জাদুঘর

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৬:৩৭, ১০ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

জাদুঘর  আই.সি.ও.এম (১৯৭৪)-এর দশম সাধারণ সভা জাদুঘরকে সংজ্ঞায়িত করেছে সমাজের সেবায় এবং উন্নয়নের জন্য একটি অলাভজনক স্থায়ী প্রতিষ্ঠান হিসেবে। জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত এ প্রতিষ্ঠান জনগণের শিক্ষা-দীক্ষা এবং বিনোদনের উদ্দেশ্যে মানুষ ও তাঁর পারিপার্শ্বিক বস্ত্তগত নিদর্শনাদি সংগ্রহ, সংরক্ষণ, গবেষণা, প্রকাশনা এবং প্রদর্শন করে থাকে।

বাংলায় জাদুঘরের ধারণা এসেছে ব্রিটিশদের মাধ্যমে। কেবল বাংলায় নয় সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে জাদুঘরের ইতিহাসের সূচনা ১৭৯৬ সালে। কোলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি এর সদস্যগণ এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁরা প্রত্নতাত্ত্বিক, জাতিতাত্ত্বিক, ভূ-তাত্ত্বিক এবং প্রাণী সম্বন্ধীয় নমুনা সংগ্রহ এবং সেগুলিকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। ১৭৯৬ সালে একটি ভবন নির্মাণের জন্য আর্থিক সাহায্যের আহবান জানানো হয়। এশিয়াটিক সোসাইটির পৃষ্ঠপোষক ওয়ারেন হেস্টিংস কলকাতার পার্ক স্ট্রিটে এক খন্ড জমির ব্যবস্থা করেন এবং ১৮০৮ সালে ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হয়। এভাবে ১৮১৪ সালে উপমহাদেশের প্রথম জাদুঘর ‘এশিয়াটিক সোসাইটি মিউজিয়াম’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ডেনমার্কের উদ্ভিদবিদ ড. নাথানিয়াল ওয়ালিক-এর কিউরেটর নিযুক্ত হন। প্রাকৃতিক ইতিহাস এবং জাতিতাত্ত্বিক বিষয়াবলির উপর বিশেষ গুরুত্ববসহ এ জাদুঘর গড়ে উঠতে থাকে। প্রথমদিকে  প্রত্নতত্ত্ব এখানে কম গুরুত্ব পায়।

১৮১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত পশ্চিমবঙ্গের শ্রীরামপুরস্থ ‘কেরী মিউজিয়াম’ হচ্ছে উপমহাদেশের প্রথম মহাবিদ্যালয় জাদুঘর। কলকাতায় অবস্থিত ‘চার্লস স্টুয়ার্ট মিউজিয়াম’ হচ্ছে ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত প্রথম জাদুঘর। লন্ডনে অনুষ্ঠিত ১৮৫১ সালের গ্রেট এক্সিবিশন উপমহাদেশে কর্মরত ব্রিটিশ কর্মকর্তাগণকে জাদুঘর সংক্রান্ত কর্মকান্ডে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করে। ১৮৫৪ সালে কলকাতায় ‘স্কুল অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্ট’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ছিল উল্লিখিত বিশাল প্রদর্শনীর প্রেরণাজাত প্রতিষ্ঠান।

যদিও উইলিয়ম জোনস বাংলায় জাদুঘর সংস্কৃতির প্রবর্তক কিন্তু উপমহাদেশে জাতীয় জাদুঘরের ধারণা সর্বপ্রথম প্রকাশের কৃতিত্বের অধিকারীজেমস্ প্রিন্সেপ। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকার বাস্তবিকপক্ষেই ভারতে জাদুঘর গড়ে তোলার বিষয়ে আগ্রহী ছিল না। ১৮০১ সালে লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির জাদুঘরটি সমৃদ্ধ করতেই তাদের বিশেষ আগ্রহ ছিল। ভারতীয় সাম্রাজ্য থেকে নিদর্শনাবলি সংগ্রহ করাই ছিল তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য। যাহোক অত্র অঞ্চলের জাদুঘরের উন্নয়নে তাদের প্রদত্ত যেকোন ধরনের সমর্থন ও সহযোগিতার মূল উদ্দেশ্যই ছিল ভারতের সম্পদ সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ। অতঃপর ব্রিটিশ কর্মকর্তাগণ ভূ-তত্ত্ব, প্রাণিকূল, বাণিজ্য, শিল্প, কৃষিপণ্য, বনাঞ্চল এবং খনিজ সম্পদের প্রতি সুগভীর আকর্ষণ প্রদর্শন করেন। উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক সম্পদ উপমহাদেশেই রক্ষণাবেক্ষণে তাঁরা কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেন নি। চার্লস স্টুয়ার্ট-এর সংগ্রহসমূহ কলকাতা থেকে লন্ডন নিয়ে যাওয়া হয় এবং ১৮৩০ সালের জুন মাসে সেগুলি নিলামে তোলা হয়।

