নৌপরিবহণ

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৬:৫২, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ

নৌপরিবহণ  অভ্যন্তরীণ নৌপথ নেটওয়ার্ক। বাংলাদেশ ভূখন্ডের দুই-তৃতীয়াংশ বন্যায় আক্রান্ত হয় এবং অধিকাংশ এলাকাই বছরের দুই থেকে পাঁচ মাস পানিতে ডুবে থাকে। তাই সড়ক ও রেলপথের উন্নয়ন এবং রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় তুলনামূলকভাবে বেশি। পক্ষান্তরে, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ বাংলাদেশে সবসময়ই একটি প্রাকৃতিক ও তুলনামূলকভাবে স্বল্প ব্যয়ের পরিবহণ মাধ্যম। কোন কোন এলাকায় এটি পরিবহণের একমাত্র মাধ্যম। দেশের অশ্রেণিকৃত রুটসহ নৌপথের (৭০০ নদী) মোট দৈর্ঘ্য হচ্ছে প্রায় ১৩ হাজার কিলোমিটার। বর্ষাকালে মোট নৌপথের ৮,৪৩৩ কিলোমিটারে বড় নৌযান চলতে পারে। এর মধ্যে ৫,৯৬৮ কিলোমিটার নৌপরিবহণের জন্য শ্রেণিকৃত এবং শুষ্ক মৌসুমে নৌপরিবহণ পথের দৈর্ঘ্য শ্রেণিকৃত ৩,৮৬৫ কিলোমিটারসহ প্রায় ৪,৮০০ কিলোমিটারে কমে আসে। বিআইডব্লিউটি কর্তৃক চারটি বিভাগে ভাগ করা অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণের জন্য নৌপথগুলি হচ্ছে:

শ্রেণি ১: চারটি ট্রাঙ্ক নৌপথ (গভীরতা ৩.৬৬ মি থেকে ৩.৯ মি, দৈর্ঘ্য প্রায় ৬৮৩ কিমি): যেমন- চট্টগ্রাম-চৌকিঘাটা-চাঁদপুর-শম্ভুপুরা-নারায়ণগঞ্জ/ঢাকা; শম্ভুপুরা-ডেমরা; শম্ভুপুরা-ভৈরববাজার/ আশুগঞ্জ এবং চৌকিঘাটা-বরিশাল-মংলা-খুলনা-মহেশ্বরপাশা।

শ্রেণি ২: আটটি সংযোগ নৌপথ (গভীরতা ১.৮৩ মি থেকে ৩.৬৫ মি দৈর্ঘ্য প্রায় ১০০০ কিমি): যেমন- মোহনপুর-দৈখাওয়া; ভৈরববাজার-ছাতক; চালনা-রাইমঙ্গল; হিজলা-শায়েস্তাবাদ; সাতনল-দাউদকান্দী; চট্টগ্রাম-কক্সবাজার; দিয়ারা-বরিশাল ভায়া নন্দীর বাজার এবং চাঁদপুর-ইছুলি।

শ্রেণি ৩: ১২টি মাধ্যমিক নৌপথ (গভীরতা ০.৯১ মি থেকে ১.৮২ মি দৈর্ঘ্য প্রায় ১,৯০৫ কিমি): যেমন- দিলালপুর-ফেঞ্চুগঞ্জ-জাকিগঞ্জ; চট্টগ্রাম-কাপ্তাই; রাঙ্গামাটি-কাপ্তাই; কাপ্তাই-বিলাইছড়ি; রাঙ্গামাটি-ছোট হরিণা; রাঙ্গামাটি-মহালছড়ি, রাঙ্গামাটি-মরিশা; শ্রীপুর (ভোলা)-নাজিরপুর-চর মন্তাজ; ঝালকাঠি-বরগুনা-পাথরঘাটা; চর পাওয়ার-পটুয়াখালী-গলাচিপা-বড় বাইশদিয়া; বড় বাইশদিয়া-খেপুপাড়া-মহীপুর; এবং খুলনা-বরদিয়া-মানিকদহ। এবং

শ্রেণি ৪: মৌসুমি নৌপথ (গভীরতা ০.১৯ মিটারের কম, দৈর্ঘ্য প্রায় ২,৩৮০ কিমি)।

উল্লিখিত নৌপথগুলি ছাড়াও অনেক অশ্রেণিকৃত নৌপরিবহণ পথ রয়েছে। এসবের একটা বড় অংশেই মূলত দেশি নৌকায় পরিবহণ ব্যবস্থা চালু আছে।

অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ  অাঁকাবাঁকা নদীপথবহুল বাংলাদেশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবহণ ব্যবস্থা যা জাতীয় জীবনে বিরাটি ভূমিকা পালন করে। দেশের প্রায় সকল বড় শহর এবং বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে উঠেছে নদীর তীরে। ব্রিটিশ শাসনামলে ইন্ডিয়ান জেনারেল নেভিগেশন (আইজিএন) এবং রিভার স্টিম নেভিগেশন (আরএসএম)-এর মালিকানাধীন বাষ্পচালিত নৌযান প্রচলনের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশের এ অংশে বেসরকারি খাতে যন্ত্রচালিত অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ চালু হয়। ব্রিটিশ শাসন এবং পাকিস্তান আমলের পুরো সময় জুড়ে এগুলির আধিপত্য বজায় ছিল। ১৯৬০-এর দশকে পাক-বে, সিনক্লেয়ার মুরে এবং চালনা লাইটারেজ নামক কিছু স্থানীয় সংস্থা মাল পরিবহণ খাতে এবং পাক ওয়াটারওয়েজ যাত্রী পরিবহণ খাতে কাজ শুরু করে। যাত্রী এবং মালামাল পরিবহণ পুরোটাই বেসরকারি খাতে পরিচালিত হতো এবং নৌপরিবহণ যানের সত্তর শতাংশ ছিল ব্রিটিশ কোম্পানিসমূহের মালিকানাধীন।

১৯৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষ (ইপিআইডিব্লিউটিএ) প্রতিষ্ঠার পর দ্রুত বেশকিছু পরিবর্তন সাধিত হয়। নৌপথে চলাচল ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটে, চালনা বন্দর প্রতিষ্ঠা করা হয়, নৌপথের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পায় এবং সারাদেশের মাল ও যাত্রী উঠানামার বহু ঘাট প্রতিষ্ঠিত হয়। যথেষ্ট চাহিদা থাকায় আইডব্লিউটিএ ১৯৬০-এর দশকের শুরুতে ৪০০টি গ্রে মেরিন ডিজেল ইঞ্জিন আমদানি করে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের নিকট বিতরণ করে। এর ফলে যাত্রী পরিবহণ খাতে ব্রিটিশ মালিকানাধীন কোম্পানিসমূহের একাধিপত্য নষ্ট হয় এবং দেশিয় পরিচালকদের মালিকানাধীনে বেশ কিছুসংখ্যক কাঠনির্মিত যাত্রীবাহী নৌযান দেশের নদীপথে চলাচল শুরু করে। ব্রিটিশ শাসনামলে নৌপরিবহণ খাতে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালনকারী আইজিএল ও আরএসএন কোম্পানিদ্বয় গুরুত্বপূর্ণ নদীপথসমূহের সংস্কার কাজ পরিচালনা করে এবং তাদের নিজস্ব বাণিজ্যিক স্বার্থে নদী-তীরবর্তী কয়েকটি স্টেশনে স্থানীয় মালিকদের নৌযানগুলিকে অবতরণ সুবিধা প্রদান করে। পরবর্তীকালে আইডব্লিউটিএ আরএসএন ও আইজিএলকে পাকিস্তান রিভার স্টিমারস (পিআরএস) নামক একটি দেশিয় কোম্পানিতে পরিণত করে। বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার পর পিআরএস এবং পাক বে ফ্লোটিলাসহ সকল পরিত্যক্ত কোম্পানি অধিগ্রহণ করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্পোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) নামক সরকারি সংস্থা গঠন করা হয়। জাতীয়করণ সত্ত্বেও দেশে যাত্রী পরিবহণের ৮৫ শতাংশ এখনও বেসরকারি খাতের মালিকানাধীন নৌযানের মাধ্যমে পরিচালিত হয়।

