দেউলবাড়ি

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২১:৪৫, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

দেউলবাড়ি  কুমিল্লা জেলার একটি ঐতিহাসিক স্থান। দেউলবাড়ি শাব্দিক অর্থে মন্দিরস্থল বোঝায়। নলিনীকান্ত ভট্টশালী এর ঐতিহাসিক আবিষ্কারের ফলে এ স্থানটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিশ শতকের গোড়ার দিকে একটি প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ ভেঙ্গে ফেলার সময় এ আবিষ্কারের কাজ সম্পন্ন হয়।

দেউলবাড়ি আসলে একটি গ্রাম নয়; এটি চৌদ্দগ্রাম উপজেলাধীন ৩ নং কালিকাপুর ইউনিয়নের বৃহৎ গ্রাম ধর্মপুরের একটি পাড়া বা অংশ। গ্রামটি কুমিল্লা হতে ২২ কি.মি. দক্ষিণে, চৌদ্দগ্রাম হতে ১০ কি.মি. উত্তরে এবং কুমিল্লা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে প্রায় দেড় মাইল পূর্বে ত্রিপুরা রাজ্যের ভারত সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত।

এলাকায় বা সরকারের রাজস্ব বিভাগের সেটেলমেন্টের কাগজপত্রে এখন আর দেউলবাড়ির কোনো ভৌগোলিক অবস্থান নেই। ধর্মপুর গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে পুরানো মন্দিরকে কেন্দ্র করে যে একটি ক্ষুদ্র বসতি কালক্রমে গড়ে উঠেছিল, ভারত বিভাগকালে হিন্দু অধিবাসীদের দেশত্যাগের ফলে তার বিলুপ্তি ঘটে। সম্পূর্ণ এলাকাটি বর্তমানে আবাদি জমিতে পরিণত হয়েছে। পুরানো বাড়িঘরের চিহ্নও নেই। সৌভাগ্যক্রমে স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠান ‘দেউলবাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়’-এর মাধ্যমে ঐতিহাসিক নামটি এখনও বেঁচে আছে। মন্দিরের দেবোত্তর সম্পত্তি বর্তমান সেবায়েত এর তত্ত্বাবধানে রক্ষিত।

দেউলবাড়িতে প্রাপ্ত ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলির মধ্যে রয়েছে: (ক) বর্তমানে ঢাকার জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত ১৫.২৪ সে.মি উঁচু একটি ক্ষুদ্রাকৃতির সূর্যমূর্তি; (খ) ৭ম-৮ম শতকের লিপিতে উৎকীর্ণ গৌরীপট্টসহ কয়েকটি অষ্টধাতু নির্মিত লিঙ্গ; (গ) হিন্দুদেবী দুর্গার ষোলটি নামের অন্যতম সর্বাণীর উৎকীর্ণ মূর্তি।

সূর্যমূর্তিটি নিঃসন্দেহে পূর্ব ভারতীয় শিল্পের এক উল্লেখযোগ্য নমুনা। অবশ্য সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হচ্ছে ক্ষোদিত সর্বাণী মূর্তি। ৫০.৮ সে.মি দীর্ঘ অষ্টধাতু নির্মিত এ মূর্তির ঢালাই কাজ নিম্নমানের এবং অনেকটা স্থূল ও ভারি। এর নির্মাণকৌশল খুবই স্থূল এবং ভঙ্গিটি অনমনীয়। অষ্ট বাহুবিশিষ্ট এ দেবীর আরোপিত গুণাবলি দুর্গারই অনুরূপ। একমাত্র পার্থক্য হচ্ছে বামদিকের একটি হাতে তর্জনী মুদ্রার স্থলে সর্বাণীর রয়েছে একটি ঘণ্টা। কিন্তু এ মূর্তির প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে খড়গরানী প্রভাবতী কর্তৃক এর পাদমূলে উৎকীর্ণ সংক্ষিপ্ত ঐতিহাসিক বিবরণ। এটি থেকে মূর্তিটিকে দেবী সর্বাণীর বলে স্পষ্টরূপে ও নির্দিষ্টভাবে প্রমাণিত হয় এবং ধারণা করা যে রানী স্বয়ং মূর্তিটিকে সোনার পাত দিয়ে মুড়িয়ে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। এটি পূর্ব ভারতে অদ্যাবধি প্রাপ্ত এ ধরনের একমাত্র মূর্তি (অবশ্য প্রায় একই ধরনের একটি মূর্তি সাম্প্রতিককালে ময়নামতীতে আনন্দবিহার খননকালে পাওয়া গিয়েছে)। এ বিবরণের আরও গুরুত্ব এ যে, এতে খড়গ বংশের বংশলতিকা উৎকীর্ণ আছে, যা দেবখড়গের আশরাফপুর ধাতুলিপিতে প্রাপ্ত একমাত্র প্রমাণকে সমর্থন করে।

রানী স্বয়ং মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কিনা তা জানা যায় না। কিন্তু তার প্রিয় দেবীর প্রতিমা প্রতিষ্ঠার জন্য স্থানটি তার ভালোভাবে জানা এবং সুপরিচিত ছিল। রাজধানীতে তার বাসভবন রাজপ্রাসাদ থেকে এ স্থান সম্ভবত খুব দূরে ছিল না। অতএব, দেউলবাড়ি বিস্মৃত খড়গ রাজধানীর অবস্থান নির্ণয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হিসেবে কাজ করতে পারে, অবশ্য যদি পরবর্তী কালের ধ্বংসাবশেষের নিচে চাপা পড়ে কোনোরূপে তা টিকে থেকে থাকে।

এ লিপির মাধ্যমে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রকাশ পেয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাণী কর্তৃক হিন্দু দেবীর প্রতিমা প্রতিষ্ঠা কেবল ব্যাপক ধর্মীয় সহিষ্ণুতারই নয়, প্রাচীন বাংলায় অপরাপর ধর্মের দেবদেবীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের আরও একটি প্রমাণ। দেউলবাড়ির ভূপৃষ্ঠে কোনো প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ এখন আর দৃশ্যমান না হলেও নিকটবর্তী এলাকাগুলিতে পুরাতাত্ত্বিক গুরুত্বের কিছু সন্ধান পাওয়া গেছে।

দেউলিবাড়ির ঠিক পূর্বদিকে চুকুয়া গ্রামে একটি প্রাচীন মন্দির, একটি রাজবাড়ি ও চারটি বৃহৎ পুরানো পুকুর রয়েছে। মাটির উপর পুরানো ইট, ইটের টুকরা, মাটির তৈরি তৈজসপত্র প্রভৃতি পাওয়া গেছে। এলাকার সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত প্রাচীন স্থল হচেছ দেউলবাড়ির প্রায় ৩.২২ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত এবং বর্তমানে একটি আধুনিক কবরস্থান দ্বারা ব্যাপৃত জামমুড়া নামক এক বিশাল পুরানো ঢিবি। ইট চোর ও কবর খননকারীদের হাতে এ ঢিবিটি বিধ্বস্ত ও বিকৃত হয়েছে এবং তা অনেকটা সমতল করা হয়েছে। জঙ্গলে আচ্ছাদিত ভূ-পৃষ্ঠে পুরানো ইট, ইটের টুকরা, মৃৎপাত্র প্রভৃতি এখনও বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো ছিটানো অবস্থায় পাওয়া যায়। এ ঢিবিতে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে বলে ব্যাপক ধারণা প্রচলিত আছে যা খড়গদের লুপ্ত রাজধানীর অবস্থান শনাক্তকরণে সূত্র সরবরাহ করতে পারে।  [এম. হারুনুর রশিদ]