ছোটগল্প

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২০:৫৩, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

ছোটগল্প  কথাসাহিত্যের একটি বিশেষ ধারা। বাংলা সাহিত্যে এর আবির্ভাব উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। ছোটগল্প বলতে সাধারণত তাকেই বোঝায় যা আধঘণ্টা থেকে এক বা দুঘণ্টার মধ্যে এক নাগাড়ে পড়ে শেষ করা যায়। তবে আকারে ছোট হলেই তাকে ছোটগল্প বলা যাবে না। কারণ ছোটগল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এতে বিন্দুতে সিন্ধুর বিশালতা থাকতে হবে, অর্থাৎ অল্প কথায় অধিক ভাব ব্যক্ত করতে হবে। উপন্যাসের সঙ্গে এর মৌলিক পার্থক্য এখানেই। ছোটগল্পে উপন্যাসের বিস্তার থাকে না, থাকে ভাবের ব্যাপকতা। উপন্যাস পড়ে পাঠক পরিতৃপ্তি লাভ করে, কিন্তু ছোটগল্প থেকে পায় কোনো ভাবের ইঙ্গিতমাত্র। ক্ষুদ্র কলেবরে নিগূঢ় সত্যের ব্যঞ্জনায়ই এর সার্থকতা।

ছোটগল্পের প্রকৃতি সম্পর্কে  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) তাঁর ‘বর্ষাযাপন’ কবিতায় বলেছেন:

ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যথা  ছোটো ছোটো দুঃখকথা

নিতান্তই সহজ সরল,

সহস্র বিস্মৃতিরাশি  প্রত্যহ যেতেছে ভাসি

তারি দু-চারিটি অশ্রুজল।

নাহি বর্ণনার ছটা  ঘটনার ঘনঘটা,

নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ।

অন্তরে অতৃপ্তি রবে  সাঙ্গ করি মনে হবে

শেষ হয়ে হইল না শেষ।

ছোটগল্পের কয়েকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো: এর ক্ষুদ্রায়তনের মধ্যে বৃহতের ইঙ্গিত থাকবে, এর আরম্ভ ও উপসংহার হবে নাটকীয়, এর বিষয়বস্ত্ত সাধারণত স্থান, কাল ও ঘটনার ঐক্য মেনে চলবে, এতে মানবজীবনের কোনো একটি বিশেষ মুহূর্ত, ভাব বা চরিত্রের একটি বিশেষ দিক উজ্জ্বল হয়ে উঠবে, যেকোনো ধরনের বাহুল্য বর্জনের মাধ্যমে গল্পটি হয়ে উঠবে রসঘন, এতে থাকবে রূপক বা প্রতীকের মাধ্যমে অব্যক্ত কোনো বিষয়ের ইঙ্গিত ইত্যাদি। সর্বোপরি গল্পসমাপ্তির পরেও পাঠকের মনের মধ্যে এর গুঞ্জরণ চলতে থাকবে। তাহলেই তা সার্থক ছোটগল্পে পরিণত হবে।

বাংলা ছোটল্পের প্রথম আভাস পাওয়া যায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৩৮-১৮৯৪) যুগলাঙ্গুরীয় (১৮৭৪) ও রাধারাণী (১৮৭৫) গল্পে। পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যয়ের মধুমতী এবং সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৩৪-১৮৮৯) রামেশ্বরের অদৃষ্ট, দামিনী প্রভৃতির মধ্যেও ছোটগল্পের আভাস পাওয়া যায়; তবে এর সবগুলিই উপন্যাসধর্মী রচনা। পরে স্বতন্ত্র প্রতিভাস্পর্শে ছোটগল্পকে সমৃদ্ধ করেন ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় (১৮৪৭-১৯১৯)। তাঁর ভূত ও মানুষ, মুক্তামালা, মজার গল্প ও ডমরুচরিত গল্পগ্রন্থের মধ্যে ছোটগল্পের স্পষ্ট ইঙ্গিত পরিলক্ষিত হয়। তবে তাঁর রচনায় উদ্ভট কাহিনীই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। তিনি শ্লথগতিতে অবাস্তব সুরে গল্প রচনা করেছেন। স্বর্ণকুমারী দেবীর (১৮৫৫-১৯৩২) নবকাহিনী গ্রন্থের কোনো কোনো গল্পেও ছোটগল্প রচনার প্রয়াস লক্ষ করা যায়। প্রাথমিক পর্যায়ের আর একজন গল্পকার হলেন নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত (১৮৬১-১৯৪০)। তিনি প্রেম ও রোম্যান্সের মাধ্যমে ছোটগল্পে বিশিষ্টতা দান করেন।

প্রকৃত অর্থে বাংলা সাহিত্যে সার্থক ছোটগল্পকার হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর প্রথম গল্প ‘ভিখারিণী’ ১৮৭৪ সালে  ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও ‘দেনা-পাওনা’ (১৮৯০) গল্পটিই প্রথম সার্থক ছোটগল্প। ১৮৮৪-৮৫ সময়ের মধ্যে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘ঘাটের কথা’, ‘রাজপথের কথা’ ও ‘মুকুট’। গল্পগুচ্ছ, সে, তিনসঙ্গী প্রভৃতি গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের সংখ্যা ১১৯টি।

ত্রিশ বছর বয়স থেকে রবীন্দ্রনাথ ছোটগল্প রচনা শুরু করেন। ছোটগল্প রচনার সঙ্গে তাঁর জমিদারি তদারকির একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এ উপলক্ষে কুষ্টিয়া,  শিলাইদহ, পাবনা, রাজশাহী,  পতিসর,  শাহজাদপুর প্রভৃতি অঞ্চল ঘুরতে গিয়ে তিনি নিবিড়ভাবে পরিচিত হন  পদ্মা, গড়াই,  নাগর ও  ইছামতী নদী এবং গ্রামবাংলার প্রকৃতি ও মানুষের সঙ্গে। ফলে তাঁর প্রথমদিকের লেখায় এসব বিষয় উপজীব্য হয়েছে। ইমপ্রেসনিস্ট শিল্পীদের মতো জীবনের রং ও রূপ কাছ থেকে উপভোগ করে তিনি তাঁর গল্পে স্থান দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথই যথার্থ অর্থে বাংলা ছোটগল্পে জীবন দান করেন।

