পুরাণ

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২২:১২, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

পুরাণ ইতিহাস, আখ্যান-উপাখ্যান, ধর্মীয় বিধিবিধান ইত্যাদি সম্বলিত এক শ্রেণীর মিশ্র সাহিত্য। সাধারণ মানুষের গল্পরস আস্বাদনের আকাঙ্ক্ষা থেকে এর উৎপত্তি। উপনিষদের যুগে উচ্চমার্গের দার্শনিক তত্ত্ব যখন শ্রেণীবিশেষের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে, তখন গণমানুষের চাহিদা মেটাতে গল্পের ঢঙে সহজ-সরল ভাষায় রচিত হয় প্রধানত কাহিনীমূলক এই পুরাণ সাহিত্য। সাহিত্যরসের সঙ্গে যাতে ধর্মলাভও হয় সেজন্য ধর্মীয় বিষয়াদিও এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়।

পুরাণের সাধারণ লক্ষণ পাঁচটি: সর্গ, প্রতিসর্গ, বংশ, মন্বন্তর এবং বংশানুচরিত। এর মধ্য দিয়ে পুরাণের আলোচ্য বিষয়ও প্রতিফলিত হয়েছে। সর্গের আলোচ্য বিষয় সৃষ্টিতত্ত্ব। গল্পচ্ছলে এখানে বিশ্বসৃষ্টির কারণ ও পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে। প্রতিসর্গের বিষয় ধ্বংসের পর নতুন বিশ্বসৃষ্টি। সৃষ্টিমাত্রেরই যেমন ধ্বংস অনিবার্য, তেমনি প্রলয়ের পর নবসৃষ্টিও অপরিহার্য। প্রতিবার ধ্বংসের পর এই নবসৃষ্টির নির্মাতা হলেন প্রজাপতি  ব্রহ্মা। বংশে থাকে দেবতা ও ঋষিদের বংশতালিকা। প্রাচীনতম ঋষি ও দেববংশ থেকে শুরু করে মধ্যপর্বে মনুবংশ এবং শেষাংশে ঐতিহাসিক রাজবংশের বর্ণনা এতে পাওয়া যায়। মন্বন্তরের আলোচ্য বিষয় মনুর বংশ। প্রতিবার ধ্বংসের পর যখন নতুন সৃষ্টি হয় তখন একজন আদি পুরুষের জন্ম হয়। তিনিই মনু এবং তাঁর থেকে ক্রমান্বয়ে মানব সমাজের উদ্ভব ঘটে। এক মনু থেকে অন্য মনুর কালকে বলে মন্বন্তর। এযাবৎ চৌদ্দজন মনুর আবির্ভাব ঘটেছে। বংশানুচরিত সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য অংশ। এখানে দেবতা, ঋষি বা খ্যাতিমান রাজাদের কহিনী বর্ণিত হয়। মহৎ ব্যক্তিদের জীবনের উত্থান-পতন দেখিয়ে মানব জীবনের শ্রেয়পথের নির্দেশ দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত দুই রাজবংশ চন্দ্রবংশ ও সূর্যবংশের কীর্তিমান রাজাদের কাহিনী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পুরাণের লক্ষণাক্রান্ত এই প্রধান পাঁচটি বিষয় ছাড়াও এতে রয়েছে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক বিধিবিধান (যেমন: বর্ণাশ্রম ধর্ম, শ্রাদ্ধ, প্রায়শ্চিত্ত, দান, পূজা, দীক্ষা ইত্যাদি),  জ্যোতিষছন্দ, কৃষিকাজ, পশুপালন, বাণিজ্য,  আয়ুর্বেদব্যাকরণ, ভূগোল, অস্ত্রবিদ্যা ইত্যাদি বিষয়। প্রাচীন রাজবংশের পাশাপাশি রয়েছে আধুনিক রাজবংশের বর্ণনা (যেমন: নন্দবংশ, মৌর্যবংশ, শূঙ্গবংশ, আন্ধ্রবংশ, গুপ্তবংশ ইত্যাদি)। বিষ্ণুপুরাণ, বায়ুপুরাণ ও মৎস্যপুরাণে যথাক্রমে মৌর্য (৩২৬-১৮৫ খ্রি.পূ), গুপ্ত (৩২০-৩৫৭) এবং আন্ধ্রবংশের নির্ভরযোগ্য ইতিহাস পাওয়া যায়। এর পাশাপাশি আভীর, শক, যবন, হূণ প্রভৃতি রাজবংশের কথাও জানা যায়।

