ধাতুশিল্প

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১০:০৮, ২০ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

ধাতুশিল্প  একটি ব্যবহূত শব্দ যা বিশেষ কোন ধাতু দ্বারা দ্রব্য তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ধাতু একটি রাসায়নিক উপাদান এবং শিল্প হল একটি পেশাভিত্তিক কাজ যার জন্য প্রয়োজন নির্দিষ্ট ধরনের কাজের ওপর দক্ষতা। ঐতিহাসিকভাবে, বিশেষ করে মধ্যযুগ বা তারও পুর্বে এ শব্দটি ব্যবহূত হতো নির্দিষ্ট একটি জনগোষ্ঠির ক্ষেত্রে যারা ধাতু দ্বারা বিভিন্ন ব্যবহারযোগ্য দ্রব্য হাতে তৈরি করত। ধাতুর ওপর খোদাই করে দ্রব্য তৈরির শিল্প প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত হয়ে আসছে।

প্রাচীন যুগ  বাংলায় ধাতুর ব্যবহার শুরু হয়েছে তাম্রপ্রস্তর যুগে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে। তবে ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে লোহার ব্যবহার ভালভাবেই শুরু হয়েছিল। প্রাচীন যুগে বাংলায় তামা ও এর ধাতু সংকর এবং লোহা ব্যাপকভাবে এবং সোনা ও রূপা সীমিতভাবে ব্যবহূত হয়েছে।

তামা ও এর ধাতু সংকর  তাম্রপ্রস্তর যুগের শুরু থেকেই তামার ব্যবহার শুরু হয়েছে। তাম্রপ্রস্তর যুগের শেষ পর্বের বিশ্লেষিত বস্ত্ততে ধাতু সংকরণের নজির পাওয়া গিয়েছে। ছাঁচে ঢালাই এবং পরে পেটাই করে ছোটখাট তামার জিনিসপত্র বানানো হতো। ঐ সময়ে তামার সঙ্গে রাং বা টিনের মিশ্রণ করে সংকর ধাতু বানানো শুরু হয়।

ব্রোঞ্জের ঘন্টা, ময়নামতী

তবে সঠিক প্রকৌশল জানা না থাকায় ঐ সংকরে টিনের তারতম্য লক্ষ করা যায়। ধাতুবিদ্যার পরিভাষায় এ সংকরকে ‘আলফা ব্রোঞ্জ’ বলা হয়। যে সমস্ত ধাতব প্রত্নবস্ত্ত পাওয়া গিয়েছে সেগুলির মধ্যে আছে বালা, কানের মাকড়ি, আংটি, মাছধরার বড়শি ইত্যাদি। তাম্রপ্রস্তর যুগের যেসব ব্রোঞ্জের সামগ্রী পান্ডুরাজার ঢিবি, বাহিরি, ভরতপুর, ডিহর ও মঙ্গলকোট উৎখনন থেকে পাওয়া গিয়েছে, সেখানে টিনের পরিমাণ কমবেশি শতকরা ৯-১১ ভাগ। আদি ঐতিহাসিক পর্বে অধিক মাত্রায় টিনযুক্ত (শতকরা প্রায় ২২.৫ ভাগ) কাঁসার ব্যবহার জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ধাতুবিদ্যার পরিভাষায় এ সংকরকে ‘বিটা ব্রোঞ্জ’ বলা হয়। এ ব্রোঞ্জে নির্মিত বস্ত্ত ঢালাই-এর পর জলে ডুবিয়ে ঠান্ডা করে পালিশ করলে দেখতে তা সোনার মতো হয়। বাংলা থেকে আমদানি করা এ ধাতুতে নির্মিত জলের কলসের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে থাইল্যান্ডের ‘ব্যান-ডন-তা-পেট’-এর উৎখননে। ঐ কলস বা ঘড়া ভঙ্গুর হলেও সোনালি রং-এর জন্য সমাজে খুবই চাহিদাসম্পন্ন ছিল। এ টিনযুক্ত ব্রোঞ্জ-এর দর্পণ চন্দ্রকেতুগড়মহাস্থানএ পাওয়া গিয়েছে। ছাঁচে ঢালা তাম্র মুদ্রার ব্যবহার মৌর্য যুগ থেকেই শুরু হয়েছিল। পিতলের ব্যাপক ব্যবহার হয় পাল-সেন যুগে। টিনযুক্ত কাঁসার বাসন ও অন্যান্য সামগ্রী বাংলার ধাতুশিল্পের বৈশিষ্ট্য।