১৮৫৮ সালে  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ক্ষমতা ব্রিটিশ রাজের হাতে গেলে তা অত্র অঞ্চলে জাদুঘরের বিকাশে দারুনভাবে সাহায্য করে। ১৮৬১ সালে ‘আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া’ গড়ে উঠলে এক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। আইন সভায় প্রণীত একটি আইনের (নম্বর ১৭, ১৮৬৬ সাল) মাধ্যমে ১৮৬৬ সালে ব্রিটিশ সরকার ‘এশিয়াটিক সোসাইটি মিউজিয়াম’ কে ‘ইম্পেরিয়াল মিউজিয়াম’-এ রূপান্তরিত করে। অচিরেই এর নাম রাখা হয় ‘ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম’। ১৮৭৫ সালে এটি বর্তমান ভবনে স্থানান্তরিত হয়। জেমস উড মেসন-এর সহযোগিতায় ড. জন এন্ডারসন জাদুঘরটিকে বহুমুখী জাদুঘরে পুনর্বিন্যস্ত করার দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ভাইসরয় লর্ড লিটন এর আমলে ১৮৭৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রণীত  ‘ট্রেজার-ট্রোভ অ্যাক্ট’ মুদ্রা, শিলালিপি, ভাস্কর্য এবং পোড়ামাটির নিদর্শনাবলি সংগ্রহে সরকারকে সুযোগ এনে দেয় এবং এগুলি পর্যায়ক্রমে জাদুঘরে স্থান পায়।

১৮৯৯ সালে লর্ড কার্জন এর আগমন জাদুঘর বিকাশে বিশেষ প্রেরণা সৃষ্টি করে। এ সময় সাম্রাজ্যবাদী শাসকের সমর্থন এবং স্থানীয় কমিটি ও প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় এলিটদের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া যায়। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ-এর পর ঢাকা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। যখন ‘শিলং কেবিনেট অব কয়েনস্’ নতুন রাজধানীতে স্থানান্তর করা হচ্ছিল তখন সরকারের অবৈতনিক মুদ্রাবিদ এইচ.ই স্ট্যাপলটন ঢাকায় একটি জাদুঘর স্থাপনের প্রস্তাব করেন যা ১৯১৩ সালে চূড়ান্তভাবে বাস্তবায়িত হয়।

১৯০৪ সালের প্রাচীন সৌধমালা সংরক্ষণ সংক্রান্ত বিধিবদ্ধ আইন প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্বসম্পন্ন প্রত্নস্থলে স্থানীয় জাদুঘর গড়ে উঠতে যথেষ্ট প্রণোদনা সৃষ্টি করে। পশ্চিমবঙ্গের মালদহে এ ধরনের প্রথম জাদুঘর দেখা যায়। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের পর মালদহ নতুন পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং সে সময় এ জাদুঘর পাল-সেন ভাস্কর্যশিল্প এবং পান্ডুয়া ও গৌড় নগরের ধ্বংসাবশেষ থেকে সংগৃহীত নিদর্শনাদির ভান্ডার হিসেবে গড়ে ওঠে।

একটি গুরুত্বপূর্ণ জাদুঘর হিসেবে গড়ে ওঠা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল প্রাথমিক পর্যায়ে লর্ড কার্জনের কাছে ছিল একান্তভাবে ঋণী। ১৯০১ সালের ২২ জানুয়ারি মহারানি ভিক্টোরিয়ার মৃত্যু হলে লর্ড কার্জন মহারানীর গৌরবময় শাসনামলের স্মৃতি রক্ষার্থে মার্বেল পাথরের একটি উল্লেখযোগ্য বা জাঁক-জমকপূর্ণ অট্টালিকা নির্মাণের আদেশ দেন। এটি পরে ঐতিহাসিক জাদুঘর হিসেবে অর্থাৎ জাতির সম্মানজনক ও গৌরবময় অতীতের একটি জাতীয় গ্যালারির দায়িত্ব পালন করে।

