পয়স্তি ও শিকস্তি

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১০:২৩, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

পয়স্তি ও শিকস্তি (Alluvion and Diluvion)  দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কিছু পার্বত্য এলাকা ছাড়া অবশিষ্ট বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম নদীগঠিত বদ্বীপ। তিনটি বড় নদী গঙ্গা/পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র/যমুনা ও মেঘনা/গাঙ্গেয়-ব্রহ্মপুত্র গঠন করেছে এই বদ্বীপ। এই তিন প্রধান নদনদী হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগর অবধি তাদের সর্পিল প্রবাহপথে প্রতিবছর কোটি কোটি টন বালি ও কাদা বয়ে নিয়ে আসে। ফলে এসব বালি-কাদার সিংহভাগ দিয়ে নদনদীর বক্ষদেশ ক্রমেই উঁচু হয়ে ওঠে আর তাদের সঙ্গমস্থল বা মোহনার মুখে চর জেগে ওঠে এবং ভূমি গঠিত হয়। মৌসুমি বর্ষার প্রবল জলপ্রবাহ স্ফীত ও অগভীর নদীখাত বরাবর সরাসরি সাগরে পতিত হতে না পেরে নদনদীর উভয় তীর ছাপিয়ে বিস্তীর্ণ এলাকার জমি যেমন প্লাবিত করে তেমনি নদীর পাড় এলাকার বিশাল ভূমিখন্ডও গ্রাস করে। এই প্রক্রিয়ায় নদীর একদিকে যখন ভাঙ্গন চলে অন্যদিকে তখন অলক্ষ্যে নতুন ভূখন্ড গঠিত হয়। এ ধরনের নদীভাঙ্গা (diluvion) ও চর জেগে-ওঠা (alluvion) হলো নদীর নিয়ত প্রক্রিয়া। আর এই ভূমিগঠন প্রক্রিয়া থেকে চরজমির মালিকানার অধিকার ও নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত কিছু প্রয়োগবিধি ও প্রথা গড়ে উঠেছে।

আইন প্রণয়নের নিয়মকানুনগুলি সম্পর্কে সাধারণভাবে জানা না থাকায় এদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলের গোড়ার দিকে প্রতিষ্ঠিত বিচার-আদালতগুলি চরজমির মালিকানার দাবিদার ও বিরোধে লিপ্ত পক্ষগুলির অধিকার নির্ণয়ে বেশ সমস্যায় পড়ে। এই পরিস্থিতিতে ১৮২৫ সালে বঙ্গীয় পয়স্তি ও শিকস্তি প্রবিধান জারির মাধ্যমে এ সম্পর্কিত ব্যবহার ও প্রয়োগরীতিমূলক বিধিবিধানকে প্রথমবারের মতো আইনের আকার দেওয়া হয়। কোন নতুন আইনের বিধি প্রবর্তন এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল না, বরং কোন ক্ষেত্রে স্পষ্ট প্রতিষ্ঠিত প্রয়োগরীতি ও প্রথা থেকে থাকলে এ প্রবিধানে সেগুলির শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রযোজ্যতাই ঘোষিত হয়েছে মাত্র। সুস্পষ্ট প্রয়োগরীতির অনুপস্থিতিতে এই নিয়ামক প্রবিধানের মূলনীতিগুলি আদালতের জন্য চরজমির মালিকানা নির্ণয়ে নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করার কথা। ১৮২৫ সালের এই প্রবিধানে মোটামুটি দুই ধরনের জমি পুনর্গঠনের বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে: ১. মূল/আদি স্থানে (in situ) জমির পুনর্গঠন, ২. নতুন ভূমিগঠন বা চরগঠন। শিকস্তি, ভাঙন বা ভূমিক্ষয়ে জমি বিলীন হওয়ার পরবর্তী সময়ে ঐ জমির মূল বা পুরাতন স্থলে আবার জমি গড়ে উঠলে তার অগ্রাধিকার এবং নতুনভাবে গঠিত জমি বা নতুন চরের জমির মালিকানা দুটিই সুনির্দিষ্ট অধিকার।

