নারী

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৭:০১, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

নারী যে সকল ইতিহাসবিদ বাংলার প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে কাজ করেছেন তারা বিভিন্ন ঘটনা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে নারী-পুরুষের পার্থক্যকে বিবেচনায় আনেন নি। এ বিবরণসমূহে রানীদের এবং উপলক্ষবিশেষে রাজকীয় ভগিনীদের নাম পরিলক্ষিত হয়, কিন্তু সর্বদাই পুরুষমানুষের সাথে যুক্ত হয়ে। উদাহরণস্বরূপ, একটি কাহিনীতে দেখা যায় যে, পাল রাজা ধর্মপালের স্ত্রী রানী বল্লভদেবীকে বনবাসে পাঠানো হয়। কারণ, তিনি কোনো পুত্রসন্তান জন্ম দিতে পারেন নি। একটি রূপকথা অনুযায়ী বনবাসে থাকাকালীন তিনি সমুদ্র কর্তৃক নিষিক্ত হয়ে দেবপাল নামক একটি পুত্রকে গর্ভে ধারণ করেন। পাল রাজারা বৌদ্ধ হলেও ব্রাহ্মণদের প্রতি তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রসারিত করেছেন।

বারো শতকে সেনগণ ক্ষমতায় আসার পর ব্রাহ্মণ পুরোহিতগণ ছিলেন রাজ দরবারের অপরিহার্য অঙ্গ। তাঁদের শাসনামলে ব্রাহ্মণদের নির্দেশাবলি কতটুকু পালন করা হতো তা জানা যায় না, তবে বলা যায় এগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল তিনগুণ বয়সী বরের সাথে অপ্রাপ্তবয়স্ক কনের বিবাহ। পারিবারিক অনুষ্ঠানের অধিকাংশ ছিল নারীদের গর্ভধারণের সাথে সম্বন্ধযুক্ত: প্রথম রজঃস্রাব, গর্ভধারণ, সন্তানপ্রসব, মস্তকমুন্ডন, অন্নপ্রাশন এবং নামকরণ। কিছুসংখ্যক নারী, যাদের সকলেই ছিলেন নিঃসন্দেহে উচ্চশ্রেণীর, অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন হলেও তাদের স্বেচ্ছায় চলাফেরার ক্ষমতা ছিল অতি সীমিত।

পরিবারে তাদের অবস্থান থেকে প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ছাড়া নারীদের অন্য কোনো আইনগত অথবা সামাজিক মর্যাদা ছিল না। তারা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারত না। এর ব্যতিক্রম ছিল বিধবাদের ক্ষেত্রে, অবশ্য কোনো পুরুষ উত্তরাধিকারী না থাকলে তাদের স্বামীদের সম্পত্তি ‘ভোগ’ করার অনুমতি দেওয়া হতো। এছাড়া তাদের নিজ ভরণপোষণের জন্য অতি অল্পসংখ্যক উপায় ছিল। রাজ অন্তঃপুরে নারীরা দৃষ্টির বাইরে নিভৃতে অবস্থান করলেও সাধারণভাবে নারীদের বেলায় এটা সত্যি ছিল না। কারণ তারা ঘোমটা দিয়ে চলত না। এটা বিশ্বাস করা হতো যে, বিধবারা অমঙ্গলসূচক এবং তাদের জন্য অনুষ্ঠানাদিতে উপস্থিত থাকা নিষিদ্ধ ছিল। পতিদের চিতায় তাদের আত্মাহুতি দিতে উৎসাহিত করা হতো। কিভাবে আধ্যাত্মিক কার্যাবলি সম্পন্ন করা হবে এবং কোন কাজটি আদর্শ আচরণ বলে পরিগণিত তা জানা যায় না। জনসাধারণ কিভাবে জীবনযাত্রা নির্বাহ করত সে সম্পর্কে কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না। অর্থনৈতিক উৎপাদনে নারীদের অংশগ্রহণ এবং তাদের জীবনে ফসল ও ব্যবসা-বাণিজ্য পরিবর্তনের ফল কতটা ছিল সে সম্পর্কিত তথ্যও পাওয়া যায় না।

বাংলায় মুসলিম শাসনের প্রথম তিন শতকে সমাজে হিন্দু জাতিভেদ প্রথা প্রচলিত ছিল। সামাজিক ক্রমাধিকার বলবৎ করতে হিন্দু শাসনকর্তা না থাকলে জাতিপ্রথা কাউন্সিল প্রথার বিষয়ে মধ্যস্থতা করত। জাতিগত শুদ্ধতার প্রতি অধিকতর মনোযোগ দেওয়া হলে এর প্রভাব পড়ে নারীর ওপর, কারণ তারা ছিল আইন ও বিধির বাহক। শুদ্ধতা বজায় রাখতে বিবাহ ছিল প্রধান ভিত্তি এবং এ জন্য বিবাহ ও সন্তানদের পিতৃত্ব উভয়টিই সতর্কতার বিষয় ছিল।

বাংলা সাহিত্যে ‘স্বর্ণযুগ’ বলে বিবেচিত ষোল শতকে সাহিত্যের বিষয় হিসেবে নারীরা আলোচিত হয়। বিষ্ণু পূজা বিভিন্ন আখ্যানের জন্ম দেয়। এ ক্ষেত্রে রামায়ণ ও কৃষ্ণের কাহিনী এবং রূপকাকারে মানবিক প্রেমসহ ভক্তিমূলক গানের কথা উল্লেখ করা যায়। এগুলোতে নারীদের নায়িকারূপে এবং কামনার লক্ষ্য ও বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। অন্য প্রধান ঘরানা হলো মঙ্গলকাব্য যার কবিতাগুলো দেবীদের পূজাকে কেন্দ্র করে রচিত এবং স্থানীয় দেবীদের শিবের স্ত্রী ও এভাবে প্রভাবশালী ঐতিহ্যের সাথে সংযুক্ত করার উদ্দেশ্যে নিবেদিত। শ্রী চৈতন্য পুরুষ ও নারী উভয়েরই উন্নয়নের জন্য কাজ শুরু করেন এবং কোনো কোনো ইতিহাসবিদ এটাকে এমন একটি সময় হিসেবে দেখেছেন যখন নারীদের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। ভদ্র পরিবারের নারীরা কীর্তন গানে অংশগ্রহণ করে, কিছুসংখ্যক নারী তীর্থযাত্রী হিসেবে ভ্রমণ করে, এবং কিছুসংখ্যক নারী শিষ্য হিসেবে অন্যদের দীক্ষিত করে। মঙ্গলকাব্য ছিল জনপ্রিয় দেবীদের পূজা প্রচারের কাজে অতীব কার্যকর শক্তি। এ কাব্য কমলা, গঙ্গা, শীতলা, মনসা, ষষ্ঠী ও অন্যান্য দেবীকে জনসাধারণের মানসপটে প্রতিষ্ঠিত করে। এ যুগের অধ্যয়নে নিয়োজিত ইতিহাসবিদদের তথ্য আহরণের সমৃদ্ধ উৎস হলো মঙ্গলকাব্য এবং এটি নারীদের জীবন সম্পর্কেও কিছুটা আলোকপাত করে।

ষোল শতকের শেষ নাগাদ বাংলা মুগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং দিল্লি থেকে এর শাসনকার্য পরিচালিত হতে থাকে। মুগল শাসনামলে উপমহাদেশে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ধান, তুলা ও রেশমের চাহিদা বৃদ্ধির ফলে বাংলা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি লাভ করে। ভূসম্পত্তি প্রদান ও অন্যান্য আকর্ষণীয় কার্যাবলি দ্বারা শক্তিশালী হিন্দু প্রধানদের মুগল শাসন ব্যবস্থার সাথে যুক্ত করা হয়। একই সময়ে চাষবাসের জন্য জমির পরিমাণ গুরুত্বপূর্ণভাবে বৃদ্ধি পায় এবং ইসলাম ধর্মের প্রতি জনগণের আনুগত্য বেড়ে যায়।

একালের নারীদের সম্পর্কে যা জানা যায় তা প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। হিন্দু নারীদের মধ্যে যারা শিব-শক্তির পূজা করত তারা কালী ও দুর্গা পূজা প্রবর্তনের সাথে সাথে এসব অনুষ্ঠানাদিতে অধিক বেশি জড়িত হয়ে পড়ে। কিন্তু দেবী পূজা নারীদের জন্য কি গুরুত্ব ও অর্থ বহন করে তা বিশ্লেষণ করা কষ্টকর। কোনো কোনো পন্ডিত মনে করেন যে, দেবী পূজার মাধ্যমে নারীরা ক্ষমতা অর্জন করে কারণ তারা দেবীর ক্ষমতার সাথে নিজেদের একাত্ম বোধ করে; আবার কেউ কেউ মনে করেন, দেবীগণ প্রধানত পুরুষ ভক্তদের উপকার করেন। অধিকন্তু, নারীদের উপর নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে কালী ও শীতলার মতো দেবীদের বিপজ্জনক ও অযৌক্তিক দিককে যুক্তিসঙ্গতভাবে ব্যাখ্যা করা যায়।

নারীদের ক্ষমতায়নের পরিভাষার ন্যায় বৈষ্ণব ধর্মবিশ্বাসও অনুরূপভাবে দ্ব্যর্থক। সকল রকম বিষ্ণু পূজাপদ্ধতি নারীদের আধ্যাত্মিক সমতাকে স্বীকৃতি জানিয়ে তাদের পরিচিতি দান করে, কিন্তু চৈতন্য তাঁর ভক্তদের নারীদের প্রতি তাকাতে অথবা তাদের সঙ্গে বাক্যালাপ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। ধর্ম ভক্তির ক্ষেত্রে নারীদের সুপ্ত শক্তির ওপর গুরুত্বারোপ মনে হয়। তাদের যৌনতার বিষয় গভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত ভীতি ও সন্দেহের সাথে সম্বন্ধযুক্ত ছিল।

এ উৎসগুলো একমত পোষণ করে যে, হিন্দু ও মুসলমানরা বিভিন্ন প্রথা অনুসরণ করত কিন্তু যে সকল ক্ষেত্রে মুসলমানগণ হিন্দু প্রথা পালন করত এবং হিন্দুরা মুসলমানদের প্রথা অবলম্বন করেছিল সেগুলোর উপরও লক্ষ্য রাখত। মুসলিম শাসকশ্রেণী এদেশে আসার সময় কদাচিৎ নারীদের সহযাত্রী করেছে। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে তাদের স্ত্রীগণ, এবং অবশ্যই দাসীরা, বাংলা থেকে সংগৃহীত হয়েছিল। দাসীরা গৃহস্থালির কার্যে নিয়োজিত হতো, কিন্তু তারা কোথা থেকে আসত অথবা তারা পরিবারে কি ভূমিকা পালন করত সে সম্পর্কে জানা দুঃসাধ্য।

ঐতিহাসিক বিবরণ হিন্দু নারীদের অপহরণ ও ধর্ষণের কাহিনীতে ভরপুর হলেও এগুলোর ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু উল্লেখ না করে শুধু সাধারণ বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এতদ্সত্ত্বেও বাল্যবিবাহের মতো প্রথাকে অনুসরণ করার ক্রমবর্ধমান কঠোরতাকে নারীদের প্রতি সহিংসতার একটি প্রচলিত ব্যাখ্যা ছিল।

যদিও কিছুসংখ্যক হিন্দু মেয়ে পাঠশালায় যেত এবং শিক্ষিত নারীরা তাদের পান্ডিত্যের জন্য সুপরিচিত ছিল, তবু নারীদের জন্য আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল বিরল। মেয়েরা শিক্ষাগ্রহণ করলে তা তাদের অকাল বৈধব্য ডেকে আনবে, এরূপ বিশ্বাস বোধ হয় ছিল বহুবিস্তৃত। এর সাথে বাল্যবিবাহের প্রতি ঝোঁক ও স্ত্রীজাতির সতীত্বের ব্যাপারে উদ্বেগের ফলে দেখা যায়, যে সকল মহিলা পড়তে শিখেছে তারা সেটা স্কুলে গিয়ে নয় বরং অন্তঃপুরে শিখেছে। বাল্যবিবাহের ব্যাপকতায় দেখা যায়, হিন্দুদের অনেক বালবিধবাকে পরিধেয় বস্ত্র ও খাবার-দাবারের ব্যাপারে কঠোর নিয়মকানুন অনুসরণ করতে হতো। হিন্দু নারীরা কখন প্রথম পর্দা প্রথা পালন শুরু করে তা অজ্ঞাত। মনে হয়, এ প্রথা ষোল ও আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে শুরু হয়েছিল এবং তা অপহরণের ভয় ও সতীত্বের প্রতি অধিক গুরুত্বারোপের কারণে। বাল্যবিবাহ, পুনর্বিবাহ ছাড়া আবশ্যিকভাবে বৈধব্যপালন এবং নারীদের চলাচলের উপর বিধিনিষেধ আরোপ ইত্যাদি প্রথা ছিল হিন্দু উচ্চবর্ণের বৈশিষ্ট্য, নিম্নবর্ণের লোকদের জন্য এগুলো অনুসরণ করা অপরিহার্য ছিল না। এ উৎসসমূহ থেকে মুসলিম নারীদের বিষয়ে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না, কিন্তু পুরুষদের বহুবিবাহ ও নারীদের নিভৃতে থাকার ন্যায় প্রথার প্রচলন সম্পর্কে উল্লেখ আছে। তাদের শিক্ষাদীক্ষা অথবা বিবাহের স্বাভাবিক বয়স সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়।

ব্রিটিশ শাসন জনগণের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন নিয়ে আসে। উনিশ শতকের প্রারম্ভে ‘নারী’ প্রশ্নটি ভারতীয় সভ্যতা সম্পর্কে আলোচনার প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে এবং প্রভাবশালী ব্রিটিশ লেখকগণ ভারতীয় ধর্ম, সংস্কৃতি ও সমাজকে নিকৃষ্ট বলে নিন্দা করে নারীদের প্রতি যে আচরণ করা হয় সে বিষয়টি উল্লেখ করেন।

হিন্দু ও মুসলিম এ দুটি প্রধান সম্প্রদায় প্রভাবিত হয়েছিল ভিন্নভাবে। মুসলমানগণ ও অনেক হিন্দু আত্মরক্ষার্থে নিজেদের অবস্থানে গুটিয়ে নিলেও হিন্দু সম্প্রদায়ের কেউ কেউ তাদের নিজেদের সমাজকে পর্যালোচনা করে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে এবং সংস্কারের প্রস্তাব করেন। তখন থেকেই নারী সম্বন্ধীয় আলোচনায় সতীদাহ, বাল্যবিবাহ, বৈধব্য, বহুবিবাহ এবং শিক্ষার ব্যাপারে বাধানিষেধ আরোপের মতো বিষয়গুলো প্রাধান্য পায়।

বিদেশি লেখক যারা এদেশীয় সংস্কৃতিকে ‘বর্বরসুলভ’ বলে ঘোষণা করেন তাদের ব্যাপারে সংস্কারকগণ মতামত ব্যক্ত করেন। কিন্তু তাঁরাও ছিলেন পাশ্চাত্যের ধারণা দ্বারা প্রভাবিত এবং ভারতীয় ঐতিহ্যসমূহ যে যুক্তিযুক্ত ও মহীয়ান সেটা প্রমাণের ব্যাপারেও উদ্বিগ্ন। রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথার বিরোধিতা করেন এবং যুক্তি দেন যে নারীদের ‘পশ্চাৎপদতা’ ছিল সামাজিকীকরণের ফলাফল। পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হিন্দু বিধবাদের মর্যাদাকে উন্নতকরণ এবং পুনর্বিবাহকে উৎসাহদান, নারীশিক্ষাকে সমর্থন ও পুরুষের বহুবিবাহ নিরোধ করতে তাঁর জীবনকে উৎসর্গ করেন। ১৮২৯ সালে ব্রিটিশরা সতীদাহকে বেআইনী ঘোষণা করে এবং ১৮৫৬ সালে বিধবাদের পুনর্বিবাহ আইন পাস করে। তবে সতীদাহ চলতে থাকে। নারীদের জীবনে ১৮৫৬ সালের আইনের প্রভাবও ছিল যৎসামান্য। ব্রিটিশরা ছিল বিদেশি প্রভু এবং সামাজিক প্রথাসমূহ সম্বন্ধে তাদের ঘোষণাবলি সমাজে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন আনয়নে মোটেই যথেষ্ট ছিল না।

সংস্কারকদের মধ্যে আলোচনার অন্যতম প্রধান বিষয় ছিল নারীশিক্ষা। বাংলায় শিক্ষার অবস্থার উপর একটি রিপোর্টে (১৮৩৬) উইলিয়ম অ্যাডাম লেখেন, যখন হিন্দুরা বিশ্বাস করত যে শিক্ষা বালবিধবার পথ প্রশস্ত করবে, তখন হিন্দু ও মুসলমান উভয়েরই নারীদের শিক্ষিত করার ব্যাপারে অনীহা ছিল, কারণ তারা এর মধ্যে ‘নারসিুলভ ষড়যন্ত্রের’ আশঙ্কা করে। ঐ সময় নারীশিক্ষা ছিল প্রধানত অনানুষ্ঠানিক এবং ব্যবহারিক বিষয়াবলির মধ্যে সীমিত। সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারীরা প্রায়শ ‘নির্মল বিনোদন’ হিসেবে ধ্রুপদী অথবা দেশিয় সাহিত্য পাঠ করত, এবং ধনাঢ্য পরিবারের মেয়েরা হিসাবরক্ষণের কাজে লাগে এমন কিছু শিক্ষাগ্রহণ করত। এখানে স্মর্তব্য যে, বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম আত্মজীবনী আমার জীবন (১৮৭৫ সালে প্রকাশিত)- এর লেখক ছিলেন একজন গৃহবধূু রাসসুন্দরী দেবী যিনি নিজের চেষ্টায় পড়তে শিখেন। মুসলমান মেয়েদের নিকট থেকে প্রত্যাশিত ছিল যে, তারা কুরআন পড়তে শিখবে ও হিসাবনিকাশে কিছুটা দক্ষতা অর্জন করবে। শিক্ষিত ও হিসাবনিকাশ সামলানোর ব্যাপারে যোগ্যতাসম্পন্ন নারীদের সংখ্যা ইংরেজদের দেওয়া হিসেবের চেয়ে নিঃসন্দেহে অধিক বেশি থাকলেও তাদের মোটামুটি সংখ্যা কত ছিল সে ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া দুঃসাধ্য।

বাংলায় মেয়েদের স্কুল প্রথম চালু করেন মিশনারিগণ। ১৮১৯ সালে ব্যাপ্টিস্ট মিশন ‘ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি’ গঠন করে প্রথম বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। ‘সম্ভ্রান্ত’ হিন্দু বালিকাদের জন্য চার্চ মিশনারি সোসাইটি কর্তৃক যে ৩০-টিরও অধিক স্কুল খোলা হয় তার দায়িত্ব নিতে ১৮২১ সালে মিস মেরী অ্যান কুক কলকাতায় আগমন করেন। ১৮২৪ সাল নাগাদ ঢাকায় একটি খ্রিস্টান মহিলা স্কুল শুরু করা হয়, কিন্তু ১৮২৬ সালে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। এ স্কুলগুলোতে ব্রাহ্মণ পন্ডিতগণ শিক্ষাদান করতেন, হিন্দু সদ্বংশজাত ব্যক্তিগণ এর পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও এগুলো উচ্চতর বর্ণ থেকে মেয়েদের আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হয়।

মেয়েদের বিখ্যাত স্কুলগুলোর অন্যতম বিদ্যালয় ছিল ১৮৪৯ সালে কলকাতায় জে.ই ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়। বেথুন তাঁর এ পদক্ষেপের পক্ষে বিখ্যাত কয়েকটি পরিবারের সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হন। ফলে ১৮৫০ সাল নাগাদ এর ছাত্রীসংখ্যা দাঁড়ায় ৮০ জন। ১৮৫৪ সালে সরকার অনুদানের মাধ্যমে নারীশিক্ষাকে সমর্থন করার কথা ঘোষণা করে। ঐ বছর মেয়েদের জন্য বাংলায় সর্বমোট ২৮৮টি স্কুল ছিল। যারা নারীশিক্ষাকে সমর্থন করত তারা চাইত যে তাদের কন্যাগণ তাদের নিজ নিজ পতির উপযুক্ত সঙ্গিনী, ‘বিজ্ঞানমনস্ক’ ও সুশীল সমাজের সদস্য হবে।

ব্রাহ্মসমাজ নারীশিক্ষার প্রসার ও লৈঙ্গিক সমতার জন্য আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়। উনিশ শতকের শুরুতে যারা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস পর্যালোচনা করে দেখতে চাচ্ছিলেন তাঁদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সমাজ উনিশ শতকের ষাটের দশক নাগাদ জনসমাবেশ, ধর্মীয় শিক্ষা ও নারীদের জন্য সেলাই শিক্ষার আয়োজন করে। এক দশকের মধ্যে সমাজ-এর সদস্যবৃন্দের মাঝে নারীশিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের প্রশ্নে মতবিরোধ দেখা দেয়। ১৮৭৮ সালে ‘নারী-মুক্তি’-র প্রশ্নে এটি বিভক্ত হয়ে যায় এবং সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ-এর প্রগতিশীল শাখাটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অধিভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বেথুন কলেজ প্রতিষ্ঠা করে। ১৮৮৩ সালে কাদম্বিনী গাঙ্গুলী (১৮৬১-১৯২৩) ও চন্দ্রমুখী বসু বেথুন কলেজ থেকে বি.এ ডিগ্রি লাভ করেন এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম মহিলা স্নাতক হন।

উনিশ শতকের শেষদিকে শুধু মুসলমান সম্প্রদায় নারীশিক্ষা ও সমাজ সংস্কারমূলক বিষয়সমুহের প্রতি মনোনিবেশ করে। প্রথম যারা এ সংস্কারে মনোনিবেশ করেন তারা ছিলেন বুদ্ধিজীবী আশরাফ শ্রেণির সদস্য। তাদের সাথে যোগ দেন আলীগড়ে সৈয়দ আহমদ খানের কাজ দ্বারা অনুপ্রাণিত প্রচুর ভূসম্পত্তির অধিকারী পরিবারসমূহ এবং একটি নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি যারা ব্যবসায় ও প্রশাসনিক কাজের মাধ্যমে সম্পদ ও মর্যাদা লাভ করে। উত্তর ভারতের উর্দু সাহিত্য দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে বাংলার মুসলমানগণ তাদের কন্যাদের আদর্শ নারীসুলভ আচার-ব্যবহার সম্পর্কিত গ্রন্থাবলি পাঠের নির্দেশ দেয়। এ ধরনের গ্রন্থাবলির অন্যতম ছিল উর্দু ভাষায় লিখিত আশরাফ আলী থানবীর বেহেশতী জেওর (১৯০৫)। ১৯২৫ সালে এর বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থটি রচনার উদ্দেশ্য ছিল ‘নব চিন্তাধারার অধিকারী মুসলমান নারী’-কে পথনির্দেশ দেওয়া যাতে তারা পরিবর্তনশীল বিশ্বকে বুঝতে, ঐতিহ্যকে নিষ্ঠার সঙ্গে লালন ও রক্ষা করতে, স্বেচ্ছায় পরনির্ভরতা ও পারিবারিক গন্ডির মধ্যে তার মর্যাদাকে স্বীকার করে নিতে পারে। নারীদের জন্য পুরুষ কর্তৃক প্রণীত এ গ্রন্থসমূহে শিক্ষার কথা বলা হয়েছে যার উদ্দেশ্য ছিল নারীর জন্য পরিবারে সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি করা।

হিন্দু সংস্কারকদের নিকট প্রাধান্য পেয়েছে এরূপ কিছু বিষয় নিয়েও মুসলিম সম্প্রদায় উদ্বিগ্ন ছিল। এগুলোর একটি হলো বাল্যবিবাহ। এ বিষয়ের ওপর মুসলমান সংস্কারকগণ উনিশ শতকের শেষদিকে ও বিশ শতকের শুরুতে মতামত ব্যক্ত করেন। কিন্তু তারা এমন কিছু বিষয়ের ওপরও আলোকপাত করেন যেগুলো তাদের নিকট ছিল গুরুত্বপূর্ণ, যেমন দেনমোহর, কাবিন, উত্তরাধিকার, বহুবিবাহ, ও নারীদের পর্দা। ক্রমান্বয়ে মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি যারা এ সংস্কারসমূহ সমর্থন করে তারা এমন এক জীবনযাত্রার বিকাশ ঘটায় যা সংস্কারবাদী হিন্দুদের নির্দেশিত ব্যবস্থার মতো ছিল না।

সম্ভ্রান্ত এক ভূস্বামীর মালিকের কন্যা নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ১৮৭৩ সালে কুমিল্লায় প্রথম মুসলিম বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু বিশ শতকের পূর্বে এ ধরনের বিদ্যালয়ে মুসলমান মেয়েরা যোগদান করে নি। ঢাকা কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রিধারী কিছুসংখ্যক মুসলিম ব্যক্তি উনিশ শতকের আশির দশকে ‘মুসলমান সুহূদ সম্মিলনী’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এ সংগঠন মেয়েদের জন্য নিয়মানুগ গৃহশিক্ষার অনুকূলে মত প্রকাশ করে এবং এ আন্দোলন চালিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে একটি পাঠক্রম প্রস্ত্তত, পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ এবং পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করে। মুসলমান বালিকাদের শিক্ষাগ্রহণের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠার আন্দোলন যিনি শুরু করেন তিনি হলেন রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন (১৮৮০-১৯৩২)। ভূস্বামী পরিবারে জন্মগ্রহণকারী রোকেয়া তাঁর ভাইয়ের সাহায্য নিয়ে গোপনে লেখাপড়া শিখেন। তাঁর স্বামী তাঁর শিক্ষার এ ধারাটি অব্যাহত রাখেন, অন্যান্য সম্প্রদায়ের ‘নতুন আলোকপ্রাপ্ত নারীদের’ সাথে তাঁর মেলামেশাকে উৎসাহিত করেন, এবং মেয়েদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে তাঁকে প্রয়োজনীয় অর্থ সাহায্য করেন। ১৯১১ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল ছিল বাংলায় মুসলমান মহিলাদের জন্য প্রথম বিদ্যালয়।

পর্দা ও অবগুণ্ঠনের ক্ষতিকারক প্রভাব সম্পর্কেও রোকেয়া অবগত ছিলেন এবং এগুলো সম্পর্কে তিনি তাঁর বিভিন্ন রচনায় আলোচনা করেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১৯২৯ সালে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত ভীতিকর ও কৌতুকপূর্ণ রচনাসংকলন অবরোধবাসিনী। অবগুণ্ঠনের বাড়াবাড়িকে তিনি যতই অপছন্দ করুন না কেন, রোকেয়া তাঁর স্কুলে এর নিয়মকানুন পালন করতেন।

বিশ শতকের শুরু নাগাদ সামাজিক সংস্কারকে এগিয়ে নিতে বাংলার নারীরা তাদের নিজস্ব সংগঠন তৈরি করতে থাকে। ঠাকুর পরিবারের একজন সদস্য সরলাদেবী চৌধুরানী (১৮৭২-১৯৪৫) ভারতীয় নারীদের জন্য একটি স্থায়ী সঙ্ঘের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। ভারত স্ত্রী মহামন্ডল নামক তাঁর সংগঠন ১৯১০ সালে এলাহাবাদে প্রথম সভায় মিলিত হয়। সংগঠনটি শীঘ্রই বাঁকুড়া, হাজারিবাগ, মেদিনীপুর ও কলকাতাসহ ভারতের অন্যান্য নগরীতে এর শাখা গড়ে তোলে। এ সংগঠনটির উদ্বেগের অন্যতম প্রধান বিষয় ছিল নারীশিক্ষা এবং যেসব শিক্ষক নারীদের তাদের বাড়িতে গিয়ে পড়তে, লিখতে, সংগীত, সেলাই ও এমব্রয়ডারি শিক্ষা দিত তাদেরকে এ সংগঠন আর্থিক সহায়তা দিত। সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত মুসলিম নারীদের মাঝে কাজ করার জন্য ১৯১৬ সালে রোকেয়া আঞ্জুমান-ই-খাওয়াতিন-ই-ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন। একই সময় বাংলায় নারীদের ইনস্টিটিউট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা সরোজ নলিনী দত্ত (১৮৮৭-১৯২৫) জেলা শহরগুলোতে মহিলা সমিতি সংগঠিত করেন।

বিশ শতকের বিশ ও ত্রিশের দশকে সর্বভারতীয় নারী সংগঠনগুলো আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করে যেখানে বাংলার নারীরাও যোগদান করে। দি ন্যাশনাল কাউন্সিল অব উইমেন ইন ইন্ডিয়া এবং অল ইন্ডিয়া উইমেন্স কনফারেন্স দুটি সংগঠনেরই বাংলায় শাখা ছিল এবং বাংলার নারীরা সেগুলোর জাতীয় কাউন্সিল ও কমিটিতে সক্রিয়ভাবে কাজ করে।

জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে বাংলার নারীরা জড়িত হয় উনিশ শতকের শেষদিকে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস গঠিত হওয়ার পাঁচ বছর পর ১৮৯০ সালে ঔপন্যাসিক স্বর্ণকুমারী ঘোষাল (১৮৫৬-১৯৩২) ও ভারতের অন্যতম প্রথম মহিলা চিকিৎসক কাদম্বিনী গাঙ্গুলী প্রতিনিধি হিসেবে এর অধিবেশনে যোগ দেন।

