ছিটমহল

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৬:৩১, ২৭ নভেম্বর ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)
thumb

ছিটমহল  বাংলাদেশ ও ভারতের একদেশের সীমানার সম্পূর্ণ ভেতরে বিচ্ছিন্নভাবে থেকে যাওয়া অন্যদেশের ভূখন্ড। বাংলাদেশ ও ভারতের ইতিহাস ও ভূগোলের সাথে মিশে আছে ছিটমহল সমস্যা। ভারত বিভক্ত হওয়ার পূর্বমুহূর্তে, মাউন্টব্যাটেন-পরিকল্পনা মাফিক (৩ জুন ১৯৪৭) বাংলা ও পাঞ্জাবকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ভাগ করার জন্য গঠিত একটি সীমানা কমিশনের নেতা হিসেবে নিযুক্ত হন স্যার র‌্যাডক্লিফ। স্বাধীনতা ঘোষণার সময় তৎকালীন পরিস্থিতিতে জরুরিভিত্তিতে এবং দ্রুততার সাথে র‌্যাডক্লিফকে সীমানা চিহ্নিতকরণের কাজটি সম্পন্ন করতে হয়েছিল। কার্যত এ কাজ মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যে নিষ্পন্ন হয়। স্যার র‌্যাডক্লিফ জুলাইয়ের ৮ তারিখে লন্ডন থেকে দিল্লিতে পৌঁছেন এবং আগস্টের ১৩ তারিখে তাঁর রিপোর্ট পেশ করেন। দীর্ঘকালের যোগাযোগ ব্যবস্থা, সমন্বিত অর্থনীতি ও স্থিতিসম্পন্ন অখন্ড এলাকার মাঝ বরাবর সানন্দে দাগ টেনে দেওয়া হয়। ফলে দুই নতুন সার্বভৌম দেশের সীমারেখার এপারে ওপারে, ব্রিটিশ-ভারতের পূর্ব-পশ্চিম এ দু অঞ্চলের দুটি প্রদেশ বাংলা ও পাঞ্জাব, প্রত্যেকটি বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১৬ আগস্ট সীমারেখা নির্ধারণী টপো-শিটের মূলকপি জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়। এ রায় যে বিতর্কের বিষয় হবে তা কমিশনের কাছেও ছিল নিশ্চিত এবং অনিবার্যতই অবিচার ও দুর্ভোগ এড়ানো যায় নি। কাগজে সীমানা যেভাবেই দাগানো হোক, মৌজা ও সামাজিক, সাংস্কৃতিক, এমনকি পারিবারিক বা গোষ্ঠীগত কারণে এবং জমি-জমার মানচিত্রে অসঙ্গতির কারণে বহু স্থানেই র‌্যাডক্লিফ যেভাবে দাগিয়েছেন, বাস্তবে সীমানা সেভাবে নির্ধারিত হওয়া সম্ভব ছিল না। ফলে দু দেশের ছিটমহলগুলি বিন্যস্তভাবে তৈরি হলেও অস্থিরকল্প সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। কমিশনের সদস্যদের নিষ্ক্রিয় পরিস্থিতিতে জমিদার, নবাব, স্থানীয় নেতা এবং এমনকি চা বাগানের মালিকরা বাংলা বিভক্তিকে কেন্দ্র করে তাদের নিজস্ব স্বার্থানুকূল রায়ের জন্য প্রভাব বিস্তার করে। ১৯৪৭ সালে এভাবে ব্রিটিশের হাতে ভারত বিভাগের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ওপর ছিটমহল সমস্যা বর্তেছে।

বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে অবস্থিত ভারতের কিংবা ভারতের মধ্যে অবস্থিত বাংলাদেশের ছিটমহল সম্পর্কিত তথ্যাবলি দুষ্প্রাপ্য। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায় যে, শুধু উত্তর-পশ্চিম সীমান্তেই ১৭৯টি ছিটমহল রয়েছে, যেগুলির অবস্থান অমীমাংসিত এবং যেগুলির বিষয়ে কোনো বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় নি। ১৯৯৬ সালের ৯ থেকে ১২ অক্টোবর কলকাতায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-ভারত সীমানা সম্মেলনে ছিটমহল সমস্যা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয় এবং ঐবছর ২১ থেকে ২৪ নভেম্বর সরেজমিন পরিদর্শনে ভারতীয় ভূখন্ডে মোট ১১১টি বিনিময়যোগ্য বাংলাদেশি ছিটমহল চিহ্নিত করা হয় যার আয়তন ১৭,১৬০.৬৩ একর। ওই পরিদর্শনে বাংলাদেশ ভূখন্ডে ৫১টি বিনিময়যোগ্য ভারতীয় ছিটমহল চিহ্নত করা হয় যার আয়তন প্রায় ৭,১১০.০২ একর। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারতীয় সীমানায় অবস্থিত বাংলাদেশি ৭৫টি ছিটমহলের মধ্যে ৪১টি লালমনিরহাট জেলায় (২টি হাতিবান্ধা উপজেলায়, ১টি লালমনিরহাট সদরে, ৪টি কালীগঞ্জে, ৩টি আদিতমারীতে, ২৮টি পাটগ্রামে এবং ৩টি ফুলবাড়ীতে), ১৬টি কুড়িগ্রাম জেলায় (সবকটি ভুরুঙ্গামারি উপজেলায়) এবং ১৮টি পঞ্চগড় জেলায় (২টি পঞ্চগড় সদরে, ১২টি বোদায় এবং ৪টি দেবীগঞ্জে)।

