জিন্নাহ, মোহাম্মদ আলী

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৮:২৪, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

জিন্নাহ, মোহাম্মদ আলী (১৮৭৬-১৯৪৮)  আইনজীবী, রাজনীতিক ও পাকিস্তানের স্থপতি। তিনি ১৮৭৬ সালের ২৫ ডিসেম্বর করাচিতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতামাতা পশ্চিম ভারতীয় উপকূলের কাথিয়াবার থেকে করাচিতে গিয়ে বসতি স্থাপন করেন। জিন্নাহ করাচির একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বোম্বের গোকুলদাস তেজ প্রাইমারি স্কুল এবং করাচির সিন্ধু মাদ্রাসা হাইস্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন এবং পরে খ্রিস্টান মিশনারি সোসাইটি হাইস্কুলে পড়াশুনা করেন। ১৮৯২ সালে মিশন স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে তিনি লন্ডন যান এবং আইন পড়ার জন্য লিংকন’স ইনে ভর্তি হন।

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ

জিন্নাহ ১৮৯৬ সালে করাচিতে ফিরে আসেন। ১৮৯৭ সালে তিনি আইন ব্যবসায়ের জন্য বোম্বাই যান, কিন্তু প্রথম তিন বছর তাঁকে কঠিন অর্থকষ্টে ভুগতে হয়। শতাব্দীর মোড় ঘুরতেই তাঁর ভাগ্যের পরিবর্তন হতে শুরু করে। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আয়ের দিক থেকে তিনি বোম্বাইর সব আইনজীবীকে ছাড়িয়ে যান। জিন্নাহ রাজনীতিতে আসেন ১৯০৬ সালে। সেসময় ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে হিন্দুসমাজের তীব্র প্রতিবাদমুখর পরিস্থিতিতে কলকাতায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন চলছিল। দাদাভাই নওরোজীর কংগ্রেসের নতুন ব্যানারে তখন ‘স্বরাজ’-এর স্লোগান যুক্ত হয়, জিন্নাহও তাতে সামিল হন।

১৯০৯ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারতীয় কাউন্সিল অ্যাক্ট পাশ হলে রাজনীতিতে জিন্নাহর উত্থান শুরু হয়। এ আইনের মাধ্যমে ভাইসরয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলকে ইম্পেরিয়েল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে রূপান্তরিত করা হয় এবং এতে নতুন ৩৫ জন মনোনীত সদস্য এবং ২৫ জন নির্বাচিত সদস্য অন্তর্ভুক্ত করে এর কলেবর বৃদ্ধি করা হয়। এতে মুসলমানদের এবং জমিদারশ্রেণীর জন্য বিশেষ প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা থাকে। জিন্নাহ বোম্বাইয়ের একটি নির্বাচনী এলাকা থেকে কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর মুসলিম লীগের সঙ্গে জিন্নাহর যোগাযোগ শুরু হয়। জিন্নাহ পরের বছর ডিসেম্বর মাসে মুসলিম লীগের অধিবেশনে যোগ দেন। এ অধিবেশনে কংগ্রেসের সঙ্গে একই সুরে ‘স্বরাজ’ দাবি করার লক্ষ্যে মুসলিম লীগের গঠনতন্ত্র সংশোধনের প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। মওলানা মোহাম্মদ আলী ও সৈয়দ ওয়াজির হাসানের অনুরোধে জিন্নাহ ১৯১৩ সালে মুসলিম লীগে যোগ দেন।

১৯১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে কংগ্রেস বোম্বাইতে তাদের বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠানের প্রস্ত্ততি নেয়। বোম্বাইর মুসলিম নেতাদের সম্মতি নিয়ে জিন্নাহ একটি পত্রের মাধ্যমে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দকে কংগ্রেসের সঙ্গে একই স্থানে এবং একই সময়ে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগকে তার বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠানের আহবান জানান। কিন্তু কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের উগ্রপন্থীরা এর তীব্র বিরোধিতা করে। ১৯১৬ সালের শরৎকালে জিন্নাহ পুনর্বার ইম্পেরিয়েল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯১৬ সালের ডিসেম্বরে তিনি কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগকে লক্ষ্ণৌতে একই স্থানে একই সময়ে বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠানে রাজী করান। জিন্নাহ লীগের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। দুটি দলের অধিবেশনেই তাদের যৌথ কমিটির তৈরি করা ন্যূনতম সংস্কারের দাবি অনুমোদন লাভ করে এবং ভারত সরকারের কাছে তা পেশ করা হয়। যেসব প্রদেশে মুসলমানরা সংখ্যালঘিষ্ঠ সেখানে আইন পরিষদে তাদের প্রতিনিধিত্বে অতিরিক্ত সুযোগ দেওয়া হবে এই মর্মে কংগ্রেস জিন্নাহর সঙ্গে একমত হলে পৃথক নির্বাচনী এলাকা সংক্রান্ত ভারতীয় রাজনীতির প্রধান অভ্যন্তরীণ সমস্যার সুরাহা হয়। এই ঐতিহাসিক লক্ষ্ণৌ চুক্তির পর জিন্নাহ মুসলমানদের সর্বভারতীয় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।

