ডালহৌসী, লর্ড

লর্ড ডালহৌসী

ডালহৌসী, লর্ড (১৮১২-১৮৬০)  ১৮৪৮ থেকে ১৮৫৬ সাল পর্যন্ত কর্মরত ভারতের গভর্নর জেনারেল। তিনি ১৮১২ সালের ২২ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন এবং হ্যারো ও অক্সফোর্ডের ক্রাইস্ট চার্চে শিক্ষালাভ করেন। ১৮৪৮ সালের ১২ জানুয়ারি ভারতের গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে তিনি প্রিভি কাউন্সিলর ও বাণিজ্য বোর্ডের প্রেসিডেন্ট-এর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সর্বক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের শ্রেষ্ঠত্বে প্রবল বিশ্বাসী ছিলেন, তাঁর শাসনকালে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ এবং একই সঙ্গে এদেশে অনেক সংস্কার ও গঠনমূলক কার্য সম্পন্ন হয়েছিল ডালহৌসী দ্বিতীয় শিখ যুদ্ধ (১৮৪৮-৪৯) সংঘটিত করে পাঞ্জাব অধিকার করেন। ১৮৫০ সালে তিনি সিকিমের কিয়দংশ দখল করেন এবং ১৮৫২ সালের শেষদিকে তাঁর সেনাবাহিনী দ্বিতীয় বার্মা যুদ্ধে অংশ নিয়ে বার্মার নিম্নাঞ্চল জয় করেন।

তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ভারতীয়দের জন্য তাদের নিজ রাজন্যবর্গের চেয়ে ব্রিটিশ শাসন অধিক হিতকর। তাঁর সম্বন্ধে এটা বলা হয়ে থাকে যে, তাঁর পূর্ববর্তী শাসকগণ যেখানে অন্যের ভূখন্ড জোর করে অধিকার করার নীতি পরিহার করে চলতেন, সেখানে ডালহৌসী বৈধভাবে সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের মূলনীতি গ্রহণ করেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি  স্বত্ববিলোপ নীতি প্রবর্তন করেন। এ নীতি অনুসারে, যদি কোনো দেশীয় রাজা স্বাভাবিক উত্তরাধিকারী না রেখে মারা যান তাহলে ওই স্বাধীন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের হাতে ন্যস্ত হবে। এ আইনে দত্তকপুত্র গ্রহনের অধিকার অবৈধ ঘোষণা করা হয়। স্বত্ববিলোপ নীতি প্রয়োগ করে তিনি সাতারা, সম্বলপুর, উদয়পুর, ঝাঁসি ও নাগপুর রাজ্যসমূহ দখল করেন। ডালহৌসী কর্ণাটক ও তাঞ্জোরের খেতাবসার সার্বভৌমত্বের বিলোপ সাধন করেন। কারণ তিনি তাদেরকে অকার্যকর বলে গণ্য করেন। প্রাক্তন পেশোয়া দ্বিতীয় বাজি রাও মারা গেলে তিনি তাঁর দত্তকপুত্র নানা সাহেবকে পেনশন প্রদান করতে অসম্মতি জানান।

অবশেষে তিনি অদক্ষ শাসনের অজুহাতে ১৮৫৬ সালে অযোধ্যা দখল করেন। তিনি মুগল সম্রাটের রাজকীয় খেতাব বিলোপ করতে, দিল্লির রাজপ্রাসাদ থেকে রাজপরিবারকে সরিয়ে ফেলতে এবং বাহাদুর শাহর পুত্রকে রাজকীয় অভিধা থেকে বঞ্চিত করতে উদ্যোগী হন। ডালহৌসীর স্বত্ববিলোপ নীতির প্রয়োগ সম্পর্কে যৌক্তিকভাবেই বলা হয়ে থাকে যে, যখন উত্তরাধিকারীর অভাব ঘটত তখন তিনি স্বত্ব বিলোপ করতেন; যখন তাদের প্রাচুর্য থাকত, তখন তিনি পরস্পরবিরোধী দাবিদারদের মধ্য থেকে রাজ-পরিবারের প্রধান কে হবেন তার স্বীকৃতিকে বিলোপের একটি শর্ত হিসেবে ব্যবহার করতেন। এভাবে ডালহৌসী তাঁর আট বছরের রাজত্বকালের মধ্যে উপমহাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্র বদলে দেন।

ডালহৌসীর সময়ে ঔপনিবেশিক রাজ্যের বেশ কিছু সংস্কার সাধন করা হয়। তিনি কলকাতার সচিবালয় পুনরায় সংগঠিত করেন এবং গভর্নর জেনারেলের প্রশাসনিক গুরুভার মোচন করতে বাংলার জন্য একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নর নিয়োগ করেন। তিনি ভারতের রেল ব্যবস্থা উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রধান রেল লাইনসমূহ স্থাপন করেন। তাঁর আমলে টেলিগ্রাফ যোগাযোগ স্থাপিত হয় এবং এর সঙ্গে ডাক ব্যবস্থারও উন্নয়ন সাধন করা হয়। তিনি সরকারি পূর্ত বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন যার মাধ্যমে পূর্ত কর্মসূচি, যেমন রাস্তা ও সেতু নির্মাণ, সেচ প্রকল্পসমূহের সম্প্রসারণ এবং জনসাধারণের উপকারে আসে এমন অন্যান্য কার্যাবলী বাস্তবায়ন করেন। গণশিক্ষা বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষা ক্ষেত্রে ক্রমান্বয়িক পর্যায় সম্পর্কে পরিকল্পনা গ্রহন করেন। নতুন আইন প্রণয়ন করে তিনি হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহকে বৈধ ঘোষণা দেন এবং খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিতদের পৈতৃক সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারের অযোগ্য ব্যবস্থাকে অবৈধ ঘোষণা করেন। ১৮৫৩ সালে  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চার্টার নবায়ন করা হয় এবং নতুন চার্টারের অধীনে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসকে ভারতীয়দের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। বন সংরক্ষণ থেকে জেলসমূহের অবস্থার উন্নতিসাধন পর্যন্ত প্রশাসনিক ক্ষেত্রে এমন সকল শাখাতে ডালহৌসী তাঁর সংস্কারমূলক কাজের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। বলা হয়ে থাকে যে, ভারতে যে সকল ব্রিটিশ প্রশাসক এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন বিজয়ী, কয়েকজন ছিলেন নির্মাতা এবং অন্যরা ছিলেন সংস্কারক, কিন্তু লর্ড ডালহৌসী একাই ছিলেন এর সবগুলিই।

ডালহৌসীর ধ্যান-ধারণা ছিল ভারতকে পাশ্চাত্যের আদলে গড়ে তোলা এবং সম্ভবত সেজন্য তিনি ‘অনেকটা পথ অতি দ্রুত’ অতিক্রম করেছিলেন। যদিও তিনি পরিতৃপ্ত পাঞ্জাব রেখে গেছেন, রেলপথ, সড়ক ও টেলিগ্রাফের সুবিধাদি প্রদান করেছেন, কিন্তু তিনি ওই সকল ব্যক্তির অনুভূতিকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করেছেন যারা তাঁর সম্প্রসারণ নীতি ও সৃষ্টিশীল সংস্কারসমূহ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এজন্য ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লব ছিল ব্রিটিশদের কৃতকর্মের দন্ড পরিশোধের মতো।

১৮৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি অবসর গ্রহণের পর তিনি ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে ভারত ত্যাগ করেন এবং ১৮৬০ সালের ১৯ ডিসেম্বর মারা যান।  [কে.এম মোহসীন]