জাতীয় গ্রন্থাগার

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৫:১৪, ৭ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

জাতীয় গ্রন্থাগার  একটি জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির আইনানুমোদিত তত্ত্বাবধানকারী ও সংরক্ষণকারী এবং জাতির সৃষ্টিশীল কাজের প্রহরী প্রতিষ্ঠান। প্রকৃতপক্ষে কোনো একটি দেশের পান্ডিত্য পরিমাপক, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আয়না এবং দেশের গ্রন্থাগার ব্যবস্থার শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় গ্রন্থাগার কাজ করে। স্বাধীনতা লাভের পরপরই সরকারি এক বিশেষ অধ্যাদেশের অধীনে বাংলাদেশের জাতীয় গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়।

জাতীয় গ্রন্থাগার ভবন, আগারগাঁও

স্বাধীনতার পূর্বে ১৯৬৭ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের একটি শাখা চালু হয় এবং এর নাম দেওয়া হয় ‘বুকস্ অ্যান্ড নিউজপেপারস্ কালেকশন ব্রাঞ্চ’। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রকাশিত গ্রন্থ ও সংবাদপত্র সংগ্রহ করাই ছিল এর কাজ। এটিই বাংলাদেশ জাতীয় গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক ধাপ। কার্যত ১৯৭৩ সাল থেকেই বাংলাদেশ জাতীয় গ্রন্থাগার চালু হয়। যদিও জাতীয় গ্রন্থাগারের যাত্রা শুরু হয়েছিল খুবই সাধারণভাবে তথাপি এটি খুব দ্রুত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থে শিক্ষা-দীক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রের চরিত্র অর্জন করে। এ প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন বিষয়ের উপর বিশেষত ইতিহাস, রাজনীতি, সংস্কৃতি, প্রশাসন, বিজ্ঞান, চিকিৎসা এবং প্রযুক্তিসহ সকল গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ও বেশ কিছু আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংগ্রহ করতে শুরু করে।

বিশেষ করে দেশ ও বিদেশ থেকে বাংলাদেশের মাটি ও মানুষ সম্পর্কিত যে কোনো ধরনের দলিলপত্র ও প্রকাশনা সংগ্রহের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। এর ফলে এটি বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কাগুজে দলিলপত্রের সবচেয়ে বড় সংগ্রহশালায় পরিণত হয়।

১৯৭৩ সালে কিছু প্রয়োজনীয় কাঠামোগত পরিবর্তন এনে সরকার বাংলাদেশ জাতীয় গ্রন্থাগারকে বাংলাদেশ জাতীয় মহাফেজখানা ও গ্রন্থাগার (ডাইরেক্টরেট অব আর্কাইভস অ্যান্ড লাইব্রেরিস) অধিদপ্তরের অধীনে নিয়ে আসে। বর্তমানে (২০০২) এ অধিদপ্তর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান।

প্রথমদিকে ঢাকায় ১০৩ নং এলিফেন্ট রোড এবং পরে ১০৬ নং সেন্ট্রাল রোডের ভাড়া বাড়িতে জাতীয় গ্রন্থাগারের কর্মকান্ড চলে। ১৯৮৫ সালে ঢাকার শেরে বাংলা নগরস্থ আগারগাঁও-এ সরকার কর্তৃক নির্মিত নিজস্ব ভবনে গ্রন্থাগার স্থানান্তরিত হয়।

বাংলাদেশ জাতীয় গ্রন্থাগারের প্রধান কর্মকান্ডের মধ্যে রয়েছে (১) ১৯৭৪ সালে প্রণীত বাংলাদেশ কপিরাইট আইন (২০০০ সালে সংশোধিত) অনুসারে দেশের সকল প্রকাশনা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা এবং এগুলির যথাযথ ব্যবস্থাপনা এবং গবেষক ও পাঠকদের কাছে প্রাপ্তিসাধ্য করে তোলা; (২) জাতীয় গ্রন্থপঞ্জি প্রস্ত্তত ও প্রকাশ করা; (৩) দেশের সকল গ্রন্থাগারের অভিভাবক হিসেবে কাজ করা; (৪) দেশ ও বিদেশের সকল গ্রন্থাগারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা এবং তাদের সংগৃহীত বই-পুস্তক ও তথ্য আদান-প্রদান করা; (৫) জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত সকল সম্পাদকীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধের তালিকা প্রস্ত্তত ও প্রকাশ করা; (৬) গ্রন্থাগার ও তথ্য বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান করা; (৭) লাইব্রেরি ডাইরেক্টরি প্রস্ত্তত ও প্রকাশ করা; (৮) ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড বুক নাম্বার্স (আই.এস.বি.এন) প্রদান করা; এবং (৯) বাংলাদেশের জন্য একটি ইউনিয়ন ক্যাটালগ প্রস্ত্তত ও প্রকাশ করা।

