পাক-ভারত যুদ্ধ ১৯৬৫

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৭:০২, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

পাক-ভারত যুদ্ধ ১৯৬৫  এক অর্থে ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের পাক-ভারত যুদ্ধ ছিল দুটি দেশের মধ্যে এক বছরে সংঘটিত তিনটি বিবাদমান ঘটনার ক্রম পরিণতি। এগুলো হলো: এপ্রিল মাসে কুচের রান অঞ্চলে সীমিত আকারের পরীক্ষামূলক যুদ্ধ, আগস্ট মাসে ছদ্মবেশে পাকিস্তানিদের কাশ্মীরে অনুপ্রবেশ, এবং পরিশেষে সেপ্টেম্বর মাসে পরস্পরের আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রমণ। বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে এই যুদ্ধ শুধু এক বছরের ঘটনার ফলশ্রুতি নয়, সাম্প্রদায়িক পরিবেশে গড়ে ওঠা দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতা ও অবিশ্বাসের ফলেই এই যুদ্ধের সূচনা হয়। তা ছাড়া ১৯৪৮ সালের কাশ্মির যুদ্ধ, পরবর্তীকালে কাশ্মিরের একাংশে পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ, জম্মু ও কাশ্মিরকে ভারতে অন্তর্ভুক্তি, জাতিসংঘের ভেতরে ও বাইরে প্রতিপক্ষের কূটনেতিক আলোচনা ইত্যাদি ঘটনাবলি পাকিস্তানকে  তার পছন্দ অনুযায়ী কাশ্মির সমস্যার একটি সমাধান অর্থাৎ কাশ্মিরকে পাকিস্তানের সঙ্গে অঙ্গীভূত করার প্রয়াস ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধ এবং পরবর্তীকালে ভারতে ইঙ্গ-মার্কিন সামরিক সাহায্য ইত্যাদি ঘটনায় পাকিস্তান হতাশ হয়ে পড়ে এবং কাশ্মির সমস্যার সমাধান সুদূর পরাহত মনে হয়। আইয়ুব খানের মতো একজন সামরিক শাসকের নিকট একমাত্র সামরিক হস্তক্ষেপ ও যুদ্ধই এই সমস্যার সমাধান বলে প্রতীয়মান হয়।

যুদ্ধের প্রস্ত্ততি কুচের রান অঞ্চলের ঘটনা- কুচের রান অঞ্চল হচ্ছে ভারতের গুজরাট রাজ্য এবং পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত ৩২০ মাইল দীর্ঘ এবং ৫০ মাইল প্রশস্ত এক মরুময় অঞ্চল এবং জলাভূমি। দেশ বিভাগের সময় এবং রান অঞ্চলের কর্তৃত্ব নিয়ে বাউন্ডারি কমিশনের ব্যর্থতার কারণে প্রায় ৩৫০০ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে দুটি নতুন দেশের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। ১৯৬৫ সালের ৯  এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বিরোধপূর্ণ এলাকায় জোরপূর্বক প্রবেশ করে এবং দাবি করে যে ভারতীয় সেনাবাহিনী কাঞ্জারকোটের নিকট একটি পাকিস্তানি চৌকিতে আক্রমণ করেছে। এই যুদ্ধ অতি দ্রুত তীব্রতর হয় এবং পাকিস্তান আমেরিকা থেকে সংগৃহীত নতুন প্যাটন ট্যাংক এই যুদ্ধে ব্যবহার করা শুরু করে। পরিশেষে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসনের মধ্যস্থতায়  এবং ভারত ও পাকিস্তানে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনারদের (যথাক্রমে জন ফ্রিম্যান ও স্যার মরিস জেম্স) প্রচেষ্টায় ১৯৬৫ সালের ১ জুলাই থেকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়।

