ঢাকা

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৫:২৬, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী। এর একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। প্রাক্-মুসলিম আমলে ঢাকার বিষয় নিয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা দুরূহ। তবে সূত্র অনুসারে বলা যায় যে, সুলতানি আমলে এটি একটি নগর কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে এবং মুগল আমলে প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদা পাওয়ার পর এটি প্রসিদ্ধি লাভ করে। এখানে ঢাকার ইতিহাস মূলত দুটি অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে: ১৮০০ সাল পর্যন্ত ঢাকা এবং ১৮০০ সালের পরবর্তী ঢাকা। ইতিহাসে এর পারিসরিক বৃদ্ধি আলোচিত হয়েছে সর্বশেষ অংশে।

ঢাকা (১৮০০ সাল পর্যন্ত) বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার গুরুত্ব মুগল-পূর্ব যুগে থাকলেও শহরটি ইতিহাসে প্রসিদ্ধি লাভ করে মুগল যুগে। ঢাকা নামের উৎপত্তি সম্পর্কে স্পষ্ট করে তেমন কিছু জানা যায় না। এ সম্পর্কে প্রচলিত মতগুলির মধ্যে কয়েকটি নিম্নরূপ: (ক) এক সময় এ অঞ্চলে প্রচুর ঢাক গাছ (বুটি ফ্রনডোসা) ছিল; (খ) গুপ্তাবস্থায় থাকা দুর্গা দেবীকে (ঢাকা-ঈশ্বরী) এ স্থানে পাওয়া যায়; (গ) রাজধানী উদ্বোধনের দিনে ইসলাম খানের নির্দেশে এখানে ঢাক অর্থাৎ ড্রাম বাজানো হয়েছিল; (ঘ) ঢাকা ভাষা’ নামে একটি প্রাকৃত ভাষা এখানে প্রচলিত ছিল; (ঙ) রাজতরঙ্গিণী-গ্রন্থে ঢাক্কা শব্দটি ‘পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র’ হিসেবে উল্লিখিত হয়েছে অথবা এলাহাবাদ  শিলালিপিতে উল্লিখিত সমুদ্রগুপ্তের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ডবাকই হলো ঢাকা।

মীরজুমলার গেটের একাংশ

মুগল-পূর্ব যুগের পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে ঢাকার পুরনো অংশে দুটি এবং মিরপুরে একটি মসজিদ রয়েছে। এর মধ্যে প্রাচীনতমটির নির্মাণ তারিখ ১৪৫৬ খ্রিস্টাব্দ। জোয়াও দ্য ব্যারোস ঢাকাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে দেখতে পান এবং ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে অঙ্কিত তাঁর মানচিত্রে এর অবস্থান নির্দেশ করেন। আকবরনামা গ্রন্থে ঢাকা একটি থানা (সামরিক ফাঁড়ি) হিসেবে এবং আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে সরকার বাজুহার একটি পরগনা হিসেবে ঢাকা বাজুর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে ইসলাম খান চিশতি সুবাহ বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করেন এবং সম্রাটের নামানুসারে ঢাকার নাম করেন জাহাঙ্গীরনগর। প্রশাসনিকভাবে জাহাঙ্গীরনগর নামটি ব্যবহূত হলেও সাধারণ মানুষের মুখে ঢাকা নামটিই থেকে যায়। সকল বিদেশি পর্যটক এবং বিদেশি কোম্পানির কর্মকর্তারাও তাঁদের বিবরণ এবং চিঠিপত্রে ‘ঢাকা’ নামটিই ব্যবহার করেছেন।

বুড়িগঙ্গা ও এর উৎস নদী ধলেশ্বরী অন্যান্য বড় বড় নদীর মাধ্যমে বাংলার প্রায় সবকটি জেলার সঙ্গে ঢাকার সংযোগ স্থাপন করেছে। ঢাকা ছিল ভাটি’ (নদীবেষ্টিত নিম্নভূমির বাঙ্গালাহ) অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত এবং এটি ছিল মুগলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণাকারীদের আবাসস্থল। সুতরাং বাংলায় মুগল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা অনুযায়ী ইসলাম খান চিশতি ঢাকাকে রাজধানী করার জন্য উপযুক্ত স্থান হিসেবে গ্রহণ করেন। ঢাকায় পৌঁছে ইসলাম খান ‘ঢাকা দুর্গ’ নামে পরিচিত স্থানে তাঁর আবাসস্থল স্থাপন করেন।

এটি ইটনির্মিত ইমারত হোক বা না হোক ইসলাম খান এটিকেই সুবাহদারের বাসস্থান হিসেবে উপযুক্ত করে নির্মাণের সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বর্তমান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে এ দুর্গের অবস্থান চিহ্নিত করা হয়। প্রাচীন ঢাকা শহরটি পাকুড়তলির (বর্তমান বাবুবাজার এলাকা) সীমিত এলাকা ঘিরে গড়ে ওঠেছিল, কিন্তু মুগল সুবাহর রাজধানী হওয়ার পর এর পরিধি বৃদ্ধি পায়। এ সময় বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা শহরটি পশ্চিমে দুর্গ থেকে শুরু করে পূর্বদিকে বর্তমান সদর ঘাট পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।

রাজধানী হওয়ার পর ঢাকার ক্রমবৃদ্ধি ঘটতে থাকে। প্রশাসনিক প্রয়োজন ও সরকারি কর্মকান্ড বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শহরটির সম্প্রসারণেরও প্রয়োজন হয়। ঢাকার বিভিন্ন স্থানের নাম (যা বর্তমানে বিদ্যমান) থেকে শহরটির উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, সেনা ছাউনি থেকে উর্দু রোডের নামকরণ করা হয়েছে। দীউয়ান বাজার, বখশী বাজার, মুগলটুলি, হাজারিবাগ, পিলখানা, অতীশখানা, মাহুৎটুলি ইত্যাদি নাম থেকে বোঝা যায় যে, এসব স্থানে এককালে মুগল সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা এবং তাঁদের অধীনস্থদের বসতি ছিল। বাণিজ্যিক এবং পেশাগত প্রয়োজনও শহরটির বিকাশে ভূমিকা রাখে। কায়েৎটুলি নামটি মুগল প্রশাসনে নিয়োজিত কায়েৎদের (কায়স্থ) বসতির ধারণা দেয়। তাঁতি বাজার, শাঁখারি বাজার, বানিয়ানগর, কামারনগর প্রভৃতি নামের স্থানগুলিতে হিন্দু পেশাজীবীদের বসতি ছিল। গঞ্জ যুক্ত নামের স্থানগুলি (নওয়াবগঞ্জ, আলমগঞ্জ) বাণিজ্যিক প্রয়োজনে গড়ে ওঠে। অন্যদিকে বেচারাম দেউড়ি, মীর জামাল দেউড়ি  প্রভৃতি ‘দেউড়ি’যুক্ত স্থানগুলি ছিল জমিদারি কর্মকান্ডের সঙ্গে সম্পর্কিত।

রাজধানী প্রতিষ্ঠার ত্রিশ বছর পর ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দে সেবাস্টিয় ম্যানরিক ঢাকায় আসেন। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী, এ সময় ঢাকা শহরের পরিধি পশ্চিমে মানেশ্বর থেকে শুরু করে পূর্বে নারিন্দা এবং উত্তরে ফুলগারি (ফুলবাড়িয়া) পর্যন্ত দেড় লিগেরও বেশি (প্রায় সাত কিলোমিটার) বিস্তৃত ছিল। সুতরাং উল্লিখিত ত্রিশ বছরে ঢাকা শহরের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে যদিও প্রধানত পশ্চিমদিকেই ছিল এ বিস্তার। ঢাকার এ অংশেই মুগলদের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি গড়ে ওঠেছিল। ১৬৬৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় এসে মানুচি শহরটি তেমন বৃহৎ নয় বলে মন্তব্য করেন। কিন্তু তাঁর বর্ণনা থেকে জানা যায়, ঢাকা শহরে প্রচুর মানুষের বসবাস ছিল এবং বেশির ভাগ ঘরবাড়ি ছিল খড়ের তৈরি। এর তিন বছর পর (১৬৬৬) পর্যটক টেভার্নিয়ার ঢাকায় আসেন। তিনি বলেন, ঢাকা জনবসতিপূর্ণ বড় একটি শহর। কিন্তু এটি কেবল দৈর্ঘ্যে বেড়েছে কেননা সকলেই নদীর তীর ঘেঁষে বসতি স্থাপনে আগ্রহী ছিল। টেভার্নিয়ার শহরটিকে লম্বায় দুই লিগেরও বেশি (প্রায় সাড়ে নয় কিলোমিটার) বলে উল্লেখ করেছেন। এর তিন বছর পর (১৬৬৯-৭০) ঢাকায় আসেন টমাস বাউরি। তাঁর দৃষ্টিতে ঢাকা শহর ছিল সুপ্রশস্ত, চতুর্পার্শ্বে এর পরিধি ৪০ মাইলের কম নয়। অথচ নিম্নজলাভূমির উপরই ছিল শহরটির অবস্থান। প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে ঢাকার গৌরব আঠারো শতকে অনেকটা ম্লান হয়ে যায়। ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি মোটামুটিভাবে তেজগাঁও এলাকা ঘিরে শিল্প কারখানা তৈরি শুরু করায় এ সময় বিশেষভাবে উত্তর দিকেই ঢাকা শহরের বিস্তার ঘটে। ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ঢাকা শহরের সীমানা হিসেবে দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা, উত্তরে টঙ্গী-জামালপুর, পশ্চিমে মিরপুর এবং পূর্বে পোস্তগোলা পর্যন্ত গ্রহণ করে। ঢাকার আবাসিক ইংরেজ বণিক প্রতিনিধি জন টেইলর ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা, উত্তরে টঙ্গী, পশ্চিমে জাফরাবাদ এবং পূর্বে পোস্তগোলা পর্যন্ত মুগল ঢাকার সীমানা বর্ণনা করেন। মুগল ঢাকার এ সীমানা বাউরির আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী চর্তুপার্শ্বে চল্লিশ মাইলের কম হবে না।

লালবাগ দুর্গের ফটক

১৬১০ খ্রিস্টাব্দে প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর প্রায় একশত বছর ঢাকার এ মর্যাদা অক্ষুণ্ণ ছিল। এ শহরে ছিল প্রশাসনিক সদর দফতর এবং  সুবাহদার ও অন্যান্য কর্মচারীদের বাসস্থান। ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক কারণে শাহজাদা সুজা (১৬৩৯-৫৯) রাজমহলে রাজধানী স্থানান্তর করেন, যদিও প্রারম্ভিকভাবে তিনি কয়েক বছর ঢাকায় অবস্থান করেছিলেন। সুবাহদারি স্থানান্তরিত হলে ঢাকা রাজধানীর গুরুত্ব হারিয়ে একটি স্থানীয় প্রশাসনিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। শাহজাহান এর পুত্রদের মধ্যে সংঘটিত উত্তরাধিকার যুদ্ধের পর সুজা আরাকানে পালিয়ে গেলে পরবর্তী সুবাহদার মীরজুমলা ঢাকাকে পুনরায় তাঁর সদর দপ্তরে পরিণত করেন। আঠারো শতকের শুরুতে সুবাহদার শাহজাদা আজিমুদ্দীন ও দীউয়ান মুর্শিদকুলী খান এর কলহের কারণে ঢাকা থেকে তাঁদের দফতরসমূহ (সুবাহদারি পাটনায়, দীউয়ানি- মুর্শিদাবাদে) সরিয়ে নেয়ার পূর্বপর্যন্ত রাজধানী হিসেবে ঢাকার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ ছিল। ১৭১৫-১৬ খ্রিস্টাব্দে মুর্শিদকুলী জাফর খান সুবাহদার (নাজিম হিসেবেও পরিচিত) হিসেবে নিয়োগ লাভ করার পূর্বপর্যন্ত বেশ কয়েক বছর সুবাহদারের প্রতিনিধিরা ঢাকা শাসন করতেন। মুর্শিদকুলী খান এরপর মুর্শিদাবাদ থেকে প্রদেশ পরিচালনা করেন। তখন থেকে ঢাকা নায়েব-নাজিমের শাসন কেন্দ্রে পরিণত হয়। ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে নায়েব নাজিম-এর পদ বিলুপ্তির পূর্বপর্যন্ত এ ব্যবস্থা অব্যাহত ছিল।

ঢাকা আসার পথে শাহজাদপুর (পাবনা) থেকে ইসলাম খান চিশতি কিছুসংখ্যক কর্মকর্তাসহ একটি অগ্রবর্তী দল প্রেরণ করেন। শাসনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও সুবাহদারকে অভ্যর্থনা জানানোর লক্ষ্যে তিনি ঢাকায় থানাদারের কর্মকেন্দ্রে একটি দুর্গ নির্মাণের জন্য তাদের নির্দেশ দেন। দুর্গটি ইটনির্মিত হতে পারত, কিন্তু খুব সম্ভবত এটি ছিল কাদামাটির দেয়াল দিয়ে ঘেরা একটি স্থান। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে এ স্থানটিকেই সুবাহদারের বসবাসের উপযোগী করে তোলা হয়। ঢাকায় প্রেরিত মুগল সুবাহদারগণ সাধারণত তাঁবুতে বসবাস করতেন। যেহেতু তাঁদের নিযুক্তি সাময়িক ও বদলিযোগ্য, তাই খুব কম সুবাহদারই নিজেদের জন্য বাড়ি বানাতে মনোযোগী ছিলেন। ঢাকার একমাত্র দুর্গ লালবাগ বা আওরঙ্গাবাদের নির্মাণ কাজ শাহজাদা আজম শাহ (১৬৭৮-৭৯) শুরু করলেও তিনি তা সমাপ্ত করতে পারেন নি। এ দুর্গ ব্যতীত ইসলাম খানের সময়কার অপর গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত চাঁদনি ঘাট। এখানে রাজকীয় নৌবহরের আসা-যাওয়া চলত এবং সামরিক ও নৌবাহিনীর সৈন্যদের অবতরণের ব্যবস্থা ছিল।

বড় কাটরা

পরবর্তী সুবাহদার শাহ সুজা ঢাকায় নির্মাণ কর্মকান্ড শুরু করেন। শাহ সুজার দীউয়ান মীর আবুল কাশিম ১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে বড় কাটরা নামে একটি সুপ্রশস্ত ইমারত নির্মাণ করেছিলেন। ইমারতটির অবস্থান বুড়িগঙ্গার তীরে এবং বর্তমান চকবাজারের দক্ষিণে। পরিদর্শনকারী বণিকদের অতিথিশালা হিসেবে এটি দান করা হয়েছিল এবং এ থেকে ইমারতটিকাটরা নামে পরিচিত হয়। মীর আবুল কাশিম পিলখানার উত্তরে সাত মসজিদে যাওয়ার পথে একটি প্রশস্ত ঈদগাহ নির্মাণ করেছিলেন। ১৬৪৯ খ্রিস্টাব্দে একজন মুগল কর্মকর্তা মুহম্মদ বেগ চকবাজারের নিকটে চুরিহাট্টায় একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। নাওয়ারার (নৌবাহিনী) দারোগা মুহম্মদ মুকিম ১৬৬২ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করেন একটি কাটরা।

এটি বর্তমান কেন্দ্রীয় কারাগারের পূর্ব এবং প্রধান ফটকের পেছনে অবস্থিত ছিল। যদিও বর্তমানে এর কোনো চিহ্ন অবশিষ্ট নেই তবুও বর্তমানে এটি মুকিম কাটরা  নামে পরিচিত।

বেশ কয়েকটি নির্মাণ কাজের সঙ্গে মীরজুমলার নাম জড়িয়ে আছে, প্রথমে মীরজুমলার গেট পরবর্তী সময়ে যা ‘রমনা গেট’ নামে পরিচিত হয়। কার্জন হল এর কাছাকাছি ও পুরাতন হাইকোর্ট ভবনের পশ্চিমে ময়মনসিংহ রোডে গেটটি অবস্থিত। উত্তরদিক থেকে শহরটিকে রক্ষার জন্যই সম্ভবত এ গেট নির্মাণ করা হয়েছিল। তিনি মগ দস্যুদের আক্রমণ থেকে শহর ও শহরতলিকে রক্ষার জন্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। সড়ক পথে সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র দ্রুত পাঠানোর জন্য ঢাকাকে সংযুক্ত করে দুটি সড়ক নির্মাণ এবং রাজধানীকে সুরক্ষিত করার জন্য তিনি কয়েকটি দুর্গও নির্মাণ করেন। সড়ক দুটির একটি উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলির সঙ্গে ঢাকাকে যুক্ত করে। বর্তমানে ময়মনসিংহ রোড নামে পরিচিত সড়কটি টঙ্গী-জামালপুরে একটি দুর্গের সঙ্গে যুক্ত হয়। তুরাগ নদীর উপর টঙ্গীব্রিজ তিনিই নির্মাণ করেন। অপর সড়কটি পূর্বদিকে প্রসারিত হয়ে ফতুল্লার (প্রাচীন দাপা) সঙ্গে ঢাকাকে যুক্ত করেছে। এখানে ছিল দুটি দুর্গ। সড়কটি খিজিরপুর পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয় যেখানে আরও একটি দুর্গ ছিল। ফতুল্লার অদূরে পাগলা ব্রিজটিও মীরজুমলা নির্মাণ করেন।