১৯০৫ সালে ব্রিটিশরা বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিকে বিভক্ত করে। বিদেশি পণ্য বর্জন ও শুধু দেশিয় দ্রব্য ক্রয়ের মাধ্যমে এ বিভক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে নারীরা পুরুষদের সঙ্গে যোগ দেয়। অন্য নারীরা স্বদেশের কাজে নিজেদের উৎসর্গ করার ব্রত নেয় এবং এ কাজের জন্য প্রতিদিন এক মুষ্ঠি চাল জমা রাখার কর্মসূচি গ্রহণ করে। এর বাইরেও নারীরা বিপ্লবী সংগঠনগুলোর প্রতি তাদের সমর্থন জ্ঞাপন করে।

১৯১৭ সালে ভারত সচিব এডউইন মন্টেগু যখন অধিক সংখ্যক ভারতীয়কে শাসনকার্যে অন্তর্ভুক্ত করা সম্পর্কিত ব্রিটিশ সরকারের অভিপ্রায়ের কথা ঘোষণা করেন, তখন নারীদের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে আলোচনার জন্য ভারত স্ত্রী মহামন্ডলের সদস্যদের পক্ষ থেকে সরলাদেবী চৌধুরানী তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের  আবেদন জানান। মাদ্রাজে নবগঠিত ভারতীয় নারী এসোসিয়েশনের সদস্যবৃন্দও তাঁর কাছে সাক্ষাৎদানের অনুরোধ করেন। সরকারি কর্মকর্তাবৃন্দ উভয় দলকে জানান যে, শুধু রাজনৈতিক বিষয়াবলির ওপর প্রতিনিধিবর্গের বক্তব্য শোনা হবে। ডিসেম্বর মাসে মন্টেগু ও চেমসফোর্ডের সাথে সাক্ষাৎ করতে এবং মহিলাদের জন্য ভোটের অনুরোধ জানাতে হায়দ্রাবাদ থেকে সরোজিনী নাইডু সর্বভারতীয় বিশিষ্ট নারীদের একটি প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। এতে সরলাদেবী চৌধুরাণী অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। সরোজিনী নাইডু ও সরলাদেবী চৌধুরানী মহিলাদের ভোটদানের অধিকারের পক্ষে কংগ্রেসের সমর্থন পান। ইংল্যান্ডে সরোজিনী নাইডু জয়েন্ট সিলেক্ট কমিটির সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন যে, সকল ভারতীয় নারী, এমনকি গোঁড়া হিন্দু ও মুসলমান নারীরাও ভোটের অধিকার চায়। অবশেষে হাউস অব কমন্স প্রাদেশিক বিধান পরিষদসমূহকে রেজিস্ট্রিকৃত ভোটারদের তালিকায় নারীদের অন্তর্ভুক্ত করার অনুমতি প্রদান করে। নারী সংগঠনগুলো ভোটদানে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করতে থাকে এবং ১৯২৬ সালে বাংলায় সম্পত্তির অধিকারী এমন মহিলারা ভোটাধিকার লাভ করে। মহিলা আসন ছিল সমগ্র নির্বাচকমন্ডলীর শতকরা ৩ ভাগ।

বাংলা ও ভারতব্যাপী নারীদের বিক্ষুব্ধ রাজনীতিতে নিয়ে আসতে গান্ধী প্রাথমিক ভূমিকা পালন করেন। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে কংগ্রেস নেতা সি.আর দাশের পরিবারের সদস্য বাসন্তী দেবী, ঊর্মিলা দেবী ও সুনীতি দেবী ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের সমর্থনে বিক্ষোভ জানাতে রাস্তায় নেমে আসেন। তাঁদেরকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁদের আটক করা হলে তা জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং গান্ধী সমগ্র ভারতের নারীদের বাংলার এ সাহসী নারীদের দৃষ্টান্ত অনুসরণের আহবান জানান।

লতিকা ঘোষ (জন্ম ১৯০২) কর্তৃক ১৯২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত মহিলা রাষ্ট্রীয় সঙ্ঘ ছিল বাংলার নারীদের রাজনীতিতে সংগঠিত করার প্রথম নিয়মমাফিক সংগঠন। ঐ বছর কলকাতায় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন উপলক্ষে শোভাযাত্রায় পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের মার্চ করে যাবার জন্য নারী স্বেচ্ছাসেবকদের একটি দল গঠনের জন্য সুভাষচন্দ্র বসু লতিকাকে অনুরোধ করেন। লতিকা বেথুন কলেজ ও ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশনের ছাত্রী এবং কলকাতা কর্পোরেশন কর্তৃক নিয়োগকৃত শিক্ষিকাদের সমন্বয়ে ৩০০ নারীর একটি দল গঠন করেন। পরের বছর (১৯২৯) জাতির প্রতি দায়িত্ব পালনের জন্য নারীদের প্রস্ত্তত থাকতে কংগ্রেসের আহবানে  কলকাতার নারীরা নারী সত্যাগ্রহ সমিতি গঠন করে। আইন অমান্য আন্দোলন চলাকালে নারীরা লবণ তৈরি ও বিক্রয় করে, বস্ত্র ও মদের দোকানে পিকেটিং চালায়, খদ্দরের উপযোগিতা সম্পর্কে প্রচার করে এবং শোভাযাত্রায় অংশ নেয়।

ঐ সময় মুসলমানগণ সাধারণত কংগ্রেসের ব্যাপারে বেশ সংশয়যুক্ত ছিল। আইন অমান্য আন্দোলনের প্রাক্কালে গাড়োয়ানদের ধর্মঘটের সমর্থনে কলকাতার হিন্দু ও মুসলমান একত্রিত হয়। ধর্মঘটের প্রথম দিনে সাতজন গাড়োয়ানকে হত্যা করা হয় এবং পরদিন যখন হিন্দু ও মুসলমান একসাথে শোক পালন করে; নারীরা বাড়ি থেকে ফুল ছুড়ে দিয়ে তাদের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে। কিন্তু অচিরেই তাদের এই সংহতিতে ভাঙন ধরে এবং অনেকগুলো শহরে সহসাই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে।

এ সময় বিপ্লবী সংগঠনগুলো তাদের হয়ে কাজ করার জন্য বেশিরভাগ ছাত্রীসহ নারীদের রিক্রুট করতে থাকে। চারজন বিপ্লবী নারীর কৃতিত্বের কথা ইতিহাসবিদগণ কর্তৃক যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। ১৯৩১ সালের ১৪ ডিসেম্বর কুমিল্লার দুজন স্কুলছাত্রী শান্তি ঘোষ (১৯১৬-১৯৮৯) ও সুনীতি চৌধুরী (১৯১৭-১৯৮৮) ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্কে গুলি করে হত্যা করে। পরের বছর ফেব্রুয়ারি মাসে বীণা দাস (১৯১১-১৯৮৬) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বাংলার গভর্নরকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা চালায়। সেপ্টেম্বর মাসে চট্টগ্রামের স্কুল শিক্ষিকা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার (১৯১১-১৯৩২) চট্টগ্রাম ক্লাবে হামলায় পনেরো জনের একটি দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। হামলা চালানোর পর গ্রেফতার এড়াতে ক্লাব থেকে প্রায় ১০০ গজ দূরে প্রীতিলতা বিষ পান করে প্রাণ বিসর্জন দেন। এদের মধ্যে প্রথমোক্ত তিন জনকে দীর্ঘ মেয়াদি কারাদন্ড দেওয়া হয়।

জেলা শহর ও গ্রামগুলোতে নারীরা শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে, খদ্দর পরিধান করে, এবং আত্মগোপনকারী বিপ্লবীদের লুকিয়ে রাখে। মেদিনীপুর, চবিবশ পরগনা, খুলনা, বাখেরগঞ্জ, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের নারীরা লবণ আইন ভঙ্গ করে এবং তাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত পুলিশের নৃশংস নির্যাতন মোকাবেলা করে। এই বিশৃংখল পারিপার্শ্বিক অবস্থাতেই সরলাদেবী চৌধুরানী নারীদের জন্য আলাদা কংগ্রেস সংগঠিত করার চেষ্টা চালান। এ বিষয়ে আলোচনা করার জন্য সমগ্র বাংলা থেকে নারীরা ১৯৩১ সালের মে মাসে একত্রে মিলিত হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাথেই থেকে যায়।

১৯৩২ সাল নাগাদ শহরগুলোতে সরকার বিরোধিতা কমে আসে, কিন্তু গ্রামাঞ্চল ও নারীদের মধ্যে তা বৃদ্ধি পায়। মুসলমান তাঁতিরা এবং দেওবন্দ মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহণকারী বহু লোক এ সময় এই আন্দোলনে যোগ দেয়। সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ ও পুনা চুক্তি বিতর্কিত বিষয়টির প্রকৃতিতে পরিবর্তন আনে। কারণ ইতোমধ্যে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচকমন্ডলী এবং হিন্দু নিম্নবংশজাতদের জন্য সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা থাকবে। হিন্দুদের নির্বাচনসংক্রান্ত ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হিন্দু মহাসভা এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে এবং হিন্দু নারীদের উপর মুসলমানদের দৈহিক নির্যাতন সম্পর্কিত কল্পিত কাহিনী প্রচার করে।

শুধু বিশ শতকে এসে নারীদের কাজের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। একদিকে অনেক কারখানা গড়ে ওঠায় নারীদের কর্মসংস্থানের দ্বার উন্মুক্ত হয়, অন্যদিকে আগে নারীদের অর্থ উপার্জনের যে পথ খোলা ছিল যান্ত্রিকীকরণের ফলে তা অনেকটা বন্ধ হয়ে যায়। বাংলার পাটকলগুলোতে শ্রমিকদের প্রায় শতকরা ২০ ভাগ ছিল নারী। কিন্তু তাদের অনেকেই বাঙালি ছিল না। বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান নারীরা পর্দার বিধিনিষেধ দ্বারা বাধাগ্রস্ত হতো এবং তারা ছিল নারী পাট কর্মীদের মাত্র শতকরা ১০ ভাগ। বর্ধিতাকারে যান্ত্রিকীকরণ ও শ্রমিক আইন চাপিয়ে দেওয়ার ফলে জুট মিলগুলোতে নারীদের নিয়োগ হ্রাস পাওয়ার বিষয়টি ১৯৩০ সাল থেকে পরিদৃষ্ট হতে থাকে। সংখ্যায় খুব বেশি না হলেও ধর্মঘট ও শ্রমিক বিক্ষোভের সময় এবং ধর্মঘট ভঙ্গকারী ও শ্রমিক নেত্রী হিসেবে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অন্য নারীরা ঝি, কুলি ও গনিকা হিসেবে অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ নিয়ে জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করে।

উনিশ শতকের শেষদিকে শিক্ষিত নারীরা শিক্ষকতা ও চিকিৎসার কাজে নিয়োজিত হওয়ার জন্য ট্রেনিং নেয়। ১৮৮৪ সালে কাদম্বিনী গাঙ্গুলী কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে প্রথম নারী হিসেবে ভর্তি হন। বিধুমুখী বসু ও ভার্জিনিয়া মেরী মিত্র প্রথম ভারতীয় নারী হিসেবে ১৮৮৯ সালে মেডিক্যাল কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। মাতৃভাষায় মেডিক্যাল ডিগ্রি প্রদানকারী ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুল ১৮৮৮ সালে নারীদের জন্য এর দ্বার উন্মুক্ত করে। বাংলার প্রথম মুসলমান নারী হিসেবে চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়নে মুসাম্মৎ ঈদেন্নেসা ১৮৯১ সালে এ প্রোগ্রামে ভর্তি হন। তিনি ১৮৯৪ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে ময়মনসিংহে চিকিৎসক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।

১৯৪২ সালের ভারত ছাড় আন্দোলনে নারীরা বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করে। এ আন্দোলন গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়লে কৃষক পরিবারের বিরাট সংখ্যক নারী খাজনা, জমির ভোগদখলের সময়কাল ও ভূমিমালিকের অধিকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে পুরুষদের সাথে যোগ দেয়। ১৯৪২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে মেদিনীপুর জেলার চারটি মহকুমায় চাষীরা থানা আক্রমণ করে ও টেলিগ্রাফ লাইন বিনষ্ট করে। তমলুক মহকুমার জনগণ মার্চ করে শহরের দিকে যাওয়ার সময় ৭৩ বছর বয়সী একজন বিধবা মাতঙ্গিনী হাজরা সম্মুখে এগিয়ে আসেন, কংগ্রেসের ঝান্ডা তুলে ধরেন এবং জনসমক্ষে তাঁর প্রথম ভাষণ দান করেন। তিনি যে হাতে ঝান্ডা ধরে রেখেছিলেন প্রথমে সে হাতে এবং পরে তাঁর মাথায় গুলি করা হয়।

এ আন্দোলনে অরুণা গাঙ্গুলী আসফ আলী (১৯০৯-১৯৯৬) ও সুচেতা মজুমদার কৃপালনী (১৯০৮-১৯৭৪) নামে দুজন বাঙালি মহিলা সর্বভারতীয় নেত্রী হিসেবে আবির্ভূত হন। যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে ব্যাহত ও এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ১৯৪২ সালে অরুণা আসফ আলী আত্মগোপন করেন। সুচেতা কৃপালনীও ১৯৪২ সালে আত্মগোপন করেন, কিন্তু সরকারকে অচল করে দিতে অহিংস কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য তিনি কাজ চালিয়ে যান।

বাংলায় ১৯৪৩-১৯৪৪ সালের দুর্ভিক্ষে কমপক্ষে ৩৫ লক্ষ লোক মারা যায় এবং এর চেয়েও অধিকসংখ্যক ব্যক্তিকে দারিদ্র্যবরণ করতে ও গৃহচ্যুত হতে হয়। যে সকল নারী পূর্বে ঢেঁকিতে ধান ভেনে অথবা স্থানীয় বাজারে কেনাবেচা করে জীবিকা নির্বাহ করত তারা উপার্জনের পথ থেকে বঞ্চিত হয়। খাদ্য ঘাটতির পাশাপাশি নারীরা যখন কাজের অন্বেষণে বের হয় অথবা সাহায্যের আশায় রিলিফ কেন্দ্রগুলোতে ভীড় জমায় তখন তারা যৌন হয়রানির শিকার হয়। দুর্ভিক্ষের বছরগুলোতে নারীরা পরিস্থিতির শিকার হয়। ভুখা নারীরা প্রকাশ্য স্থানে খাদ্য ভিক্ষা করে, আর মধ্যবিত্ত-শ্রেণীর নারীরা রিলিফ প্রদানের কাজে সম্পৃক্ত হয়।

জার্মানি ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেও ভারত এ যুদ্ধে সম্মতি প্রদান করে নি। সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৪১ সালের জানুয়ারি মাসে কলকাতা থেকে পালিয়ে যান এবং ১৯৪৩ সাল নাগাদ সিংগাপুরে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠনে ব্যাপৃত থাকেন। প্রথাগত সেনাবাহিনীর অতিরিক্ত বাহিনী হিসেবে তিনি ঝাঁসির রানী ব্রিগেড নামে নারীদের একটি ইউনিট সংগঠিত করতে চেয়েছিলেন। অনতিবিলম্বে তিনি কিছুসংখ্যক বাঙালি নারীসহ ১০০০ নারীকে রিক্রুট করেন, যারা মাতৃভূমিকে মুক্ত করতে আমরণ যুদ্ধ করতে প্রস্ত্তত ছিল।

১৯৪৬ সালের তেভাগা আন্দোলনে নারীরা ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়ে। গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের সংগঠিত করার কাজে কমিউনিস্টদের মধ্যে ছিলেন রানি মিত্র দাশগুপ্ত, মণিকুন্তলা সেন ও রেনু চক্রবর্তী (১৯১৭-১৯৯৪)। গ্রামের নারীরা প্রথমে সাহায্যকারীর ভূমিকায় এবং পরে নেত্রী ও যোদ্ধা হিসেবে নির্দ্বিধায় এ আন্দোলনে যোগ দেয়। এ ধরনের নারীদের মধ্যে সর্বাধিক পরিচিতদের একজন হলেন মেদিনীপুর জেলার বিমলা মাঝি নামে একজন বিধবা যিনি নারীদের একজন সফল সংগঠকে পরিণত হন।

১৯৪৬ সালের আগস্ট মাস উপদলীয় রাজনীতিতে একটি নতুন পর্বের সূচনা করে। প্রতিবেশী হিন্দু ও মুসলমানরা পাশাপাশি বসবাস করলেও এ সময় তারা একে অপরের বিরুদ্ধে অসৎ উদ্দেশ্যে তৎপর হয়। কলকাতার দাঙ্গার পরে নোয়াখালী, কুমিল্লা ও ত্রিপুরায় দাঙ্গা সংঘটিত হয়।

১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে বাঙালি নারীদের বিবরণ দিতে গেলে নারীরা তাদের নতুন জাতীয় পরিচয়ে যেভাবে গড়ে উঠেছে তাতে নারী হিসেবে তারা কি করতে পারত এবং কি করতে পেরেছে এ উভয় চিত্র তুলে ধরতে হবে।  [জেরাল্ডিন ফোর্বেস]

গ্রন্থপঞ্জি  Usha Chakraborty, Condition of Bengal Women Around the Second  Half of the Nineteenth Century, Calcutta, 1963; Ghulam Murshid, The Reluctant Debutante: Response of Bengali Women to Modernization, 1849-1905, Rajshahi, 1983; Meredith Borthwick, The Changing Role of Women in Bengal, 1849-1905, Princeton, 1984; Rokeya Sakhawat Hossain, Sultana’s Dream and Selections from the Secluded Ones, edited and translated by Roushan Jahan, New York, 1988; Tilottama Tharoor, ed, Naari, Calcutta, 1990; Sonia Nishat Amin, The World of Muslim Women in Colonial Bengal, 1876-1939, Leiden, 1996.

সাংবিধানিক অবস্থান বাংলাদেশের নারী জনগোষ্ঠী রাজনৈতিক সামাজিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনগ্রসর থাকায় বাংলাদেশের সংবিধানে তাদের অবস্থার উন্নতিকল্পে বিশেষ সুবিধা ও অধিকার সন্নিবেশিত হয়েছে। ১৯৭২ সালে প্রণীত প্রথম ও মূল সংবিধান এবং পরবর্তীতে কয়েকটি সংশোধনীতে তাদের বাড়তি সুযোগ সুবিধা ও সংরক্ষিত অধিকার দেওয়ার কথা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংযোজন করা হয়েছে।

সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে বর্ণনা করা হয়েছে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি। এ অধ্যায়ের ১৫নং ধারার (ঘ) উপধারায় ঘোষিত হয়েছে যে, সমাজের দুঃস্থ মানুষের পাশাপাশি বিধবাদের সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের জন্য সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার সংরক্ষিত থাকবে। ১৭নং ধারার (ক) উপধারায় বলা হয়েছে, একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক এবং বালিকার জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদান ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ১৮ (২) ধারায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্র কর্তৃক পতিতা বৃত্তি বন্ধ করার জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া হবে। ১৯নং ধারার ১নং উপধারায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্র সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগের নিশ্চয়তা দিবে এবং ২নং উপধারায় লিখিত হয়েছে, রাষ্ট্র মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য বিলোপ করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

বাংলাদেশ সংবিধানের তৃতীয় ভাগে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে মৌলিক অধিকার সম্বলিত ধারাসমূহ। ২৭নং ধারায় বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্রের সকল নাগরিক আইনের চোখে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। ২৮নং ধারার ১নং উপধারা অনুযায়ী রাষ্ট্র, ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোনো বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশ বা কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোনো নাগরিককে কোনরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা বা শর্তের সম্মুখীন হতে হবে না এবং একই ধারার ৪নং উপধারা অনুযায়ী যেকোন অনগ্রসর এলাকার নারী বা শিশু অথবা নাগরিকদের উন্নতির জন্য রাষ্ট্র বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। ২৯নং ধারার ১নং উপধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রের কর্মে নিয়োগ লাভের ব্যাপারে সকল নাগরিকের সমান সুযোগ থাকবে এবং একই ধারার ২নং উপধারায় বলা হয়েছে, কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিক রাষ্ট্রের কর্মে নিয়োগ বা কর্ম লাভের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না অথবা তাঁর প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাবে না।

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের আসন সংখ্যা ৩০০। এর অতিরিক্ত মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ৪৫টি আসন। তবে সাধারণ আসনের নির্বাচনে মহিলাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় কোনো বাধা নেই। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, সংবিধান জাতীয় সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য ৬৫নং ধারার মাধ্যমে সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা করেছে। ১৯৭৩-এ সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা ছিল ১৫টি এবং এ আসনগুলি দশ বছরের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়। ১৯৭৯ সালে নারী দশকের প্রভাবে এ আসন সংখ্যা ৩০-এ বাড়ানো হয়। নিয়মানুযায়ী ১৯৮৮ সালের সংসদে সংরক্ষিত আসন ছিল না। দশম সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৯১ সালে পুনরায় দশ বছরের জন্য ৩০টি আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। ২০০৪ সালে এ সংখ্যা ৪৫-এ উন্নীত করা হয়েছে।

সংরক্ষিত আসনে পরোক্ষ নির্বাচন পদ্ধতি প্রচলিত। এ আসনগুলির নির্বাচনের জন্য নির্বাচকমন্ডলী হলেন জাতীয় সংসদের সদস্যগণ। ফলে সংরক্ষিত আসনের জন্য নির্বাচন বাংলাদেশে কোনো সময়ই হয় নি, যা হয়েছে বা হয় সেটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মনোনয়ন।  [শওকত আরা হোসেন]

আইনগত মর্যাদা  দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীরা কতটা সমতা ভোগ করছে আইন কাঠামো এর একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। নারীর অধিকার রক্ষাকারী আইনসমূহ নারীর অধিকার বাস্তবায়নের জন্য আনুষ্ঠানিক সমতার মৌলিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও চাকুরি ক্ষেত্রে নারীর অধিকার সুরক্ষায় আইন ন্যায়সঙ্গত হস্তক্ষেপ করতে পারে।

বাংলাদেশে নারী-পুরুষ কর্তৃক ভোগকৃত মৌলিক অধিকারের মূল উৎস হলো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান। জনগণের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা সম্পর্কে রয়েছে দুই ধরনের আইন: দেওয়ানি ও ব্যক্তিগত। দেওয়ানি আইন সংবিধান প্রদত্ত নারীর অধিকার এবং ব্যক্তি-আইন পারিবারিক জীবনে নারীর অধিকার রক্ষা করে।

বাংলাদেশের সংবিধান রাষ্ট্রীয় ও জনজীবনে নারী ও পুরুষের সমানাধিকার ঘোষণা করে এবং তাতে রাষ্ট্রকে এই লক্ষ্যে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণে নিদের্শনা দেয়। সংবিধানের ১৯ ধারা লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য সম্পূর্ণ বাতিল করে নারীর রাজনৈতিক সমঅধিকারের স্বীকৃতি দেয়।

সংবিধানের ২৭ ধারা দ্ব্যর্থহীনভাবে উল্লেখ করে যে, সকল নাগরিক আইনের চোখে সমান এবং আইনের মাধ্যমে অভিন্ন সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারী। ২৮ ধারা রাষ্ট্রকে ‘মহিলা বা শিশু অথবা সমাজের যেকোন পশ্চাদপদ অংশের উন্নয়নের জন্য’ বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের নিদের্শনা দিয়েছে। নারীদের বিরুদ্ধে সকল ধরনের বৈষম্যের বিলুপ্তি বিষয়ক জাতিসংঘ সনদ (UNCEDAW) অনুমোদনের মাধ্যমে সরকার এক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে।

তবে সংবিধানের সংশ্লিষ্ট ধারাগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নারী ও পুরুষের মধ্যেকার সমানাধিকার ব্যক্তিজীবনের (অর্থাৎ পৈতিৃক উত্তরাধিকার ও পারিবারিক সম্পর্কের) সর্বক্ষেত্রে সম্প্রসারিত হয় নি। সরকার কর্তৃক সমর্থিত জাতিসংঘের বৈষম্য বিলুপ্তি সম্পর্কিত কনভেনশনকে পরিবারের আওতায় সমানাধিকারের বিধানসমূহের ক্ষেত্রে শর্তাধীন করা হয়েছে। এটা হলো লিঙ্গসমতা প্রতিষ্ঠার জন্য UNCEDAW অনুমোদনের মাধ্যমে সরকার প্রদর্শিত আন্তরিকতা থেকে সুস্পষ্ট বিচ্যুতি। দেওয়ানি আইনে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্যহীনতা বজায় থাকা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু এ সকল আইনের কয়েকটি স্পষ্টত নারীর ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক। ১৯৫১ সালের নাগরিকত্ব আইন এধরনের বৈষম্যের একটি উদাহরণ যা নারীর জন্য পুরুষের মতো আইনগত সমানাধিকার ভোগের সুযোগ সঙ্কুচিত করেছে।

ফৌজদারি আইনসমূহ ধর্মীয় আইনের ওপর ভিত্তিশীল নয়। তবু এসব আইন কিছু ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্যহীনতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান ফৌজদারি আইনে ধর্ষণ একটি যৌন সহিংসতা, কিন্তু একজন মহিলার ক্ষেত্রে ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণ খুবই কঠিন করা হয়েছে, কেননা এজন্য সাক্ষ্যপ্রমাণবিধি মোতাবেক ডাক্তারি পরীক্ষার মাধ্যমে ধর্ষণের আলামত এবং তা যে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঘটেছে ধর্ষিতাকেই তা প্রমাণ করতে হয়। এ আইন নির্যাতিত ও অভিযুক্তকে অভিন্ন অবস্থানে রেখেছে, কেননা আইন মোতাবেক নির্যাতিতাকে অভিযোগ প্রমাণ করতে হয়।

সংবিধান শিল্পখাতে বিদ্যমান শ্রম-আইন বৈষম্যহীন ও পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর করার নিশ্চয়তা দেয়, কিন্তু বাস্তবে এসকল আইন থেকে নারী-শ্রমিকরা খুব কমই নিরাপত্তা পেয়ে থাকে। কারখানাস্থলে বিরাজমান ব্যবস্থায় পরিচালকদের বিধিবদ্ধ দায়িত্ব এড়িয়ে যাবার সুযোগ রয়েছে। অবিবাহিত নারীদের অগ্রাধিকারভিত্তিক নিয়োগ এবং নারী শ্রমিকদের অবেক্ষাধীন মেয়াদ  আইনগত মেয়াদের চেয়ে অতিরিক্ত হওয়ায় অনেক নারী-শ্রমিক তাদের বৈধ/আইনগত অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। অনানুষ্ঠানিক খাতে নারী-শ্রমিকদের ব্যাপক সংখ্যাবৃদ্ধি সত্ত্বেও তাদের অধিকারসমূহ আইন দ্বারা সুরক্ষিত নয়।

সংবিধান নারীর অধিকার ও মর্যাদার যে নিশ্চয়তা দিয়েছে এবং সামাজিক নিয়মাচার ও রীতি হিসেবে ব্যক্তি-আইনে যা প্রতিফলিত হয়েছে এ দুয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ে জন্মগ্রহণ করে সেই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ব্যক্তি-আইন বস্ত্তত পারিবারিক আইনসমূহের ভিত্তি। সুতরাং বিবাহ, বিবাহ-বিচ্ছেদ, অভিভাবকত্ব, শিশু-রক্ষা ও উত্তরাধিকার বিষয়ে দেওয়ানি আইন ও ব্যক্তি-আইন নারী-পুরুষের ব্যবধান অব্যাহত রেখে চলেছে।

মুসলিম আইন অনুসারে বিবাহ হলো দু’ব্যক্তির মধ্যে সম্পাদিত একটি চুক্তি এবং এই চুক্তির বৈধতার জন্য দু’জন সাক্ষীর উপস্থিতিতে উভয় পক্ষের সম্মতি প্রদান অত্যাবশ্যক। বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে আইনের ব্যাখ্যা হচ্ছে: মেয়েকে বাল্যাবস্থায় পিতামাতা বিয়ে দিলে মেয়েটি সাবালেগ হওয়ার পর অবশ্যই সে তা অনুমোদন বা বাতিল করতে পারবে। বাল্যবিবাহ রোধের পদক্ষেপ হিসেবে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ১৯২৯ (১৯৮৪ সালে সংশোধিত) নারী-পুরুষের বিয়ের ন্যূনতম বয়স বাড়িয়ে সংশোধিত আইনে নারীর জন্য ১৮ ও পুরুষের জন্য ২১ বছর নির্ধারণ করেছে। কিন্তু বাস্তবে এটির প্রয়োগ খুবই সীমিত এবং এ আইনভঙ্গের জন্য মামলা দায়ের হয়েছে এমন নজীর খুবই কম। আইনটি ভঙ্গের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা থাকলেও এতে এধরনের বিবাহ অবৈধ ঘোষণার কোনো বিধান নেই। ইসলাম সীমিত আকারে বহুবিবাহ অনুমোদন করে যেখানে একজন ব্যক্তি বিশেষ শর্তাধীনে একসঙ্গে ৪ জন স্ত্রী রাখতে পারে: (ক) স্ত্রীদের মর্যাদানুযায়ী ভরণপোষণ দেওয়ার ক্ষমতা স্বামীর থাকতে হবে; (খ) স্বামী সকল স্ত্রীকে সমান ভালোবাসা দিবে এবং সকলের প্রতি সমদর্শী হবে। কিন্তু এ ধরনের নির্দেশাবলি কার্যকর করার পদ্ধতির অভাবে বয়োজ্যেষ্ঠ স্ত্রীগণ সাধারণত স্বামীর অবহেলা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে।

