ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২১:১৫, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন  শিল্প বিকাশের গোড়ার দিকে যখন মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল, তখন এ দুই পক্ষের মধ্যে সম্পর্ক নিরূপণের জন্য কোনো সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা ছিল না। কিন্তু আধুনিক কল-কারখানা ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত যোগাযোগের বিষয়টি অনুপস্থিত এবং মালিক ও শ্রমিকের সম্পর্কটি টানাপোড়নে সঙ্কটপূর্ণ। শ্রমশক্তির ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যকার স্বার্থের দ্বন্দ্ব ক্রমে তীব্র হয়েছে এবং এর ফলে বিশ্বব্যাপী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের প্রসার ঘটেছে। ব্রিটিশ ভারতে শুরু হওয়া জাতীয়তাবাদী এবং ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সমান্তরাল বিকাশের ধারাটির ঐতিহ্য পাকিস্তান আমল পার হয়ে বাংলাদেশের জন্ম পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।

ভারতের প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন সংস্থা বম্বে মিল হ্যান্ডস অ্যাসোসিয়েশন গঠিত হয় ১৮৯০ সালের ২৪ এপ্রিল। এটি ব্রিটিশ ভারতে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে গতি সঞ্চার করে। ১৯১৯ সালে আইএলও-র প্রতিষ্ঠা শ্রমিকদের নিজেদেরকে সংগঠিত করার এবং নিজেদের ভাগ্য গঠনের প্রেরণা ও শক্তি যোগায়। এ আন্তর্জাতিক সংস্থায় ভারতের সদস্যপদ গ্রহণের ঘটনাটি শ্রমিক সংগঠনসমূহের কার্যক্রম সমন্বয়করণ ও পরিচালনার লক্ষ্যে ১৯২০ সালে অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (এআইটিইউসি) নামে একটি কেন্দ্রীয় সংগঠন সৃষ্টিতে গভীর প্রভাব বিস্তার করে।

১৯২৪ থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত সময়কে বিপ্লবী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সময় বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। এম.এন রায়, মুজাফ্ফর আহমদ, এস.এ ডাঙ্গে, শওকত ওসমানী প্রমুখ ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এবং এর ফলস্বরূপ শিল্পশ্রমিকদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্রিটিশ সরকার আন্দোলনকারী শ্রমিক ও ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে দমনমূলক ব্যবস্থা (যেমন কানপুর ষড়যন্ত্র মামলা এবং মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা) গ্রহণ করে, কিন্তু কোনো কৌশলই আন্দোলনকে দমন করতে পারে নি। বরং এসব বাধা ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সংঘটিত আন্দোলনকেই আরও শক্তিশালী করে। পরবর্তীকালে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত হয় এবং শ্রমিক শ্রেণি ঔপনিবেশিক শাসকদের চরম নির্যাতন ও অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে মুক্তির লক্ষ্যে জোরালো আন্দোলন শুরু করে।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময়ে বেশির ভাগ ট্রেড ইউনিয়নের নেতা ছিলেন হিন্দু এবং যখন তাঁরা ভারতে অভিবাসী হন, তখন পাকিস্তানে, বিশেষত এর পূর্ব অংশে চলমান আন্দোলনে এক ধরনের নেতৃত্ব-শূন্যতার সৃষ্টি হয়। অধিকন্তু, শ্রমিক স্বার্থ এগিয়ে নেওয়া সম্পর্কিত শ্রমিকদের প্রতিষ্ঠানসমূহ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাকিস্তানের বাইরের এলাকায় অবস্থিত ছিল। সমগ্র পাকিস্তানে মাত্র ৭৫টি নিবন্ধিত ট্রেড ইউনিয়ন ছিল, যেখানে ১৯৪৬ সালে অবিভক্ত ভারতে এ সংখ্যা ছিল ১,৯৮৭টি। এ অল্পসংখ্যক ট্রেড ইউনিয়নের মধ্যে পূর্ব অংশের সামান্য কয়েকটি বাদে অধিকাংশই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানে সর্বমোট ২৮,০০০ শ্রমিকসহ ১৪১টি কারখানা ছিল এবং এদের ২০,০০০ সদস্য ছিল ৩০টি ইউনিয়নের।

পাকিস্তান আমলে অধিকাংশ ট্রেড ইউনিয়ন নেতা পরস্পরবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী ছিলেন এবং ট্রেড ইউনিয়নসমূহ ছিল খন্ডিত ও দুর্বল। ফলে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন এক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়, ট্রেড ইউনিয়নের কার্যক্রম পাতি বুর্জোয়া নেতৃত্বের হাতে চলে যায়। অধিকন্তু, পাকিস্তানের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন ইউনিয়নসমূহের ভাঙ্গন, দীর্ঘস্থায়ী ধর্মঘট, পাল্টাপাল্টি তালাবন্ধকরণ, কাজে বাধাদান, কখনও কখনও সন্ত্রাস ইত্যাদির রূপ পরিগ্রহ করে।