পরবর্তী সুবাহদার শায়েস্তা খান ছিলেন একজন খ্যাতিমান নির্মাতা। তিনি নিজের প্রাসাদটি কাঠ দ্বারা নির্মাণ করেন। অবশ্য তিনি একটি কাটরাও নির্মাণ করেন। এটি ছোট কাটরা নামে পরিচিত, শাহ সুজার বড় কাটরা থেকে পৃথক করার জন্য এ নামকরণ। তিনি বেশ কয়েকটি মসজিদ ও সমাধিসৌধও নির্মাণ করেন। মসজিদগুলির মধ্যে চকবাজার মসজিদ, বাবুবাজার মসজিদ ও সাতগম্বুজ মসজিদ বিখ্যাত। সমাধিগুলির মধ্যে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে  বিবি পরীর সমাধি। এছাড়াও বিবি চম্পা, দারা বেগম ও অন্যান্যদের কয়েকটি সমাধিসৌধ রয়েছে।

একজন নির্মাতা হিসেবে শায়েস্তা খান এতই বিখ্যাত ছিলেন যে, তাঁর স্থাপত্য রীতি তাঁরই নামানুসারে (শায়েস্তা খানি রীতি) পরিচিত হয়। কাওরান বাজার এলাকায় খাজা আম্বর একটি কূপ, একটি সরাই, একটি সেতু ও একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। একজন ব্যবসায়ী পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকাকে যুক্ত করার জন্য দোলাইখালের উপর নির্মাণ করেন নারিন্দা সেতু। এ সময় শাহজাদা আজম শাহের অসমাপ্ত আওরঙ্গবাদ দুর্গে (বর্তমানে লালবাগ দুর্গ নামে পরিচিত) কয়েকটি সুন্দর ইমারত নির্মাণ করা হয়। এগুলির মধ্যে মসজিদ ও বিবি পরীর সমাধি উল্লেখযোগ্য। শাহজাদা আজিমুদ্দীন পোস্তায় (পোস্ত-কিল্লা) একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেন যা বর্তমানে নদীতে বিলীন। বেগমবাজার মসজিদটি নির্মাণ করেন মুর্শিদকুলী খান। শাহজাদা ফররুখ সিয়ার (পরবর্তীকালের সম্রাট) লালবাগ দুর্গের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এটি বর্তমানে শাহী মসজিদ নামে পরিচিত। খান মুহম্মদ মৃধা লালবাগ দুর্গের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে অতীশখানা এলাকায় একটি মসজিদ নির্মাণ করেন।

শিয়া মুসলমানদের আগমন এবং তাদের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিয়া-ধর্মীয় ইমারত হিসেবে হোসেনী দালান নির্মিত হয়। নায়েব-নাজিমগণ ইসলাম খান চিশতির নির্মিত কিল্লা বা দুর্গে বসবাস করতেন। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির দীউয়ানি অধিকার লাভের পর দুর্গটি ইংরেজ কর্মকর্তাদের দখলে আসে। এ সময় নায়েব-নাজিম বড় কাটরা প্রাসাদে চলে যান। প্রাসাদ (পুরাতন ঢাকা জাদুঘর এলাকা) নির্মিত হওয়ার পর নায়েব-নাজিম সেখানে যান। প্রাসাদটির অস্তিত্ব বর্তমানে নেই, তবে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি ভবনের অভ্যন্তরে এর ধ্বংসপ্রায় ফটকটি (নিমতলী দেউরি) আজও রয়েছে। ইসলাম খানের বাসস্থান ও চাঁদনি ঘাটের মাঝামাঝিতে একটি বাজার গড়ে ওঠেছিল। এটি বাদশাহী বাজার নামে পরিচিত ছিল পরবর্তীকালে চকবাজার নামে পরিচিত হয়েছে। ১৭২৮ খ্রিস্টাব্দে এ বাজারের নির্মাণ কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন মির্জা লুৎফুল্লাহ, দ্বিতীয় মুর্শিদকুলী খান ও রুস্তম জঙ্গ।

নদীপথের পাশে অবস্থানের কারণে ঢাকা প্রাক্-মুগল যুগেই স্থানীয় বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল। রাজধানী স্থানান্তরিত হলে এখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং প্রশাসনের লোকজনের পাশাপাশি কারিগর, উৎপাদক প্রভৃতি নানা পেশার লোক এখানে আসতে থাকে। ঢাকায় প্রাদেশিক, আন্তঃপ্রাদেশিক ও বহির্বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে। এখানে আরব, পারস্য, আর্মেনীয়, চীন, মালয়, জাভা ও সুমাত্রা থেকে বণিকরা আসা-যাওয়া করত। এখানে মহাজনমাড়োয়ারি ব্যাঙ্কারদেরও আগমন ঘটেছিল। সতেরো শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি এসে ঢাকায় শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে থাকে। সর্বপ্রথম আসে পর্তুগিজরা। ঢাকা রাজধানীতে পরিণত হওয়ার পূর্বেই হুগলিতে পর্তুগিজদের বসতি গড়ে উঠেছিল। তারা ঢাকায় একটি ফ্যাক্টরি স্থাপন করে এবং  পর্তুগিজ পাদ্রিগণ গির্জা নির্মাণ করেন। কিন্তু তাদের অত্যাচার, সমগোত্রীয় আরাকানিদের জলদস্যুতা এবং ডাচ ও ইংরেজ কোম্পানি ও বণিকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা প্রভৃতি কারণে পর্তুগিজ বাণিজ্য তেমন সমৃদ্ধি লাভ করতে পারে নি। ১৬৬৩ খ্রিস্টাব্দে ওলন্দাজ, ১৬৬৭ খ্রিস্টাব্দে  ইংরেজ এবং ১৬৮২ খ্রিস্টাব্দে ফরাসিরা ঢাকায় ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠা করে। সকলেই ভাগীরথী নদীর তীরে তাদের প্রধান বসতি গড়ে তুলেছিল। ডাচদের প্রধান কেন্দ্র ছিল  চুঁচুড়ায়, ইংরেজদের হুগলিতে (পরে কলকাতায়) এবং ফরাসিদের ছিল চন্দননগরে।

ঢাকা ছিল একটি উৎপাদন কেন্দ্র। এখানে উৎপাদিত সুতিবস্ত্র উচ্চমানসম্পন্ন এবং বহির্বিশ্বে ছিল এর প্রচুর চাহিদা। মসলিন নামে পরিচিত বিভিন্ন ধরনের উন্নত সুতিবস্ত্র বাইরে রপ্তানি হতো। ঢাকায় উৎপাদিত পণ্য ক্রয়ের জন্য ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি প্রচুর স্বর্ণ ও রৌপ্য পিন্ড আমদানি করত। দেশীয় ও আমদানিকৃত মালামাল ওঠা-নামা করার জন্য ঢাকায় বন্দর সুবিধাও ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে আঠারো শতকে তৎকালীন প্রায় ত্রিশ লক্ষ টাকার বস্ত্রসামগ্রী রপ্তানি করা হয়।

১৬৪০ খ্রিস্টাব্দে সেবাস্টিয় ম্যানরিক ঢাকা শহর ও শহরতলির লোকসংখ্যা ২ লক্ষ বলে উল্লেখ করেন। ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার কালেক্টর এবং ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার কমার্শিয়াল রেসিডেন্টও অনুরূপ সংখ্যা উল্লেখ করেন। প্রথম দুই সূত্রের হিসাব ছিল অনুমাননির্ভর। তৃতীয়টির হিসাব কিছুটা আনুমানিক হলেও একজন পুলিশ কর্মকর্তার তৈরি রেকর্ডের ওপর ভিত্তি করে তা লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেকর্ড থেকে জানা যায় যে, ঢাকায় নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী এবং শ্রম দুই-ই সস্তা ছিল। সাধারণ্যে প্রচলিত রয়েছে যে, শায়েস্তা খানের সুবাহদারি আমলে ঢাকার বাজারে টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত। ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে সরফরাজ খান এর সময় চালের দাম পুনরায় ওই পর্যায়ে নেমে এসেছিল।  [আবদুল করিম]

গ্রন্থপঞ্জি  Mirza Nathan, Baharistan-I-Ghaibi, 2 volumes, (tr.) MI Borah, Government of Assam, 1936; SM Taifuor, Glimpses of Old Dhaka, Dhaka 1952; AH Dani, Dacca- A Record of its Changing Fortunes, Dhaka, 1962; A Karim, Dacca: The Mughal Capital, Dhaka, 1964; Sharif uddin Ahmed (ed.), Dhaka Past Present Future, Dhaka, 1991.

ঢাকা (১৮০০ সাল পরবর্তী) বাংলার নওয়াবদের রাজনৈতিক ক্ষমতার পতন এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উত্থান আঠারো শতকের শেষভাগে ঢাকার প্রশাসনিক গুরুত্বকে ম্লান করে দেয়। উপরন্তু, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক ও উৎপাদন নীতি নগরীর আর্থিক ভিত্তিকে ধ্বংস করে দেয়। ফলে ভূতপূর্ব শাসকগোষ্ঠীর গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ বহুসংখ্যক লোক বেকার হয়ে পড়ে এবং বিকল্প জীবিকার সন্ধানে তারা নগরী ত্যাগ করে বিভিন্ন স্থানে ও পল্লী এলাকায় চলে যায়। এভাবে ঢাকার জনসংখ্যা অতি দ্রুত হ্রাস পায়। স্বাভাবিকভাবেই নগরীর প্রাকৃতিক বিস্তার এতোটাই সংকুচিত হয়ে যায় যে, উনিশ শতকের প্রারম্ভে ঢাকা হয়ে পড়ে তার পূর্বের অবস্থার ছায়ামাত্র। প্রকৃত অর্থে এর প্রশাসনিক গুরুত্ব, এর ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্প উৎপাদন কার্যত বিলুপ্ত হয়ে যায়। একইভাবে ঢাকার সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কার্যক্রমেরও মারাত্মক অবনতি ঘটে।

মুগল আমলে ঢাকার নাটকীয় উত্থান ও উন্নয়ন হয়েছিল প্রথমত এর সুবিধাজনক ভৌগোলিক অবস্থান, রাজধানী হিসেবে এবং পরবর্তী সময়ে একটি ধনী ও সম্পদশালী প্রদেশের উপ-রাজধানী হিসেবে এর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক গুরুত্ব, এর সমৃদ্ধ অভ্যন্তরীণ ও বহির্বাণিজ্য এবং এর বিখ্যাত উৎপাদন দ্রব্য বিশেষত মসলিনের জন্য। মুগল আমলে ঢাকার সমৃদ্ধির শীর্ষ সময়ে শহরতলিসহ ঢাকা নগরীর জনসংখ্যা ধরা হয় প্রায় নয় লক্ষ। এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছিল অভিজাত সম্প্রদায়, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, সৈনিক, কারখানার মালিক, বণিক এবং বিভিন্ন শ্রেণীর শ্রমজীবী ও চাকরিজীবী লোক। অধিবাসীদের মধ্যে ছিল বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের মানুষ। মূল নগরী বিস্তৃত ছিল বুড়িগঙ্গা বরাবর সাত থেকে দশ মাইল এবং অভ্যন্তরভাগে আড়াই মাইল পর্যন্ত। শহরতলির বিস্তার ঘটে বুড়িগঙ্গা থেকে টঙ্গী ব্রীজ পর্যন্ত ১৫ মাইল দক্ষিণে এবং পশ্চিমে মিরপুর-জাফরাবাদ থেকে ১০ মাইল পূর্বে পোস্তগোলা পর্যন্ত।

উপরের বর্ণনানুযায়ী নগরীর ভাগ্য বিপর্যয় ঢাকার জনগোষ্ঠী এবং প্রাকৃতিক সীমানার উপর চরম প্রভাব ফেলে। ১৮০১ সালে নগরীর জনসংখ্যা ছিল মাত্র ২ লক্ষ এবং ১৮৪০ এর মধ্যে তা ক্রমশ কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৫১,৬৩৬ জনে। ১৮০১ সাল থেকে ১৮৪০ সালের মধ্যে পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব দিকে ঢাকার নিকটবর্তী ঘনবসতিপূর্ণ বহু এলাকা, যেমন নারিন্দা, ফরিদাবাদ, উয়ারী ও আলমগঞ্জ অনেকাংশেই পরিত্যক্ত হয়ে যায়। অন্যদিকে উত্তরে ফুলবাড়িয়া, দীউয়ান বাজার, মনোহর খান বাজার এবং পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিমে ঢাকেশ্বরী, আজিমপুর ও এনায়েতগঞ্জ সম্পূর্ণরূপে জনশূন্য হয়ে যায়। অথচ এ সব অঞ্চলের কোনো কোনো অংশে ১৮০১ সালেও লোকজন বসবাস করত। মেরামতের অভাবে দোলাই নদীর উপরে বিশাল সেতুগুলির কয়েকটি একেবারে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।

উন্নয়নের নতুন ধারা এবং সমৃদ্ধির নতুন যুগের সূত্রপাতের মাধ্যমে ১৮৪০-এর দশক থেকে ঢাকার নগর ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হয়। নগর উন্নয়নের এই যাত্রা তখন থেকেই অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। যে উপাদানগুলি নগরের পুনরুদ্ধারের কাজ সম্পন্ন করেছে সেগুলিই প্রাথমিক পর্বে নগরের উত্থানে সহায়ক ছিল। এগুলি হলো একটি সম্পদশালী পশ্চাদভূমি (কার্যত সমগ্র দক্ষিণ ও পূর্ব বাংলা), একটি উপযুক্ত ভৌগোলিক অবস্থান, প্রশাসনিক উন্নতি, এবং নতুন ধরনের শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, উৎপাদন ও শিল্প কারখানার আবির্ভাব। একই সময়ে ইউরোপের সাথে সংযোগ স্থাপনের পরবর্তীকালে যে সাংস্কৃতিক রেনেসাঁর সূচনা হয় তার ফলে বিভিন্ন শিক্ষা বিষয়ক, রাজনৈতিক ও সামাজিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে ক্রমাগতভাবে এবং নিশ্চিতভাবেই একটি গুরুত্বপূর্ণ নগরকেন্দ্র হিসেবে ঢাকার ক্রমবিকাশকে সাহায্য করেছে।

প্রশাসনিক ক্রমবৃদ্ধি  ইতিপূর্বে ১৭৭২ সাল থেকেই ঢাকা একটি জেলা প্রশাসনের কেন্দ্র ছিল। ১৮২৯ সালে নগর ঢাকা ঢাকা বিভাগ নামে একটি বৃহৎ বিভাগের সদর দফতরে পরিণত হয়। এরপর ঢাকার  প্রশাসনিক গুরুত্ব ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। কারণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং পরবর্তীকালে ব্রিটিশ-ভারত সরকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ও নির্মাণ, স্থানীয় সরকার এবং অন্যান্য কল্যাণমূলক কাজে তাদের সরকারি দায়িত্বগুলি সম্প্রসারিত করে। এ সকল কর্মকান্ডের জন্য এক একটি বিভাগ খোলা হয় এবং কোনো কোনোটির কার্যালয়ের পরিধি ছিল ব্যাপক এবং পূর্ব বাংলার বিশাল অঞ্চল এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। ঔপনিবেশিক আমলে এ সমস্ত সরকারি কার্যালয় সম্প্রসারণের ফলে নগর ঢাকা একটি বড় প্রশাসনিক কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয় এবং ১৮৮৫ সালের মধ্যে বঙ্গপ্রদেশে কলকাতার পরে ঢাকা নগরী সর্ববৃহৎ ‘বেসামরিক কেন্দ্র’ (civil station) হিসেবে গড়ে ওঠে।

পুরাতন হাইকোর্ট ভবন

১৯০৫-১১ সালের মধ্যে ঢাকার প্রশাসনিক গুরুত্ব নাটকীয়ভাবে আরও বৃদ্ধি পায় যখন এটিকে পূর্ব বাংলা ও আসাম নামে নতুন একটি প্রদেশের রাজধানী করা হয়। এ সময় বিভিন্ন বিভাগ এবং বিভিন্ন উচ্চ ও মধ্যপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে ঢাকায় প্রাদেশিক প্রশাসনের একটি উপরিকাঠামো প্রবর্তন করা হয়। একটি হাইকোর্ট এবং একটি সচিবালয়সহ একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। ১৯১২ সালে এই নতুন প্রদেশের বিলুপ্তি ঘটে। স্বল্পস্থায়ী হলেও এর প্রভাব পড়ে নগরীর সম্প্রসারণ এবং এখানকার জনগোষ্ঠীর উপর। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান এবং স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব বাংলা নামে নতুন প্রদেশের রাজধানী হওয়ায় ঢাকার উত্থানে অধিকতর স্থায়ী প্রশাসনিক অবকাঠামো সংযোজিত হয়। এ সময় হতে ঢাকা শুধু নতুন প্রদেশের প্রশাসনিক সদর দফতরই ছিল না, বরং এখানে পূর্ব বাংলা/পূর্ব পাকিস্তানের আইন পরিষদ (Legislative Assembly) এবং নির্দিষ্ট অধিবেশনের জন্য হলেও  জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসত।