শেরশাহ-এর পিতল নির্মিত কামান (১৬-শতক), ময়নামতী

লোহা  বাংলায় লোহার ব্যবহার শুরু হয় তাম্রপ্রস্তর যুগের শেষ পর্বে। আদি ঐতিহাসিক পর্বে লোহা ব্যাপক পরিমাণে নির্মিত হতো। শিল্প বাণিজ্যসহ একটি পূর্ণাঙ্গ বৃদ্ধির নজির এ পর্বে লক্ষ্য করা যায়। প্রাথমিক লোহা নির্মাণের নজির পান্ডুরাজার ঢিবি, বাহিরি, হাটইকড়া, মঙ্গলকোট প্রভৃতি স্থানে দেখা গেছে। লোহার সঙ্গে অঙ্গার বা কার্বনের সংযোজনকে বলা হয় কার্বুরাইজেশন বা অঙ্গারীকরণ। এভাবে লোহা ইস্পাতে পরিণত হয়। এ পদ্ধতি যদিও অতি প্রাচীনকালেই আয়ত্ত হয়েছিল তবে নির্দিষ্টভাবে ঠান্ডা করা ও পান দেওয়ার নজির পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব তিন শতকে পান্ডুরাজার ঢিবি থেকে। কামাররা অঙ্গারীকৃত উত্তপ্ত লোহার হাতিয়ারকে গনগনে লাল অবস্থা থেকে হঠাৎ জলে ডুবিয়ে ঠান্ডা করলে তা খুবই শক্ত হলেও ভঙ্গুর হতো। এ ভঙ্গুরতা অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা যেত পুনরায় উষ্ণ করে। শেষোক্ত অবস্থাকে ‘টেম্পারিং’ বা পান দেওয়া বলা হয়। তবে এ হঠাৎ ঠান্ডা করে পরে পান দেওয়া হতো সেসব হাতিয়ারকেই যেগুলির বেশি ধার প্রয়োজন ছিল। এ মসৃণ ধার করার জন্য পাথরের ব্লকে ঘষে নেওয়া হতো। লোহা বানানো, আকার দেওয়া এবং তাপ প্রক্রিয়ার সঠিক প্রয়োগ এ সময়েই আয়ত্ত হয়েছিল। বিভিন্ন ধরনের লোহার অবস্থিতি থেকে বোঝা যায়, কামারেরা ধাতুর ধর্ম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল। হাতিয়ারের বিভিন্ন ধরন থেকে আমজনতার চাহিদা ও তা পূরণ করার কথা অনুমান করা যায়।

দৈনন্দিন জীবনে ধাতুর ব্যবহার  মঙ্গলকোটের উৎখননে তাম্রপ্রস্তর স্তরে মাছ ধরার বড়শি, আংটি ও কিছু বালাও পাওয়া গেছে। লৌহ যুগে (তৃতীয় পর্ব) বালা, রিং, মাল্যদানা ইত্যাদি এবং আদি ঐতিহাসিক পর্বে তামার প্রাচুর্য লক্ষণীয়। তামার ছুঁচ, জামবাটির ভাঙ্গা টুকরো, সর্পিল বালা ইত্যাদি এবং প্রচুর ছাঁচে ঢালা তাম্র মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে।

তামার বা এর সংকর থেকে বানানো গহনা উত্তর ভারতীয় ব্ল্যাক পলিশড্ সামগ্রীর (এনবিপি) সময় এবং আদি ঐতিহাসিক পর্বে খুব জনপ্রিয় ছিল। তবে তাদের স্বল্পতা থেকে অনুমান করা যায় সমাজে এর প্রাচুর্য ছিল না। গহনাগুলি হচ্ছে বাজু, মাল্যদানা, বালা, কানের গহনা, আংটি, চুলের কাটা ইত্যাদি।