১৯৬০-এর দশকের প্রথম দিকে আইডব্লিউটিএ বেসরকারি খাতে ২৪টি কোস্টার সংগ্রহের একটি প্রকল্প চালু করে। ৬০০-১,০০০ টন পরিবহণ ক্ষমতাসম্পন্ন এ সকল কোস্টার বঙ্গোপসাগরে চলাচলে সক্ষম ছিল এবং এগুলি  চট্টগ্রাম বন্দর থেকে চলাচল করত। এভাবে বেসরকারি খাত বিশেষায়িত সেবার একটি নতুন ক্ষেত্রে প্রবেশ করে এবং এই খাত স্বল্পব্যয়ে দেশের সমুদ্রবন্দরে জাহাজজট কমানো এবং অধিক পরিমাণে মালামাল পরিবহণে সহায়তা করে। বর্তমানে বঙ্গোপসাগরীয় নৌপথে ১০০টিরও অধিক কোস্টার চলাচল করছে। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় ভারতের প্রায় ১৯৩টি চওড়া পাটাতনের নৌযান, বার্জ, টাগ প্রভৃতি আটক করা হয় এবং হাইকোর্ট এগুলিকে যুদ্ধে অর্জিত পুরস্কার হিসেবে ঘোষণা করে। পরবর্তী সময়ে এ সকল নৌযানের অধিকাংশই বেসরকারি খাতে বিক্রয় করা হয়। সময়ের সাথে সাথে অভ্যন্তরীণ মালামাল পরিবহণ ব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন আসে এবং কালক্রমে ৮০ থেকে ৩৫০ টন পরিবহণ ক্ষমতাসম্পন্ন স্বয়ংচালিত নৌযানের চাহিদা সৃষ্টি হয়। আবারও বেসরকারি খাত এই চাহিদা পূরণে এগিয়ে আসে এবং আইডব্লিউটিএ-র বিশেষজ্ঞ সেবার সাহায্য নিয়ে বেসরকারি খাতে বিপুলসংখ্যক স্বয়ংচালিত নৌযান প্রস্ত্তত করা হয়। বর্তমানে বেসরকারি মালিকানায় মোট ২,৬৮,৬০৩ টন পরিবহণ ক্ষমতাসম্পন্ন ১,১১৫টি স্বয়ংচালিত নৌযান রয়েছে। অয়েল ট্যাঙ্কার খাতেও একই ধরনের বৃদ্ধি ঘটে এবং এর ফলে অয়েল ট্যাঙ্কারের সংখ্যা ও মোট ক্ষমতা  দাঁড়ায় যথাক্রমে ৭২ এবং ৬৭,৯৩৬ টন।

অভ্যন্তরীণ বন্দর ও অবতরণ স্টেশন  নির্ধারিত দায়িত্বের অংশ হিসেবে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ খাতের উন্নয়ন তত্ত্বাবধানের ধারায় বিআইডব্লিউটিএ অভ্যন্তরীণ নৌবন্দরসমূহের উন্নয়নের প্রকল্প হাতে নেয়। প্রাথমিক পর্যায়ে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, বরিশাল এবং খুলনায় পাঁচটি প্রধান অভ্যন্তরীণ বন্দর প্রতিষ্ঠিত হয়। সরকার ১৯৬০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর এক গেজেট নোটিফিকেশন দ্বারা ১৯০৮ সালের বন্দর আইনের প্রবিধানসমূহ এই পাঁচটি অভ্যন্তরীণ নৌবন্দরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলে ঘোষণা করেন। পরবর্তী সময়ে আইডব্লিউটি খাতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ছয়টি নতুন অভ্যন্তরীণ  নদীবন্দর প্রতিষ্ঠা করা হয় পটুয়াখালী (১৯৭৫), নগরবাড়ি (১৯৮৩), আরিচা (১৯৮৩), দৌলতদিয়া (১৯৮৩), বাঘাবাড়ি (১৯৮৩) এবং নরসিংদী (১৯৮৩)-তে।  পদ্মা ও  যমুনা নদীর অপর পাড়ে অবস্থিত জেলাসমূহের সাথে ফেরি সার্ভিসের মাধ্যমে রাজধানী নগরীর যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বিআইডিব্লিউটিএ আরিচা, দৌলতদিয়া, নগরবাড়ি, মাওয়া এবং চরজানাজাত-এ পাঁচটি ফেরি টার্মিনাল গড়ে তোলে। বিআইডব্লিউটিএ জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য বিবিধ সুবিধা চালু করেছে।          