অবশ্য পাকিস্তান রাষ্ট্র দীর্ঘদিন টিকে থাকে নি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তান একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং বাংলাদেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে ঢাকা রাজনৈতিক ক্ষমতা, প্রশাসনিক কার্যকলাপ এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্ররূপে মর্যাদা লাভ করে। বিশেষ কোনো বিকেন্দ্রীকরণ নীতি না থাকায় এ নগরী বর্তমানে দেশের সকল প্রকার প্রশাসনিক ক্ষমতার একক কেন্দ্র। আইন শৃঙ্খলা, রাজস্ব আদায়, স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে শুরু করে সমাজ কল্যাণ পর্যন্ত সকল সরকারি বিভাগের সদর-দফতর সরকারি সচিবালয়ে সংযুক্ত হওয়াতে এ স্থান থেকেই কার্যত সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ নগরীতেই দেশের প্রধান সামরিক সদর দফতর অবস্থিত।

বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট ভবন

রাজনৈতিক গুরুত্ব  প্রশাসনিকভাবে বিকাশ লাভের সাথে সাথে ঢাকার রাজনৈতিক গুরুত্বও বৃদ্ধি পেতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে বিগত দুই শতকে শুধু বাংলাদেশেরই নয়, পুরো উপমহাদেশের রাজনৈতিক জীবনে এ নগরীর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ ও বৈচিত্র্যময়। উনিশ শতকে এটি ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের (যা ১৮৫৭ সালের তথাকথিত সিপাহি বিপ্লব নামে পরিচিত) গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলির একটি।

লালবাগ দুর্গে অবস্থানরত বাংলার সেনাবাহিনীর সিপাহিরা তাদেরকে নিরস্ত্রীকরণের ব্রিটিশ প্রশাসকদের প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করার জন্য সংগ্রামে লিপ্ত হয়। এ ঘটনার পর থেকে দেশের অন্যান্য অংশের দেশীয় সৈন্যরা বিদ্রোহ শুরু করে। এ ঘটনা নগরীর ইতিহাসে যুগান্তকারী বলে বিবেচিত। এ অবস্থায় ব্রিটিশ প্রশাসকগণ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং স্থানীয় জনগণ ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে তখন থেকেই গভীর অসন্তোষ পোষণ করতে শুরু করে। যে স্থানে সিপাহিদের ফাঁসি দেওয়া হয় সে স্থানটি জাতীয় প্রতিরোধের প্রতীকে পরিণত হয়। কিন্তু ঘটনাটি বিত্তশালী স্থানীয় জমিদার এবং ব্যবসায়ী বিশেষ করে ঢাকার নওয়াব পরিবারএর পক্ষ থেকে ব্রিটিশদের প্রতি গভীর আনুগত্য ও সমর্থনও প্রকাশ করে। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে সমগ্র পূর্ববাংলা থেকে সমর্থন সংগ্রহের জন্য এ নগরী কংগ্রেসের কার্যকলাপের কেন্দ্রে পরিণত হয়। কিন্তু বিশ শতকের প্রথম দিকে  বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫) কার্যকর করার ক্ষেত্রে  নগরীর রাজনৈতিক ভূমিকা ছিল উল্লেলখযোগ্য এবং বিষয়টি পূর্ববংলার মুসলমানদের বিজয় হিসেবে বিবেচিত। এ ব্যাপারে ঢাকার নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহর ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯০৫ সাল থেকে ঢাকা উপমহাদেশের মুসলমানদের অন্যতম কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়। স্যার সলিমুল্লাহ ১৯০৬ সালে ঢাকায় উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রথম রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ঢাকার নওয়াব গ্রহণ করেন এবং সফল হন। দলটি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বিপক্ষে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার জন্য গঠিত হয়েছিল। বঙ্গভঙ্গের কারণে স্বদেশী আন্দোলন এবং চরমপন্থী হিন্দুদের দ্বারা ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ শুরু হয়। ঢাকা এ সব কার্যকলাপের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে এবং ‘অনুশীলন সমিতি’ নামে চরমপন্থী দলগুলির অন্যতম একটির শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত হয়। পরবর্তী বছরগুলিতে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে ঢাকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

পাকিস্তান সৃষ্টি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের, বিশেষ করে এর শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আশা এবং আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারে নি। উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পাকিস্তানি শাসকদের ঘোষণা পূর্ব পাকিস্তানিদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সূচনা করে। কারণ এ অঞ্চলের অধিবাসীরা তাদের ভাষা এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে দারুণ গর্ব করত। ঢাকা তাই ভাষা আন্দোলন-এর প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। এ আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানিদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনারও জন্ম দেয়। প্রকৃতপক্ষে ভাষা আন্দোলনই হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রদূত। এ ক্ষেত্রেও ঢাকা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বৈষম্য দূরীকরণ আন্দোলন (ছয়দফা কর্মসূচি), ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১-এর ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের যাত্রা-সবকিছুই এ রাজধানী শহর থেকে শুরু হয়। আবার এ শহরেই ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরে রমনা রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান।

শিক্ষার উন্নয়ন এ অঞ্চলের, বিশেষ করে ঢাকা নগরীর শিক্ষার উন্নয়নের মাঝেই বাংলাদেশের অভ্যুদয় নিহিত। বস্ত্তত, আধুনিক যুগে ঢাকার গুরুত্ব অনেকখানি বৃদ্ধি পেয়েছে শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে। ১৮৩৫ সালে ঢাকা গভর্নমেন্ট কলেজিয়েট স্কুল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এ নগরী পূর্ববাংলার বিশাল পশ্চাদভূমির হাজার হাজার তরুণের কাছে নতুন ইংরেজি শিক্ষা এবং পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। বিষয়টি পূর্ববাংলায় শুধু পাশ্চাত্য শিক্ষারই প্রসার ঘটায় নি, বরং সাংস্কৃতিক নবজাগরণ এবং সামাজিক বিপ্লবও সৃষ্টি করে। ফলে পাশ্চাত্য জ্ঞান ও বিজ্ঞানে নব্যশিক্ষিত তরুণেরা তাদের মাতৃভূমির বিভিন্ন ক্ষতিকর সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতি এবং প্রথা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলতে শুরু করে। এভাবে নগরীর শিক্ষার বিস্তার ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৮৪১ সালে ঢাকা গভর্নমেন্ট কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৭৪ সালে ঢাকা মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠা পূর্ব বাংলার মুসলমান তরুণদের ধর্মীয় চাহিদা অনুযায়ী আরবি ও ফারসি, সেইসাথে ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ করে দেয় যা যুগের প্রয়োজনে তাদের জন্য উপযুক্ত ছিল। ১৮৮৪ সালে একটি বেসরকারি উদ্যোগ হিসেবে জগন্নাথ কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এটি পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ আমলে উচ্চশিক্ষার সর্বোৎকৃষ্ট কেন্দ্রগুলির একটিতে পরিণত হয়েছিল। বর্তমানে এটি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে।

জগন্নাথ কলেজ, ঢাকা

সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহও প্রতিষ্ঠিত হয়, যেমন ১৮৬৩ সালে ঢাকা কলেজের আইন বিভাগ, ১৮৭৫ সালে ঢাকা মেডিক্যাল স্কুল (মিটফোর্ড হাসপাতাল সংলগ্ন) এবং ১৮৭৬ সালে ঢাকা সার্ভে স্কুল। এ প্রতিষ্ঠানগুলি পূর্ণাঙ্গ কারিগরি ও বিশেষ শিক্ষা ব্যবস্থার কেন্দ্র হিসেবে পরবর্তী সময়ে রূপান্তরিত হয়। এগুলি পরে চিকিৎসাবিদ্যা, আইন, প্রকৌশল ইত্যাদির সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উন্নীত হয়েছিল। ১৮৭৮ সালে ইডেন গার্লস স্কুল নামে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। এতদিন পর্যন্ত দেশে নারী শিক্ষা ছিল অবহেলিত। ইডেন গার্লস স্কুল এ অবস্থা দূর করে। পরে ইডেন কলেজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে দেশে নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে সামাজিক বিপ্লব সূচিত হয়।

অবশ্য এ পর্যায়ে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ঢাকার শিক্ষার উন্নয়ন পূর্ণতা লাভ করে। তীব্র বিরোধিতার মুখে এটি একটি বেশ অবহেলিত অঞ্চলের শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নয়ন এবং তুলনামূলকভাবে অনগ্রসর মুসলমান জাতির অগ্রগতির প্রবেশদ্বার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি শিক্ষা প্রদানের পাশাপাশি অতিশীঘ্রই সমগ্র পূর্ববাংলার সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক পুনর্জাগরণের কেন্দ্রে পরিণত হয়। কালক্রমে এটি ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন হতে উপমহাদেশের মুক্তির আন্দোলনের একটি শক্তিশালী কেন্দ্রেও উন্নীত হয়। এ বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ববাংলা অঞ্চলে বিশেষ করে মুসলমানদের মধ্যে একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থানেও সহায়তা করে।

১৯৪৭ সাল থেকে নগরীর শিক্ষার অগ্রগতি ক্রমাগতভাবে সম্প্রসারিত হতে থাকে। কিন্তু ১৯৭১ সালের পর নাটকীয়ভাবে তা বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে ঢাকায় অনেকগুলি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেগুলি বিভিন্ন প্রকারের কলা, বিজ্ঞান, প্রকৌশল, চিকিৎসাবিদ্যা, চারুকলা, সঙ্গীত, চিত্রকর্ম এবং অন্যান্য বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করে চলেছে। শিক্ষার অগ্রগতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে কেবল ঢাকার জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশ ছাত্রই নয় বরং নগরীর অধিকাংশ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনযাত্রা এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ছাত্রছাত্রীদের ঘিরেই আবর্তিত হয়। বর্তমানে দেশের অধিকাংশ নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিজীবী, উচ্চপদস্থ বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তা, কুটনীতিক, টেকনোক্র্যাটস, ডাক্তার, আইনজীবী, রাজনীতিক এবং সাহিত্যিকগণ ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরই সৃষ্টি। শিক্ষার উন্নয়নের ফলেই নগরীর গুরুত্ব এবং সাফল্যের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে।

ব্যবসা ও বাণিজ্য  বিগত দুই শতকে ঢাকা ধীরে ধীরে এবং ক্রমাগতভাবে দক্ষিণ এশিয়াতে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হয়। মুগল আমলে এর সৌভাগ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্ভর করত মসলিন ও সূক্ষ্ম  বস্ত্রের উৎপাদন ও রপ্তানির উপর, এমনকি ইউরোপের রাজপরিবারের অনেকেই এর ক্রেতা ছিলেন। অবশ্য এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ভারতের সম্রাট এবং অন্যান্য রাজা ও অভিজাত সম্প্রদায়ের ব্যক্তিবর্গ। সাধারণভাবে বাংলায় মসলিনের সন্তোষজনক নিজস্ব বাজার ছিল। কিন্তু ইংরেজদের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় রাজশক্তির ক্ষমতার পতন হতে থাকে এবং নগরীর ব্যবসায়িক সমৃদ্ধি বিলীন হয়ে যায়। ১৭৪০-এর দশকে ঢাকায় উৎপাদিত মসলিনের (নগরী ও তার আশেপাশের স্থানসমূহে) পরিমাণ ছিল সাড়ে ২৮ লক্ষ টাকার কাছাকাছি। ১৮০০ সালের শেষ দিকে ঢাকায় উৎপাদিত মসলিনের মূল্য দাঁড়ায় ২৬ লক্ষ টাকায়। এরপরে মসলিনের উৎপাদন হ্রাস পায় প্রধানত ভারতীয় পৃষ্ঠপোষকদের অভাবে এবং ইংল্যান্ডে কারখানায় তৈরি সস্তা দরের বস্ত্রের আমদানির কারণে।

মসলিন উৎপাদন এবং এর বাণিজ্যের পতন নগরীর উপর বিপর্যয়কর প্রভাব ফেলে। অবশ্য ১৮২০ ও ১৮৩০ দশকের দিকে কিছু সময় ধরে নীলের ব্যবসা এবং পরবর্তীকালে ১৮৫০ এর দশকে পাটের বাণিজ্যের মাধ্যমে নগরটি তার ব্যবসায়িক সৌভাগ্য ফিরে পায়। ১৮৮০-এর দশকের মধ্যে ঢাকা নগরী পরিণত হয় পাট বাণিজ্য ও পাট উৎপাদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে। পরবর্তীকালে পাট রপ্তানির বিস্ময়কর বৃদ্ধি ঘটে এবং নারায়ণগঞ্জ থেকে তা সরাসরি পরিচালিত হয়। নারায়ণগঞ্জ ছিল কার্যত ঢাকার একটি বন্দর। সম্ভবত উনিশ ও বিশ শতকে পূর্ব বাংলার সম্পূর্ণ পাটের বাণিজ্য ঢাকা থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। পূর্ববাংলার পাট উৎপাদন ও তার বাণিজ্যের এ অঞ্চলকে শুধু সমৃদ্ধই করেনি বরং উনিশ শতকের শেষ দিক হতে ঢাকা নগরীর ভাগ্যের পরিবর্তনও ঘটায়। ঔপনিবেশিক আমলে এ অঞ্চলে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডে প্রতিযোগিতা দেখা দেয় এবং সেখান থেকে আদমানিকৃত মালামাল এ দেশের স্থানীয় বাজারে প্রাধান্য বিস্তার করে। এ পরিস্থিতিতে পাটজাত দ্রব্য, বস্ত্র, কাচ, রাসায়নিক পদার্থ এবং বিভিন্ন প্রকারের হস্তশিল্প সামগ্রী বিশেষত শঙ্খশিল্পজাত অলংকার উৎপাদনের ঢাকা এক ক্ষুদ্র কেন্দ্রে পরিণত হয়। যদিও এ সকল সামগ্রীর বাজার সমগ্র বাংলা জুড়েই বিস্তৃত ছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন

ঢাকার এ অবস্থা উপনিবেশিকোত্তর আমলে বর্ধিত বাণিজ্য ও শিল্পায়নের জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং বিভিন্ন উৎস থেকে মূলধন যোগানের সাথে সাথে অনেকটা বদলে যায়। সরকারের আমদানি-রফতানি নীতিও ইতিবাচক ফল বয়ে আনে। নগরীর সীমানার মধ্যেই সরকার শিল্প এলাকা স্থাপন করে, তেজগাঁও এলাকা ছিল এর প্রধান স্থান। অতি দ্রুত ঢাকা বস্ত্র শিল্প ও রেশমি দ্রব্য, সাবান, পাটজাত দ্রব্য, চামড়াজাত দ্রব্য, কাঁচ, দিয়াশলাই, লৌহ ও স্টিলের সামগ্রী, প্রকৌশল ও মোটর গাড়ির যন্ত্রাংশ, ঢালাই উপকরণ, ইট ও টালি, চীনামাটি ও মৃৎপাত্র, রাসায়নিক ও ঔষধ প্রস্ত্তত সংক্রান্ত সামগ্রী, প্ললাস্টিক দ্রব্যাদি, যেকোনো পানীয় (বেভ্যারিজ), ঠান্ডা পানীয় ও টিনজাত ফলের রস, কাগজ, ফিল্ম ইত্যাদির এক গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে।

স্বাধীনতাত্তোরকালে নগরীর শিল্পায়ন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের অগ্রগতির হার বিপুলভাবে বেড়ে যায়। যদিও যুদ্ধের কারণে প্রায় সব শিল্পকারখানা ধ্বংস হয়ে যায় এবং একই সাথে পশ্চিম পাকিস্তানিরা তাদের মূলধনও প্রত্যাহার করে নেয় তথাপি পুনর্বাসন কাজ বেশ দ্রুত শুরু হয়। সরকারি এবং বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করায় শিল্প ও উৎপাদনে বিনিয়োগও নিয়মিতভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ এবং বিশ্ব বাজারের মধ্যেও যোগসূত্র স্থাপিত হয়।