অবশ্য কুচের রান অঞ্চলের ঘটনার কয়েক বছর পূর্ব থেকেই বেশ কিছু ঘটনা ঘটে এবং এ নিয়ে বহু বিবৃতিও প্রকাশিত হয়।  এসব ঘটনা ও বিবৃতি দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের অবনতিতে সাহায্য করে। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘ সীমান্ত রেখায় সীমানা লঙ্ঘনসহ অন্যান্য ঘটনা নিত্য নৈমিত্তিক ছিল। ১৯৬৫ সালের প্রথম পাঁচ মাসে ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধ বিরতি সীমানা রেখা বরাবর নিয়োজিত জাতিসংঘের সামরিক পর্যবেক্ষক দল ভারত ও পাকিস্তান কর্তৃক ২২৩১টি অভিযোগের কথা উল্লেখ করে।  এই সময়ের মধ্যে পর্যবেক্ষক দল ৩৭৭টি সীমানা রেখা লঙ্ঘনের বিষয় নিশ্চিত করে যার মধ্যে ২১৮ টি পাকিস্তান কর্তৃক এবং ১৫৯ টি ভারত কর্তৃক লঙ্ঘন করা হয়। আইউব খান সুস্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করেন যে, কাশ্মির সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান হলে পাকিস্তান সরকার আর যুদ্ধ করবে না। কারণ কাশ্মির সমস্যা ‘আমাদের নিরাপত্তা ও সমগ্র অস্তিত্ত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ।’ ভারত কর্তৃক ‘যুদ্ধ-নয় চুক্তি’ প্রস্তাবের উত্তরে তিনি মন্তব্য করেন, ‘... যদি কাশ্মির বিতর্ক থেকেই যায়, তাহলে ভারতের প্রস্তাবিত ‘যুদ্ধ-নয় চুক্তি’ গ্রহণ করা অসম্ভব।’

কাশ্মিরে জিব্রাল্টার অভিযান আইয়ুব খান অত্যন্ত গভীর আগ্রহ সহকারে এ সব ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেন। আগস্ট মাসের মধ্যে সম্ভবত তিনি সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ‘আর কালক্ষেপন করা উচিত হবে না।’ কারণ ৩ বছর পূর্বে চীন-ভারত যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি মহলে একটি বিকল্প প্রস্তাব হিসেবে কাশ্মিরে তাঁর শক্তি প্রয়োগের কথাটি আলোচিত হয়। আইয়ুব খান তাঁর বিরুদ্ধে ক্রমশ ঘনায়িত গণঅসন্তোষকে ধীরে ধীরে এই মতবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে পরিচালিত করতে চেয়েছিলেন যে, ‘বহি:শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ জনগণের মধ্যে দেশপ্রেম ও ঐক্য সৃষ্টি করে’। আইয়ুব খানের উপদেষ্টামন্ডলি তাঁকে ঘিরে একটি ছোট বলয় গড়ে তোলে। এই গোষ্ঠী আজাদ কাশ্মির গেরিলা দ্বারা গুপ্তভাবে এবং নিয়মিত সৈন্য দ্বারা প্রকাশ্যে কাশ্মির আক্রমণের পরিকল্পনা করে। ‘জিব্রাল্টার অভিযান’ নামে খ্যাত এই অভিযানের লক্ষ্য ছিল শুধুমাত্র কাশ্মির অঞ্চলে ভারতের সঙ্গে স্থানীয় যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া। কিন্তু পরবর্তীকালে তা ভিন্ন রূপ নেয় এবং শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে একটি বড় রকমের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।

জিব্রাল্টার বাহিনী পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মিরের প্রায় ৭০০০ মুজাহিদীন নিয়ে গঠিত ছিল। ৫ আগস্ট ভারত সরকার ঘোষণা করে যে, বহুসংখ্যক সশস্ত্র মিলিশিয়া বাহিনী ছদ্মবেশে ভারত নিয়ন্ত্রিত  কাশ্মিরে প্রবেশ করেছে এবং নিয়মিত পাকিস্তানি বাহিনী যুদ্ধবিরতি সীমারেখা বরাবর গুলিবর্ষণ করছে।  ভারতীয় বাহিনী পাল্টা গুলিবর্ষণ শুরু করে এবং ১৫ আগস্টের মধ্যে উত্তর ফ্রন্টের কারগিলের ৩টি গুরুত্বপূর্ণ পাহাড়ি অবস্থান পুনর্দখল করে নেয়। পরবর্তী ১০ দিনের মধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনী উত্তর-পশ্চিম ফ্রন্টের পির সাহেবা এবং পশ্চিম কেন্দ্রীয় ফ্রন্টের হাজি পির পাস সহ কয়েকটি পাকিস্তানি অবস্থান দখল করে নেয়। আগস্ট মাসের ২৭ তারিখের মধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনী ইউরি-বেদরি অঞ্চলের যুদ্ধবিরতি সীমারেখা অতিক্রম করে। ১ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কাশ্মিরের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তের যুদ্ধবিরতি সীমারেখার ভিম্বার-চাম্ব এলাকা আক্রমণ করে। এই সংঘর্ষ ধীরে ধীরে তীব্রতর হয় এবং ৬ সেপ্টেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানের পাঞ্জাব অঞ্চলের আন্তর্জাতিক সীমারেখা অতিক্রম করে এবং কাশ্মির ফ্রন্টের যুদ্ধের চাপ কমানোর জন্য লাহোর অভিমুখে তীব্র আক্রমণ পরিচালনা করে। এভাবে ইচ্ছাকৃত সীমান্ত সংঘর্ষ সম্প্রসারিত হয়ে পরিপূর্ণ যুদ্ধে রূপান্তরিত না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানের অনুপ্রবেশের পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

