জাহাজ নির্মাণ শিল্প

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৯:৩৯, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

জাহাজ নির্মাণ শিল্প  বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক শিল্পখাত। নদীমাতৃক বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সমুদ্র জলসীমার আয়তন ৯০০০ বর্গ কিমি এবং এর মধ্যে ৭২০ কিমি দীর্ঘ সমুদ্র জলসীমা। দেশের প্রায় ৭০০ ছোট-বড় নদীর ২৪ হাজার কিমি দীর্ঘ নদীপথ অভ্যন্তরীণ জলসীমা হিসেবে নৌপরিবহণের কাজে ব্যবহূত হয়। বর্তমানে প্রায় ছোট-বড় দশ হাজার অভ্যন্তরীণ ও সমুদ্র উপকূলীয় জাহাজ সারা দেশজুড়ে পণ্য ও যাত্রী পরিবহণ কাজে নিয়োজিত রয়েছে। এসব জাহাজ দেশের শতকরা ৯০ শতাংশ তৈলজাত দ্রব্য, ৭০ শতাংশ মালামাল এবং ৩৫ শতাংশ যাত্রী বহন করে থাকে। এই শিল্প খাতে এখন দেড় লক্ষাধিক দক্ষ ও অর্ধদক্ষ শ্রমিক বর্তমানে কাজ করছে এবং প্রায় ২০ লাখ মানুষ নানাভাবে জাহাজ নির্মাণ শিল্পের সাথে জড়িত। দেশের সকল আভ্যন্তরীণ এবং উপকূলীয় জাহাজ বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ কারখানায় (শিপইয়ার্ডে) নির্মিত হয়। সম্প্রতি বাংলাদেশ সাফল্যের সাথে ডেনমার্কে প্রথম সমুদ্রগামী জাহাজ রপ্তানি করেছে। এ জন্য বাংলাদেশ ভারত, চীন এবং ভিয়েতনামের মত বৃহৎ জাহাজ নির্মাণকারী দেশের সাথে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়ে সাফল্য দেখিয়েছে। বাংলাদেশের অনেক জাহাজ নির্মাণ কারখানা এখন দশ হাজার টন ধারণ ক্ষমতার জাহাজ নির্মাণে সক্ষম।

জাহাজ নির্মাণ শিল্পের ইতিহাস প্রাচীনকাল থেকেই নৌকা ও জাহাজ নির্মাণে বাংলাদেশের খ্যাতি রয়েছে। চট্টগ্রামে নির্মিত হত ঐতিহ্যবাহী জাহাজ ও কাঠের নৌকা। ইউরোপের পরিব্রাজক সিজার ফ্রেডরিকের ভাষ্য মতে, চট্টগ্রাম পঞ্চদশ শতকে এ অঞ্চলের কাঠের জাহাজ নির্মাণ শিল্পের মূল কেন্দ্র ছিল। সপ্তদশ শতকে তুরস্কের সুলতানের জন্য পূরো ফ্লিট তৈরি করেছিল চট্টগ্রামের জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলি। মুগল আমলে বাংলা জাহাজ ও নৌকা তৈরির কাজে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি পায়।

জাহাজ নির্মাণ শিল্প

কাঠের যুদ্ধ জাহাজের পরিবর্তে লৌহ নির্মিত যুদ্ধ জাহাজ তৈরি করা শুরু হয় উনিশ শতকের শেষভাগে। উনিশ শতক পর্যন্ত চট্টগ্রাম ১০০০ টন ধারণক্ষমতার জাহাজ নির্মাণে সিদ্ধহস্ত ছিল। বিশ শতকের শুরুতে এবং পাকিস্তান আমলে সরকারি জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলি জাহাজ নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। দেশের প্রায় অধিকাংশ জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলে অবস্থিত। এ অঞ্চলের প্রতিষ্ঠানগুলি সারা দেশের অভ্যন্তরীণ ও সমুদ্র উপকূলীয় জাহাজ এবং মাছ ধরার ট্রলার নির্মাণ ও মেরামত করে যাচ্ছে। ১৯৭৯ সালে বিশ্ব খাদ্য সংস্থার অনুদানে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ জলযান সংস্থার জন্য ৮টি খাদ্য বহনযোগ্য জাহাজ নির্মাণ করে বেসরকারি জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান নারায়ণগঞ্জ হাইস্পিড শিপইয়ার্ড। 