এসকল স্ত্রীর সুরক্ষা বিধানের জন্য ১৯৬১ সালের পারিবারিক অধ্যাদেশে সালিস পরিষদ এবং বর্তমান স্ত্রী/স্ত্রীগণের লিখিত পূর্বানুমতি ব্যতীত কোনো ব্যক্তির পক্ষে অন্য কোনো বিবাহের চুক্তি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আইন ভঙ্গকারীর জন্য শাস্তি হিসেবে রয়েছে তাৎক্ষণিক পুরো দেনমোহর বা মোহরানা (স্ত্রীর কাছে স্বামী কর্তৃক একটি নির্ধারিত অঙ্কের অর্থ প্রদানের অঙ্গীকার) পরিশোধ। স্ত্রীর চাহিদানুযায়ী তলবী মোহরানা সঙ্গে সঙ্গে এবং স্থগিত মোহরানা বিবাহ বিচ্ছেদের সময় পরিশোধ করতে হয়। শাস্তির মধ্যে আরও আছে ১ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড বা ৫০০০ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ড। কিন্তু এ অধ্যাদেশে পরবর্তী বিবাহ অবৈধ ঘোষণার কোনো বিধান নেই।

মুসলিম আইনের অধীনে নিম্নোক্ত যেকোন একটি উপায়ে বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটানো যায়: (ক) আদালতের হস্তক্ষেপ ছাড়া স্বামী ও স্ত্রীর পারস্পরিক সম্মতির মাধ্যমে; (খ) ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ অনুযায়ী স্ত্রীর অনুরোধে আদালতের ডিক্রি অনুসারে এবং (গ) কোনো কারণ প্রদর্শন ব্যতিরেকে স্বামীর ইচ্ছানুযায়ী।

১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশে সাক্ষীদের সম্মুখে বিবাহ বিচ্ছেদের অভিপ্রায় প্রকাশের এবং চূড়ান্ততালাক সম্পন্ন হওয়ার প্রক্রিয়া সংশোধিত হয়েছে। অনুসৃত কার্যক্রম অনুযায়ী তালাক তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হবে না। বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে প্রেরিত বিজ্ঞপ্তি ও বিবাহ বিচ্ছেদ কার্যকর হওয়ার মধ্যে ৯০ দিনের ব্যবধান থাকতে হবে।

মুসলিম বিবাহ রেজিস্ট্রার কর্তৃক কাবিন রেজিস্ট্রির সময় স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে তালাকের অধিকার প্রদান করলেই কেবল মুসলিম নারী ইচ্ছানুযায়ী বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার পায়। অবশ্য স্ত্রী কোর্ট-ডিক্রির মাধ্যমে তালাক গ্রহণ করতে পারলেও তা একটি অনিশ্চিত, ব্যয়বহুল ও প্রলম্বিত জটিল পদ্ধতি। এর ফলে আইন সংস্কার হওয়া সত্ত্বেও বিবাহ ও তালাকের ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য টিকে আছে।

মুসলিম আইন অনুসারে মৃত স্বামীর সগোত্রীয় উত্তরাধিকারী থাকলে স্ত্রী সম্পত্তির নির্দিষ্ট অংশ হিসেবে এক-অষ্টমাংশ পায়,  আর সেরকম উত্তরাধিকারী না থাকলে পায় মৃত স্বামীর সম্পত্তির এক-চতুর্থাংশ।

একমাত্র কন্যা মৃত পিতা বা মাতার অর্ধেক সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। পুত্র ছাড়া একাধিক কন্যা থাকলে কন্যাগণ যৌথভাবে সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশের অধিকারী হয়। যদি সেখানে কোনো পুত্র (বা পুত্রগণ) থাকে তাহলে কন্যা অথবা প্রত্যেক কন্যার অংশ হবে পুত্র বা পুত্রদের অংশের অর্ধেকের সমান। এক কথায়, পুরুষ সদস্যরা নারী সদস্যদের চেয়ে বেশি সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। সুতরাং উত্তরাধিকারের বিষয়েও ব্যক্তি-আইনে বিস্তর লিঙ্গবৈষম্য বিদ্যমান।

মুসলিম আইন অনুসারে মা কখনও সন্তানদের অভিভাবকত্বের অধিকারী নন। এ অধিকার পিতার ওপর এবং তারপরে তার পিতা ও ভাইদের ওপর ন্যস্ত থাকে। মা ৭ বছর বয়স পর্যন্ত পুত্রসন্তানদের ও কন্যাসন্তান সাবালিকা না হওয়া পর্যন্ত তাদের যত্ন করার ও অভিভাবকত্বের অধিকারী।

১৮৯০ সালের প্রতিপাল্য ও অভিভাবকত্ব আইন দ্বারা সংশোধিত আইনসমূহে বলা হয়, পিতামাতার অধিকারের চেয়ে সন্তানদের কল্যাণ অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। একজন মায়ের কাছে নির্ধারিত বয়সের পরেও সন্তানরা থাকতে পারে যদি আদালত সন্তোষজনভাবে মনে করে যে, সন্তানরা পিতার নিকট যথেষ্ট যত্ন পাবে না। মা আদালতে সন্তানদের অভিভাবকত্ব দাবি করে আবেদন করতে পারেন। কিন্তু এটি একটি প্রলম্বিত ও ব্যয়বহুল মামলা। পিতা বিশেষ পরিস্থিতিতে সন্তানের সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারেন, কিন্তু মায়ের সেই অধিকার নেই; এমনকি সন্তানের অভিভাবকত্ব পেলেও মা আদালতের পূর্বানুমতি ছাড়া তা পারেন না। একজন মুসলমান মা আর্থিকভাবে স্বচ্ছল পুত্রের কাছ থেকে নিজ ভরণপোষণ লাভের অধিকারী। (মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১)।

বর্তমান আইনে অনুষ্ঠিত প্রতিটি মুসলিম বিবাহ রেজিস্ট্রিকরণ বাধ্যতামূলক। বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রিকরণ আইন, ১৯৭৪ নামে একটি আইনও রয়েছে। সাধারণত গ্রামাঞ্চলে দেখা যায়, গ্রামের অধিকাংশ বিবাহ রেজিস্ট্রি করা হয় না। আবার বাল্যবিবাহ নিরোধের আইন বলবৎ থাকা সত্ত্বেও ১৮ বছরের অনেক কমবয়সী মেয়েদেরও বিয়ে দেওয়া হয়। তবে বাংলাদেশে, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে জন্মনিবন্ধীকরণ রীতির অভাবে এ আইনটির বাস্তবায়ন যথেষ্ট কঠিন। ধর্মীয় বিধি অনুসারে মোহরানার (স্ত্রীকে প্রদেয় অর্থ) ব্যবস্থা থাকলেও খুব কমক্ষেত্রেই তা পরিশোধ করা হয়। বাস্তবে সমাজে এখন যৌতুকপ্রথা (বিবাহে বিয়ের কনের অভিভাবক কর্তৃক অর্থ, গহনা ও বিলাসদ্রব্যাদি উপহার) চালু রয়েছে এবং তা একটি সামাজিক প্রথায় পরিণত হয়েছে। যৌতুক পরিশোধ না করায় প্রায়শই অনেক মহিলার জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে।

নারীদের আইনগত মর্যাদা উন্নয়নের জন্য মহিলা সংগঠনসমূহের দাবির প্রতি সাড়া দিয়ে সরকার কখনো কখনো বিদ্যমান আইনগুলি সংশোধন ও নতুন নতুন আইন প্রণয়ন করছে। এগুলির মধ্যে রয়েছে: মুসলিম ব্যক্তি-আইন (শরিয়ত) প্রয়োগ আইন ১৯৩৭; মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন ১৯৩৯; মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১ (১৯৮৬ সালে সংশোধিত); মুসলিম পারিবারিক আইন বিধি ১৯৬১; মুসলিম বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ রেজিস্ট্রেশন বিধি ১৯৭৪; মুসলিম বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ আইন ১৯৭৫; মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন ১৯৩৯; পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ ১৯৮৫;  পারিবারিক আদালত বিধি ১৯৮৫;  বাংলাদেশ দন্ডবিধি ১৮৬০;  সাক্ষ্য-প্রমাণ আইন ১৯৮০; দেওয়ানি কার্যবিধি ১৯০৩;  ফৌজদারি আইন সংশোধনী আইন ১৯৩৮; অনৈতিক কর্মকান্ড দমন আইন ১৯৩৩;  যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইন ১৯৮০;  নারী-নির্যাতন (প্রতিরোধমূলক শাস্তি) আইন ১৯৮৩; নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইন ১৯৯৫; এবং  মাতৃত্ব সুবিধা আইন ১৯৩৯।

হিন্দু সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে দেওয়ানি আইনসমূহ প্রযোজ্য হলেও বিবাহ, বিবাহ-বিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার ও অভিভাবকত্বের মতো ব্যক্তিগত বিষয় হিন্দু ব্যক্তি-আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এ সকল আইন ১৯৪৭ থেকে অপরিবর্তিত রয়েছে।

হিন্দুধর্ম মতে বিবাহ চুক্তি নয়, বরং একটি অলঙ্ঘনীয় ধর্মীয় বিধান। একজন হিন্দু পিতার প্রধান কর্তব্য হলো কন্যার বিবাহ দান। হিন্দুধর্মে বিবাহে মেয়ের সম্মতি নিষ্প্রয়োজন, বিবাহ বিচ্ছেদযোগ্য নয় এবং অনিয়ন্ত্রিত বহুবিবাহ অনুমোদিত। পিতা যেখানে সর্বদাই সন্তানদের অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারী সেখানে মাতা অভিভাবক হতে পারলেও তার অধিকার পিতার চেয়ে কম। সকল কন্যা সন্তান উত্তরাধিকার বিষয়ে সমানাধিকারী নয়। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে অবিবাহিত ও বিবাহিত সপুত্রক কন্যাগণ উত্তরাধিকারী হতে পারে। সন্তান ধারণের ক্ষমতার বয়স অতিক্রান্ত এমন বিবাহিত কন্যা বা পুত্রহীনা বিধবা কন্যারা উত্তরাধিকারী হতে পারে না। হিন্দু আইনে দত্তক অনুমোদিত, কিন্তু শুধু ছেলেরাই দত্তক হিসেবে গ্রহণযোগ্য। [খালেদা সালাহ উদ্দীন]

নারী নির্যাতন  বেইজিং-এ অনুষ্ঠিত চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলন ১৯৯৫ নারীর প্রতি সহিংসতাকে নারী-পুরুষ সম্পর্কে একটি অন্যতম সমস্যা বলে চিহ্নিত করেছে। উক্ত সম্মেলন মনে করে, পুরুষ কর্তৃক নারীর প্রতি সহিংসতামূলক আচরণ বিশ্বময়। তবে উন্নত বিশ্বের চেয়ে উন্নয়নশীল দেশসমূহে নারী নির্যাতনের মাত্রা অনেক বেশি।

নারী নির্যাতন বলতে সাধারণত বলপূর্বক নারীর উপর শারীরিক, মানসিক অথবা লিঙ্গ নির্যাতনকে বুঝায়। এ সহিংসতা হতে পারে ব্যক্তিক, পারিবারিক বা দলীয়। নারী পুরুষের অসম সামাজিক অবস্থান ও অসম অধিকার সহিংসতার সূতিকাগৃহ। পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতায় নারীর অধস্তনতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বিভিন্ন আইন-কানুন, আচার-অনুষ্ঠান ও রীতিনীতির মাধ্যমে যা পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে নারী সহিংসতায় ব্যবহূত হয়। নারী হওয়ার কারণে গৃহে অন্তরীণ থাকা, বোরখা ব্যবহার করা, অসম উত্তরাধিকার ভোগ করা, পরিবার ও সমাজে অধস্তন ভূমিকা পালন করা এবং আরও অসংখ্য বৈষম্যমূলক আচরণ নারীর প্রতি এক ধরনের নীরব সহিংসতা। ঐ সহিংসতা থেকেই উদ্ভূত শারীরিক ও লিঙ্গীয় সহিংসতা।

বাংলাদেশে নারী নির্যাতন একটি বড় সমস্যা। এদেশে শতকরা ১৪ ভাগ মাতৃমৃত্যু ঘটে নারীর প্রতি সহিংসতার কারণে। এসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে অহরহ। সহিংসতায় গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি হবার ঘটনা নিত্যদিনকার। মানবাধিকার প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, নারীর প্রতি অপরাধ প্রবণতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

নারী নির্যাতনের প্রধান ক্ষেত্র হলো: (১) লিঙ্গ নির্যাতন, (২) ধর্ষণ, (৩) জখম ও হত্যা, (৪) মেয়ে শিশু/ভ্রূণ হত্যা, (৫) ফতোয়া, (৬) যৌতুক, বিয়ে বা তালাকের কারণে জখম ও হত্যা, (৭) ব্যভিচার, (৮) পতিতাবৃত্তি, ও (৯) নারীপাচার।

পারিবারিক পরিমন্ডলেই নারী নির্যাতন সবচেয়ে বেশি হয়। রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কারণে নারীরা পুরুষের আজ্ঞাধীন। বাংলাদেশ সংবিধানে নারীপুরুষ সম্পর্ক বৈষম্যহীন করা হয়েছে। এ নীতি কার্যকর করার লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন সময়ে নারী সহিংসতা রোধকল্পে বিভিন্ন আইনও প্রণয়ন করেছে।

নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ ও অন্যান্য উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনের জন্য সরকার নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেছে। এই মন্ত্রণালয় নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যেমন: (১) লিগ্যাল এইড কমিটি গঠন, (২) মহিলা সহায়তা কর্মসূচি প্রকল্পের আইনগত সহায়তা, (৩) নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেল হতে আইনি সহযোগিতা, (৪) নির্যাতিত নারী ও শিশু আবাসন ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে নির্যাতিত নারী ও শিশুকে আশ্রয়, চিকিৎসা, প্রাথমিক শিক্ষা এবং বিভিন্ন পেশায়  প্রশিক্ষণ দান, (৫) নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধির লক্ষ্যে চাকুরি বিনিয়োগ তথ্য কেন্দ্র, কম্পিউটার অপারেটিং কোর্স, শর্টহ্যান্ড, টাইপ রাইটিং ও বিভিন্ন কোর্সে প্রশিক্ষণ পরিচালনা যা নারীদের চাকুরি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।

জাতিসংঘ এবং অন্যান্য উন্নয়ন সংস্থা কর্তৃক গৃহীত নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ সরকার তাকে স্বাগত জানিয়েছে। উল্লেখ্য, কয়েকটি ধারা ব্যতীত বাংলাদেশ ১৯৮৪ সালে নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য অপনোদন কনভেনশনে সম্মতি জ্ঞাপন করেছে। এ ছাড়া ১৯৯৫ সালে বেইজিং-এ অনুষ্ঠিত চতুর্থ বিশ্বনারী সম্মেলনে গৃহীত ১২টি বিবেচ্য বিষয়ের মধ্যে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে যে পদক্ষেপগুলির সুপারিশ করা হয়েছে তার প্রতিও বাংলাদেশ সমর্থন জানিয়েছে।  [নিলুফার পারভীন]

সিভিল সার্ভিসে নারী  ব্রিটিশ শাসিত ভারতের (১৭৫৭-১৯৪৭) সরকারি চাকুরিতে নারীদের সংখ্যা সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্য নেই। তবু, এমন ধারণা করা যায় যে, ঐ সময়কালে প্রশাসনযন্ত্রে তাদের সংখ্যা ছিল নগণ্য। প্রকৃতপক্ষে প্রাথমিক বছরগুলিতে আইনগতভাবেই উচ্চপর্যায়ের প্রশাসনিক পদে মহিলাদের প্রবেশে বাধা দেয়া হতো। প্রধানত চিকিৎসা সংক্রান্ত চাকুরিতে, ভারতীয় শিক্ষাবিভাগে, প্রাদেশিক শিক্ষা বিভাগে এবং ডাক ও তার বিভাগের পদসমূহে তাদের নিয়োগ করা হতো। স্বরাষ্ট্রবিভাগ, গোয়েন্দা ব্যুরো, অর্থ, নিরাপত্তা, মুদ্রণ, প্রতিরক্ষা, সশস্ত্র বাহিনী, ভারতীয় ভূতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ, বিস্ফোরক শাখা, শ্রম ও ভূমি, অল-ইন্ডিয়া রেডিও, সামরিক হিসাব শাখার নিম্নপর্যায়ের কারণিকের পদসমূহে এবং কেন্দ্রীয় রাজস্ব বোর্ডের বিবিধ পদে কাজ করার সুযোগ বা অনুমতিও তারা পেত।

১৯৪৭ সালের পর ব্রিটিশদের সৃষ্ট সরকারি চাকুরির পদ্ধতি পাকিস্তান অপরিবর্তিত রেখেছিল। ১৯৫৬ ও ১৯৬২ সালের পাকিস্তান সংবিধানে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের সমান সুযোগ নিশ্চিত করার বিধান থাকলেও বাস্তবে অবস্থাটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। কেন্দ্রীয় সরকার পর্যায়ে গৃহীত নিয়োগবিধি হিসাব ও নিরীক্ষণ সার্ভিস, সামরিক হিসাব সার্ভিস, আয়কর সার্ভিস, ডাকবিভাগীয় সার্ভিস সহ অধিকাংশ কেন্দ্রীয় পর্যায়ের চাকুরিতে মহিলাদের প্রবেশের সুযোগ দেয়া হয়েছিল, কিন্তু তারা নিখিল পাকিস্তানভিত্তিক কোনো সার্ভিস, যেমন সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান (সিএসপি) এবং পুলিশ সার্ভিস অব পাকিস্তান (পিএসপি) ইত্যাদিতে যোগদানের অযোগ্য বিবেচিত হতো। তবে, নিম্নতর স্তরের চাকরিসহ কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পর্যায়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিভাগের মতো পেশাদারি চাকরিতে নারীদের বর্ধিত সংখ্যায় নিয়োগ দান করা হয়েছিল। পাকিস্তানে সরকারি চাকরিতে নারীদের অসম প্রতিনিধিত্ব তাদের স্থায়ী সামাজিক পশ্চাদপদতার জন্যই প্রকটতর হয়েছিল।

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদেরও সব ধরনের পেশায় যোগদানের জন্য উৎসাহিত করা হলেও তাদের স্থায়ী সামাজিক অনগ্রসরতা সরকারি প্রশাসনের শীর্ষপর্যায়ে প্রবেশের সমান সুযোগ সদ্ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বিশ শতকের সত্তরের দশকের গোড়া থেকেই নীতিনির্ধারণ ও সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় মহিলাদের অন্তর্ভূক্তি ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য সরকার জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আইনের বিধান, নির্বাহী আদেশ, নীতি সংশোধন ও প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মাধ্যমে নারীর সামাজিক পদমর্যাদা উন্নয়ন ও অবস্থার পরিবর্তন ঘটানোর জন্য গত তিন দশকে অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এসব পদক্ষেপ ও উপযুক্ত কর্মপন্থা জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত অনুরূপ পদক্ষেপের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এসব পদক্ষেপের মধ্যে ছিল ১৯৭৫ সালে আন্তর্জাতিক নারীবর্ষ ঘোষণা, জাতিসংঘ ঘোষিত নারীদশক (১৯৭৫-৮৫), নারীদের বিরুদ্ধে সকল ধরনের বৈষম্যের বিলুপ্তি বিষয়ক জাতিসংঘ সনদ (UNCEDAW)। বস্ত্তত, এসব ব্যবস্থা নারীর মর্যাদা বৃদ্ধি ও ভূমিকা সম্প্রসারণ এবং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নীতি প্রণয়ন ও কর্মসূচি গ্রহণের জন্য সরকারকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছে বলে মনে হয়। অধিকন্তু মেক্সিকো, ডেনমার্ক, নাইরোবি ও বেইজিং শহরে অনুষ্ঠিত চারটি বিশ্ব নারী সম্মেলনের ফলাফল বাংলাদেশের মহিলাদের আশান্বিত করেছে।

বাংলাদেশের সংবিধান যেকোন সরকারি চাকরি ও কর্মে অংশগ্রহণের জন্য মহিলাদের সমান অধিকার প্রদান করে। সংবিধান কেবলমাত্র নারী পুরুষের সমতাই নিশ্চিত করে নি, এছাড়াও সরকারি চাকরির নির্দিষ্ট আনুপাতিক সংখ্যক পদ মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত রাখার মাধ্যমে বিদ্যমান অসম প্রতিনিধিত্ব নিরসনের প্রয়োজনীয়তাও স্বীকার করে। প্রশাসনে মহিলাদের অংশগ্রহণ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ আইনগুলোর অন্যতম হচ্ছে সরকারি চাকরিতে মহিলাদের নিয়োগের জন্য চাকরির কোটা সংরক্ষণ। ১৯৭২ সালে মহিলাদের জন্য প্রথম কোটা সংরক্ষণের ব্যবস্থা চালু করা হয়, তবে তা কার্যকর হয়েছিল ১৯৭৬ সালে কিছুটা পরিবর্তন করে জারিকৃত সরকারি আদেশের পর। আদেশটিতে সকল শ্রেণির শূণ্য পদে মৌলিক যোগ্যতা পূরণ সাপেক্ষে মহিলাদের জন্য শতকরা ১০ ভাগ পদ সংরক্ষণের বিধি সংযোজিত হয়। তথাপি, কিছু কারিগরি পদে, প্রতিরক্ষা বিভাগের পদসমূহে এবং মহিলাদের জন্য অনুপযুক্ত বিবেচিত হতে পারে এমন ধরনের পদগুলিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা সংরক্ষণ ব্যবস্থা প্রযোজ্য ছিল না। তথাপি, বিভিন্ন চাকরিতে মহিলাদের বর্ধিত হারে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংশোধিত এবং আংশিকভাবে পরিবর্তিত কোটা ব্যবস্থার অপর একটি আদেশ ১৯৮৫ সালে জারি করা হয়। সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে এ আদেশ সকল সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্ত্বশাসিত সংস্থা এবং বিভিন্ন সেক্টর কর্পোরেশনের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়। বর্তমানে মেধাভিত্তিক নিয়োগের অতিরিক্ত গেজেটেড পদগুলির ১০ শতাংশ এবং নন-গেজেটেড পদসমূহের ১৫ শতাংশ মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে এবং তা সকল সরকারি চাকরির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তাই মেধা ও লিঙ্গের ভিত্তিতে মহিলারা সরকারি চাকরিতে যোগদান করতে পারে। মুক্তিযোদ্ধা, উপজাতি, আনসার ও ভিডিপি’র জন্য সংরক্ষিত অন্যান্য কোটার মাধ্যমেও তারা সরকারি চাকরিতে যোগ দিতে পারে যদি তারা সেগুলির যেকোনটির অন্তর্ভুক্ত থাকে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদের শতকরা ৬০ ভাগ মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত রাখারও একটি বিধান রয়েছে।

এ কোটার অপর একটি দিক হচ্ছে এটি চাকরিতে প্রবেশকালীন সময়েই প্রযোজ্য। যে অল্পসংখ্যক মহিলা ঐ পর্যায়ের বাইরে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেছে (চুক্তি, প্রেষণ বা অন্য বিভাগ থেকে প্রেরিত) তারা কোটা ব্যবস্থা থেকে কোনোই সুবিধা লাভ করতে পারে না। কোটা ব্যবস্থা প্রচলনের পূর্বে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পসমূহ এবং সংবিধিবদ্ধ সংস্থা ব্যতীত সরকারি খাতের চাকরির মাত্র ৬.৬০ শতাংশ পদে মহিলারা মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ লাভ করে। ১৯৭৬ সালে কোটা ব্যবস্থা প্রচলনের পর মহিলা চাকুরিজীবীর সংখ্যা প্রায় ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায় এবং কোটা ব্যবস্থা মহিলাদের নিয়োগের ধরনে কোনো লক্ষ্যণীয় মাত্রায় প্রভাব ফেলেছে বলে মনে হয় না।

সকল খাতে মহিলাদের সমান প্রতিনিধিত্বের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য শাসনতান্ত্রিক বিধান থাকা সত্ত্বেও এবং নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির পক্ষ থেকে অব্যাহত সমর্থন ও সহযোগিতা দেওয়ার পরও প্রশাসনে মহিলাদের নিয়োগের অবস্থা প্রান্তিক পর্যায়েই রয়ে গেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর সরকারি চাকরিতে মহিলাদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৭২ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত মাত্র ১৪১৭ জন মহিলাকে ১৫টি ক্যাডারে নিয়োগ করা হয়েছে এবং অধিকাংশ মহিলাকে এ ক্যাডারগুলির মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডার এবং অধস্তন পর্যায়ে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সরকারি চাকরির বিভিন্ন ক্যাডারে মোট চাকরিজীবীর মাত্র ৪.৮৯ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে এসব মহিলা। কোটা নীতি প্রচলনের পূর্বে সরকারি চাকরিজীবীর (সরকারি খাতের শিল্প প্রতিষ্ঠান ব্যতিরেকে) সংখ্যা ছিল ৩,৩১,১৮৯। তন্মধ্যে মাত্র ২৩,৪২০ জন মহিলাকে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দান করা হয়েছিল। বর্তমানে সরকারি খাতের মোট ৯,৭১,০২৮ জন চাকরিজীবীর মধ্যে আছেন মাত্র ৮৩,১৫৬ জন মহিলা। প্রায় ৮.৫৬ শতাংশ মহিলা চাকরিজীবী এবং এদের ৯০ শতাংশের অধিক (৭৪,৮৮৪) তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ সরকারি চাকরিতে বিপুল সংখ্যক মহিলা নিম্নবেতনভূক ও করণিক পদের কর্মচারী। কিন্তু শীর্ষ প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে অবস্থানরত মহিলা চাকরিজীবীগণ (শতকরা প্রায় ১০ ভাগ) অপেক্ষাকৃত বেশি মর্যাদা ও বেতন লাভ করলেও তাদের সংখ্যা নগণ্য। ১ম ও ২য় শ্রেণির পদগুলির ১০ শতাংশ এবং ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণির পদগুলির ১৫ শতাংশ সংরক্ষিত করা সত্ত্বেও এরূপ অবস্থা দেখা যাচ্ছে।

সচিবালয়ে মহিলা কর্মচারীর সংখ্যা খুবই নগণ্য। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলিতে ৮৬১১ জন কর্মচারীর মধ্যে মাত্র ৭৮৪ জন মহিলা (প্রায় ৯.১ শতাংশ)। সরকারি কর্মচারীদের সাধারণভাবে চার শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছে, যেমন ১ম ও ২য় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা, ৩য় শ্রেণির নন-গেজেটেড কর্মকর্তা এবং ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী। ২০৭০ জন গেজেটেড কর্মকতার মধ্যে মাত্র ২১২ জন মহিলাকে ১ম ও ২য় শ্রেণিতে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। ৬৫৪১ জন সরকারি কর্মচারীর মধ্যে প্রায় ৫৭২ জন মহিলাকে নন-গেজেটেড কর্মকর্তা ও কর্মচারী পদে ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণিতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম-সচিব ও উপ-সচিব পদে কর্মরত মহিলাদের সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য।  [সালমা আহমেদ]

ঊন্নয়নে নারী  উন্নয়ন অভিধানে একটি অতি আধুনিক সংযোজন এবং এমন একটি ধারণা যা বৈশ্বিক ও জাতীয় পর্যায়ে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বা অবদানকে স্বীকৃতি দেয়। ঊন্নয়নে নারী  বলতে বুঝায় যে নারীরা উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত এবং উন্নয়নে তাদের অংশগ্রহণের পরিবেশ  অনুকূল করা অত্যাবশ্যক। বাংলাদেশের নারীরা বরাবরই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার সনাতনী  ধ্যান-ধারণা ও মূল্যবোধ এবং লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি ও সুশাসনের প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক বহু সুযোগ সুবিধা থেকে  প্রায়শ তারা বঞ্চিত। নারীরা সন্তান ধারণ করে,  সন্তান জন্ম দেয়, তাদের প্রতিপালন করে এবং সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম করে, কিন্তু কখনো তারা নিজেদের কাজের জন্য যথোপযুক্ত  মজুরি ও স্বীকৃতি পায় না। চাকরির ক্ষেত্রে কোনো প্রকার আইনি বা প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা নারীরা পায় না।  গ্রা্রমীণ পর্যায়ে  ৮৪%  এবং শহরে ৫৯%  নারী অবৈতনিক গৃহ পরিচালিকা  হিসেবে কর্মরত থাকে। বাংলাদেশের নারীরা পুরুষের তুলনায় সপ্তাহে গড়ে ২১ ঘন্টা বেশি সময় কাজ করে। যদিও  ঘর গৃহস্থালীর কাজে যুক্ত নারীশ্রমকে অর্থনৈতিক মানদন্ডে কর্মকান্ড হিসেবে ধরা হয়েছে, কিন্তু এর অর্থমূল্য এখন পর্যন্ত জাতীয় আয় গণনায় হিসাব করা হয় না।