১৮৯৩ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত ‘বেঙ্গল একাডেমী অব লিটারেচার’ ১৮৯৪ সাল থেকে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ নামে পরিচিত হয়। ১৯০৬ সালে কলকাতায় পরিষদের নিজস্ব ভবনে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ চিত্রশালা স্থাপিত হয়। বাংলার বিভিন্ন অংশে পরিষদের ৩০টিরও অধিক শাখা স্থাপিত হয়। ১৯২১ সালে পরিষদের রংপুর ও ঢাকা শাখায় এবং এর কিছুদিন পরে শ্রীহট্ট শাখায় সংগ্রহশালা গড়ে তোলা হয়। প্রায় একই সময়ে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের বিদ্যাসাগর স্মৃতি সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠিত হয়।

বাঙালি বেসামরিক ব্যক্তিত্ব গুরুসদয় দত্ত বিশেষ করে গ্রামীণ বাংলার কুটিরশিল্প সামগ্রীর জন্য একটি জাদুঘরের কথা চিন্তা করেন এবং ১৯৪০ সালে তিনি তাঁর নিজের ব্রতচারী গ্রামে ‘ব্রতচারী জাদুঘর’ (বাংলার লোক শিল্পকলার গুরুসদয় জাদুঘর হিসেবে বর্তমানে পরিচিত) প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪১ সালে কলকাতার স্টোর স্ট্রিটে (বর্তমানে গুরুসদয় দত্ত রোড) অবস্থিত গুরুসদয় দত্তের নিজস্ব বাড়িতে এগুলি স্থানান্তরিত হয়।

১৯৫৯ সালে কলকাতার দক্ষিণ-পশ্চিম উপকণ্ঠে ২৪ পরগনার ঠাকুরপাড়াস্থ বর্তমান ভবনটিতে জাদুঘর চালু হয়। ১৯৩৩ সালে কলকাতায় ‘একাডেমী অব ফাইন আর্টস’ প্রতিষ্ঠিত হয় যা একটি গুরুত্বপূর্ণ জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করে। এখানে মধ্যযুগের চিত্রকলা ও বস্ত্রশিল্প, জীবনীভিত্তিক উপকরণ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর চিত্রকলার একটি আকর্ষণীয় প্রদর্শনী দেখা যায়।

১৯২০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি নৃতাত্ত্বিক জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হাউজের পশ্চিম হলে ভারতীয় শিল্পকলার আশুতোষ মিউজিয়াম গড়ে তোলা হয়। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতির গবেষণা সহজতর করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। বাংলার বিভিন্ন অংশে জরিপ পরিচালনা ও প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন এবং প্রাচীন নিদর্শনাবলি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ এবং বাংলার বিভিন্ন অংশ থেকে লোকশিল্পের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন সংগ্রহ করার মাধ্যমে  আশুতোষ মিউজিয়াম অব ইন্ডিয়া আর্ট মোটামুটিভাবে একটি প্রাদেশিক জাদুঘরের দায়িত্বই পালন করতে থাকে।

বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর, রাজশাহী

বাংলাদেশের জাদুঘরসমূহ  দেশের সমৃদ্ধশালী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ভান্ডার হিসেবে দেশে রয়েছে বেশ কিছু জাদুঘর। ১৯১০ সালের এপ্রিল মাসে দিঘাপতিয়া রাজপরিবারের কুমার শরৎকুমার রায় এর পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর হচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম জাদুঘর। ১৯২৫ সালে বলধার নরেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরী বোটানিক্যাল গার্ডেনসহ ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেন বলধাজাদুঘর। ঢাকায় খ্রিস্টান সমাধি ক্ষেত্রের কাছে ওয়ারীতে অবস্থিত জাদুঘরটি পারিবারিক জাদুঘর হিসেবে শুরু হয় এবং এটি বিভিন্ন সামগ্রীর ভান্ডার হিসেবে গড়ে ওঠে। এ দুটি জাদুঘর গড়ে ওঠার অন্তর্বর্তীকালে ১৯১৩ সালে ঢাকা মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠিত হয়।