প্রকৃত অর্থে এটাই বেসরকারিভাবে প্রথম আন্তর্জাতিক মানের জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু। এরপর হাইস্পিড শিপইয়ার্ড জাপানের সাথে যৌথ উদ্যোগে গভীর সমুদ্রগামী চারটি মাছ ধরা ট্রলার নির্মাণ করে। নববইয়ের দশকে জাপানের মিটস্যুই ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড শিপবিল্ডিং ইন্ডাস্ট্রি হাইস্পিড শিপইয়ার্ডের সাথে যৌথ শিল্পদ্যোগ গ্রহণ করে এবং চারটি গভীর সমুদ্রগামী মাছ ধরা ট্রলার তৈরি করে। বর্তমানে আনন্দ শিপইয়ার্ড অ্যান্ড স্লিপওয়ে লিমিটেড এবং ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড লিমিটেডের মত জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান আধুনিক জাহাজ নির্মাণে আন্তর্জাতিক মানের দক্ষতা অর্জন করেছে। ২০০৮ সালে আনন্দ শিপইয়ার্ড ডেনমার্কে তাদের নির্মিত প্রথম সমুদ্রগামী জাহাজ স্টিলা মেরিজ রপ্তানি করে সারা বিশ্বে জাহাজ রপ্তানীকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য সুনাম বয়ে এনেছে।

জাহাজ নির্মাণ শিল্পে বর্তমান অবস্থান  বাংলাদেশে প্রায় অর্ধশতাধিক শিপইয়ার্ড এবং শতাধিক মেরিন ওয়ার্কশপ সক্রিয় রয়েছে। শিপইয়ার্ডগুলির ৭০% ঢাকা এবং এর আশেপাশে অবস্থিত, ২০% চট্টগ্রামে এবং ১০% খুলনা ও বরিশালে অবস্থিত। দেশের প্রায় সকল অভ্যন্তরীণ এবং সমুদ্র উপকূলীয় জাহাজ এই সব শিপইয়ার্ডে নির্মাণ এবং মেরামত হয়ে থাকে। স্থানীয় চাহিদা পূরণের জন্য এসব শিপইয়ার্ড ৩৫০০ টন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন জাহাজের ডিজাইন তৈরি এবং নির্মাণ করে থাকে। বেশিরভাগ শিপইয়ার্ডই নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়ে থাকে; এতে সরকারের পর্যবেক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণ অতি সামান্য। বছর প্রতি নতুন নির্মিত জাহাজের সংখ্যা গড়ে ২৫০। এ কাজে শিপইয়ার্ডগুলি বিপুলসংখ্যক দক্ষ ও অদক্ষ জনশক্তি নিয়োগ করে থাকে। বেশিরভাগ ব্যক্তি মালিকানাধীন শিপইয়ার্ড মার্চেন্ট শিপের পুরানো প্লেট, ইঞ্জিন ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে যা ভাটিয়ারী অঞ্চলে জাহাজভাঙ্গা কারখানা থেকে সংগ্রহ করা হয়। ইতোমধ্যে দেশের বেশ কিছু শিপইয়ার্ড ১০,০০০ টন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন জাহাজ তৈরি করার ক্ষমতা অর্জন করেছে।

