গ্রিক, জাতি

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২০:২৮, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

গ্রিক, জাতি  উসমানীয় তুর্কিদের বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য অধিকার এবং পরবর্তী সময়ে গ্রিস ও বল্কান অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের কারণে পনেরো শতকের শেষ পর্ব থেকে শুরু করে ষোল শতকের মধ্যে গ্রিকরা বিদেশি সাম্রাজ্যবাদের দাসত্বে শৃঙ্খলিত হয় এবং তাদের সংস্কৃতি হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ে। গ্রিকদের সৌভাগ্য যে, তুর্কিরা বাণিজ্যিক দখলদারিতায় অবজ্ঞা দেখালে অনেক গ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যে তুলনামূলক সমৃদ্ধি অর্জন করেন। প্রকৃতপক্ষে আঠারো ও ঊনিশ শতকে উসমানীয় সাম্রাজ্যের গোটা বাণিজ্যিক কর্মকান্ড ছিল গ্রিক ও আর্মেনীয়দের হাতে। গ্রিক বণিকগণ ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল, বিশেষ করে পূর্ব-ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে বাণিজ্যিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর মধ্য ইউরোপ ও রাশিয়ার ওপর প্রভাব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। তাদের মধ্যে সম্ভবত বেশি দুঃসাহসিকগণ আঠারো শতকে ভারতে আগমন করেন।

কলকাতার একটি ক্যাথলিক গির্জায় স্থাপিত দুজন গ্রিক বণিকের স্মৃতিস্তম্ভ আধুনিক ভারতে গ্রিকদের বাণিজ্যিক উপস্থিতির আদি দলিল। এ স্মৃতিস্তম্ভের লিপি থেকে জানা যায় যে, বণিক দুজনের যথাক্রমে ১৭১৩ ও ১৭২৮ সালে কলকাতা শহরে মৃত্যু হয়। কিছু গ্রিক স্থলপথে পারস্য ও আফগানিস্তানের ভেতর দিয়ে ভারত আসেন। কিন্তু অধিকাংশ গ্রিকই এ ক্ষেত্রে লোহিতসাগর ও ভারত মহাসাগর হয়ে বিদ্যমান সমুদ্রপথ বেছে নিয়েছিলেন। ভারতে তাদের আগমন ঘটে গ্রিক উপনিবেশসমূহ যথা এশিয়া মাইনর, ইজিয়ান, আয়নিয়ান দ্বীপসমূহ এবং গ্রিসের মূল ভূখন্ড থেকে। তবে থ্রেসীয় শহর ফিলিপ্পোপলিস (বর্তমানে এটি বুলগেরিয়ার সঙ্গে যুক্ত এবং প্লভদিভ নামে খ্যাত) থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গ্রিক এখানে আগমন করেন। এরা বসতি স্থাপন করেন প্রধানত ঢাকা ও কলকাতায়। বাংলায় গ্রিকদের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা কঠিন, তবে ১৭৭০ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে গ্রিকদের সম্ভাব্য সংখ্যা ছিল দুইশত বা তার কিছু বেশি এবং কলকাতায় ছিলো এর কিছু কম।

গ্রিকদের বড় অংশ বাণিজ্যিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত ছিলেন। শুরুতে তারা ঢাকার বস্ত্র বসরা হয়ে ইউরোপ এবং পূর্ব-ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে রপ্তানি করতেন। কিন্তু ঊনিশ শতকের প্রথমদিকে তারা রপ্তানি বাণিজ্যে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হন এবং বাংলায় তাদের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গ্রিকরা লবণ ও নানা ধরনের দেশিয় উৎপাদন সামগ্রীর বাণিজ্য করতেন। কেউ কেউ চুন উৎপাদনে নিয়োজিত ছিলেন।

