কৃষিপণ্য

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১০:০২, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

কৃষিপণ্য (Agricultural Produce) কৃষি, বন, মৎস্য ও পশুসম্পদসহ বিভিন্ন খামার কার্যক্রমের মাধ্যমে উৎপন্ন দ্রব্য। বাংলাদেশে অনেক ধরনের শস্য উৎপন্ন হয়, যেমন দানাশস্য, অাঁশফসল, ডাল, তৈলবীজ, আখ, মূল ও কন্দ, মসলা ও সুগন্ধি, মাদক ফসল, পশুখাদ্য, শাকসবজি, ফলমূল, রেশম উৎপাদক ফসল প্রভৃতি। ২০০৫-০৬ সালে জাতীয় মোট উৎপাদনে কৃষিতে জিডিপি ছিল ২৩% এর মধ্যে শস্য ১৩.৩৭, পশুসম্পদ ২.৯৫, মৎস্য ৫.০০ এবং বনসম্পদ ১.৬৪ ভাগ। দেশের শস্য, পশুসম্পদ, মৎস্যচাষ ও বন সমন্ধে নিচের অনুচ্ছেদগুলিতে আলোচিত হলো।

ফসল ১৯৭০-১৯৭১ ১৯৮০-১৯৮১ ১৯৯০-১৯৯১ ২০০০-২০০১ ২০০৫-২০০৬
জমি উৎপাদন জমি উৎপাদন জমি উৎপাদন জমি উৎপাদন জমি উৎপাদন
আউশ (স্থানীয়) ৩১৬০ ২৭৫৭ ২৬২৭ ২২১৪ ১৭৪৪ ১৬৩০ ৮৬০ ৯৮১ ৫১৮ ৬৬৪
আউশ (উফলী) ৩২ ১০৬ ৪৮৬ ১০৭৫ ৩৬৮ ৬৯৮ ৪৬৬ ৯৩৫ ৫১৭ ১০৮১
আমন (স্থানীয়) ৫৬৬২ ৫৭০০ ৫০৭৮ ৫৯০৩ ৩৮১২ ৪৯২০ ২৭৮৪ ৪৩১১ ২২৩৬ ৩৩০৫
আমন (উফলী) ২৫৩ ২১২ ৯৬২ ২০৬১ ১৯৬৬ ৪২৪৭ ২৭৯৮ ৬৯৩৮ ৩১৯৫ ৭৫০৫
বোরো (স্থানীয়) ৬৩৫ ১০০৫ ৪১৪ ৬৪০ ২৮২ ৪০৭ ২০২ ৩৬৭ ১৭৪ ৩৪৭
বোরো (উফলী) ৩৪৭ ১১৮৭ ৭৪৭ ১৯৯০ ২২৬৭ ৫৯৫০ ৩৫৬২ ১১৪১২ ৩৮৯৪ ১৩৬২৮
ধান মোট ১০০৮৯ ১০৯৬৭ ১০৩১৪ ১৩৮৮৩ ১০৪৩৯ ১৭৮৫২ ১০৬৭২ ২৪৯৪৪ ১০৫৩৪ ২৬৫৩০
গম ৩১১ ১১০ ৫৯১ ১০৭৫ ৫৯৯ ১০০৪ ৭৭৩ ১৬৭৩ ৪৭৯ ৭৩৫
অপ্রধান দানাশস্য ১৪৫ ১০৭ ১১২ ৭৮ ১১১ ৮১ ৫৬ ৫০ ১০০ ৫২৪
ডাল ৩৭২ ২৯৬ ৩২৬ ২১১ ৭২৮ ৫২৩ ৪৭৪ ৩৬৬ ৩৩৭ ২৭৯
তৈলবীজ ৩৩৪ ২৭৪ ২৬৩ ১৬৬ ৪৬১ ৩১৮ ৪২১ ৩৮৫ ৩০২ ৫৯৫
পাট ৮৯১ ১১৯১ ৬৩৫ ৮৯৭ ৫৮৪ ৯৬২ ৪৪৮ ৮২১ ৪০২ ৮৩৮
তুলা ১৯ ১৬ ১১ ১৬
আখ ১৬৪ ৭৫৯৮ ১৪৯ ৬৬০০ ১৯১ ৭৬৮২ ১৬৯ ৬৭৪২ ১৫৩ ৫৫১১
মূল ও কন্দ ১৬০ ১৬৬৮ ১৭০ ১৬৭৬ ১৭৪ ১৭২০ ২৮৮ ৩৫৭৩ ৩৩৫ ৪৪৬৯
মসলা/সুগন্ধি ১৬৪ ৩৭৭ ১৪৪ ২৪০ ১৪৭ ৩১৯ ২৫৩ ৩৯৪ ৩২১ ১১৮২
তামাক ৪৪ ৩৯ ৫১ ৪৮ ৩৮ ৩৪ ৩০ ৩৭ ৩২ ৪৩
চা ৪৫ ৩১ ৪৫ ৩৮ ৪৮ ৪৭ ৪৯ ৬৩ ৫৩ ৬৪
শাকসবজি ১৩১ ৯৩১ ১৩৬ ৯৮৭ ১৭৮ ১০৫৫ ৩১৭ ৪৬৪৭ ৪৫৫ ৫৯৫২
ফল ১৩৫ ১২০৬ ১৮৭ ১৪৪৮ ২০৭ ১৫০৯ ১৯২ ১৫৬০ ২৪০ ২৯৪৭