বিষয়বস্ত্ত হিসেবে রবীন্দ্রনাথের গল্পে প্রেম, প্রকৃতি, মানুষ, অতিপ্রাকৃত ঘটনা, সামাজিক জীবন, নারী-পুরুষের মনস্তাত্ত্বিক দিক ইত্যাদি স্থান পেয়েছে। প্রেমের গল্প হিসেবে একরাত্রি, মহামায়া, সমাপ্তি, মাল্যদান, মধ্যবর্তিনী, শাস্তি, প্রায়শ্চিত্ত, দুরাশা, অধ্যাপক, নষ্টনীড়, স্ত্রীর পত্র, পাত্র ও পাত্রী, মানভঞ্জন, রবিবার, শেষকথা, ল্যাবরেটরি প্রভৃতি গল্পের নাম উল্লেখ করা যায়। প্রকৃতিবিষয়ক গল্পের মধ্যে শুভা, অতিথি, আপদ, বলাই ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এসব গল্পে প্রকৃতিপ্রেমিক নারী ও বালক চরিত্রগুলি হয়েছে যেন প্রকৃতির সন্তান। সমাজজীবনের সম্পর্কবৈচিত্র্য নিয়ে রচিত গল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ব্যবধান, মেঘ ও রৌদ্র, পণরক্ষা, পোস্টমাস্টার, কাবুলিওয়ালা, দিদি, হৈমন্তী, কর্মফল, দান-প্রতিদান, দেনা-পাওনা, ছুটি, পুত্রযজ্ঞ, খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন ইত্যাদি। অতিপ্রাকৃত রসের স্পর্শ লেগেছে গুপ্তধন, জীবিত ও মৃত, নিশীথে, মণিহারা, ক্ষুধিত পাষাণ, মাস্টারমশাই ইত্যাদি গল্পে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম সার্থকভাবে বাংলা ছোটগল্পকে বিশ্বসাহিত্যের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেন।

রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক ছোটগল্পকারদের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮৬৩-১৯৪৯) নাম। বাংলা ব্যঙ্গগল্পের ধারায় তিনি বিশেষ কৃতিত্বের দাবিদার। তাঁর বিশিষ্ট গল্পগুলি হলো: আমরা কি ও কে, কবুলতি, পাথেয়, দুঃখের দেওয়ালী, মা ফলেষু, সন্ধ্যা শঙ্খ ও নমস্কারী। এর পরের ছোটগল্পকার হলেন  প্রথম চৌধুরী (১৮৬৮-১৯৪৬)। তিনি ছোটগল্প রচনায় অনেকটা দক্ষতা দেখালেও রূপসংহতির অভাবে তাঁর কোনো গল্পই পূর্ণাঙ্গ ছোটগল্প হয়ে ওঠেনি। তাঁর গল্পগ্রন্থের মধ্যে চার-ইয়ারি কথা, আহুতি, নীললোহিত ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় (১৮৭৩-১৯৩২) ১৯০০-১৯৩১ সাল পর্যন্ত ত্রিশ বছর ধরে শতাধিক ছোটগল্প রচনা করেন। নবকথা, ষোড়শী, গল্পাঞ্জলি, গল্পবীথি, পত্রপুষ্প, গহনার বাক্স, বিলাসিনী, যুবকের প্রেম, নতুন বই, জামাতা বাবাজী ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্প। তাঁর গল্পে সাধারণ বাঙালিজীবনের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেলেও তাঁর কৌতুকরসাশ্রিত গল্পগুলিই বেশি উপভোগ্য।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৭৬-১৯৩৮) আবির্ভাব বাংলা ছোটগল্পে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তাঁর প্রথম ছোটগল্প ‘মন্দির’ তাঁকে এ ক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্য এনে দেয়। এ ছাড়া কাশীনাথ, একাদশী বৈরাগী, মামলার ফল, পরেশ, বিলাসী, মুষ্টিমেয়, অভাগীর স্বর্গ, মহেশ ইত্যাদি তাঁর বিখ্যাত ছোটগল্প। এসব গল্পে বঞ্চিতদের বেদনার কাহিনী জীবনসন্ধানী শিল্পী হিসেবে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য লাভের ফলে চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৭৭-১৯৩৮) সূক্ষ্ম জীবনদৃষ্টি নিয়ে ছোটগল্প লিখেছেন। পুষ্পপাত্র, সওগাত, গল্পপত্র, ধূপছায়া, চাঁদমালা, বরণডালা, মণিমঞ্জরী  ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্পসংকলন।

মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় (১৮৮৮-১৯২৯) ঝাঁপি, পাপড়ি, জলছবি, খেয়ালের খেসারৎ ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ রচনা করেন। বাংলা গল্পে অমানবিক জীবনবাসনা ও মনোলৌল্যের লেখক হচ্ছেন জগদীশ গুপ্ত। তাঁর গল্পগ্রন্থসমূহ বিনোদিনী, পাইক শ্রীমিহির প্রামাণিক, শ্রীমতী ইত্যাদি।  বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০) রচিত ছোটগল্পগুলি কল্পনাপ্রবণতা ও অনুভূতির গাঢ়তায় চমৎকার। তাঁর গ্রন্থগুলোর মধ্যে মেঘমল্লার, মৌরীফুল, যাত্রীবদল, জন্ম ও মৃত্যু, কিন্নরদল, বেনীগির ফুলবাড়ি, বিধু মাস্টার, অসাধারণ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১) বাংলাদেশের গ্রামীণ সংস্কৃতিকে উপজীব্য করে বেশিরভাগ গল্প রচনা করেছেন। পাষাণপুরী, নীলকণ্ঠ, ছলনাময়ী, জলসাগর, রসকলি, তিনশূন্য ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ তাঁর সৃজনশীল প্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর। তাঁর গল্পে  বেদেপটুয়া,  মালাকার, লাঠিয়াল, চৌকিদার, ডাকহরকরা ইত্যাদি সাধারণ শ্রেণীর মানুষের জীবনচিত্র দক্ষতার সঙ্গে অঙ্কিত হয়েছে।  কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) ছোটগল্পের মধ্য দিয়ে প্রধানত যৌবনের জয়গান গেয়েছেন। তাঁর প্রথম গল্পসংকলন ব্যথার দান-এ (১৯২২) গদ্যকাব্যের আভাস যাওয়া যায়। নজরুলের গল্পের একটি চমৎকার সংকলন হচ্ছে শিউলিমালা (১৯৩১)। এ গ্রন্থে তিনি হাস্যরস সৃষ্টিতে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। রিক্তের বেদন (১৯২৫) তাঁর অপর একটি বিখ্যাত গল্পগ্রন্থ। তাঁর অধিকাংশ গল্পেই নর-নারীর প্রেম প্রাধান্য পেয়েছে।

শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় (১৯০০-১৯৭৬) খনি শ্রমিকদের নিয়ে গল্প রচনার পথিকৃৎ হিসেবে খ্যাত। তাঁর প্রতিভার নিদর্শনস্বরূপ অতসী, বধূবরণ, মারণযন্ত্র, নারীমেধ, দিনমজুর ইত্যাদি গল্পগ্রন্থের নাম উল্লেখ করা যায়। বাংলা ছোটগল্পে তিনিই প্রথম আঞ্চলিকতা প্রয়োগ করেন।  মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৫-১৯৫৬) কল্লোলগোষ্ঠীর বাস্তবধর্মিতার আদর্শ নিয়ে ছোটগল্পে আবির্ভূত হন। তিনি সংস্কারমুক্ত বৈজ্ঞানিক জীবনদৃষ্টির মাধ্যমে গল্পে জীবনের আন্তর সত্যকে খুঁজেছেন। মানবজীবনের জৈবিক চাহিদা বলে খ্যাত ফ্রয়েডীয় চেতনা তাঁর গল্পে বারবার উঁকি দিয়েছে। তাঁর ‘প্রাগৈতিহাসিক’ (১৯৩৭) গল্পটি নৃশংসতা ও প্রতিহিংসাপরায়ণতার জোরালো অভিব্যক্তি। তাঁর ‘সরীসৃপ’ (১৯৩৯) গল্পটি একজন পুরুষের মনোলোকের সরীসৃপ-লীলাকে অবলম্বন করে রচিত। এ ছাড়া তাঁর গল্পগ্রন্থসমূহের মধ্যে অতসীমামী ও অন্যান্য গল্প (১৯৩৫), মিহি ও মোটা কাহিনী (১৯৩৮), সরীসৃপ (১৯৩৯), বৌ (১৯৪৩), সমুদ্রের স্বাদ (১৯৪৩), ভেজাল (১৯৪৪), হলুদ পোড়া (১৯৪৫), আজ কাল পরশুর গল্প (১৯৪৬), মাটির মাশুল (১৯৪৮), ছোট বড় (১৯৪৮), ফেরিওয়ালা (১৯৫৩), শ্রেষ্ঠগল্প (১৯৫০) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

প্রবোধকুমার সান্যালের (১৯০৫-১৯৮৩) গল্প লেখার রীতি সহজ-সরল ও হূদয়গ্রাহী। চেনা ও জানা, নিশিপদ্ম, অবিকল, অঙ্গরাগ, কয়েক ঘণ্টা মাত্র, দিবাচল, গল্পসঞ্চয়ন, নওরঙ্গী, মধুকরী, মাস, নীচের তলায়, অঙ্গার, কাদামাটির দুর্গ, সায়াহ্ন, পঞ্চতীর  ইত্যাদি তাঁর বিখ্যাত গল্পগ্রন্থ।

বিভাগপূর্বকালে ছোটগল্প রচনায় খ্যাতি লাভ করেছিলেন এমন আরো কয়েকজন লেখক হলেন:  দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদাররাজশেখর বসু, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়,  সতীনাথ ভাদুড়ীবলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, মনোজ বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র,  সৈয়দ মুজতবা আলী প্রমুখ।

বিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত রচিত ছোটগল্পগুলিকে বিষয়বস্ত্তর দিক থেকে কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। যেমন:

প্রেমের গল্প  এ ধরনের গল্পে মানব-মানবীর বিচিত্র প্রেমানুভূতির রূপায়ণ ঘটে। এক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের রাধারাণী, রবীন্দ্রনাথের একরাত্রি, নষ্টনীড়, সমাপ্তি, স্ত্রীর পত্র ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

সামাজিক গল্প  এ ধরনের গল্পে কোনো বিশেষ সমাজের চিত্র অঙ্কিত হয়। যেমন রবীন্দ্রনাথের পয়লা নম্বর, পোস্টমাস্টার, মেঘ ও রৌদ্র, হালদার গোষ্ঠী; কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের থাকো; শরৎচন্দ্রের মহেশ, বিন্দুর ছেলে, অভাগীর স্বর্গ; তারাশঙ্করের পিতাপুত্র ইত্যাদি।

ঐতিহাসিক গল্প  অতীত ইতিহাসের উপকরণ নিয়ে রচিত গল্প, যেমন রবীন্দ্রনাথের দালিয়া, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রত্নতত্ত্ব, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃৎপ্রদীপ, চন্দনমূর্তি ইত্যাদি।

