পার্বত্য চট্টগ্রাম

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৫:৫৭, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

পার্বত্য চট্টগ্রাম (Chittagong Hill Tracts)  দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাপক পাহাড়ি অঞ্চল (২১°২৫´ উত্তর অক্ষাংশ থেকে ২৩°৪৫´ উত্তর অক্ষাংশ ও ৯১°৫৪´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ থেকে ৯২°৫০´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ)। এর দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে মায়ানমার, উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, পূর্বে মিজোরাম এবং পশ্চিমে চট্টগ্রাম জেলা অবস্থিত। পার্বত্য চট্টগ্রামের এলাকা প্রায় ২৩,১৮৪ বর্গ কিমি যা বাংলাদেশের মোট এলাকার প্রায় এক দশমাংশ।

ইতিহাস  বঙ্গের প্রথম প্রকাশিত মানচিত্রে ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে এই অঞ্চলের উল্লেখ রয়েছে। অবশ্য এর অনেক আগে ৯৫৩ সালে আরাকানের এক রাজা পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান জেলাসমূহ ও চট্টগ্রাম দখল করেন। পরবর্তীতে ১২৪০ সালে ত্রিপুরার রাজা এই অঞ্চল দখল করেন। আরাকানের রাজা ১৫৭৫ সালে জেলাগুলো পুনরায় দখল করে নেন এবং ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত দখল বজায় রাখেন। প্রকৃত প্রস্তাবে পার্বত্য ত্রিপুরা ও আরাকানের শাসকদের মধ্যেই এই অঞ্চলের মালিকানার দ্রুত হাতবদল হতে থাকে।  মুগলরা ১৬৬৬ থেকে ১৭৬০ সাল পর্যন্ত অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রণ করে। ১৭৬০ সালে এলাকাটির কর্তৃত্ব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হস্তগত হয়। ব্রিটিশরা ১৮৬০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম দখল করে একে ব্রিটিশ ভারতের অংশে পরিণত করে। তারা এর নামকরণ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম (চিটাগাং হিল ট্র্যাক্টস)। ব্রিটিশরা পার্বত্য  চট্টগ্রামকে চট্টগ্রামের সম্প্রসারিত অংশ হিসেবে নথিভুক্ত করে। দক্ষিণের পাহাড় পার্বত্য আরাকান ও উত্তরের পাহাড় পার্বত্য ত্রিপুরা রূপে পরিচিত হয়। প্রশাসনিকভাবে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামকে বঙ্গ প্রদেশের অধীনে নিয়ে আসে। ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিধিতে হেডম্যান ও প্রধানদের নেতৃত্বে কর আদায়ের একটি স্থানীয় ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানের এখতিয়ারে  আসে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এটি বাংলাদেশের অধিভুক্ত হয় এবং এখানে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ও উন্নয়ন কার্যক্রম সূচীত হয়। আশির দশকের প্রথম দিকে দেশব্যাপী প্রশাসনিক সংস্কারের অংশ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে তিনটি স্বতন্ত্র  জেলায় বিভক্ত করা হয়। এগুলো হচ্ছে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলা। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার  পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি-র সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তিটি ঐ অঞ্চলে দুই দশকব্যাপী সশস্ত্র বিদ্রোহ দমনের মাধ্যমে শান্তি স্থাপনে সহায়ক হয়।

জলবায়ু  এখানকার আবহাওয়া ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ু দ্বারা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ উত্তর ও পূর্বে ২৫৪০ মিমি এবং দক্ষিণ ও পশ্চিমে ২৫৪০ মিমি থেকে ৩৮১০ মিমি। নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত শীত ঋতু। এপ্রিল থেকে মে সময়টা প্রাক-বর্ষা মৌসুম। এটি খুবই গরম ও রৌদ্রকরোজ্জ্বল। বর্ষা মৌসুম জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বলবৎ থাকে। এ সময়টা গরম, মেঘলা ও আর্দ্র।

মৃত্তিকা  পাহাড়ের মাটি ডিসট্রিক ক্যামবিসলস (dystric cambisols) প্রধানত হলদে বাদামি থেকে লালচে-বাদামি, দো-অাঁশ মাটি। ভিন্ন ভিন্ন গভীরতায় এগুলো ভগ্ন কর্দম শিলা, বেলেপাথর এবং কর্বুরিত (mottled) বালির স্তরে বিভক্ত। এই মাটি বেশি মাত্রায় অম্লধর্মী।