প্রধান প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র এবং শহরসমূহের অভ্যন্তরীণ নদীবন্দরসমূহের উন্নয়ন ছাড়াও দূরদূরান্ত এলাকা থেকে নদীপথে আগত জনগণের অবতরণ সুবিধার প্রয়োজনীয়তাও তীব্রভাবে অনুভূত হয়। বিআইডব্লিউটিএ গুরুত্বপূর্ণ লঞ্চঘাটসমূহের উন্নয়নের প্রকল্প হাতে নেয়। ১৯৬৯ সালে ৫০টি লঞ্চঘাট উন্নয়নের প্রথম প্রকল্প উদ্বোধন করা হয়। এরপর ১৯৭০, ১৯৭৫, ১৯৮০ এবং ১৯৮৬ সালে আরও অনেক লঞ্চঘাট উন্নয়নের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। বিএডব্লিউটিএ সর্বমোট ২৯২টি লঞ্চঘাট উন্নয়নের কাজ সম্পন্ন করেছে। লঞ্চঘাটসমূহে নির্মিত সুবিধাদির মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন আকারের ভাসমান পন্টুন। পন্টুনগুলি কাঠের জেটি ও গ্যাঙওয়ে দিয়ে তীরের সাথে যুক্ত এবং এগুলি জাহাজ ভেড়ানো, যাত্রীদের ওঠানামা এবং মালামাল বোঝাই ও খালাস করার কাজে ব্যবহূত হয়। পন্টুনের উপরে মহিলা ও পুরুষ যাত্রীদের জন্য বিশ্রামাগার ও টয়লেট রয়েছে।

অভ্যন্তরীণ নদীবন্দর পরিচালনায় ইঞ্জিনিয়ারিং, সংরক্ষণ ও নৌচালনা এবং বন্দর ও ট্রাফিক বিভাগ নামে বিআইডব্লিউটিএ-র তিনটি বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে। ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের আওতায় আছে নির্মাণ, নদীতীরে টার্মিনাল ভবন ও অন্যান্য সুবিধাদি নিশ্চিত করা এবং টার্মিনাল ছাউনি, জেটি, চলাফেরার পথ, অবতরণস্থান, গুদাম, রাস্তা এবং পার্কিংয়ের জায়গা পরিচর্যা ও মেরামত করা। সংরক্ষণ এবং নৌচালনা বিভাগ পন্টুন, বয়া, মুরিং ইত্যাদি ভাসমান কাঠামো সরবরাহ করে। বন্দর ও ট্রাফিক বিভাগের প্রধান কাজ উল্লিখিত সুবিধাদি চালু রাখা এবং সেসবের ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে বন্দর রাজস্ব আদায় করা। বিআইডব্লিউটিএ-র হাইড্রোলজি বিভাগ নিরাপদ ও কার্যকর নৌচালনা এবং অন্যান্য ব্যবহার নিশ্চিত করতে নৌপথের রক্ষণাবেক্ষণ পরিচালনা করে। ১৯০৮ সালের বন্দর আইন এবং ১৯৬৬ সালের বন্দর বিধান অনুযায়ী বন্দরসমূহ পরিচালনা করা হয়। বন্দর ব্যবস্থাপনার প্রধান বিষয়সমূহ হচ্ছে সকল প্রকার বন্দরসুবিধার ব্যবহার কার্যকর করা, চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা, এবং অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণের সাথে অন্যান্য ধরনের পরিবহণ, সমুদ্রবন্দর এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ও কৃষিবিষয়ক কাজের সমন্বয় সাধন করা। অভ্যন্তরীণ নদীবন্দরসমূহের পরিচালনা কার্যক্রমের মধ্যে আছে বন্দরের কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ক কার্যক্রম, বড় বড় নৌযান রাখার পোতাশ্রয়ের স্থান নির্ধারণ, যাত্রী উঠানামার ব্যবস্থা এবং মালামাল বোঝাই ও খালাসকরণের ব্যবস্থা করা। এছাড়া কার্গোসমূহের ট্রান্সশিপমেন্ট, বন্দর এলাকায় অবৈধ কার্যক্রম রহিতকরণ, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদকরণ, আবহাওয়ার সঙ্কেত প্রচার, ঝড়ো হাওয়ার সময় বড় বড় নৌযানের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ, বিধি-বহির্ভূতভাবে নৌযানসমূহে অবৈধ চলাচল রহিতকরণ, সংশ্লিষ্ট অন্যান্য স্থানীয় এজেন্সির সাথে সমন্বয়সাধন, সহজে চোখে পড়ে এরূপ স্থানে বন্দরের বিভিন্ন ভাড়ার হার প্রদর্শন ইত্যাদিও এই কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত। নদীবন্দর পরিচালনা কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিত হয় ১৯০৮ সালের বন্দর আইন, ১৯৬৬ সালের বন্দর বিধান এবং ১৯৫৮ সালের বিআইডব্লিউটিএ অধ্যাদেশ অনুযায়ী। বন্দরের কর্মকর্তা রিভার ট্রাফিক পুলিশ, শিপিং ইন্সপেক্টর এবং লঞ্চ মালিক সমিতির সাথে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করে।

