নাথসাহিত্য

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২১:৫৭, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

নাথসাহিত্য  নাথধর্মের আচার-আচরণ ও নাথযোগীদের কাহিনীভিত্তিক সাহিত্য। এটি মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের একটি বিশেষ ধারা। এ সাহিত্য দুটি ধারায় বিকাশ লাভ করে: একটি হলো সাধন-নির্দেশিকা (guideline); এগুলি সাধনার গুহ্যতা রক্ষার্থে কতগুলি রহস্যজ্ঞাপক পদ বা দোহা; এতে প্রচুর পারিভাষিক শব্দ ও বাক্য (code language) রয়েছে এবং বাক্যগুলি উপদেশমূলক। দ্বিতীয় ধারার সাহিত্য হচ্ছে গাথাকাহিনী বা আখ্যায়িকা; এতে সিদ্ধাদের সাধনজীবনের অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ বা সিদ্ধিলাভের কথা পরিবেশিত হয়েছে। এই শ্রেণির কাহিনীর লক্ষ্য ছিল সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকে বিশেষ ধর্মপথের দিকে আকৃষ্ট  করা।

নির্দেশিকামূলক পদ বা দোহাগুলি সংকলন বা প্রত্যক্ষ রচনা হিসেবে প্রকাশ পেয়েছিল। গোরক্ষসংহিতা এবং যোগচিন্তামণি এরূপ দুটি সংকলন।  কাহ্নপা ও জালন্ধরীপার রচনা হিসেবে কিছু দোহার সন্ধান মিলেছে এবং চর্যাগীতিকার দোহা সংকলনে সেগুলি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। গোরক্ষপন্থীদের মধ্যে গোরক্ষনির্দেশিকা হিসেবে যা প্রচলিত তা শ্রুতিনির্ভর সংকলন। মীননাথ বা গোরক্ষনাথের ব্যক্তিগত কোন রচনা নেই।

গাথা-কাহিনীগুলি অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালের রচনা; পূর্বধারার সঙ্গে এগুলির কালিক ব্যবধান অন্তত দুশতকের। এই ধারার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাহিনী হলো  গোরক্ষবিজয়। রাজা মানিকচন্দ্রের গীত, ময়নামতীর গান বা  গোপীচন্দ্রের গান একই ধারার ত্রিমুখী কাহিনী। বিভিন্ন স্থানিক সংস্করণে পৃথক পৃথকভাবে প্রকাশিত হলেও এগুলি মূলে একই কাহিনীর রকমফের। নাথসাহিত্যের এই ধারাটি সাধারণ্যে বিশেষ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। রূপকের মাধ্যমে নিষ্ঠা ও চরিত্রশুদ্ধির মহান আদর্শকে এ ধরনের কাহিনীতে উচ্চে তুলে ধরা হয়েছে। ফলে নীতিমূলক লোকশিক্ষার গৌরবে এসব কাহিনী সহজেই সমাদৃত হয়েছে। বাংলা ছাড়াও হিন্দি, ওড়িয়া, মারাঠি, গুজরাটি, নেপালি ও তিববতি ভাষায় গাথামূলক কাহিনীগুলির আলাদা আলাদা সংস্করণ পাওয়া যায়।

গোরক্ষবিজয় কাহিনীতে একদিকে গোরক্ষনাথকে অবিচল যোগীর আদর্শে চিত্রিত করা হয়েছে, অন্যদিকে বিবৃত হয়েছে মীননাথের চারিত্রিক অধঃপতনের কাহিনী একবার জলটুঙ্গি ঘরে মাছের রূপ ধরে শিবকথিত মহাজ্ঞান গোপনে শোনার জন্য এবং অন্যবার গৌরীর সহজ মায়ায় অতি সহজে বশীভূত হয়ে অসংযম প্রকাশ করার জন্য। প্রথম অপরাধে শিব-শাপে তিনি মহাজ্ঞান বিস্মৃত হন এবং দিতীয় অপরাধে তাঁকে কদলী নামক প্রমীলারাজ্যে ষোলোশত নারীর বাঁধনে নীতিভ্রষ্ট ভোগজীবন যাপন করতে হয়। এই অধঃপতিত গুরু মীননাথকে আত্মপ্রত্যয়ে ফিরিয়ে এনে তাঁর শিষ্য গোরক্ষনাথ কীভাবে কদলীরাজ্য থেকে তাঁকে মুক্ত করে আনেন তারই চমকপ্রদ কাহিনী বর্ণিত হয়েছে গোরক্ষবিজয় কাব্যে। গোরক্ষনাথ নর্তকীর বেশে মৃদঙ্গতালে মহাজ্ঞানের সূত্র স্মরণ করিয়ে গুরুকে স্বচেতনায় ফিরিয়ে আনেন।