গাছপালা  পাহাড়ি ভূমি চাষাবাদের অনুপযুক্ত। তবে প্রাকৃতিক উদ্ভিদাদি প্রচুর জন্মে। পাহাড়ি ঢালে জুম চাষের প্রয়াস চলছে। দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী উপত্যকার সমতলভূমিতে তুলা, ধান, চা ও তৈলবীজের চাষ হচ্ছে।

অর্থনীতি  খাগড়াছড়ি জেলায় অবস্থিত সেমুতাং গ্যাসক্ষেত্র পার্বত্য চট্টগ্রামের একমাত্র গ্যাসক্ষেত্র। ১৯৬৯ সালে ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি (তৎকালীন পাকিস্তানের Oil and Gas Development Corporation) এটি আবিষ্কার করে। অন্যান্য প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে বেলেপাথর, গন্ডশিলা, ক্যালকেরিয়াস কনক্রিশন, কংগ্লোমারেট ও লিগনাইট কয়লা। চন্দ্রঘোনায় কর্ণফুলি নদীর তীরে একটি কাগজের কল স্থাপিত হয়েছে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কাপ্তাইয়ে একটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। পাহাড়ি জনগণ ঐতিহ্যবাহী সুতার কাপড়, বাঁশের জাল ও ঝুড়ি তৈরি করে। পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা নিচের সারণিতে দেওয়া হলো:

কর্মক্ষেত্র নারী-পুরুষের যৌথ কর্মকাণ্ড শুধুমাত্র পুরুষের কর্ম শুধুমাত্র নারীর কর্ম শিশুদের কর্ম
জুমচাষ জঙ্গল পরিষ্কারকরণ, ছাই ছিটানো, শস্য বপন ও নিড়ানো, শস্য কর্তন ও মাড়াই। জঙ্গল ও গাছের ডালপালা কাটা, অগ্নিসংযোগ, শিকার, শস্য বিক্রয়। মৎস্য শুকানো, মজুত রাখা, ঢেঁকিতে ধান ছাঁটা। পশুপাখি তাড়ানো।
সমতল ভূমির কৃষি বীজ বপন ও চারা রোপণ, শস্য নিড়ানো ও পরিচর্যা, শস্য উত্তোলন। লাঙ্গল দেওয়া, মই দেওয়া, শস্য বিক্রয়, সেচ ও কীটনাশক ব্যবহার। শস্য শুকানো ও সঞ্চয় রাখা, ঢেঁকিতে ধান ছাঁটা। পশুপখি তাড়ানো ও শস্য পাহারা দেওয়া।
গৃহসংলগ্ন বাগান ও সবজি তে জমি তৈরি, বীজ বপন ও ফসল উত্তোলন। ফল সংগ্রহ ও বড় গাছের চারা রোপণ করা। আহরিত ফল ও সবজি সংরণ করা। বাগান পাহারা দেওয়া ও আগাছা নিড়ানো।
গৃহস্থালি কর্ম --- --- রান্না, পশুপাখির পরিচর্যা, পরিচ্ছন্নতা, পানি আনা, শিশু পালন করা। গৃহস্থালি কর্মে সহযোগিতা, পশুচারণ।
বনজ সম্পদ সংগ্রহ ছন ও ঘাস কাটা এবং ফলমূল সংগ্রহ করা। বাঁশ, বেত ও কাষ্ঠ আহরণ। জ্বালানি কাঠ ও শামুক সংগ্রহ। বনজ ফলমূল ও সবজি সংগ্রহ এবং শামুক ওকাকড়াজাতীয় প্রাণী সংগ্রহ।
শিকার মৎস্য শিকার। বন্য হরিণ শিকার, শূকর, খরগোশ ও পাখি শিকার। --- মৎস্য শিকার।
হস্তশিল্প ও অন্যান্য বাঁশ ও বেতের ঝুড়ি, মাদুর ইত্যাদি তৈরি; বাঁশ ও বেতের ছাল দ্বারা রশি তৈরি এবং লোকজ ঔষধ তৈরি। বেতের রশি তৈরি করা, চোলাই মদ তৈরি, গৃহ নির্মাণ। তাঁত বোনা, সুতা কাটা, বিড়ি সিগারেট তৈরি। বিভিন্ন হস্তশিল্পে সহকারী হিসেবে কাজ করা।
পশু পালন --- --- হাঁস-মুরগি পালন। গরু/ছাগল পালন, শূকর পালন, দুগ্ধ দোহন, ঘি,মাখন ও দধি তৈরি। পশু চরানো।
ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য হাটে-বাজারে পণ্য বিক্রয়। বিক্রয়কর্মে সহযোগিতা করা। ---