লোহার তৈরি ধাতুর হাতিয়ার, মহাস্থানগড়

তামার সামগ্রী  তামা বা তামার সংকর দিয়ে বানানো বস্ত্তগুলি মূলত পাঁচ রকমের: (১) গহনা, (২) বাসন বা ঘরের ব্যবহূত বস্ত্ত, (৩) যন্ত্রপাতি, (৪) তাম্রভান্ডার ও (৫) ব্রোঞ্জের মূর্তি। তাম্রভান্ডার বা ‘কপার হোর্ড’ প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে খুবই বিভ্রান্তিমূলক বস্ত্ত। প্রায় সব হাতিয়ারই হঠাৎ করে পাওয়া। এ হাতিয়ারগুলির উৎস এবং পরবর্তী সময়ে এর উন্নয়নের সঠিক তথ্য এখনও নির্দিষ্টভাবে জানা যায় নি। দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গে কুশদ্বীপ, পরিহাটি, ভক্তাবাঁধ ইত্যাদি অঞ্চলে এ হাতিয়ারগুলি পাওয়া গিয়েছে।

গুপ্ত যুগ এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে হাজার হাজার ব্রোঞ্জের মূর্তি বা ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে। বিশেষ করে পাল যুগে ভাস্কর্য শিল্প চরম উৎকর্ষ অর্জন করেছিল। বাংলার সর্বত্র প্রাচীন জমি হস্তান্তরে বা দানে তাম্রপট্ট ব্যবহূত হয়েছে।

লোহার সামগ্রী  উৎখননে প্রাপ্ত পুরাবস্ত্ত থেকে লোহার ব্যাপক ব্যবহারের নজির পাওয়া যায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হচ্ছে কৃষিকার্যে ব্যবহূত কাস্তে।

চন্দ্রকেতুগড়ে প্রাপ্ত একটি পোড়ামাটির ফলকে দেখা যায়, ‘কৃষক একটি বড় আকারের কাস্তের সাহায্যে ধান কাটছেন’। চাষের কাজে আদি ঐতিহাসিক পর্বে কাস্তের জনপ্রিয়তা যে কতখানি তা সহজেই অনুমেয়। পান্ডুরাজার ঢিবি, মঙ্গলকোটে লাঙলের ফলার সঙ্গে কাস্তেও পাওয়া গিয়েছে।

তীর ও বল্লম

তীর এবং বল্লমের ফলা বাংলার সবকটি প্রত্নস্থলেই পাওয়া গিয়েছে। উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলে বল্লমের ফলা ও লোহার পিন্ড পাওয়া গিয়েছে। শিরযুক্ত ও ফাঁপা তীরের ফলা ও ভাঙ্গা তরবারির নজির পাওয়া যাচ্ছে পান্ডুরাজার ঢিবি থেকে। আদি ঐতিহাসিক পর্বে অন্যান্য লোহার জিনিসগুলি হচ্ছে সূচক, আল, ছেনি, ছুরি, ছোরা, পেরেক ও গজাল। ময়নামতী থেকেও এ সমস্ত হাতিয়ার পাওয়া গিয়েছে।

লোহা নির্মাণের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব এ অঞ্চলের আদিবাসীদের। সমগ্র পূর্ব ভারতবর্ষের লৌহ শিল্প প্রসারে আদিবাসীদের উদ্ভাবিত লোহা বানাবার পদ্ধতি আবিষ্কারই ছিল মূল চালিকা শক্তি। মাটির উপরে অগভীর গর্ত করে মাটি দিয়ে লেপে লোহার খনিজ ছোট ছোট টুকরা করে কাঠ কয়লার সঙ্গে মিশিয়ে মাটি ও কাঠ কয়লা দিয়ে ঢেকে চুল্লি বানিয়ে হাপর-এর সাহায্যে হাওয়া দেওয়া হতো। কাঠ কয়লার অাঁচে লোহার খনিজ বিজারিত হয়ে লোহার ফাঁপা পিন্ডে পরিণত হতো। চুল্লির উপরিভাগটি ভেঙ্গে ফেলে ঐ ফাঁপা পিন্ডটি বের করে নিয়ে আবার গরম করে হাতুড়ির সাহায্যে পেটাই করে ঘন লোহায় পরিণত করে প্রয়োজনীয় জিনিস তৈরি করা হতো।

সোনা ও রূপা  এনবিপি স্তরে এ দুটি মূল্যবান ধাতু ছিল বিরল। এ থেকে মনে হয় যে, এ পর্বে এগুলির অনুপস্থিতি ছিল। তবে আদি ঐতিহাসিক পর্বে এ দুটি ধাতু ক্ষুদ্র অলংকার ও মুদ্রা তৈরিতে ব্যবহূত হয়েছে।

ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রা বাদ দিলে বাণগড়ের উৎখননে আদি ঐতিহাসিক পর্বে সোনার কবচ ও লকেট বা পেনডেন্ট পাওয়া গিয়েছে। রূপার একটি ছোট রডও বাণগড় থেকে পাওয়া গিয়েছে। খুব সম্ভবত এটি অলংকার নির্মাণের কাঁচামাল। চন্দ্রকেতুগড়ে ভূমিপৃষ্ঠ অনুসন্ধানে রূপার তৈজসপত্র পাওয়া গিয়েছে। পান্ডুরাজার ঢিবির উৎখননে সোনা গলাবার পোড়ামাটির মুচি এবং এর সঙ্গেই সোনার একটি চ্যাপ্টা মাল্যদানা ও পুঁতি পাওয়া গিয়েছে। ময়নামতী-লালমাই অঞ্চলে প্রচুর সোনা, রূপা ও ব্রোঞ্জের অলংকার পাওয়া গিয়েছে।

রূপার দন্ড, ময়নামতী

রূপার বাণিজ্য  বাংলায় রূপা পাওয়া গেছে খুবই কম। মৌর্যযুগ থেকে পুন্ড্রনগর রূপার অন্যতম বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। উত্তর ব্রহ্মদেশ এবং ইউনান থেকে রূপা আমদানি করা হতো।

গুপ্তদের পতনের পর সমতট বর্ধিষ্ণু হয় এবং আরাকানের সঙ্গে রূপার বাণিজ্যে যুক্ত হয়। বাংলাদেশের হরিকেলের রূপার মুদ্রা সেখানে আমদানিকৃত রূপার ব্যবহার হত-এ তথ্যটি নির্দেশ করে। [প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়]

আধুনিক যুগ  ধাতু শিল্পকে (আধুনিক) বাংলাদেশে ছয়টি প্রধান শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। যেমন, লৌহ শিল্প, কাঁসা শিল্প, পিতল বা তাম্র শিল্প, স্বর্ণ শিল্প, রৌপ্য শিল্প এবং অলঙ্কার শিল্প। লোহার কাজের সঙ্গে সম্পৃক্তদের কামার, কাঁসা বা তামার কাজের সঙ্গে সম্পৃক্তদের কাংস্যকার বা কাঁসারু,স্বর্ণ ও রৌপ্যের জিনিস তৈরির কারিগরদের স্বর্ণকার এবং যে কোন ধরণের ধাতুর ওপর আলঙ্কারিক বা শোভাবর্ধনের কাজের কারিগরদের নকশি বা খোদাই শিল্পি বলা হয়ে থাকে।

অলঙ্কার ও পদক ব্যতীত অন্য কিছু তৈরিতে স্বর্ণ খুব কমই ব্যবহূত হয়। অবশ্য অলঙ্কার, রূপার থালা এবং ঝালর তৈরির কাজসমূহ রূপার কাজের অন্তর্ভুক্ত। ঝালর তৈরির কাজের জন্য ঢাকার স্বর্ণকার ও রৌপ্যকার এক সময় খুবই বিখ্যাত ছিল। বিশ শতকের গোড়ার দিকে তাদের এ খ্যাতি বিলুপ্ত হয়। আনুমানিক দশ বছর পূর্বে রৌপ্য ঝালরের প্রচলন পুনরায় শুরু হয়। যদিও সেই পুরাতন গৌরব ফিরে আসতে সময় লাগবে তবুও বর্তমানে ঝালরের এ পুন:প্রচলন পূর্ববর্তী কারিগরদের দক্ষতার বহু নিদর্শন রাখছে।