উৎস   বিবিএস, ১৯৭২, ১৯৮২, ১৯৯২, ২০০২ এবং ২০০৭।

দানাশস্য দানাশস্যগুলির মধ্যে ধানের আবাদ হয় মোট ফসলি জমির প্রায় ৮০ ভাগ, বাৎসরিক ১০.৫৩ মিঃ হেক্টর জমি থেকে প্রায় ২৬.৫৩ মিঃ মেঃ টন ধান যা সকল ফসলের মূল্যের ৭৫ ভাগ।  দেশে উৎপন্ন  মোট দানাশস্যের প্রায় ৯৫% ধান। উচ্চফলনশীল (উফলী) জাতগুলি প্রবর্তনের ফলে ১৯৭০-৭১ সাল থেকে ২০০৫-০৬ সালের মধ্যে ধানের উৎপাদন  ১৪২% বৃদ্ধি পেয়েছে, সাথে সাথে ধান চাষের আবাদি জমির পরিমান বৃদ্ধি পেয়েছে ৬%। আউশ মৌসুমে উফলী ধানের বিস্তার ছিল খুবই মন্দা এবং আমন ও বোরোর চেয়ে অনেক কম। বোরো সাধারণত আউশ ধানের জমি দখল করে রাখে বলে আউশের জমির পরিমাল হ্রাস পায়। উফলী ধানের জমি ১৯৭০-৭১ সালে ৬% থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৮০-৮১ সালে ২১%, ১৯৯০-৯১ সালে ৪৪%, ২০০০-০১ সালে ৬৪% এবং পরবর্তীতে ৭০% বৃদ্ধি পেয়েছে। সেচ এলাকার দ্রুত সম্প্রসারণের ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে। দেশে ধানের বর্তমান উফলী জাতগুলির ফলনক্ষমতা হেক্টর প্রতি প্রায় ৪ মে টনের অধিক, যেখানে ধানের অন্যান্য জাতগুলির অধিকাংশের গড় ফলন ২.৫০ মে টন/হে।

পাহাড়ের ঢাল থেকে শুরু করে নদীগর্ভ পর্যন্ত বিভিন্ন ভূমি পরিবেশে ধানচাষ হয়। কিছু কিছু এলাকার একই জমিতে শুধূ ধানের একটি ফসলের চাষ হয় এবং প্রধানত পাট, ডাল, তৈলবীজ, শাকসবজি, গম, বার্লি প্রভৃতি ফসলের সঙ্গে পর্যায়ক্রমে ধান চাষ করা হয়। কোন কোন স্থানে ধানের পর ইক্ষু চাষের প্রচলন আছে। মৌসুল ও ভূসংস্থান অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের ধান তিনটি প্রধান শ্রেনীতে বিভাজ্য ক. আউশ, খ. আমন, এবং গ. বোরো।

ক. আউশ মোট প্রায় ১.০৩ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে চাষ হয় এবং মোট উৎপন্ন ধানের ৬.৫৮% আউশ। সাধারণত ছিটিয়ে বোনা হলে ও কিছু কিছু এলাকায় এপ্রিল-মে মাসে রোপা হয়, ফসল তোলা হয় জুলাই-আগস্টে।