বর্তমানে ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকা দেশের বৃহত্তম শিল্প এলাকাগুলির মধ্যে একটি শিল্প অঞ্চল বলে বিবেচিত। এখানে বিভিন্ন প্রকার পণ্য ও শিল্পদ্রব্য, বিশেষ করে চিরাচরিত পণ্য সামগ্রী, যেমন বস্ত্র, রৌপ্য ও স্বর্ণের কাজ থেকে শুরু করে আধুনিক বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি পর্যন্ত উৎপাদিত হয়। এ সকল সামগ্রীর অধিকাংশই প্রস্ত্তত হয় যৌথ উদ্যোগের অধীনে। রফতানিকল্পে পণ্যসামগ্রী উৎপাদনের জন্য এখানে বিশেষ শিল্পবলয়ও (Industrial Zone) রয়েছে। এখানে সুনির্দিষ্টভাবে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন করা হয়। ‘পোশাক শিল্প’ হল বর্তমানে ঢাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কর্মকান্ড যার জন্য ঢাকা বিশ্ববাজারে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে নিয়েছে। পোশাক তৈরি কারখানাগুলি বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে চাহিদার ভিত্তিতে বস্ত্র ও পশমি সামগ্রী উৎপাদন করে। বর্তমানে দেশে পোশাক শিল্প খাত থেকেই সর্বাধিক বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জিত হয়। দেশের মোট পোশাক তৈরি কারখানার শতকরা ৮০ ভাগই ঢাকা নগরীতে অবস্থিত যেখানে কয়েক হাজার শ্রমিক, বিশেষ করে নারী শ্রমিক কর্মরত আছেন।

এভাবে ঢাকা দেশের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলিরও একটিতে পরিণত হয়েছে। এখানে স্থানীয় এবং বৈদেশিক, উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন পণ্য থেকে শুরু করে প্রসাধন সামগ্রী পর্যন্ত সকল পণ্যেরই জমজমাট বাণিজ্য চলে। ঢাকা নগরীতে বর্তমানে অসংখ্য বহুতল বিশিষ্ট আধুনিক বিপণিকেন্দ্র (departmental store) রয়েছে যেখানে বিভাগ ভেদে বিভিন্ন পণ্য বিক্রয় হয়। এভাবে আধুনিক দোকান এবং নতুন করে প্রতিষ্ঠিত বিপণিকেন্দ্রগুলি (shopping plaza) ক্রমে ক্রমে পুরনো ধাঁচের দোকান ও বাজারগুলির স্থানকে দখল করে নিচ্ছে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ  বর্তমানে দেশের সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান কেন্দ্র হচ্ছে ঢাকা। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত এ ব্যাংক দেশের সকল ব্যাংকিং ও আর্থিক লেনদেন নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ঢাকার আধুনিক ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলির যাত্রা শুরু হয় উনিশ শতকে। এর পূর্বে ব্যাংকের কারবার মোটামুটিভাবে দেশীয় পদ্ধতিতে এবং জগৎ শেঠ পরিবার-এর মাধ্যমে সম্পন্ন হতো যারা ছিলেন বাংলার নওয়াবদের ব্যাংকার। ঢাকায় অবস্থিত জগৎশেঠদের ব্যাংকের একটি শাখা থেকে নবাবী আমলে এ নগরীর প্রায় সকল আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন হতো।

বর্তমানে জাতীয় এবং মহানগরীর ‘চেম্বার অব কমার্স’ এবং ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলিরও মূল অফিস হচ্ছে ঢাকা। মোটকথা, দেশের সকল ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি ও রপ্তানি এ নগর থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক যেমন জনগণের আর্থিক বিষয়গুলি তদারক করে, তেমনি বিভিন্ন ধরনের ‘চেম্বার অব কমার্স’ বেসরকারি বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষা করে। সাম্প্রতিককালে বিকশিত শেয়ার বাজার নগরীর আর্থিক জীবনে এক নতুন সংযোজন।

জনসংখ্যা  নগরীর সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো জনসংখ্যা স্ফীতি। ১৮৭২ সালে প্রথম আদমশুমারিকালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ৬৯,২১২ জন; এরপর পর্যায়ক্রমে ১৮৮১ সালে ৭৯,০৭৬ জন; ১৯১১ সালে ১,২৫,০০০ জন এবং ১৯৪১ সালে ২,৩৯,০০০ জন। ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগের পর ভারত থেকে বসবাসের উদ্দেশ্যে এ অঞ্চলে বিহারি ও অন্যান্যদের আগমনের ফলে জনসংখ্যা ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ১৯৫১ সালে জনসংখ্যা ৩,৩৬,০০০ জনে পৌঁছে। ১৯৬১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী নগরীর জনসংখ্যা ছিল ৫,৫৬,০০০ জন, এক দশকে যা শতকরা হিসেবে প্রায় ৪৪.৬৩ ভাগ বৃদ্ধি। বৃদ্ধির এ হার নাটকীয়ভাবে আরও বেড়ে যায় ১৯৭১ সালের পর। ১৯৭৪ সালের মধ্যে তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ১,৬৮০,০০০ জনে; ১৯৮১ সালে তা ৩,৪৪০,০০০ জনে পৌঁছে এবং ১৯৯১ সালে জনসংখ্যা হয় ৬,১৫০,০০০ জন। বাস্তব বা কাল্পনিক যাই হোক না কেন নগরীর অভূতপূর্ব বিস্তার, চাকরি ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার প্রলোভন দেশের সব স্থান থেকে বিপুলসংখ্যক অধিবাসীকে ঢাকায় আসতে উদ্বুদ্ধ করে। নগরীর আইনগত ও প্রশাসনিক সীমানা বর্তমানে বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, নারায়ণগঞ্জ ও সাভার এ নগরীর অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এর জনসংখ্যা (২০০২ খ্রি) দাঁড়ায় ১ কোটিরও অধিক। বর্তমানে (২০১০) সালে ঢাকার জনসংখ্যা ধরা হয় ১.৫০ কোটি। অবশ্য বৃহত্তর ঢাকার সীমানার মধ্যেই রয়েছে পল্লী এলাকার অনেক টুকরো জমি এবং সেই সাথে অনেক পতিত জমি। জনসংখ্যার এ বিশাল বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে নগরীর আবাসিক এবং বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে; সেই সঙ্গে এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন, বিশেষত এর পরিবেশের উপর। নগরীর বিরাট এক অংশ জুড়ে গড়ে উঠেছে বস্তি যেখানে নিম্নবিত্ত, বাস্ত্তহারা মানুষদের (migrants) বসবাস।

পরিবহণ, বাসস্থান এবং নাগরিক সেবা  নগরীর ব্যাপক বিস্তার এবং জনসংখ্যার বিপুল বৃদ্ধি পুরনো দিনের পরিবহণ ব্যবস্থা, বাসস্থান এবং নাগরিক সুযোগ-সুবিধাকে সম্পূর্ণভাবে অপর্যাপ্ত এবং অনুপযুক্ত করে তোলে। উনিশ শতকে বেশির ভাগ মানুষ পায়ে হেঁটে বাড়ি থেকে কর্মক্ষেত্রে ও বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করত। অবশ্য ঘোড়ার ব্যবহার এবং অন্তত দোলাই খাল দিয়ে নৌকার চলাচল তখনও ছিল। নগরীর দ্রুত প্রসারের সাথে সাথে উনিশ শতকের পরিবহণ যথা, পালকি, টাট্টু ঘোড়া, হাতি ও ভাড়াটে গাড়ি (Hackney-carriages) প্রভৃতি বিশ শতকের  মাঝামাঝি সময়ে বিলীন হয়ে যায় এবং রিকশা, বাস ও গাড়ি ইত্যাদি নানা প্রকার যানবাহন এদের স্থান দখল করে। ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে ব্যক্তিমালিকানাধীন বিলাসবহুল বাস ও ট্যাক্সির প্রচলন হয়।

যদিও বর্তমানে (২০১২ সাল) নগরীর আবাসন সমস্যা প্রকট, তথাপি ঢাকার আবাসিক দৃশ্যপট গত দুই শতকে খুবই আকর্ষণীয় রূপে পরিবর্তিত হয়েছে। উনিশ শতকের ঢাকার দৃশ্যপট এখন সম্পূর্ণই বদলে গিয়েছে। ব্যক্তি মালিকানাধীন জমির উপর ধনী নাগরিকদের  ঘরবাড়ি ছাড়াও সবধরণের আয়ের লোকদের জন্য পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা এবং একই ধরনের আবাসিক কলোনি গড়ার ধীকল্প (idea) উনিশ শতকের শেষদিকেই শুরু হয়। এখন পর্যন্ত এ চিত্রই আবাসিক দৃশ্যপটে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। ১৯৮০-এর দশক থেকে উপযুক্ত জায়গার অভাবে নগরীর সর্বত্র বহুতলবিশিষ্ট সুউচ্চ ভবনসমূহ অফিস ও বাসভবন উভয় উদ্দেশ্যেই নির্মিত হচ্ছে।

কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, ঢাকা

স্থানীয় প্রকৌশলী, স্থপতি এবং নির্মাতাদের সঙ্গে বিদেশি কোম্পানি এ-কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত হয়ে নতুন ভবনসমূহ নির্মাণ করছে। সাম্প্রতিক কালে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ব্যয়বহুল ও বিলাসবহুল বাড়ি ও এপার্টমেন্ট গড়ে উঠেছে এবং কোন কোন এলাকা সর্বাধিক আকর্ষণীয় আবাসিক এলাকায় উন্নীত হয়েছে। এতদসত্তেও ঢাকার জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী বস্তির ঘনবসতিপূর্ণ কুটিরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করে। সম্প্রতি সরকার নিম্ন ও মধ্য আয়ের পরিবারের জন্য আবাসিক প্রকল্প গ্রহণ করেছে।

ঢাকায় আধুনিক ধারার নাগরিক সেবা আরম্ভ হয় উনিশ শতকের শেষ ভাগে, ১৮৬৪ সালে ঢাকা মিউনিসিপালিটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। তখন থেকে বাড়ি নির্মাণের উপর কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, প্রশস্ত রাস্তা নির্মিত হয়, রাস্তা ঝাড়ু দেওয়া, শৌচাগার পরিষ্কার করা ও পাইপ লাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা শুরু হয়, বাজার নিয়ন্ত্রিত হয়, ট্রাফিক ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়, এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা স্থাপিত হয়। সরকারি অনুদান এবং ব্যক্তিগত বদান্যতা উভয় প্রচেষ্টায় এ কর্মকান্ড বাস্তবায়িত হয়।

গত ত্রিশ বছর বা এর কিছু বেশি সময়ে নাগরিক সেবা এবং পৌর সুবিধাদি বৃদ্ধি পেয়েছে। নগরীর বিভিন্ন অংশের সাথে সংযোগ স্থাপন এবং সেই সাথে দেশব্যাপী সংযোগ স্থাপনকারী জালের ন্যায় বিস্তৃত রাস্তা নির্মিত হয়। নগরীর যানজট নিরসনে এ পর্যন্ত দুটি ফ্লাইওভার নির্মিত হয়েছে। মহাখালী ও খিলগাঁও ফ্লাইওভার ছাড়াও যাত্রাবাড়িতে তৃতীয় বৃহত্তম ফ্লাইওভারটি নির্মাণাধীন রয়েছে। তাছাড়াও এশিয়ান হাইওয়ে, টঙ্গী ডাইভারশন রোড, ভিআইপি রোড, বিজয় সরণি, রোকেয়া সরণি, মিরপুর-মোহাম্মদপুর রোড, সাত মসজিদ রোড, ঢাকা-সায়েদাবাদ রোড ইত্যাদি নগরীর উল্লেখযোগ্য রাস্তাগুলির উন্নয়ন করা হয়েছে। এ সকল রাস্তা থেকে অনেক ছোট ছোট রাস্তা শাখা প্রশাখার মতো বেরিয়ে এসেছে।

নগরীতে গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়েছে ১৯৭০-এর দশক হতে যা একটি বৃহত্তর সাহায্যকারী উপাদান যা রাজধানীকে আধুনিক পর্যায়ে উন্নীত করেছে, সেইসাথে কয়লা ও কাঠের দূষণ থেকে রাজধানীকে মুক্ত করতেও সাহায্য করেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ নিষ্কাশন থেকে গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি সরবরাহ প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। একইভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ সাম্প্রতিক কালে যথেষ্ট বাড়লেও তা এক কোটির অধিক নগরবাসী এবং এর প্রচুর শিল্প কলকারখানার নানাবিধ কর্মকান্ডে ব্যবহারের জন্য পর্যাপ্ত নয়। গৃহকার্য, শিল্পকারখানা, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও ক্লিনিক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং খেলাধুলার স্থানসমূহে ক্রমবর্ধমান চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ সরবরাহ এতই অপ্রতুল যে নগরীকে এখন বাধ্যতামূলকভাবে বিদ্যুৎ ঘাটতি পোহাতে হচ্ছে (২০১২)।

টেলিফোন, টেলেক্স, ফ্যাক্স, মোবাইল ফোন, ই-মেল এবং অতি সম্প্রতি ইন্টারনেট-এর বিরাট সরবরাহ নগরীর যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং বাইরের জগতের সাথে এর সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে এক আমূল পরিবর্তন এনেছে।

সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড  আঞ্চলিক রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং খেলাধুলা বিষয়ক কর্মকান্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে ঢাকা দক্ষিণ এশিয়ার একটি অন্যতম প্রধান রাজধানী শহর। এখানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শিল্প, সঙ্গীত, সিনেমা, থিয়েটার, নৃত্য এবং সাহিত্য বিষয়ক সম্মেলন ও উৎসবগুলি নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হয়। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় হতে ঢাকায় পাশ্চাত্য প্রভাবিত থিয়েটারভিত্তিক নাট্যচর্চা শুরু হয়। পরবর্তীকালে মঞ্চে অভিনয়ের ক্ষেত্রে অভিনেত্রী হিসেবে মহিলাদের আবির্ভাব ঘটে, যা ঢাকার রক্ষণশীল সমাজে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। বর্তমানে নাটক হচ্ছে নগরীর সবচেয়ে জনপ্রিয় বিনোদন মাধ্যমগুলির একটি। এ সকল কর্মকান্ডের কেন্দ্রস্থল হচ্ছে সেগুনবাগিচা, রমনা এবং শাহবাগ এলাকা যা একটি বলয়ের মতো এবং বাস্তবিকই অতিসম্প্রতি এ এলাকাটিকে ‘ঢাকা সাংস্কৃতিক বলয়’ হিসেবে পরিকল্পনার আওতায় আনা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীবাংলা একাডেমী, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বাংলাদেশ জাতীয়  আর্কাইভস ও গ্রন্থাগার, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, নজরুল ইনস্টিটিউট, চারুকলা ইনস্টিটিউট, বুলবুল ললিতকলা একাডেমী এবং অন্যান্য অনেক সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এক্ষেত্রে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে।

বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম ও শিল্প ব্যাংক ভবন

অতি সম্প্রতি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট, ফুটবল, হকি, ভলিবল এবং অন্যান্য বিষয়ে খেলার আয়োজন করে স্বাগতিক দেশের রাজধানী হিসেবে ঢাকার নাম আন্তর্জাতিক খেলাধুলার অঙ্গনে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছে। বিশেষভাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট প্রতিযোগিতার স্থান হিসেবে ঢাকার উত্থানে বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষের মুখে বাংলাদেশের নাম উচ্চারিত হচ্ছে।

এ উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামকে বিশেষভাবে নির্বাচন করা হয়েছে। ২০১১ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদ্ভোধণী অনুষ্ঠান বঙ্গবন্ধু জাতীয় ষ্টেডিয়ামে ও ম্যাচসমূহ ঢাকার মিরপুর ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়েছে। অন্যান্য আন্তর্জাতিক কর্মকান্ডের মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে বইমেলা। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র প্রতিবছর এটি উদযাপন করে থাকে। বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাস ব্যাপী একুশে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। প্রকৃতপক্ষে এটি একটি সাধারণ মেলার চাইতেও অনেক বেশি গুরুত্ববহ। কেননা এ উপলক্ষে বাংলাদেশের সংস্কৃতির পরিপূর্ণ বিস্তার ঘটে এবং মাতৃভাষা বাংলার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার অনুভূতি প্রকাশিত হয়। বস্ত্তত বই প্রকাশনা এবং ক্রয়-বিক্রয় বর্তমানে ঢাকার একটি সমৃদ্ধশালী শিল্প; এ শিল্পের প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে বাংলাবাজার এলাকা।

বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদ

মাতৃভাষা রক্ষার জন্য ঢাকায় জীবন উৎসর্গকারী শহীদদের স্মৃতিরক্ষার উদ্দেশে, একুশে ফেব্রুয়ারিকে ১৯৯৯ সালে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে সম্প্রতি ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এর ফলে বাংলা বই-এর প্রকাশনার ক্ষেত্রে প্রেরণার সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি, বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানের জন্য বিক্ষোভ প্রদর্শনকালে ঢাকার ছাত্র এবং নাগরিকরা পাকিস্তানি পুলিশ বাহিনীর হাতে নির্যাতিত এবং তাঁদের কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হন। মেডিক্যাল কলেজের নিকটে গুলিতে ছাত্রদের নিহত হওয়ার স্থানে এ নির্মম ঘটনা এবং ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিরক্ষার উদ্দেশ্যে নির্মিত হয় স্মৃতিস্তম্ভ শহীদ মিনার। এ মিনার বরাবরই বাঙালির জন্য প্রতিবাদের প্রতীক এবং বর্তমানে এটিকেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বিশ্বজনীন প্রতীক হিসেবেও গ্রহণ করা হয়েছে।