নদী ভাঙ্গন

মূল স্থানে জমির পুনর্গঠন ও নতুন ভূমিগঠন বা চরগঠনজনিত জমির মালিকানার অধিকারকে ব্যক্তিবিশেষের ভৌত সম্পত্তিতে তার স্বত্বের অনুগামী বলে (incidental) ধরা হয়। বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে এই প্রবিধানে নেই, তবে এটি ৪ নং ধারার ৫ দফায় সন্নিবেশিত ন্যায়বিচার ও ন্যায্যতার মূলনীতিমালা থেকে উদ্ভূত। প্রিভি কাউন্সিল ঘোষিত উল্লিখিত নীতির অন্তর্নিহিত ধারণাটি হলো এই যে, পানির নিচে তলিয়ে গেছে বলেই সম্পত্তিতে অধিকার নষ্ট/ধ্বংস বা পরিবর্তিত হয়ে যায় নি। জমিটি পানিতে তলিয়ে থাকার সম্পূর্ণকাল পরিক্রমায় ধরে নেওয়া হবে যে, ঐ শিকস্তি জমির মালিক তার জমি জলমগ্ন থাকাকালেও ঐ জমির দখলে ছিলেন। পানি থেকে ঐ জমি পুনরায় যখন জেগে ওঠে তখন তা শনাক্ত হওয়ার পর তিনি এর মালিকানা আবার দাবি করতে পারেন। মূল অবস্থানে পুনর্গঠিত বা পুনঃসৃষ্ট জমির মালিকানার অধিকার, তাই বলা যায়, বিচারক প্রণীত আইন থেকে উদ্ভূত হয়েছে। ১৮৫৯ সালের বঙ্গীয় খাজনা আইনের ১৭ ও ১৮ ধারায় সন্নিবেশিত প্রজাস্বত্ব আইনে এই অনুসিদ্ধান্তমূলক নীতি স্বীকার করে নেওয়া হয় যে, পয়স্তিক্রমে কোন প্রজার জমির আয়তন বেড়ে গেলে তাকে বাড়তি খাজনা দিতে হবে, আর কমে গেলে বা শিকস্তির ক্ষেত্রে যে পরিমাণ জমি তার ভূমিক্ষয়জনিত কারণে কমে যাবে, সে অনুপাতে তত পরিমাণ কম খাজনা দেওয়ার অধিকারী হবে।

বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন, ১৮৮৫র ৫২ ধারায় একই ধরনের বিধানাবলি সন্নিবেশ করা হয়। এক সংশোধনীতে ৮৬-ক নামে একটি নতুন ধারা বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনে যোগ করা হয়। এই ধারার বিধান অনুযায়ী, যদি কোন প্রজা তার জমি শিকস্তির কারণে হ্রাসকৃত খাজনার সুবিধা পেয়ে থাকে তা হলে সেক্ষেত্রে ধরে নেওয়া হবে যে, ঐ প্রজা শিকস্তি জমিতে তার অধিকার সমর্পণ করেছে অথবা তার সে অধিকার লুপ্ত হয়েছে। ১৯৩৮ সালে এই বিধানটিকে আবার সংশোধন করা হয়। এর আওতায় এই মর্মে নিশ্চয়তার ব্যবস্থা করা হয়, ভূমি ক্ষয় বা শিকস্তির ২০ বছরের মধ্যে জমি পুনর্গঠিত হলে জমির খাজনা হ্রাস সত্ত্বেও তার ঐ জমি ফেরত পাওয়ার অধিকার বহাল থাকবে।