নারীর শ্রেণি পরিচিতি সবসময় নির্ধারিত হয় পরিবারের পুরুষ সদস্যের পেশা ও সামাজিক মর্যাদার ভিত্তিতে। এমন কি পরিবারের মধ্যে, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় নারীরা কম খাদ্য গ্রহণ করে, স্বাস্থ্যসেবা এবং সম্পত্তির উত্তরাধিকার লাভ ও সংরক্ষণের সুযোগ তাদের জন্য কম। সাংবিধানিকভাবে নারী ও পুরুষ উভয়েরই সমানাধিকার স্বীকৃত থাকলেও পারিবারিক ও ধর্মীয় আইন নারীর সার্বভৌম সত্ত্বা ও  অধিকারকে খর্ব করে রেখেছে। বাংলাদেশের নারী অধিকার আন্দোলন, অসংখ্য নারী অধিকার দল বাংলাদেশের সকল মানুষের জন্য এক ও অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নের দাবিতে সোচ্চার রয়েছে। প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দল তাদের বিগত নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে নারীর প্রতি বৈষম্য দূরীকরণে প্রয়োজনীয় কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেছে।  অনেক সেমিনার ও কর্মশালা শেষে ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সর্বপ্রথম ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোডের একটি ড্রাফট মডেল তৈরি করে এবং অন্যান্য নারী সংগঠনের সহায়তায় মডেলটির উৎকর্ষ সাধন করে। ১৯৯৬ সালে  আইন ও সালিস কেন্দ্রের সহায়তায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোডের  চূড়ান্ত খসড়া তৈরি করে সরকারের নিকট জমা দেয়। কিন্তু সরকারের নিষ্ক্রিয়তার কারণে এটি এখন পর্যন্ত আইনে পরিণত হয় নি। সিডও’র ওপর প্রণীত এনজিও শ্যাডো রিপোর্ট (২০০৪) পর্যালোচনা শেষে জাতিসংঘ সিডও কমিটি নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে বৈষম্যের সংজ্ঞা নিরূপণ বিশেষ করে পারিবারিক সহিংসতা, ধর্ষণ ইত্যাদিসহ পারিবারিক আইনে বৈষম্য দূরীকরণে  ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে  বাংলাদেশকে পরামর্শ দেয়। বর্তমান আইনি প্রক্রিয়াতে জটিলতা থাকা সত্ত্বেও নারীর জন্য কিছু আইন প্রণীত হয়েছে। মিডিয়েশন কোর্ট প্রতিষ্ঠা, এসিড নিক্ষেপ আইন প্রণয়ন এবং নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশ সরকারের  একটি ইতিবাচক  উদ্যোগ।

নারী আন্দোলনসমূহ ও নারী মুক্তি প্রচেষ্টা, উন্নয়ন ও পরিবর্তনের প্রতিনিধি হিসেবে নারীর স্বীকৃতি আদায়ের জন্য এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নারীদের ব্যাপকতর অংশগ্রহণের পথ প্রশস্ত করেছে। বাংলাদেশে নারী শ্রমশক্তির পরিমাণ প্রায় ২৫ মিলিয়ন। এরমধ্যে মাত্র ১০,০০০ জন নিয়োজিত প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনা পেশায়। প্রায় ৭৯% নারী কাজ করে কৃষিখাতে (মৎস্য ও বনায়নসহ), ৯.৯% নারী কাজ করে ম্যানুফ্যাকচারিং ও পরিবহন খাতে, ২.২% নারী বিপণন শ্রমিক ও ০.৬% নিয়োজিত করণিক পর্যায়ের কাজে। আত্মকর্মসংস্থানের অধীনে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি, বিশেষত গ্রামীণ  অবকাঠামো বিন্যাসে রাস্তা নির্মাণ ও সংরক্ষণ এই বিভাজনের পর্যায়ভুক্ত নয়। নারী সমাজের এক বিশাল অংশ নিয়োজিত স্বকর্মসংস্থানে, বিশেষ করে কৃষি উৎপাদন, মৎস্যচাষ,  হাঁস-মুরগী পালন, সবজি বাগান, বসতবাড়ির আশেপাশে বৃক্ষরোপণ এবং অাঁখ, বাঁশ ও বেত উৎপাদনে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের প্রায় ৩৪% হচ্ছে নারী। শহরকেন্দ্রিক শ্রমনির্ভর শিল্প, বিশেষত পোশাক শিল্পে ৮০% কাজ নারীরাই করে থাকে।

শ্রম প্রদান ছাড়াও উন্নয়ন ক্ষেত্র উদ্যোক্তা হিসেবে নারীদের অবদান অপরের জন্য বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। উদ্যোক্তা হিসেবে নারীরা হস্তশিল্প ব্যবসাকে প্রাধান্য দেন বেশি। শহর ও গ্রামাঞ্চলে তাদের উপার্জনমূলক ক্রিয়াকর্মের মধ্যে রয়েছে কাপড় সেলাই, নকশা, বাটিক, বুটিক, এমব্রয়ডারি ও খাদ্য বিক্রয়। শহরে কর্মজীবী হিসেবে নারীরা যুক্ত আছেন বিপণীকেন্দ্রসমুহে, অভ্যর্থনা ডেস্কে, বিজ্ঞাপনী সংস্থায়, শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা, আইনব্যবসায়, স্বাস্থ্য বিভাগে, কর্পোরেটেড সেক্টরে, শিল্পকলা, ব্যবস্থাপনা, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং এনজিওতে। সরকারের প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ স্তরে জড়িত আছেন সীমিতসংখ্যক নারী।

এক পরিসংখ্যাণে দেখা গেছে যে সর্বমোট ৫১ জন সচিবের মধ্যে মাত্র ২ জন নারী সচিব, ৮০ জন অতিরিক্ত সচিবের মধ্যে ১ জন নারী, ২৫১ জন  যুগ্ম সচিবের মধ্যে ৩ জন নারী এবং ৪৭৪ জন উপ-সচিবের মধ্যে মাত্র ৭ জন নারী রয়েছেন। পুলিশ প্রশাসনে  বর্তমানে মোট ১ লক্ষ ২৪ হাজার পুলিশের মধ্যে ১৯৫৬ জন নারী কর্মরত আছেন। এরমধ্যে ডি.আইজি পদে ১ জন নারী, এডিশন্যাল ডি.আইজি পদে ৪ জন নারী, এডিশন্যাল এ.এস.পি পদে ১৯ জন নারী, এ.এস.পি পদে ৭৭ জন নারী, ইনস্পেক্টর  পদে ৫৩ জন, এস.আই পদে ১৮৯ জন, এ.এস.আই পদে ২৫৩ এবং কনস্টেবল পদে ১৩৩১ জন নারী  কাজ করছেন। আর্মি মেডিক্যাল কোরে ১ জন মাত্র নারী ব্রিগেডিয়ার কর্মরত আছেন।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নির্বাহী পরিষদের সদস্য হিসেবে ১জন কর ক্যাডারভুক্ত নারী রয়েছেন। তাছাড়া, জাতীয় রাজস্ব বিভাগে কর ক্যাডারে ১৮জন নারী রয়েছেন। এদের মধ্যে কর কমিশনার হচ্ছেন ৪ জন, সহকারি কর কমিশনার ৮ জন এবং যুগ্ম কমিশনার হিসেবে ৬ জন নারী কাজ করছেন। ব্যাকিং সেক্টরে মাত্র ১ জন জেনারেল ম্যানেজার রয়েছেন। সংরক্ষিত কোটা পদ্ধতির ভিত্তিতে নারীরা পুরুষের সাথে সরকারি চাকরি করতে পারেন।  সরকারি চাকরিরত ৮৫,০০০ নারীর মধ্যে (কর্মরত মোট জনশক্তির ৮.৬%) মাত্র ১% মন্ত্রণালয়গুলোতে, ১৬.৫৫% স্বায়ত্বশাসিত সংস্থায় এবং ৮২.৫% সাধারণ অফিসে নিয়োগ প্রাপ্ত। এদের মধ্যে ৭% প্রথম শ্রেণির, ৩% দ্বিতীয় শ্রেণির, ৭৫% তৃতীয় শ্রেণির এবং ১৫% চতুর্থ শ্রেণির চাকরিভুক্ত। জাতীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর ভূমিকা সীমিত। রাজনীতি ও জাতীয় সংসদে তাদের অংশগ্রহণ খুবই নগণ্য।

২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদে সরাসরি নির্বাচনে ৬২ টি আসনে ৫৭জন নারী প্রার্থী ছিলেন। তাদের মধ্য থেকে সর্বাধিক ২৩ জন সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। সরাসরি ও সংরক্ষিত আসন মিলে ৩৪৫টি আসন বিশিষ্ট জাতীয় সংসদে  মোট ৬৮ জন নারী সদস্য রয়েছেন। মন্ত্রী পরিষদে প্রধান মন্ত্রীসহ ৪ জন নারী মন্ত্রী হিসেবে (স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ও কৃষি মন্ত্রণালয়ে)  অধিষ্ঠিত আছেন।

২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসন ছিল ৪৫টি। এই ৪৫টি আসনের বিপরীতে আওয়ামী লীগ ৩৫টি, বিএনপি ৫টি, জাতীয় পার্টি ৪টি ও অন্যান্য দল ১টি আসন  লাভ করে। এসব আসনে দলের পক্ষ থেকে মনোনয়ন দানের ফলে দ্বিতীয় কোনো প্রতিপক্ষ ছিল না। তাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৪৫ জন নারী সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত হন। তাদের নির্বাচনের মাধ্যমে সর্বাধিক নারী সদস্য নিয়ে নবম জাতীয় সংসদ যাত্রা শুরু করে।। এছাড়া বিরোধী দলীয় নেত্রী তো রয়েছেন। যে ২৩টি আসনে নারী প্রার্থীরা সরাসরি প্রতিদ্বন্ধিতা করে বিজয়ী হয়েছেন সেখানে ১টি আসন ছাড়া অন্য ২২টি আসনে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন পুরুষ।

দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ১৫জন প্রেসিডিয়াম ও সেক্রেটারিয়েট সদস্যের মধ্যে ৪ জন এবং জাতীয় কার্যনির্বাহী কমিটির ৭৫ জন সদস্যের মধ্যে ৮ জন হচ্ছেন নারী। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ১২-সদস্য বিশিষ্ট স্থায়ী কমিটিতে মাত্র ১ জন এবং ২৬০-সদস্য বিশিষ্ট জাতীয় কার্যনির্বাহী কমিটিতে ১২জন  নারী রয়েছেন। জাতীয় পাটির (এরশাদ) স্থায়ী কমিটির ৩১জন সদস্যের মধ্যে ২জন নারী ও কার্যনির্বাহী কমিটির ২০০ জন সদস্যের মধ্যে ১৫জন নারী  আছেন।

জামায়েতে ইসলামীর মজলিশ-ই-শুরাতে ২৩৭ জন সদস্যের মধ্যে ৩৫ জন নারী রয়েছেন। তবে এ সংগঠনের মজলিশ-ই-আমেলাতে কোনো নারী নেই। বাংলাদেশ কমিউনিষ্ট পার্টির ৩৩-সদস্য বিশিষ্ট  কেন্দ্রিয় কমিটিতে মাত্র ৩ জন নারী সদস্য রয়েছেন। স্থানীয় সরকারের প্রশাসনিক ইউনিটে নির্বাচিত নারীদের অংশগ্রহণ কম। ইউনিয়ন পরিষদে  ৪২৭৬ জন নির্বাচিত চেয়ারম্যানের মধ্যে  মাত্র ২২ জন নারী ও সাধারণ আসনে নির্বাচিত ৩৮,৪৮৪ সদস্যের মধ্যে ৮৫ জন নারী রয়েছেন।

উন্নয়নে নারী কার্যক্রম এনজিও সেক্টরে বহুল বিস্তৃত। এনজিওদের শীর্ষ সংস্থা এডাবের ১৫ সদস্য বিশিষ্ট নির্বাহী কমিটিতে ৫জন নারী ছিলেন। ৮৮৬টি সদস্য সংস্থার মধ্যে ৩৮ টি ছিল নারী সংগঠন। ২০০১ সালে অভ্যন্তরিণ  কোন্দলে এডাবের  কার্যনির্বাহী কমিটি অচল হয়ে পড়ে। বেশিরভাগ সদস্য এডাব থেকে বের হয়ে The Federation of NGO in Bangladesh নামে পৃথক একটি শীর্ষ সংগঠন গঠন করেন। এই নতুন সংগঠনের ২১ সদস্য বিশিষ্ট কার্যনির্বাহী কমিটিতে ১টি নির্বাচিত ও ৩টি সংরক্ষিত পদে মোট ৪টি নারী সংগঠনকে রাখা হয়। এই সংগঠনের বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৪৭৯। এর মধ্যে ৮৫টি নারী সংগঠন রয়েছে। এরা নারীদের মধ্যে কাজ করে এবং তাদের মধ্যে সংগঠন তৈরি, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, আয়মুখী ও ঋণ কার্যক্রমে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো, মৌলিক মানবাধিকার সংরক্ষণে গতিশীলতা বৃদ্ধি, জীবিকা নির্বাহের জন্য দক্ষতা বৃদ্ধি প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্যসেবা বৃদ্ধি ও নারীশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি ইত্যাদি ক্ষেত্রে কাজ করে।

উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে প্রচুর প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। নারীরা কৃষি বা অন্য অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিম্ন মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হয়। মজুরি বৈষম্য ছাড়াও নারীদের সাধারণত শ্রমবাজারে প্রবেশাধিকার সমস্যা রয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে প্রবেশের সুযোগ থাকলেও নিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের বিবেচনা করা হয় না। সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের ভূমিকা গৌণ। সরকারের স্বকর্মসংস্থান কর্মসূচি এবং অধিকাংশ বেসরকারি সংস্থার অভিষ্ট লক্ষ্যগোষ্ঠীর মধ্যে দরিদ্র ও ভূমিহীন নারীরাও রয়েছেন। কিন্তু এসব কর্মসূচি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানো, বিশেষ করে দরিদ্রদের মধ্যে যারা হতদরিদ্র তাদের জন্য কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এখনো সমস্যা হিসেবেই রয়ে গেছে। বিষয়টি বেসরকারি সংস্থার কর্মকান্ডের আওতাভুক্ত হলেও প্রান্তিক পরিবারের নারীরা এসব কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের তেমন সুযোগ পায় না। উন্নয়নে  নারীর পূর্বশর্ত হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়ন ও দক্ষতাবৃদ্ধির পাশাপাশি তাদের অবস্থা ও অবস্থানের পরিবর্তন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। অবিভক্ত বাংলায় নারী উন্নয়ন শুরু হয়েছিল বাল্যবিবাহ, অবরোধ প্রথা ও ধর্মের নামে নারীদের উপর অন্যায় অবিচার প্রতিরোধ আন্দোলনের মাধ্যমে। পরবর্তী সময়ে নারী অধিকার ইস্যু হিসেবে শিক্ষা, ভোটাধিকার ও নির্বাচন, কৃষক আন্দোলন, রাজনীতি, অর্থনৈতিক কার্যক্রম এবং প্রশাসনে গুরুত্ব পায়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন সংস্থার কার্যক্রমে বর্তমানে দারিদ্র্য দূরীকরণ, জনমিতিক পরিবর্তন ও মৌলিক চাহিদা নিরূপক সেবামূলক কার্যক্রমে নারীর অংশগ্রহণ গুরুত্ব পাচ্ছে।

বাংলাদেশের সংবিধান ধর্ম, বর্ণ, স্থান ও জন্মের কারণে  নারীদের প্রতি বৈষম্য নিষিদ্ধ করেছে। সরকার নারী উন্নয়নে নারী পুনর্বাসন বোর্ড, পুনর্বাসন ও কল্যাণ ফাউন্ডেশন, জাতীয় নারী সংস্থা, নারী বিষয়ক অধিদপ্তর, স্বতন্ত্র নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেছে। মহিলা অধিদপ্তর বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় এবং ১৩৬ টি উপজেলায় শাখা খুলেছে। জাতীয় নারী সংস্থা ২৩৬টি উপজেলায় শাখা কার্যক্রম বাস্তবায়িত করছে।

সরকার কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল নির্মাণ, বস্তিবাসী নারীদের সহযোগিতা, কর্মজীবী মায়েদের সন্তানদের জন্য ডে- কেয়ার স্থাপন, স্বতন্ত্র মহিলা বাস সার্ভিস চালু, সরকারি চাকরিতে  নারীদের কোটা  সংরক্ষণ, নারী উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রকল্প, শহরে ও গ্রামে নারীদের জন্য আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, কারিগরি শিক্ষায় প্রশিক্ষণ ও নারী সমাজের স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করে, কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক সমঝোতার অভাবে  আজো এ নীতি কার্যকর করা সম্ভব হয় নি।

বাংলাদেশের সংবিধান, সিডও সনদ, সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র ও নারী উন্নয়ন নীতিতে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন গুরুত্ব পেয়েছে; গুরুত্ব পেয়েছে  নারীর কর্মসংস্থান ও তার নিরাপত্তার বিষয়টি। সিডও সনদের ২নং ধারা (যা বাংলাদেশের সংবিধানের ২৬,২৭,২৮,২৯ ধারার সাথে সংগতিপূর্ণ) ও ১৬নং ধারা নারীর স্বার্থ সংরক্ষণের কথা বলছে। অথচ এ দুটি ধারা বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদন পায় নি। বাংলাদেশ সকল প্রকার নারী বৈষম্য সংক্রান্ত জাতিসংঘ কনভেনশনে  এ দুটি ধারা  বাদ দিয়ে স্বাক্ষর করেছে। তবে বেইজিং প্লাটফর্ম ফর অ্যাকশনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। বেইজিং ফোরাম কর্তৃক চিহ্নিত নারী উন্নয়নের ১২টি প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে সরকার ও এনজিওদের সাথে যৌথ কর্মকৌশল গ্রহণ করেছে।

বেইজিং ফোরাম এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের সুপারিশমালার আলোকে বাংলাদেশ সরকার ও এনজিওসমূহ অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করেছে এবং তা বাস্তবায়নে কৃষি, বন ও পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা, সমাজকল্যাণ, তথ্য, পরিকল্পনা, যুব ও ক্রীড়া, সংস্কৃতি, পররাষ্ট্র, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে যুক্ত করেছে। মন্ত্রণালয়ের বাইরে যেসব সংস্থা এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেছে এদের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান, নারী সংগঠন, গণসংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন, পেশাজীবী প্রতিষ্ঠান, ক্লাব, নেটওয়ার্ক ফোরাম এবং এনজিও। [নিবেদিতা দাশ পুরকায়স্থ]

শিল্প ও ব্যবসায়িক উদ্যোগে নারী বাংলাদেশে শ্রমশক্তি খাতে নারীদের অংশগ্রহণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু সাধারণভাবে তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ খুব সীমিত। বাংলাদেশ সরকার ও এনজিওসমূহ দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির জন্য নানারকম কর্মসূচি নিয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচনের একটি উপায় হচ্ছে নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, বিশেষ করে এমন সব প্রকল্পের মাধ্যমে যেগুলি নারীদের শিল্পোদ্যোগের মাধ্যমে আয় সৃষ্টির কাজে নিয়োজিত রাখে।

ঐতিহাসিকভাবে, উন্নত ও উন্নয়শীল সব দেশেই শিল্প ও ব্যবসায়িক উদ্যোগে নারীর চেয়ে পুরুষের সংখ্যা অনেক বেশি। বাংলাদেশেও নারীরা এখনও শিল্প ও ব্যবসায়িক উদ্যোগের মূল ধারায় আসে নি। শুধু ক্ষুদ্র শিল্প ও ব্যবসায়িক উদ্যোগে নারীর কিছু উপস্থিতি রয়েছে, অন্যত্র তাদের উপস্থিতি একেবারেই নগণ্য। অধিকাংশ নারী উদ্যোক্তাই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, তারা প্রধানত গ্রামাঞ্চলের বাজারে কেন্দ্রীভূত অনানুষ্ঠানিক শিল্প খাতে কাজ করেন। তবে তৈরি পোশাক শিল্পের মতো পরিকল্পিত ও সংগঠিত শিল্প খাতেও স্বল্প কিছুসংখ্যক নারী উদ্যোক্তার উপস্থিতি নজরে পড়ে।

সামাজিক কাঠামো ও আন্তসম্পর্ক থেকে উদ্ভূত সুযোগ-সুবিধাদি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের তুলনায় বঞ্চিত এমন দৃষ্টান্ত যথেষ্ট রয়েছে। প্রথমত, শিক্ষার অভাবে ও চলাফেরায় সামাজিক বাধানিষেধের কারণে অধিকাংশ নারীই নিজেদের ক্ষমতা ও ব্যবসায়িক সুযোগের সদ্ব্যবহার করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সচেতন নন। দ্বিতীয়ত, অন্যান্য সকল যোগ্যতা থাকলেও নারীরা প্রায়শই ব্যবসায়িক উদ্যোগে ঝুঁকি নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ঋণ পায় না, বা পুঁজির ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। তৃতীয়ত, এমন কিছু আইনগত বাধা ও সামাজিক রীতিনীতি রয়েছে যেগুলি শিল্প ও ব্যবসায়িক কর্মকান্ডে নারীদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, নারীরা যদি সামান্য কিছু ঋণের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলির কাছে আবেদন করে তাহলে তাদের অন্তত একজন পুরুষ অংশীদার থাকতে হবে। এ কারণে নারী উদ্যোক্তারা যদি অপেক্ষাকৃত বড় কোনো ব্যবসায়িক কর্মকান্ড শুরু করতে চায় তাহলে তাদের পুরুষের সঙ্গে যৌথভাবে তা করতে হয়। একইভাবে, প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ লাভের ক্ষেত্রে শর্তাদি সম্পর্কে দরকষাকষিতে নারীদের সামর্থ্যের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে সমাজে প্রচলিত লিঙ্গ সম্পর্কিত ধ্যানধারণা ও মানসিকতা। নারী উদ্যোক্তাদের সামনে আরও কিছু বিশেষ ধরনের সমস্যাও রয়েছে। পুরুষেরা নারী উদ্যোক্তাদের গুরুত্বের সঙ্গে নিতে চায় না। নারীদের ওপর এর একটা নিরাশাব্যঞ্জক প্রভাব রয়েছে। পুরুষ উদ্যোক্তাদের প্রাধান্যে পরিচালিত বাজারে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকা নারী উদ্যোক্তাদের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন। চলাফেরার ক্ষেত্রে ঐতিহ্যগত সীমাবদ্ধতা ও সামাজিক বিধিনিষেধের কারণেও নারী উদ্যোক্তারা অপরিচিত পুরুষদের সঙ্গে ব্যবসায়িক আলোচনা বা দরকষাকষিতে যেতে আগ্রহী হয় না।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা প্রণীত বাংলাদেশ বিষয়ক একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশি নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বাড়তি অসুবিধা সৃষ্টি করে এমন কিছু বিষয় চিহ্নিত করা হয়েছে। ক্ষুদ্র ঋণভিত্তিক কর্মকান্ডের বাইরে প্রধানত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্প ও ব্যবসায়িক উদ্যোগের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি সমীক্ষা জরিপের ওপর ভিত্তি করে এই বিষয়গুলি চিহ্নিত করা হয়েছে। ঐ প্রতিবেদনে দেখা যায়, একই ধরনের ব্যবসায়িক উদ্যোগ শুরু করার আগে পুরুষ উদ্যোক্তাদের কাজের অভিজ্ঞতা নারী উদ্যোক্তাদের চেয়ে অনেক বেশি থাকে। পুরুষদের অভিজ্ঞতা গড়ে ৪.৯ বছর, আর নারীদের অভিজ্ঞতা গড়ে মাত্র ০.৮ বছর। অধিকাংশ পুরুষ উদ্যোক্তা (জরিপকৃতদের ৭৩.৮ শতাংশ) নিজেদের সঞ্চয় থেকে একটা মোটামুটি অঙ্কের নিট নিজস্ব মূলধন সৃষ্টি করতে পারে, অন্যদিকে নারীদের মধ্যে মাত্র ৪০.১ শতাংশ সামান্য কিছু সঞ্চয় করতে পারে। ফলে নারীরা ব্যাংকের ঋণ সমমূলধনের অনুপাতের শর্ত পূরণে সমস্যার সম্মুখীন হয়, যার ফলে নারীরা ব্যাংক ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য বিবেচিত হয়। নারী উদ্যোক্তাদের চলাফেরায় সীমাবদ্ধতার কারণে নারীর মালিকানাধীন অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের অবস্থান লক্ষ্য করা যায় বাসস্থানের সীমানার মধ্যে। এর ফলে নারীরা প্রায়শই বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি লক্ষ্য করা গেছে তা হলো কোনো ব্যবসায়ে উদ্যোগ নিতে একজন নারী উদ্যোক্তার প্রাথমিক পুঁজি একই ধরনের ব্যবসার শুরুতে একজন পুরুষ উদ্যোক্তার প্রাথমিক পুঁজির মাত্র এক ষষ্ঠাংশ।

ক্ষুদ্র ঋণভিত্তিক ব্যবসায়িক কর্মকান্ডের বাইরে একটা নতুন প্রবণতা ইদানীং লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। বাণিজ্যিক ও সেবা খাতে নারীদের গৃহীত উদ্যোগের সংখ্যা বাড়ছে। এসব নারী মূলত ধনী পরিবার থেকে আগত এবং তারা কিছু কিছু প্রাতিষ্ঠানিক বাধাবিপত্তি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম। বড় বড় শহরে এখন নারীদের মালিকানায় পরিচালিত অনেক বাটিক, বিউটি পারলার, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি দেখা যায়। নারী স্থপতি ও প্রকৌশলীদের অনেকেই এখন পুরুষ পরিচালিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করার পরিবর্তে নিজেরাই কনসাল্টিং ব্যবসা শুরু করছেন। তা ছাড়া মনোহারি দোকান, স্বাস্থ্য ক্লিনিক, কোল্ড স্টোরেজ, ভ্রমণ ও বিজ্ঞাপনী সংস্থার মতো নানা ধরনের ব্যবসা নারীরা চালাচ্ছেন এমন দৃশ্যও এখন আর বিরল নয়। অনেক নারী উদ্যোক্তা বিদ্যালয়, বিশেষত ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়, টিউটোরিয়াল স্থাপনেও আকৃষ্ট হচ্ছেন। একজন নারী উদ্যোক্তা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করেছেন। সংখ্যায় কম হলেও নারীদের প্রতিষ্ঠিত তৈরি পোশাকের কারখানাও রয়েছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯৮০ সালে একজন নারী উদ্যোক্তা বৈশাখী গার্মেন্টস নামে একটি তৈরি পোশাক কারখানা স্থাপন করেছেন যা এ দেশে প্রাচীন গার্মেন্টস কারখানাগুলির অন্যতম।

নারী উদ্যোক্তারা সামাজিক পুঁজি সংগঠনের প্রয়াস অব্যাহত রেখেছেন। শহরাঞ্চলের নারীরা নিজেদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে চাপ সৃষ্টির ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কার্যকারিতা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। ঢাকার নারী উদ্যোক্তারা একটি সমিতি গঠন করেছেন যার মাধ্যমে শিল্পে ও ব্যবসায়ে নারীদের পৃষ্ঠপোষকতা দানের প্রয়াস চলছে। নারীদের শিল্প ও ব্যবসায়িক উদ্যোগে পৃষ্ঠপোষকতার উদ্দেশ্যে মাইডাস (Micro Industries Develpoment Assistance Society) দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় নারী উদ্যোক্তার নেতৃত্বে একটি নারী উদ্যোগ উন্নয়ন কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটি জামানত ছাড়া ঋণ দানের মাধ্যমে নারীদের ব্যবসায়িক উদ্যোগ গ্রহণে সহযোগিতা দিয়ে আসছে। এই কমিটির মাসিক বৈঠকে ব্যবসায়িক কর্মকান্ডের নানা দিক সম্পর্কে নারী উদ্যোক্তাদের পরামর্শ দেয়া হয়।

ঐতিহাসিকভাবে, বাংলাদেশের নারীরা অনেক ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করে থাকেন, বিশেষত গৃহস্থালী ও খামারভিত্তিক অর্থনেতিক কর্মকান্ডে ঐতিহ্যগতভাবেই তাদের অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায়। তারা নিজেদের পুঁজি বা ধার করা পুঁজি খামার গড়া বা শাকসবজির বাগান করার কাজে লাগিয়ে কিছু অর্থ উপার্জন করে থাকেন। এই অর্থে তাদের উদ্যোক্তাই বলা যায়। গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থা প্রচলনের পর থেকে এই শ্রেণীর নারী উদ্যোক্তারা অত্যন্ত দৃশমান হয়ে উঠেছেন। পৃথক পৃথকভাবে এসব উদ্যোগের আকার বেশ ছোট বটে, কিন্তু গোষ্ঠী হিসেবে সাকুল্যে তারাই বাংলাদেশের বৃহত্তম নারী উদ্যোক্তা শ্রেণী।

শিল্প ও ব্যবসায়িক উদ্যোগে সাফল্যের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে সরকারের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। স্বাস্থ্য, পুষ্টি, স্বাস্থ্যজ্ঞান, শিক্ষাগত মান এবং শিল্প ও ব্যবসায়িক কর্মকান্ডে উন্নয়ন সাধনের সর্বাপেক্ষা কার্যকর উপায় হচ্ছে নারী উন্নয়নে সরকারের বিনিয়োগ। নারী উদ্যোগ বিকাশের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকার সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাসমূহের মধ্যকার সহযোগিতামূলক সম্পর্কে উৎসাহিত করে থাকে। নারীর ক্ষমতায়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে বেশ কিছু কর্মসূচি ও প্রকল্পের বাস্তবায়ন চলছে। নারীদের উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার পথে সামাজিক-সাংস্কৃতিক নানা বাধাবিপত্তি ছাড়াও একটা প্রধান বাধা হচ্ছে নারীদের ঋণ লাভের সুযোগের অভাব। গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচির সাফল্যের পর তাদের অনুসরণে ব্যাপক সংখ্যক এনজিও ও জাতীয় বাণিজ্যিক ব্যাংক ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ক্ষুদ্র অর্থায়নের ফলে নারীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলির মাধ্যমে নারীরা নিজেদের ও পরিবারের সদস্যদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সহায়তা পাচ্ছেন। এখন অনেক নারীই অন্যের প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করার পরিবর্তে আত্ম-কর্মসংস্থান বেশি পছন্দ করেন। চাকুরির কঠোর শর্তাবলি, শিশুদের দেখাশোনা করার সুযোগের অভাব, অগ্রহণযোগ্য কাজের পরিবেশ, কাজের নির্দিষ্ট সময়ের অনমনীয়তা, চাকুরিক্ষেত্রে হতাশা, লিঙ্গ বৈষম্য ইত্যাদি কারণে অনেক নারীই এখন অন্যের প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করতে আগ্রহী নন।

পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৯৭-২০০২) নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রচলিত কিছু আইন সংশোধনের শর্তারোপ করা হয়েছে। ক্ষুদ্র ঋণের ব্যাপারে সামর্থ্য সৃষ্টিতে সহায়তা যোগানোর উদ্দেশ্যে সরকার একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপরেখা তৈরি করেছে। নারী উদ্যোক্তাদের উন্নয়নে গ্রামীণ ব্যাংকের সৃজনশীল ভূমিকা অত্যন্ত ইতিবাচক প্রভাব রেখেছে। গ্রামীণ ব্যাংকের অনুসরণে অনেক এনজিও এখন নারী উদ্যোক্তাদের প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে অবদান রাখছে, যদিও তাদের সহযোগিতা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নানা উদ্যোগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। খামার-বহির্ভূত কর্মকান্ড যেমন আয়োডিনযুক্ত লবণ উৎপাদন, উচ্চ ফলনশীল ধান চাষ, হাতে তৈরি কাগজ উৎপাদন এবং তৈরি পোশাক শিল্পের বর্জ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ইত্যাদি কর্মকান্ডে ব্র্যাকের রুর‌্যাল এন্টারপ্রাইজ প্রজেক্ট নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ সুযোগ সৃষ্টি করছে। ব্র্যাকের কর্মসূচি সহায়ক উদ্যোগগুলি তাদের গ্রুপ-সদস্য নারীদের ব্যবসায়িক ঝুঁকি কমানোর লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিয়ে থাকে। কিন্তু নারী উদ্যোক্তারা তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণে নানা সমস্যার মুখোমুখি হন। তাদের কর্মকান্ড মূলত স্থানীয় বাজারগুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অবশ্য দুধ, ডিম, হাঁস-মুরগি, হস্তশিল্পজাত পণ্য, তৈরি খাদ্য, গরু মোটাতাজাকরণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে কিছু কিছু বাজার নেটওয়ার্ক ক্রমশ গড়ে উঠছে। এর ফলে গ্রামীণ অঞ্চলে নারীদের ব্যবসায়িক উদ্যোগ বিকাশ লাভ করছে।  [নাজমা সিদ্দিকী]

সাংবাদিকতায় নারী  বাঙালি নারীদের সাংবাদিকতায় আগমন ঘটে সাময়িকী সম্পাদনার মাধ্যমে। প্রথম সাময়িকী পাক্ষিক বঙ্গমহিলা সম্পাদনা করেছিলেন একজন মহিলা। মোক্ষমদায়িনী মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৭০ সালের ১৪ এপ্রিল। প্রথম মাসিক জেন্ডার ভিত্তিক ম্যাগাজিন অনাথিনী মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত ও প্রকাশিত হয় ১৮৭৫ সালের জুলাই মাসে। মহিলা কর্তৃক সম্পদিত প্রথম সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন বঙ্গবাসিনী প্রকাশিত হয় ১৮৮৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। মুসলিম নারী বেগম সুফিয়া খাতুন কর্তৃক সম্পাদিত প্রথম মাসিক ম্যাগাজিন অন্বেষা সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় ১৩২৮ সনের বৈশাখ মাসে  (১৯২১ খ্রি)। একজন মহিলা কর্তৃক সম্পাদিত পাপিয়া নামক ত্রৈমাসিক ম্যাগাজিন প্রথম প্রকাশিত হয় ঢাকা থেকে। ম্যাগাজিনটি সম্পাদনা করেন বিভাবতী সেন। এ সচিত্র সাময়িকীটি শিশুদের উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা হয়। বেগম শামসুন্নাহার এবং মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ বাহার সম্পাদিত বুলবুল প্রকাশিত হয় বছরে তিন সংখ্যা। এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৯৩৩ সালে। ১৯৩৬ সাল থেকে এটি মাসিক ম্যাগাজিনে রূপান্তরিত হয়। একজন মুসলমান মহিলা কর্তৃক সম্পাদিত প্রথম সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন বেগম প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই। নূরজাহান বেগম এবং সুফিয়া বেগম যৌথভাবে তা সম্পাদনা করেন। কিন্তু এর প্রকাশনার দ্বাদশ সংখ্যা (২ নভেম্বর) থেকে নূরজাহান বেগম এককভাবে এর সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন।

পূর্ব বাংলার কোনো নারী প্রথম যে সাময়িকী সম্পাদনা করেন তার নাম ছিল বঙ্গনারী। ১৯২৩ সালে চিন্ময়ী দেবীর সম্পাদনায় এটি ময়মনসিংহ থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। ঊর্মিলা সিনহা কর্তৃক সম্পাদিত ত্রিপুরা হিতৈষী প্রকাশিত হয় কুমিল্লা থেকে। তিনি ১৯২৪ সাল থেকে সাময়িকীটি সম্পাদনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। বিভাবতী সেন কর্তৃক সম্পাদিত ত্রৈমাসিক পাপিয়া ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে এবং ১৯২৮ সাল থেকে এটি মাসিক ম্যাগাজিনে রূপান্তরিত হয়।

লীলাবতী নাগ সম্পাদিত সচিত্র মাসিক জয়শ্রী ১৯৩১ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকা থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রধান সম্পাদক কমলবাসিনী দেবী কর্তৃক সম্পাদিত পাক্ষিক আশ্রমী প্রকাশিত হয় রংপুর থেকে। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪১ সালের ১ জানুয়ারি। পূর্ব বাংলা থেকে প্রথম মহিলা বিষয়ক সাপ্তাহিক সুলতানা প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালের ১৪ জানুয়ারি। সুফিয়া কামাল এবং জাহানারা আরজু এটির সম্পাদক ছিলেন। মাহফুজা খাতুনের সম্পাদনায় ঢাকা থেকে নওবাহার প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে। কুমারী জোৎস্নারানী দত্তের মাসিক মানসী ১৩৫৭ সনের আশ্বিনে (১৯৫০ সাল) প্রকাশিত হয় পাবনা থেকে।

নারীরা শুরুতে সংবাদপত্র সম্পাদনার কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত করলেও ধীরে ধীরে সাংবাদিকতার অন্যান্য শাখায় তাদের পদচারণা ঘটে। পাকিস্তান আমলে বাংলার এ অঞ্চলে সাংবাদিকতায় নারীদের আগমন ঘটে খুব ধীরগতিতে। এ আমলে খুব বেশি নারী সাংবাদিকের নাম পাওয়া যায় না। সাংবাদিকতায় খ্যাতিমানদের মধ্যে লায়লা সামাদ, নূরজাহান বেগম, জাহানারা আরজু, মাফরুহা চৌধুরী, মাহফুজা খাতুন, হাসিনা আশরাফ, সেলিনা হোসেন, বেবী মওদুদ এবং তাহমিনা সাঈদের নাম উল্লেখযোগ্য।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এই দৃশ্যপটে বেশ পরিবর্তন ঘটে। বর্তমানে অনেক শিক্ষিত নারী পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকে বেছে নিচ্ছেন এবং এদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা শুধু প্রিন্ট মিডিয়ার ক্ষেত্রে নয়, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ক্ষেত্রেও সত্য।

১৯৯০ সালে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট কর্তৃক পরিচালিত এক জরিপের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ঢাকার প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় গড় মহিলা প্রতিনিধিত্ব প্রায় শতকরা পাঁচ ভাগ (৪% সংবাদপত্রে, ৫% রেডিওতে এবং ৬% টেলিভিশনে)। সংবাদপত্রে কর্মরত অধিকাংশ মহিলাই সম্পাদকীয় বিভাগের সাথে এবং অনেকে রিপোর্টিংয়ের কাজে যুক্ত। জরিপে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ কোর্সে ছাত্রছাত্রী ভর্তির ক্ষেত্রে খুব কম বৈষম্যই পরিলক্ষিত হয়। তবে কর্মজীবনে প্রবেশের ক্ষেত্রে মহিলাদের জন্য প্রদত্ত সুযোগ সুবিধা সমান নয়। নিয়োগবিধি মহিলাদের পক্ষে নয় এবং সাংবাদিকতার সবক্ষেত্র মহিলাদের জন্য উন্মুক্ত নয়। বিদ্যমান সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমিতে মাঠ পর্যায়ের প্রারম্ভিক ক্ষেত্রে রিপোর্টিং এবং অ্যাসাইনমেন্ট প্রদান মহিলাদের জন্য সহায়ক নয়। তাই তাদের অধিকাংশকেই সম্পাদকীয় বিভাগে ডেস্কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই অবস্থায় ইলেকট্রনিক মিডিয়া, যথা রেডিও এবং টেলিভিশনে মহিলাদের অংশগ্রহণের হার সংবাদপত্রের তুলনায় বেশি। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মহিলা কোটা বজায় থাকা এর অন্যতম কারণ।  [হেলাল উদ্দিন আহমেদ এবং মাহবুবুল আলম]

রাজনীতিতে নারী বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর অবস্থানের অগ্রগতি হয়েছে চারটি পৃথক স্তরে: (১) নেতৃত্বের পর্যায়, (২) কোটা পদ্ধতি, (৩) নির্বাচনী রাজনীতি এবং (৪) নারী আন্দোলন।

দেশের রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের ধরন ও সুযোগ সম্পর্কে ১৯৭২ সালের সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে। ২৯ নং অনুচ্ছেদে সুনির্দিষ্টভাবে উভয় লিঙ্গের ক্ষেত্রে সম অধিকার নিশ্চিত করে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের কোন দফতরে চাকুরির ক্ষেত্রে নাগরিকদের মধ্যে নারী পুরুষের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার বৈষম্য সৃষ্টি করা যাবে না। এ ঘোষণার উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে নারীদের উৎসাহিত করা এবং নারীর সম্ভাবনাময় নেতৃত্বের যোগ্যতা বৃদ্ধি। বাংলাদেশে বিদ্যমান আর্থসামজিক অবস্থার আলোকে জাতীয় সংসদে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসন সৃষ্টির লক্ষ্যে সংবিধানে জাতীয় সংসদকে ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। নির্বাচিত সদস্যদের ভোটে সংসদে মহিলা সদস্য নির্বাচিত করার বিধান রাখা হয়।

আইনসভায় মহিলাদের আসন সংরক্ষণের বিষয় নিয়ে বিতর্কও নতুন কিছু নয়। পাকিস্তানের গণপরিষদে এ সম্পর্কিত আলোচনা থেকেই এর সূত্রপাত, যেখানে মাত্র দুজন মহিলা প্রতিনিধি ছিল। এ দুই মহিলা সদস্য ১৯৩৫ সালের রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সের ফ্র্যাঞ্চাইজ কমিটির নিকট আইনসভায় ১০ ভাগ মহিলা কোটা সংরক্ষণের দাবি জানান। কিন্তু সেখানে মাত্র ৩ ভাগ কোটার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সংরক্ষিত মহিলা আসন বাড়ানোর বিষয়টি একটি ইস্যুতে পরিণত হয়। কিন্তু মহিলা আসন সংখ্যা বাড়ানোর এই দাবি উপেক্ষিত হয় এবং গণপরিষদের চূড়ান্ত বৈঠকে নারী অধিকার সনদ সংক্রান্ত খসড়া বিল সম্পর্কে আলোচনাকালে জাতীয় ও প্রাদেশিক আইনসভায় মহিলাদের জন্য পূর্ববর্তী ৩ ভাগ কোটাই বহাল রাখা হয়। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে নারীদের অংশগ্রহণের সুযোগ ও পরিধি অনেকটা বৃদ্ধি পায়। মহিলাদের দ্বৈত ভোটের অধিকার তথা মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত বিশেষ নির্বাচনী এলাকায় ভোট প্রদান এবং সাধারণ নির্বাচনী এলাকায় ভোটাধিকারের সুযোগ দেওয়া হয়। আইন প্রণয়নের রাজনীতিতে মহিলাদের আগ্রহের সাক্ষ্য মেলে পূর্ববাংলার প্রাদেশিক আইন পরিষদ নির্বাচনে ৩ জন মহিলার নির্বাচনের মধ্যে।

কিন্তু ১৯৫৮ সালে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্রমাবনতি এবং সামরিক আইন জারির প্রেক্ষিতে আইনসভায় গণতান্ত্রিকভাবে মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব করার দাবি নিয়ে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ হ্রাস পায়। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত সমগ্র আইয়ুব শাসনামলে আইন প্রণয়নের রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ রাষ্ট্রের কুক্ষিগত করে রাখা হয়। আইয়ুব খানের ১৯৬২ সালের সংবিধানে মহিলাদের পৃথক নির্বাচনী এলাকার ভিত্তিতে ১৯৫৬ সালের সংবিধানে প্রদত্ত সংরক্ষিত মহিলা আসন ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। মহিলাদের জন্য মাত্র ৭টি সংরক্ষিত আসন রাখা হয় এবং আইনসভার পুরুষ সদস্যদের ভোটে তাদের নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। সংরক্ষিত মহিলা আসনে এভাবে সদস্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করে নারীদের তাদের পুরুষ প্রতিপক্ষের মুখাপেক্ষী করা হয়েছে।

এটাই ছিল দেশের আইনসভায় নারীর প্রতিনিধিত্বের সূচনা। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে এ ধরনের অভিব্যক্তি এখনও পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিদ্যমান আর্থসামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নতুন সংবিধানে আসন সংখ্যা বাড়িয়ে ১৫ করা হয়। এতে বলা হয়, মহিলাদের অবস্থার উন্নতি হলে এই সংরক্ষিত আসন ব্যবস্থাও রহিত করা হবে। নতুন নির্বাচন পদ্ধতির সুবাদে মহিলা আসন জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ‘ভোট ব্যাংক’ হিসেবে কাজ করে বলে মনে করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে এই ব্যবস্থায় সংসদে মহিলাদের যথার্থ কার্যকর প্রতিনিধিত্ব থাকে কিনা। ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনের কয়েকদিন আগে সংরক্ষিত মহিলা আসন ১৫ থেকে বাড়িয়ে পরবর্তী ১০ বছরের জন্য ৩০-এ উন্নীত করা হয়। সংসদে মহিলা কোটা বিলুপ্ত করার বিষয়ে সংসদের ভেতর ও বাইরে মহিলা আসনসংখ্যা ও এর নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে তীব্র বিতর্ক এখনও অব্যাহত রয়েছে। নারী সংগঠনগুলি, বিশেষ করে ১৭টি সংগঠনের মিলিত সংস্থা ঐক্যবদ্ধ নারী সমাজ তাদের ১৭-দফা দাবিতে সংরক্ষিত মহিলা আসনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে তা পূরণের দাবি পেশ করে। কিন্তু ১৯৯০ সালে এক সাংবিধানিক সংশোধনীর মাধ্যমে পরোক্ষভাবে নির্বাচনযোগ্য ৩০টি সংরক্ষিত মহিলা আসনের মেয়াদ আরও ১০ বছরের জন্য বর্ধিত করা হয়। সংরক্ষিত আসনের মেয়াদ ২০০১ সালে শেষ হওয়ার পর এর মেয়াদ আর বর্ধিত করা হয় নি।

ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনে ক্ষমতা প্রদান যেকোন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে একটি মৌলিক বিষয়। এক্ষেত্রে প্রশাসনের সর্বনিম্ন স্তর ইউনিয়ন পরিষদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনে নারীদের প্রতিনিধিত্বও অস্থায়ী ও অকার্যকর। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯৪৬ সালে নির্বাচিত এবং মনোনীত উভয় ধরনের সদস্য নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ গঠিত হয়। কিন্তু সেখানে নারীদের মনোনয়নের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো বিধান ছিল না। বস্ত্তত ১৯৫৬ সালে প্রথম বারের মতো নারীরা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটাধিকার লাভ করে। তখন প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তখন থেকে সম্পত্তির মালিকানা, খাজনা প্রদান ও শিক্ষাগত যোগ্যতা স্থানীয় সরকার কাঠামোতে ভোট দানের যোগ্যতা হিসেবে গণ্য করা হয় নি। স্বাধীনতার পরই এদেশের ইতিহাসে প্রথম স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন স্তরে নারীরা প্রতিনিধিত্ব করার মর্যাদা লাভ করে। সেই থেকে এ পর্যন্ত ৬ বার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে (১৯৭৩, ১৯৭৭, ১৯৮৪, ১৯৮৮, ১৯৯৩, ১৯৯৭) এবং ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচিত মহিলা চেয়ারম্যানের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৯৭৩ সালে ১ জন, ১৯৯৩ সালে ২৪ জন এবং ১৯৯৭ সালে ২০ জন। ১৯৭৬ ও ১৯৮৪ সালের অধ্যাদেশে মহিলা সদস্য মনোনয়নের বাধ্যতামূলক বিধান রাখা হয়। অধ্যাদেশে ইউনিয়ন পরিষদে মহিলাদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন দানের ক্ষমতা অর্পিত হয় উপজেলা পরিষদের উপর এবং উপজেলা পরিষদের মহিলা সদস্যদের মনোনয়ন দানের এক্তিয়ার থাকে সরকারের।

স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনে নারীদের প্রতিনিধিত্বের পদ্ধতির শুরু থেকেই ক্ষমতা কাঠামোতে স্থানীয় উদ্যোগী মহিলারা মনোনীত সদস্য হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করছে। পরবর্তী সময়ে নির্বাচিত পুরুষ সদস্যদের পরোক্ষ ভোটে মহিলাদের নির্বাচনের পদ্ধতি গ্রহণ করা হয় (জাতীয় পর্যায়েও একই ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়)। কিন্তু সেখানে নারী ও পুরুষ উভয় সদস্যের কার্যকারিতা ছিল সমমানের। ফলে প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর স্থানীয় এলিট পরিবার থেকে মহিলাদের ক্ষমতায় বসানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বরে এক সাংবিধানিক সংশোধনীর মাধ্যমে মহিলাদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। এর ফলে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায় থেকে নারীদের রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। নির্বাচন কমিশনের সূত্রমতে ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মোট ২,০৪,৯০৮ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এর মধ্যে মহিলা প্রার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৪৬ হাজার। ১২,৯৫৪টি সংরক্ষিত আসনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে ৪৪,৪২১ জনের মতো প্রার্থী। অবশিষ্ট মহিলা প্রার্থীরা পুরুষ প্রার্থীদের প্রতিপক্ষ হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। পুরুষ প্রার্থীদের তুলনায় মহিলাদের নির্বাচনী এলাকা বৃহত্তর হওয়ায় নির্বাচনী প্রচারণায় তাদের অধিক শ্রম ও সময় দিতে হয়েছে। একশ’ মহিলা সাধারণ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছেন এবং বর্তমানে নির্বাচিত মহিলা চেয়ারপারসন রয়েছেন ২০ জন। এই প্রথমবারের মতো প্রভাবশালী পরিবারের মহিলাদের পরিবর্তে ভূমিহীন বা প্রান্তিক কৃষক পরিবারের মহিলারা নির্বাচিত হন।

জাতীয় সংসদে মহিলাদের সংরক্ষিত আসনের প্রথম পর্যায়ের মেয়াদ ১০ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই (১৯৮৭ সালের ৭ ডিসেম্বরে মেয়াদ শেষ হতো) সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা ১৫ থেকে ৩০-এ উন্নীত করা হলেও ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি বা আওয়ামী লীগ কেউই সাধারণ আসনে একটিও মহিলা প্রার্থী মনোনয়ন দেয় নি। ১৯৭৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে মোট ২১২৫ জন প্রার্থীর মধ্যে ১৫টি সাধারণ আসনে মাত্র ১৭ জন মহিলা প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং তাদের কেউই নির্বাচিত হতে পারেন নি। তবে এসময়ে নারীদের শীর্ষ পর্যায়ের নির্বাচনী রাজনীতিতে অংশগ্রহণের হার ০.৩% থেকে ০.৯%-এ উন্নীত হয়।

১৯৮৬ সালের নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে মহিলাদের গ্রহণযোগ্যতা আরও বেড়ে যায়। জাতীয় পার্টি প্রথমবারের মতো সাধারণ আসনে ২ জন মহিলা প্রার্থী দাঁড় করায়। আওয়ামী লীগও সাধারণ নির্বাচনে মহিলা প্রার্থী দাঁড় করায়। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা ছাড়াও ৮টি আসনে মহিলা প্রার্থী দেওয়া হয়। এছাড়া আরও চারটি দল নির্বাচনে মহিলা প্রার্থী মনোনয়ন দেয়। সর্বমোট ২০ জন মহিলা সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং ৫টি আসনে নির্বাচিত হন। নারীর অংশগ্রহণের হার ০.৯% থেকে ১.৩%-এ উন্নীত হয়। সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত করা সংরক্ষিত মহিলা আসনের মেয়াদ ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বরে শেষ হয়ে যায়। তাই ১৯৮৮ সালের সংসদে কোনো সংরক্ষিত আসন ছিল না। এসময়ে নির্বাচনী রাজনীতিতে সাধারণ আসনে নারীদের অংশগ্রহণের মাত্রা বৃদ্ধির পরিবর্তে দ্রুত হ্রাস পায়। তাদের অংশগ্রহণের হার ১.৩% থেকে ০.৭%-এ নেমে আসে। এই হার ১৯৭৯ সালের অংশগ্রহণের মাত্রার চেয়েও কম। এ ধরনের পরিবর্তনের পেছনে প্রধান কারণ ছিল সবগুলি প্রধান বিরোধী দল কর্তৃক নির্বাচন বর্জন।

১৯৯১ সালের নির্বাচনে ৭৫টি রাজনৈতিক দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এবং তাদের মধ্যে ১৬টি দল মহিলা প্রার্থী মনোনয়ন দেয়। ৪৭ জন মহিলা প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং তাঁদের মধ্যে নির্বাচিত হন মাত্র ৮ জন। ১৯৯৬ সালের ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনাসহ ৭ জন মহিলা প্রার্থী নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালের অবস্থার তুলনায় এটা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। বর্তমানে নির্বাচনী রাজনীতির প্রধান ধারায় নারীদের অংশগ্রহণের হার ১.৫% এবং ১৯৭৩ সালের ০.৩%-এর তুলনায় অবশ্যই বড় ধরনের অগ্রগতি। তবে দুটি বড় দলের নেতৃত্বে মহিলা থাকা সত্ত্বেও দেশের নির্বাচনী রাজনীতির মূলধারায় নারীদের ভূমিকা এখনও নগণ্য।

নারী সংগঠনের মাধ্যমে নারীদের সচেতন করার কাজটি শুরু হয়েছিল পাকিস্তান শাসনামলেই। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমের মাধ্যমে নারীদের সংগঠিত করার কাজ শুরু হয়। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বাইরে নারীদের সংগঠিত করার জন্য প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিল ওমেন’স ভলান্টারী সার্ভিস। এই সংগঠনই পরবর্তী সময়ে অল পাকিস্তান উইমেন’স অ্যাসোসিয়েশন, ফেডারেশন অব ইউনিভার্সিটি উইমেন এবং করাচি বিজনেস অ্যান্ড প্রফেশনাল উইমেন’স ক্লাবের মতো নারী সংগঠন প্রতিষ্ঠার প্রেরণা যুগিয়েছে। পরবর্তী সময়ে আরও কিছু পেশাভিত্তিক নারী সংগঠন গড়ে উঠে। তবে এসব সংগঠনের অধিকাংশেরই মূল আগ্রহ ছিল সমাজকল্যাণমূলক এবং নারীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি তথা নারী শিক্ষার প্রসার, দক্ষতা বৃদ্ধি, অর্থোপার্জনের সুযোগ সৃষ্টি এবং শিশু ও মাতৃসদন কেন্দ্র স্থাপন প্রভৃতি। অল পাকিস্তান উইমেন’স অ্যাসোসিয়েশন পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১ (ফ্যামিলি লজ অর্ডিন্যান্স) পাসের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। জাতীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদে মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষণের পক্ষেও এই সংগঠনের জোরালো ভূমিকা ছিল। তবে এ অ্যাসোসিয়েশন সরকারের সঙ্গে বেশি সংশ্লিষ্ট হওয়ার কারণে রাজনীতিতে নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির দাবি দাওয়া তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়। নারী অধিকার ভিত্তিক একমাত্র সংগঠন ছিল ইউনাইটেড ফ্রন্ট ফর ওমেনস রাইট। কিন্তু এই সংগঠনটিও নারীদের দাবিদাওয়া তুলে ধরার জন্য শক্তিশালী কোনো প্লাটফর্ম গড়ে তুলতে পারে নি।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নারী আন্দোলন মূলত জনকল্যাণমূলক কর্মকান্ডে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে। তবে উল্লেখ্য, নারীরা একসময় বিক্ষোভের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে শুরু করেছিল। প্রমাণ হিসেবে ১৯৬৮-৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে তাদের ভূমিকার কথা বলা যায়। সে সময় পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সংগ্রাম পরিষদের মতো সংগঠন গড়ে উঠেছিল এবং এই সংগঠন সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রামে নারীদের সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছিল। ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদ সামাজিক ও রাজনৈতিক দাবিসহ নারীদের জন্য সুনির্দিষ্ট বেশ কিছু দাবিদাওয়া উপস্থাপন করে। তারা সার্বভৌম সংসদ নির্বাচন, মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচন, মহিলা শ্রমিকদের জন্য পুরুষের সমান পারিশ্রমিক (যদিও সে সময় নারী শ্রমিকের হার ছিল নগন্য), মাতৃ ও শিশু কেন্দ্র স্থাপন এবং শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি দাবি উত্থাপন করে। কিন্তু দেশের গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতি এবং উঠতি মহিলা সংগঠনগুলির আদর্শগত বিভ্রান্তির কারণে বাংলাদেশে সদ্য গড়ে উঠা নারী আন্দোলনের গতি স্থবির হয়ে পড়ে। সংগঠনগুলি তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে সমাজের সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরের মাধ্যমে নারী সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করে।

রাষ্ট্র রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ উৎসাহিত করলেও এখনও তা সীমিত পর্যায়েই রয়ে গেছে। তবে লিঙ্গ ভিত্তিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈষম্য সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী নারীদের সচেতনতা নারী আন্দোলনে যে নতুন দিগনির্দেশনা ও গতি সঞ্চার করেছে বাংলাদেশেও তার প্রভাব পড়েছে। বিশ শতকের আশির দশকে বাংলাদেশে যে নারী আন্দোলনের উদ্ভব ঘটে অনেকে একে পশ্চিমের নারী আন্দোলনের প্রতিচ্ছবি মনে করেন। কিন্তু অচিরেই এ আন্দোলনে দেশের নারী সমাজের বিভিন্ন ইস্যু, ভিত্তিমূল, নতুন নেতৃত্ব, নতুন সংগঠন এবং সাংগঠনিক আচরণে নতুন রীতিনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়। আশির দশকের অগ্রগতির সাথে সাথে সমাজসেবা ও দক্ষ প্রশিক্ষণ দানে নিয়োজিত শত শত সংগঠনের পাশাপাশি নতুন নতুন নারী সংগঠন ও নেতৃত্ব গড়ে উঠতে থাকে। এই নতুন সংগঠনগুলি নারীর বিরুদ্ধে অপরাধমূলক অপতৎপরতা অবসানের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করে। নারীদের উপর সহিংসতা, ধর্ষণ, যৌতুক ও ফতোয়ার কারণে মৃত্যু, নারী পাচার, বেতন বৈষম্য, গার্মেন্টসের মতো শ্রমভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠানে নারীদের শোষণ, নারী শ্রমিকদের চাহিদা পূরণে প্রচলিত ট্রেড ইউনিয়নের উদ্যোগে অনীহা বা ঔদাসিন্য, ঋণ ও ভূমির মতো উৎপাদনের উপাদান লাভের অধিকার, অসম সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারের বিষয়গুলি নারী সংগঠনগুলির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ে পরিণত হয়। তবে সন্ত্রাস, ধর্ষণ, যৌতুক ও ফতোয়ার কারণে মৃত্যু, এসিড নিক্ষেপ এবং এ ধরনের যেসব কর্মকান্ডের ফলে সমাজে নারীরা অসহায়, ক্ষমতাহীন ও অরক্ষিত অবস্থায় নিপতিত তার বিরুদ্ধে নারী সংগঠনগুলি শহর ও গ্রামে মহিলাদের মধ্যে যথেষ্ট সচেতনতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে।

নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার বিষয়টি সর্বত্রই একটা মানসিক চাঞ্চল্যকর ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে, যে কারণে নারীরা নির্দলীয় ভিত্তিতে একত্রিত হচ্ছে। ১৯৯৫ সালে পুলিশ কর্তৃক ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাটি নারী সংগঠনগুলিই গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। অবশ্য নারীদের এই অবস্থা থেকে দ্রুত উত্তরণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যেমন বড় ধরনের কোনো নীতিগত বা কৌশলগত উদ্যোগ নেয়া হয় নি, তেমনি নারী সংগঠনগুলিও নির্যাতিতা নারীদের জন্য তেমন কোনো বড় ধরনের সহযোগিতা সমর্থন বা আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে পারে নি, পারে নি তাদের বেঁচে থাকার জন্য কোনো বিকল্প পথ খুঁজে বের করতে। ১৯৯৫ সালে বেইজিং-এ অনুষ্ঠিত চতুর্থ বিশ্ব সম্মেলনে অনুমোদিত অ্যাকশন প্লাটফর্মে গৃহীত কৌশলগুলিকে কার্যকর করার জন্য বর্তমানে বিভিন্ন নারী সংগঠন কাজ করে যাচ্ছে।

আন্তর্জাতিকতাবাদের আলোকে জাতিসংঘও বাংলাদেশে নারী আন্দোলনকে জোরদার করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা দিচ্ছে। নারী দশক (১৯৭৫-৮৫) তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে যা ১৯৫২ সালে নারীর রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আয়োজিত সম্মেলনে চিহ্নিত করা হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৯ সালে সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণের জন্য গৃহীত কনভেনশন (সি.ই.এফ.ডি) এবং মেক্সিকো (১৯৭৫), নাইরোবি (১৯৮৫) ও বেইজিং-এ (১৯৯৫) অনুষ্ঠিত তিনটি বিশ্ব সম্মেলন বাংলাদেশে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে নারীদের প্রেরণা যুগিয়েছে। আশির দশকের শেষদিকে প্রায় ২০টি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ঐক্যবদ্ধ নারী সমাজ সুদূরপ্রসারী ১৭-দফা দাবিনামা উপস্থাপন করে। এসব দাবির মধ্যে ছিল সম অধিকার, সিইডিএডব্লিউ (CEDAW) কনভেনশনের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন, অভিন্ন দেওয়ানি আইন, সরকারি চাকুরিতে কোটা বৃদ্ধি, গার্মেন্টস-এ নারী শ্রমিকদের জন্য পুরুষের সমান পারিশ্রমিক, বেতন ও অন্যান্য সুবিধাসহ মাতৃত্ব ছুটির মতো আই.এল.ও (ILO) কনভেনশনে নির্ধারিত বৈধ অধিকারের বাস্তবায়ন, ভূমিহীন ও শহরের নিঃস্ব নারীদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং গৃহ পরিচারিকাদের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ। ঐক্যবদ্ধ নারী সমাজের এই দাবিনামায় নারীদের আর্থসামাজিক প্রয়োজনকে অত্যন্ত সফলভাবে সন্নিবেশ করা হয়। নারী সংগঠনগুলির মধ্যে সবচেয়ে সংগঠিত মহিলা পরিষদের রয়েছে নিজস্ব আইন সহায়তা সেল ও নিবেদিত কর্মিবাহিনী। এই সংগঠনটি নারীদের বিভিন্ন দাবি তুলে ধরার জন্য সাফল্যের সঙ্গে একটি প্লাটফর্ম গড়ে তোলে। সংগঠনটি দাবি করে, মূলত তাদের তৎপরতার জন্যই বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৫ সালে সিইডিএডব্লিউ কনভেনশন নীতিমালা বাস্তবায়ন করে। একজন মহিলা রাজনৈতিক কর্মীর প্রতি দুর্ব্যবহার করা হলে এবং তার গণতান্ত্রিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে নারীরা যখন ঐক্যবদ্ধভাবে এর প্রতিবাদে বিক্ষোভে নেমে পড়ে তখন প্রমাণিত হয় যে, তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে।

সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে, দেশের নারী জনগোষ্ঠীকে জাগ্রত করতে এবং তাদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে নারী আন্দোলন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। নারী সংগঠনগুলি নারী নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ সংস্থা হিসেবে কাজ করে, বিশেষ করে নারীদের দাবি দাওয়ার সঠিক চিত্র তুলে ধরার মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে যায়। বিভিন্ন সেমিনার, কর্মশালা এবং লেখালেখির মধ্য দিয়ে তারা তুলে ধরেন সরকারি নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের সীমাবদ্ধতা বা দুর্বল দিক যা তাদের প্রাত্যহিক জীবনে প্রভাব ফেলে। তবে ক্ষমতায় অংশীদারিত্ব এবং নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় তাদের দাবিগুলি পুরুষ নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ধীর ধীরে নাড়া দিচ্ছে। নারীদের বিভিন্ন বিষয় জাতীয় এজেন্ডা হিসেবে তুলে ধরার জন্য এখনও কোনো জাতীয় মোর্চা গড়ে উঠে নি। কোনো সংগঠন বা সংগঠনগুলির এমন কোনো সংঘবদ্ধ রূপ বা ঐক্য গড়ে উঠে নি যা জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য সম্ভাবনাময় নারী প্রার্থীদের নির্বাচনে সহযোগিতা দিতে সত্যিকার ভাবে এগিয়ে আসবে। নারী সংগঠনগুলির রাজনীতিকীকরণ এধরনের ঐক্য মোর্চা গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে নারী সমাজের কণ্ঠকে জোরালো করার ক্ষেত্রে তাদের অবদানকে অতিরঞ্জিত করার অবকাশ নেই।

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মূলধারায় নারী সমাজকে যুক্ত করার গতি ধীর, জটিল এবং প্রতিবন্ধকতাপূর্ণ। ক্ল্যাসিক্যাল গণতন্ত্র, সামাজিকভাবে পিতৃতান্ত্রিকতার প্রভাব ও সহজে অপরিবর্তনীয় রাষ্ট্রীয় বিধান রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণকে কঠিন করে তুলেছে। ফলে দরিদ্র ও সুবিধা বঞ্চিত নারীরা এই ব্যবস্থায় এগিয়ে আসতে পারছে না। তবে রাষ্ট্রের সম্প্রতি গৃহীত কিছু উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে।  [দিলারা চৌধুরী]

মুক্তিযুদ্ধে নারী  মুক্তিযুদ্ধে নারীদের ভূমিকা ছিল গৌরবোজ্জ্বল। ১৯৭১ সালে মার্চ মাসের প্রথম থেকেই দেশের প্রতিটি অঞ্চলে যে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল তাতে মহিলাদের, বিশেষ করে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফুর্ত। মুক্তিযুদ্ধ সময়ে তাদের ভূমিকা আরও বিস্তারিত হয়। অনেক মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে পুরুষের পাশাপাশি মহিলাদের অস্ত্রচালনা ও গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

মুক্তিযুদ্ধে মহিলাদের অংশগ্রহণ ঘটে নানাভাবে। একদিকে যেমন তারামন (বীর প্রতীক), কাঁকন বিবি, রহিমা বেগমদের মত অনেকে সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, অপরদিকে সহযোদ্ধা হিসেবে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা-শুশ্রূষা করে ও মুক্তিযোদ্ধাদের আতিথ্য প্রদান ও তথ্য সরবরাহ করেও যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে অগণিত মহিলা। অনেক মহিলা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ, বস্ত্র ও ওষুধপত্র সংগ্রহ করে তাদের নিকট পৌঁছে দিয়েছে।

পাকসেনা কর্তৃক ধর্ষিত হয়েছে প্রায় দুই লক্ষ নারী। তারাও মুক্তিযোদ্ধাদের সহযাত্রী এবং তাদের ত্যাগের স্বীকৃতিতে তাদের সরকারিভাবে বীরাঙ্গনা উপাধি দেওয়া হয়। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণে তাঁদের অধিকাংশই বীরাঙ্গণা উপাধি ধারণ করে নি বা নিজেদের ধর্ষিতা হিসেবে ঘোষণা করে নি। ধর্ষিতা মহিলাদের গর্ভে জন্ম নেওয়া শিশুদের রাষ্ট্রীয়ভাবে আশ্রয় দেওয়ার ঘোষণা হলেও, অধিকাংশ ধর্ষিতা মাতাই নানা বিবেচনায় ঐ সব শিশুদের বিদেশিদের হাতে তুলে দিয়েছে দত্তক শিশু হিসেবে।

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মহিলাদের সম্পর্কে কোনো সরকারি তথ্য এখনও প্রস্ত্তত হয় নি। নারী মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ, গবেষণা ও প্রচারণার জন্য ১৯৯০ সালে নারী গ্রন্থ প্রবর্তনা নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মহিলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নামে আরেকটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৯৭ সালে। বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অংশগ্রহণ বিষয়ে বিশেষ গ্রন্থ প্রকাশ করার পরিকল্পনা করছে।  [সাহিদা বেগম]

সাহিত্য-সংস্কৃতিতে নারী  ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিক থেকে বাংলা সাহিত্যে নারীর ধারাবাহিক অবদান লক্ষ করা যায়। সাহিত্যিক উৎকর্ষ এবং স্বকীয়তার দিক দিয়ে তাঁদের রচনাবলি বিশিষ্ট। নারীর প্রতি সামাজিক বৈষম্য এবং পুরুষের স্বেচ্ছাচারিতা নারীকে তাঁর আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে প্রবৃত্ত করেছে। প্রথমদিকে সাহিত্যে বিদ্রোহের চেয়ে করুণ রসের আধিক্য লক্ষ করা গেলেও পরবর্তীতে তা আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে পর্যবসিত হয়। আলোচনার সংক্ষিপ্ত পরিসরে সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায় উল্লেখযোগ্য নারী সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের অবদানকে মূল্যায়নের চেষ্টা করা হয়েছে।

সাহিত্য স্বর্ণকুমারী দেবীর (আনু. ১৮৫৫-১৯৩২) উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ গাথা (১৮৮০), কবিতা ও গান (১৮৯৫)। সাশ্রুসম্পাদন, সাধের ভাসান, খড়গ-পরিণয়, অভাগিনী-এ চারটি অধ্যায়ের সমষ্টি তাঁর গাথা কাব্যটি। খড়গ-পরিণয় অধ্যায়টি ঐতিহাসিক কাহিনী অবলম্বনে রচিত। মানকুমারী বসুর (১৮৬৩-১৯৪৩) সর্বোৎকৃষ্ট গ্রন্থ কাব্য-কুসুমাঞ্জলি (১৮৮৪)। তাঁর কবিতা সামাজিক, প্রাকৃতিক, স্বাদেশিকতামূলক, সমসাময়িক ঘটনা বিষয়ক, পৌরাণিক এবং শিশুবিষয়ক। কামিনী রায়ের (১৮৬৪-১৯৩৩) কবিতার প্রধান লক্ষণ ভাবের জটিলতা, অস্পষ্টতা ও ছন্দের আড়ষ্টতাবিহীন ভাবসম্পদে পূর্ণ এবং সম্পূর্ণ অনুকরণমুক্ত। এ পর্যায়ে তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: আলো ও ছায়া (১৮৮৯), পৌরাণিকী (১৮৯৭), দীপ ও ধূপ (১৯২৯), নির্ম্মাল্য (১৮৯১), অশোক-সঙ্গীত (সনেটগুচ্ছ, ১৯১৪), জীবন-পথে (সনেটগুচ্ছ, ১৯৩০) প্রভৃতি। সরলাবালা সরকার (১৮৭৫-১৯৬১) বৈষ্ণবভাবাপন্ন কবি। তাঁর প্রবাহ (১৯০৪) ও অর্ঘ্য (১৯৫১) কাব্যদ্বয় ছন্দমাধুর্যে, শব্দসম্পদ ও স্বদেশানুরাগে সার্থকমন্ডিত হয়েছে। উমা দেবীর (১৯০৪-১৯৩১) কবি প্রতিভার উৎকৃষ্ট নিদর্শন চল্লিশটি চতুর্দ্দশপদী কবিতা সন্নিবিষ্ট বাতায়ন কাব্যগ্রন্থ। দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সহজসরল চিত্রটি তাঁর কবিতাকে আশ্রয় করে আছে। মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকার (১৯১০-১৯৮৩) উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে পসারিণী (১৯৩১), মন ও মৃত্তিকা (১৯৬০), অরণ্যের সুর (১৯৬৬)। সুফিয়া কামাল (১৯১১-১৯৯৯) কবি, সংগঠক। স্বৈরাচার, ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তিনি বরাবর সোচ্চার ছিলেন। সমাজ, ভাষা ও সংস্কৃতি তাঁর মূূূূল প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: সাঁঝের মায়া (১৯৩৮), মায়া কাজল (১৯৫১), মন ও জীবন (১৯৫৭), উদাত্ত পৃথিবী (১৯৬৪), প্রশান্তি ও প্রার্থনা, দিওয়ানা, স্বনির্বাচিত কবিতা সংকলন প্রভৃতি। তাঁর কবিতার বিষয় প্রেম, প্রকৃতি ব্যক্তিগত অনুভুতি, বেদনাময় স্মৃতি, জাতীয় উৎসবাদি, স্বদেশানুরাগ, স্বাধীনতাযুদ্ধ ও ধর্মানুভূতি। তাঁর কবিতায় রয়েছে অন্তরঙ্গ আবেগ ও ভাষাভঙ্গির সহজ আবেদন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে লেখা সুফিয়া কামালের কবিতাগুলি পরবর্তীতে মোর যাদুদের সমাধি পরে নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। যুদ্ধের সময় তিনি মাতৃভূমির প্রতি দায়িত্ব পালনের জন্য নারী সমাজকে আহবান করেছেন তাঁর বেণীবিন্যাস সময় তো আর নেই কবিতায়। মৈত্রেয়ী দেবীর কবিতায় রয়েছে প্রকৃতি ও জীবন সম্পর্কে ভাবনার সুগভীর অনুসন্ধান। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ উদিতা (১৯২৯), চিত্তছায়া (১৯৩৮)। জাহানারা আরজুর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে নীল স্বপ্ন (১৯৬২), রৌদ্র ঝরা গান (১৯৬৪), ক্রন্দসী আত্মজা (১৯৮৪)।  তসলিমা নাসরিনের শিকরে বিপুল ক্ষুধা (১৯৮৬), নির্বাসিত বাহিরে অন্তরে (১৯৮৯), অতলে অন্তরীণ (১৯৯১), নির্বাচিত নারী (১৯৯২), নির্বাসিত নারীর কবিতা (১৯৯৬) উল্লেখযোগ্য কবিতাগ্রন্থ।

স্বর্ণকুমারী দেবী কবি হিসেবে যতটা পরিচিতি লাভ করেছেন তার চেয়ে বেশি পরিচিতি পেয়েছেন ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ গদ্য লেখিকা এবং ঔপন্যাসিক হিসেবে। সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য অবদান মাসিকপত্র ভারতী সম্পাদনা। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস বিদ্রোহ, কাহাকে, স্বপ্নবাণী, মিলনরাত্রি, স্নেহলতা বা পালিতা এবং ঐতিহাসিক উপন্যাস ফুলের মালা, মিবার-রাজ, হুগলীর ইমামবাড়ী। নিরুপমা দেবীর (১৮৮৩-১৯৫১) উল্লেখযোগ্য উপনা্যস অন্নপূর্ণার মন্দির (১৯১৩), দিদি (১৯১৫)। প্রেম ও দাম্পত্য জীবনের অন্তর্দ্বন্দ্ব তাঁর উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য। তাঁর উপন্যাসের কাহিনী পরিকল্পনা সরল এবং রচনারীতি নিরাড়ম্বর ও গতি স্বচ্ছন্দ। অনুরূপা দেবীর (১৮৮২-১৯৫৮) পোষ্যপুত্র (১৯১১), জ্যোতিঃহারা (১৯১৫), বাগদত্তা (১৯১৪), মন্ত্রশক্তি (১৯১৫), মহানিশা, (১৯১৯) প্রভৃতি উপন্যাস গার্হস্থ্য, পারিবারিক ও ঐতিহাসিক বিষয়বস্ত্ত অবলম্বনে রচিত এবং বিদেশি প্লটের প্রভাবসমৃদ্ধ। তাঁর উপন্যাসে স্বার্থত্যাগ, ভগবৎ প্রেম ও লোক-হিতৈষণা, হিন্দু সমাজের আদর্শ ও অনুপ্রেরণা সহানুভূতির সঙ্গে চিত্রিত হয়েছে। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের (১৮৮০-১৯৩২) সাহিত্যকর্মে রয়েছে ধর্মীয় বিধানের অপব্যবহারের কথা, সমকালীন রাজনীতির প্রসঙ্গ, সেযুগের নারীদের মানসিক, শারীরিক, মনস্তাত্ত্বিক অবরুদ্ধতার কথা, সমাজের কুসংস্কার ও অবরোধ-প্রথার কুফল, নারীদের প্রতি সামাজিক অবমাননা, নারী অধিকার ও নারী জাগরণ সম্পর্কে এবং নারীশিক্ষার পক্ষে প্রাগ্রসর নিজস্ব অভিমত। তিনি তৎকালীন পুরুষশাসিত প্রতিকূল সমাজব্যবস্থায় অবরুদ্ধ নারীর বাস্তবচিত্র তির্যক ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর অনেক নক্শাধর্মী রচনায় সমাজের নিচুস্তরের মানুষের দুর্দশার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস পদ্মরাগ (১৯২৪)। তাছাড়া তাঁর অনেক কবিতা, ছোটগল্প, নকশাধর্মী রচনা ও অনুবাদ রয়েছে। নুরুন্নেসা খাতুন বিদ্যাবিনোদিনী সাহিত্যসরস্বতী (১৮৯৪-১৯৭৫), ছিলেন বঙ্গীয় মোসলেম মহিলা সংঘের সভানেত্রী। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস স্বপ্নদ্রষ্টা (১৯২৩), জানকী বাঈ (১৯২৪), আত্মদান (১৯২৫), ভাগ্যচক্র, বিধিলিপি, নিয়তি। তাঁর উপন্যাসে রয়েছে ইতিহাস, মুসলিম পরিবারের মনোরম চিত্র ও কাহিনী এবং সত্যঘটনামূলক গার্হস্থ্য কথন। দৌলতুন্নেসার পথের পরশ (১৯৫৭) উপন্যাসটি তৎকালীন অনাচার ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদই শুধু নয়, কায়েমী স্বার্থবাদীদের চিরায়ত রূপ ফুটে উঠেছে। শতাধিক উপন্যাসের রচয়িতা প্রভাবতী দেবী সরস্বতী (১৯০৫-১৯৭২)। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা অম্বা (১৯২২), আয়ুষ্মতী (১৯২৩), বিজিতা (১৯২৩), জাগরণ (১৩৩৩),  সংসার পথের যাত্রা প্রভৃতি। সরসীবালা বসুর উপন্যাস ভাষার স্বাচ্ছন্দ্য ও সারল্যে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। প্রায়শ্চিত্ত (১৯১৯), শিবালী (১৯২১), শুকতারা (১৯২২) ও রেখা (১৯২২) তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। শৈলবালা ঘোষজায়ার (১৮৯৪-১৯৭৪) সেখ আন্দু, মিষ্টি সরবৎ (১৯২০), অবাক (১৯২৫), নমিতা (১৯১৮), জন্ম অপরাধী (১৯২০), জন্ম অভিশপ্তা (১৯২১), মঙ্গলমঠ (১৩২৭), ইমানদার (১৯২২), মহিমাদেবী (১৯২৩) প্রভৃতি উপন্যাস। নীলিমা ইব্রাহীমের (১৯২১-২০০২) কেয়াবন সঞ্চারিনী, পথশ্রান্ত, বিশ শতকের মেয়ে, একপথ দুই বাঁক প্রভৃতি উপন্যাস সমসাময়িক জীবনের সমস্যাকে আশ্রয় করেছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য মুক্তযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থ আমি বীরাঙ্গনা বলছি। জাহানারা ইমাম (১৯২৯-১৯৯৪) রচিত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক দিনলিপি গ্রন্থ একাত্তুরের দিনগুলি (১৯৮৬)। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস অন্য জীবন (১৯৮৫), জীবন মৃত্যু (১৯৮৮), বুকের ভিতর আগুন (১৯৯০), নাটকের অবসান (১৯৯০), দুই মেরু (১৯৯০)। সেলিনা হোসেন রচিত হাঙ্গর নদী গ্রেনেড (১৯৭৬), যাপিত জীবন (১৯৮১), নিরন্তর ঘন্টাধ্বনি (১৯৮৪) উপন্যাসগুলো মুক্তিযুদ্ধ, বায়ান্নের ভাষা-আন্দোলন এবং ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের পূর্ববর্তী ঘটনা অবলম্বনে রচিত। তাঁর পোকামাকড়ের ঘরবসতি (১৯৮৬) অবৈধ প্রেমের উপন্যাস এবং নীল ময়ুরের যৌবন (১৯৮৩) উপন্যাসে রয়েছে সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে বাঙালি সমাজের জীবনচিত্র। পান্না কায়সারের উল্লেখযোগ্য উপন্যাস মুক্তি (১৯৯২),  নীলিমায় নীল (১৯৯২), হূদয়ে বাংলাদেশ (১৯৯৩), রাসেলের যুদ্ধ যাত্রা (১৯৯৪)। রাজিয়া খানের বটতলার উপন্যাস (১৯৫৯) ও অনুকল্প (১৯৫৯) উপন্যাস দুটি ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনী এবং বিংশ শতাব্দীর জটিল মানব জীবনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতি ও অন্তর্দ্বন্দ্বের শিল্পরূপ। তাঁর উপন্যাস হে মহাজীবন (১৯৮৩) প্রগতিশীল মনোভাবাপন্ন নায়িকা আমিনার নিগৃহীত দাম্পত্য জীবনে নিঃশেষিত হওয়া থেকে অবৈধ প্রণয়ে আত্মবিসর্জনের মর্মান্তিক ইতিহাস। তাঁর উপন্যাসে রয়েছে আধুনিক নিঃসঙ্গতা, শূণ্যতাবোধ, প্রেম ও সংস্কারের দ্বন্দ্ব। নাসরীন জাহানের উল্লেখযোগ্য উপন্যাস উড়ুক্কু (১৯৯৩), ঈশ্বরের বাম হাত (২০০৭), মৃত্যুসখীগণ (২০০৬)। তাঁর উপন্যাসে ব্যক্তির অন্তর্নিহিত ক্রন্দন, ক্লেদ, দ্বিধা, ভয়, আর্থসামাজিক টানাপোড়েন এবং তৃতীয় বিশ্বের অস্থিরতা প্রকটভাবে রূপায়িত হয়েছে। তাঁর অসামান্য ভাষাশৈলী ও ব্যক্তি প্রাখর্য্য তাঁর রচনাকে দীপ্তিময় করে তুলেছে। রাবেয়া খাতুনের উল্লেখযোগ্য উপন্যাস অনন্ত অন্বেষা (১৯৬৯), মধুমতি (১৯৬৩), মন এক শ্বেত কপোতী (১৯৬৫), বায়ান্ন গলির এক গলি (১৯৮৪)। তাঁর ফেরারী সূর্য (১৯৭৪) উপন্যাসটির পটভূমি ২৫ মার্চের কালো রাত্রির বিভীষিকা। তাঁর নীল নিশীথ (১৯৮৪) উপন্যাসটি ব্যর্থ প্রেমের হতাশা থেকে জৈবের বিকৃত চিত্তের বিকাশ। তাঁর ই বাদর মাহ ভাদর (১৯৮৮) উপন্যাসটি অবৈধ দেহ মিলনের উপন্যাস। মহাশ্বেতা দেবীর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস নটী (১৯৫৭), হাজার চৌরাশির মা (১৯৭৫), তারুণ্যের অধিকার (১৯৭৭), অগ্নিগর্ভ (১৯৭৮)। তাঁর কাজ মূলত মুন্ডা আদিবাসীদের ওপর। রোমেনা আফাজের উপন্যাস কাগজের নৌকা, জানি তুমি আসবে, প্রিয়ার কণ্ঠস্বর, লেখকের স্বপ্ন, সোনালী সন্ধ্যা, হারানো মানিক। রহস্যোপন্যাস রচনায় তাঁর কৃতিত্ব রয়েছে। রাজিয়া মজিদের উপন্যাস তমসা বলয় (১৯৬৬), দিগন্তের স্বপ্ন (১৯৬৭), মেঘে জলতরঙ্গ (১৯৮৫), নক্ষত্রের পতন (১৯৮২), দাঁড়ায়ে আছি একা (১৯৮৭)। মকবুলা মনজুর রচিত উপন্যাস আর এক জীবন (১৯৬৮), জল রং ছবি (১৯৮৪), বৈশাখে শীর্ণ নদী (১৯৮৩), অবসন্ন গান (১৯৮২), কালের মন্দিরা (১৯৯৭) প্রভৃতি। রিজিয়া রহমান রচিত একাল চিরকাল (১৯৮৪) উপন্যাসটি সাঁওতাল জীবনের আনন্দ-বেদনা, প্রত্যাশা প্রাপ্তি, ধর্মবিশ্বাস ও কুসংস্কার, শোষণ বঞ্চনা, ঈর্ষা আর স্বার্থপরতার ছবি। তাঁর বং থেকে বাংলা (১৯৮৭) উপন্যাসটি বাঙালি জাতীয়তাবোধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শতাব্দীব্যাপী অবহেলিত, অধিকারবঞ্চিত বাঙালির জীবনচিত্র। দিলারা হাশেমের ঘর মন জানালা (১৯৬৫) উপন্যাসটি নাগরিক জীবনের প্রতিচ্ছবি। তাঁর অন্যান্য উপন্যাস একদা এবং অনন্ত (১৯৭৫), স্তব্ধতার কানে কানে (১৯৭৭), আমলকীর মৌ (১৯৭৮), অনুক্ত পদাবলী (১৯৯৮)। তসলিমা নাসরিনের উল্লেখযোগ্য উপন্যাস অপরপক্ষ (১৯৯২), শোধ (১৯৯২), লজ্জা (১৯৯৩), বন্দিনী (২০০৮)।

স্বর্ণকুমারী দেবীর নবকাহিনী  উল্লেখযোগ্য ছোটগল্পগ্রন্থ। ইন্দিরা দেবীর (১৮৮৯-১৯১২) নির্মাল্য (১৯১২), কেতকী (১৯১৫) ও ফুলের তোড়া, সুরুচিবালা রায়  রচিত মর্মস্মৃতি (১৯১৯), ঝরা পাতা ও আহুতি, সরসীবালা বসুর গল্পগ্রন্থ শ্রেয়সী (১৯২১) ও মিলন এবং জ্যোতির্ময়ী দেবীর (১৮৯৪-১৯৮৮) সোনা রূপা নয় (১৩৭৬), রাজযোটক (১৯৪১), আবাবল্লীর আড়ালে (১৯৫৫), ব্যান্ড মাস্টারের মা (১৯৬১), আবাবল্লীর কাহিনী (১৯৬৫) উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ। সুফিয়া কামালের ছোটগল্পগ্রন্থ কেয়ার কাঁটা (১৯৩৭)। রাজিয়া মাহবুবের গল্পগ্রন্থ খাপছাড়া (১৯৫৮), দূর ভাষিণী (১৯৬৯) ও স্বনির্বাচিত গল্প (১৯৬২), মকবুলা মনজুরের সায়াহ্ন যুথিকা ও দিবা রাত্রি, রিজিয়া রহমানের অগ্নিস্বাক্ষর, ইফফাত আরার রোদন ভরা বসন্ত (১৯৮৯), নোনা স্বাদের জীবন (১৯৯০), একাকী অন্ধকারে (১৯৯৪), সুখ যখন শেষ বেলায় (২০০০) উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ। সেলিনা হোসেনের গল্পগ্রন্থ উৎস থেকে নিরন্তর, খোল করতাল ও মানুষটি, নাজমা জেসমিন চৌধুরীর মেঘ কেটে গেলে, অন্য নায়ক, বাড়ি থেকে পালিয়ে, ঝর্ণা রহমানের কালঠুঁটি, অন্য এক অন্ধকার, জীবনের জল ও অনল বিশিষ্ট গল্পগ্রন্থ। নাসরীন জাহানের উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ স্থবির যৌবন (১৯৮৪), বিচূর্ণ ছায়া ((১৯৮৫), সূর্যতাপসী (১৯৮৯), পথ, হে পথ (১৯৮৯)।

জ্ঞানদানন্দিনী দেবী (১৮৫০-১৯৪১) সম্পাদিত বালক পত্রিকায় তাঁর রচিত সাত ভাই চম্পা ও ঠাক ডুমা ডুম নাটক দুটি  ১৯১০ সালের ৬ জুন এবং ২০ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়। স্বর্ণকুমারী দেবীর নাটক নিবেদিতা, দিব্যকমল, গীতিনাট্য বসন্ত-উৎসব (১৮০১), বিবাহ-উৎসব (১৮৯২), কাব্যনাট্য যুগান্ত, কৌতুকনাট্য ও বিবিধ কথা, দেবকৌতুক এবং প্রহসন কনেবদল ও পাকচক্র। অমলাদেবীর ভিখারিণী (১৯১৪), সরযুবালা দাশগুপ্তার ত্রিবেণী সঙ্গম (১৯১৪), দেবোত্তর বিশ্বনাট্য (১৯১৫) ও অন্নপূর্ণা (বাংলা ১৩২২) উল্লেখযোগ্য । দেবোত্তর বিশ্বনাট্য একটি রূপক নাটক। নাটকটি শ্রমিক ও ধনিকের বিরোধ সম্পর্কিত। নীলিমা ইব্রাহীম দুয়ে দুয়ে চার, নব মেঘদূত, মনোনীতা, যে অরণ্যে আলো নেই প্রভৃতি নাটকগুলোতে সমকালীন সমাজচিত্রকে প্রতিফলিত করেছেন।