১৯১৯ সালের মার্চ মাসে রাউল্যাট আইন পাস করে ভারত সরকার রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য প্রচুর ক্ষমতা হাতে নেয়। এর প্রতিবাদে জিন্নাহ ইম্পেরিয়েল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল থেকে পদত্যাগ করেন এবং গান্ধী অহিংস  অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন। এপ্রিলের প্রথমদিকে গান্ধীর অনুসারীরা অমৃতসরে দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু করে তিনজন ইউরোপীয় ব্যাংক ম্যানেজারকে হত্যা করে। এরই ফলশ্রুতিতে ১৩ এপ্রিল জালিয়ানওয়ালা বাগে সংঘটিত হয় নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন স্থগিত করেন। ১৯২০ সালের ডিসেম্বর মাসে কংগ্রেসের নাগপুর অধিবেশনে এই দল সম্পর্কে জিন্নাহর ধারণা সম্পূর্ণ বদলে যায়। এখান থেকেই তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছেদ করেন। মুসলিম লীগের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্কে ভাটা পড়ে, কারণ তিনি দেখতে পান যে মুসলিম নেতৃবৃন্দের অভিজাতশ্রেণী কিছুতেই ব্রিটিশ রাজের প্রতি তাঁদের চিরাচরিত আনুগত্য থেকে সরে আসতে রাজী নন, বরং তাঁরা ইংরেজদের তাঁদের পৃষ্ঠপোষক মনে করেন। ১৯১৬ সালের লক্ষ্ণৌ চুক্তিতে কংগ্রেস যেসব অঙ্গীকার করেছিল, দলটি তা কখনও পালন করে নি। ফলে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে দূরত্ব বাড়তেই থাকে।

জিন্নাহর জন্য বিশের দশক ছিল শুধুই রাজনৈতিক হতাশার। রাজনৈতিক সংস্কার নিয়ে ব্রিটিশ সরকার টালবাহানা করতে থাকে, কংগ্রেস মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বের স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে, ভারতীয় গণমানুষের ভাগ্য নির্ধারণে গান্ধী লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতি অব্যাহত রাখেন এবং মুসলমানরা তাদের অবস্থান ও শক্তি সম্পর্কে শোচনীয় সঙ্কটে ভুগতে থাকে। ১৯৩০ সালে লন্ডনে নিষ্ফল প্রথম গোলটেবিল বৈঠকে জিন্নাহ নিজেকে প্রায় অবহেলিত হিসেবে আবিষ্কার করেন। দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে মুসলিম প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব পান আগা খান এবং কংগ্রেসের নেতৃত্ব পান গান্ধী। তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠকেও জিন্নাহকে অন্তর্ভুক্ত করা হলো না এবং তিনি যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ মতবাদের প্রতিনিধিত্ব করেন তা কেউ ভাবলেনই না। ১৯৩১ সালে জিন্নাহ সিদ্ধান্ত নেন যে, তিনি লন্ডনে স্থায়িভাবে বসবাস করবেন এবং চিরদিনের জন্য ভারতীয় রাজনীতি ত্যাগ করবেন। লন্ডনে তিনি প্রিভি কাউন্সিল বারে আইনব্যবসা শুরু করেন।