নির্মাণকৃত জাহাজ

বর্তমানে এই শিল্পে প্রায় ৫০,০০০ দক্ষ এবং ১০০,০০০ আধাদক্ষ কর্মী নিয়োজিত রয়েছে। দেশে আনুমানিক ১০,০০০ টন ক্ষমতার আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন জাহাজ তৈরির ক্ষমতা সম্পন্ন প্রায় ১১ টি স্থানীয় শিপইয়ার্ড রয়েছে। এগুলো হলো: আনন্দ শিপইয়ার্ড ও স্লিপওয়ে লিমিটেড, ঢাকা; ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড লিমিটেড, চট্টগ্রাম; খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেড, খুলনা; কর্ণফুলী স্লিপওয়ে (প্রা.) লিমিটেড, চট্টগ্রাম; হাইস্পিড শিপবিল্ডিং অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেড, নারায়ণগঞ্জ; ঢাকা ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেড, ঢাকা; ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেড, নারায়ণগঞ্জ; চিটাগাং ড্রাইডক লিমিটেড, চট্টগ্রাম; নারায়ণগঞ্জ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড শিপবিল্ডিং লিমিটেড, নারায়ণগঞ্জ; চিটাগাং শিপইয়ার্ড লিমিটেড, চট্টগ্রাম এবং বসুন্ধরা স্টিল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড, নারায়ণগঞ্জ। 

শিপইয়ার্ডের উৎপাদনক্ষমতা ও শ্রমঘণ্টা  বাংলাদেশের শিপইয়ার্ডগুলির শ্রমিকদের কার্যক্ষমতা ১১.৪৩ যা অন্যান্য দেশের তুলনায় সর্বনিম্ন (সারণি ১)। কিন্তু যথাযথ প্রশিক্ষণ এবং স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতির ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে বাংলাদেশে ঘণ্টাপ্রতি গড় পারিশ্রমিক মাত্র এক ইউএস ডলার যা এখন পর্যন্ত সর্বনিম্ন (সারণি ২)। সুতরাং বাংলাদেশে তুলনামুলক শ্রমব্যয় দাঁড়াল মাত্র ০.৪৫ (সারণি ৩) এবং এটি পৃথিবীর সর্বনিম্ন।

সারণি ১ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাহাজ নির্মাণ শিল্পের অগ্রগতি।

দেশ শ্রমিকের কর্মদক্ষতা
জাপান
ইউরোপিয়ান দেশসমূহ
আমেরিকা
ভারত ১০
বাংলাদেশ ১১.৪৩

সারণি ২ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাহাজ নির্মাণ শ্রমিকদের শ্রম ব্যয়।

দেশ ঘণ্টাপ্রতি গড় পারিশ্রমিক (ডলার)
বাংলাদেশ ১.০০
ভারত ২.০০
চীন ৭.০০
দক্ষিণ কোরিয়া ২৩.০০
জাপান ২৬.০০
আমেরিকা ২৫.০০
ব্রিটেন ২৭.০০
ফ্রান্স ২৬.০০
ইটালি ২৪.০০
জার্মানি ৩৬.০০

সারণি ৩ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনামূলক শ্রম ব্যয়।

দেশ তুলনামূলক শ্রম ব্যয়#দেশ তুলনামূলক শ্রম ব্যয়
বাংলাদেশ ০.৪৫ কানাডা ১১
ভারত জাপান ১২
চীন ১-২ ইটালি ১৩
সিঙ্গাপুর ফ্রান্স ১৩
হংকং ডেনমার্ক ১৩
তাইওয়ান নরওয়ে ১৪
দক্ষিণ কোরিয়া সুইডেন ১৪
ব্রিটেন ১০ ফিনল্যান্ড ১৫
আমেরিকা ১০ জার্মানি ১৫