২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশের সাথে ছিটমহল সর্ম্পকিত একটি স্মারকচুক্তি স্বাক্ষর করেন। এচুক্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে ভারতের ১১১টি ছিটমহল যার অধিবাসী ৩৭,৩৩৪ এবং ভারতের ভূখন্ডের ভিতর বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল যার জনসংখ্যা প্রায় ১৪,২১৫ জন। ভারতীয় সীমানায় অবস্থিত বাংলাদেশের ছোট ছোট ছিটমহলের ওপর বাংলাদেশের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ নেই, এসব জায়গার কোনো রকম উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনাও সম্ভব নয়, যদিও ওই  সকল ছিটমহলে বসবাসকারী সকল মানুষ বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে সাংবিধানিকভাবেই বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাসহ নাগরিক অধিকারের হকদার।

ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক কারণে ছিটমহলে বসবাসকারী মানুষের প্রশাসনিক মর্যাদা নিশ্চিত করা দু দেশের সরকারের জন্যই লাভজনক। সীমান্ত নিরাপত্তা, অবৈধ চলাচল এবং জনসাধারণের জন্য উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনার বৃহত্তর স্বার্থে ছিটমহলগুলির রাজনৈতিক অবস্থান নির্ধারণ, কার্যত কঠিন হলেও জরুরি। আর তা পারস্পরিক বিনিময় বন্দোবস্তের মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব।

দেশ বিভাগের এক বছরের মধ্যে ছিটমহল ইস্যু ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চাপা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার প্রকাশ ঘটায়। অবস্থা সামাল দিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নুন কর্তৃক ১৯৫২ সালে দু দেশের মধ্যে ছিটমহল দক্ষিণ বেরুবাড়ির (৭.৩৯ বর্গ কিমি) একটি অংশ পূর্ববাংলার কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিলে ভারতের বিরেধী রাজনৈতিক শিবির এর কঠোর বিরোধিতা করে। সিদ্ধান্ত ছিল যে, পূর্ববাংলার মূলভূমির সঙ্গে নীলফামারী জেলার পাটগ্রাম থানাধীন আঙ্গরপোতা-দহগ্রাম ছিটমহলকে সংযুক্ত করতে ‘তিন বিঘা’ নামে খ্যাত এক একর জমির বিনিময়ে ভারত ছিটমহল সংলগ্ন অন্য এক খন্ড জমির অধিকারী হতে পারে। কিন্তু ভারতে এ নিয়ে লড়াই শুরু হলে এ সিদ্ধান্ত দু দশক সময়েও বাস্তবায়িত হতে পারে নি।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিটমহল ও অন্যান্য সীমান্ত বিরোধ নিরসনে আশার সঞ্চার করে। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে ইন্দিরা গান্ধী ও শেখ মুজিবুর রহমান স্বারিত চুক্তি অনুসারে সম্মত সীমান্তরেখাগুলি বলবৎ রাখার সিদ্ধান্ত হয়। চুক্তির ১৪ ধারায় ছিল যে, বাংলাদেশের পাটগ্রামের আঙ্গরপোতা-দহগ্রামকে যুক্ত করতে স্থায়ী সংযোগভূমির বিনিময়ে বাংলাদেশকে ভারতের নিকট দণি বেরুবাড়ির দণিাংশ ছেড়ে দিতে হবে। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সরকার চুক্তি মোতাবেক ভারতকে দণি বেরুবাড়ির সংশ্লিষ্ট অংশ হস্তান্তর করে। কিন্তু ভারতীয় পে সাংবিধানিক ও আইনগত বিতর্কের কারণে ১৭৮৮৫ মিটার আয়তনের স্থায়ী করিডোরটুকুর হস্তান্তর বিলম্বিত হয়। এ বিতর্ক ১৯৮২ সালের ৭ অক্টোবর আরেকটি চুক্তি স্বারিত হওয়ার আগ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এ চুক্তিতে স্থায়িভাবে তিন বিঘা হস্তান্তরের বিষয়টি ভারতের অবশিষ্ট সিদ্ধান্ত হিসেবে ছাড় দিয়ে বাংলাদেশের নাগরিকদের ছিটমহল থেকে মূলভূমিতে চলাচলের ব্যবস্থা রাখা হয়। ওই দেশের স্থানীয় বিরোধী প এ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আইনগত পদপে নেওয়ায় ভারত কর্তৃক চুক্তিটি বাস্তবায়নে আরেকটি দশক বিলম্বিত হয়। এসব বিঘ্ন নিষ্পত্তির পর, ভারত এবং বাংলাদেশ ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ চলাচলের জন্য করিডোর ব্যবহার, ছিটমহল এবং বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের মধ্যে যানবাহন চলাচল ও নিরাপত্তা সম্পর্কিত একটি আচরণবিধি সম্বলিত প্রোটোকল স্বার করে। এ সংযোগ-স্থানের ওপর নিয়ন্ত্রণ এখনও মূলত ভারতই ধরে রেখেছে। অন্যান্য সমস্যাক্রান্ত ছিটমহলগুলি এখনও সমাধানের বাইরে রয়ে গেছে। অবশেষে ২০১১ সালে বাংলাদেশি জনগণের জন্য সীমিতভাবে চলাচলের জন্য তিন-বিঘা করিডোর উম্মুক্ত করে দেয়া হয়। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রী সীমানা নির্ধারণী এক চুক্তিতে স্বার করেন। এতে বলা হয়, ছিটমহলবাসী তাদের ইচ্ছানুযায়ী নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন অথবা বর্তমান ভূখণ্ডে বসবাস করতে পারবে। কিন্তু এখনও অন্যান্য ছিটমহলগুলির সমস্যা অমীমাংসিত। [কে. মওদুদ এলাহী]