গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১০:৩০, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প (জি-কে প্রজেক্ট)  গঙ্গা নদীর দক্ষিণ তীরের বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে (বাংলাদেশের ভূখন্ডে) সেচের জন্য  বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক গৃহীত একটি প্রকল্প। কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ এবং মাগুরা জেলার ১,৯৭,৫০০ হেক্টর জমি এ  সেচ কার্যক্রমের আওতাভুক্ত। এর মধ্যে ১,৪২,০০০ হেক্টর জমি সেচযোগ্য। উল্লিখিত চারটি জেলার সর্বমোট ১৩টি উপজেলায় এ কার্যক্রম বিস্তৃত। উপজেলাগুলি হলো - কুষ্টিয়া সদর, কুমারখালী, খোকসা, মিরপুর, ভেড়ামারা, চুয়াডাঙ্গা সদর, আলমডাঙ্গা, ঝিনাইদহ সদর, হরিণাকুন্ড, শৈলকূপা, মাগুরা সদর, শ্রীপুর এবং দৌলতপুর। প্রকল্পের ভৌগোলিক সীমারেখা উত্তরে গঙ্গা ও  গড়াই নদী, পূর্বে গড়াই-মধুমতি, দক্ষিণে  নবগঙ্গা এবং পশ্চিমে মাথাভাঙ্গা নদী পর্যন্ত বিস্তৃত। এ প্রকল্পের বিশেষত্ব হলো, গঙ্গা নদী থেকে পাম্পের সাহায্যে পানি তুলে সংযোগ  খাল ও নালার মাধ্যমে কৃষি জমিতে পানি সরবরাহ করা। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বা পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়নকে এ প্রকল্পে ততটা গুরুত্ব দেওয়া হয় নি। প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্যগুলির মধ্যে শস্যের অধিক ফলন, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি এবং কৃষকের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ছিল অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

১৯৫১ সালে পরিচালিত প্রাথমিক জরিপের পর ১৯৫৪ সালে তৎকালীন  পাকিস্তান সরকার প্রস্তাবিত জি-কে প্রকল্প অনুমোদন করে। প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয় ১৯৫৪-৫৫ অর্থ বছরে। ১৯৬২-৬৩ মৌসুমে প্রকল্পভুক্ত এলাকায় স্থানীয় কিছু উন্নত জাতের  ধান চাষ করা হয়। ওই সময়ে উফশী (উচ্চ ফলনশীল) জাতের ধান চাষ এ অঞ্চলে বিশেষ পরিচিত ছিল না এবং এ ধানের বীজও সহজপ্রাপ্য ছিল না। জি-কে প্রকল্পের কল্যাণে উফশী ধানের চাষ অল্পদিনের মধ্যেই এ এলাকার কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। বিশেষ করে খরিপ-১ মৌসুমে (মার্চ-জুন) উফশী আউসের চাষ এবং খরিপ-২ (জুলাই এর মধ্যবর্তী সময় থেকে নভেম্বর) মৌসুমে উফশী আমনের চাষ অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পায়। শুধুমাত্র প্রয়োজনের সময়ে সেচ বা সম্পূরক সেচের পরিকল্পনা এবং উদ্দেশ্য নিয়ে এ প্রকল্প যাত্রা শুরু করলেও, বর্তমানে একটি অতিরিক্ত উফশী আউস চাষের জন্য প্রয়োজনীয় সেচ কার্যক্রম প্রকল্পভুক্ত করা হয়েছে। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত আমন (খরিপ-১) মৌসুমে সেচের আওতায় আসা সর্বোচ্চ জমির পরিমাণ ৪৩,০০০ হেক্টর এবং আউস (খরিপ-২) মৌসুমে ৯৯,০০০ হেক্টরে পৌঁছায়।

সমগ্র প্রকল্প এলাকাটি দুটি অঞ্চলে বিভক্ত, কুষ্টিয়া অঞ্চল এবং যশোর অঞ্চল। কুষ্টিয়া অঞ্চলটি দুই অংশে বিভক্ত, পর্ব-১ ও পর্ব-২। পর্ব-১ এর আওতাভুক্ত এলাকা ৮৫,০২০ হেক্টর যার মধ্যে ৪৮,৭০০ হেক্টর ভূমি সেচযোগ্য। পর্ব-২ এর আওতাভুক্ত এলাকা ১,১৭,৮১৪ হেক্টর যার মধ্যে ৯৩,৩০০ হেক্টর ভূমি সেচযোগ্য। প্রকল্পটির আওতায় সর্বমোট সেচযোগ্য ভূমির পরিমাণ ১,৪২,০০০ হেক্টর।

শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়ন ও পরিচালনাগত উভয় দিক থেকেই বিভিন্ন সমস্যার মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। পূর্বের অনুমানের চেয়ে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পানির চাহিদা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এ কারণে প্রকল্পভুক্ত এলাকাকে সেচের আওতায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে এক ধরনের অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গা থেকে পাম্পের সাহায্যে প্রয়োজনীয় পানি উত্তোলন প্রায়শ সম্ভব হয় না, কেননা পাম্পগুলি পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে যে স্থানে বসানো হয়েছিল সেখানে এখন আর ন্যূনতম প্রয়োজনীয় পানির স্তর থাকছে না। শুষ্ক মৌসুমে পানির ঊর্ধ্বসীমা লক্ষণীয়ভাবে নিচে নেমে যায়। প্রতি বছর গঙ্গা থেকে পাম্প হাউজের সংযোগ খালে ১০ লক্ষ ঘনমিটার জমে থাকা পলিমাটি ড্রেজিং করে অপসারণ করতে হয়। পানি সরবরাহের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক সংস্কার কাজ গৃহীত হয় ১৯৮৪ সালে এবং ১৯৯৩ সালে তা সমাপ্ত হয়।

