তাম্রলিপ্তি

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২১:২৭, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

তাম্রলিপ্তি প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য, সিংহলি গ্রন্থ এবং গ্রিক ভৌগোলিক ও চৈনিক তীর্থযাত্রীদের বিবরণে উল্লিখিত প্রাচীন মানব বসতিস্থল। এ সকল গ্রন্থ ও বিবরণ থেকে জানা যায় যে, পূর্ব উপকূলবর্তী তাম্রলিপ্তি গঙ্গা নদী যেখানে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে তার কাছে অবস্থিত ছিল। বিবরণসমূহে আরও উল্লেখ পাওয়া যায় যে, তাম্রলিপ্তি তৎকালীন বাণিজ্যপথের সঙ্গে যুক্ত ছিল এবং এখানে ব্যবসায়ী, পর্যটক ও তীর্থযাত্রীদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। এ সকল লিখিত উৎসের ভিত্তিতে তাম্রলিপ্তিতে মানববসতির কালসীমা মোটামুটিভাবে চতুর্থ/তৃতীয় খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে আট খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বলে নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীন বন্দর হিসেবে তাম্রলিপ্তির সর্বশেষ প্রমাণ বহন করছে আট শতকের উদয়মনের দুধপানি প্রস্তরলিপি। গ্রিক ভৌগোলিক টলেমীর মানচিত্রে ‘তমলিটিস্’ রূপে তাম্রলিপ্তির উল্লেখ রয়েছে। চৈনিক তীর্থযাত্রী হিউয়েন-সাং তাম্রলিপ্তি শহরকে ‘তান-মো-লি-তি’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

এসকল লিখিত উৎসগুলির ভিত্তিতে পন্ডিতগণ তাম্রলিপ্তিকে আদি ঐতিহাসিক ভারতের ব্যবসায়-বাণিজ্যের একটি অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে শনাক্ত করেন। উৎসগুলি সূত্রে আরও বিশ্বাস করা হয় যে, তৎকালে একটি সমৃদ্ধিশালী নগরকেন্দ্র হিসেবেও তাম্রলিপ্তির উত্থান ঘটে এবং এর সাথে জল ও স্থলপথে দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কিছু অঞ্চলের সংযোগ ছিল।

যদিও এ বন্দর নগরীর সঠিক শনাক্তকরণ সম্পর্কে পন্ডিতদের মধ্যে মতবিভেদ রয়েছে তথাপি তাঁরা মোটামুটি একমত যে, বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর (প্রাচীন যুগে মিধুনাপুর নামে পরিচিত) জেলার তমলুক শহরই ছিল প্রাচীন তাম্রলিপ্তি নগরস্থল। বর্তমান শহরটি বঙ্গোপসাগরের কাছে রূপনারায়ণের তীরে অবস্থিত।

স্থানটিতে কমপক্ষে দুবার প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজ চালানো এবং বেশ কয়েকবার প্রত্নসম্পদের সন্ধান করা হয়েছে। বিখ্যাত বাঙালি কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত-এর বন্ধু আই.সি.এস গৌড়দাস বসাক হচ্ছেন প্রথম ব্যক্তি যিনি আঠারো শতকের শেষপাদে তমলুকের ধ্বংসাবশেষ সম্পর্কে বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন। ‘প্রসিডিংস অব দি এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল’-এর ১৮৮৮ সালের জানুয়ারি-ডিসেম্বর সংখ্যায় (কলকাতা, ১৮৮৯) তিনি তাঁর আবিষ্কারের কথা সংক্ষেপে প্রকাশ করেন। প্রায় একই সময়ে তমলুকের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব উমাচরণ অধিকারী একটি গ্রন্থে আলোচ্য নগরের প্রাচীন নির্দশন সম্পর্কে বর্ণনা করেন।

১৯২০-২১ সালে ‘আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া’ (এ.এস.আই) তমলুকের ওপর একটি সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট তৈরি করে। ১৯৪০ সালে প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজ সম্পাদন করেন স্যার গুরুসদয় দত্ত, টি.এন রামচন্দ্রন এবং কে.এন দীক্ষিত। এ উৎখনন থেকে যে সকল প্রত্ননিদর্শন পাওয়া যায় তার মধ্যে ছিল পোড়ামাটির সামগ্রী, মৃৎপাত্র এবং মুদ্রা। প্রাপ্ত নিদর্শনাবলির কয়েকটি ছিল খ্রিস্টপূর্ব তিন শতকের। এ.এস.আই ১৯৫৪-৫৫ সালে এম.এন দেশপান্ডের তত্ত্বাবধানে পরবর্তী প্রত্ন-উৎখননের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ফলে চার স্তরের সাংস্কৃতিক পর্যায় পরিলক্ষিত হয়। অবশ্য এ উৎখনন থেকে কোনো ধরনের কাঠামোগত অস্তিত্ব পাওয়া যায় নি। কেবল পেটানো মেঝে এবং পাতকুয়া দেখা গেছে।