উদ্ভিদকুল  অঞ্চলটির পাহাড়, নদী ও খাঁড়া চূড়া (steep cliff) সমূহ ঘন বাঁশঝাড়, লম্বা বৃক্ষ ও লতাগুল্মে আচ্ছাদিত। উপত্যকাসমূহ ঘন জঙ্গলে আবৃত। বৈশিষ্ট্যমন্ডিত গাছপালার মধ্যে রয়েছে আধা-চিরহরিৎ থেকে নিরক্ষীয় চিরহরিৎ বৃক্ষরাজি। এসব আকাশচুম্বী বৃক্ষরাজির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ডিপটারো কারপাসিয়ে, ইউফোরবেসিয়ে, লুরাসিয়ে, লেগুমিনাসিয়ে ও রুবিয়াসিয়ে।

প্রাণিকুল  পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাণিকুলের মধ্যে রয়েছে হাতি, বানর, দেশি শিয়াল, বনবিড়াল, মেছোবিড়াল, বন্য শূকর, কাছিম, বাজ-কেউটে, জালক-অজগর, ইঁদুর, ভুখ সাপ ও অন্যান্য নির্বিষ সাপ, বিভিন্ন প্রজাতির গিরগিটি এবং ব্যাঙ ও গেছো ব্যাঙের মতো উভচর প্রাণী। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাখিসম্পদ খুবই সমৃদ্ধ। প্রায় পঞ্চাশ  প্রজাতির পাখি এখানে দেখতে পাওয়া যায়।

বনাঞ্চল  এখানকার অধিকাংশ পাহাড় ঘন বনে ঢাকা, যেখানে বাঁশ, বেত ও ছন (এক প্রকার ঘাস) এবং মূল্যবান কাষ্ঠ সম্পদ রয়েছে।

জনসংখ্যা  এখানকার জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই মঙ্গোলীয় শ্রেণিভুক্ত। প্রধান প্রধান মঙ্গোলীয় উপজাতির মধ্যে রয়েছে চাকমা, ত্রিপুরা, মুরং ও মগ। প্রকৃতপক্ষে ১৩টি স্বতন্ত্র উপজাতি পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করে। এরা প্রায় একশ ভিন্ন ভিন্ন গোত্রে বিভক্ত। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী এখানকার মোট জনসংখ্যা ছিল ১০ লক্ষ ৫ হাজার ৩৬২ জন। অধিকাংশ চাকমা ও মারমা বৌদ্ধধর্মের অনুসারী, ত্রিপুরার অধিবাসিরা হিন্দু ধর্মের আর মিজো, বম ও থেয়াং খ্রিস্টান। অন্য কিছু গোত্র আত্মা, প্রাণী ও উদ্ভিদের পূজারী।

নিম্নের সারণিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বণ্টন ও শতকরা হার দেখানো হলো:

জনগোষ্ঠীর নাম মোট জনসংখ্যা (পূর্ণ সংখ্যায়) শতকরা হার
বাঙালি ৫,০০,০০০ ৫০%
চাকমা ২,৪০,০০০ ২৪%
মারমা ১,৪৩,০০০ ১৪%
ত্রিপুরা ৬১,০০০ ৬%
মুরং ২২,০০০ ২.২%
তঞ্চংগ্যা ১৯,০০০ ১.৯%
বম ৭,০০০ ০.৭%
পাঙেখা ৪,৫০০ ০.৩৫%
চাক ২,০০০ ০.২০%
খ্যাং ২,০০০ ০.২০%
খুমি ১,২০০ ০.১২%
লুসাই ৬৬২ ---
কুকি (ম্রো) ৫,০০০ (?)

উৎস Preliminary Report on Population Census, 1991.