বাংলায় গ্রিক সম্প্রদায়ের প্রথম স্বীকৃত প্রধান পুরুষ হচ্ছেন ‘এলোক্সিও আরগিরি প্যানাঘিওটিস’ (Alexios Argyree Panaghiotis)। পরবর্তী সময়ে তাঁর উত্তরপুরুষগণ নামটির ইংরেজি রূপ করেন প্যানিওটি (Panioty)। ফিলিপ্পোপলিসে জন্মগ্রহণকারী প্যানিওটি ১৭৫০ সালে ভারত আসেন। মিশরে ব্রিটিশ বণিকদের বাণিজ্য করার অনুমতি লাভের উদ্দেশ্যে ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭১ সালে এক কূটনৈতিক মিশনে তাঁকে কায়রো প্রেরণ করেন। তাঁর কাজ সাফল্যের সঙ্গে সম্পাদিত হয়। তিনি হেস্টিংসের কাছ থেকে কলকাতার আমড়াতলা স্ট্রিটে একটি গ্রিক গির্জা নির্মাণের অনুমতি লাভ করেন। অবশেষে প্যানিওটি তাঁর বাণিজ্যিক কার্যক্রম ঢাকায় স্থানান্তর করেন। এখানেই ১৭৭৭ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।

প্যানিওটির কাজ অব্যাহত রাখেন তাঁর পুত্র আলেকজান্ডার প্যারিওটি (Alexander Parioty) এবং তিনি সিলেটে একটি চুনের কারখানা চালু করেন। প্যারিওটি নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের মধ্যে বিস্তৃতভাবে লবণের বাণিজ্য করতেন। পিতা-পুত্র ছিলেন বাংলায় গ্রিক অর্থডক্স চার্চের প্রধান এজেন্ট। তাঁরা ঢাকা ও কলকাতায় গ্রিকদের আধ্যাত্মিক চাহিদা পূরণের জন্য সিনাইয়ের আর্চবিশপের সঙ্গে যোগাযোগ করে সেন্ট ক্যাথরিন মঠ থেকে বেশ কজন সাধু সন্ন্যাসীকে আনেন। ১৭৮২ সালে আমড়াতলা স্ট্রিটের গির্জাটিকে আদর্শায়িত রূপদান এবং ১৮১২ সালে ঢাকায় আরেকটি গির্জা নির্মাণ করা হয়। প্রথমদিকে কলকাতায় অর্থডক্স ধর্মগুরু হিসেবে সবচেয়ে সুপরিচিত ছিলেন কর্ফু অঞ্চল থেকে আগত কর্মশক্তিপূর্ণ ফাদার কনস্ট্যানটাইন পার্থেনিয়স (Constantine Parthenios)। জফে (Zoffay) যাঁকে যিশুর মডেল হিসেবে গ্রহণ করে ‘শেষ নৈশভোজের’ চিত্র অংকন করেন এবং কলকাতায় অবস্থিত সেন্ট জনের অ্যাংলিকান চার্চে টানিয়ে রাখেন।

১৮২০ থেকে ১৮৪০ সালের মধ্যে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে বড় রকমের ধ্বস নামে। এটি ছিল ল্যাঙ্কাশায়ারের বস্ত্র শিল্প প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতার ফল। এর সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ায় গ্রিক সম্প্রদায়ও ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার হয়। ঊনিশ শতকের শেষভাগে লন্ডনকেন্দ্রিক গ্রিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান র‌্যালি ব্রাদার্স ঢাকার প্রথমদিকের গ্রিক বণিকদের স্মরণে রমনা এলাকায় একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করে। এ স্মৃতিস্তম্ভে গ্রিক বণিক, তাদের কারও কারও স্ত্রী এবং ১৮০০ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে মৃত্যু গ্রিক ধর্মগুরু প্রমুখের দশটি সমাধিলিপি পাওয়া গেছে। স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণ করা হয়েছে ক্লাসিক্যাল গ্রিক মন্দিরের আদলে। পরবর্তীকালে এটিকে সরিয়ে এনে বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের নিকট প্রতিস্থাপন করা হয়। এখানে উৎকীর্ণ অধিকাংশ লিপিই ক্লাসিক্যাল গ্রিক রীতিতে লেখা, অবশ্য কিছু ইংরেজি লিপিও রয়েছে।