সংস্কৃতি, জীবনী, ইতিহাস, ভ্রমণকাহিনী, রম্যরচনা, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয় অবলস্বনে প্রবন্ধ-সাহিত্যের সম্প্রসারণ ঘটেছে। এগুলোর মধ্যে সাহিত্য সম্পর্কিত প্রবন্ধের সংখ্যাই বেশি। এ পর্যায়ে যাঁরা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন, নীলিমা ইব্রাহীম, বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ, সনজীদা খাতুন, হোসনে আরা শাহেদ, বেগম আক্তার কামাল, সিদ্দিকা মাহমুদা, মনোয়ারা হোসেন, সিদ্দিকা কবির, সেলিনা হোসেন, রাজিয়া খান, রাজিয়া মাহবুব, রাজিয়া সুলতানা, শাহিদা আখতার, মাহবুবা সিদ্দিকী, নাসরীন জাহান প্রমুখ।

সঙ্গীত  ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী (১৮৭৩-১৯৬০) ট্রিনিটি কলেজ অব মিউজিক থেকে ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেন এবং বাদ্রিদাস মুকুলের নিকট উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে তালিম নেন। তৎকালীন বামাবোধিনী, বঙ্গলক্ষ্মী, সাধনা, পরিচয়, সবুজপত্র প্রভৃতি পত্রিকায় সঙ্গীত বিষয়ের ওপর তাঁর মৌলিক রচনা প্রকাশিত হয়েছে। ‘মায়ার খেলা’, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’, ‘কালমৃগয়া’সহ প্রায় দু’শ রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপি রচনা করেন। তিনি শান্তিনিকেতন সঙ্গীত ভবনে রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিক্ষক ছিলেন। সতী দেবী (১৯১১-১৯৭৯) রবীন্দ্রসঙ্গীত ও অতুলপ্রসাদের গানের খ্যাতনামা শিল্পী। আলমোড়ায় উদয়শঙ্কর প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান কালচার সেন্টারে তিনি গান শেখাতেন। তিনি বোম্বের পৃত্থী থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি সুরবিতান নামে একটি গানের স্কুল পরিচালনা করতেন। তিনি হিমাংশু দত্ত এবং দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অনেক গান রেকর্ড করেছেন। ফিরোজা বেগম নজরুল সঙ্গীত শিল্পী ও স্বরলিপিকার হিসেবে পরিচিত। ১৩৯৩ বঙ্গাব্দে কলকাতার এইচএমভি কোম্পানি তার ১১টি গানের রেকর্ড বের করে। তিনি স্বাধীনতা পদক (১৯৭৬), জাতীয় টেলিভিশন পুরস্কার (১৯৭৬), একুশে পুরস্কার, শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কারে (১৯৭৯) ভূষিত হন। গীতা দত্ত চলচ্চিত্রের প্লেব্যাক  গায়িকা। ছায়াছবি ও গ্রামোফোন রেকর্ডের অসংখ্য জনপ্রিয় গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। খালেদা মনযুর-এ খুদা ১৯৫১-১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ঢাকা বেতারে রবীন্দ্র সঙ্গীত, আধুনিক সঙ্গীত, লোক সঙ্গীত ও ধর্মীয় সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে তৎকালীন খালেদা ফ্যান্সি খানম নামে পরিচিতি পান। সন্জীদা খাতুন রবীন্দ্র সঙ্গীতশিল্পী ও রবীন্দ্র গবেষক। তাছাড়াও তিনি ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলার গণশিল্পী সংস্থার সভানেত্রী ও মুক্তিযোদ্ধা সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন। ছায়া আহমেদ বাংলাদেশ বেতারের গীতিকার। ফেরদৌসী রহমান বাংলাদেশ টেলিভিশনের সূচনালগ্ন থেকে আজ অবধি নিয়মিত শিল্পী। তিনি ঠুমরী, গজল, নজরুলগীতি, আধুনিক গান, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালী এবং লোকসঙ্গীত পরিবেশন করছেন। প্রায় ২০০ চলচ্চিত্রের নেপথ্যে কণ্ঠ দিয়েছেন। আনজুমান আরা বেগম ১৯৬৯ সাল থেকে বেতার ও চলচ্চিত্রে কণ্ঠ দিচ্ছেন। ষাটের দশকের বাংলা গানের অন্যতম এ শিল্পী প্রায় ৩০০ ছবিতে কণ্ঠ দিয়েছেন। তিনি ১৯৬৫ সালে হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গীত বিষয়ে অধ্যয়নের জন্য বৃত্তি লাভ করেন। তাছাড়া তিনি ‘তারকালোক পদক ৯৫’ লাভ করেন। কল্যাণী ঘোষ বাংলাদেশ বেতার, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী। ১৯৬৩ সালে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে নজরুলগীতি, দেশাত্মবোধক ও আধুনিক গান পরিবেশন  করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ৩০জন শিল্পী সমন্বয়ে গঠিত ‘বাংলাদেশ তরুণ শিল্পী গোষ্ঠী’র সদস্য হিসেবে যুদ্ধের স্বপক্ষে ভারতের বিভিন্ন শহরে ও শরণার্থী শিবিরে সঙ্গীত পরিবেশন করেন। কলকাতার বিখ্যাত সঙ্গীত দল ‘ক্যালকাটা ইয়ুথ কেয়ার’-এর সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন। আভা আলম (১৯৪৭-১৯৭৬) উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পী ও সঙ্গীত শিক্ষক। আতিক সঙ্গীত একাডেমীর অধ্যক্ষ, সেনানিবাস সঙ্গীত একাডেমীর সহঅধ্যক্ষ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত পরীক্ষক ছিলেন। ১৯৭৮ সালে তিনি একুশে পদকে ভূষিত হন। লিলি ইসলাম শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্র সঙ্গীত ও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করেন এবং রবীন্দ্র সঙ্গীতে অনার্স ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ঝুমুর ললিতকলা একাডেমীর শিক্ষক ছিলেন। নীলুফার ইয়াসমিন (১৯৪৮-২০০৩) ১৯৬৮ সাল থেকে আমৃত্যু বাংলাদেশ টেলিভিশনে নিয়মিত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত, আধুনিক সঙ্গীত, অতুল প্রসাদের গান, রজনীকান্ত কীর্তন ও দ্বিজেন্দ্র গীতি পরিবেশন করেন। তাছাড়া তিনি রেডিও, মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। রুনা লায়লা ১৬টির অধিক ভাষায় সঙ্গীত পরিবেশনের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী। এক সময় তার সম্মানে পাকিস্তান টেলিভিশনে ‘বাজমে লায়লা’ নামে একটি ধারাবাহিক অনুষ্ঠান চালু ছিল। বাংলাদেশ ছাড়াও তিনি পাকিস্তান ও ভারতের চলচ্চিত্রে কণ্ঠ দিয়েছেন। তাঁর বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কারের মধ্যে ১৯৬৮ সালে ‘কমান্ডার’ ছবিতে কণ্ঠ দেওয়ার জন্য ‘গ্রাজুয়েট নিগার ফিল্ম ক্রিটিক পুরস্কার’ অন্যতম। সাবিনা ইয়াসমীনের হাতে খড়ি হয় ক্ল্যাসিকেল সঙ্গীত দিয়ে। এ সঙ্গীতে যোগ্যতা অর্জন করে তিনি পরবর্তীতে আধুনিক সঙ্গীতে স্থায়ী হন। তিনি নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে গান পরিবেশন করে আধুনিক বাংলা গানে নতুন মাত্রা যোগ করেন। তাঁর বিপুল সংখ্যক লংপ্লে এবং ৪৫ মিনিটের রেকর্ড রয়েছে।  হৈমন্তী শুক্লা বাংলাদেশ ও ভারতের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী। দেশবিভাগের পরে তিনি পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। তাঁর বহু লংপে, ডিস্ক রেকর্ড রয়েছে। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা রবীন্দ্র সঙ্গীতের বিশিষ্ট শিল্পী। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষকরূপে কর্মরত আছেন। মিতা হক রবীন্দ্র সঙ্গীতের বিশিষ্ট শিল্পী। বর্তমানে ছায়ানট সংস্কৃতি-ভবন সঙ্গীত বিভাগে কর্মরত আছেন। এ বিভাগের অন্যান্য শিল্পী  লাইসা আহমদ লিসা, ইলোরা আহমেদ শুল্কা, নীলুফার জাহান প্রমুখ। শাহীন সামাদ নজরুল সঙ্গীতের বিশিষ্ট শিল্পী। তিনি উক্ত প্রতিষ্ঠানের নজরুলগীতি বিভাগে কর্মরত আছেন। এ বিভাগের আরো উল্লেখযোগ শিল্পীরা হলেন নাসিমা শাহীন ফ্যান্সী, শারমিন সাথী ইসলাম, মাসুদা নার্গিস, নবনীতা চক্রবর্তী, রোকসানা হোসেন মুন্নী, ফারহানা আক্তার শার্লী, আফরোজা খান মিতা, অনিন্দিতা চৌধুরী। সঙ্গীতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য আরো শিল্পীরা হলেন ফেরদৌস আরা, শাহনাজ রহমতুুুল্লাহ, ফওজিয়া ইয়াসমিন, ফাতেমাতুজ জোহরা, দিলরুবা খান, শাম্মী আখতার, মমতাজ বেগম, কনক চাপা, সামিনা চৌধুরী, ফাহমিদা নবী, ফরিদা ইয়াসমীন, আবিদা সুলতানা, সুমনা হক, ডলি সায়ন্তনী প্রমুখ।

অভিনয়  আনোয়ারার অর্ধশতাধিক ছবির মধ্যে নয়ন মনি, গোলাপী এখন ট্রেনে, নবাব সিরাজউদ-দৌলা উল্লেখযোগ্য । অভিনয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির পুরস্কারসহ বহু পুরস্কারে ভূষিত হন। আতিয়া চৌধুরী নবাব সিরাজউদদৌলা (১৯৬৭), অরুণ বরুণ কিরণমালা (১৯৬৮), সাত ভাই চম্পা (১৯৬৮) প্রভৃতি ছবিতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন। কবরী সারোয়ারের অভিনীত শতাধিক ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য লালন ফকির, সুজন সখি, সারেং বউ। শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও বাচসাস পুরস্কার লাভ করেন। গেীতম ঘোষ পরিচালিত ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ ছবির উল্লেখযোগ্য অভিনেত্রী চম্পা। তাছাড়াও তিনি সন্দ্বীপ রায় এবং বুদ্ধদেব দাসগুপ্ত পরিচালিত ছবিতে অভিনয় করেন। ডলি ইব্রাহিম (১৯৪৮-১৯৯১) সূর্য দীঘল বাড়ি ছবির শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী। অভিনেত্রী নূতনের উল্লেখযোগ্য ছবি প্রাণ সজনী, রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত, ওরা ১১জন, পাগলা রাজা, মহেশখালির বাঁকে, ফকির মজনু শাহ। ১৯৮৩ সালে প্রাণ সজনী ছবিতে অভিনয়ের জন্য বাচসাস পুরস্কার এবং ১৯৮৭ সালে রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত ছবিতে অভিনয়ের জন্য পুরস্কার লাভ করেন। ববিতা দ’ুশতাধিক ছবিতে অভিনয়ের পারঙ্গম অভিনেত্রী। শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে  ১৯৭৭ সালে বসুন্ধরা পুরস্কার, ১৯৮৫ সালে রামের সুমতি ছবিতে অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। তাছাড়া ১৯৭৪ সালে ‘আলোর মিছিল’, ১৯৭৭ সালে ‘বসুন্ধরা’, ১৯৮৫ সালে ‘দহন’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য বাচসাস পুরস্কার লাভ করেন। রওশন জামিলের (১৯৩১-২০০২) উল্লেখযোগ্য ছবি আলীবাবা, জীবন থেকে নেয়া, মনের মতো বউ, তিতাস একটি নদীর নাম, গোলাপী এখন ট্রেনে, আবার তোরা মানুষ হ, ওরা ১১জন। রোজিনা প্রায় ২০০ ছবিতে অভিনয়ের সাক্ষর রেখেছেন। ১৯৮০ সালে তিনি পার্শ্ব অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় পুরস্কার, ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে বাচসাস পুরস্কার লাভ করেন। তাছাড়া তিনি ১৯৮৬ সালে ভারতের কল্পমন্দির থেকে এবং ১৯৮৭ সালে পাকিস্তান থেকে পুরস্কারে ভূষিত হন। শামীম আখতার রোজী শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে রাজু আহমেদ স্মৃতি স্বর্ণপদক (১৯৭৪), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, সিকোয়েন্স পুরস্কার (১৯৭৫), বাচসাস পুরস্কার (১৯৭৭) চিত্রালী ও বঙ্গবন্ধু পুরস্কার (১৩৮৯) লাভ করেন। শাবানা সখী তুমি কার (১৯৮০), দুই পয়সার আলতা (১৯৮২), নাজমা (১৯৮৩), ভাতদে (১৯৮৪) ও অপেক্ষা (১৯৮৭) প্রভৃতি ছবিতে অভিনয়ের জন্য জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮২ সালে লাল কাজল এবং ১৯৮৭ সালে রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত ছবিতে অভিনয়ের জন্য বাচসাস পুরস্কারে ভূষিত হন। সুচিত্রার ১৯৫৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত অভিনীত বিখ্যাত ছবি পথে হলো দেরী। ১৯৬১ সালে তিনি সপ্তপদী ছবিতে অভিনয় করেন। ছবিটি বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক  শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে পুরস্কার লাভ করে। ১৯৬৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সাত পাঁকে বাঁধা-ছবিতে অভিনয়ের জন্য আন্তর্জাতিক  চলচ্চিত্র  শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পান।

নাট্য আন্দোলনের পথিকৃৎ তৃপ্তি মিত্র চল্লিশের দশকে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের ‘নবান্ন’ নাটকে অসাধারণ অভিনয়ের মাধ্যমে সফল অভিনেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। বহুরূপী নাট্যগোষ্ঠীর অন্যতম পুরোধা তৃপ্তি মিত্র চার দশকেরও বেশি নাট্যশিল্পকে বিভিন্নভাবে সমৃদ্ধ করেন। টেলিভিশনের বিশিষ্ট নাট্যশিল্পী দিলারা জামান। তিনি বেতার ও টেলিভিশন শিল্পী সংসদের সহসভাপতি। ফেরদৌসী মজুমদার বেতার ও টেলিভিশনের জনপ্রিয় নাট্যশিল্পী। তিনি ১৯৭৫ সালে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে প্রথম বারের মতো জাতীয় টেলিভিশন পুরস্কার লাভ করেন। এ বছর তিনি সিকোয়েন্স এওয়ার্ড অব মেরিট লাভ করেন। শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে তাঁর অন্যান্য পুরস্কার: শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৭৭), কাজী মাহবুবুল্লাহ স্বর্ণপদক (১৯৮১), বাংলাদেশ পদক (১৯৮৫), মানিক মিয়া স্মৃতি পদক (১৯৮৭) ও বঙ্গবন্ধু পুরস্কার। নাগরিক নাট্য দলের সদস্য লাকী  ইনাম শতাধিক নাটকে অভিনয় করেছেন। অভিনয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি সিকোয়েন্স এওয়ার্ড (১৯৮৪) লাভ করেন। সুবর্ণা মুস্তাফা প্রথম সারির নাট্যাভিনেত্রী। তাঁর প্রথম মঞ্চ নাটক জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন এবং প্রথম টেলিভিশন নাটক বরফ গলা নদী।

এছাড়া উল্লেখযোগ্য অভিনেত্রীরা হলেন শবনম, শর্মিলী আহমেদ, বনানী চৌধুরী, ডলি জহুর, আয়শা আকতার, লায়লা হাসান, জাহানারা আহমেদ, কেয়া চৌধুরী, তমালিকা কর্মকার, রোকেয়া প্রাচী, ত্রপা মজুমদার, শমী কায়সার, আফসানা মিমি, বিপাশা হায়াত প্রমুখ।

ভাস্কর্য নভেরা আহমেদ (১৯৩০-১৯৮৯) বাংলাদেশের প্রথম ভাস্কর শিল্পী। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নকশা প্রণয়নে তিনি  চিত্রকর হামিদুর রহমানকে সহযোগিতা করেন। ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে সামরিক শাসন জারির ফলে শহীদ মিনারের কাজ বন্ধ হয়ে গেলে নভেরা আহমেদ ব্যক্তিগত উদ্যেগে শহীদ মিনারের কাজ শুরু করেন। ১৯৬১ সালের All Pakistsn Painting and Sculpture Exhibition-G Zuvi Child Philosopher চিত্রকর্মটি শ্রেষ্ঠ পুরস্কার লাভ করে। তাঁর অধিকাংশ শিল্পকর্ম বোঞ্জ দিয়ে তৈরি। তিনি তাঁর শিল্পকর্মে ইউরোপিয় শিল্প ভাবনার সঙ্গে দেশজ বিষয় ও টেকনিকের সমন্বয় ঘটিয়েছেন। মেহেরুন ১৯৭৮ সালে ঢাকা চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের বার্ষিক প্রদর্শনীতে তৈল রং-এ শ্রেণি পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর আলোকচিত্র ‘কনসার্ন’ ১৯৭২-১৯৮২ সালে বাংলাদেশ স্ম^ারকগ্রন্থে প্রকাশিত হয়। শামীম শিকদারের উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্মের মধ্যে রয়েছে স্বোপার্জিত স্বাধীনতা’ (টিএসসি-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), লা-গয়েনিকা (পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মুখে), রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন, পদ্মায় ভাস্কর্য, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট, পুলিশ ক্লাব ও প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সম্মুখের শিল্পকর্ম। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সিরাজ শিকদারের আবক্ষ মূর্তি তৈরি করেন। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের সম্মুখের ক্যালিগ্রাফি আর্ট, ক্যান্টনমেন্ট থার্ড গেট ও হযরত শাহজালাল বিমান বন্দরের ক্যালিগ্রাফি আর্ট এবং সুগন্ধার সম্মুখে বাংলাদেশের সংস্কৃতির ওপর তাঁর শিল্পকর্ম উল্লেখযোগ্য ।

চিত্রকলা মেহেরবানু খানম চিত্রশিল্পী। ১৯২০ সালে তিনি কলকাতা থেকে প্রকাশিত মাসিক মোসলেম ভারত পত্রিকায় ছাপানোর জন্য তাঁর অাঁকা দুটি ছবি পাঠান। ছবি দুটি দেখে কাজী নজরুল ইসলাম মুগ্ধ হন এবং একটি ছবি অবলম্বনে তিনি ‘খেয়া পারের তরণী’ কবিতাটি রচনা করেন। তাঁর ছবি মোসলেম ভারতের ১৩২৭ সনের শ্রাবণ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় এবং তিনি প্রথম মুসলিম মহিলা চিত্রশিল্পীর মর্যাদা লাভ করেন। ফরিদা জামান সত্তর দশকের শেষদিকের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমন্ডিত চিত্রশিল্পী। চিত্রকর্মে তাঁর বিষয় বাঙালি জীবনের অতি পরিচিত নদী, মাছ, জাল। উল্লম্ভ^ ও আনুভূমিক দোলানো রেখা ও আকার দিয়ে জালের গড়নকে প্রতিভাত করে তাঁর চিত্রতল বিভক্ত। পানির অভ্যন্তরের অনুভুতি সঞ্চারিত তাঁর চিত্রকল্পে রঙের ব্যবহার হালকা প্রলেপের মতো এবং তাতে মিশানো থাকে আলো ও ছায়ার স্তর। নাসরীন বেগম প্রথমদিকে জলরঙে তথাকথিত প্রাচ্যরীতির চিত্র নির্মাণ করেছেন। পরে তাঁর কাজে নিজস্ব শৈলীর ব্যবহার লক্ষ করা যায়। পটের মধ্যবতী পরিসরে একটি খোলা দরজার ভিতর দিয়ে দেখা অপর অংশের জগৎ, এ রূপকল্প ব্যবহার করে নাসরীন নারী জীবনের বিবাহ-পূর্ববর্তী স্বপ্নময়তার বিপরীতে যেন বিবাহ পরবর্তী স্বপ্ন ভঙ্গের ট্রাজেডিকেই রূপায়িত করেন। তাঁর অর্থময় প্রতীক নির্বাচন সুমিত বর্ণ প্রয়োগে নারীর দ্বিবিধ জগৎ প্রতিভাত হয়ে ওঠে। তাঁর চিত্রকল্পকে আবার অতিরোমান্টিকতা আক্রান্ত আলঙ্কারিক বিন্যাসে উপস্থিত করার প্রতি তাঁর পক্ষপাত রয়েছে। রোকেয়া সুলতানা নারীবাদি চিন্তাচেতনার মধ্য দিয়ে তাঁর ছবির অবয়ব সৃষ্টি করেন। তাঁর চৈতন্য সমাজের ফ্যান্টাসির মধ্য দিয়ে সমাজের দুষ্ট বেষ্টন থেকে মুক্তি খুঁজেছে।  তাঁর চিত্রকর্মে একযুগ ধরে ফ্যান্টাসি চর্চার বিবর্তন চলছে। প্রথম দিকে তাঁর ‘ম্যাডোনা’ শীর্ষক ছবিতে একরকম হাসিখুশি আনন্দময় পরিবেশ বজায় থাকত। কিন্তু ধীরে ধীরে শিল্পীর ছবির তল থেকে উধাও হয়ে যায় ম্যাডোনার স্পষ্ট উপস্থিতি। টেক্সাচার, জল গড়িয়ে যাওয়ার দাগ, হলুদাভ গড়নে মৃত্তিকার মনের সংকেত, বিন্দুরাশির মধ্যে জলজ শব্দ-এসব মিলিয়ে রোকেয়ার চিত্রজগৎ হয়ে ওঠে একটি বিচিত্র অনুভূতির মনোদর্পণ। সাধারণত নারী শিল্পীদের উপস্থাপিত ধরণ থেকে নাজলী লায়লার প্রকাশভঙ্গি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। দাম্পত্য জীবনের দৈনন্দিন আটপৌরে নানান ঘটনা ও দৃশ্যের মধ্যেই তিনি খুঁজে পান বৈপরীত্য ও প্রহসনের উপাদান। রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনাপ্রবাহ তাঁর ছবিতে ইঙ্গিতময় ও দ্ব্যর্থবোধক অর্থময়তায় আভাসিত হয়ে আসে। তাঁর অংকনশৈলী প্রধানত সাদৃশ্যধর্মী হলেও বাস্তব পরিপ্রেক্ষিতকে পরিবর্তিত করে এবং বর্ণচয়নের স্বাধীনতা গ্রহণ করে তিনি ছবিতে আনেন বহুমাত্রিক কৌণিক মাত্রা। নিলুফার চামান আশির দশকের কনিষ্টতম শিল্পীদের একজন হলেও তার রচনা প্রবলভাবে স্বাতন্ত্র্যমন্ডিত। প্রথম পর্যায়ের তাঁর একরঙা ছবিতে বাস্তবানুগ ফিগর নির্মাণে নিজ দক্ষতাকে ব্যবহার করে তিনি ফিগরে আনেন সারল্য, চিত্রপটে দ্বিমাত্রিকতা ও জ্যামিতিক বিন্যাস। তাঁর শৈলীতে, তেলরঙ প্রয়োগে প্রথানুগ লেপনরীতির বিরুদ্ধে তিনি বর্ণের ছোট ছোট পোঁচে গড়ে তোলেন আকৃতি, পটের বেশিরভাগই থাকে বর্ণহীন। কখনো তাঁর আকৃতি শিশুসুলভ ‘নাইভ’ সারল্যে, বিষয় ও বিন্যাসেও নতুনত্ব। আতিয়া ইসলাম এ্যানি তাঁর চিত্রে নিজস্ব চিত্রভাষা নির্মাণ করেছেন। তাঁর চিত্রভাষার রূপক ও প্রতীক সরল ও সহজবোধ্য। তাঁর ছবি বিভ্রান্ত সমাজের অকপট প্রকাশ। কনকচাপা শিল্পকলার মূলস্রোতে সম্ভবত প্রথম উল্লেখযোগ্য চাকমা শিল্পী। তাঁর ছবিতে প্রথমবারের মতো উপজাতি মানুষের অন্তর্জগতের দ্বন্দ্ব ও বেদনা কিছুটা হলেও প্রতিভাত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রচলিত চিত্রাঙ্কন রীতি এবং দৃষ্ঠিভঙ্গির রোমান্টিকতা তাঁর শিল্পকর্মকে প্রভাবিত করলেও কখন কখনও পাহাড়ি পরিপার্শ্ব ও ওই অঞ্চলের মানুষের জীবনের নানান অনুষঙ্গ কনকচাপার ছবিতে আলাদা দ্যোতনায় প্রতিভাত হচ্ছে। তৈয়বা বেগম প্রথমদিকের নারীবাদী মনোভাব থেকে ক্রমে সরে এসেছেন মিশ্র ও স্থাপনাধর্মী শিল্পের দিকে। তাঁর চিত্রে প্রায়ই লক্ষ করা যায় অবরোধবাসিনী ব্যক্তি নারী। সমাজের অসংগতিসমূহকে তিনি ইঙ্গিতপূর্ণ রূপকে তুলে ধরেন। সুলেখা চৌধুরীর চিত্রকর্মও প্রায় সরাসরি ভাষায় সে অবস্থানেরই জানান দেয়। সমাজের চেয়ে প্রধানত সংসার জীবনের নারীর পীড়ন ও একাকিত্বের প্রতিরূপ তাঁর ছবি।

আলোকচিত্র নারী আলোকচিত্রীদের মধ্যে সাইদা খানম পথিকৃৎ। তিনি ১৯৬১ সালে বেগম পত্রিকার মাধ্যমে ফটো-সাংবাদিকতায় জড়িত হন। ডলি ইব্রাহিম আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় জাতিসংঘ পুরস্কার লাভ করেন। শিরীন সুলতানা তাঁর প্রথমদিকের শৌখিনতা থেকে পেশাদার ফটো-সাংবাদিক হিসেবে সচিত্র সন্ধানী ও সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকায় কাজ করেন। ১৯৮৬ সালে ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি ফটোগ্রাফি একাডেমি’ থেকে বেসিক ফটোগ্রাফি কোর্স এবং ১৯৯৮-২০০০ সালে ‘পাঠশালা’ থেকে আলোকচিত্রে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন মুনীরা মোরশেদ মুন্নী। তিনি ১৯৯৬ সাল থেকে আলোকচিত্রকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। বর্তমানে যারা এ পেশার সঙ্গে জড়িত আছেন তাঁরা হলেন ফারজানা খান গোধূলি (অঋচ), মোমেনা জলিল (ঘবঅিমব), কাকলী প্রধান (সমকাল), ও লায়লা আনোয়ার বিন্দু (ইউ ঘবংং), স্নিগ্ধা জামান, যুথিকা হাওলাদার, সানজীদা শহীদ, সামীরা হক। ২০০৫ সালের ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে নবীন ও প্রবীণ আলোকচিত্রীগণের ‘বিক্ষুব্ধ নারী মোর্চা’র কর্মসূচীতে জ্বলে উঠি সাহসী নারী’ ব্যানারে একটি দলগত প্রদর্শনী করা হয়।

নৃত্য  বিভাগপূর্ব বাংলায় যে দুজন বিখ্যাত নৃত্যশিল্পীর আবির্ভাব ঘটে তাঁরা হলেন অমলাশঙ্কর নন্দী ও মেনকা চৌধুরী। অমলাশঙ্কর নন্দী নৃত্যনাট্য ও ছায়ানাট্যে অভিনয়ের পারঙ্গম শিল্পী। পরের দুজন নৃত্যশিল্পী হলেন মালেকা পারভীন বানু ও লুলু বিলকিস বানু। ১৯৪৮ সালে গওহর জামিল ‘শিল্পকলা ভবন’ নামে একটি নৃত্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এ সময় শকুন্তলা, মেঘদূত ও সোনার নুপুর নামে কয়েকটি নৃত্যনাটক মঞ্চস্থ হয়। এসব নাট্যনৃত্যে যাঁরা অংশগ্রহণ করেন তাঁদের মধ্যে লায়লা সামাদ, রোকেয়া কবির, রওশন জামিল, জহরত আরা, মমিনুন নেসা, কুলসুম হুদা, নাঈমা আহমেদ, লিলি খান, রোজী মজিদ, মেহের আহমেদ, জিনাত আহমেদ ও সেলিনা বাহার জামানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । ষাটের দশকে প্রতিষ্ঠিত ছায়ানট সংস্কৃতি-ভবনের প্রধান দুজন উদ্যোক্তার একজন সন্জীদা খাতুন। জাগো আর্ট সেন্টার, নিক্কন ললিতকলা কেন্দ্র ও মিউজিক কলেজ থেকে যেসব নৃত্যশিল্পী নৃত্য বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেছেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন রাহিজা খানম ঝুনু, ডালিয়া নিলুফার, মন্দিরা নন্দী, নার্গিস মুর্শেদা, আলপনা মুমতাজ, লায়লা খান, মীনু হক, ডলি ইকবাল, সেলিনা মোহসিন, জিনাত বরকতউল্লাহ, লুবনা মরিয়ম, সেলিনা হোসেন, মিলি কাজী, শারমীন হাসান ও লায়লা হাসান।