১৯৫০ সালের জমিদারি তালুক হুকুমদখল ও প্রজাস্বত্ব আইনে ভূমিবৃদ্ধি বা পয়স্তি সম্পর্কিত একটি সুনির্দিষ্ট বিধান সন্নিবেশিত করা হয়। এ যাবৎকাল বিষয়টি ১৮২৫ সালের ১১নং নিয়ামক প্রবিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো। ১৯৫০ সালের আইনে এই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বিধানটি ৮৭ ধারার আকারে সংযোজিত হয়। শিকস্তি জমির জন্য খাজনা হ্রাসের বিধান এবং অনুরূপ জমিতে প্রজার অধিকারমূলক বিধানাবলি ১৯৫০ সালের আইনের ৮৬ ধারায় সন্নিবেশ করা হয়। এই বিধানগুলি ৮৬(ক) ধারায় সন্নিবেশিত বিধানের অনুরূপ। ১৯৭২ সালের ৪ আগস্ট রাষ্ট্রপতির ১৩৫ নং আদেশ জারি করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল জমি শিকস্তির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট জোত বা জমির খাজনা হ্রাস এবং খাজনা হ্রাসের ব্যবস্থা করা। তবে এইসঙ্গে এই বিধানও যুক্ত করা হয় যে, শিকস্তি জমিতে প্রজার মালিকানার অধিকার লুপ্ত হবে এবং ঐ জমি পুনরায় গঠিত হলে তা সরকারে বর্তাবে। তবে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হবে এই যে, জমির মূল বা আদি অবস্থান সংক্রান্ত অধিকার যদি সার্বজনীন আইন ও ন্যায়বিচারের বুনিয়াদে ঘোষিত হয়ে থাকে এবং ১৮২৫ সালের ইতিবাচক আইনের মঞ্জুরি এক্ষেত্রে থেকে থাকে তাহলে সেগুলি বাতিলের আগে যদি আদালত বা কোন উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক চূড়ান্তভাবে কোন জমির ওপর প্রজার পূর্ণ দখলের অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়ে থাকে তাহলে ঐ জমি প্রজার ওপরেই বর্তাবে। সকল চর/জমি সেটি জমির মূল অবস্থানে পুনর্গঠিত হয়ে থাকুক কিংবা তা নতুন ভূমি গঠন হোক, সেসব জমি খাসজমি হিসেবে ঘোষিত হয়। ১৯৯৪ সালে অবশ্য এই অবস্থানটি আবার বদলে যায়।

১৯৯৪ সালের ১৫ নম্বর আইন সংশোধনবলে সন্নিবেশিত বিধানে শিকস্তিক্রমে ভূমিক্ষয় ঘটে থাকলে তার জন্য খাজনা হ্রাস এবং ৬০ বিঘা জমির সিলিং-এর শর্তে ৩০ বছরের মেয়াদে জমির মূল অবস্থানে জমি পুনর্গঠিত হলে সেই জমিতে প্রজার অধিকার বহাল রাখার ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৯৪ সালের ১৫ নম্বর আইন সংশোধনের মাধ্যমে যেভাবে নিষ্পত্তি করা হয় সেভাবেই জমির মূল অবস্থানে পুনর্গঠিত জমির মালিকানার অধিকার সম্পর্কিত বর্তমান আইনগত অবস্থানও বিন্যস্ত। অর্থাৎ জমির শিকস্তি ঘটলে ঐ জমির মালিকানা পাবে প্রজা এবং ৩০ বছর পর যদি মূল অবস্থানে ভূমি পুনর্গঠিত হয় তাহলে সেই জমি হবে সরকারের সম্পত্তি। মালিক শনাক্ত করার সুবিধার জন্য রাজস্ব কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে খাজনা হ্রাস সংক্রান্ত একটি প্রত্যয়নপত্রের প্রয়োজন হবে।

জমির মূল অবস্থানে পুনর্গঠিত হিসেবে চিহ্নিত জমিগুলি ছাড়া সকল পয়স্তি জমিকে মোটামুটি দুই শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে। আর এভাবে শ্রেণিবিভক্তির ভিত্তি হবে নদীতলের মালিকানার বিষয়টি। ১৮২৫ সালের প্রবিধানটি এমন সময় জারি করা হয় যখন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলবৎ ছিল। এই বন্দোবস্ত প্রথার আওতায় দু’ধরনের নদী অস্তিত্বশীল বলে ধরে নেওয়া হয়: ক. ছোট ও অগভীর নদী, যার নদীতলে জলকর অধিকার (মাছ চাষের অধিকার) রয়েছে এবং এ সম্পত্তি ব্যক্তিগত সম্পত্তি; খ. বড় ও নাব্যনদী, যে নদীর নদীতল সরকারি বা জনসাধারণের এলাকার অংশ। ছোট ও অগভীর নদীতে কোন চর জেগে উঠলে যেহেতু ঐ নদীর নদীতল কোন ব্যক্তির মালিকানাধীন সেহেতু চরটি ঐ ব্যক্তির মালিকানাধীন থাকবে। এটি যে নীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত তা জমির মূল অবস্থানে পুনর্গঠিত জমির মালিকানার অধিকার নির্ধারক নীতির অনুরূপ।