খ. আমন দেশের মোট ধানী জমির শতকরা ৫২ ভাগে আমন চাষ হয় এবং মোট উৎপন্ন ধানের ৪১%। জীবনচক্রের মেয়াদ ১২০-২৭০ দিন। রোপা আমন জুলাই-আগষ্ট মাসে লাগানো হয় এবং কাটা হয়   নভেম্বর-জানুয়ারী মাসে। বোনা আমন চাষ হয় নিচু জমিতে, যেখানে বর্ষায় পানির গভীরতা ১.৫ মিটারের বেশি, এমনকি ৩.০-৩.৫ মিটার বা ততোদিক হতে পারে। বীজ বপন হয় মার্চ-এপ্রিল মাসে এবং ফসল তোলা হয় নভেম্বর-ডিসেম্বরে।

গ. বোরো চাষ হয় প্রায় ৪.০৭  হেক্টর জমিতে তাতে মোট উৎপাদনের প্রায় ৫৩ ভাগ ধান উৎপাদিত হয়।  হাওর, নদীগর্ভ,বিল ইত্যাদির ধারে কাছে নিচু জমিতেই সাধারণত বোরো চাষ হয়। সেচ সুবিধা রয়েছে এমন জমিতে ও বোরো ধানের চাষ করা হয়।  নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে চারা রোপণ এবং মার্চ-এপ্রিল মাসে ফসল তোলা হয়। অন্যান্য ধানের চেয়ে বোরো ধানের হেক্টর প্রতি ফলন বেশি। উৎপাদন প্রধানত সেচ সুবিধার ওপর নির্ভরশীল।

গম দেশের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যশস্য। গমের উৎপাদন এলাকা ১৯৭০-৭১ সালে ০.৩ মিলিয়ন হেক্টর থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০০০-০১ সালে ০.৮ মিলিয়ন হেক্টর এবং পরবর্তীতে ২০০৫-০৬ সালে হ্রাস পেয়ে ০.৫ মিলিয়ন হেক্টরে দাঁড়ায়   বর্তমান উৎপাদন প্রায় ১.০ মিলিয়ন মে টন। সম্প্রতি চাউলের ঘাটতির কারণে গমের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে।

ভুট্টা ও অন্যান্য দানাশস্য শুল্ক মৌসুমে সেচ ও বর্ষাকালে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করে বাংলাদেশে বছরের যে কোন সময় ভুট্টা ফলানো যায় বলে ফসলটি এখন ধান ও গম উভয়ের বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বর্তমান ভুট্টার গড় ফলন প্রায় ৫ মে টন/হে। ভুট্টা ছাড়া ও অন্যান্য দানাশস্য, যেমন যব, চীনা, কাউন এবং জোয়ার সম্পূরক খাদ্য, পশুখাদ্য, হাঁস-মুরগির খাদ্য ও শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে যথেষ্টে গুরুত্বপূর্ণ।

অাঁশ উৎপাদক ফসল দেশের প্রধান অাঁশ উৎপাদক ও অর্থকরী ফসল পাট। ১৯৭০-৭১ সালে পাটের জমি ও উৎপাদনের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ০.৯০ মিলিয়ন হেক্টর এবং ১.১৯ মিলিয়ন মে  টন, কিন্তু ২০০৫-০৬ সালে তা হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ০.৪০ মিলিয়ন হেক্টর ও ০.৮৪ মিলিয়ন মে টনে। কাঁচা পাট ও পাটজাত দ্রব্য রফতানী করে বাৎসরিক প্রায় ১৬% বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা হয়। বাংলাদেশে প্রধানত ২ জাতের পাট উৎপাদন হয় তোষা পাট এবং সাদা পাট। তোষা পাট সাধারণত হালকা সোনালী রঙের এবং সাদা পাট সাধারণত সাদা রঙের। সাদা পাটের চাষ হয় নিচু জমিতে, বীজবপন করা  হয় মার্চ-এপ্রিল এবং পাট কাটা হয় জুলাই-আগস্ট মাসে। তোষা পাটের চাষ হয় মাঝারি-উঁচু জমিতে, বীজবপন হয় এপ্রিল -মে মাসে এবং তা কাটা হয় আগস্ট-সেপ্টেম্বরে।