১৯৭৩-৭৪ সালে এ.এস.আই-এর পক্ষ থেকে প্রত্নস্থলটিতে এস.কে মুখার্জীর তত্ত্বাবধানে আরেক দফা উৎখননের উদ্যোগ চলে। এ উৎখনন থেকে চারটি পৃথক সাংস্কৃতিক পর্বের সন্ধান পাওয়া গেছে। এগুলির মধ্যে প্রথম পর্বে নব্যপ্রস্তর যুগীয় সংস্কৃতির অসম্পূর্ণভাবে পোড়ানো মৃৎপাত্র (ill-fired pottery), বিপুল পরিমাণ মধ্যপ্রস্তর যুগীয় হাতিয়ার, হাড় দিয়ে প্রস্ত্ততকৃত সূঁচ বিশেষ এবং অল্প কিছুসংখ্যক তাম্রসামগ্রী পাওয়া গেছে। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয়-দ্বিতীয় শতক হচ্ছে দ্বিতীয় পর্বের কালসীমা। এ স্তরে ‘উত্তর ভারতীয় কালো মসৃণ মৃৎপাত্র’ (NBPW)-এর কিছু টুকরা, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক স্বল্পমূল্য পাথরের গুটিকা (beads), এবং বিপুল সংখ্যক ছাপাঙ্কিত ও ছাঁচে ঢালা তাম্রমুদ্রা পাওয়া গেছে। কেউ কেউ এ স্তরকে তথাকথিত মৌর্য-শুঙ্গ যুগের বলে অনুমান করেন। এখানে ইটনির্মিত একটি জলাধার এবং পোড়ামাটির কিছু পাতকুয়ার নিদর্শনও পাওয়া গেছে। তৃতীয় স্তরটি কুষাণ-শুঙ্গ যুগের সমসাময়িক এবং সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধ বলে মনে হয়। এখানে মৃৎশিল্প, এবং প্রচুর পরিমাণে পোড়ামাটির মূর্তি (যার কোনো কোনোটির সাথে হেলেনীয় রীতির সুস্পষ্ট মিল বিদ্যমান) পাওয়া যায়। এ সকল সামগ্রী একটি আধুনিক নাগরিক জীবনের ইঙ্গিত দেয় যেখানে নাগরিকগণ শিল্পকর্মে লিপ্ত থাকতো। চতুর্থ স্তরটি গুপ্তযুগের সমসাময়িক বলে ধারণা করা হয়। এ পর্যায় থেকে প্রাপ্ত প্রত্ন নিদর্শনাবলি তেমন একটা আকর্ষণীয় নয়, চৈনিক তীর্থযাত্রীদের প্রদত্ত বর্ণনার সঙ্গেও এর মিল নেই।

১৯৫৪-৫৫ এবং ১৯৭৩-৭৪ সালের মধ্যে কয়েকজন গবেষকের ব্যক্তিগত পর্যায়ের উৎখননে তমলুকের আশে-পাশের বিভিন্ন অঞ্চল হতে গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনাদি প্রকাশিত হয়। প্রয়াত প্রফেসর পি.সি দাশগুপ্ত ছিলেন গবেষণার এ অঙ্গনে পথিকৃৎ। এ প্রত্নস্থল থেকে তিনি অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রত্ন-নিদর্শনাদির সাথে পোড়ামাটির আকর্ষণীয় মূর্তি আবিষ্কার করেন। ১৯৭৩-৭৪ সালের পর ‘তাম্রলিপ্ত গবেষণা ও জাদুঘর কেন্দ্র’ অত্র অঞ্চলে স্বাধীন গবেষণা সম্পাদন করে। জাদুঘরের বর্তমান (২০০১) কিউরেটর তমলুকের প্রত্নতত্ত্বের উপর দুটি গুরুত্বপূর্ণ মনোগ্রাফ প্রকাশ করেন। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের ফলে উক্ত অঞ্চলে আরও কয়েকটি প্রত্নস্থল আবিষ্কৃত হয়েছে।

তমলুকের আদি ঐতিহাসিক যুগ নানা ধরনের মৃৎপাত্র, যেমন ‘রুলেটেড’ (নক্শা করা) পাত্র, ধূসর মৃৎপাত্র, লোহিত মৃন্ময় পাত্র,কালো মসৃণ মৃৎপাত্র ও উত্তর ভারতীয় কালো মসৃণ মৃৎপাত্র দ্বারা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। মৃৎপাত্রের পাশাপাশি বিরল সৌন্দর্যের কিছু পোড়ামাটির সামগ্রীও এ প্রত্নস্থল থেকে পাওয়া গেছে। তমলুক জাদুঘরের সংগ্রহে রয়েছে পোড়ামাটির তৈরি যক্ষী ও জীবজন্তুর মূর্তি এবং সাধারণ পুরুষ ও মহিলাদের জীবন সম্পর্কিত পোড়ামাটির ফলক। অক্সফোর্ডের Ashmolean Museum (অ্যাশমোলিয়ন জাদুঘর)-এ রক্ষিত যক্ষীর বিখ্যাত মূর্তিটি তমলুক থেকেই সংগৃহীত। যদিও তাম্রলিপ্তির উদ্ভব তাম্র-প্রস্ত্তর যুগে হয়েছিল কি না সে সম্পর্কিত সমস্যা সম্যকভাবে নিরসন করা যায় নি, তথাপি কালো ও লোহিত মৃন্ময় পাত্র এবং তার সাথে বড়শির মতো অসংখ্য হাড়ের তৈরি দ্রব্যাদির প্রাপ্তি বিষয়টিকে সংশয়িত করে তুলেছে। [অমিতা রায় এবং কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়]