১৯৫৬ সালে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পর জলকরের অধিকার রয়েছে এমন সকল ছোট ও অগভীর নদী সরকার অধিগ্রহণ করেন। ফলে ১৯৫৬ সালের পর থেকে এসব ছোট ও অগভীর নদীতে জেগে ওঠা চরগুলি তখন রাষ্ট্রের সম্পত্তি হয়ে ওঠে। বড় নাব্যনদী বা সমুদ্রে গঠিত চরে মালিকানা অধিকারের ক্ষেত্রে নদী বা সমুদ্রতল এলাকা যা সরকারি বা জনগণের এখতিয়ার সে বিষয়টি প্রবিধানের আওতায় বিচার করা হয় তিনটি ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতির ধারণায়। পয়স্তি জমি মালিকানার বেলায় সাধারণ আইন হচ্ছে, অলক্ষ্যে ও ধীর গতিতে চর গঠিত হলে তার অর্থ হবে এই যে, এটি সংশ্লিষ্ট নদী বা সমুদ্রে নিজ জমির সম্প্রসারণ হিসেবে পরিগণ্য। তবে এ ধরনের চরকে জমির মূল অবস্থানে ভূমির পুনর্গঠন বা পুনরাবির্ভাব হিসেবে দাবি করা যাবে না। কেননা, এর উদ্ভব ঘটে সরকারি নাব্যনদীতে, যা কোন ব্যক্তির সম্পত্তি নয়। কোন বড় আকারের নাব্যনদী বা সমুদ্রে কোন চর জেগে উঠলে এবং সেই চর একটি প্রণালী দ্বারা উপকূলভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হলে ও ঐ প্রণালী সংবৎসর নাব্য হলে জমি রাষ্ট্রের সম্পত্তি হবে। তবে চর ও উপকূলের মধ্যবর্তী প্রণালীটি যদি পায়ে হেঁটে বছরের যেকোন ঋতুতে পারাপারযোগ্য হয় তাহলে ঐ চর উপকূলভাগের সবচেয়ে নিরবচ্ছিন্ন জমির সম্প্রসারণ হিসেবে গণ্য হবে। এই প্রবিধানে আরও একটি পরিস্থিতির জন্য বিধিব্যবস্থা রয়েছে যাকে রোমান আইনে এভালশান (জমি বিচ্ছিন্নকরণ ও সংযুক্তকরণ) বলা হয়। এক্ষেত্রে পয়স্তি-সম্পর্কিত যে সাধারণ আইনের বিষয় উপরে বর্ণিত হয়েছে তার ব্যতিক্রম ঘটে। যদি কখনও কোন নদী আকস্মিক গতি পরিবর্তনের মাধ্যমে কোনরকমে ক্রমান্বয়ে ধীর অনুপ্রবেশ ব্যতিরেকেই একটি তালুকের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায় কিংবা ঐ স্রোতধারার প্রবল তোড়ে তালুকের একখন্ড জমি তালুক থেকে আলাদা হয়ে যায় এবং চিহ্ন-পরিচয় লুপ্ত না করে অন্য একটি তালুকের সঙ্গে সম্মিলিত হয় তাহলে সে ধরনের জমি স্পষ্টভাবে চিহ্নিত হওয়া সাপেক্ষে ঐ জমি মূল মালিকেরই সম্পত্তি থাকবে।

