ডন সোসাইটি

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২১:১৬, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

ডন সোসাইটি (১৯০২-১৯০৬)  জাতীয় শিক্ষা নীতির প্রস্তাবক সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় কর্তৃক ১৯০২ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এর আগে ১৮৯৬ সালে সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় স্থাপন করেন ভাগবৎ চতুষ্পাঠী। এটি ছিল প্রধানত ভারতীয় ধর্ম ও দর্শন চর্চা এবং সামগ্রিকভাবে ভারত বিষয়ক গবেষণায় নিবেদিত। প্রতিষ্ঠানটি জাতীয় পরিচয় অন্বেষণে একান্তভাবে রত ছিল। এর পাঠদান কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হতো সন্ধ্যায় মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে (বর্তমান বিদ্যাসাগর কলেজে)। একই সময়ে বিখ্যাত ‘ডন’ ম্যাগাজিন প্রকাশিত হতো। ১৯০২ সালে ডন সোসাইটির মুখপাত্রে পরিণত হওয়ার সময় পর্যন্ত এ ম্যাগাজিনে ভারতীয় ইতিহাস, সভ্যতা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, শিল্পকলা সংক্রান্ত অনেক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।

সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় একজন জনপ্রিয় শিক্ষক এবং সমসাময়িক তরুণ প্রজন্মের বিজ্ঞ পরামর্শদাতা ছিলেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বিনয়কুমার সরকার, রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়, হারাণ চন্দ্র চাকলাদার, রবীন্দ্রনারায়ণ ঘোষ, কিশোরী মোহন গুপ্ত এবং আরও অনেকে তাঁর সাথে যোগ দেন এবং তাঁরা ডন সোসাইটির প্রধান অবলম্বনে পরিণত হন। এ সোসাইটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক অনুসৃত উপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার সমালোচনা করে। তাঁদের মতানুসারে, এ শিক্ষা ব্যবস্থার প্রকৃতি ছিল অতিমাত্রায় সাহিত্যনির্ভর, অতি প্রাতিষ্ঠানিক, অবৈজ্ঞানিক এবং অনুৎপাদনমুখী। ডন সোসাইটি মানব-সম্পদ উন্নয়ন এবং জাতি গঠনের উদ্দেশ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটাতে চেয়েছিল। সে কারণে, তাদের পাঠ্যসূচিতে কলা বিভাগে ইতিহাস, ভূগোল, অর্থনীতি, রাষ্ট্র-বিজ্ঞান অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগও চালু করা হয়। সতীশচন্দ্রের উপরিউল্লিখিত অনুসারিগণ ছাড়াও জগদীশচন্দ্র বসু, নীলরতন সরকার, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর মতো বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব, এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও এখানে বক্তৃতা প্রদান করতেন। রামকান্ত রায় এবং কুঞ্জ বিহারী সেন প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিষয়ে বক্তৃতা দিতেন।

ছাত্ররা শিক্ষকদের বক্তৃতা থেকে নোট গ্রহণ এবং সেগুলি নিরীক্ষণের জন্য শিক্ষকদের কাছে পেশ করত। এরপর ছাত্র অংশগ্রহণে আগ্রহী এমন বিষয়ের উপর আলোচনার ব্যবস্থা করা হতো। ডন ম্যাগাজিনে প্রকাশের জন্য লেখা পেশ করতে ছাত্রদেরকে উৎসাহ দেওয়া হতো। প্রযুক্তি সেকশনে ছিল একটি প্রাথমিক ও অপ্রধান কোর্স যা কর্মশালা কার্যক্রমের সাহায্যে পরিচালিত হতো। এসব কর্মশালায় রাসায়নিক প্রক্রিয়া যেমন সাবান ও তেল প্রস্ত্তত প্রণালিসহ সব ধরনের যান্ত্রিক কাজের শিক্ষা দেওয়া হতো। আধুনিক বুনন কৌশলও শিখানো হতো। ছাত্রদের উৎপাদিত সামগ্রী বিক্রি হতো বড় বাজারস্থ স্বদেশী দোকানে। ডন সোসাইটিতে স্বদেশী শিক্ষার একটি অন্যতম মূলনীতি ছিল প্রযুক্তি সংক্রান্ত জ্ঞান লাভ। বিজ্ঞান চর্চাই ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্স এর মূল উদ্দেশ্য হলেও সোসাইটি এখানে অভিনবত্ব যুক্ত করেছিল।

সোসাইটির মুখপাত্র হিসেবে ডন ম্যাগাজিন জাতীয় শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে প্রতিফলিত করত। এর উদ্দেশ্য ছিল ভারতের ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা ও এর রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার বিশ্লেষণ এবং সমাধানের সুপারিশ করা। ইন্ডিয়ানা ছিল এ ম্যাগাজিনের একটি বিশেষ বিভাগ যার লক্ষ্য ছিল প্রতিটি মানুষের মধ্যে স্বদেশ সম্পর্কিত জ্ঞান বৃদ্ধি এবং জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটানো। এ লক্ষ্যে সতীশচন্দ্রও স্বয়ং এবং তাঁর অনুসারীদের মধ্যে কয়েকজন ভারতবর্ষ সংক্রান্ত সকল বিষয়ের উপর অবিশ্রান্তভাবে লিখে গেছেন। ডন ম্যাগাজিন সমসাময়িক বাঙালি মানস এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদের দর্পণে পরিণত হয়েছিল। ডন সোসাইটি ১৯০৬ সালে ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশনের সাথে একীভূত হয়ে গেলেও এ সাময়িকীটি ১৮৯৬ থেকে ১৯১৩ পর্যন্ত চালু ছিল।

ডন সোসাইটির কার্যক্রম এবং ডন ম্যাগাজিনের মূল বক্তব্য যা ছিল, তাকে নিঃসন্দেহে জাতীয় শিক্ষা বলে গণ্য করা যায়। এর সব শিক্ষা ও প্রকাশনা ব্যবহারিক দিক থেকে জাতীয়তাবোধের বিকাশে এবং জাতীয় পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল বটে, কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অনুসৃত উপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার কুফলের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ সাংগঠনিক কাঠামো নিয়ে ডন সোসাইটি যে সংগ্রামের সূচনা করেছিল, তেমন আর কোনো প্রতিষ্ঠানই করে নি।  [চিত্তব্রত পালিত]