দূরশিক্ষণ

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২১:৪৪, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

দূরশিক্ষণ এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে যে কোনো পর্যায়ের এবং বয়সের শিক্ষার্থী ঘরে বসে অথবা কর্মস্থলে বসে শিক্ষার সুযোগ লাভ করে থাকে। দূরশিক্ষা সম্পর্কে নানাবিধ সংজ্ঞা প্রচলিত আছে। তবে যে সংজ্ঞা সর্বজনগ্রাহ্য, তা হলো এটি এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা যেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে একটি দূরত্ব বিরাজ করে। এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয় একটি শিক্ষা সংগঠন যার উদ্দেশ্য হচ্ছে যোগাযোগ বা গণমাধ্যম ব্যবহারের দ্বারা শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর মধ্যে উভয়মুখী যোগাযোগের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। এসব বৈশিষ্ট্যের মধ্যে উভয়মুখী যোগাযোগের উপর গুরুত্ব প্রদানই হচ্ছে মুখ্য যেমন কম্পিউটার ও কম্পিউটার ব্যবহারকারীর মধ্যে নিরন্তর দ্বি-পাক্ষিক তথ্য বিনিময় এমন মিথস্ক্রিয়া সম্ভব করে তোলে। দূরশিক্ষণ মুদ্রিত উপকরণ, অডিও-ভিডিও উপকরণ, কম্পিউটার এবং অন্যান্য প্রযুক্তির মাধ্যমের দ্বারা ছাত্র ও শিক্ষকের সংযোগ ঘটায়।

১৯৫৭ সালে শিক্ষা পুনর্গঠন কমিশন পরীক্ষামূলক একটি দূরশিক্ষণ স্কুল (Correspondence School) স্থাপনের সুপারিশ করে যার দ্বারা নিয়মিত শ্রেণিকক্ষে যেতে পারেনা অথচ শিক্ষালাভে আগ্রহী এমন শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেওয়া যায়। এরপর থেকে বিভিন্ন দূরশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের সৃষ্টি হতে থাকে। শিক্ষা অধিদপ্তর দূরশিক্ষণের ভিত্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে ২০০ রেডিও সেট বিতরণ করে। ১৯৬২ সালে প্রথম একটি অডিও-ভিডিও কোষ এবং পরবর্তীকালে অডিও-ভিডিও শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। ১৯৮০ সালে পাইলট প্রকল্প হিসেবে একটি বিদ্যালয় সম্প্রচার অনুষ্ঠান (School broadcasting programme) চালু করা হয়। ১৯৮৩ সালে এ দুটি দূরশিক্ষণ শিক্ষাকেন্দ্রকে একীভূত করে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন মিডিয়া অ্যান্ড টেকনোলজি (NIEMT) গঠন করা হয়। ১৯৮৫ সালে স্থাপিত হয় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডিসট্যান্স এডুকেশন বা বাইড (BIDE)। পরবর্তীকালে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন মিডিয়া অ্যান্ড টেকনোলজি এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডিসট্যান্স এডুকেশন একীভূত হয় এবং শিক্ষা কার্যক্রম চলতে থাকে। অডিও-ভিডিও উপকরণ তৈরি ও বিতরণ ছাড়াও বাইড দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে বি.এড কর্মসূচি চালু করে। এ সময় মিল্টন কিন্সে (Milton Keynes) ব্রিটিশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে একটি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের চিন্তাভাবনা শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে ব্রিটিশ বৈদেশিক উন্নয়ন সংস্থার (ODA) আর্থিক সহায়তায় এ ধরনের একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ১৯৮৮ সালের অক্টোবরে পুনরায় ওডিএ-র সহায়তায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন ও  বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন-এর প্রতিনিধি সমন্বয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের টিম গঠন করা হয়। এই টিম ভারত, পাকিস্তান  থাইল্যান্ড ও যুক্তরাজ্য সফর করে। ১৯৮৯ সালে যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। একইসঙ্গে সরকারের আমন্ত্রণে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের একটি মিশন বাংলাদেশে আসে। পরবর্তীকালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহযোগিতায় আরেকটি সম্ভাব্যতা-সমীক্ষা পরিচালিত হয় এবং এ প্রকল্পে সরকার ও ব্যাংক যৌথভাবে অর্থায়নের জন্য বাংলাদেশ সরকার ও এডিবি-র মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৯২ সালে সংসদে একটি আইন পাসের মাধ্যমে বাংলাদেশ ওপেন ইউনিভার্সিটি বা উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (বাউবি) প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বাইডকে একই সময়ে উম্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একীভূত করা হয়।

প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মধ্যেই বাউবি ১৮টি আনুষ্ঠানিক ও ১৯টি অনানুষ্ঠানিক কর্মসূচির আওতায় ৩০০-এর বেশি কোর্স চালু করেছে। আরও বহু কোর্স চালুর প্রক্রিয়া চলছে। কর্মসূচিগুলি কার্যকরভাবে পরিচালনার জন্য ৬টি অনুষদ/স্কুল এবং ১২টি প্রশাসনিক বিভাগ স্থাপিত হয়েছে। শিক্ষা কার্যক্রমে সহায়তা প্রদানের উদ্দেশ্যে ১২টি আঞ্চলিক ও ৮০টি স্থানীয় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দূরশিক্ষণ পদ্ধতি যদিও শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার আওতাভুক্ত নয়, তথাপি বাউবি শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য সারাদেশে এক হাজারেরও বেশি টিউটোরিয়াল কেন্দ্র স্থাপন করেছে। বেতার, টিভি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে শিক্ষাক্রমভিত্তিক অনানুষ্ঠানিক কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে।