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে বিভিন্ন আইন পরিষদে মুসলমান এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষার জন্য তাদের প্রতিনিধিত্ব রাখার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ আইন অনভিজাত জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকদের জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মুসলিম নেতৃবৃন্দের আহবানে জিন্নাহ ভারতে ফিরে এসে মুসলমানদের নেতৃত্ব গ্রহণে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। নতুন ভারত শাসন আইনের অধীনে ১৯৩৭ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দেখা গেল ভারতের দশ কোটি মুসলমান মোটেও একটি সংঘবদ্ধ সম্প্রদায় নয়। তারা ছিল বিচ্ছিন্ন, একে অপরের নিকট অনেকটা অপরিচিত এবং ধর্ম ছাড়া তাদের মধ্যে অন্য কোনো যোগসূত্র ছিল না। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ মুসলমান হলেও সেখানে কেন্দ্রীয় বা প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে মুসলিম লীগ একটি আসনও পেল না। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঞ্জাবে মুসলমানরা নানা পুরনো দলের পতাকাতলে সংঘবদ্ধ ছিল এবং জিন্নাহর পুনরুজ্জীবিত মুসলিম লীগের প্রতি তাদের কোনো আগ্রহ ছিল না। সিন্ধু প্রদেশেও মুসলমানরা লীগকে পাত্তা না দিয়ে ভারত বিভক্তি নীতির বিরোধিতা করে কংগ্রেসের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে। নির্বাচনে মুসলিম লীগ শুধু বাংলায় জয়লাভ করে এবং কৃষক প্রজা পার্টির নেতা এ.কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করে।

১৯৩৮ সালে জিন্নাহ হিন্দুদের মুসলিম বিরোধী প্রচারণার মোকাবেলা করার জন্য দিল্লিতে Dawn নামে একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকার প্রকাশনা শুরু করেন। ১৯৪০ সালে জিন্নাহ দ্বিজাতিতত্বের প্রচারণা শুরু করেন এবং ওই  বছর ২৩ মার্চ নিখিল ভারত মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। এ অধিবেশনে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক উত্থাপিত ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ গ্রহণ করা হয়।

ক্রিপস মিশন ব্যর্থ হলে গান্ধী ভারত ছাড় আন্দোলন শুরু করেন। গান্ধী, নেহেরু এবং কংগ্রেসের অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে তখন দেশদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৪৩ সালের ২৬ জুলাই বোম্বাইয়ে জিন্নাহকে একজন খাকসার স্বেচ্ছাসেবক হত্যার চেষ্টা করে, কিন্তু জিন্নাহ অল্পের জন্য বেঁচে যান।

জিন্নাহ কেবিনেট মিশন পরিকল্পনা মেনে নেন, কিন্তু কংগ্রেস এ পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে। ১৯৪৬ সালের ২৮ জুলাই বোম্বাইতে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল সভায় মুসলিম লীগ কেবিনেট মিশনের পরিকল্পনার প্রতি তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে এবং পাকিস্তান হাসিলের জন্য প্রত্যক্ষ সংগ্রাম কর্মসূচির সিদ্ধান্ত নেয়। এ সময় (৮ আগস্ট ১৯৪৬) ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল কেন্দ্রে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের জন্য কংগ্রেসকে আমন্ত্রণ জানালে মুসলিম লীগ তার তীব্র প্রতিবাদ জানায়। ১৬ আগস্ট প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসে কলকাতা হত্যাযজ্ঞের শুরু হয় এবং এতে কমপক্ষে ৪ হাজার মুসলমান ও হিন্দু নিহত হয়। অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে বিহারে ৮ হাজার মুসলমানকে হত্যা করা হয়। যুক্ত প্রদেশেও বহু মুসলমানকে হত্যা করা হয়।

অক্টোবরের গোড়ার দিকে ভাইসরয়ের সঙ্গে আরও আলাপ-আলোচনার পর জিন্নাহ অন্তর্বর্তী সরকারে লিয়াকত আলী খানের নেতৃত্বে ৫ জন মুসলিম লীগ মন্ত্রী দিতে সম্মত হন। সর্বশেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারত বিভক্তি অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করতে ১৯৪৭ সালের ২২ মার্চ দিল্লিতে পৌঁছান। ১৯৪৭ সালের ৭ আগস্ট জিন্নাহ দিল্লি থেকে করাচি যান এবং ১৪ আগস্ট পকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তাঁর নেতৃত্ব এবং তাঁর প্রতি জনগণের পূর্ণ আস্থার কারণেই নবগঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তান তার প্রাথমিক সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়। জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর করাচিতে মৃত্যুবরণ করেন।  [এনামুল হক]