জি-কে প্রকল্পে গঙ্গা নদী থেকে পাম্প করে পানি উত্তোলন করে উত্তোলিত জলরাশির প্রবাহ নিম্নাঞ্চলে খালের মাধ্যমে কৃষি জমিতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রকল্পের দুটি পাম্প ঘরে বিভিন্ন ক্ষমতার বিভিন্ন ধরনের পাম্প রয়েছে। নদী থেকে প্রধান খালে পানি উত্তোলনের জন্য তিনটি মূল পাম্পের প্রত্যেকটির নির্ধারিত পানি উত্তোলন ক্ষমতা ৩৭ কিউমেক। এর সঙ্গে ১২টি সম্পূরক পাম্প রয়েছে যার প্রতিটির নির্ধারিত পানি উত্তোলন ক্ষমতা ৩.৫ কিউমেক। নদী থেকে পানি উত্তোলনে এ ১৫টি পাম্পের সর্বমোট পানি উত্তোলন ক্ষমতা ১৫৩ কিউমেক।

প্রকল্পের প্রধান দুটি খালের নাম কুষ্টিয়া খাল ও গঙ্গা খাল। কুষ্টিয়া খালের সেচ কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৬৯-৭০ সালে, যাকে এ প্রকল্পে পর্ব-১ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। গঙ্গা খালের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৮২-৮৩ সালে, যা পর্ব-২ নামে পরিচিত। প্রকল্পটিতে পানি সেচের জন্য রয়েছে ১,৬৫৫ কিমি দীর্ঘ বিভিন্ন ধরনের খাল ও নালা। প্রধান খাল দুটির দৈর্ঘ্য ১৯৩ কিমি। মধ্যবর্তী পর্যায়ে পানি বিতরণের খালগুলির সম্মিলিত দৈর্ঘ্য ৪৬৭ কিমি (সর্বমোট সংখ্যা ১৭টি) এবং কৃষিজমিতে পানি পৌঁছে দেওয়ার জন্য নির্মিত তৃতীয় পর্যায়ের খালগুলির সম্মিলিত দৈর্ঘ্য ৯৯৫ কিমি (সর্বমোট সংখ্যা ১৫৪টি)। এ ছাড়া সর্বমোট ২,৭৭০.৭০ কিমি দীর্ঘ নালা (সর্বমোট সংখ্যা ১,৭৭২টি) রয়েছে যা মাঠের কৃষি জমিতে চূড়ান্ত পর্যায়ের সেচকার্য সম্পন্ন করে। প্রকল্প এলাকায় সার্বিক পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নয়নের উদ্দেশ্যে ৯৭১ কিমি দীর্ঘ পানি নিষ্কাশন প্রণালী গড়ে তোলার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় সড়ক নির্মিত হয়েছে মোট ২২৮ কিমি। সেচ কার্যক্রম তত্ত্বাবধানের উদ্দেশ্যে মূলত এ সড়ক ব্যবস্থা নির্মিত হলেও একই সঙ্গে তা এলাকাবাসীর যোগাযোগের রাস্তা হিসেবেও ব্যবহূত হচ্ছে। অনেক সেতু, কালভার্টও নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে সেচ খালের উপর ১,২৬৮টি, মাঠের নালার উপর ৬৫৩টি, নিষ্কাশন নালার উপর ২৫৩টি ছোট ছোট সেতু/কালভার্ট নির্মিত হয়েছে। প্রকল্পভুক্ত এলাকাকে বন্যামুক্ত রাখার জন্য সর্বমোট ৩৯ কিমি দীর্ঘ  ভেড়িবাঁধ নির্মিত হয়েছে।

গঙ্গায় পানির প্রবাহ কম থাকলে পাম্পগুলি নির্ধারিত ক্ষমতার (১৮০ কিউমেক) মাত্র ৬৮%, অর্থাৎ ১২২ কিউমেক পানি উত্তোলন করতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে শুষ্ক মৌসুমের মাসগুলিতে সেচ কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে এবং গত কয়েক বছর ধরে প্রকল্প এলাকার কৃষকেরা পানির পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করার জন্য  নলকূপ স্থাপন করছে। সহজপ্রাপ্যতার সময়গুলিতে তারা ভূপৃষ্ঠের পানি ব্যবহার করে থাকে।

জি-কে প্রকল্পের সেচ ব্যবস্থা সাধারণভাবে মধ্য ফেব্রুয়ারিতে জোরদার হয়ে ওঠে এবং মধ্য নভেম্বরে তা বন্ধ হয়ে যায়। শীত মৌসুমে সেচ কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয় বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য। প্রকল্পের সেচ সুবিধা ব্যবহার করে এ অঞ্চলের কৃষকেরা প্রতি বছর প্রায় ৩ লক্ষ টন অতিরিক্ত  ফসল উৎপাদন করছে, যার আর্থিক মূল্য ২৪০ কোটি টাকা।  [মাসুদ হাসান চৌধুরী]