বিআইডব্লিউটিএ অবশ্য জনশক্তির স্বল্পতা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক বাধার কারণে বন্দরের সব সুবিধা সরাসরি নিজস্ব তত্ত্বাবধানে বাস্তবায়ন করতে পারে না। কিছু কিছু সুবিধা ইজারাদার কর্তৃক বাস্তবায়ন করা হয়, তাদেরকে সম্পৃক্ত করা হয় বাৎসরিক ভিত্তিতে নিলাম, পুনঃনিলাম, টেন্ডার এবং সমঝোতামূলক আলোচনার মাধ্যমে। ১৯৯১-৯২ সাল থেকে ইজারাদারদের শুধু সীলমোহরকৃত টেন্ডারের মাধ্যমে কাজে লাগানো হয়। বিআইডব্লিউটিএ-র তৈরি ২৯২টি লঞ্চঘাটের সবকটিই রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে সীলমোহরকৃত টেন্ডারের মাধ্যমে বাৎসরিক ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া ইজারাদারদের দ্বারা। ইজারাদারদের কাজ বিআইডব্লিউটি-এর সঙ্গে স্বাক্ষরিত দ্বিপাক্ষিক চুক্তির শর্তাবলি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং বন্দর কর্মকর্তাগণ তাদের তত্ত্বাবধান করেন।

আইডব্লিউটিএ নৌবহর এবং অনানুষ্ঠানিক সেক্টর  অভ্যন্তরীণ নৌপবিহণ নেটওয়ার্কে মূলত যাত্রীবাহী নৌকা, মালবাহী নৌকা, ট্যাঙ্কার, টাগবোট এবং ডামক্রাফটসের সমন্বয়ে গঠিত। সি ট্রাক এবং ফেরিসহ রেজিস্ট্রিকৃত যাত্রীবাহী নৌকার সংখ্যা ১,৮৬৮, ট্যাঙ্কার এবং কোস্টারসহ মালবাহী নৌকা ২,১৬০, ডামক্রাফট ৭৬০ এবং টোয়িং নৌকার সংখ্যা ১৯৪। বর্তমানে (২০১১) বিআইডব্লিউটিসি’র ৯৭টি জাহাজ রয়েছে যার মধ্যে ৪১টি রেজিস্ট্রার্ডকৃত যাত্রীবহনকারী এবং ৫৬টি ফেরি। আনুষ্ঠানিক নৌপরিবহণ খাতের বার্ষিক পরিবহণ ক্ষমতা প্রায় ০.২০ মিলিয়ন যাত্রী এবং ০.৫৫ মিলিয়ন টন মালামাল। পরিবহণ ক্ষমতার বিচারে যাত্রী ও মালামাল পরিবহণে বেসরকারি খাতের অবদান সরকারি খাতের চেয়ে বেশি। বেসরকারি খাত যাত্রীদের ৯৩% এবং মালামালের ৯৫% পরিবহণ করে। অনানুষ্ঠানিক নৌপরিবহণ খাতের প্রধান মাধ্যম নৌকা এবং তা মূলত বর্ষব্যাপী জলপথে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশের নদীপথে চলাচল করেছে প্রায় ৭,৪৫,০০০টি দেশি নৌকা যেগুলির অধিকাংশই ছিল শ্যালোপাম্প ইঞ্জিনচালিত। দেশের প্রায় ৬৫% নৌকা যাত্রীবাহী এবং অবশিষ্ট নৌকা মালামাল বহনকারী। দেশের নৌকাসমূহের মোট মালামাল পরিবহণ ক্ষমতা প্রায় এক মিলিয়ন টন, আনুষ্ঠানিক নৌপরিবহণ খাতের বাহনসমূহের প্রায় দ্বিগুণ। সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ নৌপথ দিয়ে প্রতি বছর প্রায় ১৪% (৮৭.৮০ মিলিয়ন) যাত্রী এবং ৩৫% (.৫৮ মিলিয়ন টন) পণ্য বহন করা হয়।

