চৌধুরানী, নবাব ফয়জুন্নেসা

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৫:২৬, ২৩ নভেম্বর ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)
নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী

চৌধুরানী, নবাব ফয়জুন্নেসা (১৮৩৪-১৯০৩)  জমিদার, নারীশিক্ষার প্রবর্তক, সমাজসেবক ও কবি। কুমিল্লা জেলার লাকসাম উপজেলাধীন পশ্চিমগাঁও গ্রামে এক জমিদার বংশে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আহমদ আলী চৌধুরী ছিলেন হোমনাবাদ-পশ্চিমগাঁও-এর জমিদার। পারিবারিক পরিবেশে গৃহশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে বাড়িতেই তিনি শিক্ষালাভ করেন। মুসলমানদের কঠিন পর্দাপ্রথার মধ্যে থেকেও ফয়জুন্নেসা আরবি, ফারসি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায়ও ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন।

১৮৬০ সালে ফয়জুন্নেসা দূর সম্পর্কের আত্মীয় পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের জমিদার মুহম্মদ গাজীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের দাম্পত্য জীবন সুখের হয়নি, ফলে তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। ১৮৮৩ সালে পিতার মৃত্যুর পর তিনি পশ্চিমগাঁও-এর জমিদারি লাভ করেন এবং ১৮৮৫ সালে মায়ের মৃত্যুর পর মাতুল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন।

ফয়জুন্নেসা জমিদারি লাভের পূর্ব থেকেই সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড এবং দীন-দরিদ্রের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করেন। ১৮৭৩ সালে তিনি নারীশিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে কুমিল্লায় একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এটি উপমহাদেশে বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত মেয়েদের প্রাচীনতম স্কুলগুলির অন্যতম। কালক্রমে এটি একটি কলেজে রূপান্তরিত হয় এবং এর নাম হয় নবাব ফয়জুন্নেসা কলেজ। জমিদার হওয়ার পর তাঁর সেবার হাত আরও প্রসারিত হয়। ১৮৯৩ সালে পর্দানশীন, বিশেষত দরিদ্র মহিলাদের চিকিৎসার জন্য তিনি নিজ গ্রামে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। তিনি ‘ফয়জুন্নেসা জেনানা হাসপাতাল’ নামে একটি চিকিৎসালয়ও স্থাপন করেন। এছাড়া মসজিদ,  মাদ্রাসা ইত্যাদি নির্মাণেও তিনি প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। এলাকার রাস্তাঘাট নির্মাণ, দিঘি-পুষ্করিণী খনন প্রভৃতি জনহিতকর কাজে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।

১৮৯৪ সালে  হজ্জ পালন করতে গিয়ে ফয়জুন্নেসা মক্কায় একটি মাদ্রাসা ও একটি মুসাফিরখানা প্রতিষ্ঠা করেন। মৃত্যুর আগে তিনি জমিদারির এক বিশাল অংশ ওয়াকফ করে যান, যা থেকে এলাকার দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্ররা আজও অর্থসাহায্য পেয়ে থাকে। ফয়জুন্নেসার এরূপ জনহিতৈষণার পুরস্কারস্বরূপ মহারানী ভিক্টোরিয়া ১৮৮৯ সালে তাঁকে ‘নবাব’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনিই বাংলার প্রথম মহিলা যিনি এই উপাধি লাভ করেন।

ফয়জুন্নেসা বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সাময়িকীর পৃষ্ঠপোষকতা করেন। বান্ধব,  ঢাকা প্রকাশ, মুসলমান বন্ধু,  সুধাকর, ইসলাম প্রচারক প্রভৃত বাংলা পত্রপত্রিকা তাঁর আর্থিক সহায়তা লাভ করে। সাহিত্যিক হিসেবেও ফয়জুন্নেসার পরিচিতি আছে। গদ্যে-পদ্যে রচিত তাঁর রূপজালাল (১৮৭৬) গ্রন্থটি রূপকের আশ্রয়ে একটি আত্মজীবনীমূলক রচনা। এতে তাঁর বিড়ম্বিত দাম্পত্য জীবনের করুণ কাহিনী স্থান পেয়েছে। এছাড়া সঙ্গীতসার ও সঙ্গীতলহরী নামে তাঁর দুখানি কাব্যের কথাও জানা যায়। উল্লেখ্য যে, নবাব ফয়জুন্নেসা এমন এক সময়ে  বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা করেন যখন অভিজাত মুসলমানদের মধ্যে এই ভাষা সাধারণত ব্যবহূত হতো না। ১৯০৩ সালে স্বগ্রামে তাঁর মৃত্যু হয় এবং পারিবারিক গোরস্থানে তিনি সমাহিত হন। ২০০৪ সালে ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীকে একুশে পদক (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়। [গোপিকারঞ্জন চক্রবর্তী]