ধাতব পাত্রের কারুকাজ

ধাতু শিল্প তিনটি সনাতনী পদ্ধতির ধাতব কার্য পদ্ধতির ওপর প্রতিষ্ঠিত;  (১) পিটাইকার্য (২) ঢালাইকার্য (৩) ছাঁদের কার্য। পিটাই কার্য, ঢালাই কার্য এবং ছাঁদের কার্যকে পর্যায়ক্রমে কামারের কাজ, ছাঁচে ঢালাই কাজ এবং ঝালাইয়ের কাজ বলা হয়ে থাকে। পিটাই কার্য করা হয় ধাতুকে তাপ প্রয়োগ করে তাকে পিটিয়ে, ঢালাই কার্য করা হয় গলিত ধাতুকে শক্ত বা কঠিন করে এবং ছাঁদের কার্য করা হয় টুকরো ধাতু তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবহার উপযোগী পূর্ব প্রস্ত্ততকৃত ধাতুর পাতের ওপর।

সাধারণভাবে সকল ধাতু শিল্পিই পিটানো পদ্ধতি ব্যবহার করে। কামারের বা কর্মকারের কাজের পাঁচটি প্রধান ধারা আছে: (১) লৌহ কর্মকার, (২) কাঁসা কর্মকার (৩) তাম্র কর্মকার (৪) রৌপ্য কর্মকার এবং (৫) স্বর্ণ কর্মকার।

স্বর্ণকার ও রৌপ্যকার পিটানো পদ্ধতির সাথে অলঙ্করণ পদ্ধতি ও ব্যবহার করে থাকে। গৃহস্থালীর সামগ্রী তৈরিতে পিটানো পদ্ধতির অধিক ব্যবহার হয়। ধাতুকে গলিয়ে পুঞ্জীভূত করা হয় এবং পূর্ব প্রস্ত্ততকৃত ছাঁচে ঐ গলিত ধাতুকে ঢেলে ঠান্ডা ও শক্ত করে ঢালাই কার্য করা হয়।

তাম্র কর্মকার

দুই ধরনের ছাঁচ ঢালাই পদ্ধতি আছে। কঠিন ছাঁচে ঢালাই কাজ এবং ফাঁপা ছাঁচে ঢালাই কাজ।যখন সম্পূর্ণ ছাঁচটি গলিত ধাতু দ্বারা পূর্ণ হয়ে যায় তখন এটি একটি শক্ত ধাতব বস্ত্ততে রুপান্তরিত হয়। যদি ঢালাইকৃত বস্ত্তটির ভেতরে কোন ফাঁপা অংশ থাকে তাহলে একটি শক্ত শাঁস খন্ডের প্রয়োজন পড়ে। ছাঁচে ঢালাইয়ের তিনটি পদ্ধতি আছে (১) উন্মুক্ত পাত্রে ছাঁচ ঢালাই পদ্ধতি (২) লস্ট-ওয়াক্স ছাঁচ ঢালাই পদ্ধতি এবং (৩) বালু ছাঁচ ঢালাই পদ্ধতি। ঢাকা জেলার ধামরাই অঞ্চলে কাঁদামাটির জোড়া ছাঁচ ব্যবহার করে উন্মুক্ত পাত্রে ছাঁচ ঢালাইয়ের কাজ ব্যাপকভাবে হয়ে থাকে। ওয়াক্স বা মোম ছাঁচ ঢালাই পদ্ধতির ব্যবহার ধামরাই ও ঢাকার লালবাগ এলাকায় বেশি দেখা যায়। বালু ছাঁচ ঢালাই পদ্ধতিটি আঠারো শতকের নতুন একটি উদ্ভাবন হিসেবে চিহ্নিত। বালু ছাঁচ ঢালাই পদ্ধতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, ছাঁচগুলি স্থায়ী বা ক্ষণস্থায়ী উভয় ধরনের হয়ে থাকে। ঢাকা শহরের লালবাগের শিল্পশালায় বালু ছাঁচ ঢালাই পদ্ধতিতে বালুর বিকল্প হিসেবে কালো মাটি ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে এটি একটি নতুন উদ্ভাবন। সাধারণত এই ছাঁচ ঢালাই পদ্ধতি প্রতিকৃতি, বাতি এবং খেলনা তৈরিতে ব্যবহূত হয়। ঝালাই কাজ এমন একটি পদ্ধতি যেখানে ধাতব পাত দিয়ে বস্ত্ত সামগ্রী প্রস্ত্তত করা হয়।