সাধারণ পাট ছাড়া ও অাঁশের জন্য মেস্তা পাট এবং কেনাফ অল্প পরিমাণে চাষ করা হয়। এগুলির চাষাবাদে ততটা যত্ন প্রয়োজন হয় না। অাঁশ উৎপাদন ও সবুজ সার উৎপাদন উভয় প্রয়োজনে ব্যবহার্য শন-পাট রবি ও খরিফ উভয় মৌসুমে চাষ করা যায়।এই অাঁশ পাটের চেয়ে শক্ত এবং রশি, মাছ ধরার জাল, মোটা কাপড় প্রভৃতি তৈরিতে ব্যভহূত হয়।

তুলা বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ অাঁশ উৎপাদক ফসল। তুলার চাষাধীন জমি ও উৎপাদন ১৯৭০-৭১ সালে যথাক্রমে ছিল ৭,০০০ হেক্টর এবং ২,০০০  মে টন, ২০০০-০১ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১৬,০০০ হেক্টর ও ৬,০০০ মে টন এবং তা ২০০৫-০৬ সালে  হ্রাস পেয়ে ১১,০০০ হেক্টর ও ৬,০০০ মে টনে দাঁড়ায়। হেক্টর প্রতি বীজ তুলার ফলন সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যদিও দেশে তুলার ফলন বিশ্বমানের তুলনায় কম। রবি ও খরিফ উভয় মৌসুমে তুলার চাষ করা যায়। খরিফ মৌসুমে তুলাচাষে ১০ থেকে ১১ মাস প্রয়োজন আর রবি মৌসুমে ফলন সামান্য কম হলে ও সময় লাগে ৬-৭ মাস। অবশ্য আগ-ফসলি ভাল জাতের তুলা চাষের জন্য শীতকালই উত্তম।

ডালশস্য  বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের আমিষের প্রধান উৎস। বাংলাদেশের ডালশস্যের মধ্যে রয়েছে মসুর, খেসারি, মাষকলাই,  মুগ, ছোলা, মটর ও অড়হর। গোমটর ভাল জন্মে চট্রগ্রাম অঞ্চলে। ডাল বা তৈলবীজ হিসেবে দেশে সয়াবিনের চাষ খুবই সামান্য। বর্তমানে প্রায় ০.৩৮ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে ডাল শস্যের আবাদ করে প্রায় ০.২৮ মিলিয়ন মে টন ডালশস্য উৎপাদিত হয়।

তৈলবীজ দেশে উৎপন্ন বিভিন্ন তৈলবীজের মধ্যে সরিষা, তিল, চীনাবাদাম, সূর্যমুখী, কুসুমফুল, গর্জনতিল, নারিকেল ভোজ্যতেল এবং তিসি, রেড়ি অভোজ্যতেল যোগায়। ভোজ্য তৈল হিসেবে নারিকেল তৈল এখনও ব্যবহার হচ্ছে না। সরিষা হচ্ছে প্রধান তৈলবীজ, শীতকালে চাষ হয়, ৩ থেকে ৪ মাসের মধ্যেই ফসল ওঠে। নানা জাতের সরিষা প্রায় ০.২২ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে চাষ হয়  যা তৈলবীজের চাষাধীন মোট জমির ৭০ ভাগ। তিল আবাদ হয় প্রায় ০.০৩১ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে এবং গ্রীষ্ম ও শীত উভয় মৌসুমে  উৎপন্ন হয় প্রায় ০.০৪ মিলিয়ন মে টন। চীনাবাদামের তেল সরিষার তেলের চেয়ে অধিক পুষ্টিকর এবং চীনাবাদমের হেক্টর প্রতি ফলন ও সরিষার চেয়ে বেশি। প্রায় ০.০৩ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে চীনাবাদমের চাষ হয়, বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ০.০৪ মিলিয়ন মে টন। রবি ও খরিফ উভয় মৌসুমেই ফলে। সূর্যমুখী, কুসুমফুল এবং গর্জনতিলের খুব অল্পই চাষ হয়। সরিষার তুলনায় এসব শস্যের তেল উচ্চমানের। নারিকেল জন্মে প্রায় ০.০৪ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে এবং মোট উৎপাদন প্রায় ০.০৯১ মিলিয়ন মে টন। নারিকেল বসতবাড়ির ফল এবং ডাব অবস্থায় পানীয় হিসেবেই বেশির ভাগ ব্যবহূত হয়। ভোজ্যতেল হিসেবে নারিকেল তেল ব্যবহার মোটেই জনপ্রিয় নয়, তবে বিভিন্ন প্রসাধনীতে ব্যাপক ব্যবহূত হয়। তিসি ও রেড়ি বীজের তেল বার্নিস ও শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহূত হওয়ায় এগুলি ও চাষ করা হয়। রবি ও খরিফ উভয় মৌসুমে চাষ হয়।