চর গঠন

এই বিধানে পয়স্তির যে আইন সন্নিবেশিত হয় তা ১৯৫০ সালের পূর্ববঙ্গ জমিদারি তালুক হুকুমদখল ও প্রজাস্বত্ব আইনের ৮৭ ধারায় নতুন বিধান প্রবর্তনের আগে পর্যন্ত বলবৎ ছিল। পয়স্তি সম্পর্কিত প্রবিধানটির পুরানো বিধান বহাল রেখে এতে এ মর্মে একটি ব্যতিক্রমের বিধান রাখা হয়েছে যে, পয়স্তির অধিকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মোট জোত মালিকানার একটি সিলিং অবধি সীমিত থাকবে এবং এই অধিকার সরকার কর্তৃক গৃহীত উন্নয়নমূলক কাজ হিসেবে কোন কৃত্রিম বা যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট পয়স্তির ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত হবে না।

১৯৭২ সালের ২৮ জুন পয়স্তিতে নদীর কিনারের জমিমালিকের অধিকারও ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির ৭২নং আদেশে বাতিল হয়ে যায়। ১৯৫০ সালের জমিদারি তালুক হুকুমদখল ও প্রজাস্বত্ব আইনের সংশোধিত ৮৭ ধারার বিধান অনুযায়ী, নদী বা সমুদ্রের যে কোন অংশ থেকেই পয়স্তি বা ভূমিগঠিত হয়ে থাকুক না কেন, সেটি কোন ব্যক্তির জোত বা জমির সম্প্রসারণ বলে বিবেচিত হবে না, তা নিরঙ্কুশভাবে সরকারের মালিকানায় বর্তাবে। তবে ঐসব ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই মর্মে একটি রেয়াত প্রদানের ব্যবস্থা হয়েছে যে, ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির ৭২ নং আদেশ শুরুর তারিখের আগেই আবির্ভূত চরের পয়স্তির ক্ষেত্রে তাদের অধিকার চূড়ান্তভাবে আদালত বা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছে। আজকের আইনগত অবস্থা হচ্ছে এই যে, শিকস্তির ৩০ বছরের মধ্যে মূল অবস্থানে পুনর্গঠিত জমি ছাড়া সকল চরভূমি রাষ্ট্রের সম্পত্তি। এসব চরের জমি বিধিবিধান মোতাবেক সরকার বন্দোবস্ত দিতে পারেন।

পয়স্তি জমি জোর করে নিয়ন্ত্রণে নেওয়া ও রাখার কাজ সাধারণভাবে চরদখল নামে অভিহিত। সরকারি প্রশাসনের কোনরকম অনুমতি বা মঞ্জুরি ছাড়াই মূল অবস্থানে পুনর্গঠিত জমি পুনর্দখল করার অবাধ অধিকার একজন শিকস্তি জমিমালিকের রয়েছে। একইভাবে নদী-তীরবর্তী মালিক নতুন চরের জমি দখলে নেওয়ারও অধিকারী যদি ঐ নতুন চর ধীরে ক্রমান্বয়ে তার জমির সাথে লাগোয়া আকারে গড়ে ওঠে। এক্ষেত্রে তার একটি মাত্র দায়িত্ব রয়েছে, আর সেটি হলো কর বা খাজনা প্রদান করা। সম্পত্তিতে এই রদ-অযোগ্য অধিকারের ভিত্তি সার্বজনীন আইন ও ন্যায়বিচারের বুনিয়াদে প্রতিষ্ঠিত বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে যা ১৮২৫ সালের নিয়ামক প্রবিধানে বিধিবদ্ধ। আর এ কারণেই জমিদার ও অন্যান্য জোতের স্বত্বাধিকারীরা যখন যেখানে নতুন চর জেগেছে সেগুলি বলপ্রয়োগে গ্রাস করতে উৎসাহিত হয়েছে। তারা সুযোগ ও পরিস্থিতি অনুযায়ী ঐ চরের জমিকে মূল অবস্থানে পুনর্গঠিত শিকস্তি জমি অথবা জমিসংলগ্ন বিবৃদ্ধি হিসেবে দাবি করেছেন। অবশ্য প্রতিপক্ষের তরফ থেকে একই ধরনের দাবি উত্থাপিত হয়ে থাকে।