আন্তঃপথ এবং আন্তঃদেশীয় ট্রাফিক  ব্রিটিশ আমলে আইজিএন এবং আরএসএন  কলকাতা থেকে পূর্ববঙ্গ হয়ে আসামে মালামাল পরিবহণ করত। ১৯৫০-এর দশকের শেষদিকে পাকিস্তান ও ভারত সরকার একটি চুক্তির মাধ্যমে উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য এবং এক দেশের একস্থান থেকে অন্যস্থানে মালামাল নেওয়ার জন্য অপর দেশের জলপথ ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করে। এই চুক্তির নামকরণ করা হয় প্রোটোকল অন ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট অ্যান্ড ট্রেড। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে পাক-ভারত যুদ্ধ শুরুর পূর্বপর্যন্ত এই চুক্তি কার্যকর ছিল। এরপর এটি স্থগিত করা হয়। ১৯৭২ সালের ২৮ মার্চ বাংলাদেশ এবং ভারতের সরকার এই চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করে এবং আটটি বাণিজ্যিক রুট চালু করে। রুটগুলি হচ্ছে, ১. কলকাতা- রাইমঙ্গল- চালনা- খুলনা- মংলা- কাউখালী- বরিশাল- নন্দীরবাজার-চাঁদপুর- আরিচা- সিরাজগঞ্জ- বাহাদুরাবাদ- চিলমারি- ধুবরি; ২. ধুবরি- চিলমারি- বাহাদুরাবাদ-সিরাজগঞ্জ- আরিচা- চাঁদপুর- নন্দীরবাজার- বরিশাল- কাউখালী- মংলা- খুলনা- চালনা- রাইমঙ্গল- কলকাতা; ৩. কলকাতা- রাইমঙ্গল- মংলা- কাউখালী- বরিশাল- নন্দীরবাজার- চাঁদপুর- নারায়ণগঞ্জ ভৈরববাজার- আজমিরিগঞ্জ- মারকুলি- শেরপুর- ফেঞ্চুগঞ্জ- জাকিগঞ্জ- করিমগঞ্জ; ৪. করিমগঞ্জ- জাকিগঞ্জ- ফেঞ্চুগঞ্জ- শেরপুর- মারকুলি- আজমিরিগঞ্জ- ভৈরববাজার- নারায়ণগঞ্জ- চাঁদপুর-নন্দীরবাজার- বরিশাল- কাউখালী- মংলা- রাইমঙ্গল- কলকাতা; ৫. রাজশাহী- গোদাগাড়ি- ধুলিয়ান; ৬. ধুলিয়ান- গোদাগাড়ি- রাজশাহী; ৭. ভৈরববাজার- মিটামইন- ইটনা- লালপুর- সুনামগঞ্জ- ছাতক; এবং ৮. ছাতক- সুনামগঞ্জ- লালপুর- ইটনা- মিটামইন- ভৈরববাজার।

নৌচলাচল নিয়ন্ত্রণ  নৌচলাচল নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাটি মূলত জাহাজ চলাচল অধিদপ্তর কর্তৃক প্রয়োগ করা হলেও সরকার বিআইডব্লিউটিএ (টাইম অ্যান্ড ফেয়ার টেবিল অ্যাপ্রুভাল) রুলস ১৯৭০-এর অধীনে বিআইডব্লিউটিএ-কে যাত্রী বহনকারী নৌযানের সময়সূচি ও যাত্রাপথের অনুমোদন এবং যাত্রী ও মালের ভাড়া নির্ধারণ বিষয়ক কিছু নিয়ন্ত্রণমূলক ক্ষমতা অর্পণ করেছে।