চিনি উৎপাদক ফসল  আখ দেশের একটি গুরুত্বপূর্ন অর্থকরী ও চিনি উৎপাদনকারী ফসল। দেশের প্রায় ০.১৫ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে প্রায় ৫.৫১ মিলিয়ন মে টন আখ উৎপন্ন হয়। আখ ছাড়া ও গুড় তৈরির জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে অত্যন্ত সীমিত পরিমাণে খেজুর ও তাল লাগানো হয়।

মাদক ফসল তামাক খোলামেলা, সুনিস্কাশিত বেলেমাটি ও শীতল জলবায়ুতে ভাল জন্মে। প্রধানত রবি ফসল হিসেবে বৃহত্তর কুষ্টিয়া ও রংপুর জেলায় এর চাষ করা হয়। ১৯৮০-৮১ সালে তামাকের চাষাধীন জমির পরিমাণ ছিল প্রায় ০.০৫১ হেক্টর, যা ২০০৫-০৬ সালে ০.০৩২ মিলিয়ন হেক্টরে নেমে গেছে। ব্যবহারের ভিত্তিতে তামাকের শ্রেণিবিভাগ (ক) হুঁকা-তামাক যেমন মোতিহারি’, ‘ভাঙ্গি প্রভৃতি; (খ) ‘বিড়ি’ তামাক যেমন ‘নিপনি’; (গ) সিগারেট তামাক যেমন হ্যারিসনস এবং (ঘ) সিগারেট তামাক যেমন ‘সুমাত্রা’, ‘ম্যানিলা’ ইত্যাদি। চিবানোর ফসল হিসেবে পান ও সুপারির চাষ যথেষ্ট ব্যাপক।

পানীয় ফসল  চা দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয়, জন্মে প্রধানত সিলেটে, তাছাড়া চট্রগ্রাম, পার্বত্য চট্রগ্রাম,  কুমিল্লায় এবং পঞ্চগরে কিছু চা বাগান আছে। লক্ষণীয়, চা চাষাধীন এলাকা গত কয়েক দশকে প্রায় অপরিবর্তিত থাকলেও বর্তমান দশকে সমতল ভূমিতে কিছু এলাকায় চায়ের আবাদ বাড়ছে তাতে চায়ের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন,  উন্নত খামার উপকরণের প্রচলন, সময়োচিত প্রসম্ভার (Input) যোগান এবং আধুনিক যন্ত্রপাতি প্রবর্তনের ফলে চা শিল্প উন্নততর হয়েছে এবং তাতে বিশ্বের অন্যান্য রপ্তানিকারক দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ আরও দক্ষতার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারছে।

কফি এদেশে ততটা জনপ্রিয় নয় এবং এর চাষাবাদও প্রায় নেই। অবশ্য পরীক্ষা ও গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে বাংলাদেশে পর্যাপ্ত কফি উৎপাদন সম্ভব।

মূল ও কন্দ ফসল  চাউল ঘাটতির সময় উচ্চ শর্করাসমৃদ্ধ আলু যথেষ্ট সহায়ক এবং এটি একটি জনপ্রিয় সবজিও। স্বল্পমেয়াদি ফসল হওয়ার দরুন আলুর অধিক ব্যবহার ধান ও গমের ওপর চাপ যথেষ্ট কমাতে পারে। দেশে বছরে প্রায় ৪.৪৬  মিলিয়ন মে টন আলু উৎপন্ন হয়। এই শীতকালীন সবজিটি প্রধানত বৃহত্তর বগুড়া, রংপুর, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, রাজশাহী, কুমিল্লা ও ঢাকা জেলায় উৎপন্ন হয়।