পার্বত্য চট্টগ্রামে মানব বসতি স্থাপনের বিন্যাসে এলাকাভিত্তিক মেলামেশার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। কিছু গোষ্ঠী কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চলে বিশিষ্ট হয়ে ওঠে (যেমন চাকমারা পার্বত্য চট্টগ্রামের কেন্দ্রে এবং মারমারা সাঙ্গু ও কর্ণফুলি নদীর অববাহিকায়), আবার অন্যরা কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় কেন্দ্রীভূত থাকে (যেমন ত্রিপুরারা উত্তরে ও মুরোরা দক্ষিণে)। পাহাড়ের উপত্যকায় বসবাসকারী গোষ্ঠী ও পাহাড়ের চূড়ায় বসবাসকারী গোষ্ঠীর ভিতরেও পার্থক্য আছে। অর্থাৎ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আঞ্চলিক বসতি স্থাপনের বিন্যাসটি অত্যন্ত জটিল।

নিচের সারণিতে  উপজাতি ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর শতকরা তুলনা (১৯৪১-২০০১) দেখানো হলো:

সাল বাঙালি উপজাতি
১৯৪১ ৫.০ ৯৫
১৯৫১ ৯.১ ৯০.৯
১৯৬১ ১৭.৭ ৮২.৩
১৯৭৪ ১৯.০ ৮১.০
১৯৮১ ২৭.৫ ৭২.৫
১৯৯১ ৪৮.৪৬ ৫১.৫৪
২০০১ ৫১(?) ৪৯(?)

উৎস বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো।

যোগাযোগ  সড়কপথ ও জলপথই যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলার মধ্যে মোট জলপথের দৈর্ঘ্য যথাক্রমে ৪৪৪ কিমি, ৬৪০ কিমি এবং ১৬৬ কিমি। খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলার মধ্যে মোট পাকা রাস্তার দৈর্ঘ্য যথাক্রমে  ১৩৪ কিমি এবং ২৯৬ কিমি। নিচের সারণিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের নবনির্মিত ও নির্মিতব্য সড়কসমূহ দেখানো হলো:

নির্মিত/নির্মাণাধীন সড দৈর্ঘ্য (কিমি) প্রস্থ (মিটার) মন্তব্য
চিড়িংগা-আলীকদম ৪০.৫৬ সমাপ্ত
পানছড়ি-গৌরাঙ্গপাড়া ।। ১৪.২০ ৪.৫৭ সমাপ্ত
দিঘীনালা-মারিস্যা ১৯.৫০ ৩.৩০ সমাপ্ত
চিম্বুক-থানচ ৫৪ ৩.৬৬ অসমাপ্ত
বাঘাইছড়ি-মাছালং-সাজেক ।। ৩১ ৩.৬৬ অসমাপ্ত
রাজস্থালী-জুরাইছড়ি-বরকল ৫৮ ৩.৬৬ অসমাপ্ত
চিম্বুক-টঙ্কাবতী ৫৮ ৩.৬৬ অসমাপ্ত
আলীকদম-থানচ ৩৫ ৩.৬৬ অসমাপ্ত
খাগড়াছড়ি-লঙ্গদু ৩৭ ৩.৬৬ অসমাপ্ত
পানছড়ি-গৌরাঙ্গপাড়া ১২.৫০ ৩.৬৬ অসমাপ্ত

উৎস সড়ক ও জনপথ বিভাগ (অপ্রকাশিত তথ্য)।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ  উল্লেখযোগ্য  ভূমিকম্পসমূহ  ১৭৬২, ১৮৬৯, ১৮৮৫, ১৮৯৭, ১৯৩০, ১৯৫০ ও ১৯৯৭ সালে সংঘটিত হয়েছিল। ১৮৭৬, ১৮৯৫, ১৮৯৭, ১৯৬০, ১৯৬৩, ১৯৯১ ও ১৯৯৭ সালের ঘূর্ণিঝড়গুলোও ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে। ১৯৬৯ সালে এখানে একবার বড় ধরনের বন্যা সংঘটিত হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম, বান্দরবান

