ক্যাম্পবেল, স্যার জর্জ

ক্যাম্পবেল, স্যার জর্জ (১৮২৪-১৮৯২)  বাংলার বেসামরিক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা এবং লেফটেন্যান্ট গভর্নর (১৮৭১-১৮৭৪)। ইডেন উড-এর স্যার জর্জ ক্যাম্পবেল (ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মেডিক্যাল সার্ভিসের প্রাক্তন সদস্য)-এর পুত্র ক্যাম্পবেল এডিনবার্গ নিউ অ্যাকাডেমি এবং হেইলবারিতে শিক্ষা লাভ করেন। ১৮৪২ সালে ক্যাম্পবেল বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। কিন্তু বাংলায় লেফটেন্যান্ট গভর্নর হিসেবে নিয়োগ লাভের পূর্বে তিনি প্রদেশে কদাচিৎই চাকুরি করেন। শুধু দুবার কলকাতা হাইকোর্টের বিচারক (১৮৬৩-১৮৬৬) এবং উড়িষ্যা ফ্যামিন কমিশনের সভাপতি (১৮৬৬-১৮৬৭) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বিভিন্ন পদে তার চাকুরিজীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত হয়েছে উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ, পাঞ্জাব ও অযোধ্যায়।

অন্যান্য অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা অপেক্ষা জর্জ ক্যাম্পবেল ছিলেন সক্রিয় বুদ্ধিজীবী। বাংলায় লেফটেন্যান্ট গভর্নর হিসেবে তার নতুন নিয়োগে যোগদানের জন্য আসার পূর্বে তিনি প্রজননিক গবেষণা- যেমন, মডার্ন ইন্ডিয়া (১৮৫২), এথনোলজি অব ইন্ডিয়া (১৮৬৮), আইরিশ ল্যান্ড টেনিউর (১৮৬৮) এবং টেনিউর অব ল্যান্ড ইন ইন্ডিয়া (১৮৭০)-এর স্বীকৃতিস্বরূপ অক্সফোর্ড থেকে ডি.সি.এল ডিগ্রি লাভ করেন। বাংলার প্রশাসনিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে তাকে লেফটেন্যান্ট গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। কারণ, এসময় সমগ্র ব্রিটিশ ভারতে ইন্ডিয়া অফিস এবং ভারতসরকার উভয়ই বাংলা প্রদেশকে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে অবহেলিত এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অনগ্রসর বলে চিহ্নিত করে।

ক্যাম্পবেল তার অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে উপলব্ধি করেন যে, উন্নয়নের প্রক্রিয়া শুরু করতে এবং তা ধরে রাখতে হলে সরকারের প্রয়োজনীয় পরিসংখ্যান ও তথ্যাদির প্রয়োজন। তাই তিনি জনসংখ্যা, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, কৃষি ও শিল্প সংক্রান্ত উৎপাদন, যোগাযোগ ব্যবস্থা, অপরাধ ও অপরাধ ব্যবস্থাপনা এবং আরও অন্যান্য বিষয়ের ওপর পরিসংখ্যান সংগ্রহ করার নির্দেশ জারি করেন। ক্যাম্পবেলের প্রশাসন নৃতত্ত্ব, ধর্মবিশ্বাস, সামাজিক রীতিনীতি, জাতিপ্রথা প্রভৃতির ওপর পরিসংখ্যান সম্বলিত আদমশুমারিসহ অনেকগুলি প্রকল্প গ্রহণ করে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বাংলার প্রশাসন বিষয়ক ক্যাম্পবেলের পরিসংখ্যানমালা ঔপনিবেশিক শাসনের শেষ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।