বর্তমানে ঢাকা দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিনোদন কেন্দ্রগুলির মধ্যে একটি যেখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি সিনেমা হল, নাট্য ও সঙ্গীত মিলনায়তন। এ নগরী জাদুঘর, লাইব্রেরি, আর্ট গ্যালারি, ক্লাব এবং রেস্টুরেন্ট দ্বারা সুশোভিত হয়ে আছে।

তারা মসজিদ
আহসান মঞ্জিল
কার্জন হল
জাতীয় সংসদ ভবন

স্থাপত্য  মুগল আমল থেকে ইন্দো-ইসলামিক রীতিতে নির্মিত মনোরম মসজিদগুলির সংখ্যাধিক্যের কারণে ঢাকা ‘মসজিদের শহর’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। উনিশ শতকে ইন্দো-ব্রিটিশ রীতিতে নির্মিত বেশ কিছু ভবন ঢাকাতে রয়েছে। আহসান মঞ্জিল, মিটফোর্ড হাসপাতাল, রূপলাল হাউস, বর্ধমান হাউস, রোজ গার্ডেন এবং বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কার্জন হল নগরীর স্থাপত্যিক নিদর্শনসমূহের মধ্যে অন্যতম। পাকিস্তান আমলে এ নির্মাণশৈলী নতুন মোড় নেয় এবং এসময় পশ্চিমা রীতি, বিশেষত আমেরিকানদের প্রভাব স্থাপত্যে স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র- এর নির্মাণ হচ্ছে এ ধারার গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। আমেরিকান স্থপতি লুই কানের (Louis Kahn) নকশাকৃত জাতীয় সংসদ ভবন বা পার্লামেন্ট ভবনের নির্মাণ এবং শের-এ-বাংলা নগরে দ্বিতীয় রাজধানীর পরিকল্পনা ও উন্নয়নে অবশ্য এ প্রভাব কমে আসে। তবে স্থাপত্যিক পরম উৎকর্ষের জন্য নকশাটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে। বর্তমানে এ ভবন আধুনিক ঢাকার স্থাপত্যশিল্পের একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন হিসেবে চিহ্নিত।

বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর
রাজউক ভবন
বঙ্গভবন
হোটেল রূপসী বাংলা (প্রাক্তন শেরাটন)

খাদ্য এবং রান্নাবান্না  সম্পর্কিত খ্যাতি বিদেশি খাদ্য এবং রান্নাবান্নায় পারদর্শিতার ক্ষেত্রে ঢাকার খ্যাতি গত কয়েক শতাব্দী ধরে অক্ষুণ্ণ রয়েছে। ঐতিহ্যবাহী মুগল খাদ্য যেমন- পোলাও, বিরিয়ানি, বাকরখানি এবং বিভিন্ন প্রকারের মিষ্টান্ন এ এলাকার সুখ্যাতিকে ধরে রেখেছে এবং স্থানীয় ও বিদেশিদের কাছে খাবারগুলি আজও খুব প্রিয়। সম্প্রতি ঢাকার সাথে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের ফলে চাইনিজ, থাই, ইরানিয়ান, ইউরোপিয়ান রেস্টুরেন্ট এবং উল্লেখযোগ্যভাবে আমেরিকান ফাস্ট ফুড চেইন গড়ে উঠেছে। এগুলি বেশ জনপ্রিয় খাদ্য এবং স্থানীয়দের কাছেও প্রিয় হয়ে উঠেছে। নগরীতে আরও আছে পর্যাপ্ত পরিমাণে পাশ্চাত্য ধরনের পাঁচতারা হোটেল। প্যান প্যাসিফিক হোটেল সোনারগাঁও এবং শেরাটন হোটেল (বর্তমানে রূপসী বাংলা) হচ্ছে এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য; এগুলি ঢাকাকে আন্তর্জাতিকভাবে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছে।

বর্তমানে ঢাকা একটি সমৃদ্ধ ও ক্রমবর্ধমান নগরী যেখানে ব্যাপকভাবে বাণিজ্যিক, শিল্পসংক্রান্ত, আর্থিক, খেলাধুলাবিষয়ক এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড সম্পাদিত হয়। রাজধানী শহর এবং দেশের প্রশাসনিক সদর দফতর হওয়াতে এটি রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালীও বটে। চতুর্দিকে বর্ধিত হয়ে এ নগরী প্রায় ৩৬০ বর্গকিলোমিটার (ঢাকা সিটি কর্পোরেশন) এলাকাতে বিস্তার লাভ করেছে এবং বর্তমানে এর জনসংখ্যা প্রায় দেড় কোটি (২০১১)। প্রায় ক্ষেত্রেই কোনো কাজকর্ম ছাড়া গ্রামাঞ্চল এবং জেলা শহরগুলি থেকে লোকজনের অব্যাহত আগমন নগরীর অপ্রতুল বাসস্থান এবং অন্যান্য সুবিধাদির উপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করছে। ফলে পানি সরবরাহের স্বল্পতা, স্বাস্থ্যবিষয়ক ঝুঁকি এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিতিশীলতা হতে সৃষ্ট বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।  [শরীফ উদ্দিন আহমেদ]

ঢাকা (পারিসরিক বৃদ্ধি) বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর তীরে ধলেশ্বরী বুড়িগঙ্গার সঙ্গমস্থলের প্রায় ১৩ কিমি উজানে অবস্থিত (২৩°-৪৩´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯০°-২৪´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ)। স্থানটি পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার সাথে ছোট ছোট নদী দ্বারা সংযুক্ত। ফলে দেশের যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্থানের সাথে পণ্য পরিবহনযোগ্য। স্থল যোগাযোগের ক্ষেত্রেও ঢাকা সুবিধাজনক স্থানে, কেননা পুরানো পলল ভূমি গঠিত ভূখন্ডের দক্ষিণ সীমান্তের নগরটি সাধারণ বন্যার সময় চারপাশের নদী সমতল থেকে উঁচুতে অবস্থিত। নগরের উত্তর অংশ লাল মাটি অঞ্চলে অবস্থিত, যা উত্তরে ময়মনসিংহ পর্যন্ত বিস্তৃত।

সাভারের সামান্য নিচে ধলেশ্বরী থেকে উদ্ভূত হয়ে বুড়িগঙ্গা নগরের পশ্চিম ও দক্ষিণ দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ডান দিকে বাঁক নিয়ে ফতুল্লার পরেই পুনরায় ধলেশ্বরীতে মিলিত হয়েছে। নদীটি এভাবে নগরের দক্ষিণ ও পশ্চিম সীমানা নির্ধারণ করে। আরও কিছু জলধারা (প্রধানত দোলাই খাল, পান্ডু নদী এবং বালু নদী) নগরীর মধ্য ও আশপাশ দিয়ে প্রবাহিত। ফলে নগরের বৃদ্ধিতে একটি ভূপ্রকৃতিগত বাঁধার সৃষ্টি হয়েছে। নগরটি দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা থেকে উত্তরে প্রকৃত অর্থে টঙ্গী নদী পর্যন্ত বিস্তৃত এবং এ উঁচুভূমির বিস্তার দুপাশে সমাপ্ত হয়েছে নিচু জলাভূমি এবং পুরাতন নদী-চরের মাঝে। নিচু জলমগ্ন এলাকা উঁচুভূমির একেবারে মাঝে এসে প্রবেশ করেছে, যেমন- পশ্চিম থেকে পূর্বে, মিরপুর থেকে ক্যান্টনমেন্টের নিচু ভূমিতে এবং পূর্ব থেকে পশ্চিমে বারিধারা, খিলক্ষেত, উত্তরার নিচু ভূমিতে। ফলে নগরের পারিসরিক বৃদ্ধি খুব সহজে এবং নির্বিঘ্নে ঘটে নি। নগরটির অস্তিত্বের বিভিন্ন পর্যায়ে ভূমিরূপ এর বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে।

প্রাক্-মুগল পর্যায় ঢাকার প্রাক্-মুসলিম অতীত অস্পষ্ট। দশম থেকে তের শতক পর্যন্ত নিকটবর্তী রাজধানী শহর বিক্রমপুরই ছিল বিখ্যাত। উক্ত সময়ে এ এলাকায় জনবসতির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় মুসলমানদের (তেরো শতকের শেষার্ধ এবং চৌদ্দ শতকের প্রথম দিকে) আধিপত্য বিস্তারের পর নিকটবর্তী সোনারগাঁও প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে। প্রাক্-মুগল আমলে (চৌদ্দ থেকে ষোল শতকে) দুটি মসজিদের উৎকীর্ণ লিপি, ধ্বংসাবশেষ এবং লিখিত দলিলে, বিশেষত বাহারিস্তান-ই-গায়েবী থেকে স্বল্প গুরুত্বের একটি ছোট শহর হিসেবে ঢাকার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। বুড়িগঙ্গার বাম তীরে (উত্তর) বাবু বাজারের পূর্ব, উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব অংশ নিয়েই গড়ে ওঠে প্রাক্-মুগল ঢাকা (মানচিত্র-১)। প্রাক্-মুগল আমলে হিন্দু নাম বিজড়িত লোকালয় নিয়ে গড়ে ওঠা পুরনো ঢাকার এ অংশটিতে (যেমন- লক্ষ্মীবাজার, বাংলাবাজার, সূত্রাপুর, জালুয়ানগর, বানিয়ানগর, গোয়ালনগর, তাঁতিবাজার, শাঁখারিবাজার, ছুতারনগর, কামারনগর, পটুয়াটুলি, কুমারটুলি ইত্যাদি) হিন্দু কারিগর ও পেশাজীবীদের প্রাধান্যের ইঙ্গিত পাওয়া যায়, যা বাণিজ্যিক গুরুত্ব সহকারে রাজধানী সোনারগাঁয়ের সন্নিকটে গড়ে ওঠেছিল। সোনারগাঁও থেকে নদীপথে যোগাযোগের উপর ভিত্তি করে প্রাক্-মুগল ঢাকার লোকালয়গুলি গড়ে ওঠেছিল। বুড়িগঙ্গা এবং দোলাই নদী এর দক্ষিণ এবং পূর্ব সীমানা নির্দেশ করত। তবে এর পশ্চিম সীমানা চিহ্নিত করা কঠিন। নসওয়ালগলি মসজিদ লিপিকে (১৪৫৯ খ্রি.) হিসাবে এনে এর প্রাপ্তিস্থানে (বর্তমান কেন্দ্রীয় কারাগারের পশ্চিম পার্শ্ব) যদি মসজিদের অবস্থান ধরা হয় এবং যদি মুগল আগমনের পূর্বেও ঢাকেশ্বরী মন্দিরের অস্তিত্ব থেকে থাকে, যার সম্ভাবনা যথেষ্ট, তাহলে এ ধারণা খুবই সঙ্গত যে, নগরের পশ্চিম সীমানা বাবুর বাজার ছাড়িয়েও ঢাকেশ্বরী-উর্দু রোড পর্যন্ত ছিল। মিরপুরে শাহ আলী বাগদাদীর (যিনি ১৫৭৭ খ্রি. মারা যান) দরগাহর অস্তিত্ব এ এলাকায় প্রাক্-মুগল বসতি প্রমাণ করে। এটি খুবই সম্ভব যে, বুড়িগঙ্গার প্রবাহ বরাবর নগরের দক্ষিণ, পশ্চিম এবং উত্তর-পশ্চিম অংশে বসতি গড়ে ওঠে। নগরের পশ্চিম অংশটি, নদী তীরের রায়ের বাজার কুমারপাড়া হিসেবে গড়ে ওঠে, যদিও এ বসতিটির স্থাপনা সময় সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যায় না। অবশ্য নদীর তীরে গড়ে ওঠা এসব বসতি ছিল বিক্ষিপ্ত। তবে বাবুর বাজারের পূর্ব অংশটিই ছিল ঘন বসতিপূর্ণ।

মানচিত্র-১

মুগল আমল প্রাক্-মুগল ঢাকা আকবর এর সামরিক অভিযানের সময় একটি থানায় (সামরিক ঘাঁটি) রূপান্তরিত হয়। কিন্তু এটি প্রসিদ্ধ হতে শুরু করে ১৬১০ সালে ইসলাম খান চিশতি যখন সুবাহর রাজধানী এখানে স্থানান্তরিত করে এর নাম দেন জাহাঙ্গীরনগর। বাহারীস্তান থেকে জানা যায় যে, ইসলাম খান চিশতীর সময়ে দুর্গ (বর্তমান কেন্দ্রীয় কারাগার) এবং দুর্গের সোজা দক্ষিণে নদীতীরের চাঁদনিঘাট এলাকা দুটি গড়ে ওঠে। দুর্গ এবং চাদনিঘাটের মধ্যবর্তী এলাকার বাজারটি (বর্তমান চকবাজার), যার পূর্বের নাম বাদশাহী বাজার, এবং দুর্গের পশ্চিমে উর্দুবাজার সম্ভবত একই সময়েই গড়ে উঠেছিল। বাবুর বাজারের নিকটবর্তী বুড়িগঙ্গা থেকে মালিটোলা-তাঁতিবাজারের নিকটে দোলাই খাল পর্যন্ত একটি খাল খননের কৃতিত্ব ইসলাম খানের। কার্যত এ খালটিই ‘পুরানো ঢাকা’র সাথে ইসলাম খানের ‘নতুন ঢাকা’র সীমানা নির্ধারণ করত (মানচিত্র-২)। নদী তীরের সমান্তরালে বাবুর বাজার থেকে পাটুয়াটুলি পর্যন্ত এলাকাটি ইসলামপুর নামে পরিচিত ছিল। বংশাল-মালিবাগ এলাকার পুরানো মুগলটুলির অস্তিত্ব ‘পুরানো ঢাকা’য় মুগলদের প্রথম দিকের দখলদারিত্ব প্রমাণ করে।

মানচিত্র-২

১৭১৭ সালে মুর্শিদাবাদে রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ার পূর্বপর্যন্ত ইসলাম খান কর্তৃক সূচিত ‘নতুন ঢাকা’ পরবর্তী সুবাহদারদের দ্বারা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। একশ বছরের কিছু বেশি সময় ধরে ঢাকা প্রাদেশিক রাজধানীর সম্মান উপভোগ করে। প্রশাসনিক প্রয়োজনের সাথে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যিক কর্মকান্ড যুক্ত হয়ে ঢাকা একটি ছোট শহর থেকে মহানগরে পরিণত হয়। মুগল ঢাকা নিজের ভেতরেই ‘পুরানো ঢাকা’কে গ্রাস করে পূর্বে নারিন্দা, পশ্চিমে মানেশ্বর ও হাজারিবাগ এবং উত্তরে রমনার প্রান্তস্থিত ফুলবাড়িয়া এলাকা পর্যন্ত (বর্তমান কেন্দ্রীয় টেলিফোন এক্সচেঞ্জ-এর দক্ষিণে যেখানে এক সময় ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন অবস্থিত ছিল) বর্ধিত হয়েছে। পশ্চিম সীমান্তে গড়ে ওঠেছিল পিলখানা। পশ্চিমে দুর্গ ও পিলখানার মধ্যবর্তী স্থান এবং উত্তরে দুর্গ ও ফুলবাড়িয়ার মধ্যবর্তী স্থানে রাজকীয় কর্মকর্তা, সরকারি কর্মচারী, ব্যবসায়ী প্রভৃতিদের আবাসিক এলাকা গড়ে ওঠে। পরিকল্পনাহীন ভাবে গড়ে ওঠা কুন্ডুলিপাঁকানো রাস্তাসহ (পুরনো ঢাকা নামে পরিচিত) নগরটি সুস্পষ্টভাবেই মুগল শহরের ছাপ বহন করছে। দুর্গটি ছিল শহরের প্রধান কেন্দ্র। শহরের অন্যান্য এলাকা (মহল্লা) গড়ে উঠেছিল আবাসিক ও বাণিজ্যিক প্রয়োজনে। দুর্গের দক্ষিণ এবং একেবারে নদী পর্যন্ত দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ গড়ে উঠেছিল বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে এবং উত্তর-পূর্ব  এবং  উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল ছিল আবাসিক এলাকা।

নগরের উত্তর সীমানা বর্ধিত ছিল মীরজুমলা (১৬৬০-১৬৬৩) কর্তৃক নির্মিত প্রধান ফটক পর্যন্ত। বর্তমানে এ তোরণটি আধুনিক সমাধিসৌধ তিন নেতার মাযারের নিকটে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান গ্রন্থাগার-এর পূর্বে অবস্থিত। মীরজুমলা রাজধানী প্রতিরক্ষার জন্য দুটি দূরবর্তী দুর্গের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী রাস্তা তৈরি করেছিলেন। একটি রাস্তা ছিল উত্তরে টঙ্গী-জামালপুর দুর্গ এবং অপরটি  পূর্বে  ফতুল্লা  দুর্গ  পর্যন্ত।  এ দুদিকে শহরের বৃদ্ধিতে রাস্তা দুটির প্রভাব অবশ্যই ছিল।