ভূ-প্রকৃতি  ভূ-প্রাকৃতিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল উত্তর ও পূর্বের  উঁচু পাহাড় বা পর্বতশ্রেণীর  মধ্যে পড়ে। এই পর্বতশ্রেণী সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম, দহ্মিণের হবিগঞ্জের কিছু অংশ এবং মৌলভীবাজারের দক্ষিণ ও পূর্ব সীমানা বেষ্টন করে। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল পর্বতশ্রেণীই প্রায় তরু আচ্ছাদিত শৈলশিরা। এগুলো খুব খাড়াভাবে উপরে উঠে যাওয়ায় উচ্চতার তুলনায় অনেক বেশি দৃষ্টি নন্দন। অধিকাংশ পাহাড় শ্রেণীতে চূড়া ও ঝর্ণাসহ পশ্চিম দিকে খাড়া ঢাল (scarp) আছে। বঙ্গোপসাগরে নিপতিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ নদী নিয়ে গঠিত জালিকা সদৃশ (Trellis) ও বৃক্ষসদৃশ (Dendritic) জলনিকাশ প্যাটার্নের এক অতি ব্যাপক নেটওয়ার্ক অঞ্চলটিকে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করে তুলেছে। গুরুত্বপূর্ণ নদীসমূহ হচ্ছে কর্ণফুলি, সাঙ্গু, মাতামুহুরী ও ফেনী। পার্বত্য চট্টগ্রামে কর্ণফুলি নদীর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উপনদীর মধ্যে চেঙ্গী, কাসালং, রেংখিয়ং অন্যতম।

সাধারণত পাহাড়শ্রেণী ও নদী উপত্যকাসমূহ অনুদৈর্ঘ্যভাবে সারিবদ্ধ। পার্বত্য জেলাটির উত্তরাঞ্চলে গড়ে তিন শতাধিক মিটার উচ্চতা সম্পন্ন চারটি পাহাড় শ্রেণী উত্তর-দক্ষিণ বরাবর উঠে গেছে। এগুলো হচ্ছে ফোরামেইন রেঞ্জ (ফোরামেইন, ৪৬৩ মি), দোলাজারি রেঞ্জ (ল্যাংট্রাই, ৪২৯ মি), ভুয়াছড়ি (চাংপাই, ৬১১ মি) ও বরকল রেঞ্জ (থাংনাং, ৭৩৫ মি)। পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যন্তরভাগে কর্ণফুলি নদীর দক্ষিণে বাংলাদেশের অংশে ৭টি প্রধান পাহাড় শ্রেণী রয়েছে। এগুলো হচ্ছে মুরাঞ্জা রেঞ্জ (বাসিটং, ৬৬৪ মি), ওয়েইলা রেঞ্জ (এর অধিকাংশ শ্রেণী মায়ানমারে), চিম্বুক রেঞ্জ (টিন্ডু, ৮৯৮ মি), বাটিমেইন রেঞ্জ (বাটিটং, ৫২৬ মি), পোলিটাই রেঞ্জ (কেওক্রাডাঙ, ৮৮৪ মি),  রামিওটং (৯২১ মি), সাইচল-মৌডক রেঞ্জ (বিলাইসড়ি, ৬৬৯ মি) এবং সাইচল রেঞ্জ। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গগুলো সাইচাল রেঞ্জে অবস্থিত। এগুলো হচ্ছে ওয়েবুং (৮০৮ মি), র‌্যাংলাং (৯৫৮ মি), মৌডক লাং (৯০৫ মি) ও মায়ানমারের সীমান্তবর্তী মৌডক মুয়াল (১,০০৩ মি)। এই সব পাহাড়শ্রেণীর কয়েকটিতে গ্যাস সঞ্চিত থাকার উপযুক্ত উত্তম আবদ্ধিক কাঠামো গঠনের মতো ভূতাত্ত্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ঊর্ধ্বভঙ্গ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কাঠামোসমূহের মধ্যে রয়েছে সেমুতাং উত্তলভঙ্গ (গড় উচ্চতা ৮০ মি কোন কোন স্থানে  ১৬০ মি থেকে বেশি), সীতাপাহাড় উত্তলভঙ্গ (২৪৫ থেকে ৩৩০ মি কাঠামোর দক্ষিণ ও মধ্যভাগে এবং উত্তরাঞ্চলে ৩৩০ থেকে ৪১০ মি), মাতামুহুরী উত্তলভঙ্গ (উত্তর অংশে গড় উচ্চতা ২৪৫ থেকে ৩৩০ মি কিন্তু দক্ষিণ অংশে এই উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে ৪১০ থেকে ৫৭০ মি উঠে সর্বোচ্চ ৭১০ মি পর্যন্ত উন্নীত হয়েছে) এবং বান্দরবান উত্তলভঙ্গ (সর্বোচ্চ উচ্চতা ৬৫০ থেকে ৮০০ মি। এর মধ্যে উত্তর থেকে দক্ষিণে তিনটি শৃঙ্গ অবস্থিত যাদের উচ্চতা ৯৩৫ মি, ৯৬০ মি ও ৯৬৫ মি)।