কলকাতার গ্রিক সম্প্রদায় আমড়াতলা স্ট্রিট গির্জাকে ঘিরেই বসতি গড়ে তোলে। ১৮১৮ সাল থেকে ১৮৪২ সালের মধ্যে এপিরাসের বণিক কনস্ট্যানটাইন পার্টাজেস (Constantine Partazes) ছিলেন এ সম্প্রদায়ের প্রবীণতম এবং সম্মানিত ব্যক্তি। কনস্ট্যান্টিনোপলের সাথে তাঁর বাণিজ্য চলত। তিনি গ্রিক সম্প্রদায়ের ছেলে-মেয়েদের নিজ ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতি শিক্ষা দেওয়ার জন্য কলকাতায় একটি গ্রিক স্কুল স্থাপন করেন। পরে এ দায়িত্ব তিনি তাঁর অনুবর্তী পিটার প্রটোপাপাসকে (Peter Protopapas) হস্তান্তর করেন। আগ্রা ও অযোধ্যায় ব্রিটিশ শক্তি বিস্তার লাভ করলে কিছুসংখ্যক গ্রিক এর সুবিধা গ্রহণ করেন। তারা কানপুর, মিরাট, করণৌল ও দিল্লিতে দোকানদার ও ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেন।

ঊনিশ শতকে ব্যক্তিগত উদ্যোক্তাদের বাণিজ্যে ক্রমাবনতি দেখা দেয়। ফলে গ্রিক বণিকদের প্রথম পুরুষের উত্তরাধিকারীগণ তাদের পেশায় পরিবর্তন আনেন। এমনকি আঠারো শতকের  শেষদিক থেকেই অল্পসংখ্যক সাহসী ও উদ্যমী গ্রিক ভাড়াটে সৈনিকের জীবনও বেছে নেন। এ প্রবণতার দুটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। কনস্ট্যান্টিনোপলের অভিজাত পরিবারের সন্তান কাউন্ট আলেকজান্ডার ঘিকা (Count Alexander Ghika) ১৭৯৬ থেকে ১৮০২ সাল পর্যন্ত মারাঠা প্রধান আম্বাজি-র (Ambajee) অধিনায়কত্বে তাঁর সৈন্যবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। আলেকজান্ডারের সমসাময়িক অ্যাডাম জর্জ (Adam George) ১৭৯১ সালে বেনয়েট ডি বোগনের (Benoit De Boigne) বিখ্যাত স্যাভয় (Savoyard) সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। পরে তিনি গোয়ালিয়রের সিন্ধিয়ার সৈন্যবাহিনীতে চাকুরি নেন। তিনি একটি অশ্বারোহী বাহিনীর সেনাপতিও হয়েছিলেন।

বাংলায় গ্রিকদের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বংশধরের অধিকাংশই প্রথমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও পরে ব্রিটিশ-রাজের প্রশাসনে আমলা হিসেবে যোগ দেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে সফল ব্যক্তি ডেমেট্রিয়াস প্যানিওটি (Demetrius Penioty)। তিনি অলেক্সিয়াস আরগিরি প্যানাঘিওটিস-এর সরাসরি বংশধর। ১৮৪৯ সালে তিনি বেঙ্গল সেক্রেটারিয়েটে একজন করণিক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। ১৮৫৩ সালে তাঁকে গভর্নর জেনারেলের দরবার বিভাগে বদলি করা হয়। অতঃপর ১৮৮০ সালে লর্ড রিপনের (Lord Ripon) সহকারী ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে তিনি নিযুক্ত হন। এভাবে ১৮৯৫ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি বেশ কজন ভাইসরয়ের সঙ্গেই কাজ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে এ কর্মবীরের স্মৃতি রক্ষার্থে কলকাতার ময়দানে একটি স্মারক ঝর্ণা নির্মাণ করা হয়। প্যানিওটির স্ত্রী পারসিন (Persine) লেডি ডাফরিনের (Dufferin) দোভাষী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পারসিনের মাধ্যমে লেডি ডাফরিন ভারতের বিভিন্ন রানী ও রাজকন্যাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন।