১৯৬০-১৯৭২ সাল পর্যন্ত লুবনা মরিয়ম বুলবুল ললিতকলা একাডেমীতে নাচের ওপর প্রশিক্ষণ নেন। তাছাড়া তিনি প্রহলাদ দাশের কাছে তালিম নেন। তিনি ভারত নাট্যমের নৃত্যশিল্পী। আনোয়ারা বাহার চৌধুরী ১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘সুরবিতান’ নামক নৃত্য ও সঙ্গীত বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা। তাছাড়া তিনি বুলবুল ললিতকলা একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। লোক ও আধুনিক ধারার নৃত্য শিল্পীরা হলেন রওশন জামিল, জিনাত বরকতুল্লাহ, লায়লা হাসান, আল্পনা মুমতাজ। আশির দশকের ভারত নাট্যমের উল্লেখযোগ্য নৃত্যশিল্পীরা হলেন শুক্লা সরকার, শর্মিলী বন্দ্যোপাধ্যায়, সোমা মুমতাজ, প্রমা অবন্তী, ব্যানার্জী সালাম সুমি, সুভ্রা সেনগুপ্তা, বেবী রোজারিও, মুন্নি, নিসা, অর্ণ কমালিকা, লিলি ইসলাম। মণিপুরী নৃত্যের মধ্যে শর্মিলা আহমেদ, লিলি ইসলাম ও তামান্না রহমান উল্লেখযোগ্য। কথক নৃত্যের উল্লেখযোগ্য শিল্পী মুনমুন আহমেদ, ওড়িশি নৃত্যের শিল্পী মীনু হক। নৃত্যশিল্পীদের পরিচালিত নৃত্য-বিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে অমলাশঙ্কর নন্দীর কন্যা মমতাশঙ্কর পরিচালিত উদয়ন-মমতাশঙ্কর ডান্স কোম্পানি (১৯৮৬), শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত নৃত্য নন্দন, শামীম আরা নীপা পরিচালিত নৃত্যাঞ্চল, শুক্লা সরকার পরিচালিত দ্রুপদ, লায়লা হাসান পরিচালিত নটরাজ, মুনমুন আহমেদ পরিচালিত রেওয়াজ পারফর্মিং একাডেমি, প্রথমদিকে আলপনা মুমতাজ পরে তাঁর কন্যা সোমা মুমতাজ পরিচালিত কথাকলি, দীপা খন্দকার পরিচালিত দিব্য।  [শামীমা আক্তার]

গ্রন্থপঞ্জি  যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, বঙ্গের মহিলা কবি, কলকাতা, ১৯৫৩; ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গ সাহিত্যে নারী, কলকাতা, ১৯৫০; শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গ সাহিত্যে উপন্যাসের ধারা, কলকাতা, ১৩৭২; সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, পঞ্চম খন্ড, কলকাতা, ১৯৫৮; বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ, সাহিত্য-সাধক-চরিতমালা, কলকাতা, ১৯৪৬; ফরিদা সুলতানা, বাংলাদেশের উপন্যাসে জীবন চেতনা, ঢাকা, ১৯৯৯; সাঈদা জামান, বাংলাদেশের নারী চরিতাভিধান, ঢাকা, ১৯৯৮; বিশ্বজিৎ ঘোষ, বাংলাদেশের সাহিত্য, ঢাকা, ২০০৯; বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা, ২০০৭; মইনুদ্দীন খালেদ, বাংলাদেশের চিত্রশিল্প, ঢাকা, ২০০০; বাংলা একাডেমী লেখক অভিধান, ঢাকা, ২০০৮।

নারী আন্দোলন  নারীর অধিকার ও নারী পুরুষের সমমর্যাদার প্রতি বিশ্বাস এবং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পরিচালিত কর্মকান্ড। নারী আন্দোলনের লক্ষ্য ও কার্যক্রম দেশ, শ্রেণী, জাতি এবং সংস্কৃতি ভেদে ভিন্নতর। ভারত উপমহাদেশে বিশেষত অবিভক্ত বাংলায় নারী আন্দোলন শুরু এবং পরিচালিত হয় সংস্কারবাদী আন্দোলন এবং আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে। সমাজ সংস্কার আন্দোলনের প্রগতিশীল নেতা রাজা রামমোহন রায় (১৭৭৪-১৮৩৩), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১), ব্রিটিশ পন্ডিত ডিরোজিও, ব্রাহ্মসমাজ নেতৃবৃন্দ এবং অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি নারীদের সামাজিক ও ধর্মীয় নির্যাতন থেকে রক্ষার জন্য ব্যাপক আন্দোলন শুরু করেন। তৎকালীন সময়ে তাঁরা বৈপ্লবিক পরিবেশ সৃষ্টি করেন এবং মানুষের মনমানসে নারী পুরুষের সমতা বিষয়ে ইতিবাচক ধারণার সৃষ্টি করেন। নারী আন্দোলনের সূচনা পুরুষের মাধ্যমে হলেও পরবর্তী সময়ে নারীরাও এতে অন্তর্ভুক্ত হন। বিশ শতকের শেষদিকে এসে নারীর অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে এবং তা সম্ভব হয়েছে বৃহত্তর নারী আন্দোলনের প্রভাবে।

অবিভক্ত ভারতে নারী আন্দোলন: মুক্তি ও আত্মসচেতনতার যুগ উনিশ শতকে নারী আন্দোলন শুরু হয় রাজা রামমোহন রায়ের প্রচেষ্টায় সমাজ সংস্কারের অংশ হিসেবে এবং সতীদাহ প্রথা বিলোপের জন্য প্রচারণা ও কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে। ১৮১৫ সালে রামমোহন রায় আত্মীয় সভা প্রতিষ্ঠা করেন নারীদের প্রতি সামাজিক ও ধর্মীয় নিপীড়ন বন্ধের জন্য। ১৮২৮ সালে রামমোহন রায় প্রগতিশীল ব্রাহ্মদের সহযোগিতায় সতীদাহ বন্ধের জন্য ব্রাহ্ম সভা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সতীদাহ বিষয়ে কয়েকটি বই লেখেন, যেমন সহমরণ বিষয়ে প্রবর্তক এবং নিবর্তকের সংবাদ: প্রথম প্রস্তাব (১৮১৮) ও দ্বিতীয় প্রস্তাব (১৮১৯) এবং সহমরণ (১৮২৯)। সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে অব্যাহত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৮১৫ এবং ১৮১৭ সালে সহমরণ বিষয়ে শিথিলতা আরোপ করা হয়। ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক সতীদাহ বিলোপে আইন প্রণয়ন করেন। রামমোহন রায় বর্ণবৈষম্য, বহুবিবাহ এবং বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। তাঁর মতে নারীর প্রতি নিপীড়ন বিদ্যমান সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় আচরণ ব্যবস্থার বহিঃপ্রকাশ। তিনি বাঙালি নারীদের নিজস্ব সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ পশ্চিমা সংস্কৃতির উৎকৃষ্ট দিক গ্রহণ করার প্রতি জোর দেন।

সতীদাহ প্রথা বন্ধের পর ঔপনিবেশিক বাংলার সংস্কারকগণ বিধবা পুনর্বিবাহের প্রতি গুরুত্বব দেন। সতীদাহ আইন প্রণয়নের পর নারীরা ধর্মীয় নিপীড়ন থেকে মুক্তি পেলেও বিধবা নারীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে সমস্যা প্রকট হয়ে উঠে। বয়স্ক কুলীন ব্রাহ্মণদের বহুবিবাহ এবং স্বামীর মৃত্যুর পর  বিধবা বিবাহ অনুমোদিত না থাকার কারণে বিধবাদের কঠোর জীবন পদ্ধতি অনুসরণ করতে হতো। পরিমিত ও নিয়ন্ত্রিত খাবার, কঠোর গৃহশ্রম, পুরুষের সামনে নিজের সৌন্দর্য্যকে নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি প্রাত্যহিক জীবনাচরণের কারণে কখনোবা নারীরা বাড়ি থেকে পালিয়ে পতিতাবৃত্তিতে নিযুক্ত হতো। মুসলিম সমাজে বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ না হলেও সমাজ সংস্কৃতির নিয়মে সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারীরা পুনর্বিবাহ করতে পারত না।

বিধবা পুনর্বিবাহ বিষয়ে প্রথম সমর্থন দেয় ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর সদস্যগণ। ১৮৩৩-১৮৩৪ সালে জ্ঞানান্বেষণ এবং পরবর্তী সময়ে বেঙ্গল স্পেক্টেটর পত্রিকায় বিধবা বিবাহের সমর্থনে মতামত প্রকাশিত হয়। এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তাঁর প্রকাশিত সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার মাধ্যমে তিনি এ বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা চালান। তাঁর রচিত বিধবা বিবাহ উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৫) বইয়ে তিনি বিধবা বিবাহের সমর্থনে শাস্ত্রের সঠিক ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। তিনি ১৮৫৫ সালের ৪ অক্টোবর আইনসভায় স্মারকলিপি প্রদান করেন। তাঁর প্রচারণা ও আন্দোলন জনসমাজে এতটাই প্রভাব বিস্তার করে যে ১৮৫৬ সালের ১৯ জুলাই বিধবা পুনর্বিবাহ আইন প্রণীত হয়। আইন প্রণয়নের পর প্রথমদিকে ব্রাহ্ম সমাজের প্রগতিশীল সদস্যদের মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে বিধবা পুনর্বিবাহের ঘটনা ঘটে এবং পরিসংখানে দেখা যায়, ১৮৫৬-১৯১১ সাল পর্যন্ত উচ্চবর্ণের হিন্দু নারীদের মধ্যে মাত্র ৫০০ বিধবা বিবাহ হয়। অধিকাংশ নারী আইনি সুবিধার বাইরে ছিল। তা সত্ত্বেও বিধবা বিবাহ আইন প্রণয়নের কারণে হিন্দু সমাজে বিধবা মেয়েদের প্রতি সমাজের নিষ্ঠুর আচরণের বিষয় আলোচনায় পরিণত হয়। অবশ্য সমাজ সংস্কারের ঐ নতুন পদক্ষেপ অনেক বিতর্কের জন্ম দেয়।

রক্ষণশীল এবং সংস্কারকদের মধ্যে বিভেদ পুনরুদ্দীপ্ত হয় তখনই যখন ১৮৯১ সালে Age of Consent Bill পাসের মাধ্যমে ১২ বছরের কম বয়সের মেয়ের সাথে সহবাস নিষিদ্ধকরণের মধ্য দিয়ে বাল্যবিবাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সমসাময়িক সংবাদপত্রগুলো ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের প্রতি বিলের মাধ্যমে অপ্রত্যাশিত হস্তক্ষেপের ক্রমাগত সমালোচনা করে। সেই সঙ্গে নারীসমাজের সংস্কার ও উন্নয়ন উনিশ শতকে প্রশ্নাতীত ও সংবেদনশীল বিষয়ে পরিণত হয়।

নারী আন্দোলনের বড় অধ্যায় জুড়ে ছিল ধর্ম ও সংস্কৃতির নিপীড়ন থেকে নারীদের মুক্তি। কিন্তু নারী  আন্দোলনের প্রধান পদক্ষেপ ছিল শিক্ষা আন্দোলন এবং শিক্ষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই নারীর নবজাগরণ শুরু হয়। উনিশ শতকে বাঙালি নারীদের শিক্ষার আন্দোলন শুরু হয় খ্রিস্টান মিশনারীদের মাধ্যমে। ১৮১৮ সালে চিনসুরায় মেয়েদের জন্য প্রথম স্কুল প্রতিষ্ঠা করে লন্ডন মিশনারী সোসাইটি। ১৮৫৪ সালে শিক্ষা বিষয়ে উডের ডেসপ্যাস প্রণয়নের পূর্ব পর্যন্ত মেয়েদের জন্য শিক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ ছিল না।  নারী শিক্ষার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে মিস মেরি অ্যান কুকের নেতৃত্বে ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এই সোসাইটির উদ্যোগে ১৮২৬-১৮৩৬ সালের মধ্যে মেয়েদের জন্য ৩০ টি স্কুল গড়ে উঠে। এসব স্কুলে অধিকাংশ মেয়ে আসে দরিদ্র পরিবার থেকে। কারণ উনিশ শতকের প্রথমভাগে ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ভয়ে উচ্চবিত্ত মেয়েদের জন্য শিক্ষার সুযোগ তেমন শুরু হয় নি। ১৮৪৭ সালে বারাসতে পিয়ারীচরণ সরকার কর্তৃক বাঙালি উচ্চবিত্ত মেয়েদের জন্য প্রথম স্কুল স্থাপিত হয়। অধিকন্তু ১৮৪৯ সালে কলকাতায় জন ইলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন সবশ্রেণীর মেয়েদের জন্য বেথুন স্কুল (পরবর্তী সময়ে বেথুন কলেজ) প্রতিষ্ঠা করেন এবং এই উদ্যোগ ছিল মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদানে উচ্চবিত্ত অভিভাবকদের প্রভাবিত করার উপায়।

সমাজ সংস্কারে রামমোহন রায়ের আত্মীয় সভার পর তাঁর প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসমাজের (১৮২৮) ভূমিকা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। নারী শিক্ষা, বিধবা পুনর্বিবাহ, বর্ণ বহির্ভূত বিয়ে, অবরোধ প্রথা বিলোপ, সামাজিক ও জনজীবনে নারীদের পরিমিত অংশগ্রহণ এবং তাদের অবস্থানের মানোন্নয়নের জন্য ব্রাহ্মসমাজের সদস্যগণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ১৮৪৬ সালে পূর্ববঙ্গে (ঢাকায়) এবং পরবর্তী সময়ে এর বিভিন্ন অংশে ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং নারী শিক্ষা প্রসারে ও নারীর প্রতি ইতিবাচক ভাবমূর্তি সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে।

উনিশ শতকের শেষদিকে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে নারীর অগ্রগতির বিষয় গুরুত্ব পায়। এ কারণে পূর্ববঙ্গে অন্তঃপুর স্ত্রী শিক্ষা (১৮৭০), হিতকরী সভা (১৮৭২), ব্রাহ্মিকা সভা (১৮৭৭), মুসলমান সুহূদ সম্মিলনী (১৮৮২), কন্যাপণ নিবারণী সভা (১৮৮৯) প্রভৃতি সংগঠন বিধবা বিবাহ, কন্যা বিক্রি, যৌতুক  রোধ এবং নারীর শিক্ষার উন্নতির লক্ষ্যে কাজ করে। উল্লেখ্য যে, উনিশ শতকের শেষদিকে স্বয়ং নারীরা নিজ উদ্যোগে নারীমুক্তির আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। স্বর্ণকুমারী দেবী ১৮৯৬ সালে নারীদের শিক্ষা ও আত্মকর্মসংস্থানের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন সখি সমিতি। ১৯০৬ সালে এই সংগঠন হিরন্ময়ী ঘোষালের বিধবা শিল্পাশ্রমের সাথে যুক্ত হয়ে আশ্রম এবং কর্মমূখী প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করে।

বাংলায় নারী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের শক্তিশালী ভিত গড়ে উঠে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের উদ্যোগে। তিনি তাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিকভাবে নারী আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ পটভূমি তৈরি করেন। তিনি মেয়েদের জন্য সাখাওয়াত হোসেন মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল (১৯১১) প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলায় নারীর অধস্তন অবস্থার পরিবর্তন এবং নারী অগ্রগতিতে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। রোকেয়ার বড় আন্দোলন ছিল নারী শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি এবং অবরোধ প্রথার বিরুদ্ধে। পূর্ববাংলা থেকে লেডি অবলা বসু মেয়েদের শিক্ষার জন্য নারী শিক্ষা সমিতি গঠন করেন এবং উনিশ শতকের শেষদিকে উভয় বাংলা থেকে নারীরা উচ্চ শিক্ষায় প্রবেশ করে। বেথুন কলেজ (১৮৪৯), লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ এবং ঢাকায় ইডেন কলেজ প্রতিষ্ঠা ছিল নারী আন্দোলনের এক শক্তিশালী পদক্ষেপ। নারী আন্দোলনের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল নারী শিক্ষার সম্প্রসারণ এবং এ কারণে পূর্ববঙ্গেও মেয়েদের জন্য বিভিন্ন স্থানে ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্কুল স্থাপিত হয়।

উনিশ শতক থেকে বিশ শতকের দু’দশক পর্যন্ত নারী আন্দোলন পরিচালিত হতো অরাজনৈতিক অবস্থান থেকে এবং নারীর সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনই ছিল মূখ্য উদ্দেশ্য। কিন্তু শিক্ষা আন্দোলনের পর এবং বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক অংশগ্রহণের দাবিতে স্বয়ং নারীরাই আন্দোলন শুরু করে। এ লক্ষ্যে ১৯২৫ সালে নারীর ভোটাধিকারের দাবিতে ন্যাশনাল কাউন্সিল অব উইমেন ইন ইন্ডিয়া (এনসিডব্লিউআই) গঠিত হয় এবং ১৯২৬ সালে সরোজিনী নাইডু, কমলা দেবী এবং জাহানারা শাহনেওয়াজ প্রমূখ নারীদের প্রতিনিধিত্বে অল ইন্ডিয়া উইমেন কনফারেন্স (এআইডব্লিউসি) গঠিত হয়। ১৯২৮ সালে বাংলায় অল ইন্ডিয়া উইমেন কনফারেন্স-এর শাখা গঠিত হয়।

১৯১৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর উপমহাদেশের বিভিন্ন সংগঠন থেকে নারীদের একটি প্রতিনিধিদল ভোটাধিকারের দাবিতে ভাইসরয় মন্টেগু চেমসফোর্ডের নিকট স্মারকলিপি পেশ করে। কিন্তু কংগ্রেস সভায় একমাত্র অ্যানি বেসান্ত ব্যতীত অন্যদের আপত্তির কারণে এই দাবি প্রত্যাখাত হয়। একই বছরে ইন্ডিয়ান উইমেন অ্যাসোসিয়েশন গঠিত হয় এবং এই সংগঠনের সঙ্গে জড়িত সরোজিনী নাইডু, কমলা দেবী চৌধুরী এবং বেগম হামিদা আলী প্রমূখ তাদের দাবিকে প্রাধান্য দিয়ে আন্দোলন শুরু করেন। ১৯১৮ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ এবং ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস নারীর ভোটাধিকারের দাবি সমর্থন করে। পূর্ববাংলা থেকে লেডি অবলা বসু নারী সমাজ গঠন করে জনসমর্থন আদায় করেন। ১৯১৯ সালে মাদ্রাজে এবং ১৯৩৫ সালে সমগ্র ভারতে নারীরা ভোটাধিকার লাভ করে। এই অধিকার প্রাপ্তির সাথে রাজনৈতিক পরিসরে নারীর অংশগ্রহণের প্রভাবই সম্ভবত পরবর্তী সময়ে নারীদের জাতীয় আন্দোলন এবং ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে।

নারী আন্দোলন: পাকিস্তান পর্ব ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর নারী আন্দোলন অনেকটাই সংগঠন কেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গড়ে উঠে নতুন সংগঠন। তবে এ সংগঠনগুলো নারী আন্দোলনের তুলনায় রাজনৈতিক আন্দোলনে বেশি সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। মুসলিম লীগ সরকারের পুষ্ঠপোষকতায় ১৯৪৯ সালে অল পাকিস্তান উইমেন অ্যাসোসিয়েশন (আপওয়া) গঠিত হয়। এ সংগঠন নারীদের মুক্তবুদ্ধির চর্চাকেন্দ্র হিসেবে পরিচালিত হলেও তৃণমূল পর্যায়ের নারীরা ছিল এর আওতার বাইরে। ১৯৪৮ সালে পূর্ববঙ্গে নারীরা বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ রোধ এবং বিয়ের ক্ষেত্রে মেয়ের সম্মতি প্রভৃতি বিষয়ে শাসনতন্ত্রে বিধান প্রণয়নের প্রস্তাব তুলে ধরে। কিন্তু এ প্রস্তাব গৃহীত হয় নি। এসময় নারী আন্দোলন অনেক ক্ষেত্রে সরকার কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়। ১৯৪৮ সালের ২৬ মে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি গঠিত হয়। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে সরকার বিরোধী কর্মকান্ডের অজুহাতে এ সংগঠন নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। পরবর্তী সময়ে বেগম সুফিয়া কামাল, হেনা দাস, লীলা নাগ প্রমূখের সহায়তায় পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতি গঠিত হয়। তবে এ সংগঠন মূলত নারী আন্দোলনের চেয়ে সরকার বিরোধী সংগঠন হিসেবে পরিচিতি পায়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরই মূলত নারীদের আইনগত অধিকারের বিষয় অধিক গুরুত্ব পায়। ১৯৪৮ সালের বাজেট অধিবেশনে নারীদের কাজের অধিকার ও সুযোগ বৃদ্ধির দাবি উত্থাপিত হয়। নারীদের সম্মিলিত দাবির প্রেক্ষাপটে মুসলিম নারীদের ব্যক্তিগত আইনের শরীয়া বিল ১৯৫১ পাস হয় এবং এর মাধ্যমে সম্পত্তিতে নারীদের অধিকার স্বীকৃত হয়। ১৯৫৪ সালে সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনের উদ্যোগে নারীদের সাহিত্য চর্চার সুযোগ সৃষ্টির জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় বেগম ক্লাব। পরবর্তী সময়ে এই ক্লাব এবং বেগম পত্রিকার মাধ্যমে যৌতুকের সংস্কৃতি নির্মূল এবং সম্পত্তিতে নারীর সমানাধিকার, নারী শিক্ষা প্রভৃতি বিষয়ে ব্যাপক তৎপরতা শুরু হয়। ১৯৫৫ সালে বেগম জাহানারা শাহনেওয়াজের নেতৃত্বে বিভিন্ন সংগঠনের সমন্বয়ে বিয়ে, তালাক, সন্তানের অভিভাবকত্ব প্রভৃতি বিষয়ে নারীর অধিকার সমুন্নত রাখার জন্য ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গঠিত হয়। একই বছরে উল্লেখিত বিষয়ে আইন প্রণয়নের জন্য কমিশন গঠন করা হয় এবং এ কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে পারিবারিক আইন ১৯৬১ প্রণীত হয়। এ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বহু বিবাহ প্রথা নিষিদ্ধ, বিয়ে রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক, বিয়ের বয়স নির্ধারণ, দেনমোহর প্রভৃতি বিষয়ে নারীর অধিকার স্বীকৃত হয়। যদিও আইন প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের মধ্যে পার্থক্য থেকে যায় এবং পরবর্তী সময়ে বিরোধীপক্ষ এ আইনকে ইসলাম পরিপন্থি হিসেবে অ্যাখ্যা দিয়ে সংস্কারের দাবি জানায়। কিন্তু নারীদের ক্রমাগত আন্দোলনের ফলে এ আইন কোনো সংস্কার ব্যতীত ১৯৬৩ সালে জাতীয় পরিষদে গ্রহীত হয়। এ আইন ছিল নারী আন্দোলনের বিজয়সূচক।

পরবর্তী বছরগুলোতে ১৯৬২ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাতিলের আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থানে ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ প্রভৃতি বিষয় মূখ্য হয়ে দাঁড়ায়। সামগ্রিকভাবে পাকিস্তান শাসনামলে নারী আন্দোলন সরাসরিভাবে পরিচালিত না হয়ে অনেকাংশেই জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সাথে একীভূত হয় এবং বলা যায় নারীর অধিকারের বিষয়গুলো খুব কমই গুরুত্ব পায়।

বাংলাদেশে নারী আন্দোলন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর নারী আন্দোলন সমষ্টিক পর্যায়ের পরিবর্তে সংগঠন ভিত্তিক কার্যক্রমের রূপ নেয়। বিভিন্ন নারী সংগঠন গড়ে উঠে এবং সংগঠনগুলো বিদ্যমান অবস্থার নিরীখে তাদের কৌশল ও কর্মপন্থা নির্ধারণ করে। তারা প্রাথমিক পর্যায়ে যুদ্ধাহত নারীদের পুনর্বাসন এবং সমাজে তাদের অবস্থান নির্ণয়ের প্রতি জোর দেয়। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে অল পাকিস্তান উইমেন অ্যাসোসিয়েশনের (আপওয়া) পূর্ব পাকিস্তান শাখা বেগম সুফিয়া কামালের উদ্যোগে পাকিস্তান মহিলা পরিষদ নামে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করে। পাকিস্তান মহিলা পরিষদের নতুন নামকরণ হয় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। মহিলা পরিষদের সর্বপ্রথম এজেন্ডা ছিল নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা। ১৯৭২ সালে মহিলা পরিষদ জাতীয় সংসদে এবং স্থহানীয় সরকার ব্যবস্থায় নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন নির্ধারণ এবং আসনসমূহে সরাসরি নির্বাচন দাবি করে। এছাড়া মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি, প্রজনন স্বাস্থ্য, সাংবিধানিক ও আইনগত অধিকার এবং নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে অভিযান চালায়।

সত্তরের দশকের শেষদিকে মহিলা পরিষদ নারীদের প্রতি যৌতুক নিপীড়ন বন্ধ করার লক্ষ্যে সরকারের কাছে যৌতুকবিরোধী স্মারকলিপি প্রদান করে। ১৯৮০ সালে যৌতুক বিরোধী আইন প্রণীত হয়। আশির দশকের প্রথমে নারীর অধিকারের আন্তর্জাতিক দলিল সিডও সনদের পূর্ণ অনুমোদন এবং এর লক্ষ্য বাস্তবায়নে সরকারের সঙ্গে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করে। ১৯৮০ সালে সকল ধর্মের নারীদের জন্য ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড বা সার্বজনীন পারিবারিক আইন প্রণয়নের দাবি করে। এর ভিত্তিতে যুক্তি ছিল, ধর্মের পার্থক্য থাকলেও মূলত নিপীড়ন ভোগ করার ক্ষেত্রে সকল নারীই সমগোত্রীয়, ধর্ম নৃগোষ্ঠী ও বর্ণের ঊর্ধ্বে বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামো ও রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে নারীরা অধস্তন।

আশির দশকে নারীপক্ষ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এ সংগঠন দেশের বিভিন্ন জেলায় নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নারীর প্রতি সহিংসতা, সন্তানের অভিভাবকত্ব, সম্পত্তির অধিকার, পারিবারিক নির্যাতন রোধ প্রভৃতি বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য তৃণমূল পর্যায় থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারী সংগঠনগুলো আইনি সহায়তা প্রদান করে আসছে। ১৯৮৭ সালে নারী অধিকার নিশ্চিত করার জন্য ঐক্যবদ্ধ নারী সমাজ গঠিত হয়। এই সম্মিলিত জোট তাদের ১৭ দফা দাবি তুলে ধরে ১৯৮৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি সম্মেলন করে। এই ১৭ দফা দাবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল জাতীয় ক্রিয়াকর্মে নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণ, যৌতুক নিরোধ আইন বাস্তবায়ন, সহিংসতা এবং পাচার রোধ, পারিবারিক আদালত গঠন, রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিতকরণ, কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি হয়রানি বন্ধ, আদিবাসী নারীদের অধিকার রক্ষা, উত্তরাধিকার এবং জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য কোটা বৃদ্ধি প্রভৃতি।

মূলত বাংলাদেশে নারী আন্দোলন অধিকাংশই প্রেক্ষাপট ভিত্তিক। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নারীর সমস্যা অবলোকনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের নারী আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে। নববইয়ের দশকে নারী সংগঠনগুলোর প্রধান আলোচনা ছিল মুক্তিযোদ্ধা নারীদের যথাযথ স্বীকৃতি। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর মাসে উবিনীগ (উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা) প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ করে এবং ১৯৯৫ সালে নারীর প্রতি সহিংসতা বিশেষত ফতোয়া বন্ধ করার জন্য সম্মিলিত নারী সমাজ ফোরাম গঠিত হয়। তবে সম্মিলিত নারী সমাজের মূখ্য প্রতিবাদ ছিল রাষ্ট্র কর্তৃক সহিংসতা, পিতৃতান্ত্রিক প্রভাব এবং নারী ও শিশু শ্রমিকদের প্রতি শোষণের বিরুদ্ধে। ১৯৯৫ সালে বেইজিং-এ বিশ্ব নারী সম্মেলনের পর প্রতিটি দেশের সরকারের প্রতি নারী উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয় উল্লেখ করা হয়। বেইজিং সম্মেলন এবং তৎপরবর্তী নারী সংগঠনের উল্লেখযোগ্য আন্দোলনের ফলাফল হিসেবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ প্রণীত হয়।

মূলত অবিভক্ত ভারতের প্রগতিশীল সংস্কারকদের প্রয়াস থেকেই বাংলাদেশে নারী আন্দোলনের সূত্রপাত। জাতীয়তাবোধ এবং বাঙলার নবজাগরণ প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় নারীদের মুক্তি ও অগ্রগতির শক্তিশালী আন্দোলন শুরু হয়েছে উনিশ শতকে। বাস্তব অর্থেই উনিশ শতকে নারী আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা ছিল নারীর সামাজিক মুক্তি ও আত্মপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে নারীর অবস্থান অনেক সুদৃঢ় হলেও নতুন নতুন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নারীর প্রতি সহিংসতা ও বৈষম্যর রূপও ভিন্নতর। সেক্ষেত্রে নারী আন্দোলন প্রয়োজন নারীর অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য। নারী আন্দোলন তাই অপরিহার্যভাবেই একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। [লিলীমা আহমেদ]

গ্রন্থপঞ্জি  Southard, Barbara, The Women’s Movement and Colonial Politics, The University Press Limited, 1996; Ferdous Azim, Women’s Movement in Bangladesh; মালেকা বেগম, বাংলার নারী আন্দোলন; বাঙালি নারী: হাজার বছরের বাঙালি নারী