দূরশিক্ষণ ব্যবস্থায় শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসূচি ও শিক্ষণ প্রক্রিয়া সনাতনী শিক্ষা পদ্ধতির চেয়ে পুরোপুরি ভিন্ন। একটি সনাতনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান করেন একজন শিক্ষক। অন্যদিকে দূরশিক্ষণে পাঠদান করে একটি প্রতিষ্ঠান। এ পদ্ধতিতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করতে সাহায্য নেওয়া হয় গণমাধ্যমের। দূরশিক্ষণে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মাঝে যে দূরত্ব বিরাজ করে তা পূরণ করা হয় গণমাধ্যমের সাহায্যে।

সনাতনী ব্যবস্থায় অর্ন্তমুখী শিক্ষাদান ও জ্ঞানার্জনই মুখ্য। দূরশিক্ষণে এ পদ্ধতি অনুপস্থিত। এ ব্যবস্থায় শিক্ষাদান ও জ্ঞানার্জনের বিষয়টিকে স্ব-শিক্ষণ পদ্ধতির উপযোগী করে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। এখানে সনাতনী শিক্ষা প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ থাকে না বললেই চলে। এ ছাড়া সনাতনী শিক্ষাব্যবস্থা যেমনি ব্যক্তিক, দূর শিক্ষাব্যবস্থা তেমনি নৈর্ব্যক্তিক। তাই দূরশিক্ষণ ব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থী সনাতনী বিদ্যা অর্জন প্রক্রিয়ার উপর নির্ভর করে না।

শিক্ষার যে কোনো স্তরে বা পর্যায়ে দূরশিক্ষণ ব্যবস্থা কার্যকর। দূরশিক্ষণ ব্যবস্থায় মুদ্রিত সামগ্রী, অডিও-ভিডিও, কম্পিউটার ইত্যাদি প্রযুক্তিগত মাধ্যম শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মিলিত করে জ্ঞানার্জনের পথ উন্মুক্ত করে। সনাতনী মুখোমুখী শিক্ষা ব্যবস্থায় এসব বিষয়ে সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

দূরশিক্ষণে ইলেকট্রনিক মাধ্যম একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যবহূত। ইতোমধ্যে যোগাযোগ ক্ষেত্রে গোটা বিশ্বে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হওয়ায় টেলিযোগাযোগ দূরশিক্ষণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠেছে। এ যোগাযোগ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে। দূরশিক্ষণে মাল্টিমিডিয়া প্রক্রিয়ার বিকল্প কিছু নেই। বাউবি ইতোমধ্যে একটি অত্যাধুনিক মিডিয়া সেন্টার স্থাপন করেছে। এ পদ্ধতিতে শিক্ষক, বেতার-টিভি প্রযোজক, সাংবাদিক, গণশিল্পী, কৃষি-স্বাস্থ্য-সমবায় কর্মীবৃন্দ, যুবসংগঠন, মহিলা সংগঠন, নগর ও গ্রাম পরিষদ এবং প্রশাসকগণ শিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। আধুনিক গণমাধ্যম প্রযুক্তির ব্যবহার জীবনব্যাপী শিক্ষার দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছে। এসব কর্মসূচিতে প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার শিক্ষার্থী আছে। এ সংখ্যা বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ছাত্রছাত্রীর চেয়ে বেশি। আশা করা হচ্ছে আগামী দশকে বাউবির ছাত্রসংখ্যা ৩ লাখ ছাড়িয়ে যাবে।

দেশব্যাপী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বাউবি মুদ্রিত উপকরণ, অডিও-ভিডিও ক্যাসেট, বেতার-টিভি অনুষ্ঠান এবং টিউটোরিয়াল সেবার ওপর নির্ভর করে থাকে। আঞ্চলিক ও স্থানীয় কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য বাউবির টেলিসম্মেলন (Teleconferencing) ইউনিট রয়েছে। কম্পিউটার সম্মেলন ও ভিডিও সম্মেলন ইউনিট স্থাপনেরও একটি পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে বাউবি সংবাদ মাধ্যম (প্রিন্ট মিডিয়া) এবং ইলেক্ট্রনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দূরশিক্ষণ বিস্তারের প্রত্যশা করছে। বাংলাদেশে উম্মুক্ত দূরশিক্ষণের চাহিদা ও প্রয়োজনের ব্যাপ্তি এখনও পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। একুশ শতকে দূরশিক্ষণের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে কেবল বাংলাদেশ উম্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর নির্ভর করলে চলবেনা। এ জন্য দেশের সনাতন বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকেও এগিয়ে আসতে হবে। তাদেরও উম্মুক্ত দূরশিক্ষণ চালু করা প্রয়োজন যাতে দ্বৈতমাধমে শিক্ষা প্রদান করা যায় এবং বহুমুখী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সমাজে ভূমিকা রাখা যায়।  [এম আমিনুল ইসলাম]