওঠে একমাত্র জমিদার। চাষিরা জমিতে উপসামন্তায়নের তথা আরও মধ্যস্থ সৃষ্টির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা পায়। এদেশে চাকরিভিত্তিক যে জমি বন্দোবস্ত প্রথা বিশেষ করে, সিলেট জেলায় প্রচলিত ছিল তা বিলুপ্ত করা হয়। জমিদার ও জমিতে মধ্যবর্তী স্বার্থধারীদের খাজনা আদায়-স্বার্থ অধিগ্রহণের কাজটি তাদেরকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের এক পরিকল্পনার আওতায় এনে সম্পন্ন করা হয়। প্রথম দিকে জোতের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করা ছিল ১৩.৪৮ হেক্টর, পরে সেটি আরও তিনগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। তবে পরবর্তীকালে আইনে আরও সংশোধনীর মাধ্যমে এই সর্বোচ্চ সীমা কমিয়ে পরিবার-প্রতি জোত ধারণের পরিমাণ ৮.৭৯ হেক্টরে নির্ধারণ করা হয়। আইনে জমিদারিপ্রথা বিলুপ্ত হলেও এক সোপানক্রমিক বিন্যাসের কিছু রাজস্ব কর্মকর্তা তার স্থলবর্তী হয়, আর এসব কর্মকর্তার ঊর্ধ্বতন সংস্থা হিসেবে থাকে ভূমি প্রশাসন বোর্ড। এ বোর্ডের নিম্নস্তরের কর্মকর্তাকে বর্তমানে সহকারী কমিশনার (ভূমি) বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। আর জেলা পর্যায়ের রাজস্ব প্রশাসনে প্রধান হিসেবে থাকেন কালেক্টর ও ডেপুটি কমিশনার। তাকে সাহায্য করেন অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার (রাজস্ব), ডেপুটি কালেক্টর রাজস্ব ও বেশ কিছুসংখ্যক তহসিলদার, কানুনগো ও সার্ভেয়র।

এই আইন পাস হওয়ার পর তাৎক্ষণিক নতুন বিধান মেনে নিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারী জমিদার ও অন্যান্য জোতমালিক মামলা রুজু করেন। আর এজন্য সরকারকে রায়ত (যারা পরবর্তীকালে মালিক নামে স্বীকৃত) ও সরকারের মধ্যে মধ্যস্থ ভূমি স্বার্থধারীরদের অপসারণের জন্য আইনে বহুসংখ্যক সংশোধনী আনতে হয়।

বাংলাদেশ বদ্বীপ ও অসংখ্য নদীবিধৌত অঞ্চল বিধায় এখানে নতুন ভূমি গঠন ও পুরানো ভূমির পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ার কারণে এই বিষয়গুলিও আইনটির আওতায় এসেছে। আগে কোন জোত কোন সরকারি নাব্য নদীর পলির কারণে আয়তনে বাড়লে তাতে ঐ জোতধারীর জমির পরিমাণ বেড়ে যেত। এছাড়া, কোন পুরানো জোত ভেঙ্গে আবার তা ২০ বছরের মধ্যে পুনর্গঠিত হলে সে জমিও হতো পুরানো বন্দোবস্তধারীর। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এ ধরনের জমির আয়তন বৃদ্ধিতে সেসব বর্ধিত জমি বর্তায় সরকারে। কোন প্রজা/রায়তের জমি ভাঙ্গন বা অনুরূপ কোন কারণে কমে গেলে ঐ রায়ত বা মালিক তার প্রদেয় খাজনার বেলায় রেয়াত লাভের অধিকারী হয়। আর যদি ৩০ বছরের মধ্যে পুরানো লুপ্ত জমি পুনর্গঠিত হয় তাহলে সেই জমিতে মালিকানা লাভের ক্ষেত্রে তার পুরানো রায়তকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হবে এই শর্তে যে, পুনঃবন্দোবস্ত দেওয়া হলে যে জমি প্রাপ্য হয় তা আইনানুগ সিলিং বা মালিকানাধীন জমির মোট আয়তনের সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করবে না। অবশ্য, এই আইনের আওতায় কেবল ভূমিহীন চাষিরাই জমির আয়তন বৃদ্ধি বা অন্যভাবে সৃষ্ট সরকারি খাসজমি বন্দোবস্ত পাওয়ার অধিকারী।

জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের আওতায় প্রতিটি রায়ত বা জমি মালিকের নামে সরাসরি সরকারের আওতায় খতিয়ান তৈরি করা হয়েছে। উক্ত আইনে জমি হস্তান্তর, উত্তরাধিকার ও সরকারের তরফ থেকে বন্দোবস্ত দানের কারণে জমির নতুন অধিকারীদের নাম খতিয়ানে হালনাগাদ করার একটি প্রক্রিয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে।

এই আইন কোন নিরবচ্ছিন্ন জোতের সহ-মালিক যাতে ঐ জমির কোন অংশ কোন বহিরাগত ব্যক্তির কাছে হস্তান্তরের ক্ষেত্রে সেই জমি ক্রয়ে অগ্রাধিকার পান তার ব্যবস্থাও রয়েছে। এই ক্রয় অগ্রাধিকারের বিধান সাধারণ আইনের অংশ হিসেবে এ দেশে কৃষিজমি প্রজাস্বত্ব সম্পর্কিত ১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনে প্রথম প্রবর্তন করা হয়। অবশ্য, কৃষি-বহির্ভূত প্রজাস্বত্ব বা বন্দোবস্তের ক্ষেত্রে ক্রয় অগ্রাধিকারের বিষয়টি অ-কৃষি প্রজাস্বত্ব আইনগত বিধানের অধীন।

এই আইনে জমির সরেজমিনে মেয়াদি জরিপের এবং এ ধরনের মেয়াদি বন্দোবস্তি কার্যক্রমের মাধ্যমে খতিয়ান হালনাগাদ করার বিধান রয়েছে। উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে এই আইনের কোন প্রয়োগ নেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আয়তন দেশের মোট আয়তনের এক-দশমাংশ। এ অঞ্চলের ভূমি ব্যবস্থা ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রবিধান, পরবর্তীকালে সংশোধিত আইনসমূহ এবং ৩০ নভেম্বর ১৯৫৫ তারিখের সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই আইনের আওতায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আদিবাসীদের জমি হস্তান্তরের ওপরও বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। বিধান অনুযায়ী, একজন আদিবাসী আরেকজন আদিবাসীর কাছে তার ভূ-সম্পত্তি ইচ্ছানুযায়ী হস্তান্তর করতে পারলেও রাজস্ব কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া আদিবাসী নয় এমন কারও কাছে সে তার সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারে না।  [আবদুল কাইয়ুম]