নতুন চরের জমি অত্যন্ত উর্বর, তা থেকে বেশ মোটা সালামি ও নতুন খাজনা পাওয়া যাবে বিধায় এর অনিবার্য ফল হিসেবে চর দখলে সহিংসতা প্রয়োগ করা হয়। এর ফলে দাঙ্গাহাঙ্গামা ও খুনাখুনি ঘটে। এ ধরনের চরের জমি আগেভাগে দখলে নেওয়ার স্পষ্টতই সরেজমিনে তো বটেই, এমনকি, আইন আদালতেও একটি সুবিধা পাওয়া যায়। তাই এক বা অন্য তরফের অনুকূলে আইনে যা কিছুই ভালমন্দ থাকুক না কেন কার্যত পেশিশক্তি চর শাসন করে। অতীতে এ ধরনের পরিস্থিতি বিরাজমান থাকার কারণে কর্তৃপক্ষ ১৯২০ সালে বঙ্গীয় পলিগঠিত ভূমি আইন পাস করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল পয়স্তি কিংবা সাগরের নিকটবর্তী কোন নদী মজে যাওয়ার কারণে যেসব জমি গড়ে ওঠে সেইসব জমির দখল-সংক্রান্ত বিরোধ নিবারণ করা। এ আইনে বিধান সন্নিবেশিত করা হয় যে, যদি কালেক্টর বিশ্বস্তসূত্রে অবহিত হন যে, কোন পয়স্তি জমি নিয়ে কোন বিরোধ শান্তিভঙ্গের কারণ ঘটাতে পারে তেমন কারণ অস্তিত্বশীল অথবা এমন কারণের উদ্ভব ঘটতে পারে যে জমি তার মতে সম্প্রতি গঠিত হয়েছে, তাহলে সেই পরিস্থিতিতে তিনি এক লিখিত আদেশবলে জমি ক্রোক করে সেটি সীমানা থাম্বা দিয়ে চিহ্নিত করেন। এরপর তিনি জমির ব্যবস্থাপনার জন্য একজন রিসিভার নিয়োগের পরে ঐ জমিতে যাদের দাবি রয়েছে তাদের আবেদনপত্র দাখিলের জন্য আমন্ত্রণ জানাতে পারেন এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এই দাবিদারদের একটি তালিকা জেলা জজের কাছে পাঠাতে পারেন। জেলা জজ ঐসব দাবিদারকে স্বত্বাধিকারী বলে প্রত্যয়ন পত্র প্রদান করবেন। কালেক্টার এই চর/জমির জরিপ করাবেন ও একটি ম্যাপ তৈরি করবেন, এই ম্যাপের বিষয় বিপরীত কিছু প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নিখুঁত ও সঠিক বলে গণ্য হবে। এই আইনটি ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৫ ধারার আওতায় যেসব নিবারণমূলক তৎপরতার বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে তারই অনুরূপ। যখন কালেক্টর এই মর্মে নিশ্চিত হন যে, একটি বিরোধ শান্তিভঙ্গের কারণ হতে পারে, তেমন কারণ বর্তমান অথবা তেমন কারণের উদ্ভব হতে পারে সেই পরিস্থিতিতেই কেবল ঐ ধারায় উল্লেখিত ব্যবস্থাগুলি গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে বলপূর্বক এ ধরনের জমি দখল করার ক্ষেত্রে এসব নির্ধারিত ব্যবস্থা কোন উপকারে আসে না। স্বভাবতই এই আইন কদাচিৎ কাজে লাগনো হয়েছে, বরং পেশিশক্তি আধিপত্য বজায় রেখে চলেছে।