শায়েস্তা খান এর আমলে (১৬৬৩-১৬৭৮; ১৬৭৯-১৬৮৮) ঢাকার বৃদ্ধি এবং দালান-কোঠা নির্মাণ হয়েছে ব্যাপক হারে। ১৬৬৬ সালে ঢাকায় আগত জে.বি টেভার্নিয়ার এর মতে ঢাকা ছিল একটি বিশাল শহর। তিনি বলেন ঢাকা বৃদ্ধি পায় শুধু লম্বায়, কারণ সবাই নদীর ধারেই বাস করতে চাইত। টমাস বাউরি (১৬৬৯-১৬৭৯ সময়ের মধ্যে লেখা) ঢাকার পরিধি প্রায় ৪০ মাইল বলে উল্লেখ করেছেন।  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম দিকের দলিল অনুযায়ী (১৭৮৬ ও ১৮০০) শহরের সীমানা ছিল- দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা, উত্তরে টঙ্গী, পশ্চিমে জাফরাবাদ, মিরপুর এবং পূর্বে পোস্তগোলা। তবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে মীরজুমলার ঢাকা তোরণের উত্তরে লোকবসতি ছিল বিক্ষিপ্ত। ইউরোপীয় বাণিজ্য কোম্পানিগুলির ফ্যাক্টরিসমূহ ছিল তেজগাঁও এলাকায়। ফুলবাড়িয়া এবং ঢাকা তোরণের মধ্যবর্তী এলাকাটি, যা বাগ-ই-বাদশাহী নামে পরিচিত ছিল, মূল মুগল শহরের বাইরে একটি বহিস্থবলয় তৈরি করেছিল। মুগল শহরের বিস্তার হয়েছিল মূলত দুর্গের পশ্চিম দিকে এবং নদীতীর বরাবর মুগল বসতি বর্ধিত হয়েছিল শহরের উত্তর-পশ্চিম দিকে জাফরাবাদ-মিরপুর এলাকা পর্যন্ত। শায়েস্তা খানের সাতগম্বুজ মসজিদ পর্যন্ত বিস্তৃত বর্তমান সাতমসজিদ সড়কটি সম্ভবত উত্তর-পশ্চিম অক্ষে মুগল বসতি গড়ে তুলতে সহায়তা করে। মীরজুমলা কর্তৃক নির্মিত বাগ-ই-বাদশাহী ও টঙ্গী সামরিক ঘাটির মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনকারী সড়কটি (পরবর্তীকালে ঢাকা ময়মনসিংহ সড়কের অংশ) শহরের ওই দিকে ভবিষ্যৎ উন্নয়নের অক্ষ তৈরি করেছে।

লক্ষণীয় যে, ঢাকা ধারাবাহিক ভাবে উঁচু ভূমির উপর অবস্থিত ছিল না। দক্ষিণে বুড়িগঙ্গার সমান্তরালে পূর্বে পোস্তগোলা থেকে পশ্চিমে হাজারিবাগ পর্যন্ত একফালি উঁচু ভূমি ছিল এবং এ বলয়ের উত্তর সীমানা মুগলদের বাগ-ই-বাদশাহী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এ বলয়ের উত্তর থেকে টঙ্গী পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলটি পূর্ব ও পশ্চিম উভয় দিক থেকে খাল, জলাশয় এবং নিচু জলাভূমি দ্বারা বিচ্ছিন্ন। পশ্চিম পার্শ্বের ধানমন্ডি, শ্যামলী-কল্যাণপুর এবং মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় রয়েছে নিচু জলাভূমি। অন্যদিকে পূর্ব পার্শ্বে কারওয়ান বাজারের দক্ষিণে উঁচু ভূমির মাঝে বেগুনবাড়ি খালের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে নিচু এলাকা। এ নিচু ভূমি উত্তরে অগ্রসর হয়ে গুলশান, বনানীর উঁচু ভূমি পর্যন্ত বর্ধিত। গুলশান-বনানীর এ উঁচু ভূমির বলয়টি উত্তরা ও টঙ্গী পর্যন্ত বিস্তৃত। এ এলাকাটি উভয় পার্শ্বে নিচু ভূমি ও জলাশয় দ্বারা বেষ্টিত, যা পশ্চিমে তুরাগ এবং পূর্বে বালু নদী দ্বারা প্ললাবিত হয়। মুগল আমলে নগরের বৃদ্ধি স্বাবাভিকভাবেই প্রকৃতির এ প্রভাবকে অনুসরণ করেছে। ঢাকা কলেজ-নিউ মার্কেট পর্যন্ত ধানমন্ডি এলাকাটি ছিল ধানি জমি।

বাণিজ্যিক গুরুত্বের কারণেই ঢাকা ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের আকৃষ্ট করে। এদের মধ্য ছিল পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ইংরেজ,  ফরাসি এবং  আর্মেনীয়গণ। এরা সকলেই সতেরো শতকে ঢাকায় তাদের বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন করে। তেজগাঁও এলাকাতে তারা তাদের ফ্যাক্টরি গড়ে তোলে, ফলে তেজগাঁও এলাকা পরবর্তী শতক এবং তারপরও বাণিজ্যিক এলাকার গুরুত্ব পেতে থাকে। কারওয়ান বাজারের উত্তরে (মুগল আমলেও গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র) এবং অধুনালুপ্ত খাজা আম্বর ব্রিজ-এর অক্ষ বরাবর মীরজুমলা কর্তৃক নির্মিত সড়কের উভয় পার্শ্বে ইউরোপীয় বসতি গড়ে ওঠে।

মানচিত্র-৩

১৭১৭ সালে প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত হলে ঢাকার গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। ঢাকা হয়ে ওঠে নায়েব নাজিমের আস্তানা এবং পূর্ববাংলার মুগল সামরিক ও নৌ বাহিনীর সদর দপ্তর। তবে ইউরোপীয় বণিকদের বাণিজ্যিক কর্মকান্ড তখনও ঢাকাকে জীবিত রাখে, যদিও তার পারিসরিক কোনো বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয় না। ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দীউয়ানি লাভ করার পর ঢাকার পতন শুরু হয়। যদিও প্রাদেশিক বিচার বিভাগ ও আপিল দপ্তর ঢাকাতেই ছিল তথাপি ১৮২৮ সাল নাগাদ নগরটি শুধু একটি জেলা সদরে পরিণত হয়। আঠারো শতকের শেষের দিকে এবং ঊনিশ শতকের প্রথম দিকে সূতিবস্ত্র বাণিজ্যের পতন হলে এ ধ্বংস ত্বরান্বিত হয় এবং ১৮৪০ সাল নাগাদ এ পতন চরমে পৌঁছায়। অধিকাংশ মুগল শহরই হয় পরিত্যক্ত নয় জঙ্গলাকীর্ণ হয়েছে। ঢাকা হয়ে ওঠে সংকুচিত। একদা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হয় লোকশূন্য। ১৮৫৯ সালে প্রস্ত্ততকৃত একটি মানচিত্র থেকে দেখা যায় যে, এ সময় ঢাকা নগর দৈর্ঘ্যে সোয়া তিন মাইলের সামান্য বেশি এবং প্রস্থে সোয়া এক মাইলের মতো জায়গা দখল করে আছে (মানচিত্র-৩)।

প্রাথমিক উপনিবেশিক পর্যায় ১৮৪০ সালে মিউনিসিপ্যাল কমিটি এবং ১৮৪১ সালে ঢাকা কলেজের প্রতিষ্ঠা ঢাকার জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ ধীরে ধীরে নগরটিকে ইউরোপীয় প্রভাবাধীন আধুনিক শহরের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধটি ছিল এর পারিসরিক পুনর্জন্মের। শহর সীমানা বৃদ্ধি না পেলেও মুগল শহরটি পাকা রাস্তা, উম্মুক্ত জায়গা, রাস্তার আলো, পাইপের মাধ্যমে পানি সরবরাহ ইত্যাদি সমৃদ্ধ হয়ে একটি আধুনিক শহরে পরিণত হয়। ১৮২৫ সালে ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ডয়েস এ প্রক্রিয়া শুরু করেন। তার পদক্ষেপের মধ্যে ছিল রমনা এলাকা পরিষ্কার করে রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) স্থাপন। রাসেল স্কিনার (ম্যাজিস্ট্রেট, ১৮৪০) এ উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখেন। আর্মেনীয় এরাতুন জমিদার পরিবার রেসকোর্স ময়দানের পশ্চিমে (বর্তমান অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন এবং টি.এস.সি এলাকা) কিছু জায়গা কিনে একটি বাড়ি র্নিমাণ করে। ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে খুব অল্প সময়ের মধ্যে ঢাকা নওয়াব পরিবার রেসকোর্স ময়দানের পশ্চিম পার্শ্বস্থ এলাকার উন্নয়ন সাধন করে এবং বেশ বড় আকারের ভবন, কমপ্লেক্স এবং বাগান নির্মাণ করে। এলাকাটি শাহবাগ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। নওয়াবগণ (খাজা আলীমুল্লাহর পরিবার) শুধু শাহবাগই নয় শহরের উত্তর-পূর্ব অংশে দিলকুশা এবং মতিঝিল এলাকাও গড়ে তোলেন। ঐসব এলাকায় তারা বিনোদনের জন্য বাগান বাড়ি নির্মাণ করেন।

ডয়েস নওয়াবপুরের উত্তর-পূর্ব অংশ পরিষ্কার করে এলাকাটিতে সেনাছাউনি স্থাপন করেন। এ এলাকাটিই পরবর্তী সময়ে পুরানা পল্টন নামে পরিচিত হয়। অবশ্য মশার প্রকোপের কারণে ১৮৫৩ সালে সেনাছাউনিটি লালবাগ দুর্গে সরিয়ে নেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিপ্লব এর পর শহরের পূর্ব সীমানায় নদী তীরের মিল ব্যারাকে সেনাছাউনি স্থানান্তরিত হয়। পুরানা পল্টন এলাকা সিপাহিদের অনুশীলনের ময়দান হিসেবে ব্যবহূত হতে থাকে। এর কিছু অংশ অবশ্য কোম্পানির বাগান এবং খেলার মাঠে পরিণত হয়।

ঊনিশ শতকের শেষ এক-চতুর্থাংশ পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা নদীতীর এলাকায় ঢাকার উন্নয়ন ঘটতে থাকে। এখানে ধনীরা আহসান মঞ্জিল এবং রূপলাল হাউসের মতো বেশ কিছু চমৎকার ভবন নির্মাণ করেন। বিভাগীয় কমিশনার সি.ই বাকল্যান্ড কর্তৃক নদীর উত্তর তীরে বাঁধ র্নিমাণের ফলে নদী-সম্মুখস্থ উপরের প্রশস্ত এলাকাটি একটি চিত্তাকর্ষক এলাকায় পরিণত হয়। বাকল্যান্ড বাঁধটিকে প্রকৃতি প্রেমীদের মিলনস্থলে পরিণত করে (ঊনিশ শতকের আশির দশকে তিনটি পর্যায়ে এ নির্মাণ সম্পন্ন হয়)। ঢাকা গভর্নমেন্ট স্কুল, মিটফোর্ড হাসপাতাল, ঢাকা ওয়াটার ওয়ার্কস এবং সেন্ট টমাস চার্চ কমপ্লেক্স ছিল ঊনিশ শতকে ঢাকার উন্নয়নে কয়েকটি মাইল ফলক। রেলওয়ে প্রবর্তনের পরই নদীতীর এলাকা ধীরে ধীরে তার গুরুত্ব হারায় এবং শহরের পশ্চাৎ অংশ হিসেবে গণ্য হতে শুরু করে।

ঊনিশ শতকের শেষ দিকে শহরের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বে নতুন আবাসিক এলাকা হিসেবে নারিন্দা ও গেন্ডারিয়া গড়ে ওঠে। একই সময় হাজারিবাগ-নওয়াবগঞ্জ এলাকায়ও উন্নয়ন ঘটে; প্রথমোক্ত এলাকাটি হাড় ও চামড়া শিল্প এবং শেষোক্তটি পাট প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। ১৮৬৬ সালে সেন্ট টমাস চার্চের উল্টোদিকে জেলা কোর্ট ও সাব-জজকোর্ট এবং ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টরের অফিস প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানেও এ অফিসগুলি পূর্বের স্থানেই বিদ্যমান। ১৮৮৫ সালে ঢাকার কালেক্টর ফ্রেডারিক ওয়্যার উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্য ওয়ারীতে সুপ্রশস্ত রাস্তা এবং পয়ঃনিষ্কাশনের সুব্যবস্থাসহ একটি পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা গড়ে তোলেন।

১৮৮৫-৮৬ সালে নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-ময়মনসিংহ স্টেট রেলওয়ে স্থাপিত হয়। মুগল আমলে স্থাপিত রাস্তার প্রায় সমান্তরালভাবে স্থাপিত রেল লাইনটি ছিল টঙ্গী থেকে তেজগাঁও, কারওয়ানবাজার হয়ে শাহবাগ পর্যন্ত। শাহবাগের বাগান এলাকাটি রক্ষার জন্য রেল লাইনটি রমনার চারপাশে একটি লুপের মতো তৈরি করে প্রথমে পূর্বদিকে বাঁক নিয়ে নিমতলী-ফুলবাড়িয়া এলাকার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে আবার দক্ষিণ দিকে বাঁক নিয়ে ফতুল্লা ও নারায়ণগঞ্জে পৌঁছায়। রেল লাইনের অবস্থিতি লাইনের দক্ষিণ এবং পূর্বে মূল শহরের অস্তিত্বকে প্রমাণ করে। ফুলবাড়িয়া এলাকাটি ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনসহ একটি রেলওয়ে কমপ্লেক্সের মতো গড়ে ওঠে।

মানচিত্র-৪

১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ পর্যায় ১৯০৫ সালে ঢাকার ভাগ্য খুলে যায় যখন একে নবগঠিত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের রাজধানী করা হয়। মুসা খান মসজিদ এর উত্তর পূর্বে বাগ-ই-বাদশাহী এলাকায় লর্ড কার্জন কর্তৃক কার্জন হল নির্মাণের মাধ্যমে ১৯০৪ সালে ‘নতুন ঢাকা’র অগ্রযাত্রা শুরু হয়। ১৯০৫ থেকে ১৯১১ সাল সময়ে দক্ষিণে কার্জন হল থেকে উত্তরে মিন্টোরোড পর্যন্ত এবং পূর্বে কার্জন হলের বিপরীতে পুরানো হাইকোর্ট ভবনের একটু পূর্বে স্থাপিত গভর্নমেন্ট হাউস থেকে পশ্চিমে নীলক্ষেত পর্যন্ত রমনা এলাকাটি গড়ে ওঠে (মানচিত্র-৪)। এলাকাটিতে ইউরোপীয় রীতির দালান-কোঠা ও পাকা রাস্তার একটি পরিকল্পিত নেটওয়ার্ক গড়ে উঠতে থাকে। নতুন প্রদেশের প্রথম লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার ব্যাম্পফিল্ড ফুলার এর নাম অনুসারে নীলক্ষেত এলাকার মধ্য দিয়ে অগ্রসরমাণ রাস্তাটির নাম দেওয়া হয় ফুলার রোড।

এ সময়ে গড়ে ওঠা আকর্ষণীয় ভবনের মধ্যে ছিল গভর্নর হাউস (পুরানো হাইকোর্ট ও বর্তমান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ভবন), সেক্রেটারিয়েট ভবন (বর্তমান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল) এবং কার্জন হল। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের জন্য বেশকিছু আর্কষণীয় নকশার আবাসিক বাড়ি গড়ে ওঠে এবং ভবিষ্যতে উন্নয়ন কার্যক্রমের লক্ষ্যে কিছু এলাকা, বিশেষ করে শহরের উত্তর অংশে নির্দিষ্ট করে রাখা হয়। এ সময়ই ঢাকেশ্বরী এলাকায় মধ্যবিত্ত শ্রেণী ও নিম্নপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য স্টাফ কলোনি গড়ে ওঠে। আমলাপাড়া নামে গড়ে ওঠা এলাকাটি ছিল একটি নতুন নগর সংস্কৃতির সূত্রধর এবং আজিমপুর স্টাফ কলোনির পূর্বসূরি। একটি সুপরিকল্পিত নতুন রাজধানীর উন্মেষ ঘটে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে মানানসই একটি পার্কের জন্য উত্তর পার্শ্বে সুপরিসর উন্মুক্ত স্থান নির্দিষ্ট করা হয়। পার্কটি রমনা পার্ক নামে অভিহিত হয়। পার্কটি র্নিমাণে লন্ডনের কিউ গার্ডেন থেকে বিশেষজ্ঞ আনা হয় ফুলের বাগান নির্মাণ, বিরল প্রজাতির বৃক্ষ রোপণ এবং জলাশয় তৈরির পরিকল্পনার জন্য। একই সময়ে রমনার উত্তর-পূর্ব অংশে সিদ্ধেশ্বরী এলাকাটি পরিষ্কার করে আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা হয়। ফলে বিশ শতকের ‘নতুন ঢাকা’র জন্ম হয় ব্রিটিশ শাসকদের হাতে। তবে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পূর্বেই এবং কিছু ভবনের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হওয়ার আগেই বঙ্গভঙ্গ রদ করা হলে নতুন একটি রাজধানী নির্মাণের সমগ্র পরিকল্পনা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে ঢাকা পুনরায় তার আগের অবস্থানে ফিরে যায়। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ঢাকার ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় রমনা এলাকায় নির্মিত বেশিরভাগ নতুন ভবনগুলি নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সর্ম্পকিত বেশ কিছু নতুন ভবন গড়ে ওঠে যা শহরের শোভা বৃদ্ধিতে মাইল ফলক হিসেবে কাজ করে। এদের মধ্যে ছিল কার্জন হলের বিজ্ঞান ভবন এবং সলিমুল্লাহ মুসলিম ছাত্রাবাস। ১৯৪৭ সালে ঢাকা পুনরায় প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদা ফিরে পায়।