প্রাথমিকভাবে পুরানো সচিবালয়ের (বর্তমানে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল) একটি কক্ষে এ জাদুঘর চালু হয়। ১৯১৩ সালের ৭ আগস্ট লর্ড কারমাইকেল আনুষ্ঠানিকভাবে এর উদ্বোধন করেন। পাবলিক ইন্সট্রাকশন অব বেঙ্গলের পরিচালক এইচ.ই স্ট্যাপলটন ছিলেন এটির প্রথম অবৈতনিক সম্পাদক। ১৯১৪ সালের ১ জুলাই নলিনীকান্ত ভট্টশালী এ জাদুঘরের কিউরেটর হিসেবে যোগ দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পূর্ববর্তী বছরে ভট্টশালীর উদ্যোগে এটি ঐতিহাসিক গবেষণার কেন্দ্রে পরিণত হয়। নিমতলী প্যালেস এর (বর্তমানে ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের আনোয়ার পাশা ভবনের অভ্যন্তরে) বারোদুয়ারিতে এটি স্থানান্তরিত হয় এবং বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে রূপান্তরিত ও শাহবাগে স্থানান্তরিত হওয়ার পূর্বপর্যন্ত এখানেই জাদুঘরের কর্মকান্ড চলতে থাকে। ঢাকা জাদুঘর প্রতিষ্ঠা ও বিনির্মাণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত থাকার কারণে সত্যেন্দ্রনাথ ভদ্র, সৈয়দ আওলাদ হাসান, বি.কে দাস, খাজা মোহাম্মদ ইউসুফ, হাকিম হাবিবুর রহমান,  সৈয়দ মোহাম্মদ তাইফুর এবং আবুল হাসনাতের নাম স্মরণীয়।

মহাস্থান প্রত্নস্থল জাদুঘর, বগুড়া

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক ও জনহিতৈষী ব্যক্তি মহেশ ভট্টাচার্য তাঁর মাতা রামমালার স্মরণে ১৯৩৫ সালে কুমিল্লার রামমালা জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেন। জাদুঘরটি বর্তমানে তাঁর অতীতের ঐতিহ্য সামান্যই ধরে রেখেছে। ময়নামতী লালমাই অঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব যা তখন পর্যন্ত ছিল অনুন্মোচিত সে সম্পর্কে মহেশ ভট্টাচার্যের গভীর অনুরাগের নিদর্শন হচ্ছে এ জাদুঘর।

১৯০৫ সালে কলকাতার বাইরে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের শাখা স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং এর প্রথম শাখা হিসেবে রংপুরে একটি সংগ্রহশালা (জাদুঘর) স্থাপিত হয়। এ দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা সাহিত্য পরিষদ গড়ে তোলে ‘ঢাকা সাহিত্য পরিষদ সংগ্রহশালা’। ধীরেন্দ্রনাথ বসু ও নলিনীকান্ত ভট্টশালীর সংগ্রহসমূহ নিয়ে এটি গড়ে তোলা হয়। ১৯৪৭ সালের পূর্বে বাংলাদেশে শ্রীহট্ট (সিলেট) সাহিত্য পরিষদ সংগ্রহশালার নাম জাদুঘরের তালিকায় যুক্ত হয়।

জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা, ময়মনসিংহ

ঔপনিবেশিক আমলে এই সাধারণ সূচনা হতে ১৯৪৭-১৯৭১ সময়কালের মধ্যে বাংলাদেশে জাদুঘরের উল্লেখযোগ্য বিকাশ ঘটে, যদিও রংপুর, ঢাকা ও সিলেটের তিনটি সাহিত্য পরিষদ জাদুঘর ততদিনে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ১৯৫৭ সালে বর্তমান নওগাঁ জেলার পাহাড়পুর এ সর্বপ্রথম একটি কক্ষে প্রত্নস্থল জাদুঘর স্থাপিত হয়। বর্তমানে পুরানোটির জায়গায় একটি নতুন ভবন নির্মিত হয়েছে এবং সেখানে প্রণালিবদ্ধভাবে প্রত্ন নিদর্শনাবলি বিন্যস্ত করা হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন ও অনুসন্ধান হতে প্রাপ্ত নিদর্শনাবলি সংরক্ষণের জন্য কুমিল্লার ময়নামতী (১৯৬৬), বগুড়ার মহাস্থান (১৯৬৭) এবং ঢাকা শহরের লালবাগ ফোর্ট এ (১৯৭১ সালে প্রস্ত্তত, কিন্তু আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ১৯৭৪ সালে) প্রত্নস্থল জাদুঘর নির্মিত হয়।