জমিদারি প্রথার অবসানের পর আশা করা হয়েছিল পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পরবর্তীকালে যেসব ঘটনা ঘটে তাতে সেই প্রত্যাশা মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়। জমিদাররা বিদায় নিলেও অর্থবল ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী বড় বড় জোতদার ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা সাবেক জমিদারদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় এবং আগের মতোই চরের জমি গ্রাস করতে থাকে। নদী শিকস্তির ঘন ঘন পুনরাবৃত্তির সবচেয়ে গুরুতর আর্থসামাজিক প্রতিক্রিয়ায় বিস্তীর্ণ জমি বিলীন হয়ে যায় ও প্রতি বছর হাজার হাজার কৃষক পরিবার গৃহহারা হয়। জমি হুকুমদখলের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা তাদের বাস্ত্তভিটা, জমি ও আয়ের অবলম্বন হারায়। তবে এভাবে ক্ষতিগ্রস্তরা কিছু ক্ষতিপূরণ পায় এবং জমি হুকুমদখলের সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনায় অনেক সময় বাস্তুহারাদের পুনর্বাসনের একটা স্কিমও থাকে। তবে শিকস্তির ক্ষতিগ্রস্তদের ভাগ্যে কিছুই জোটে না। তারা রাস্তার ধারে, বাঁধে, শহর-নগরের খালি জায়গায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। আর এভাবেই গড়ে ওঠে বস্তি। এই বস্তি পরিবেশের জন্য বিপর্যয়কর হয়ে আরও নানা আনুষঙ্গিক সমস্যার সৃষ্টি করে। সর্বস্বান্ত হয়ে এরা সমাজে বেপরোয়া হয়ে ওঠে ও যেকোন অপরাধ ঘটাতে তারা মানসিকভাবে তৈরি হয়ে যায়। এই সর্বহারার দল উচ্চাভিলাষী রাজনৈতিক নেতা ও স্থানীয় জনপদের পেশিধারীদের সহজ শিকার হয়ে ওঠে। এরা তাদেরকে নিজেদের স্বার্থ হাসিলে অপব্যবহার করে। এই লোকগুলিকেই বলপূর্বক চর দখলের কাজে লাগানো হয়। তার বিনিময়ে ভূমিহীন চাষি হিসেবে তারা জমির বরাদ্দ পাবে এমন নিশ্চয়তা তাদের দেওয়া হয়, এমনকি এ বিষয়ে রাজনৈতিক সমর্থন যোগানোরও অঙ্গীকার করা হয়। এই আইনের নিরেট দুর্বলতা হলো এই যে, চর জেগে ওঠার অব্যবহিত পরে ঐ চরের জরিপ করা হয় না। আর জরিপের পরে যে মানচিত্র তৈরি হওয়ার কথা সেই ম্যাপ না থাকায় ঐ চরের জমি কোন জমির মূল অবস্থানের পুনর্গঠিত রূপ না নতুন পয়স্তি বা ভূমিগঠন তা নির্ণয় করা সম্ভব হয় না।

দিয়ারা জরিপে মানচিত্র প্রণয়ন ও নতুন চরের প্রকৃতি নির্ধারণে দীর্ঘসূত্রতার সুযোগ নিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালী লোকেরা চরের জমি দখল করে এবং রাজস্ব দপ্তর থেকে টাকার রশিদের ভিত্তিতে ঐ জমিতে ফসল ফলায়। প্রতিপক্ষের দলগুলিও রাজস্বদপ্তর থেকে এরকমই টাকার রশিদ যোগাড় করে, জাল দলিলপত্র তৈরি করে আর ক্ষেতের উঠতি ফসল কেটে নিয়ে যায়। ফসল কাটার মৌসুমে এলাকায় পুলিশ ক্যাম্প বসিয়ে সেখানে দাঙ্গাহাঙ্গামা ও সহিংসতা নিবারণের চেষ্টা করা হলেও এই ব্যবস্থা ফলদায়ক প্রমাণিত হয় নি। ১৯৯৪ সালের সংশোধনীর উদ্দেশ্য হলো চরভূমির দখল নেওয়ার প্রাথমিক দায়িত্ব সম্পর্কিত পরিস্থিতির উন্নয়ন সাধন। এ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কালেক্টরকে যিনি চরভূমির জরিপ ও তার ম্যাপ তৈরির পর যাদের জমি শিকস্তিতে পড়েছে তাদেরকে মূল অবস্থানে পুনর্গঠিত জমির বরাদ্দ দেবেন। এই ব্যবস্থার সাফল্য নির্ভর করে জরিপ পরিচালনা, চর জাগার অব্যবহিত পরেই চরের ম্যাপ তৈরি ও রাজনৈতিক চাপ সত্ত্বেও চর দখল নিতে পারার সরকারি প্রশাসনের সামর্থ্যের ওপর।  [আমিনুল হক]