পাকিস্তান পর্যায় সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এবং সর্বোপরি আবাসিক প্রয়োজন সব মিলিয়ে জনগণের চাহিদা নবপ্রতিষ্ঠিত প্রাদেশিক রাজধানীটির দ্রুত বৃদ্ধিতে অবদান রাখে। ভারত থেকে আগত বিপুলসংখ্যক মুসলমান মোট জনসংখ্যার ১০৩% বৃদ্ধি ঘটায়। ফলে শহরের ফাঁকা জায়গাসহ শহরতলীতেও নতুন বসতি গড়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালের ১৫.৫৪ বর্গকিলোমিটার এলাকার নগরটি দুই দশকের মধ্য ১৯৬২ সালে ৬৪.৭৫ বর্গকিলোমিটারে পরিণত হয়। প্রথমদিকে সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসিক সমস্যার সমাধান ঘটে রমনা এলাকার সরকারি ভবনগুলিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার নিজস্ব উন্নয়নের জন্যই সমগ্র নীলক্ষেত এলাকা এবং শাহবাগের কিছু অংশ দখল করে। ঢাকেশ্বরী, পলাশী ব্যারাক (সিপাহি বিপ্লব-পরবর্তী কালে ইংরেজদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত) এবং আজিমপুর এলাকায় সরকারি কোয়ার্টার গড়ে উঠতে শুরু করে। ১৯৫৪ সালে নিউ মার্কেটের নির্মাণ সম্পন্ন হয়। পুরানা পল্টন থেকে নয়া পল্টন, ইস্কাটন থেকে মগবাজার, সিদ্ধেশ্বরী ও কাকরাইল থেকে রাজারবাগ ও শান্তিনগর হয়ে কমলাপুর পর্যন্ত, সেগুনবাগিচা সমস্ত এলাকাই দখল হয়ে যায়। ১৯৪৭ সালের পরে হঠাৎ করেই জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি রমনা এলাকার উত্তর, উত্তর-পূর্ব এবং উত্তর-পশ্চিমের সমস্ত উঁচু ভূমিতে নতুন ঢাকা গড়ে ওঠে। মুগল আমলের পুরনো ঢাকা উনিশ শতকের শেষ দিকে এবং বিশ শতকের প্রথম দিকে নওয়াব পরিবারের দ্বারা লালিত হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টির পর নতুন জীবনের স্পন্দনে জেগে ওঠে।

এক সময়ের জলাশয় ও নিচু ভূমির মতিঝিল এলাকা ১৯৫৪ সালে বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়। এ সময়ের মধ্যে নওয়াবপুর রেলওয়ে ক্রসিং-এর উত্তর থেকে পুরানা পল্টন পর্যন্ত একটি উন্মুক্ত এলাকার সৃষ্টি হয়। এখানে গড়ে ওঠে স্টেডিয়াম (বর্তমান বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম) এবং এ বিস্তীর্ণ উন্মুক্ত এলাকাটির পশ্চিম পার্শ্বে তৈরি হয় জিন্নাহ এভিনিউ (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ)। বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে প্রথম বারের মতো জিন্নাহ এভিনিউ (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ) থেকে বিমান বন্দর পর্যন্ত দুই দিকে চলাচলক্ষম রাস্তা তৈরি হয়। অন্যান্য বেশ কিছু রাস্তাও প্রশস্ত করা হয়। এ এলাকায় ষাটের দশকের প্রথম দিকে বায়তুল মুকাররম বা জাতীয় মসজিদের প্রতিষ্ঠা একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত। পাকিস্তান আমলে এ এলাকাটিতে গড়ে ওঠা অন্যান্য আরও কিছু বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ভবনের মধ্যে ডি.আই.টি ভবন, সাততলা আদমজি কোর্ট, পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স অফিস, পাকিস্তান রপ্তানি উন্নয়ন কর্পোরেশন ভবন উল্লেখযোগ্য।

প্রতিনিয়ত বেড়ে ওঠা আবাসিক চাহিদা পূরণের জন্য ১৯৫৫ সালের পর ধানমন্ডি এলাকাটিকে একটি পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা হিসেবে  গড়ে তোলা হয়। মিরপুর সড়ককে মাঝখানে রেখে মোহাম্মদপুর ও মিরপুর পর্যন্ত রাস্তার দু’পার্শ্বের উঁচু ভূমিতেই একটি আবাসিক বসতি গড়ে ওঠে। ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে সরকারিভাবেই মোহাম্মদপুর ও মিরপুর এলাকায় অভিবাসী মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য বসতি গড়ে ওঠে। পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে তেজগাঁও বিমান বন্দর ও তেজগাঁও বাণিজ্য এলাকা সরকারি প্রকল্পের মধ্যে আসে।

ধনী মুসলিম ব্যবসায়ীরা তাদের জায়গা করে নেয় নবগঠিত ইস্পাহানি কলোনি ও বিলালাবাদে। এরপরই আসে লেডিস ক্লাব পর্যন্ত বিস্তৃত ইস্কাটন গার্ডেন এলাকাটি, যেখানে এক পাশে গড়ে ওঠে ব্যক্তি মালিকাধীন বাড়ি এবং অন্যদিকে সরকারি ফ্ল্যাট। এর থেকে সামান্য দূরে ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল নগরটির এতদঞ্চলে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটায়।

এই একই সময় রাজারবাগ এলাকায় পুলিশদের জন্য এবং শান্তিনগর এলাকায় ডাক ও তার কর্মচারীদের জন্য সরকারি ভবন গড়ে ওঠে। সিদ্বেশ্বরী, কাকরাইল এবং কমলাপুর পর্যন্ত বিশাল এলাকাটি আবাসিক কলোনী দ্বারা সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।

বিশ শতকের ষাটের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে ঢাকাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাজধানী করার সিদ্ধান্ত করা হয় এবং তেজগাঁও ফার্ম ও বিমানবন্দরের পশ্চিমে শেরে-বাংলা নগর স্থাপন করা হয়। প্রকল্পটির নকশা করেন লুই আই কান। প্রকল্পটি যদিও ষাটের দশকে শুরু হয় তবে তা সমাপ্ত হয় আশির দশকের মাঝামাঝি। চারশ হেক্টর এলাকার শেরেবাংলা নগরটি দুটি লেক ও বৃক্ষ সারির মাঝে প্রশস্ত রাস্তাসহ হয়ে ওঠে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত এক চিত্তাকর্ষক এলাকা। এলাকাটির সবচেয়ে লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য এই যে, এটি স্বল্প উচ্চতার ভবনসমৃদ্ধ একটি স্থান। ব্যতিক্রম শুধু জাতীয় সংসদ ভবন, যা ঢাকার আধুনিক স্থাপত্য শিল্পের একটি মাইলফলক।

১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (DIT) (১৯৮৭ সালে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা রাজউক-এ পরিণত) নগরের পরিকল্পিত উন্নয়নের পদক্ষেপ নেয়। ডি.আই.টি ১৯৬১ সালে গুলশান মডেল টাউন, ১৯৬৪ সালে বনানী, ১৯৬৫ সালে উত্তরা এবং ১৯৭২ সালে বারিধারার (১৯৬২ সালে পরিকল্পিত) উন্নয়ন ঘটায়। ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যিক চাহিদা মতিঝিল সংলগ্ন দিলকুশা বাগান এলাকাটিকে গ্রাস করে। এটি লক্ষণীয় যে, গুলশান, বনানী, বারিধারা ও উত্তরার উন্নয়নের জন্য স্থান নির্বাচন করা হয়েছে ঢাকা টঙ্গী অক্ষের উঁচু ভূমিতে।

ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে রেল লাইনের পথ পরিবর্তন করা হয়। তেজগাঁওয়ের পর এটিকে পূর্ব দিকে ঘোরানো হয় এবং রাজারবাগ, কমলাপুর এবং বাসাবোর মধ্য দিয়ে স্বামীবাগ-যাত্রাবাড়ির নিকটে পুনরায় এটিকে পূর্বের পুরনো লাইনের সাথে সংযুক্ত করা হয়। কমলাপুরে একটি নতুন রেলস্টেশন স্থাপন করা হয়। এরপরেই পুরনো রেল লাইনটি রূপান্তরিত হয়ে ওঠে একটি সংযোগ সড়ক হিসেবে। সোনারগাঁও রোড নামে পরিচিত সড়কটি নীলক্ষেত, পলাশী, ফুলবাড়িয়া এবং ওয়ারী ও নারিন্দার উত্তরাংশের মধ্য দিয়ে কাওরানবাজারের সঙ্গে যাত্রাবাড়ির সংযোগ স্থাপন করে।

উত্তরাংশের এ সমস্ত উন্নয়ন নগরটির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে এক আমুল পরিবর্তন আনে। পুরনো মুগল শহরটি আগের মতোই সরু রাস্তা সম্বলিত ঘন বসত-বাড়ি, হাট-বাজার ও দোকানপাট সমৃদ্ধই থেকে যায়। অন্যদিকে উত্তর দিকে সম্প্রসারণ ঘটে প্রশস্ত রাস্তাবিশিষ্ট পরিকল্পিত নগরীর। এ পার্থক্যই মুগল ঢাকাকে পরিণত করে ‘পুরাতন ঢাকা’য় এবং উত্তরের বর্ধিত অংশ হয়ে ওঠে ‘নতুন ঢাকা’।

বাংলাদেশ পর্যায়  ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা একটি সার্বভৌম দেশের রাজধানী হিসেবে ঢাকাকে গৌরব ও সম্মান প্রদান করে। আর এটিই ঢাকার অস্বাভাবিক বৃদ্ধির সূত্রপাত করে। প্রথম দিককার পরিকল্পিত এলাকা গুলশান, বনানী, বারিধারা ও উত্তরা পূর্ণ হয়ে ওঠে, ফাঁকা অংশ খুব কমই থাকে। সম্প্রতি রাজউকের উন্নয়নসূচির মধ্য সংযুক্ত হয়েছে নিকুঞ্জ। উত্তরা আরও বর্ধিত হয়ে উত্তর দিকে টঙ্গী নদী পর্যন্ত এবং বাম দিকে মোড় নিয়ে আশুলিয়া পর্যন্ত পৌঁছায়। নিকুঞ্জ দখল করে কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্ট ও নতুন বিমানবন্দরের মধ্যবর্তী এলাকার নিচু অংশ যা বসবাসের জন্য উপযোগী করে তুলতে মাটি ফেলে ভরাট করা হয়। উনিশ শত আশির দশকের প্রথম দিকে বিমান বন্দরটিকে স্থানান্তরিত করা হয় উত্তরার দক্ষিণ পশ্চিমে এর নতুন ঠিকানায়।

পূর্ব দিকের জুরাইন, বাড্ডা, গোরান, খিলগাঁও, রামপুরা এবং পশ্চিমে কামরাঙ্গীর চর, শ্যামলী, কল্যাণপুরলএসব নিচু এলাকা বসবাসের আওতায় আনা হয়। ১৯৭১ সালের পর থেকে ঢাকার বৃদ্ধি প্রচন্ডভাবে গতিপ্রাপ্ত হয়। বেসরকারি উদ্যোগ এ উন্নয়নে প্রধান ভূমিকা পালন করে। ফলে পরিকল্পনার অভাব পরিলক্ষিত হয়। বেসরকারি পর্যায়ে পরিকল্পিত সম্প্রসারণ সম্প্রতি লক্ষ্য করা যায় বারিধারার পূর্ব দিকে বসুন্ধরা এলাকায়। এ নিচু এলাকাটি বসত বাড়ির জন্য উঁচু করা হয়েছে।

১৯৭১ সাল থেকে ঢাকার ওপর চাপ প্রচন্ডভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। শহরে বসবাসকারীর সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ভাসমান জনগোষ্ঠী, ফলে শহরের নির্মাণাধীন এলাকাসমূহের মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গায় বস্তি গড়ে উঠেছে।

মানচিত্র-৫

আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ঢাকার সম্প্রসারণ হঠাৎ করে গতিশীল হয়ে উঠে। এ সম্প্রসারণ প্রক্রিয়া অনুধাবনের জন্য ঢাকার মোটামুটি ২০ মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে ভৌত-কাঠামোর দিকে তাকানো প্রয়োজন। ঢাকার পূর্বদিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, সূত্রাপুর, শ্যামপুর, মতিঝিল, খিলগাঁও, রামপুরা, গুলশান-বারিধারা এবং উত্তরা থেকে বালু নদী পর্যন্ত অঞ্চল ছিল নিম্ন জলাভূমি এবং বর্ষাকালে এ অঞ্চলের অধিকাংশই পানিতে প্লাবিত হয়ে যেত। এর যৎসামান্য উঁচু অংশেই কেবল জনবসতি গড়ে উঠেছিল। এ সকল অঞ্চলে ব্যক্তি মালিকানাধীন জনবসতিই বেশি গড়ে উঠছে এবং সে সঙ্গে নিম্নাঞ্চলেও মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়েছে। গত বিশ বছর বা আরো আগে থেকে (১৯৯০-২০১০) নতুন নতুন এলাকায় ধীরে ধীরে জনবসতি গড়ে উঠেছে। নিম্ন ও মধ্য আয়ের জনগণের দ্বারা যাত্রাবাড়ি, বাসাবো, মুগদা, সবুজবাগ, গোড়ান, বনশ্রী, মেরুল বাড্ডা, মধ্য বাড্ডা, উত্তর বাড্ডা, নদ্দা, কুড়িল, খিলক্ষেত, দক্ষিণখান এবং উত্তরখানসহ নতুন ঢাকার পূর্বাঞ্চলীয় উপশহরসমূহ ঘন জনবসতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। অথচ মাত্র পঁচিশ বছর আগেও ঢাকার পূর্বাঞ্চলের বিস্তৃত অংশ বর্ষা মৌসুমে জলমগ্ন থাকত এবং বর্ষাকালে সেখানে প্লাবিত হওয়া ছিল একটি স্থায়ী সমস্যা (মানচিত্র-৫)।

মানচিত্র-৬

বেসরকারি ব্যবস্থাপনাধীনে ১৯৮৯ সালে ঢাকার সর্বোচ্চ ভৌত প্রকল্প হিসেবে প্রগতি সরণির কাজ শুরু হয়। প্রেসিডেন্ট এরশাদের শাসনামলে শহর রক্ষা বাঁধ তৈরির কাজ হয়। ফলে বন্যায় প্লাবিত হওয়া ও তাতে ক্ষতি সাধনের আশঙ্কা থেকে ঢাকা শহর শুধু মুক্ত হয়নি, সে সাথে বেসরকারি উদ্যোক্তাগণকে ঢাকার পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের নিচু এলাকায় নতুন আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে নতুন শহর গড়ে তুলতে উৎসাহ জুগিয়েছিল। এ সময়েই ঢাকার পশ্চিমাঞ্চলের কাঁটাসূর, আদাবর, শেখেরটেক, দারুস সালাম, শ্যামলীর পূর্বভাগ এবং কল্যাণপুর প্রভৃতি এলাকায় জনবসতি গড়ে উঠতে থাকে। শহরের পশ্চিমদিকের উত্তর সীমানায় শহর রক্ষা বাঁধের ঠিক লাগোয়া অংশে প্রাকৃতিক জলাশয়ের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে এ সময়ে জাতীয় উদ্যান ও চিড়িয়াখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। চিড়িয়াখানা ও জাতীয় উদ্যানের অভ্যন্তরের হ্রদ এখনো বিদ্যমান (মানচিত্র-৬)।

বিজয় সরণি থেকে পুরাতন বিমানবন্দর-এর সমান্তরালে মিরপুর ১০ নং গোল চক্কর পর্যন্ত রোকেয়া সরণি নির্মাণের পর সড়কের উভয় পার্শ্বের নিচু জমিতে স্বল্প আয়ের মানুষের বসতি গড়ে ওঠে। এ অঞ্চলের জনবসতি গড়ে তোলার পেছনে বেসরকারি উদ্যোগই প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। মিরপুর স্টেডিয়াম থেকে জাতীয় উদ্যান পর্যন্ত অঞ্চলের এক পার্শ্বে এবং সংলগ্ন উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে সরকারি ব্যবস্থাপনায় মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট এলাকাটি গড়ে ওঠে। কিন্তু এর মধ্যবর্তী পল্লবী এলাকাটি গড়ে ওঠে বেসরকারি উদ্যোগে। পল্লবী এবং শাহ জালাল বিমান বন্দরের পশ্চিম পার্শ্বের মধ্যবর্তী খালি জমি আংশিক বিমান বন্দরের রানওয়ের জন্য এবং প্রধানত প্রাকৃতিক বাধার কারণে এখনও বসবাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি।