প্রকৃতি ও মানুষ সম্পর্কিত গল্প  এ শ্রেণীর গল্পে প্রকৃতির পটভূমিকায় চরিত্রাঙ্কন করা হয়। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের সুভা, তারাপদ, অতিথি উল্লেখযোগ্য।

রূপক বা সাঙ্কেতিক গল্প  এ শ্রেণীর গল্পে কোনো রূপক বা প্রতীকের আড়ালে সর্বজনীন সত্যের প্রকাশ ঘটে। একে প্রতীকধর্মী গল্পও বলা হয়। রবীন্দ্রনাথের তাসের দেশ, গুপ্তধন এ শ্রেণীর উল্লেখযোগ্য গল্প।

অতিপ্রাকৃত গল্প  অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক ঘটনা অবলম্বন করে এ ধরনের গল্প রচিত হয়। এ শ্রেণীর গল্প পড়লে পাঠকের মনে এক ধরনের শিহরণ বা ভয়ের উদ্রেক হয়। রবীন্দ্রনাথের ক্ষুধিত পাষাণ, নিশীথে, সম্পত্তি সমর্পণ এ শ্রেণীর উল্লেখযোগ্য গল্প।

ব্যঙ্গ বা হাস্যরসাত্মক গল্প  আখ্যানভাগ বা চরিত্রচিত্রণ অপেক্ষা হাস্যরসই এ শ্রেণীর গল্পে প্রাধান্য লাভ করে। যেমন রবীন্দ্রনাথের অধ্যাপক, রাজটিকা; প্রভাতকুমারের রসময়ীর রসিকতা, মাস্টার-মশাই, বলবান জামাতা; কেদার বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুর্গেশনন্দিনীর দুর্গতি ইত্যাদি।

মনস্তাত্ত্বিক গল্প  এ ধরনের গল্পে পাত্র-পাত্রীর মানসিক বা মনস্তাত্ত্বিক বিষয় প্রধান হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের পোস্টমাস্টার, শরৎচন্দ্রের রামের সুমতি ইত্যাদি এ শ্রেণীর উল্লেখযোগ্য গল্প।

গার্হস্থ্যবিষয়ক গল্প  পারিবারিক কাহিনী অবলম্বন করে এ ধরনের লেখা হয়। যেমন রবীন্দ্রনাথের ব্যবধান, মধবর্তিনী ইত্যাদি।

বিজ্ঞানবিষয়ক গল্প  বিজ্ঞানবিষয়ক কাহিনী নিয়ে রচিত গল্প। যেমন প্রেমেন্দ্র মিত্রের শয়তানের দ্বীপ, সুবোধ ঘোষের সুন্দরং ইত্যাদি।

উদ্ভট গল্প  এ ধরনের গল্পে কাল্পনিক বা অবাস্তব কাহিনী বাস্তবতা-অতিক্রান্ত রূপ পরিগ্রহ করে। কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভগবতীর পলায়ন, পঞ্জিকা-পঞ্চায়েৎ, পূজার প্রসাদ, আমাদের সানডে সভা, মুক্তি, জাগৃহি ইত্যাদি এ ধরনের উল্লেখযোগ্য গল্প।

মনুষ্যেতর প্রাণিবিষয়ক গল্প  প্রাণিজগতের আচার-আচরণ ও বৈচিত্র্য নিয়ে এ ধরনের গল্প লেখা হয়। যেমন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের আদরিণী, তারাশঙ্করের নারী ও নাগিনী, বিভূতিভূষণের বুধির বাড়ী ফেরা ইত্যাদি।

বস্ত্তনিষ্ঠ গল্প  এ ধরনের গল্পে মানবজীবনের কোনো অধ্যায় বা কাহিনী বাস্তবসম্মতভাবে প্রকাশ পায়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নমুনা, প্রাগৈতিহাসিক এ শ্রেণীর উল্লেখযোগ্য গল্প।

বিদেশি পটভূমিকায় রচিত গল্প  ভিনদেশী নর-নারীর চরিত্র অবলম্বন করে এ ধরনে গল্প রচিত হয়, যেমন প্রভাতকুমারের মাতৃহীন।  [মোঃ মাসুদ পারভেজ]

১৯৪৭ সালে দেশভাগের কারণে তৎকালীন পূর্ববঙ্গ তথা বর্তমান বাংলাদেশের সাহিত্যে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, অল্পকালের মধ্যেই এ দেশিয় লেখকদের সৃষ্টিশীল রচনায় তা পূর্ণ হয়ে ওঠে। সাহিত্যের অপরাপর শাখার মতো ছোটগল্পের শাখাটিও ক্রমাগত ঋদ্ধতর হয়।

বাংলাদেশে ছোটগল্প রচনার ধারা বেগবান হয় চল্লিশের দশকে। এ সময় গল্পের বিষয়বস্ত্ত হিসেবে গৃহীত হয় গ্রাম ও নগর জীবনের কাহিনী। অনেক গল্পে স্থান পায় দেশবিভাগের মর্মান্তিক পরিণতি। আবার দেশবিভাগের আগেকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও তেতাল্লিশের মন্বন্তরও কোনো কোনো গল্পের উপজীব্য হয়।  আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮-১৯৭৯), আবু রুশদ (১৯১৯-) এবং  সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (১৯২২-১৯৭১) ছোটগল্পের প্রথম পর্বের তিন খ্যাতিমান লেখক। আবুল মনসুর প্রধানত হাস্যব্যঙ্গাত্মক অথচ গভীর সমাজমনস্ক ছোটগল্পের রচয়িতা। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ভন্ডামি তাঁর তীক্ষ্ণ সমালোচনার লক্ষ্য। প্রায়শ সমাজবিরোধী ব্যক্তিরা তাঁর গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়েছে। আয়না (১৯৩৬), ফুড কনফারেন্স (১৯৪৭), আসমানী পর্দা (১৯৫৬) প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ। আবু রুশদ ছোটগল্পে নগরজীবনের প্রথম সার্থক ভাষ্যকার। নাগরিক জীবনের জটিলতা এবং দৈনন্দিন জীবনের ছোটখাট বিষয় নিয়ে তিনি বহু গল্প রচনা করেছেন। রাজধানীতে ঝড় (১৯৩৮), প্রথম যৌবন (১৯৪৮), শাড়ি বাড়ি গাড়ি (১৯৬৩), মহেন্দ্র মিষ্টান্ন ভান্ডার (১৯৮৫) প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ।

