ডেপুটি কমিশনার

ডেপুটি কমিশনার  জেলা পর্যায়ের প্রধান প্রশাসনিক ও রাজস্ব কর্মকর্তা। পদটির উদ্ভব হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনের গোড়ার দিকে জেলা কালেক্টর ব্যবস্থা থেকে। ১৭৬৯ সালে সীমিত ক্ষমতাসহ প্রতিটি জেলায় একজন সুপারভাইজার নিযুক্ত হন। ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭২ সালে জেলা কালেক্টর ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। কিন্তু পরের বছরই তা বাতিল হয়ে যায় এবং ১৭৮৭ সালে পুনঃপ্রবর্তিত হয়।

১৭৮৭ সালের ২৭ জুন এক প্রবিধানের মাধ্যমে কালেক্টরদের উপর বিচারক ও ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা ন্যস্ত হয়। পুলিশ বাহিনীর উপরও তাদের কিছুটা কর্তৃত্ব বর্তায়। ১৭৯৩ সালে বাংলায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পর কালেক্টরদের বিচার ক্ষমতা ও পুলিশের উপর কর্তৃত্ব বিলোপ করা হয়। বাংলায় অবশ্য ১৮৩১ সালে কালেক্টররা পুনরায় বিচার ক্ষমতা লাভ করেন। এরপর থেকে বাংলায় তারা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর অথবা শুধু জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে পরিচিত হয়ে আসছেন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ডেপুটি কমিশনার অভিধা ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহূত হতো। অনিয়ন্ত্রিত (নতুন বিজিত) প্রদেশসমূহের জেলাগুলিতে প্রধান রাজস্ব ও নির্বাহী কর্মকর্তাকে ডেপুটি কমিশনার বলা হতো। নিয়ন্ত্রিত প্রদেশ বলতে বাংলার স্থায়ী বসতি অঞ্চল বোঝাত যেখানে পূর্ণাঙ্গ আইনকানুন ভিত্তিক একটি আইন ব্যবস্থা দ্বারা জেলা প্রশাসন পরিচালিত হতো। অনিয়ন্ত্রিত প্রদেশ বলতে নতুন বিজিত এলাকা বোঝাত যেখানে অস্থিতিশীলতার কারণে অধিক কর্তৃত্বশীল ধরনের প্রশাসন প্রয়োজন ছিল। পূর্ববঙ্গের জেলাগুলিতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও  কালেক্টর অভিধাটি সার্বজনীনভাবে ব্যবহূত হতো।

ফৌজদারি দন্ডবিধিতে উল্লিখিত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অভিধাটি দ্বারা জেলার প্রধান ম্যাজিস্ট্রেটকেই বোঝান হয়। কালেক্টর অভিধাটি ভূমিরাজস্ব আইন থেকে উদ্ভূত। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে সকল জেলার ক্ষেত্রেই জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর পদ চালু ছিল। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল অনিয়ন্ত্রিত এলাকা হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল, যেখানে ডেপুটি কমিশনার পদবি ব্যবহূত হতো। ১৯৬০ সালের পর থেকে অবশ্য জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টরের নামের পরিবর্তে সারাদেশে ডেপুটি কমিশনার অভিধা পুনরায় চালু করা হয়।

গোড়ার দিকে ডেপুটি কমিশনারের দপ্তর শুধু অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও রাজস্ব প্রশাসন দেখাশোনা করত। পরবর্তী সময়ে এ দপ্তরের উপর অধিক পরিমাণে জেলার জনকল্যাণমূলক কার্যক্রমের দায়িত্ব ন্যস্ত হতে থাকে এবং ফলত ডেপুটি কমিশনার জেলার যাবতীয় কার্যক্রমের সাধারণ নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। বিশ শতকের গোড়ার দিক থেকে নির্বাচিত আইনসভার প্রবর্তন এবং জেলাগুলিতে নিজস্ব কর্মকর্তাসহ কিছু বিশেষ বিভাগ সৃষ্টির ফলে ডেপটি কমিশনারের ভূমিকার সার্বজনীনতা খর্বিত হয়। তা সত্ত্বেও ডেপুটি কমিশনার এখনো জেলায় আইনশৃঙ্খলা, ভূমিপ্রশাসন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং সাধারণ ও স্থানীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে পরিগণিত। তিনি বিভাগীয় কমিশনারের সাধারণ নির্দেশ ও তত্ত্বাবধানে কাজ করেন। ডেপুটি কমিশনারগণ কেবিনেট বিভাগের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে  থাকলেও সংস্থাপন মন্ত্রণালয় তাদের পদায়ন ও বদলির দায়িত্ব পালন করে থাকে। ডেপুটি কমিশনাররা বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (প্রশাসন) সদস্যদের মধ্য থেকে নিযুক্ত হন। কেবিনেট সচিবের সভাপতিত্বে এবং সংস্থাপন, স্বরাষ্ট্র ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিবদের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটি ডেপুটি কমিশনার পদে নিয়োগের দায়িত্ব সম্পন্ন করে।  [এ.এম.এম শওকত আলী]