শিপইয়ার্ডে রপ্তানিযোগ্য জাহাজের ব্যয় বিশ্লেষণ বাংলাদেশ হতে রপ্তানিকৃত জাহাজের মূল্যমান নির্ণয় এবং খাতওয়ারি খরচের বিবরণের বিশ্লেষণ ও ফলাফল ৪ এবং ৫ নং চিত্রে দেওয়া হল। বাংলাদেশে জাহাজ নির্মাণের খরচ নানা কারণে জাহাজ নির্মাণকারী অন্যান্য দেশ যেমন চীন, কোরিয়া, জাপান, ভারত থেকে ১৫%-২০% (ব্যাংক মুনাফা ৩%-৬% + ব্যাংক গ্যারান্টি ৮%-১৬% + এল/সি কমিশন ৪%-৮% + অন্যান্য খরচ ১%) বেড়ে যায়। আবার আমদানিকৃত খুচরা যন্ত্রাংশের উপর আরোপিত কর দেশীয় জাহাজ নির্মাণ খরচকে আরো বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে ভারত মাত্র ১০% অতিরিক্ত নির্মাণ খরচকে কমানোর জন্য ৩০% ভর্তুকি দিয়ে থাকে। ফলে ভারত এদেশের তুলনায় জাহাজ নির্মাণ ব্যবসায় ৩০%-৪০% অগ্রগামী। সুতরাং শুধুমাত্র স্বল্প শ্রম ব্যয় বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্পকে বেশিদূর এগিয়ে নিতে পারবে না। বর্তমানে বাংলাদেশ জাহাজ নির্মাণের কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামের ৫০% উৎপাদন করতে পারে যা অভ্যন্তরীণ ও উপকূলীয় জাহাজ তৈরিতে ব্যবহূত হয়। বাকি যন্ত্রাংশ বিদেশি বাজার অথবা ভাটিয়ারী থেকে সংগ্রহ করা হয়। এই অনুপাত বাংলাদেশের শিপইয়ার্ডে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন জাহাজ তৈরিতে বর্তমানে ১০% থেকে ১৫%। অভিজ্ঞ বিদেশি প্রস্ত্ততকারীদের সহযোগিতা, পদক্ষেপ ও যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে এ অনুপাত ৪৫% পর্যন্ত উন্নীত করা যেতে পারে। বাংলাদেশি শিপইয়ার্ড কর্তৃক নির্মাণাধীন রপ্তানিযোগ্য জাহাজের সর্বমোট খরচের ৪০% স্থানীয় অবদান।

জাহাজ নির্মাণ শিল্পের বৈশ্বিক ধারা  আগে জাহাজ নির্মাণ শিল্পে প্রাচ্যের আধিপত্য থাকলেও প্রথম মহাযুদ্ধের পর এ শিল্পে আমেরিকার একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই শিল্পে  ব্রিটেন নেতৃত্ব দেয়। জাপান বৃহৎ আকারের তেলবাহী জাহাজ নির্মাণের ক্ষেত্রে শীর্ষস্থান দখল করে। এরপর দক্ষিণ কোরিয়া এই ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেয়। এভাবে এই শিল্পের বাজার পাশ্চাত্য থেকে প্রাচ্যের দিকে ঝুঁকে পড়ে। কিন্তু এই শিল্পে চীন এখনও পর্যন্ত অপ্রতিদ্বন্দ্বী। চীনের সূলভ মূল্যের শ্রমবাজার এর বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এক্ষেত্রে বিকাশমান শক্তির মধ্যে রয়েছে ভারত ও ভিয়েতনাম। বর্তমানে এই শিল্প তুলনামূলক সস্তা শ্রমের দেশেই স্থানান্তর হতে দেখা যাচ্ছে। এই শিল্পে ভারত পঞ্চম বৃহৎ রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। আর এভাবেই এই শিল্প ইউরোপ থেকে এশিয়ায় স্থানান্তরিত হয়েছে যার ভিত্তি হচ্ছে সস্তা শ্রমবাজার।

বিশ্বে বিভিন্ন দেশের জাহাজ নির্মাণের শতকরা ভাগ (মিলিয়ন টন)