মিষ্টিআলু বহুবর্ষজীবী লতা, এর অস্থানিক মূলের আগা স্ফীতমূলে রূপান্তরিত হয়। প্রধানত শীতকালে বেলে দোঅাঁশ মাটিতে, বিশেষত নদীর চরে জন্মে। ২০০৫-০৬  সালে মিষ্টিআলুর চাষাধীন জমি ছিল প্রায় ০.০৩৪ মিলিয়ন হেক্টর। বৃহত্তর রাজশাহী, কুমিল্লা, সিলেট, ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলাতেই প্রধানত চাষ হয়। আর ও কয়েক ধরনের মূল ও কন্দ ফসল বাংলাদেশে জন্মে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ক্যাসাভা, শাকআলু ও চুপরি আলু/কুকুর আলু। পদ্ম ও শালুকের মূল গ্রামাঞ্চলে খাওয়ার প্রচলন রয়েছে।

শাকসবজি  সবুজ শাকসবজিসহ বিভিন্ন সবুজ উদ্ভিদ বাংলাদেশের অধিবাসীদের খাদ্যের অপরিহার্য উপকরণ। ২০০৫-০৬ সালে এ দেশে প্রায় ৫.৯৫ মিলিয়ন মে টন শাকসবজি উৎপন্ন হয় যা চাহিদার মাত্র ২০%।  শাকসবজি প্রধানত দুই প্রকার শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন, আর কিছু শাকসবজি উভয় ঋতুর। সবজি হিসেবে, বিশেষত কাঁচা অবস্থায় ব্যবহূত অনেক রকমের ফলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পেঁপে, কাঁচাকলা, চালতা, জলপাই, আম, ফুটি, আনারস প্রভৃতি।  মরিচ, পেয়াজ, রসুন, ইত্যাদি মসলা ও কখনও কখনও সবজি হিসেবে ব্যবহূত হয়।

শীতকালীন শাকসবজি সব জেলায় জন্মালেও গুরুত্বপূর্ণ সবজি উৎপাদক অঞ্চলগুলি হলো ময়মনসিংহ, ঢাকা, রংপুর, রাজশাহী, বগুড়া, কুমিল্লা, যশোর, বরিশাল ও ফরিদপুর। ২০০৫-০৬  সালে ০.১৬৪ মিলিয়ন  হেক্টর জমিতে প্রায় ১.১৬ মিলিয়ন মে টন শাকসবজি উৎপন্ন হয়েছিল। শীতকালীন প্রধান শাকসবজির মধ্যে বেগুন, লাউ, মূলা, দেশী শিম ইত্যাদি জনপ্রিয় সবজি। অন্যান্য শাকসবজিগুলির মধ্যে আছে বাঁধাকপি, ফুলকপি, ওলকপি, গাজর, টমেটো, লেটুস, শালগম, পালংশাক, মটর  প্রভৃতি।

গ্রীষ্মকালীন সবজি কমবেশি সব জেলাতেই জন্মে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে কৃষকের বসতবাড়িতে শুস্ক জায়গায় চাষ হয়। গ্রীষ্মকালীন সবজির মধ্যে রয়েছে বেগুন, ঢেঁড়শ, মিষ্টিকুমড়া, চিচিঙ্গা, করলা, ঝিঙ্গা, শসা, বরবটি, ডাঁটাশাক, লালশাক ও পুঁইশাক।

মসলা ও সুগন্ধি  প্রায় ০.৩২১ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে বার্ষিক ১.১৮ মে টন মসলা ও সুগন্ধি উৎপন্ন হয়। আমাদের ব্যবহূত সাধারণ মসলা হচ্ছে মরিচ, হলুদ, আদা, পিঁয়াজ, রসুন, ধনিয়া, তেঁজপাতা  ইত্যাদি।

ফল  ০.০৯৭ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে প্রায় ২.৯৫  মিলিয়ন মে টন বিভিন্ন ধরনের ফল উৎপন্ন হয়। সাধারণ ফলের মধ্যে রয়েছে কলা, পেঁপে, আম, আনারস, লিচু, কাঁঠাল, তরমুজ, পেয়ারা, কুল ও বেল।