পুরাণগুলি দুই ভাগে বিভক্ত মহাপুরাণ ও উপপুরাণ। মহাপুরাণ ১৮ খানা এবং উপপুরাণও ১৮ খানা, মোট ছত্রিশ খানা। সেগুলি হচ্ছে: মহাপুরাণ ব্রহ্ম, পদ্ম, বিষ্ণু, শিব বা বায়ু, ভাগবত, নারদ, মার্কন্ডেয়, অগ্নি, ভবিষ্য বা ভবিষ্যৎ, ব্রহ্মবৈবর্ত, লিঙ্গ, বরাহ, স্কন্দ, বামন, কূর্ম, মৎস্য, গরুড় ও ব্রহ্মান্ড এবং উপপুরাণ সনৎকুমারসংহিতা, নরসিংহ, বায়ু, শিবধর্ম, আশ্চর্য, নারদ, নন্দিকেশ্বর, উশনস্, কপিল, বরুণ, শাম্ব, কালিকা, মহেশ্বর, কলিঙ্গ, দেবী, পরাশর, মারীচ ও ভাস্কর বা সূর্য। মহাপুরাণগুলি কালের বিচারে প্রাচীনতম এবং এগুলির প্রামাণিকতাও অধিক। এছাড়া দুই প্রকার পুরাণের মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। ভারতীয় ঐতিহ্য অনুসারে ব্যাসদেবকে পুরাণগুলির রচয়িতা বলা হয়, যদিও মৎস্যপুরাণ অনুসারে ব্যাসদেব রচনা করেন অষ্টাদশ মহাপুরাণ এবং সেগুলির ভাবানুসারে পরবর্তীকালে মহাপুরাণগুলির পরিপূরক হিসেবে রচিত হয় অষ্টাদশ উপপুরাণ। পুরাণগুলির সবই  সংস্কৃত ভাষায় রচিত।

পুরাণগুলি সব এক সঙ্গে রচিত হয়নি। গবেষকদের মতে প্রাচীন কয়েকটি পুরাণ খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ/৫ম শতকের পূর্বেই রচিত হয়েছে এবং অবশিষ্টগুলির রচনা খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের মধ্যে সমাপ্ত হয়েছে। সংস্কৃত পুরাণের অনুকরণে মধ্যযুগে বাংলা ভাষায় কয়েকটি পুরাণগ্রন্থ রচিত হয়, যেমন: হাকন্দপুরাণ (=ধর্মমঙ্গল), পদ্মাপুরাণ (নারায়ণদেব) ইত্যাদি। পরবর্তীকালের বাংলা মঙ্গলকাব্যগুলিও পুরাণশ্রেণীর রচনা।