বিশিষ্ট সংস্কৃত পন্ডিত এথেন্সের ডেমেট্রিয়াস গ্যালানোস (Demetrius Galanos) প্রথমদিকে বাংলায় আগত গ্রিকদের মধ্যে সম্ভবত সবচাইতে বিখ্যাত ছিলেন। তিনি ১৭৮৬ সালে কলকাতায় আসেন এবং গ্রিক স্কুলে শিক্ষক পদে চাকুরি গ্রহণ করেন। তিনি অল্প সময়েই ইংরেজি, ফারসি, উর্দু ও সংস্কৃত ভাষায় বিশেষ বুৎপত্তি অর্জন করেন। সংস্কৃত ভাষায় বিশেষজ্ঞসুলভ জ্ঞান অর্জনের জন্য তিনি ১৭৯২ সালে বেনারসে যান। সেখানে তিনি ব্রাহ্মণ পন্ডিত সাতৌল সিং (Satoul Sing)-এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এখানে বেশ কিছু সংস্কৃত গ্রন্থ তিনি গ্রিক ভাষায় অনুবাদ করেন। ১৮৩৩ সালে তিনি বেনারসে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে ইংরেজ সমাধিক্ষেত্রে সমাহিত করা হয়। ডেমেট্রিয়াস গ্যালানোসকে আজও ইউরোপীয় সংস্কৃত পন্ডিতদের মধ্যে পুরোধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং তাঁর প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থের অনুবাদ আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিখ্যাত।

ঊনিশ শতকের মধ্যভাগে প্রথমযুগের গ্রিক বণিকদের বাণিজ্যিক কর্মকান্ডের প্রায় সমাপ্তি ঘটে। এ সময় ভারতীয় বাণিজ্যের সিংহভাগ এমন সব ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠানের হাতে চলে যায় যাদের সদর দপ্তর ছিল ইউরোপে। এ প্রতিষ্ঠানগুলিতে গ্রিকদের তেমন অংশগ্রহণ ছিল না। অবশ্য এ জন্য ভারতে গ্রিক বাণিজ্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। বরঞ্চ লন্ডনকেন্দ্রিক গ্রিক বাণিজ্যের নতুন ভিত্তি তৈরি হয়। এ জাতীয় গ্রিক বাণিজ্য কোম্পানির মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল র‌্যালি ব্রাদার্স। ১৮৫১ সালে এ কোম্পানি ভারতে তাদের প্রথম শাখা স্থাপন করে (১৫, লাল বাজার, কলকাতা)।

র‌্যালি ব্রাদার্সের প্রতিষ্ঠাতা বিখ্যাত ব্যবসায়ী পান্ডিয়াস র‌্যালি ইজিয়ান দ্বীপ কিওস থেকে আগত। ১৮২৬ সালে তিনি  লন্ডনে এ প্রতিষ্ঠানটি স্থাপন করেন এবং তাঁর দক্ষতায় এর বাণিজ্য সম্প্রসারিত হয়। নিজস্ব জাহাজ ও অন্যান্য পরিবহন ব্যবস্থার মাধ্যমে হাজার হাজার টন খাদ্যশস্য, মসলা, এবং অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী নিকটপ্রাচ্য থেকে এনে তারা ইউরোপে চালান দিতেন। কলকাতায় শাখা স্থাপনের পর তাদের কার্যক্রম সমগ্র উত্তর ভারতে বিস্তৃত হয়। ১৮৮২ সাল থেকে গৃহীত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে নারায়ণগঞ্জে এ কোম্পানি একটি পাটকল স্থাপন, দুটি বাষ্পীয় জাহাজ চালু ও নিজস্ব জাহাজ ঘাট প্রতিষ্ঠা করে। বাংলা থেকে র‌্যালি ব্রাদার্স পর্যাপ্ত পরিমাণ পাট যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, হল্যান্ড, স্পেন, ইতালি, রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেরণ করত। এ ছাড়াও এ প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যদ্রব্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিল গম, কলাই, ডাল, তিসি, পোস্তদানা, তিল, চাল, সোরা, লাক্ষা, রেঢ়ির তেল, হলুদ, আদা, রাবার, সোহাগা ইত্যাদি।