পশুসম্পদ বাংলাদেশে চাষাবাদে শ্রমশক্তির প্রধান যোগানদার হল গবাদি পশু। অধিকন্তু, পশু ও পোল্ট্রি মাংস, দুধ, ডিম, চামড়া সার প্রভৃতি যোগান দেয়। বাংলাদেশের পশুসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক তৈরি এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০৭-০৮ সালে দেশে মোট গরুর সংখ্যা ছিল প্রায় ২৩ মিলিয়ন। দেশে প্রায় ১.৩০ মিলিয়ন মহিষ, ২২ মিলিয়ন ছাগল, ২.৪০ মিলিয়ন ভেড়া, ২১০ মিলিয়ন মোরগ-মুরগি ও ৪০ মিলিয়ন হাঁস রয়েছে। ডিম, মাংস ও দুধের বর্তমান উৎপাদন যথাক্রমে প্রায় ৫৬৫০ মিলিয়ন এবং ১.০৪ ও ২.৫০ মিলিয়ন মে টন।

মৎস্য বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অভ্যন্তরীণ জলাশয় উপমহাদেশের একটি সমৃদ্ধতম অঞ্চল। পদ্মা, ব্রক্ষপুত্র, মেঘনা, কর্ণফুলী প্রভৃতি নদ-নদী শাখা -প্রশাখাসহ দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও উৎপাদনক্ষম স্বাদুপানির মৎস্যক্ষেত্র গঠন করেছে। অধিকন্তু অসংখ্য বিল, ঝিল, হাওর, দিঘি ও পুকুর রয়েছে। নিম্নভূমির বিস্তৃত কৃষি জমি বর্ষাকালে মৎস্যবিচরণ ক্ষেত্রে পরিণত হয়। বাংলাদেশে জরিপকৃত গুরুত্বপূর্ণ মৎস্য উৎপাদন এলাকার মধ্যে রয়েছে বঙ্গোপসাগরের ২২৫ কিমি দীর্ঘ উপকূলাঞ্চল  এবং ৪.৫৮ মিলিয়ন হেক্টর এলাকা জুড়ে অন্যান্য জলাশয়। বার্ষিক গড় মৎস্য উৎপাদন প্রায় ২.২২ মিলিয়ন মে টন,এর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত অভ্যন্তরীণ ও সামুদ্রিক মাছ/চিংড়ি। বিদেশে রপ্তানিকৃত বছরে প্রায় ০.০৫ মিলিয়ন মে টন মৎস্যসম্পদের মধ্যে বাগদা চিংড়ি, ইলিশ, কচ্ছপ, কাঁকড়া ইত্যাদি।

বন বাংলাদেশের প্রায় ২.৬০ হেক্টর বনভুমির বিন্যাস নিম্নরূপঃ সংরক্ষিত বন ৬৪.৭৬%, অশ্রেণীকৃত সরকারি বন ২৭.৪১%, দখলকৃত বন ০.৩৩%, খাস বনভুমি ০.৯৩%, সুরক্ষিত বন ১.৪৩% ও অর্পিত বন ০.১৫%। সকল শ্রেণির বন একত্রে দেশের মোট ভূ-ভাগের প্রায় ১৭.৫০ ভাগ। বনভূমির নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা মূলত সরকারেরই দায়িত্ব।

বাড়িঘর, আসবাবপত্র ও সাধারণ নির্মাণ কাজের প্রধান বাণিজ্যিক কাঠসমূহ যোগায় বন। শালবন রেলওয়ে স্লিপার, খুঁটি ইত্যাদি এবং জোয়ারধৌত বনাঞ্চল জ্বালানি কাঠ সরবরাহের প্রধান উৎস। সুন্দরবনের গেওয়া গাছ নিউজপ্রিন্টের প্রধান কাঁচামাল। চন্দ্রঘোনার কাগজ কলে বাঁশ কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহূত হয়। সরকারি বনভূমি বছরে প্রায় ২.৬৭ মিলিয়ন ঘনফুট  কাঠ, ৫৯ মিলিয়ন বাঁশ, ৭ মিলিয়ন ঘনফুট জ্বালানি কাঠ ও ০.৫৫ মিলিয়ন মে টন গোলপাতা উৎপাদন করে। [মোঃ হযরত আলী]