বাংলাদেশের গ্রাম, এর পশ্চাৎপদতা, কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি ইত্যাদি বিষয় বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর গল্পে। গ্রীষ্মের ছুটি, কেরায়া, জাহাজী প্রভৃতি গ্রামীণ জীবনাশ্রয়ে রচিত তাঁর উল্লেখযোগ্য ছোটগল্প। পাশাপাশি ব্যক্তিত্বের নানান সংকটও মূর্ত হয়ে উঠেছে তাঁর গল্পে। খুনী, রক্ত, স্তন প্রভৃতি গল্প এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য। দেশভাগের মতো ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক ঘটনা অবলম্বনে রচিত তাঁর ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’ গল্পটি মানবিকতার একটি উজ্জ্বল দলিল। নয়নচারা (১৯৪৫) এবং দুই তীর ও অন্যান্য গল্প (১৯৬৫) ওয়ালীউল্লাহর দুটি গল্পগ্রন্থ।

এ সময়ের আরও দুজন গল্পকার ফজলুল হক (১৯১৬-১৯৪৯) ও সোমেন চন্দ (১৯২০-১৯৪২) গল্প রচনায় অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। ফজলুল হকের গল্প নামক গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৮৩ সালে, তাঁর মৃত্যুর বহুদিন পরে শওকত ওসমানের সম্পাদনায়। সোমেন চন্দের সংকেত ও অন্যান্য গল্প (১৯৪২) এবং বনস্পতি ও অন্যান্য গল্প (১৯৪৩) গ্রন্থদুটি প্রকাশিত হয় দেশবিভাগের পূর্বে। এতে মধ্যবিত্ত চরিত্র ও সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের জীবননির্ভর কাহিনী চিত্রিত হয়েছে।

পঞ্চাশের দশকে পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে সাহিত্যজগতে লক্ষ করা যায় অভূতপূর্ব অগ্রগতি। পশ্চিম পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে বাঙালির আত্মচেতনার বিকাশ ঘটে ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনে। এর ফলে তখন সমাজ ও সাহিত্য উভয়ই প্রবলভাবে আলোড়িত হয়। ভাষা আন্দোলনের পরের বছরই এর গৌরবময় স্মৃতিকে ধারণ করে কবি হাসান হাফিজুর রহমান (১৯৩২-১৯৮৩)-এর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় একুশের সংকলন একুশে ফেব্রুয়ারি। এতে সমকালীন সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য অবদান উপস্থাপিত হয়। এর অনুসরণে পরবর্তীকালে বহুসংখ্যক পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে।  সমকাল, কণ্ঠস্বর, পূর্বমেঘ, উত্তরণ, ছোটোগল্প, পূর্বপত্র, সাম্প্রতিক, গণসাহিত্য, বিপ্রতীপ প্রভৃতি একুশে ফেব্রুয়ারি-রই সার্থক উত্তরাধিকারী। এ চেতনায় ছোটগল্পও সমৃদ্ধ হতে থাকে প্রচুর গল্পকারের লেখনী-প্রভাবে।

এ সময় ছোটগল্পে নবীন-প্রবীণ লেখকদের হাতে বিচিত্র বিষয়ের রূপায়ণ ঘটে।  ইব্রাহীম খাঁ (১৮৯৪-১৯৭৮),  মাহবুব-উল আলম (১৮৯৮-১৯৮১),  আবুল ফজল (১৯০৩-১৯৮৩),  আবু জাফর শামসুদ্দীন (১৯১১-১৯৮৮),  শওকত ওসমান (১৯১৭-১৯৯৮),  সরদার জয়েনউদ্দীন (১৯১৮-১৯৮৬),  আবদুল হক (১৯১৮-১৯৯৭),  শামসুষ্টীনআবুল কালাম (১৯২৬-১৯৯৮),  আবু ইসহাক (১৯২৬-২০০৩), আশরাফ সিদ্দিকী (১৯২৭-),  আলাউদ্দিন আল আজাদ (১৯৩২-২০০৯),  জহির রায়হান (১৯৩৩-১৯৭২) প্রমুখ এ সময়কার উল্লেখযোগ্য গল্পকার। এঁদের মধ্যে বিষয়বৈচিত্র্যে, শিল্পচেতনার অনন্যতায় এবং প্রকাশভঙ্গির প্রাতিস্বিকতায় উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠেন শওকত ওসমান ও আলাউদ্দিন আল আজাদ। এ দুজনের মাধ্যমেই পঞ্চাশের দশকে বাংলাদেশের ছোটগল্প অর্জন করে সামাজিক বাস্তবতার এক নতুন মাত্রা। গ্রামীণ ও শহুরে জীবন চিত্রণে এবং বিচিত্র চরিত্র নির্মাণে শওকত ওসমানের কৃতিত্ব অবিস্মরণীয়। কুশলী সংলাপ, আরবি-ফারসি শব্দের উপযুক্ত ব্যবহার ইত্যাদি তাঁর গল্পে এনে দেয় বৈচিত্র্য ও গতিময়তা। গেহুঁ, জুনু আপা, থুতু, বর্ণামৃত, মনিব ও তাহার কুকুর তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গল্প। জুনু আপা ও অন্যান্য গল্প, পিঁজরাপোল (১৯৫১), প্রস্তরফলক (১৯৬৪), নেত্রপথ (১৯৬৮), এবং তিন মির্জা, মনিব ও তাহার কুকুর (১৯৮৬), ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী (১৯৯০) প্রভৃতি গল্পগ্রন্থে সমাজের বহুমাত্রিক রূপ গ্রথিত করেন শওকত ওসমান।