অভ্যন্তরীণ নৌপথে যাত্রী পরিবহণকারী লঞ্চগুলিকে সময়সূচি দিয়ে দেওয়া হয়। এই সময়সূচিতে মধ্যবর্তী স্টেশনগুলির সময়সূচিসহ যাত্রার স্টেশন থেকে ছাড়ার সময় এবং গন্তব্যে পৌঁছার সময় উল্লেখ করা থাকে। গ্রীষ্ম ও শীত এই দুই মৌসুমে দুবার যাত্রীবাহী লঞ্চসমূহের সময়সূচি অনুমোদনের উদ্দেশ্যে আবেদনপত্র আহবান করা হয়। প্রথম মৌসুম ১ জুন শুরু হয়ে ৩১ অক্টোবরে শেষ হয় এবং দ্বিতীয়টি ১ নভেম্বরে শুরু হয়ে ৩০ মে শেষ হয়। অভ্যন্তরীণ জাহাজ চলাচল অধ্যাদেশ (আইএসও) ১৯৭৬-এর প্রবিধান অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র পরীক্ষানিরীক্ষার পর সময়সূচি প্রদান করা হয়। বর্তমানে ৭৩৯টি যাত্রীবাহী লঞ্চকে ২৩০টি রুটে চলাচলের জন্য ৫৯৫টি সময়সূচি প্রদান করা হয়েছে। সরকার ১৯৯১-এর ২১ আগস্ট তারিখ থেকে মালামাল পরিবহণ মাশুলের হার নির্ধারণের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণমুক্ত করেছে। বন্দর ও পরিবহণ দপ্তর নৌচলাচলের জরিপ পরিচালনা করে, নৌচলাচলের পরিসংখ্যান সংগ্রহ ও সমন্বিত করে এবং বার্ষিক বন্দর ও নৌচলাচল প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এসব কাজ নৌচলাচল নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য সহায়তা করে।

নৌচলাচল ব্যবস্থা এবং এর অবদান  বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ ব্যবস্থা খুবই ব্যাপক এবং অন্যান্য পরিবহণ ব্যবস্থার সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। চলাচল ঘনত্বের দিক থেকে অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল নেটওয়ার্ক নৌপথের প্রতিরুট কিলোমিটারে প্রায় ১.৫৭ মিলিয়ন যাত্রী কিলোমিটার সৃষ্টি করে। অভ্যন্তরীণ নৌবন্দর ও টার্মিনালসমূহের চলাচল ঘনত্ব অভ্যন্তরীণ নৌপথের তুলনায় অনেক বেশি। প্রতি ১০০ রুট কিলোমিটারে রয়েছে প্রায় ৩.৭টি জাহাজ ঘাট। অভ্যন্তরীণ নৌপথে যাত্রী উঠানামার স্থান-সুবিধাদির ঘনত্বও প্রতি ১০০ রুট কিলোমিটারে রয়েছে প্রায় চল্লিশের মতো। বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ নৌপথের গুরুত্ব নিম্নে প্রদত্ত সারণি ১ থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় অনিশ্চয়তা থাকলেও এটা সুস্পষ্ট যে যাত্রী ও মালামাল পরিবহণে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ ব্যবস্থা ভবিষ্যতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাবে।

অভ্যন্তরীণ বন্দর এবং ঘাটসমূহ দেশের দুটি সমুদ্র বন্দরের সহায়ক বন্দর হিসেবে কাজ করে থাকে। মালামাল ছাড়াও দেশের ভ্যন্তরীণ বন্দরগুলি দেশের মোট রপ্তানি ও আমদানির প্রায় চল্লিশ শতাংশ এক অভ্যন্তরীণ বন্দর থেকে অন্য অভ্যন্তরীণ বন্দরে পরিবহণ করে থাকে। রাস্তা ও রেল যোগাযোগবিহীন অথবা বাধাগ্রস্ত এলাকায় অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ এবং অভ্যন্তরীণ বন্দরসমূহ 

বন্যা, ঝড় ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মালামাল ও ত্রাণসামগ্রী পরিবহণের মাধ্যমে সেবা প্রদান করে থাকে। নৌপরিবহণ ব্যবস্থা ব্যয়সাশ্রয়ী, তুলনামূলকভাবে নিরাপদ এবং পরিবেশ সহায়ক হওয়ায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাবে। [এ.কে.এম নূরুল আলম]