সেপ্টেম্বর যুদ্ধ আন্তর্জাতিক সীমানা রেখা বরাবর পাঞ্জাব ফ্রন্ট খোলার পদক্ষেপ গ্রহণের কৃতিত্ব ছিল ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর। কাশ্মির উপত্যকার সঙ্গে স্থলপথে যোগাযোগের মাধ্যমে একে রক্ষা করা এবং নিরাপত্তার বিষয়টি ছিল ভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে একটি বিরাট পদক্ষেপ। ভারতীয় সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিক সীমানা রেখা বরাবর একই সঙ্গে দুটি আক্রমণ পরিচালনা করে। প্রথমটি ছিল ৬ সেপ্টেম্বর লাহোর অভিমুখে, এবং অন্যটি ছিল পরদিন শিয়ালকোট শহর অভিমুখে। পাকিস্তান এই শিয়ালকোট শহরকেই কাশ্মিরের চাম্ব সেক্টরে সেনাবাহিনী পাঠানোর জন্য ব্যবহার করে আসছিল। লাহোর আক্রমণ কিছু প্রাথমিক সাফল্য লাভ করে, কিন্তু ফেরার পথে সারিবদ্ধ পানিসেচ খালের কারণে তারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এই পানিসেচ খালের উপর নির্মিত প্রায় ৭০টি সেতু বিস্ফোরণে উড়িয়ে দিয়ে সেখানে পরিখার সৃষ্টি করে। অবশ্য পাকিস্তান ভারত অধিকৃত পাঞ্জাবের খেমখারান নামক একটি ছোট শহরে প্রতি-আক্রমণ পরিচালনা করে। ১২০ থেকে ১৫০টি ট্যাংক ও অন্যান্য সেনাযানে সজ্জিত সক্রিয় ও শক্তিশালী পাকিস্তানের প্রথম সশস্ত্র বাহিনী এই আক্রমণ পরিচালনা করে। কিন্তু ভারতীয় বাহিনীর পূর্বে অবস্থান নেয়া অ্যাম্বুশের কারণে পাকিস্তানের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও বহু প্রাণহানি ঘটে। অন্যদিকে শিয়ালকোট রণক্ষেত্রে উভয়পক্ষের ৪০০ থেকে ৬০০টি ট্যাংক বহর নিয়ে সর্ববৃহৎ ট্যাংক যুদ্ধ শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধে পাকিস্তান সাফল্যলাভ করে এই অর্থে যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী শিয়ালকোট অভিমুখে অভিযান বন্ধ করে দেয়। যুদ্ধ চলতে থাকলে উভয়পক্ষ একটি যুদ্ধবিরতির দিকে নমনীয় হয়ে পড়ে।  প্রথমত বিশেষ করে পাকিস্তানের সামরিক অবস্থান ধীরে ধীরে দুর্বল হতে শুরু করে, তারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর সেনাব্যুহ ভাঙতে ব্যর্থ হয়; দ্বিতীয়ত, সেনাবাহিনীর রসদ সরবরাহ, বিশেষ করে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ ক্রমশ হ্রাস পেতে শুরু করে। বিশেষ করে খেমখারান রণক্ষেত্রে ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রচুর সংখ্যক ট্যাংক আটক করে। একই সময়ে পাকিস্তানের কাশ্মির প্রচারণার গুরুত্ব হারিয়ে যায় কারণ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে তাদের গতিবেগ ভিন্ন দিকে পরিচালিত করতে এবং পাঞ্জাব রণক্ষেত্রের দিকে ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়। জাতিসংঘ ফোরামের বাইরে ব্রিটিশ আমেরিকার কার্যকর সমর্থন পেতেও পাকিস্তান ব্যর্থ হয়। এরূপ পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের মহাসচিব ২০ সেপ্টেম্বর  অত্যন্ত কঠোর ভাষায় যুদ্ধ বিরতির জন্য সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণ করলে ভারত ২১ সেপ্টেম্বর এবং পরের দিন পাকিস্তান তা গ্রহণ করে।