বিশ্বে জাহাজ নির্মাণ শিল্পের চাহিদা বর্তমানে জাপান, চীন, কোরিয়া, ভারত, সিংগাপুর এবং ভিয়েতনামের প্রায় সকল বৃহৎ জাহাজ নির্মাণ কারখানাগুলি ২০১২ সাল পর্যন্ত নতুন জাহাজ নির্মাণের জন্য কার্যাদেশ পেয়েছে। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে জাহাজ নির্মাণের চাহিদা আরো বেশি। ফলে অনেক জাহাজ ক্রয়কারী সংস্থা তাদের চাহিদা অনুসারে জাহাজ তৈরি করতে পারছে না এবং তারা এশিয়ার অনেক দেশে গিয়ে তাদের নতুন জাহাজ বানাচ্ছে। এভাবেই বাংলাদেশ, ব্রাজিল, ভারত, পকিস্তান এবং তুরস্কের মত দেশগুলি নতুন জাহাজ তৈরির ফরমায়েশ পাচ্ছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিশ্বের নতুন জাহাজ নির্মাণের চাহিদা বছরে শতকরা পাঁচ ভাগ বাড়ছে; অথচ সে তুলনায় জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান (শিপইয়ার্ড) বাড়ছে না। এছাড়া আন্তর্জাতিক নৌ সংস্থা (আইএমও) এমন কিছু আইনকানুন বলবৎ করেছে যে, পুরাতন জাহাজ কোনভাবেই মেরামত করে ব্যবহারের উপযোগী করা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে সারা বিশ্বে পণ্য পরিবহণ বেড়ে গেছে অনেকগুণ। এজন্য সবচেয়ে সূলভ পণ্য পরিবহণ খাত হিসাবে জাহাজের চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে।

বাংলাদেশ ও বিশ্বের জাহাজ নির্মাণ শিল্পের চাহিদা ও অবস্থান

জাহাজ নির্মাণ শিল্পের ভবিষ্যত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার হিসেব মতে, বিশ্বের জাহাজ নির্মাণ বাজারের মোট পরিমাণ ১৬০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যদি বাংলাদেশ এ বাজারে মাত্র ১% অর্জন করতে পারে তবে তা হবে ১৬ বিলিয়ন ডলার এবং যদি বিশ্বের ছোট জাহাজ নির্মাণ বাজারের শতকরা এক ভাগও আয়ত্তে নিতে পারে, তবে তা চার বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। বর্তমানে দেশের প্রধান দুটি শিপইয়ার্ড আনন্দ শিপইয়ার্ড ও ওয়েস্টার্ন মেরিন ৪১টি ছোট আকৃতির নৌযান তৈরির জন্য ইউরোপীয় ক্রেতাদের সঙ্গে ০.৬ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায় ২০১২ সালের মধ্যে বিশ্বে ছোট থেকে মাঝারি আকৃতির ১০,০০০ নতুন  নৌযানের চাহিদা রয়েছে। সুতরাং ছোট ও মাঝারি নৌযানের বাজার খুবই চাঙ্গা এবং বাংলাদেশ যথেষ্ট উন্নতি দেখাচ্ছে। বাংলাদেশ ছোট ও মাঝারি কার্গো জাহাজ, তেলবাহী জাহাজ, বহুমুখি ব্যবহারযোগ্য জাহাজ যা ১৫,০০০ টন বা ২৫,০০০ টন পর্যন্ত ধারণক্ষমতা সম্পন্ন জাহাজ তৈরির ক্ষমতা রাখে। সুতরাং বাংলাদেশের ছোট কার্গো ও কন্টেইনারবাহী জাহাজ নির্মাণ শিল্পের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।