প্রাপ্ত পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে ক্যাম্পবেল প্রশাসনিক উন্নয়নের অনেক পরিকল্পনা তৈরি করেন। তার গৃহীত প্রকল্পগুলির মধ্যে ছিল সাঁওতালদের জন্য স্বায়ত্ত্বশাসন, প্রাদেশিক অর্থব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ, জেলা সড়ক কর প্রচলন (সড়ক কর আইন ১৮৭১), ১৮৭১ সালের ৭ নং আইন অনুযায়ী ক্যালকাটা পোর্ট ট্রাস্টের সংস্কার, ১৮৭২ সালের আদমশুমারি, পৌর প্রশাসন এবং স্থানীয় সরকার-এর সম্প্রসারণ, পাঠশালা এবং মক্তব শিক্ষার সম্প্রসারণ, কারাগার ব্যবস্থাপনা, কলকাতা পৌরসভার সংষ্কার, ১৮৭৩ সালের বাঁধ নির্মাণ ও ড্রেনেজ আইনের আওতায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রভৃতি। নিম্নপদস্থ নির্বাহি প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা বৃদ্ধির নিমিত্তে নেটিভ সিভিল সার্ভিসের প্রবর্তন ছিল তার গৃহীত পদক্ষেপগুলির মধ্যে সবেচেয়ে উল্লেখযোগ্য। সকল অধীনস্থ কর্মকর্তাদের শিক্ষা এবং প্রশাসনিক বিষয়ের ওপর পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হতো। চাকুরিতে প্রবেশকালে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থাও চালু করা হয়। নিম্নপদস্থ বেসামরিক কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের জন্য হুগলীতে একটি নেটিভ সিভিল সার্ভিস কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ নেটিভ সিভিল সার্ভিস পরবর্তীকালে  বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস-এর অগ্রদূত হিসেবে কাজ করেছিল।

১৮৭২-৭৩ সালের পাবনা কৃষক বিদ্রোহ এর ফলে জর্জ ক্যাম্পবেলের প্রশাসন কেঁপে ওঠে। করের মাত্রা ও ভূমি অধিকার সংক্রান্ত প্রথানুগ নিয়ম ভঙ্গ করে যেসব জমিদার আবওয়াব বা অতিরিক্ত কর আদায় করছিলেন তাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল এ বিদ্রোহ। জাতীয় বিদ্রোহরূপে এ বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ার পূর্বেই ক্যাম্পবেল সমস্যা সমাধানের জন্য দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।  জমিদার ও  রায়তদের মধ্যে সমঝোতার ব্যবস্থা এবং গ্রামাঞ্চলে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়। ভারত ও আয়ারল্যান্ডের ভূমি মালিকানা বিষয়ে অভিজ্ঞ ক্যাম্পবেল বাংলার ভূমি ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য অগ্রসর হন। কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন, জোরালো জমিদারি স্বার্থ, জমিদার নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্র, জমিদার নিয়ন্ত্রিত মধ্যশ্রেণী প্রভৃতি বিষয় দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি নির্যাতিত কৃষকদের পক্ষে কোনোরূপ জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখেন। এক্ষেত্রে তিনি প্রদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে ভূমি সংস্কারের জন্য যুক্তিসহ শুধু সুপারিশ করেন। তার প্রস্তাবের শেষ ফসল হলো ১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন

ব্রিটিশ রাজের প্রতি তার অত্যধিক কর্মকান্ডের স্বীকৃতিস্বরূপ ক্যাম্পবেল ১৮৭৩ সালে কে.সি.এস.আই (KCSI) উপাধিতে ভূষিত হন। ১৮৭৩ সালের প্রথম দিক থেকে অসুস্থ থাকার কারণে তিনি শেষপর্যন্ত চাকুরি থেকে অবসর নিতে বাধ্য হন এবং ১৮৭৩ সালের শেষের দিকে ভারত ত্যাগ করেন। ১৮৭৫ থেকে ১৮৯২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কায়রোতে তার মৃত্যু পর্যন্ত ক্যাম্পবেল পার্লামেন্টের সদস্য ছিলেন।  [সিরাজুল ইসলাম]