যেহেতু বাংলাদেশে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন ব্রিটিশ ভারত এবং পাকিস্তানে আরম্ভ হয়, এটি পুঁজিবাদী শোষণের বিপরীতে একটি শ্রেণীশক্তির পরিবর্তে ঔপনিবেশিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী শক্তি হিসেবে কাজ করার তার পুরানো চরিত্রই ধরে রাখে। এর ফলে রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে এ অঞ্চলে যে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গতি লাভ করেছিল, তা স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও আদর্শিক ক্ষেত্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে।

এই সময়কালে ট্রেড ইউনিয়নসমূহের আন্দোলনের অভ্যন্তরীণ বিজয়ে সরকার এবং শাসকদলের হস্তক্ষেপ বিশেষভাবে দেখা  দেয়। অনেক শিল্প এলাকায় শাসকদলের শ্রমিক শাখা কর্তৃক ব্যাপক সন্ত্রাস চালানো হয় এবং ইউনিয়নসমূহের নেতৃত্ব থেকে সৎ ট্রেড ইউনিয়নকারীদের সরিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা চলে। অধিকন্তু, মূল ইউনিয়ন পর্যায়ে বহিরাগতদের ট্রেড ইউনিয়নের নেতা হতে বিধি-নিষেধ আরোপ ইউনিয়ন ছিনতাই-এর প্রক্রিয়াকে অনেক সহজ করে তোলে এবং শ্রমিকদেরকে অত্যন্ত দুর্বল ও প্রতিরক্ষাহীন সম্প্রদায়ে পরিণত করে।

বিশ শতকের আশির দশকে বাংলাদেশের সামরিক সরকার সব রকম ট্রেড ইউনিয়ন তৎপরতা নিষিদ্ধ করে। তখন শ্রমিকদের গণতান্ত্রিক অধিকারসহ তাদের অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়া পূরণের লক্ষ্যে ট্রেড ইউনিয়নসমূহের জাতীয় ফেডারেশনগুলি (এনএফটিইউ)  শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ) নামে একটি জোট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। শ্রমিকদের অধিকাংশ সংগঠনই স্কপভুক্ত ছিল। ১৯৮৩ সালের পর থেকে বাংলাদেশের অধিকাংশ ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন স্কপ-এর নেতৃত্বে সংগঠিত হয়। এটা লক্ষ্য করা গেছে যে, দেশের ট্রেড ইউনিয়নসমূহের আন্দোলনের মুখে সরকার এবং ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতাসমূহ স্কপসহ ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দের সুবিধাবাদ ও ঢিলেঢালা মনোভাবের দরুন শাসকমহল সেগুলিকে অমান্য করার সুযোগ গ্রহণ করে। বর্তমানে তেইশটি এনএফটিইউ-এর মধ্যে উনিশটির নেতৃবৃন্দ স্কপ-এর অন্তর্ভুক্ত।

স্কপ গঠিত হওয়ার পর তাদের উচ্চতর মজুরি এবং গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পাঁচ দফা দাবি পেশ করে। এ সকল দাবি আদায়ের লক্ষ্যে স্কপের ডাকে সমাবেশ, মশাল মিছিল, বিক্ষোভ, ধর্মঘট,  হরতাল, অবরোধ ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়। পরিহাসের বিষয় এই যে, স্কপ দেশের শ্রমিক শ্রেণির জন্য কোনো সুস্পষ্ট ফলাফল আদায় করতে ব্যর্থ হয়। স্কপের অধিকাংশ নেতার দলীয় রাজনৈতিক আনুগত্য থাকার কারণে নেতৃত্বের অধীনে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের কার্যকারিতা দুর্বল হয়ে পড়ে। স্কপের কর্মসূচিসমূহের প্রতি রাজনৈতিক দলসমূহের সমর্থনের অভাব, সরকারের ওপর বেসরকারি কর্মসংস্থানকারী ও দাতাগোষ্ঠীর অত্যধিক চাপ, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে দমন করার ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে স্কপের দাবি-দাওয়া না মানা, বিভিন্ন ইউনিয়ন জোরপূর্বক দখল, ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দকে ঘুষ দেওয়া, ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দের সুবিধাবাদী ও আপসকামী মনোভাব স্কপের দাবিসমূহকে অকার্যকর করে তোলে। প্রকৃতপক্ষে, স্কপ দেশের শ্রমিক শ্রেণীর একটি বিলুপ্তপ্রায় সংগঠনে পরিণত হয়েছে।  [আব্দুল আওয়াল খান]