পৌরাণিক যুগে সনাতন ধর্মের মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হতে দেখা যায়। তখন বৈদিক ধর্ম ও দর্শনকে লোকায়ত চেতনার উপযোগী ও সাধারণের সহজবোধ্য করার চেষ্টা করা হয়। বৈদিক আর্যদের প্রধান ধর্মানুষ্ঠান ছিল দুশ্চর যজ্ঞকেন্দ্রিক, কিন্তু পুরাণের যুগে তাকে সহজসাধ্য পূজা-পার্বণ ও ব্রতকেন্দ্রিক করা হয়। পুরাণে দেবদেবীর মানবায়ন প্রবণতা লক্ষ করা যায়। দেবদেবীর ওপর মানবীয় দোষগুণ এবং মানুষের ওপর দেবদেবীর গুণাবলি আরোপের চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। এতে সাধারণ মানুষ দেবতাদের সঙ্গে নিজেদের দূরত্ব ভুলে দেবতার আদর্শ নিজের জীবনে অনুসরণের প্রেরণা লাভ করে। শুধু তাই নয়, বৈদিক যুগে দেবদেবীকে যেখানে বিবিধ ভাব ও অমূর্ত শক্তির প্রতীকরূপে গ্রহণ করা হয়েছে এবং প্রতীকটি মূলভাবকে লাভ করার উপায়মাত্র হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে, সেখানে পুরাণে দেবদেবীকেই মূল মনে করা হয়েছে এবং তার মূর্তি কল্পনা ও তা নির্মাণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। হিন্দুধর্মে পৌত্তলিকতার বীজ এই পুরাণেই নিহিত। বৈদিক  অগ্নি, বরুণ, সূর্য প্রভৃতি দেবতার স্থলে  চন্ডী, দুর্গা,  গণেশ ইত্যাদি পৌরাণিক দেবতার উদ্ভবও এ সময়। পুরাণে মূর্তি নির্মাণের উপাদান, বিভিন্ন দেবদেবীর পূজার সময় ও উপকরণ ইত্যাদি গুরুত্বের সঙ্গে বর্ণিত হয়েছে। এভাবে ক্রমশ হিন্দু সমাজে বৈদিক দেবতাদের গুরুত্ব হ্রাস পেয়েছে এবং পৌরাণিক দেবতাদের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি প্রতিটি পুরাণ রচিত হয়েছে একেকজন দেবতার পূজা প্রচলন, মাহাত্ম্য প্রচার ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে।

এর পেছনে অবশ্য একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণও ছিল। ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উত্থান এবং আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের (খ্রি.পূ ৩২৬) ফলে হিন্দুধর্ম বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। মৌর্য সম্রাট অশোকের (খ্রি.পূ ৩য়) সময় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক প্রসার ও প্রভাবে ব্রাহ্মণ্য  হিন্দুধর্ম আরও বিপন্ন হয়ে পড়ে। তাই হিন্দু সমাজপতিরা চেষ্টা করেন হিন্দু সমাজকে ধর্মীয় আচার-আচরণের কঠোর নিয়মবন্ধনে আবদ্ধ করতে, যাতে অন্য ধর্মের প্রভাবে হিন্দুরা স্বধর্মভ্রষ্ট না হয়। আরো চেষ্টা করেন গল্পকাহিনীর মাধ্যমে হিন্দুধর্মের তত্ত্বকথা সহজভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে। গল্পকথার প্রাধান্য রেখে আচার-অনুষ্ঠান-প্রধান ধর্মের বিধান দিয়ে তাই তাঁরা রচনা করেন বিরাট পৌরাণিক সাহিত্য। আর এই বিধানগুলিই পরবর্তীকালে হিন্দুধর্মের গুরুত্বপূর্ণ আদর্শ হয়ে দাঁড়ায়।