আলাউদ্দীন আল আজাদের মধ্যে দুই বিপরীতধর্মী শিল্পচেতনার সমন্বয় লক্ষণীয়। জেগে আছি (১৯৫০), ধানকন্যা (১৯৫১), মৃগনাভি (১৯৫৩), অন্ধকার সিঁড়ি (১৯৫৮), উজান তরঙ্গে (১৯৫৯), যখন সৈকত (১৯৬৭), আমার রক্ত স্বপ্ন আমার (১৯৭২), জীবনজমিন (১৯৮৮) প্রভৃতি গ্রন্থে নরনারীর মনোজাগতিক বিশ্লেষণে, যৌনতা চিত্রণে এবং সামাজিক চরিত্র উন্মোচনে আজাদ সমান দক্ষতার পরিচয় দেন।

এ প্রসঙ্গে আরও দুজন গল্পকারের দুটি গল্প বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য: শাহেদ আলীর ‘জিবরাইলের ডানা’ (জিবরাইলের ডানা, ১৯৫৩) এবং মাহবুব-উল আলমের ‘মফিজন’ (মফিজন, ১৯৫৪)। গল্পদুটিতে মানুষের অভাবক্লিষ্ট জীবন, ধর্মের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক শোষণ, সামাজিক নিষ্ঠুরতার প্রেক্ষাপটে নারীর হূদয়বৃত্তির প্রকাশ এবং গ্রামবাংলার অবহেলিত নারীসমাজকে সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিক মর্যাদাদানের বিষয় চমৎকারভাবে চিত্রিত হয়েছে। এভাবে ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায়ে ছোটগল্পে সমাজ ও জীবনের স্বরূপ নানাভাবে প্রতিফলিত হতে থাকে; বিভিন্ন গল্পে প্রচারিত হতে থাকে মানবতাবাদ, সমাজসচেতনতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা।

ষাটের দশক থেকে ছোটগল্পের দুটি বিশেষ দিক লক্ষণীয় হয়ে ওঠে: সমকালীন ঘটনার ব্যাপক প্রতিফলন এবং ব্যক্তিসত্তার বিভিন্নমুখী বিশ্লেষণ। ভাষা আন্দোলনের পর থেকে পূর্ববঙ্গের রাষ্ট্র ও সমাজ তরঙ্গবিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ১৯৫৮-র সামরিক শাসন, ১৯৬৯-এর গণআন্দোলন, ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচন এবং ১৯৭১-এর  মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশের ছোটগল্প।  লায়লা সামাদ (১৯২৮-১৯৮৯), সুচরিত চৌধুরী (১৯২৯-১৯৯৪), আবদুল গাফফার চৌধুরী (১৯৩১-),  হাসান হাফিজুর রহমান (১৯৩২-১৯৮৩), সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫-), শওকত আলী (১৯৩৬-), জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত (১৯৩৯-), হাসান আজিজুল হক (১৯৩৯-), হাসনাত আবদুল হাই (১৯৩৯-), রাহাত খান (১৯৪০-), আবদুল মান্নান সৈয়দ (১৯৪৩-),  আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (১৯৪৩-১৯৯৭), সেলিনা হোসেন (১৯৪৭-) প্রমুখ গল্পকারের আত্মপ্রকাশ ঘটে ষাটের দশকের রাজনৈতিক-সামাজিক প্রেক্ষাপটে। এঁদের মধ্যে বিষয়বস্ত্ত, প্রকরণ ও ভাষাশৈলীর ক্ষেত্রে নতুনত্ব আনয়নের জন্য সৈয়দ শামসুল হক, শওকত আলী, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, হাসান আজিজুল হক, আবদুল মান্নান সৈয়দ ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বিশেষভাবে স্মরণীয়। এঁরা গল্পরচনায় প্রয়োগ করেন বিশ্লেষণধর্মিতা, অন্তর্মুখী ব্যঞ্জনা, আঞ্চলিক জীবন ও উপভাষা।

শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনের সঙ্কট ও গ্রামীণ জীবনকে আধুনিক শিল্পচেতনায় উপস্থাপনে সৈয়দ শামসুল হক বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন তাঁর তাস (১৯৫৪), শীতবিকেল (১৯৫৯), রক্তগোলাপ (১৯৬৪), আনন্দের মৃত্যু (১৯৬৭) প্রভৃতি গ্রন্থে। প্রথম গল্পগ্রন্থ উন্মূল বাসনা-য় (১৯৬৮) নরনারীর সম্পর্ক, মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা প্রভৃতি প্রাধান্য পেলেও শওকত আলী শেষ পর্যন্ত সমষ্টি মানুষের জীবনকেই রূপায়িত করার প্রতি অধিকতর মনোযোগী হন। তিনি নিম্নজীবী-হতদরিদ্র মানুষের কাহিনী বর্ণনায় বিশেষ সিদ্ধি অর্জন করেন। লেলিহান সাধ (১৯৭৭), শুন হে লখিন্দর (১৯৮৮), বাবা আপনে যান (১৯৯৪) প্রভৃতি তাঁর বিশিষ্ট গ্রন্থ।

সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য (১৯৬৪), আত্মজা ও একটি করবী গাছ (১৯৬৭), জীবন ঘষে আগুন (১৯৭৩), পাতালে হাসপাতালে (১৯৮১) প্রভৃতি গল্পগ্রন্থে বাক্সংযম, কাব্যময়তা ও প্রতীকতা সৃষ্টিতে এবং সমাজজীবনের গভীর প্রদেশ উন্মোচনে হাসান আজিজুল হকের সাফল্য অসাধারণ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতা অপরূপ শিল্পরূপ লাভ করেছে তাঁর নামহীন গোত্রহীন (১৯৭৪) গ্রন্থে। গল্পকার হিসেবে ব্যাপক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সম্মানও অর্জন করেন তিনি। বাস্তব ও পরাবাস্তবের আলোছায়া, মানবচরিত্রের রহস্যময়তা এবং সংক্ষুব্ধ সমকাল জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও আবদুল মান্নান সৈয়দের গল্পের মৌল উপাদান। ছোটগল্পের স্বল্প পরিসরেও অস্তিত্বের সঙ্কট, জীবনের ক্লিন্নতা ইত্যাদি বিষয়কে প্রকাশ করতে গিয়ে জ্যোতিপ্রকাশ গল্পের আঙ্গিক ও ভাষা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। দুর্বিনীত প্রধান (১৯৬৫), বহে না সুবাতাস (১৯৬৭), সীতাংশু তোর সমস্ত কথা (১৯৬৯) প্রভৃতি তাঁর প্রধান গল্পগ্রন্থ। জটিল বর্ণনারীতি, ব্যতিক্রমধর্মী শব্দব্যবহার, কাব্যিক পরিচর্যা ইত্যাদি বাংলাদেশের ছোটগল্পে এসেছে আবদুল মান্নান সৈয়দের মাধ্যমে। প্রতীকতা, পরাবাস্তবতা ও আধুনিক অস্তিত্ববাদের নিরিখে ব্যক্তি-সমাজের যোগসূত্র অনুসন্ধান তাঁর গল্পকে দিয়েছে বিশিষ্টতা। সত্যের মতো বদমাশ (১৯৬৮), চলো যাই পরোক্ষে (১৯৭৩), মৃত্যুর অধিক লাল ক্ষুধা (১৯৭৭) প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ।

ষাটের দশকে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে এরকম গল্পকারদের মধ্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সর্ব অর্থেই ব্যতিক্রমধর্মী। গ্রাম-নগর উভয় প্রেক্ষাপটেই তিনি ছিলেন সাবলীল। পুরানো  ঢাকা তাঁর গল্পে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। তাঁর গল্পের চরিত্রসমূহ লোভ-লালসা, ভালোবাসা-ঘৃণা, হিংস্রতা-ক্রূরতায় অর্জন করে সার্বজনীনতা। বাংলাদেশের ছোটগল্পে একটি নতুন গল্পভাষা নির্মিত হয় তাঁর হাতে। তাঁর গদ্যের ইতিবাচক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল তাঁর সার্থক ছোটগল্পগুলি। একেবারে চলিত কথ্যভঙ্গিকে মার্জিত চলিত গদ্যের সঙ্গে মিশিয়ে তিনি এক বেগবান ভাষা সৃষ্টি করেন, যা উভয় বাংলার প্রচলিত আদর্শ গদ্যরীতি থেকে আলাদা এবং যা একান্তই তাঁর। তাঁর গল্পগ্রন্থগুলি অন্য ঘরে অন্য স্বর (১৯৭৬), খোঁয়ারি (১৯৮২), দুধভাতে উৎপাত (১৯৮৩), দোজখের ওম (১৯৮৯), জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল (১৯৯৭)। আলোচ্য গল্পকারবৃন্দ ছাড়াও যাঁরা স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় রেখেছেন তাঁরা হলেন  সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, বশীর আল হেলাল, রাহাত খান, হাসনাত আবদুল হাই, সেলিনা হোসেন প্রমুখ।

ষাটের দশক বাংলাদেশের ছোটগল্পে এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে এ দশক অত্যন্ত তাৎপর্যবহ। শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক পত্র-পত্রিকাও এ সময় থেকেই প্রচুর পরিমাণে প্রকাশিত হতে থাকে। দেশে আসতে শুরু করে বিদেশি প্রগতিশীল সাহিত্যের অনূদিত গ্রন্থাদি। গল্পকারের সংখ্যাপ্রাচুর্যেও এ দশক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তী সময়ে ষাটের দশকের ধারাই আরো গতিশীল হয় এবং মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত নতুন নতুন গল্পকারের আবির্ভাবে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে ছোটগল্পের জগৎ। হেলেনা খান (১৯২৯-), শহীদ আখন্দ (১৯৩৫-), আবুবকর সিদ্দিক (১৯৩৬-), মাহমুদুল হক (১৯৪০-), বুলবন ওসমান (১৯৪০-), বিপ্রদাশ বড়ুয়া (১৯৪২-) হাজেরা নজরুল (১৯৪২-),  আহমদ ছফা (১৯৪৩-২০০১), ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ (১৯৪৫-), ফরিদা হোসেন (১৯৪৫-), কায়েস আহমেদ (১৯৪৮-১৯৯২), হুমায়ুন আহমেদ (১৯৪৮-) প্রমুখ গল্পকারের আত্মপ্রকাশ মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তীকালে হলেও মুক্তিযুদ্ধের পরেই তাঁরা খ্যাতি অর্জন করেন। অন্তিম ষাটের এ প্রজন্মকে স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী ও স্বাধীনতা-পরবর্তী দুই প্রজন্মের সেতুবন্ধ বলে অভিহিত করা যায়। এঁদের মধ্যে আবুবকর সিদ্দিক (ভূমিহীন দেশ, ১৯৮৫; চরবিনাশকাল, ১৯৮৭; মরে বাঁচার স্বাধীনতা, ১৯৮৭), মাহমুদুল হক (প্রতিদিন একটি রুমাল, ১৯৯৪), আহমদ ছফা (নিহত নক্ষত্র, ১৯৬৯), কায়েস আহমেদ (অন্ধ তীরন্দাজ, ১৯৭৮; লাশকাটা ঘর, ১৯৮৭) প্রভৃতি গল্পকার বিষয় ও ভঙ্গির ক্ষেত্রে মৌলিক পরিচয় দিয়েছেন।