উনিশ শতকের শেষদিকে র‌্যালি ব্রাদার্স ছাড়াও অপর কিছু গ্রিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান কলকাতায় তাদের কার্যক্রম শুরু করে। এগুলি হচ্ছে র‌্যালি অ্যান্ড ম্যাভরোজানি, আর্গেন্টি, সেছিয়ারি, সাগেলেস্টে, সাগরান্ডি, ঝলিজ্জি অ্যান্ড কোম্পানি, প্যাট্রোকোচিনো ব্রস, তাম্ভাকো অ্যান্ড কোম্পানি, জজিয়ার্দি অ্যান্ড কোম্পানি, এন. ভ্যালেটা অ্যান্ড কোম্পানি, গিফো অ্যান্ড কোম্পানি, পাল্লাচি অ্যান্ড কোম্পানি, ভ্লাস্টো অ্যান্ড কোম্পানি এবং নিকাচি অ্যান্ড কোম্পানি। র‌্যালির পরিবারের সঙ্গে অন্যান্য গ্রিক পরিবারের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ফলে কিওস দ্বীপ থেকে আগত পরিবার বাংলার গ্রিক বাণিজ্যের কর্তৃত্ব লাভ করে।

এ সকল বাণিজ্য কেন্দ্রের পাশাপাশি বিশ শতকের প্রথমদিকে কলকাতায় গ্রিকদের তামাক ও তামাকজাত পণ্যের বাণিজ্য শুরু হয়। কায়রো থেকে আগত গ্রিক থিও ভ্যাফিয়াডিস (Theo Vafiadis) ৪, ডালহৌসী স্কোয়ারে; এস.জেড এনড্রিকোপাউলস (S.Z. Andrico-Powlos) ১০, ডালহৌসী স্কোয়ারে; এবং পি-স্টি (P-isti) ও পেলেকানজ (Pelekanos) ১০৪, ক্লাইভ স্ট্রীটে তাদের বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান খোলেন। এ প্রতিষ্ঠানগুলির মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক গ্রিক কলকাতা ও মফস্বলে চাকুরি লাভ করেন। প্রথমদিকে আগত গ্রিক বণিকদের মতো এরা বাংলায় স্থায়ী অবস্থান গ্রহণ করেননি। চাকুরি শেষে তারা গ্রিসে ফিরে গিয়েছিলেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে এবং পরে কলকাতাকেন্দ্রিক ইউরোপীয় সমাজ জীবনে অবদান রাখার জন্য অন্তত একজন গ্রিক বহির্বিশ্বে কিছু খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি হচ্ছেন মেরি নিকাচি (Marie Nicachi)। ১৮৮৮ সালে কলকাতায় তাঁর জন্ম। এখানেই তিনি বড় হন ও শিক্ষা লাভ করেন। তিনি ছিলেন অনন্য প্রতিভাবান পেশাদার একজন বেহালা বাদক। তাঁর বেহালা বাদন কলকাতার শ্রোতাদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রশংসা অর্জন করে। ১৯১০ সালে তিনি বেহালা বাদনের জন্য ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলি ভ্রমণ করেন। তিনি  ভিয়েনাতে অস্ট্রিয়ার সম্রাট ফ্রাঞ্জ জোসেফ (Franz Josef) এবং সেন্ট পিটার্সবার্গে জার দ্বিতীয় নিকোলাস (Nicholas II) ও জারিনাকেও বেহালা বাজিয়ে শোনান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি কর্ফুতে তাঁর পরিবারের কাছে ফিরে যান। এখানে দুই বিশ্বযুদ্ধের অন্তর্বর্তীকালে তিনি স্থানীয় ও বিদেশি বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে তাঁর বাদন মুর্ছনায় মোহিত করেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাংলায় গ্রিক বাণিজ্যিক কর্মকান্ডকে শেষ সীমায় নিয়ে আসে। ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা ও বঙ্গ বিভাগ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নতুন প্রেক্ষাপটের সৃষ্টি করে। এ অবস্থায় র‌্যালি ব্রাদার্সসহ অধিকাংশ গ্রিক বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান নিজেদের বাণিজ্যিক কার্যক্রম গুটিয়ে ফেলে। এভাবে গ্রিকদের শতককালের (১৮৫০-১৯৫০) উজ্জ্বল দিনগুলির অবসান ঘটে।  [পল ব্যারন নরিস]

গ্রন্থপঞ্জি  Timotheos Catsiyannis, Pardias Stephen Rallis, 1793-1865, London, 1986; Paul Byron Norris, Ulysses in the Raj, London, 1992; Helen Abadzi, 'The Dshaka University Greek Gravestones and the Greek Community', Journal of The Asiatic Society of Bangladesh, 40, 1, Dhaka, 1995.