যুদ্ধবিরতির চূড়ান্ত ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশই যুদ্ধে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে কতকটা অতিরঞ্জিত দাবির উল্লেখ করে। ১৯৬৫ সালের ১৭ অক্টোবর  ওয়াশিংটন পোস্ট ওয়াশিংটনের এক সামরিক জরিপ উদ্ধৃত করে ঘোষণা দেয় যে, পাকিস্তানের ১১০০ ট্যাংকের মধ্যে আনুমানিক ২০০ ট্যাংক ধ্বংস হয় এবং অন্য ১৫০টি ট্যাংক বিকল হয়ে পড়ে এবং পরবর্তী সময়ে সেগুলো মেরামত করা হয়। অন্যদিকে ভারতের মোট ১৪৫০টি ট্যাংকের মধ্যে ১৭৫ থেকে ১৯০টি ট্যাংক ধ্বংস হয় বা খোয়া যায় এবং অন্য ২০০টি ট্যাংক প্রয়োজন মতো ব্যবহার করার জন্য আপাতত পৃথক করে রাখা হয়। সামরিক বিমানের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের প্রায় ২০টি বিমান ধ্বংস হয়, অপর দিকে ভারতের বেশি সংখ্যক বিমান ধ্বংস হয় যার সংখ্যা ৬৫ থেকে ৭০টির মতো হবে। সেনা হতাহতের দিক থেকে পাকিস্তানের সেনা সংখ্যার পরিমাণ প্রায় ৩৮০০ এবং ভারতের সংখ্যা ৩০০০। অন্যদিকে, ভূখন্ডের দিক থেকে পাকিস্তানের ভূখন্ড হারানোর পরিমাণ প্রায় ৭২০ বর্গমাইল এবং ভারত হারায় প্রায় ৩০০ বর্গমাইল। আনুপাতিকভাবে পাকিস্তানের বেশি ক্ষয়ক্ষতির একটি কারণ হচ্ছে যে, পাকিস্তান বিপুল সংখ্যক আমেরিকান প্যাটন ট্যাংক যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করে এবং সেক্ষেত্রেও তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। উভয় পক্ষের এই লাভক্ষতি সত্ত্বেও যে কেউ সঙ্গতভাবেই যুক্তি দেখাতে পারে যে, ‘যুদ্ধের অতিশীঘ্র সমাপ্তি ঘটেছে’, কারণ উভয় পক্ষই তাদের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে পেরেছে। এ প্রসঙ্গে সুমিত গাঙ্গুলি  যথার্থই বলেছেন: ‘কয়েক সপ্তাহ পরে যুদ্ধবিরতি হলে যুদ্ধ ভিন্নখাতে মোড় নিতে পারত। পাকিস্তানিদের উন্নতমানের যুদ্ধাস্ত্র থাকা সত্ত্বেও ভারতীয়দের যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য যুদ্ধাস্ত্রের পরিমাণ এবং যুদ্ধাস্ত্র তৈরির সুযোগ ছিল বেশি। এভাবে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে পাকিস্তানিদের বেশ বিপদের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল।’ কিছু পাকিস্তানি লেখক তাঁর এই অভিমতকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেন এবং বিশেষ করে পাকিস্তানের গোলাবারুদের  আশংকাজনক স্বল্পতার কথা উল্লেখ করেন। বিশেষভাবে আসগর খানের বর্ণনায় দেখা যায় যে, তিনি এবং তাঁর দল কীভাবে মরিয়া হয়ে পাকিস্তানের বাইরে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলেন।