১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা লাভের পরে ছোটগল্পে অনিবার্যভাবে যুক্ত হয় মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি। যুদ্ধ এবং যুদ্ধপরবর্তী বাস্তবতার আলোকে রচিত হয় বিপুলসংখ্যক ছোটগল্প। তবে ষাটের দশকের ছোটগল্পে আঙ্গিক ও ভাষার ক্ষেত্রে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছিল, সত্তরের দশকে তা লক্ষিত হয় না। মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে ছোটগল্পে সর্বাধিক লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এর বিষয়বৈচিত্র্য। মহসিন শস্ত্রপাণি (১৯৪৫-), সাযযাদ কাদির (১৯৪৭-), শান্তনু কায়সার (১৯৫০-), হরিপদ দত্ত, মুস্তাফা পান্না (১৯৫২-), ভাস্কর চৌধুরী (১৯৫২-), মঞ্জু সরকার (১৯৫৩-), সুশান্ত মজুমদার (১৯৫৪-), ইমদাদুল হক মিলন (১৯৫৫-), আহমদ বশীর (১৯৫৫-), ইসহাক খান (১৯৫৫-), আহমদ মুসা (১৯৫৭-), মঈনুল আহসান সাবের (জ. ১৯৫৮) প্রমুখ স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম দশকের গল্পকার। মহসিন শস্ত্রপাণি (জনশ্রুতি, ১৯৭৯), মুস্তাফা পান্না (লোকসকল, ১৯৮৪), মঞ্জু সরকার (অবিনাশী আয়োজন, ১৯৮২) প্রমুখ যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের অভাব-বঞ্চনা-শোষণের চিত্র তুলে ধরেন। সুশান্ত মজুমদার (ছেঁড়াখোঁড়া জমি, ১৯৮৫; রাজা আসেনি বাদ্য বাজাও, ১৯৯৪; শরীরে শীত ও টেবিল গুন্ডাপান্ডা, ১৯৯৮), আহমদ বশীর (অন্য পটভূমি, ১৯৮১), মঈনুল আহসান সাবের (পরাস্ত সহিস, ১৯৮২; অরক্ষিত জনপদ, ১৯৮৩; আগমন সংবাদ, ১৯৮৪) স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের নাগরিক জীবনের বিশিষ্ট রূপকার।

সত্তরের দশকে মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা, স্বপ্নভঙ্গের বেদনা, সামরিক শাসনের দুঃসহ বাস্তবতা, দারিদ্র্য, বেকার সমস্যা, নারীনির্যাতন, সন্ত্রাস প্রভৃতির প্রভাব পড়ে ছোটগল্পে। স্বাধীনতার পর থেকে আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা এবং অন্যান্য দেশের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যগ্রন্থগুলি দেশে অবাধে আসতে শুরু করে। অন্যদিকে মিডিয়া-টেকনোলজির অভাবিত উন্নতির ফলে তথ্য ও অন্যান্য বিষয়ে লেখক-পাঠক উভয়ের অভিজ্ঞতার পরিধি বৃদ্ধি পায়। সাহিত্যের ক্ষেত্রে এ নতুন অভিজ্ঞতাও যুক্ত হতে থাকে। তাই অন্তিমসত্তর থেকে আশির দশকের এবং সাম্প্রতিক বাংলা গল্পে বিষয়বস্ত্ত, প্রকাশভঙ্গি ও ভাষার ক্ষেত্রে বেশ পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এমনকি কোনো কোনো গল্পকারের গল্পকে ছোটগল্পের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিকও বলা চলে। আবু হাসান শাহরিয়ার, অনামিকা হক লিলি, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, বিশ্বজিত চৌধুরী, মহীবুল আজিজ, ওয়াহিদ রেজা, আনিসুল হক, মনির জামান, মামুন হুসাইন, সেলিম মোরশেদ, হুমায়ুন মালিক, সেলিম মোজাহার, শাহনাজ মুন্নী, রাজীব নূর, ফাহমিদুল হক, অদিতি ফাল্গুনি, আহসান ইকবাল, প্রশান্ত মৃধা প্রমুখ সত্তরের শেষ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক ধারা পর্যন্ত সৃষ্টিশীল গল্পকার হিসেবে খ্যাত। এঁদের মধ্যে মামুন হুসাইনের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আশির দশকের এ গল্পকার প্রচলিত বাংলা গল্পে সম্পূর্ণ নতুন একটি ধারার সূচনা করেন। বিষয়ভাবনা ও প্রকাশভঙ্গিতে বাংলা ছোটগল্পে তাঁর পূর্বে এমন আর কাউকে দেখা যায়নি। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত তাঁর গল্পগ্রন্থ শান্ত সন্ত্রাসের চাঁদমারি ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করে। তাঁর গল্পে বাস্তব ও কল্পজগতের সঙ্গে নিজস্ব দার্শনিক বোধ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তাঁর গল্পগুলি কেবল প্রচলিত ধারার ব্যতিক্রমই নয়, সেগুলিতে বাংলাদেশের জীবন আশ্চর্যরকমভাবে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে।  [মহীবুল আজিজ]

গ্রন্থপঞ্জি  নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সাহিত্যে ছোটগল্প (৩য় সংস্করণ), কলকাতা, ১৯৬২; ভূদেব চৌধুরী, বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্প ও গল্পকার (৪র্থ সংস্করণ), কলকাতা, ১৯৮৯; আনিসুজ্জামান, স্বরূপের সন্ধানে, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯১; সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস (১-৪ খন্ড), আনন্দ সংস্করণ, ১৯৯৩; আজহার ইসলাম, বাংলাদেশের ছোটগল্প: বিষয়ভাবনা স্বরূপ ও শিল্পমূল্য, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৬; মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন, বাংলাদেশের ছোটগল্প: জীবন ও সমাজ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৭।