কাঁসা কর্মকার

কর্মকার এবং ছাঁচে ঢালাই কাজের সহযোগী জন্য সাতটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ: (১) ধাতুপিন্ড বা পুনর্ব্যবহার যোগ্য ধাতব পদার্থ, (২) তেল, (৩) চুল্লি বা অগ্নিকুন্ড, (৪) বাতাস, (৫) ধাতু গলানোর পাত্র, (৬) পানি ভর্তি পাত্র এবং (৭) যন্ত্রপাতি। ধাতুপিন্ড হল ধাতুর সূতপ, যেমন: কপার, টিন, রূপা অথবা স্বর্ণ, যা ব্লকে বা ছাঁচে ঢালাই, মোড়ানো অথবা পরবর্তীতে তাপ দেয়া হয়। পুনব্যবহারযোগ্য ধাতরু উৎস প্রধানত তিনটি- গৃহস্থালীর জঞ্জাল, কলকারখানা এবং ভাঙ্গা জাহাজের পরিত্যক্ত অংশ বিশেষ থেকে সংগৃহীত ধাতু।

চুল্লির মাধ্যমে তাপ প্রয়োগ করার জন্য সাধারণত ব্যবহূত হয় লৌহ শলাকা ও বেলচা বা কোদাল সদৃশ্য বস্ত্ত।

লৌহ শলাকা হচ্ছে একটি ধাতব দন্ড যার দ্বারা আগুন নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় উদ্দীপ্ত করা হয়। বড় অস্ত্রের ফলার সঙ্গে হাতল সম্বলিত যন্ত্রকেই বেলচা বলে যা মুক্ত বস্ত্ত তুলতে এবং নিক্ষেপ করতে ব্যবহূত হয়। কর্মকারের কাজের প্রধান হাতিয়ার বা যন্ত্রপাতি হচ্ছে নেহাই, হাতুড়ি, গোঁজ, টুকরোখন্ড বা বাটালি এবং বিভিন্ন আকৃতির মুখ সম্বলিত সাঁড়াশি। আরও অনেক ধরনের দন্ডাকৃতির যন্ত্রপাতি আছে যা ধাতুকে আকৃতিতে আনার জন্য ধাতু শিল্পীরা ব্যবহার করে থাকে। ধাতুর উপরিভাগকে সমান অথবা মসৃণ করার কাজে এগুলি ব্যবহূত হয়।

ছাঁচ ঢালাইয়ের কাজ

বর্তমানে এবং সাধারণভাবে ধাতব শিল্পে যে সমস্ত কলা কৌশল বা পদ্ধতি ব্যবহূত হয়ে থাকে সেগুলো হলো (১) ধাতু বা অন্য কোন কঠিন পদার্থের উপর নকশা খোদাই, (২) খোদাই কর্ম, (৩) ছাপাঙ্কৃত বা খোদাইকৃত নকশা, (৪) চিত্র শোভিত বা বুটি দ্বারা খচিত, (৫) ধাতব প্লেটে ছবি অাঁকতে সুচ এবং এসিড ব্যবহার করে ছবি অাঁকা, (৬) ছেদন / বিচ্ছিন্ন করা, (৭) কাঠ বা ধাতুর উপর নকশা, (৮) কোনো সূচাগ্র জাতীয় বস্ত্তর সাহায্যে বিদ্ধ করা বা ভেদ করা এবং (৯) স্বর্ণ ও রূপার ঝালরের কারুকার্য বিশেষ।

ধাতু শিল্প ও শিল্পীর দক্ষতার মধ্যে শক্তিশালী যন্ত্র ব্যবহারের পরিবর্তে মানুষের সৃষ্টিশীল ক্ষমতাকে প্রতিফলিত করা ছাড়াও, বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক শ্রেণির মানুষের রুচি ও চাহিদার ধরণও প্রকাশ করে থাকে। অতীতে শাসক এবং অভিজাত শ্রেণির বিলাস সামগ্রী এবং ধর্মীয় ও পার্থিব ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ধাতু শিল্পজাত দ্রব্য তৈরি হতো। বর্তমানে সব স্তরের মানুষের ব্যবহারের জন্য ধাতুর সামগ্রী তৈরি করা হয়ে থাকে। ধর্মীয় এবং পার্থিব চাহিদা যদিও অপরিবর্তিতই আছে, তথাপি ধাতব সামগ্রী নানারকম চাহিদা পূরণে বিভিন্নভাবে প্রস্ত্তত ও ব্যবহূত হচ্ছে।  [ফিরোজ মাহমুদ]