ময়নামতী-গোপীচন্দ্রের গানে গার্হস্থ্য জীবনের আধারে যোগজীবনের নির্দেশিকা স্থান পেয়েছে। নারীসিদ্ধা গোরক্ষশিষ্যা রানী ময়নামতী স্বামী মানিকচন্দ্রকে স্বল্পায়ুর ভবিতব্য থেকে ফেরাবার জন্য ভোগজীবন ত্যাগ করে সন্ন্যাসজীবন গ্রহণ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। রাজা তা না মেনে অকালে মৃত্যুবরণ করেন। পরে পুত্র গোপীচন্দ্রকে একই কারণে তিনি তাঁর রাজ্যে ঝাড়ুদারের কাজে নিযুক্ত যোগী হাড়িপার শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে বলেন। অনিচ্ছাসত্ত্বেও শিষ্যত্ব নিয়ে গোপীচন্দ্র বারো বছরের জন্য গৃহছাড়া হন। পরে হীরা নটীর মোহপাশ লঙ্ঘন করে সংসারে ফিরে আসেন। গোপীচন্দ্র তাঁর পত্নীদের যোগবিভূতি দেখিয়ে চমৎকৃত করার লোভে পড়ে গুরু হাড়িপার ক্রোধে পড়েন। এতে বিরক্ত গোপীচন্দ্র স্ত্রীদের পরামর্শে গুরুকে মাটিতে পুঁতে ফেলেন। পরে হাড়িপার শিষ্য কানুপা গোরক্ষের কাছ থেকে এ কথা শুনে গুরুকে উদ্ধার করেন। গোপীচন্দ্র কী কৌশলে হাড়িপার ক্রোধ থেকে রেহাই পেয়ে চিরতরে সন্ন্যাস নিলেন, তারই বিবরণ আছে এই গল্পে।

গোরক্ষবিজয় সংক্রান্ত ১৭টির মতো  পুথি অবিভক্ত বাংলা থেকে সংগৃহীত হয়েছে। সংগ্রাহকরা হলেন  নলিনীকান্ত ভট্টশালী (১টি পুথি),  আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ (৮টি পুথি), আলি আহমদ (৭টি পুথি) এবং পঞ্চানন মন্ডল (১টি পুথি)। এসব পুথির অধিকাংশই খন্ডিত। পুথি অনুসরণে সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা তিন। নলিনীকান্ত ভট্টশালী সম্পাদিত গ্রন্থের নাম মীনচেতন এবং আবদুল করিম ও পঞ্চানন মন্ডল সম্পাদিত গ্রন্থের নাম যথাক্রমে গোরক্ষবিজয় ও গোর্খবিজয়।

গোরক্ষবিজয় কাব্যের রচনাকাল নিয়ে পন্ডিত মহলে বিতর্ক আছে।  শেখ ফয়জুল্লাহ ছাড়া কবীন্দ্র, ভীমসেন ও শ্যামদাসের নাম ভণিতায় পাওয়া যায়। তবে ভণিতায় নামের সংখ্যাধিক্যের হিসেবে ফয়জুল্লাহকেই গোরক্ষবিজয়ের কবি হিসেবে মনে করা হয়, অন্যরা ছিলেন গায়ক। প্রাপ্ত পুথির ভিত্তিতে ময়নামতী-গোপীচন্দ্রের গানের তিনজন কবির সন্ধান পাওয়া যায় দুর্লভ মল্লিক, ভবানী দাস ও সুকুর মহম্মদ। দুর্লভ মল্লিকের কাব্যের নাম গোবিন্দচন্দ্র গীত; সম্পাদনা করেন শিবচন্দ্র শীল। নলিনীকান্ত ভট্টশালীর সম্পাদনায় ভবানী দাসের ময়নামতীর গান এবং সুকুর মহম্মদের গোপীচাঁদের সন্ন্যাস কাব্যদুটি ঢাকা সাহিত্য পরিষৎ থেকে প্রকাশিত হয়।  [জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়]