হ্রদ ও জলাশয়  অঞ্চলটিতে দুটি প্রাকৃতিক হ্রদ (রাইনখিয়ং  হ্রদ ও বগাকাইন হ্রদ) ও একটি কৃত্রিম হ্রদ (কাপ্তাই লেক) রয়েছে। কাপ্তাই লেক শুকনা মৌসুমে প্রায় ৭৬৭ বর্গ কিমি ও বর্ষা মৌসুমে প্রায় ১,০৩৬ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত থাকে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি লোকালয়

ভূতত্ত্ব  ভারতীয় ও এশিয়ান প্লেটের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্ম। ক্রিটেসিয়াস যুগের শেষাংশে গন্ডোয়ানাল্যান্ড ভেঙ্গে যাওয়ার পর ভারত-অস্ট্রেলীয় প্লেট বছরে ৬ সেমি হারে  দক্ষিণপূর্ব দিকে প্রায় ১৭৫০ কিমি এগিয়ে যায়। পরবর্তীতে ভারতীয় প্লেট অস্ট্রেলীয় প্লেট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং উত্তর ও উত্তরপূর্ব দিকে যাত্রা শুরু করে। এ সময়টিতেই পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস শুরু হয়। ধীরে ধীরে বছরে ৫ সেমি সঞ্চরণ হারে ভারত ইয়োসিন উপযুগে ইয়োরেশিয় প্লেটের সঙ্গে প্রথম সংঘর্ষের আগে  উত্তর দিকে আরও প্রায় ২৫০০ কিমি সরে যায়। সেই থেকে টেথিস সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত বছরে ৩ সেমি সঞ্চরণ হারে ভারতীয় প্লেট উত্তরপশ্চিম দিকে আরও ১০০০ কিমি সরে যায়। প্রাক ওলিগোসিন যুগে প্লেট সঞ্চরন সামান্য ভিন্ন দিকে পুনরায় শুরু হয় অথবা দ্রুতগতি সম্পন্ন হয় এবং ভারত আরও উত্তরপুর্ব মুখে এশিয়ার কেন্দ্রাভিমুখী হয়। সামুদ্রিক ভূত্বক বর্মী উপ-প্লেটের নিচে অধোগমন করতে শুরু করে যার ফলে পূর্ব দিকে একটি পৃষ্ঠ চাপ অববাহিকা ও পশ্চিম দিকে একটি সম্মুখ চাপ অববাহিকার সৃষ্টি হয় যা প্রাথমিক ভাবে উত্থিত ইয়োমা সন্ধি-অঞ্চল দ্বারা বিচ্ছিন্ন। মধ্য বার্মা বা ইরাবতী অববাহিকা পৃষ্ঠ-চাপ অববাহিকার প্রতিনিধিত্ব করে; আর চট্টগ্রাম-ত্রিপুরা পাহাড় সমেত আরাকান-ইয়োমা বলিত বলয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম যার একটি অংশ, বিশেষ সম্মুখ চাপ অববাহিকার প্রতিনিধিত্ব করে। মায়োসিন ও নিম্ন-প্লাইসটোসিন যুগে ইরাবতী অববাহিকায় অবক্ষেপিত  পলির তলানি চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরা পাহাড়ে প্রকটিত।

ফলে, সম্মুখ চাপ অববাহিকায় অবক্ষেপিত ভারতীয় প্লেট ও টারশিয়ারি পলির তলানির সমকেন্দ্রাভিমুখ যাত্রাকালে অঞ্চলটি মায়োসিন গিরিজনীর সময়কালে উত্থিত হয় এবং এই উত্থান প্লাইসটোসিন গিরিজনী পর্যন্ত চলতে থাকে যার ফলে বর্তমান আরাকান ইয়োমা সুবৃহৎ-ঊর্ধ্বভঙ্গ ধারা এবং এর পশ্চিমমুখী সম্প্রসারিত চট্টগ্রাম-ত্রিপুরা পর্বত বলয়ের সৃষ্টি হয়।