কুষ্টিয়া জেলার শিলাইদহস্থ কুঠিবাড়ি নামে পরিচিত কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এর বাড়ি ১৯৫৭ সালে ‘সংরক্ষিত সৌধ’ হিসেবে ঘোষিত হয়। পরে এটি রূপান্তরিত হয় ব্যক্তিগত স্মৃতিরক্ষামূলক জাদুঘরে। ১৯৬৭ সালে চট্টগ্রামে স্থাপিত হয় জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর। অবশ্য এ জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ১৯৭৪ সালে। জাদুঘরটির উদ্দেশ্যে ছিল উপজাতিসমূহের নানা ধরনের উপকরণাদি সংগ্রহ, প্রদর্শনী ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গবেষণা পরিচালনা করা।

ঢাকা জাদুঘরের বিশেষ গুরুত্ব অনুধাবন করে ১৯৫১ সালে জাদুঘর উন্নয়নের জন্য একটি প্রকল্প প্রণীত হয়। এতদুদ্দেশ্যে বলধা জাদুঘরকে নিমতলী প্যালেসের বারোদুয়ারিতে অবস্থিত ঢাকা জাদুঘরের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। ১৯৬৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বলধা জাদুঘরের সংগ্রহাবলি ঢাকা জাদুঘরে আনা হয়। ১৯৬১ সালে এর সঙ্গে দিনাজপুরের সংগ্রহাবলিও যুক্ত হয়।

ময়নামতী প্রত্নস্থল জাদুঘর, কুমিল্লা

১৯৬৬ সালে শাহবাগে ঢাকার কেন্দ্রীয় জাদুঘর ভবনের ভিত্তি স্থাপিত হয় এবং বলা হয় যে, বিদ্যমান ঢাকা জাদুঘর হবে প্রস্তাবিত নতুন জাদুঘরের কেন্দ্রীয় বা মূল অংশ। ঢাকা জাদুঘরকে একটি স্বায়ত্বশাসিত এবং সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে ১৯৭০ সালে ঢাকা মিউজিয়াম (বোর্ড অব ট্রাস্টিজ) অর্ডিন্যান্স ঘোষিত হয়। শাহবাগে নতুন ভবন নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর ১৯৮৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। ঢাকা জাদুঘরের সংগৃহীত সামগ্রীসমূহ জাতীয় জাদুঘরে স্থানান্তরিত হয়। এভাবে ১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা জাদুঘর যা পরবর্তী ৬৯ বছর ধরে ক্রমান্বয়ে ঋদ্ধ হয়েছে তাঁর অবসান ঘটে এবং তদস্থলে জন্ম নেয় বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর।

বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের সঙ্গে সঙ্গে জাদুঘরের উন্নয়নে গতিবেগ সঞ্চার হয় এবং বর্তমানে বাংলাদেশে ৮০টিরও বেশি জাদুঘর রয়েছে। নতুন জাদুঘরসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো সোনারগাঁও এ অবস্থিত বাংলাদেশ লোকশিল্প জাদুঘর, শাহজাদপুর কাচারি বাড়ির স্মৃতি জাদুঘর, আহসান মঞ্জিল জাদুঘর, ময়মনসিংহে অবস্থিত শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন সংগ্রহশালা, বিরিশিরিস্থ উপজাতীয় সাংস্কৃতিক একাডেমী জাদুঘর এবং রংপুরস্থ উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট; কুমিল্লার ময়নামতীস্থ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, চট্টগ্রামের জিয়া স্মৃতি জাদুঘর, সিলেটের ওসমানী স্মৃতি জাদুঘর ইত্যাদি।