শহরের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক নির্মাণ ঢাকা শহরকে দক্ষিণ-পূর্বে প্রায় শীতলক্ষ্যা নদী পর্যন্ত সম্প্রসারণের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। মহাসড়কের দক্ষিণ দিকে দনিয়া, শনির আখড়া, রায়েরবাগ অঞ্চল এবং উত্তরে ডেমরা পুলিশ স্টেশন পর্যন্ত নিম্ন এলাকাসমূহে নিম্ন আয়ের জনগণের বসতি গড়ে উঠেছে। তবে এসব জনবসতি গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে। ফলে সেখানে নগর সভ্যতার সুযোগ সুবিধাগুলো প্রায় অনুপস্থিত।

১৯৮৯ সালে যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত প্রথম বুড়িগঙ্গা সেতু বা বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুটি নির্মাণের ফলে যাত্রাবাড়ী থেকে শহরের দক্ষিণমুখী সম্প্রসারণের পথ উন্মুক্ত হয় এবং জুরাইন ও তদসংলগ্ন অঞ্চলে ঘন জনবসতি গড়ে ওঠে। বুড়িগঙ্গা সেতু পর্যন্ত মহাসড়কের উভয় পার্শ্বে বাজার, গোডাউন ও ব্যবসা ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র গড়ে উঠেছে।

বুড়িগঙ্গার উপরে নির্মিত আরো দু’টি সেতু (বাবুবাজার থেকে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত দ্বিতীয় সেতুটি ২০০১ সালে এবং মুগল আমলে নির্মিত সাত গম্বুজ মসজিদের পেছনে মোহাম্মদপুর থেকে আটি বাজারকে সংযুক্তকারাী তৃতীয়টি ২০১০ সালে চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে) কেরানীগঞ্জ থেকে আটি বা তারও পরের অংশে বুড়িগঙ্গার দক্ষিণের অংশে নতুন জনবসতি গড়ে উঠতে সাহায্য করেছে।

মাত্র ২৫ বছর আগেও কেরানীগঞ্জ থেকে আটি বাজার পর্যন্ত এলাকা ছিল নিম্ন ও জলাশয়পূর্ণ গ্রাম। অথচ এখন তা পাকা   রাস্তা, উঁচু ভবন, গ্যাস ও বিদ্যুৎ ইত্যাদি সকল নাগরিক সুবিধাসহ একটি পূর্ণাঙ্গ শহর। তবে একথা বলতেই হয় যে, বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ পার্শ্বস্থ অঞ্চলসমূহ গড়ে ওঠার ব্যাপারে যদি সতর্ক পরিকল্পনা থাকত এবং তাকে যদি ঢাকা শহরের একটি অংশ হিসেবে গণ্য করা হতো তবে, ঢাকাকে ‘প্রাচ্যের ভেনিস’ হিসেবে যৌক্তিক উপস্থাপনাও সম্ভব হতো।

মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার একাংশ

ঢাকার দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে বুড়িগঙ্গা নদীতে ধীরে ধীরে একটি চর জেগে উঠছিল। ১৮৫৯ সালের একটি মানচিত্রে এ অংশটিকে চর বাগচাঁদ এবং এর পশ্চিমাংশটি ‘চর কামরাঙ্গী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমান মানচিত্রে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, হাজারীবাগ থেকে ইসলামবাগের বিপরীত অংশ পর্যন্ত ব্যাপক ভূখন্ডটি কামরাঙ্গীর চর হিসেবে চিহ্নিত। পূর্বমুখী বড় একটা বাঁক নিয়ে বুড়িগঙ্গার গতি পরিবর্তিত হওয়াতেই সম্ভবত এই নতুন চরটির সৃষ্টি। বর্তমানে চরের পশ্চিমাংশটি কার্যত শহরের সংলগ্ন অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত এবং খুব সরু একটি জলাশয়ের বিপরীত পার্শ্বে ইসলামবাগ অবস্থিত। কামরাঙ্গীর চর অতি দ্রুত নিম্নআয়ের বস্তিবাসীদের জনবসতি গড়ে ওঠে এবং যে কারণে এ অঞ্চলটি অনেকটা বস্তির রূপ ধারণ করেছে।

ঢাকার উত্তরা আবাসিক এলাকা রাজউক এর তত্ত্বাবধানে পশ্চিম দিকে সম্প্রসারিত হয়েছে। জলাভূমির ওপর কালভার্ট সংযোজনের মাধ্যমে দ্বিতীয় পর্যায়ের সম্প্রসারণ প্রক্রিয়ার অধীনে উত্তরার দশ থেকে চৌদ্দ নম্বর সেক্টরকে যুক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে রাজউক উত্তরার এই দ্বিতীয় পর্বের সম্প্রসারণ প্রকল্পে তৃতীয় পর্যায়ের সম্প্রসারণ কাজ হাতে নেয়ার পরিকল্পনা করেছে। এ পরিকল্পনার আওতায় মীরপুর ক্যান্টনমেন্ট এর উত্তর পার্শ্ব হতে শহর রক্ষা বাঁধের মীরপুর-আশুলিয়ার পূর্ব অংশ সংযোজন করা হচ্ছে।

বুড়িগঙ্গা নদীর উপর বাংলাদেশ চীন মৈত্রী সেতু

ঢাকা বিমান বন্দরের পশ্চিম অংশে অবস্থিত নিকুঞ্জ আবাসিক এলাকাটিও সরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের প্রধান রানওয়ের সম্মুখভাগের ভূখন্ডটি ছিল নিম্নাঞ্চল এবং এটি ডিআইটি-এর উদ্যোগে (রাজউক কর্তৃক সম্প্রাদিত) ‘নিকুঞ্জ’ নামে নতুন আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা হয়। প্রাথমিকভাবে নির্দেশনা ছিল যে, নিকুঞ্জ-১ অঞ্চলে নির্মীয়মান বাড়িসমূহ দ্বিতলের ঊর্ধ্বে হতে পারবে না। তবে প্রথম অংশের উত্তরে অবস্থিত নিকুঞ্জ পরিকল্পনার দ্বিতীয় পর্বের অংশে (নিকুঞ্জ-২) এরূপ কোন বিধি নিষেধ আরোপিত হয়নি। কারণ বিমান বন্দরের রানওয়ের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত না বলে বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের ক্ষেত্রে এ এলাকার ভবনসমূহ কোন বাধার সৃষ্টি করে না।

বসুন্ধরা সিটি শপিং মল

রাজউক ইতোমধ্যে ‘পূর্বাঞ্চল নিউ টাউন’ নামে একটি নতুন শহর গড়ে তোলার কাজ শুরু করেছে। প্রকল্পটি ২০১২ সালে সম্পন্ন হওয়ার কথা। পূর্বাচলের মোট আয়তন ৬১৫০ একর এবং এ অঞ্চলকে ৩০টি সেক্টরে ভাগ করা হবে। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানা এবং গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানায় পূর্বাচলের অবস্থান। সম্পূর্ণ এলাকাটি পূর্বদিকের উত্তরখান ও দক্ষিণখান অঞ্চল থেকে বালু নদীর পূর্ব পার্শ্ব দিয়ে পূর্বমুখী সম্প্রসারণের পথ ধরে শীতলক্ষ্যা নদী পর্যন্ত বিস্তৃত। খিলক্ষেত হতে শীতলক্ষ্যার উপর কাঁচা ব্রিজ পর্যন্ত একটি প্রস্তাবিত রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পের উপর পূর্বাচল নিউ টাউনের দক্ষিণভাগের উন্নয়ন নির্ভর করছে। অবশ্য ইতোমধ্যেই কিছু বেসরকারি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান উক্ত অঞ্চলে নতুন আবাসন প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করেছে। গত শতকের শেষ পর্বে কমপক্ষে চারটি প্রধান আবাসন প্রকল্প, নিম্নাঞ্চলসমূহ ভরাট করে ঢাকা শহর বৃদ্ধির প্রধান নিয়ামক হিসেবে সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগে সম্পন্ন হয়েছে।

তেজগাঁও বাণিজ্যিক এলাকা ও গুলশান সংযোগ সড়কের পার্শ্ববর্তী অংশের গুলশান লেক-এর একটি অংশের নিম্ন ভূভাগে মাটি ভরাট করে ‘নিকেতন’ নামে একটি নতুন আবাসন প্রকল্প গড়ে উঠেছে এবং ইতোমধ্যে সেখানে চমৎকার সব বাড়িও নির্মিত হয়েছে। নিকেতনের দক্ষিণ-পূর্বাংশে এবং প্রগতি সরণির পূর্বাংশ থেকে রামপুরা পর্যন্ত সম্প্রসারিত অঞ্চলের ভূভাগে মাটি ভরাট করে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে ‘বনশ্রী আবাসিক প্রকল্প’টি বাস্তবায়িত হয়েছে। বনশ্রীর উত্তরাংশ দিয়ে প্রবাহিত একটি খাল পূর্বদিকে বালু নদীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছে। তবে গত ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা ‘বসুন্ধরা আবাসিক প্রকল্প’টি ঢাকার সর্ববৃহৎ আবাসন প্রকল্প হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। প্রকল্পটি প্রগতি সরণির পূর্বদিকে বারিধারার ডিওএইচএস এবং বারিধারার সামান্য উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত। এখানকার জলমগ্ন নিম্নাঞ্চলকে মাটি ভরাট করেই এ বৃহৎ আবাসন প্রকল্পটির কাজ সম্পন্ন করা হয়। বসুন্ধরা ইতোমধ্যে ঢাকার সর্ববৃহৎ বেসরকারি আবাসিক এলাকা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। বসুন্ধরার পশ্চাৎভাগের পূর্ব, দক্ষিণ ও উত্তরাংশ এখনো বর্ষাকালে জলমগ্ন হয়ে পড়ে। তবে একই প্রক্রিয়ায় উন্নয়ন প্রকল্প চলতে থাকলে সহজেই অনুমান করা যায় যে, উত্তরের পূর্বাচল হতে দক্ষিণের তারাবো সেতু পর্যন্ত এবং পূর্বের শীতালক্ষ্যা হতে পশ্চিম দিকের বালু নদী পর্যন্ত সম্পূর্ণ ভূখন্ড ভরাট হয়ে নগরায়ণ প্রকল্পের অধীনে নতুন ঢাকার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হবে। কারণ বসুন্ধরার পূর্বমুখী সম্প্রসারণ প্রক্রিয়া ও অন্যান্য আবাসন প্রকল্প তারই সম্ভাবনার পথ খুলে দিয়েছে। তবে এটি অনস্বীকার্য  যে, ঢাকা শহরের সম্প্রসারণ সঠিকভাবে অনুমান করা সম্ভব নয়।

খিলগাঁও ফ্লাইওভার

গত বিশ বছর বা তারও বেশি সময়ে ঢাকা শহরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে। ডিআইটি-এর তত্ত্বাবধানে যে সকল এলাকা আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়ে উঠেছিল তার চরিত্রগত কয়েকটি পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে রিয়েল এস্টেট ডেভেলপারগণ নির্মাণ কাজে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রয়েছে। গত শতকের আশির দশকেও এদের অস্তিত্ব ছিল না। ধানমন্ডি  আবাসিক এলাকাটিতে ছিল মনোরম পরিবেশে ব্যক্তি মালিকানাধীন পৃথক ও একক দালান। প্রত্যেক বাড়িতে ছিল সামনে খোলা জায়গাসহ চতুর্দিকে ঘোরানো লম্বা লম্বা গাছের সারি। এখন সেখানে রয়েছে বহুতল বিশিষ্ট ফ্ল্যাট কমপ্লেক্স। এ দৃশ্য ধানমন্ডির উপরিভাগের দৃশ্যকেই বদলে দিয়েছে। একই রকমভাবে আকাশের দিকে ক্রমশ উপরে উঠে যাওয়া বহুতল বাসভবন বনানী, গুলশান, বারিধারা ও লালমাটিয়া এলাকাতেও দেখা যায়। এ আবাসন প্রকল্পসমূহ প্রথমে সরকারি উদ্যোগে পরিকল্পিতভাবে হাউজ বিল্ডিং কর্পোরেশনের (১৯৫২ সাল থেকে কার্যকর) আর্থিক সহায়তায় গড়ে উঠেছিল। আবাসিক এলাকার এ ব্যাপক পরিবর্তনের প্রধান নিয়ামক হল রিয়েল এস্টেট ডেভেলপারগণ যাদের ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠার প্রমাণ পাওয়া যায় ঢাকার প্রধান প্রধান রাস্তার ধারের প্রকান্ড সব বিলবোর্ড এর উপস্থিতিতে। এদের বিলবোর্ডসমূহই ঢাকার রাস্তায় প্রাধান্য বিস্তার করছে।

ক্রমান্বয়ে ঊর্ধ্বমুখী বহুতল দালানসমূহ উত্তরাসহ ঢাকার প্রায় সকল আবাসিক এলাকাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। এর সাথে পাল্লা দিয়ে জমির মূল্য ও ফ্ল্যাটের মূল্যও দ্রুত গতিতে ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। উন্নয়নের এরূপ ধারা পরোক্ষভাবে ঢাকার অপর পার্শ্বের দক্ষিণ-উত্তরমুখী সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে নিম্নাঞ্চল ভরাট করে নতুন নতুন উন্নয়ন প্রকল্প পরিকল্পনায় উৎসাহ যোগাচ্ছে। উল্লেখযোগ্য যে, ঊর্ধ্বমুখী বিল্ডিং নির্মাণের এ ধারার সঙ্গে ঢাকার বিপণন কেন্দ্রসমূহও যোগ দিয়েছে। মিরপুর, সাতগম্বুজ রোড, ধানমন্ডি ২৭ নং রোড, ধানমন্ডি রোড ২ প্রভৃতি এলাকা সম্প্রতি সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এখানে বিপণন কেন্দ্র, বহুতল অফিস ভবন প্রভৃতির সঙ্গে নতুন সংযোজিত হয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ডায়াগনোস্টিক সেন্টার ও বেসরকারি হাসপাতাল প্রভৃতি।

আধুনিক বহুতল এমার্টমেন্ট ভবন, ঢাকা

ইস্টার্ন হাউজিং কোম্পানি ঢাকায় ‘প্লাজা সংস্কৃতি’ (Plaza Culture) গড়ে তোলার জন্য প্রধান কৃতিত্বের দাবিদার। কারণ তারাই ঢাকার পুরনো হাতিরপুল এলাকায় ইস্টার্ন প্লাজা নামের প্রথম শপিং কমপ্লেক্সটি নির্মাণ করে, যা অন্যান্য নির্মাণ কোম্পানিকে উৎসাহিত করে তোলে। কেবল ধানমন্ডি আবাসিক এলাকাতেই না, গুলশান, বনানী, শান্তিনগর, রামপুরা রোড, মৌচাক-মালিবাগ প্রভৃতি এলাকায় এভাবে শপিং প্লাজা গড়ে ওঠে। এমনকি বিমান বন্দর সড়ক থেকে উত্তরা মডেল টাউনের মধ্যবর্তী অংশ হয়ে টঙ্গী রোড পর্যন্ত রাস্তার দু’ধার এখন নতুন রূপে সজ্জিত। কারণ এ অঞ্চলেও গড়ে উঠেছে বহুতল শপিং প্লাজা ।

ঢাকা শুধুমাত্র আকার ও আয়তনের দিক দিয়েই পরিবর্তিত হয়নি, চরিত্রগত দিক দিয়েও ঢাকার ব্যাপক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। ঢাকার অপরিকল্পিত সম্প্রসারণ দেখে আনন্দের স্থলে ভীত হতে হয়। আপাতদৃষ্টিতে অপরিকল্পিত সম্প্রসারণ ঢাকাকে ‘মেগা সিটি’তে পরিণত করলেও এখানে বসবাসরত নগরবাসীদের গর্ব করার মতো কিছু অবশিষ্ট থাকেনি। ঢাকা এখন দ্রুত বেড়ে ওঠা একটি বড় শহরের উদাহরণ মাত্র। পরিকল্পনাকারী ও পরিচালকদের পক্ষে এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।  [আবদুল মমিন চৌধুরী]

গ্রন্থপঞ্জি James Taylor, A Sketch of the Topography and Statistics of Dacca, Calcutta, 1840; Patrick Geddes, Report on Town Planning-Dacca, Calcutta, 1911; Sayid Aulad Hasan, Notes on the Antiquities of Dacca, Dacca, 1912; SM Taifoor, Glimpses of Old Dhaka (revised edn.), Dacca, 1956; AH Dani, Dacca- A Record of its Changing Fortunes (revised edn.), Dacca, 1962; Sharif uddin Ahmed, DACCA - A Study in Urban History and Development, London, 1986.