বাংলাদেশে পুরাণের পঠন-পাঠন ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। গৌড়ীয় বৈষ্ণবসমাজে বৈষ্ণব পুরাণগুলির, বিশেষত ব্রহ্মবৈবর্ত ও ভাগবত পুরাণের গভীর প্রভাব ছিল। এই পুরাণদুটি অবলম্বনে বৈষ্ণবদের জীবন ও দর্শন গড়ে ওঠে। কয়েকটি পুরাণ বাংলাদেশে রচিত হয়েছে বলেও অনুমান করা হয়, সেগুলি: দেবীভাগবত (৫ম-৬ষ্ঠ শতক), দেবীপুরাণ (আনু. ৭ম শতক), সনৎকুমারসংহিতা (আনু. ৮ম শতক), বৃহন্নারদীয়পুরাণ (আনু. ৭৫০-৯০০), লঘুভাগবতপুরাণ (আনু. ৮০০-১০০০), ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ (আনু. ৮ম শতক), পদ্মপুরাণ (৮ম-১৪শ শতক), ক্রিয়াযোগসার (৯ম-১০ম শতক), আঙ্গিরসপুরাণ (৯০০-১০০০), কালিকাপুরাণ (আনু. ১০ম-১১শ), বৃহদ্ধর্মপুরাণ (আনু. ১৩শ শতক), মহাভাগবতপুরাণ (আনু. ১৩শ-১৪শ শতক), বৃহন্নন্দিকেশ্বরপুরাণ (আনু. ১৪শ শতক), নন্দিকেশ্বরপুরাণ (আনু. ১৪শ শতক), কল্কিপুরাণ (১৭শ শতক), পুরাণসর্বস্ব (১৪৭৪), পুরাণসার (১৭শ), পুরাণার্থপ্রকাশক প্রভৃতি। এগুলির মধ্যে কয়েকটি উপরে উল্লিখিত ছত্রিশ প্রকার পুরাণের মধ্যে উল্লিখিত হয়নি। শেষের তিনটি সংকলন গ্রন্থ।  গৌড় দরবারের জনৈক কর্মকর্তা কুলধরের নির্দেশে গোবর্ধন পাঠক প্রথমটি সংকলন করেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয়টি সংকলন করেন যথাক্রমে নদীয়ার রাজা রুদ্র রায় এবং রাধাকান্ত তর্কবাগীশ। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের আদি রূপটি অষ্টম শতকের বলে মনে করা হয়। দশম শতক থেকে বাঙালিদের হাতে এর নবরূপায়ণ শুরু হয় এবং ষোড়শ শতকে তা বর্তমান রূপ লাভ করে।

এসব পুরাণের অধিকাংশ  পুথি বাংলা লিপিতে লেখা এবং বাংলাদেশেই পাওয়া গেছে। তাছাড়া বাংলাদেশে এগুলির চর্চাও হয়েছে প্রচুর। এ পুরাণগুলিতে প্রাচীন  বঙ্গ সম্পর্কে অনেক তথ্য আছে। বৃহদ্ধর্মপুরাণে বাঙালিদের ছত্রিশ প্রকার সঙ্কর জাতি; রায়, দাস, দেবশর্মা ইত্যাদি উপাধি, শারদীয়া দুর্গাপূজার বিশেষ বর্ণনা, মৎস্য ভক্ষণের বিধান, মালসী ও চৌতিশা নামক লোকগীতি ইত্যাদির উল্লেখ আছে। বৃহন্নন্দিকেশ্বর ও নন্দিকেশ্বর পুরাণোক্ত  দুর্গাপূজা পদ্ধতি কেবল বাংলাদেশেই প্রচলিত। মহাভাগবতপুরাণে ভাগীরথী ও পদ্মার বিস্তারিত বর্ণনা আছে। এমনিভাবে দেখা যায় উপরে উল্লিখিত অনেক পুরাণের সঙ্গেই প্রাচীন বাংলার বিশেষ সম্পর্ক ছিল।

বিভিন্ন পুরাণের ওপর বাঙালি রচিত অনেক ব্যাখ্যাগ্রন্থও আছে। সেগুলি পুরাণ অধ্যয়নের ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। আধুনিককালে পুরাণচর্চার ক্ষেত্রে মহামহোপাধ্যায় পঞ্চানন তর্করত্নের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি বঙ্গানুবাদসহ অধিকাংশ পুরাণ প্রকাশ করে বাঙালির পুরাণচর্চার পথ সুগম করেন। পুরাণে বিধৃত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নিকট অতীতে উভয় বঙ্গে প্রচুর গবেষণা হয়েছে। এক্ষেত্রে রাজেন্দ্রচন্দ্র হাজরার The Puranic Records on Hindu Rites and Customs (১৯৪০) গ্রন্থটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বর্তমানেও উচ্চতর গবেষণা চলছে।  [দুলাল ভৌমিক]