যুদ্ধবিরতির  পর সোভিয়েত ইউনিয়নের উদ্যোগে তাসখন্দে একটি শান্তিচুক্তিতে উপনীত হওয়ার জন্য যুদ্ধমান দুটি পক্ষ প্রয়োজনীয় মূল কাজ শেষ করতে প্রায় তিন মাস সময় নেয়। যুদ্ধের  সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রকাশ্যে নিরপেক্ষ নীতি প্রদর্শন করে যাতে পাকিস্তানকে কোনোভাবেই চীনের বলয়ে ঠেলে দেয়া না হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের এই উদ্বেগের কারণেই প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন আইযুব খান ও শাস্ত্রীকে যুদ্ধকালীন সময়েই তাসখন্দে তাঁদের  বিরোধ নিয়ে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দেন। অবশেষে ২২ সেপ্টেম্বর উভয় পক্ষই এই প্রস্তাব গ্রহণ করে। আইযুব খান আশা করেছিলেন যে, আমেরিকা তাঁর শর্ত মোতাবেক এই সমস্যার সমাধান করবে। কিন্তু তা না হওয়ায় তিনি নতুন করে সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর আস্থা স্থাপন করেন।  কিন্তু তিনি লক্ষ্য করলেন যে, তাসখন্দ বৈঠকে এ ধরনের কোনো কিছু অর্জন তার পক্ষে কঠিন হবে। অবশেষে কোসিগিনের আপ্রাণ চেষ্টার ফলে ১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারি তাসখন্দ ঘোষণা স্বাক্ষরিত হয়। এই ঘোষণাপত্রের উপসংহারে উল্লেখ করা হয় যে, কোসিগিন ‘সাক্ষী’ হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রিত কাশ্মির এলাকার ভারতীয় বাহিনীর দখলকৃত হাজি পীর পাস এবং তিতওয়াল পাকিস্তানকে ফিরিয়ে দিতে শাস্ত্রী রাজি হন। অবশ্য এ কারণে ভারতে কিছুটা অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। এ প্রসঙ্গে রাসেল ব্রাইস মন্তব্য করেন যে,  এ ছাড়া শাস্ত্রী তাসখন্দে খুব কমই ছাড় দিয়েছিলেন। তাসখন্দে শাস্ত্রীর মৃত্যু নিঃসন্দেহে ভারতের জন্য ছিল বিরাট ক্ষতি। কিন্তু আইয়ুব খান বিশেষ কোনো অর্জন ছাড়াই ফিরে আসেন। ফলে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ এবং বিশেষত এর ফলাফল সম্ভবত আইয়ুব শাসনের শেষ পরিণতির সূচনা করে।

১৯৬৬ সালের ২২ জানুয়ারি নয়াদিল্লিতে ভারত ও পাকিস্তান সৈন্য প্রত্যাহার চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এই চুক্তি অনুসারে ২৫ জানুয়ারি থেকে ভারত রাজস্থান থেকে জম্মু ও কাশ্মির যুদ্ধবিরতি সীমারেখা বরাবর এবং পাকিস্তান তার পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্ত থেকে সৈন্য প্রত্যাহার শুরু করে। [নূরুল হুদা আবুল মনসুর]

গ্রন্থপঞ্জি  Russell Briness, The Indo-Pakistan Conflict (London,1968); Sumit Ganguly, Origins of Wars in South Asia Indo-Pakistan Conflicts Since 1947 (Lahore,1988); Brigadier(Retd.) Gulzar Ahmed, Pakistan Meets Indian Challenge: A Pakistani’s Perspective of the 1965 War (Dera Dun, 1991, Ist Pakistani ed. 1967); Stanley Wilbert, Sulfa Bhutto of Pakistan: His Life and Times (Delhi, Oxford University Press, 1993); General (Retd.) Mohammad Musa, My Version India-Pakistan War 1965 (Lahore, Wajidalis, 1983); Air Marshall (Retd.) M. Asghar Khan, The First Round Indo-Pakistan War 1965 (New Delhi, 1979); Lt. General (Retd.) Harbaksh Singh, War Dispatches The Indo-Pakistan Conflict 1965 (New Delhi, 1991).