বাংলাদেশ লোকশিল্প জাদুঘর, সোনারগাঁও

অতি সম্প্রতি ঢাকায় ঢাকা নগর জাদুঘর; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকায় বিজয় সরণীর দক্ষিণ পার্শ্বে সম্প্রতি সামরিক জাদুঘর স্থাপন করা হয়েছে।

আরও কয়েকটি ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণমূলক বিশেষ জাদুঘরের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে যথা: কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়াস্থ লালন জাদুঘর এবং সুনামগঞ্জে হাছন রাজা জাদুঘর। দুটি জাদুঘরেই বাংলাদেশের দুজন বিখ্যাত পল্লীকবির জীবন ও কর্মের ওপর বিশেষ আলোকপাত করা হয়েছে।

সারণি ১ শহরে অবস্থিত জাদুঘরসমূহ।

শহর জাদুঘরসমূহ
বগুড়া জিলা পরিষদ জাদুঘর
চট্টগ্রাম জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর, বন গবেষণা ইন্সটিটিউট জাদুঘর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর, জিয়া স্মৃতি জাদুঘর, মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ জাদুঘর
চাঁদপুর মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ জাদুঘর
কুমিল্লা রামমালা জাদুঘর
কক্সবাজার মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ জাদুঘর
ঢাকা বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, লোক ঐতিহ্য জাদুঘর, বাংলা একাডেমী, লালবাগ ফোর্ট জাদুঘর, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর, পোস্টাল মিউজিয়াম, জয়নুল আবেদীন শিশু চিত্রশালা, বাংলাদেশ ভূ-তত্ত্ব জরিপ জাদুঘর, বাংলাদেশ স্মল অ্যান্ড কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন, ডিজাইন সেন্টার গ্যালারি অব টেক্সটাইলস, সিরামিকস্ধসঢ়; অ্যান্ড হ্যান্ডিক্রাফ্ধসঢ়;টস্ধসঢ়;, শিশু জাদুঘর, বাংলাদেশ শিশু একাডেমী, ঢাকা নগর জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর, পুলিশ জাদুঘর, বিজ্ঞান জাদুঘর


সারণি ২ শহর জাদুঘর।

শহর জাদুঘরসমূহ
দিনাজপুর দিনাজপুর জাদুঘর
ফরিদপুর ফরিদপুর জাদুঘর
কুষ্টিয়া কুষ্টিয়া জাদুঘর
ময়মনসিংহ ময়মনসিংহ জাদুঘর, জয়নুল আবেদীন সংগ্রহশালা
কিশোরগঞ্জ কিশোরগঞ্জ জাদুঘর
রাজশাহী বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর, বরেন্দ্র একাডেমী কালেক্টরস্ধসঢ়;, শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
রংপুর রংপুর জাদুঘর
রাঙ্গামাটি উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট
সুনামগঞ্জ হাছন রাজা জাদুঘর

সারণি ৩ নগরকেন্দ্রের বাইরে অবস্থিত জাদুঘরসমূহ।

স্থান জাদুঘরসমূহ
সোনারগাঁও বাংলাদেশ লোকশিল্প জাদুঘর (ঢাকার নিকটে)
বিরিছিরি উপজাতীয় সাংস্কৃতিক একাডেমী জাদুঘর (ময়মনসিংহের নিকটে)
দিউড়িয়া লালন জাদুঘর (কুষ্টিয়ার নিকটে)
শিলাইদহ কুঠিবাড়ি স্মৃতি জাদুঘর (কুষ্টিয়ার নিকটে)
মহাস্থান প্রত্মস্থল জাদুঘর (বগুড়ার নিকটে)
শাহজাদপুর কাচারিবাড়ি স্মৃতি জাদুঘর (পাবনার নিকটে)
পাহাড়পুর প্রত্মস্থল জাদুঘর (রাজশাহীর নিকটে)
গুরুদাসপুর চলনবিল জাদুঘর
ময়নামতী প্প্রত্মস্থল জাদুঘর (কুমিল্লার নিকটে), মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর

টীকা উপরিউক্ত তালিকায় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী এবং বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিভাগীয় জাদুঘরের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি।  [আবদুল মমিন চৌধুরী]