কাপ্তাই লেক

পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রকটিত সবচেয়ে প্রাচীন শিলা ইউনিট হচ্ছে মায়োসিন যুগের সুরমা গ্রুপের ভুবন স্তরসমষ্টি। মায়োসিন ভূবন স্তরসমষ্টির চেয়ে প্রাচীন কোন প্রকটিত শিলার সন্ধান আজও পাওয়া যায় নি। প্যালিওজিন অবক্ষেপসমূহ অনেক গভীরে প্রোথিত এবং কোন কূপে এটি এখনও পাওয়া যায়নি। সুরমা গ্রুপের অবক্ষেপ প্লায়ো-প্লাইসটোসিন যুগের টিপাম বেলেপাথর গ্রুপের দ্বারা অধিশায়িত। প্লাইসটোসিন যুগের ডিহিং স্তরসমষ্টি পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে কদাচিৎ চোখে পড়ে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে ঊর্ধ্ব-টারশিয়ারি বেলেময় এঁটেল তলানিসমূহ ধারাবাহিক সাবমেরিডিওনাল (উত্তর উত্তর পশ্চিম-দক্ষিণ দক্ষিণ পূর্ব) উত্তলভঙ্গ ও অবতল ভঙ্গে ভাঁজে ভাঁজে জড়িয়ে আছে যার প্রমাণ এখানকার সুদীর্ঘ পর্বতমালা ও মধ্যবর্তী উপত্যকাসমূহের পৃষ্ঠদেশের ভূসংস্থানে দেখতে পাওয়া যায়। বলিত গঠনসমূহ পূর্বদিকে বর্ধিতহারে পরিমাত্রা ও মিশ্রণসহ এন এশিলং (en echelon) দিক স্থিতি দ্বারা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। অনুরূপভাবে, বলিত প্রান্ত তিনটি সমান্তরাল পশ্চিম থেকে পূর্বে প্রায় উত্তর-দক্ষিণ প্রবণ বলয়ে বিভক্ত যেমন: (ক) পশ্চিমাঞ্চলীয় বলয়ে সাধারণ বাক্সসদৃশ্য বা অনুরূপ আকারের উত্তলভঙ্গ রয়েছে যার খাড়া প্রান্ত ও আলতো চূড়াগুলো মৃদু অবতল ভঙ্গ দ্বারা বিচ্ছিন্ন, মাতামুহুরী উত্তলভঙ্গ, সেমুতাং উত্তল ভঙ্গ ইত্যাদি যার উদাহরণ; (খ) মধ্য বলয় সাধারণ বাক্স সদৃশ্য ভাঁজের বিপরীতে আরও চাপা কাঠামোর বৈশিষ্ট্যমন্ডিত, যাতে রয়েছে গিরিশিরা সদৃশ ও অপ্রতিসম উত্তলভঙ্গ যেখানে প্রায়শই বিচ্যুতিসমূহ লক্ষ্য করা যায় এবং যা সংকীর্ণ অবতলভঙ্গ দ্বারা বিচ্ছিন্ন, যেমন সীতাপাহাড় উত্তলভঙ্গ, বান্দরবান উত্তলভঙ্গ, গিলাশরি উত্তলভঙ্গ, পটিয়া উত্তলভঙ্গ, চ্যাঙ্গোটুং উত্তলভঙ্গ, তুলামুরা উত্তলভঙ্গ, কাপ্তাই অবতলভঙ্গ, আলীকদম অবতলভঙ্গ ইত্যাদি; (গ) পূর্বাঞ্চলীয় বলয় অতিমাত্রায় চাপা সংকীর্ণ উত্তলভঙ্গ দ্বারা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত, যাতে রয়েছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঠেলাচ্যুতি (thrust fault) সহযোগে খাড়া টুকরা টুকরা পার্শ্বদেশ, যেমন, বেলাসরি উত্তলভঙ্গ, শুভলং অবতলভঙ্গ। উঠানছত্র উত্তলভঙ্গ, বরকল উত্তলভঙ্গ, মৌডাক উত্তলভঙ্গ, রাটলং উত্তলভঙ্গ, কাসালং অবতলভঙ্গ, সাঙ্গুভ্যালে অবতলভঙ্গ এবং অন্যান্য। [সিফাতুল কাদের চৌধুরী]

আরও দেখুন বান্দরবান জেলা; খাগড়াছড়ি জেলা; রাঙ্গামাটি জেলা; ভূ-প্রকৃতি