বিশ্ব মন্দা ও বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে বিশ্ব মন্দার বাজারে ছোট ও মাঝারি জাহাজের চাহিদা বেড়ে চলেছে। পক্ষান্তরে বড় জাহাজের চাহিদা অনেকটা কমে গেছে। যে কারণে বৃহৎ জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ও দেশগুলি অর্থনৈতিক মন্দার মুখোমুখি হয়েছে। বাংলাদেশ যেহেতু ক্ষুদ্র ও মাঝারি জাহাজ নির্মাণে অভ্যস্ত, তাই আমাদের জাহাজ নির্মাণ শিল্প বিশ্ব মন্দার কবল থেকে মোটামুটি নিরাপদ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, ধনী দেশগুলি বড় জাহাজ নির্মাণ কমিয়ে দিলেও ছোট জাহাজ নির্মাণ অব্যাহত রাখবে। ফলে বিশ্ব মন্দার সময় বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলির কাজ অব্যাহত থাকবে এবং এ সময়ের মধ্যে দেশীয় জাহাজ নির্মাণ শিল্পকে সরকারের সাথে যৌথ উদ্যোগে আরও শক্তিশালী করতে পারবে।

জাহাজ নির্মাণ শিল্পের স্থানীয় ও বিশ্ববাজারের ভবিষ্যৎ  এটা বলা যায় যে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ এবং বিশ্বের জাহাজ নির্মাণের পরিমাণ ধারণক্ষমতায় (ডেডওয়েট টনে) যথাক্রমে ০.৪৪ এবং ৫২.৫ মিলিয়ন টন। সুতরাং বাংলাদেশ ২০১৫ সালের মধ্যেই সারা বিশ্বের নতুন জাহাজ নির্মাণের চাহিদার ০.৮৪% উৎপাদন করতে সক্ষম হবে যার মূল্যমান প্রায় ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

বাংলাদেশে জাহাজ নির্মাণের প্রতিবন্ধকতা বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্পের বাধা বা চ্যালেঞ্জগুলি হলো:

(ক) বাংলাদেশের মত অনেক দেশ যেমন ভিয়েতনাম, ব্রাজিল, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক জাহাজ নির্মাণের বর্ধিত বিশ্ববাজার নিজেদের দখলে রাখার চেষ্টা করছে;
(খ) স্থানীয় শিপইর্য়াডগুলি থেকে প্রতিবছর দক্ষ জনশক্তি বিদেশি শিপইয়ার্ডগুলিতে যুক্ত হওয়ায় স্থানীয় জাহাজ নির্মাণ শিল্প সাময়িক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে;
(গ) শতকরা ৮০ ভাগের বেশি কাঁচামাল এবং জাহাজ নির্মাণ উপাদান বিদেশ থেকে আমদানী করতে হচ্ছে। ফলে দেশীয় শিপইয়ার্ডগুলিতে রপ্তানিযোগ্য জাহাজের নির্মাণ ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক নির্ভরতা বাড়ছে;
(ঘ) বিভিন্ন দেশের জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের দেশের জাহাজ নির্মাণের কাঁচামালের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে একটি সুসম্পর্ক বজায় রাখে এবং দ্রুততার সাথে সবকিছুই কাছে পেয়ে যায়। ফলে তারা তাড়াতাড়ি নির্মাণাধীন জাহাজ মালিকের কাছে হস্তান্তর করতে পারে। অথচ এদেশের শিপইয়ার্ডগুলি জাহাজ নির্মাণের কাঁচামালের জন্য বহুলাংশে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরশীল। ফলে বাংলাদেশি জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলির নতুন জাহাজ তৈরি ও সরবরাহ করতে বেশি সময় লাগে;
(ঙ) জাহাজ নির্মাণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে বেশিরভাগ জাহাজ নির্মাণকারী দেশ, জাহাজ নির্মাণ শিল্প ও অন্যান্য সহযোগী শিল্পের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে। কিন্তু মানসম্মত মেরিন যন্ত্রপাতি সরবরাহকারী কারখানার অভাব এবং সীমিত অবকাঠামোগত সুবিধার কারণে বাংলাদেশে জাহাজ নির্মাণ প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এতে জাহাজ তৈরিতে অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি অর্থ ও সময় ব্যয় হচ্ছে;
(চ) এদেশের বেশিরভাগ শিপইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনা আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন নয়। দক্ষ অর্থব্যবস্থাপনার অভাব, বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপনা সংস্কৃতির (কর্পোরেট কালচার) অনুপস্থিতি, সামগ্রিক ও দূরদর্শিতার অভাবের কারণে দিন দিন দেশীয় শিপইয়ার্ডগুলি পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে;
(ছ) সহযোগী শিল্পের পশ্চাৎপদতাও রপ্তানিযোগ্য জাহাজ নির্মাণ খরচ বৃদ্ধি ও সরবরাহ প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত করছে;
(জ) পর্যাপ্ত পরিমাণ জমির অভাব, জ্বালানি ঘাটতি এবং দূর্বল অবকাঠামোগত ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্পের উন্নতিতে একটি বড় বাধা;
(ঝ) বিশ্বমন্দার কারণে জাহাজ এবং লোহার (প্লেটের) বাজার অস্থিতিশীল হওয়ায় জাহাজ তৈরির অনেক চুক্তি বাতিল হতে দেখা যাচ্ছে, যা দেশীয় জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য একটি বড় হুমকি;
(ঞ) ইউরোপীয়রা বাংলাদেশে নির্মিত জাহাজের বড় গ্রাহক। তারা নির্মাণের মোট খরচের ৬০-৬৫% যন্ত্রপাতি বিদেশ থেকে আমদানি করার শর্ত দেয়। অথচ বিদেশি সরবরাহকারী সংস্থাগুলি বাংলাদেশি জাহাজ নির্মাণকারকদের কাছে ঐসব যন্ত্রপাতির জন্য প্রতিযোগিতামূলক দামের প্রস্তাব দেয় না এবং বেশি দাম হাকায়। ফলে দেশীয় জাহাজের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায়;
(ট) বেশিরভাগ শিপইয়ার্ড ঢাকার নিকটবর্তী নদী তীরে অবস্থিত, যা সমুদ্র থেকে অনেক দূরে। এছাড়া পলি পড়ায় নদীগুলি দিন দিন নাব্যতা হারাচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে এই সব শিপইয়ার্ডে জাহাজ নির্মাণ করে নদীপথে সমুদ্র পর্যন্ত পৌঁছানো কষ্টসাধ্য হবে। ফলে ঢাকার আশে পাশে অবস্থিত শিপইয়ার্ডগুলিতে সীমিত ড্রাফ্ধসঢ়;টের (সর্বোচ্চ ৪-৪.৫ মি.) জাহাজ তৈরি করতে হচ্ছে। এছাড়া নদীগুলির উপরে সেতু এবং বৈদ্যুতিক/টেলিফোন লাইন থাকায় বড় আকারের জাহাজ তৈরিতে ও পরিবহণে বাধার সৃষ্টি হচ্ছে;
(ঠ) স্থানীয় শিপইয়ার্ডগুলিতে মাননিয়ন্ত্রণ এবং দক্ষতার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে;
(ড) অর্থনৈতিক দিক থেকে মূলধনের স্বল্পতা, উচ্চ সুদে শিল্পঋণ, উচ্চ ব্যাংক গ্যারান্টি এবং উচ্চ হারে এলসি মার্জিনের কারণে এদেশের জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলি (শিপইয়ার্ডসমূহ) আশানুরূপ সফলতা অর্জন করতে পারছে না;

জাহাজ নির্মাণ একটি মধ্যম প্রযুক্তির এবং অতি উচ্চ মূলধনের শিল্প। এখনো বাংলাদেশে জাহাজ নির্মাণ শিল্প ঝুঁকিপূর্ণ এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হতে পারে নি।  [খন্দকার আক্তার হোসেন]