বাংলাদেশ জাতীয় গ্রন্থাগারের অনেকগুলি শাখার মধ্যে রয়েছে গ্রন্থপঞ্জি শাখা, গ্রন্থাগার শাখা, বাঁধাই শাখা, প্রসেসিং শাখা, কম্পিউটার শাখা এবং মাইক্রোফিল্ম শাখা। ফক্সপ্রো, ভিজুয়াল ফক্সপ্রো এবং সিডিএস/ আইএসআইএস ব্যবস্থার মাধ্যমে সংগ্রহ ও তথ্যের জন্য গ্রন্থাগারটিকে স্বয়ংক্রিয় প্রোগ্রামের অধীনে আনা হয়েছে। বিপুল পরিমাণ দুর্লভ গ্রন্থ ও দলিলপত্র স্ক্যান করে সংরক্ষণের একটি প্রোগ্রামও চালু করা হয়।

দুর্লভ সামগ্রী বিশেষত পুরানো সংবাদপত্র সংরক্ষণ করার জন্য মাইক্রো ফিল্মিং প্রোগ্রামও গ্রহণ করা হয়। এক্ষেত্রে অতি সম্প্রতি একটি আধুনিক মাইক্রোফিল্ম ইউনিট গড়ে তোলা হয়েছে যেখানে কম্পিউটারাইজড ক্যামেরা, একটি ডাটা প্রসেসর, মাইক্রোফিল্ম রীডার এবং প্রিন্টার রয়েছে।

সংগ্রহ ও সংরক্ষণ  দুর্লভ পুস্তক ও পান্ডুলিপিসহ জাতীয় গ্রন্থাগারে প্রায় চার লক্ষ গ্রন্থের সংগ্রহ রয়েছে। আরও রয়েছে বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহীত গবেষণা পত্রিকার প্রায় এক লক্ষ কপি। জাতীয় গ্রন্থাগারের সংগ্রহ কর্মসূচির একটি অন্যতম প্রধান দিক হচ্ছে পত্রিকা সংগ্রহ করা। ব্যক্তি বিশেষের দান থেকেও এ গ্রন্থাগারে বিপুল পরিমাণ দুর্লভ পুস্তক, পত্রিকা এবং পান্ডুলিপি সংগৃহীত হয়। সরকারের বিভিন্ন এজেন্সি এবং ইউনেস্কো, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও আইএলও-এর মতো বিদেশি উৎস থেকেও এ গ্রন্থাগার পুরানো দৈনিক সংবাদপত্র, গ্রন্থাদি এবং পত্রিকা সংগ্রহ করে।

এ গ্রন্থাগারে উর্দু, আরবি ও ফারসি গ্রন্থ ও পান্ডুলিপি এবং বাংলাদেশের ও ভারতীয় উপমহাদেশের বিপুলসংখ্যক পুরনো মানচিত্রের সংগ্রহ রয়েছে। জাতীয় গ্রন্থাগারের সকল সংগ্রহ একটি সাত তলা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ও আধুনিক সাজ-সরঞ্জামে সজ্জিত ভবনে মজুদ করে রাখা হয়।

জাতীয় গ্রন্থাগারে রয়েছে নানা ধরনের পাঠক সেবা ও অন্যান্য সুবিধা। প্রায় ৭৪৩.২২ বর্গমিটার আয়তনের চারটি বড় পাঠ কক্ষ এতে রয়েছে। আরও রয়েছে একটি ৩০০ আসনবিশিষ্ট শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অডিটোরিয়াম।

জাতীয় গ্রন্থাগার শিশু ও প্রাপ্ত বয়স্কসহ সকল প্রকার পাঠক ও গ্রন্থাগার ব্যবহারকারীদের জন্য নিয়মিতভাবে বিশেষ প্রদর্শনী, সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করে থাকে। এ ছাড়া জাতীয় বই মেলাসমূহ এবং দেশের অন্যান্য সকল প্রাসঙ্গিক প্রদর্শনীতে জাতীয় গ্রন্থাগার অংশ নেয়।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত সংক্ষিপ্ত সময়ে জাতীয় গ্রন্থাগার মোটামুটি সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে আসলেও দেশে গ্রন্থাগারের উন্নয়ন ও প্রশাসন সম্পর্কিত আইনের অনুপস্থিতিতে বর্তমানে তীব্র অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে। এ বিষয়ে বর্তমানে একটি নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় গ্রন্থাগারসহ সকল গ্রন্থাগার উপনিবেশিক আমলের আইন ও রীতি-নীতিতে পরিচালিত হচ্ছে। একটি নতুন স্বাধীন দেশের পরিবর্তিত সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশের সঙ্গে এ আইন সম্পূর্ণভাবে অনুপযোগী।

জাতীয় গ্রন্থাগারের প্রধান হিসেবে জাতীয় আর্কাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদপ্তরের পরিচালক প্রায় ৪০ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারিসহ দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে জাতীয় গ্রন্থাগার ভবন ৩২, জাস্টিস এস.এম মুর্শিদ সরণী, আগারগাঁও, শেরে বাংলানগর, ঢাকা-১২০৭-এ অবস্থিত। সাপ্তাহিক এবং সরকারি ছুটির দিন ব্যতীত প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এ গ্রন্থাগার খোলা থাকে। [শরীফ উদ্দিন আহমেদ]